ঊনপঞ্চাশ
‘গুলির মধ্যে ওদিকে দৌড়াতে দেখেছিলাম,’ ঘন একটা ঝোপের দিকে পা বাড়াল সেলেনা। ‘তার পর পড়ে গেল।’
‘দাঁড়াও একটু।’ গিবসনের দ্বিখণ্ডিত মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে আছে রানা। কোনও ধরনের আইডি, কিংবা কারা ওকে পাঠিয়েছে সেই তথ্যের খোঁজে শরীর হাতড়ানোর মানে হয় না। পাওয়া যাবে না ওসব। তবে বেল্ট হোলস্টারে এখনও রয়েছে পিস্তলটা। কেউ যদি বেঁচে গিয়ে থাকে, সে- আশঙ্কায় বিনা অস্ত্রে জঙ্গলে ঢোকার ঝুঁকি নিতে চায় না ও।
হাঁটু গেড়ে বসল রানা কাটা পা জোড়ার পাশে। তার পর ‘পটাস’ শব্দে রক্তরঞ্জিত হোলস্টারের ফ্ল্যাপ খুলে বের করে নিল হ্যাণ্ডগানটা। পয়েন্ট থ্রি এইট সুপার ক্যালিবারের কোল্ট কমব্যাট কমাণ্ডার। পুরোটাই ধাতুর তৈরি, নেই কোনও কাঠ, পলিমার বা সিনথেটিক কিছু। পুরানো স্টাইলের বিশ্বস্ত অস্ত্র, পছন্দ করত লোকটা।
লাশের ট্রাউযারে মুছে নিল পিস্তলটা। উঠতে যাচ্ছে, কিছু যেন লক্ষ করে কুঁচকে গেল ভুরু। কাছে এনে পরীক্ষা করল ও কমাণ্ডারটা।
‘কী হলো, রানা?’ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে সেলেনা।
‘না, কিছু না,’ বলে, উঠে দাঁড়াল রানা। পিস্তলটা হিপ- পকেটে গুঁজে গিবসন যেখানে ওর রাইফেলটা ফেলেছে, হেঁটে চলল সেদিকে। কাছে গিয়ে কুড়িয়ে নিল ওটাও।
সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলল ওরা জঙ্গলের মাঝ দিয়ে, ডাকছে গুস্তাফের নাম ধরে। ভাঙা ঝোপঝাড় দেখে বোঝা যাচ্ছে, জান বাঁচানোর তাগিদে কীভাবে ছুটেছে প্রৌঢ় সাংবাদিক। তবে রক্তের চিহ্ন নেই কোনখানে।
‘বহাল তবিয়তেই থাকে যেন মানুষটা,’ একান্ত প্ৰাৰ্থনা মেয়েটার।
কেবিন থেকে কয়েক শ’ গজ দূরে; মরা এক গাছের ফাঁপা গুঁড়ির মধ্যে পাওয়া গেল গুস্তাফকে। আবার দৌড় দিতে যাচ্ছিল, ওদের চেহারা দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।
কাঁপছে লোকটা ভয়ে। চকের মত সাদা হয়ে রয়েছে চেহারা। এখনও হাঁপাচ্ছে যেন ছুটে আসার কারণে।
‘দ্-দুঃখিত আমি,’ তুতলে গিয়ে বলল। ‘…অন্য দিকে দৌড় দিয়েছি বলে। স্-স্রেফ রুখতে পারিনি নিজেকে—’
‘ঠিক কাজই করেছেন আপনি, মিস্টার ভিকান্দার,’ বলল, সেলেনা সান্ত্বনা দিয়ে। লোকটার হাত ধরে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করল গুঁড়ির ভিতর থেকে। ‘শিয়োর তো, গুলি লাগেনি কোথাও?’
ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়াল গুস্তাফ। ‘না… মানে, একটা গুলিও লাগেনি।’ রানার দিকে গিয়ে দৃষ্টিটা ফিরে এল আবার মেয়েটার উপর। লক্ষ করছে ওদের রক্তাক্ত বেশভূষা। ‘ক্- কীভাবে… ও-ওরা কি….?’
‘সব কয়টা খতম!’ বলল সেলেনা ক্রূর হাসি দিয়ে। ‘এরা ছাড়া যদি আরও কেউ না থেকে থাকে
‘না থাকলে দল পাঠাবে আরেকটা,’ বলে উঠল রানা বেরসিকের মত। ‘অতএব, এখনই কেটে পড়া ভালো এখান থেকে।’
কেবিনের দিকে ফিরে চলেছে ওরা। নিজ বাসস্থানের ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখল সাংবাদিক।
‘আমার কেবিন!’ কেউ যেন গলা টিপে ধরেছে লোকটার।
‘আজকের পর এমনিতেও আর কাজে আসত না এটা,’ নরম গলায় সান্ত্বনা দিল রানা। ‘নতুন আস্তানা দরকার আপনার।’
‘আমি তো ভেবেছিলাম, সঙ্গে থাকছি আপনাদের!’
‘এ ব্যাপারে এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসিনি আমরা। ‘সাহায্যে আসব আমি,’ নিজের গুরুত্ব বোঝাতে চাইছে গুস্তাফ। ‘আরও অনেক কিছুই জানা আছে আমার…
‘এক্ষুণি তা হলে বলে ফেলেন না কেন?’ বাতলাল রানা। ‘রাস্তাতেও অবশ্য করা যায় সেটা।’ হাত পাতল ও। ‘ল্যাণ্ড রোভারের চাবিটা কি আছে এখনও আপনার কাছে?’
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে নড করল লোকটা। চেক করার জন্য হাত ভরল পকেটে। হ্যাঁ, রয়েছে। বের করে এনে রানার তালুতে ফেলল চাবি।
ব্যাগটা কুড়িয়ে নেয়ার জন্য গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল রানা।
দক্ষ হাতে খুলে ফেলল ও এআর-ফিফটিনের ম্যাগাজিন। টেক-ডাউন পিন খুলে খণ্ড খণ্ড করে ফেলল অস্ত্রটা। তার পর ওগুলো ব্যাগে ভরে ব্যাগটা ছুঁড়ে দিল ল্যাণ্ড রোভারের পিছনে।
‘জানতে পারি, কোথায় চলেছি আমরা?’ ব্যাকসিটে উঠে জিজ্ঞেস করল প্রৌঢ়।
‘ল্যাপল্যাণ্ডের বাইরে।’
‘কিন্তু অস্ত্র নিয়ে ট্র্যাভেল করবেন কীভাবে? আটকাবে না?’
‘বর্ডারের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না আমাদের,’ মনে করিয়ে দিল সেলেনা। ‘ভুলে গেছেন, প্লেনে করে এসেছি আমরা?’
ইঞ্জিন চালু করল রানা। খানাখন্দে ভরা জঙ্গলের পথ ধরে বেকায়দাভাবে ঝাঁকি আর দুলুনি খেতে খেতে বধ্যভূমি থেকে বিদায় নিল ওরা।
‘হ্যাঁ… বলুন এবার।’ রিয়ার-ভিউ মিররে গুস্তাফের সঙ্গে চোখাচোখি হলো রানার।
শুরু করল সুইডিশ।
‘বলছিলাম, মারা যাওয়ার আগে কী বলেছিল আমাদের আমেরিকান সাংবাদিক। ঘনিয়ে উঠছে বিশাল কিছু মিলফোর্ড ব্রাউন নাকি গোপন ঘাঁটির বর্ণনা দিয়েছিল লোকটার কাছে। টেসলা টেকনোলজি নিয়ে যাবতীয় গবেষণা আর ডেভেলপমেন্টের কাজ চলছে সেখানে। সবই শুনিয়েছে আমাদের ফ্লেচার লোকটা।’
‘কোথায় ঘাঁটিটা?’ জানতে চাইল রানা।
‘ইন্দোনেশিয়া।’
‘ইন্দোনেশিয়া?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ফুটল সেলেনার চোখে।
মাথা নাড়ল গুস্তাফ। ‘সিআইএ-র অন্যতম পুরানো বেইস ওটা। মধ্য-ষাটের শেষ ভাগে যখন গোপনে দমন করা হচ্ছিল ইন্দোনেশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি পিকেআই-কে, সেই তখন থেকে। প্রায় পাঁচ লাখ লোকের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল তারা। এর পর নতুন ধারার সূত্রপাত হলে মার্কিনিরা বাড়ি ফিরে যায় বলে ধারণা। কিন্তু একটা পা যে তখনও দিয়ে রেখেছে ওখানে, সেটা বোধ হয় না বললেও চলে।’
‘কী ধরনের ঘাঁটি ওটা?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েটা। ‘গবেষণাগার?’
‘বাইরে থেকে দেখলে কাঁটাতারে ঘেরা বিশাল এক ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ফ্যাসিলিটি বলে মনে হবে। কিন্তু এরকম একটা প্রতিষ্ঠানে এত বেশি সশস্ত্র পাহারা থাকবে কেন?’
‘তার মানে, গিয়েছিলেন ওখানে?’ রানার জিজ্ঞাসা।
মাথা ঝাঁকাল গুস্তাফ। ‘ক্যারেনের আইডিয়া ওটা। ওর বিশ্বাস ছিল, রহস্য উন্মোচনের নেক্সট লেভেলে পৌঁছে দেবে যাত্রাটা। ব্যক্তিগতভাবে, অতটা নিশ্চিত ছিলাম না আমি। কিন্তু নানান যুক্তি দেখিয়ে সম্মতি আদায় করেই ছাড়ে মেয়েটা। গেল মে-তে জাকার্তার ফ্লাইট ধরি আমরা। জানতাম, কোনও একটা দ্বীপে রয়েছে ঘাঁটিটা। মিলফোর্ড ব্রাউনের কাছ থেকে পাওয়া কয়েকটা সূত্র দিয়েছিল আমাদের মার্কিন সাংবাদিক।’
‘কী ধরনের সূত্র?’ সেলেনার প্রশ্ন।
‘সবই নোট করে রেখেছিল ক্যারেন। ও-ই নেতৃত্ব দিচ্ছিল বরাবরের মত। আমি ছিলাম স্রেফ হেল্পার হিসেবে। যা-ই হোক… একটা হপ্তা ঘুরে বেড়ালাম দ্বীপে দ্বীপে। খুব সাবধানে খোঁজখবর করতে হচ্ছিল আমাদের। এক পর্যায়ে আশা যখন প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিলাম, তখনই খুঁজে পেলাম ওটা। সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে জায়গাটা, আর্টা বিচের কাছাকাছি।’
কিছু বলছে না রানা। অসমতল জঙ্গুলে পথে কান খোলা রেখে গাড়ি চালাচ্ছে ও।
‘কী মনে হয়,’ জানতে চাইল সেলেনা। ‘খুঁজে বের করতে পারবেন আবার ঘাঁটিটা?’
‘দ্বীপের অনেক ভেতরে ওটা। ছোট ছোট কয়েকটা গ্রাম আর শহুরে এলাকা রয়েছে কাছাকাছির মধ্যে। তবে নিশ্চয়তা দিতে পারি, নিয়ে যেতে পারব ওখানে… ঝুঁকিটা যদি নিতে চান আর কী। যেমনটা বললাম… সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জেলখানার চাইতেও কড়া প্রহরায় মুড়ে রাখা হয়েছে জায়গাটা। কোনই সুযোগ পাইনি আমরা ভেতরে প্রবেশের। তারের বেড়ার এক শ’ গজের মধ্যে যাওয়ার আগেই বেজে ওঠে অ্যালার্ম। এক জিপ ভর্তি সশস্ত্র লোক ছুটে আসে আমাদের গ্রেফতার করার জন্যে। ঊর্ধ্বগতিতে ছুটতে শুরু করি আমরা। ভাগ্যিস, সময়মত পৌঁছুতে পেরেছিলাম গাড়িতে। ধরতে পারলে গুলি করত ওরা। এত্ত ভয় আর পাইনি জিন্দেগিতে… আজকের আগে আর কী!’
‘সেজন্যেই ইন্দোনেশিয়া থেকে ফিরে আসার পর জানিয়ে দিলেন, আর থাকতে চান না মেয়েটার সাথে?’
‘আর কী করতে পারতাম এ ছাড়া? বুঝতে পারছেন না, কতটা বিপজ্জনক এটা? বললাম, সুইডেন ফিরে যাচ্ছি আমি গা ঢাকা দেয়ার মত জায়গা খুঁজে নিয়ে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করব সব কিছু। এটাও বললাম, ওরও তা-ই করা উচিত। যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি, এসব যাতে ছেড়েছুড়ে দেয় মেয়েটা। কাজ হয়নি কোনও। প্যারিস ফিরে গিয়ে নিজের লক্ষ্যে অটল থাকবে বলে মনস্থির করে ও, মুখোশ যাতে খুলে দিতে পারে লোকগুলোর। সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিল ওর সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্যে। কিন্তু ভয়ে তখন কাবু আমি। ফলাফল: বড় ধরনের বচসা হয়ে গেল আমাদের মধ্যে। আমাকে কাপুরুষ বলল ও। আমিও বললাম, ও একটা গাধীর গাধী। পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম মেয়েটাকে বোঝাতে গিয়ে। শেষ পর্যন্ত আর কিছুই করার রইল না। যোগাযোগ বন্ধ করে দিল ও আমার সঙ্গে, চলতে লাগল নিজের মত। আমি চলে এলাম এখানে। যত বারই শহরে যেতাম, ই-মেইল করতাম ওকে। চেষ্টা নিতাম সুপথে ফেরানোর। লাভ হয়নি। যা ভয় করছিলাম, সেটাই ঘটল শেষমেশ।’ হতাশায় মাথা নাড়ল গুস্তাফ। ‘আমারও খোঁজ পেয়ে গেছে ওরা। কোথাও এখন আর নিরাপদ নই আমি।’
রিয়ার-ভিউ আয়নায় মুহূর্তকাল দেখল ওকে রানা। তার পর গিবসনের কাছ থেকে নেয়া কোল্ট পিস্তলটা বের করে চালান করল গুস্তাফের হাতে। ‘রাখতে পারেন এটা। তাতে যদি কিছুটা ভালো বোধ করেন। এখনও কয়েক রাউণ্ড গুলি রয়েছে ম্যাগাজিনে, আর ব্যারেলে রয়েছে একটা গুলি। বিপদের সময় উল্টোপাল্টা দৌড় লাগালে, আমাদের কোনও কাজে আসবেন না আপনি।’
‘নিচ্ছেন তা হলে আমাকে আপনাদের সাথে?’ মুগ্ধ বিস্ময়ে পিস্তলটা উল্টেপাল্টে দেখছে গুস্তাফ। ‘খাইছে! এরকম কিছু ব্যবহার করিনি কোনও দিন।’
‘এমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয় পিস্তল চালানো,’ বলল ওকে রানা। ‘হ্যামার কক করা ওটার, অন করা সেফটি। বুড়ো আঙুলের পাশে ছোট্ট ওই লিভারটাই হচ্ছে সেফটি ক্যাচ। উল্টে দিন—ব্যস, গুলি ছোঁড়ার জন্যে তৈরি।’
শক্ত হাতে পিস্তলটা ধরল গুস্তাফ। গম্ভীরভাবে নড করল আপন মনে। সঙ্কল্পের আভা ছড়িয়ে পড়ল যেন চেহারায়।
‘ঠিকই বলেছিল ক্যারেন বলে উঠল রানার দিকে তাকিয়ে। ‘আস্ত কাপুরুষ আমি! ভুলই করেছি ওকে সঙ্গ না দিয়ে। ভুলটা এখন শোধরাতে চাই আমি। সত্যি বলছি… মরতেও ভয় পাই না এখন আর!’