1 of 2

শকওয়েভ – ৪১

একচল্লিশ

মাত্র পাঁচ মিনিটেই পোস্ট অফিসের ঝামেলা চোকাল গুস্তাফ ভিকান্দার। পোস্টমিস্ট্রেসের স্বামীর সঙ্গে কুশল বিনিময় সেরে, চিঠিপত্র বুঝে নেয়ার জন্য যথেষ্ট সময়।

বেরিয়ে এসে সোজা চলল ল্যাণ্ড রোভারের দিকে। স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে উঠে ড্যাশবোর্ডের উপর রাখা পেপারব্যাগ থেকে আধখাওয়া, পুরু স্যাণ্ডউইচের আরেক কামড় মুখে নিয়ে ছেড়ে দিল গাড়ি।

গ্রামাঞ্চল ছেড়ে উত্তরে চলেছে গুস্তাফ। অপরিসর পথে বার কয়েক বাঁক নিয়ে কাঁকর বিছানো সারফেস ছেড়ে নেমে গেল কাঁচা রাস্তায়।

ঝাঁকি খেতে খেতে খানাখন্দ আর নুড়িপাথর মাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে চারকোনা ল্যাণ্ড রোভার। পিছনে রাখা জেরিক্যানগুলো ধাতব বাজনা বাজাচ্ছে ঠনাৎ-ঠনাৎ।

আধঘণ্টামত গাড়ি চালাল এভাবে গুস্তাফ ভিকান্দার। সভ্যতার সমস্ত চিহ্ন পিছনে ফেলে প্রবেশ করছে ক্রমশ অরণ্যের গভীর থেকে গভীরে। লোকটা নিজে ছাড়া হরিণ, মুস, উলভেরিন আর সোনালি ইগলই কেবল বাস করে এই জঙ্গলে। মাঝে-সাঝে দেখা দেয় বাদামি ভালুক।

অন্য যে-কোনও গাড়ির জন্য শেষ কয়েক মাইল দুরতিক্রম্য হলেও, নিষ্ঠার সঙ্গে তা পেরিয়ে এল লো-রেশিয়ো গিয়ার আর ডিফারেনশিয়াল লকসমৃদ্ধ অফ-রোড বাহন।

এক সময় গাছপালার শামিয়ানার নিচ দিয়ে দৃষ্টিগোচর হলো গুস্তাফ ভিকান্দারের গুপ্ত নিবাস। ভারি টায়ারের গভীর, এবড়োখেবড়ো দাগে ভরা পথটা শেষ হয়ে গেল ন্যাড়া উঠনে এসে।

ল্যাণ্ড রোভারের ইঞ্জিন বন্ধ করল টাকমাথা। লাফ দিয়ে নেমে সশব্দে লাগাল গাড়ির দরজা। তার পর এক হাতে চিঠির গাদা এবং অপর হাতে অর্ধভুক্ত স্যাণ্ডউইচটা নিয়ে কদম চালাল কেবিন অভিমুখে।

হাঁটতে হাঁটতেই কয়েক কামড়ে খাবারটা সাবাড় করে নিয়ে টোকা দিয়ে ফেলে দিল কাগজের মোড়ক। ততক্ষণে পৌঁছে গেছে লগ-কেবিনের দরজায়। চাবি দিয়ে তালা খুলে অদৃশ্য হলো বাড়ির ভিতর।

‘কী অবস্থা তোমার?’ ল্যাণ্ড রোভারের পিছন থেকে বলে উঠল রানা। ঠেলে সরাল গায়ের উপর টেনে দেয়া হলুদ তারপুলিনটা।

‘আর বোলো না!’ দুই হাতে ঘাড় ডলছে সেলেনা। ‘সারা জীবনের জন্যে মনে হয় টুলবক্সের গুঁতোর দাগ বসে গেল চামড়ায়।’ লাল চুলগুলো এলোমেলো হয়ে এসে পড়েছে মুখের উপর।

বাল্কহেডের সঙ্গে বেঁধে রাখা স্পেয়ার চাকার পিছনে ঘাড় গোঁজা অবস্থা থেকে বেরিয়ে এল রানা ক্রল করে। স্বচ্ছন্দে খুলল রিয়ার হ্যাচ। ঠনঠনে ধাতব ফ্লোরে চরম অস্বস্তিকর ছিল যাত্রাটা।

একটা গাছের জন্য আংশিক আড়ালে পড়ে গেছে কেবিনের জানালা। একই কারণে আড়াল পেল ওরা গাড়ি থেকে নামার সময়।

গাছের আড়াল নিয়ে ব্যাগটা খুলল রানা। বেরেটা সাব- মেশিন গানটা তুলে দিল সেলেনার হাতে। ‘কেবিনের সামনেটা কাভার দিতে হবে তোমাকে। আমি যাচ্ছি পিছন দিয়ে। ভিজিটর দেখে খুশি হওয়ার কথা নয় টাকলা মিয়ার। পালানোর চেষ্টা করতে পারে।’

শুঁয়োপোকা দেখছে যেন, এমনিভাবে অস্ত্রটার দিকে আড়দৃষ্টিতে চাইল সেলেনা। ‘বন্দুক তাক করব আমি লোকটার দিকে?’

‘ট্রিগার না টিপলেই হলো।’

‘কেন, গুলি ভরা নাকি?’ সাব-মেশিন গানটা সাবধানে নাড়াচাড়া করছে ও।

‘নইলে কি আর কাজে আসবে এটা? গুস্তাফ ব্যাটা দৌড় দিলে থামাতে হবে তোমাকে। অস্ত্র তাক করে ভঙ্গি করবে গুলি করার। কীভাবে কী করতে হয়, জানা আছে তোমার দরকার মনে করলে শুটও করবে- পায়ের দিকে। খেয়াল রাখবে শুধু, মাথাটা যাতে উড়ে না যায়।’

‘ইয়েস, স্যর,’ বলল সেলেনা অস্পষ্ট স্বরে। ‘চেষ্টা করব মনে রাখার।’

না-হাঁটা, না-দৌড়ানো গতিতে ছুটল রানা গাছ থেকে গাছের কাভার নিয়ে। কাঠের বাড়িটার পিছনদিকে পৌছে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখল জানালায়, সামান্যতম আওয়াজের আশায় উৎকর্ণ। মনেপ্রাণে কামনা করছে, কুকুরের ঘেউ ঘেউ যাতে ভেসে না আসে ভিতর থেকে।

ঘটল না তেমন কিছু। শুধুই নীরবতা। কিছু নড়ছে না কোথাও। কেউই লক্ষ করেনি ওর গতিবিধি।

লাকড়ি জমা করা ছোট এক ছাউনি বাড়ির পিছনটায়। ফ্ল্যাট টায়ারের উপর পেট্রোল-চালিত ইয়াব্বড় এক করাত রাখা। পাশেই একখানা কুড়াল গাঁথা রয়েছে কাটা গাছের গুঁড়িতে।

তক্তা দিয়ে ঘেরা কাঠের ভিতের উপর তোলা হয়েছে কেবিনটা। দুর্বল দেখতে চারখানা সিঁড়ির ধাপ চলে গেছে পিছন-দরজা অবধি।

সন্তর্পণে শুরুর ধাপে নিজের ভর চাপাল রানা। এর পর এক ধাপ বাদ দিয়ে পা রাখল তৃতীয় ধাপে। কোনও রকম আওয়াজ ছাড়াই ওজন নিল সিঁড়ি।

দরজা খুলতে গিয়ে দেখল— বন্ধ। খোলা পাবে, আশাও করেনি যদিও।

ওয়ালেট থেকে এক টুকরো তার বের করে ঢুকিয়ে দিল নবের ফুটোয়। আওয়াজ যাতে না ওঠে, সে-ব্যাপারে সতর্ক। কলকবজার জায়গামত তারটা প্রবেশ করেছে, বুঝে বার কয়েক মোচড় দিতেই খুলে গেল লক।

ভাগ্য ভালো, ভিতর থেকে খিল দেয়া নেই দরজায়। সাবধানী পায়ে প্রবেশ করল রানা পিছনের ছোট হলওয়েতে।

যেন-তেনভাবে বানানো হয়েছে কেবিনটা। খরখরে তক্তাগুলো চেরা হয়েছে কোনও রকমে। বহু-ব্যবহৃত এক জোড়া প্যারাফিন ল্যান্টার্নের সঙ্গে সারি সারি টিন ভর্তি রসদ রাখা তাক দেখতে পেল অনেকগুলো। বাড়তি এক জোড়া প্রোপেন গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা দেয়ালের ধার ঘেঁষে। ছোট এক কুঠার আর ছোট করে ফাড়া লাকড়ি বোঝাই কার্ডবোর্ডের বাক্সও চোখে পড়ল ওর। সভ্য জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার আয়োজন এসব। বাইরে পরার ভারি কিছু কাপড়চোপড় ঝুলছে একটা পেরেক থেকে।

দুটো অভ্যন্তরীণ দরজা কেবিনে। সামান্য ফাঁক হয়ে রয়েছে ডানেরটা। পাইন টেবিল আর একটা মাত্র চেয়ার নিরে কিচেন ওটা।

বাঁধের দরজাটা বন্ধ। আলতো ঠেলা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল রানা। তক্তার দেয়ালগুলো L-শেপের সরু এক প্যাসেজ দাঁড়িয়ে ও, মেইন রুমের দিকে চলে গেছে প্যাসেজাটা।

ছোটখাটো, সাধারণ মূল কামরাটা চৌকোনা। কতগুলো চেয়ার রাখা হয়েছে বার্নিশ ছাড়া ফ্লোরবোর্ডে বিছানো সাদামাটা এক কম্বল ঘিরে। কাস্ট আয়ার্নের উড বার্নার শোভা পাচ্ছে এক কোণে।

টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে একখানা খাম খুলছে টাকমাথা গুস্তাফ। ভিতরের চিঠিটা পড়তে দেখল ওকে রানা, নড়ছে ঠোঁট জোড়া; ওটা রেখে তুলে নিল আরেকখানা।

‘মিস্টার ভিকান্দার!’ ডাকল রানা দরজা থেকে।

গুস্তাফ ভিকান্দারের হাত থেকে পড়ে গেল চিঠি। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়িয়েই জমে গেল বরফের মত। মুখটা হাঁ। পলক পড়ছে না চোখের।

‘ভয় পাবেন না। খালি হাত দেখিয়ে নিজেকে নিরস্ত্র প্রমাণ করল রানা। ‘স্রেফ ক’টা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।’

কাজ হলো না তাতে। ওর ধারণার চেয়েও দ্রুত গতিতে সক্রিয় হলো ভিকান্দার। ভারি বুটের অ্যায়সা এক লাথি হাঁকাল যে, ধাম করে বন্ধ হলো পাল্লা রানার মুখের উপর।

পিছিয়ে যেতে হয়েছিল, অভিসম্পাত দিয়ে আগে বাড়ল আবার রানা। দরজার গায়ে ঠেলা মারতেই শটগানের ব্যারেলের মুখে আবিষ্কার করল নিজেকে। হাতের কাছেই ছিল বোধ হয় অস্ত্রটা। টুয়েলভ-গজ স্ট্যাণ্ডার্ড মসবার্গ। পাঁচ রাউণ্ডের টিউব ম্যাগাজিন। কুচকুচে কালো বাট, কালো শিং।

কান ফাটানো আওয়াজে গর্জে ওঠার আধসেকেণ্ড আগে সরে যেতে পারল ও দরজা থেকে। অসমান কিনারাঅলা বিশাল এক ফোকর সৃষ্টি হলো পিছন-দেয়ালে। কাঠের কুচি ছিটকে গেল চারদিকে।

ধূমায়মান শেলের কেসিং খসিয়ে ফেলল লোকটা পাম্পে টান দিয়ে। চেম্বারে আরেকটা কার্তুজ নিয়ে আসতে আসতে পিছিয়ে যাচ্ছে সদর দরজার দিকে। ঝটকা দিয়ে দরজাটা খুলেই বেরিয়ে পড়ল বাইরে। লম্বা এক লাফে সিঁড়ি পার হয়ে আঙিনায় নেমেই দৌড় শুরু করল উন্মত্তের মত। টার্গেট: ল্যাণ্ড রোভার।

দৌড়ের মাঝেই থেমে যেতে হলো হুমড়ি খেয়ে। বেরেটা হাতে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে এক তরুণী । ভিকান্দারের বুক বরাবর তাক করা অস্ত্রটা। হাবভাবে ফুটে বেরোচ্ছে হুমকি।

পরের সেকেণ্ডেই রানার নাইনএমএমের মাযল ঠেকল লোকটার পিঠে।

পাম্পগানটা কেড়ে নিল ও সুইডিশটার হাত থেকে। ‘এটার আর দরকার হবে না আপনার।‘

হাল ছেড়ে দিয়েছে ভিকান্দার। বাধা দিল না একটুও!

শেলগুলো বের করে নিল রানা। পাখি শিকারের কার্তুজ ওগুলো। এদিকের লোকেরা কাক-টাক মারে এ জিনিস দিয়ে। খুব ক্লোজ রেঞ্জে না পেলে কাজে আসবে না হিউম্যান টার্গেটের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায়।

কার্তুজগুলো পকেটে ফেলে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল রানা শটগানটা।

ধীরে ধীরে সাব-মেশিন গান নিচু করল সেলেনা। আপাতত নির্বিষ মনে হচ্ছে টাকমাথা লোকটাকে।

জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সুইডিশ। বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে কেশহীন চাঁদিতে। মড়ার মত রক্তশূন্য হয়ে গেছে লালচে চেহারাটা।

‘গুলি করবেন না তো?’ জিজ্ঞেস করল ভয়ে ভয়ে। প্রচুর দেশবিদেশ ঘোরা মানুষের মত আঞ্চলিক টানের মার্কিনি উচ্চারণ।

‘আগেই বলেছি, আপনাকে মারার জন্যে আসিনি আমরা,’ বলল রানা নরম গলায়। ‘ভিতরে চলুন, মিস্টার তিকান্দার। অনেক আলাপ রয়েছে আপনার সাথে।

করডাইটের কড়া গন্ধ ভুরভুর করছে লগ-হাউসে। নিতান্ত অনিচ্ছাতেই যেন ওদের সঙ্গে মেইন রুমে এল গুস্তাফ। মনে হচ্ছে, জোর পাচ্ছে না হাঁটুতে। যে-কোনও মুহূর্তে পড়ে যাবে হাঁটু ভেঙে।

‘শান্ত হয়ে বসুন এখানটায়,’ বলল রানা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে।

ওর দেখানো চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল লোকটা।

‘কোন্ চুলো থেকে এসেছেন আপনারা?’ ফেটে পড়ল পরক্ষণে। ‘আমার বাড়িতে এসে আমাকেই এভাবে নাজেহাল করছেন!’

‘আপনার এক বন্ধুর বন্ধু আমরা,’ বলল রানা। ‘আমার নাম মাসুদ রানা। আর ইনি হচ্ছেন ডক্টর সেলেনা বার্নহার্ট।’

‘ক্যারেন ল্যানকাউমে,’ বন্ধুর নাম বলে দিল মেয়েটা।

‘ক্যারেন?’ চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে উঠল গুস্তাফের। ‘আ-আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না! কী ব্যাপার, বলুন তো!’

‘আপনাকে আর আমাকে চিঠি দিয়েছিল ও। একই চিঠি পেয়েছি আমরা দিন কয়েক আগে।’

ফ্যালফ্যাল করে সেলেনার দিকে তাকিয়ে আছে টাকু ভিকান্দার। ‘আমি তো কোনও… নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে আপনাদের!’

‘চেক করুন চিঠিগুলো।’ বিষয়টা ধরতে পারছে রানা। গুস্তাফ ভিকান্দার যদি হপ্তায় একবার করে দর্শন দেয় পোস্ট অফিসে, ক্যারেনের চিঠিটা হয়তো ওখানেই পড়ে ছিল সপ্তাহভর।

অনিশ্চিতভাবে মাথা দোলাল গুস্তাফ। উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল টেবিলের কাছে। কয়েক মুহূর্ত খামগুলো নাড়াচাড়া করে ঘাড় নাড়ল নেতিবাচকভাবে। পরক্ষণে চোখে পড়ল না-খোলা এনভেলপটা, রানার উপস্থিতিতে চমকে গিয়ে ফেলে দিয়েছিল যেটা। নিচু হলো মেঝে থেকে তুলে নেয়ার জন্য।

‘ক্যারেনের হাতের লেখা…’ কেমন জানি হয়ে গেল চেহারাটা। হঠাৎই রাজ্যের উদ্বেগ ভর করেছে মনে।

‘খুলুন ওটা,’ বলল সেলেনা অনুরোধের সুরে।

কাঁপা কাঁপা হাতে খামের মুখ ছিঁড়ল গুস্তাফ। চিঠিটা বের করে নিয়ে পড়তে শুরু করল তক্ষুণি।

পাশ থেকে চোখ বোলানোর জন্য কাছাকাছি হলো সেলেনা। এক নজরের বেশি দেখার দরকার হলো না।

‘একই চিঠি… আমারটার মতই,’ বলল ও।

‘আগেই সাবধান করেছিলাম ওকে!’ দীর্ঘশ্বাস চাপল গুস্তাফ। মৃদু কাঁপছে কাগজটা। চোখ তুলে চেয়ে যোগ করল, ‘এখানে কেন এসেছেন আপনারা? ও নিজে এল না কেন? খারাপ কিছু ঘটেছে, তা-ই না? কী হয়েছে, বলুন আমাকে!’

‘তার আগে বসুন আপনি,’ ভূমিকা করল রানা। ‘ঠিকই ধরেছেন, ভালো খবর নিয়ে আসিনি আমরা।’

আগের চেয়ারটাতেই বসল আবার লোকটা। শক্ত করে ধরে রেখেছে চিঠির কাগজটা।

‘সরাসরিই বলছি আপনাকে।’ সেলেনাই নিল দুঃসংবাদ দেয়ার দায়িত্ব। ‘আমাদেরকে চিঠি লেখাই ছিল ওর বাঁচবার শেষ চেষ্টা। প্যারিসে, ওর অ্যাপার্টমেন্টেই ঘটেছে ঘটনাটা।’

চোয়াল ঝুলে পড়ল গুস্তাফের। খবর হজম করার চেষ্টায় শক্ত করে বুজে ফেলল চোখ জোড়া। অভিব্যক্তি বলছে: না, ডক্টর বার্নহার্ট, এ হতে পারে না! কথাগুলো ফিরিয়ে নিন আপনি! এভাবে মরতে পারে না ক্যারেন! সামনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে গিয়ে দুই হাতে চেপে ধরল মাথাটা। ‘ওহ, যিশু! অসুস্থ হয়ে পড়ছি আমি!’

টলোমলো ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। খটাস করে একটা শব্দ হলো দরজা খোলার। পরক্ষণেই ভেসে এল বমি ওগরানোর গা গোলানো আওয়াজ। টয়লেট ফ্ল্যাশ করার শব্দটা এল কিছুক্ষণ পর।

ফিরে এল লোকটা। ভয়ঙ্কর নিস্তেজ দেখাচ্ছে তাকে। প্রাণশক্তি সব হারিয়ে ফেলেছে যেন। ছাইয়ের মত হয়ে গেছে মুখটা। ধপ্ করে আবার বসল চেয়ারে।

গুস্তাফ ভিকান্দারের কাঁধে হাত রাখল সেলেনা। ‘দুঃখিত এভাবে খবরটা দেয়ার জন্যে। খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন আপনারা, তা-ই না?’

‘সাবধানে থাকতে বলেছিলাম ওকে!’ অক্সিজেনের অভাব বোধ করছে যেন গুস্তাফ। ‘বারণ করেছিলাম ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে!’

‘হ্যাঁ, দেখেছি আমরা ই-মেইলগুলো,’ রানা বলল। সেজন্যেই আপনার কাছে আসা। ব্যাপারটা কী নিয়ে, বলবেন? কী বোঝাচ্ছেন ওসব বলতে?’

কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না গুস্তাফ। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে শ্বাস ফেলতে লাগল ফোঁস ফোঁস করে।

‘ধাক্কাটা সামলাতে পারছি না এখনও! ড্রিঙ্ক না হলে মনে হচ্ছে পারবও না! ভোদকা রয়েছে কিচেনে। খানিকটা এনে দিতে পারবেন প্লিজ?’

‘খানিকটা করে মনে হয় আমাদের সবারই দরকার, প্রস্তাব সেলেনার।

প্যাসেজে ছড়িয়ে থাকা কাঠকুচি মাড়িয়ে আনতে চলে গেল রানা। খানিক বাদে ফিরে এল ভোদকার বোতল আর তিনটে গেলাস নিয়ে। টেবিলের উপর বিসদৃশ গ্লাসগুলো রেখে, সবচেয়ে বড়টা ভরে দিল গুস্তাফকে।

কুঁজো হয়ে থাকা অবস্থাতেই ঢক ঢক করে মদটুকু শেষ করে ফেলল লোকটা।

‘ক্-কীভাবে… কীভাবে ও…?’ জানতে চাইল ধরা গলায়। ছলছল করছে চোখ দুটো।

‘বিস্তারিত না শুনলেই ভালো করবেন,’ উপদেশ দিল সেলেনা। ‘পুলিসের ধারণা, বিকৃতমস্তিষ্ক কোনও সিরিয়াল কিলারের কাজ ওটা। আমরা ওদের সঙ্গে একমত নই।’

কেঁপে উঠল দু’হাতে ধরা গুস্তাফের খালি গেলাসটা। গভীরভাবে বার কয়েক দম নিল লোকটা।

‘সিরিয়াল কিলার… হুঁহ!’ ক্ষোভ ওগরাল আচমকা। ‘মাদার… ওই জানোয়ারগুলোর কাজ এটা! উফ… ক্যারেন!’ চোখ বন্ধ করল সুইডিশ। খোলার পর যোগ করল, ‘ভেবেছিলাম, ওদেরই লোক আপনারা, খুন করতে এসেছেন আমাকে। সেজন্যেই গুলি করেছিলাম।’

‘সে আর বলতে!’ হাসল রানা। ‘ক্ষমা চাইছি ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্যে। আসলে ভেবেছিলাম, সরাসরি দেখা করতে চাইলে হয়তো মুখ খুলবেন না আপনি।’

অবসন্ন ভঙ্গিতে শ্রাগ করল গুস্তাফ। ‘বিশ্বাস করবেন, আজকের আগে গুলি করিনি কখনও? সব সময়ই মনে হতো, কোনও একদিন ঠিকই আমার হদিস বের করে ফেলবে ওরা।’

‘ভুল কিছু ভাবেননি। মোটামুটি সহজেই খুঁজে পাওয়া গেছে আপনাকে।’

‘কাদের ভয় পাচ্ছিলেন আপনি, মিস্টার ভিকান্দার?’ কোমল গলায় জানতে চাইল মেয়েটা। ‘পরিচয়টা কী ওদের? দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভিকান্দার। ঘাম গড়াচ্ছে কপাল বেয়ে। ‘বুঝতে পারছি, কী পরিমাণ আপসেট হয়ে পড়েছেন। কিন্তু কথাগুলো জানা দরকার আমাদের। এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই ক্যারেনের মৃত্যুর কারণ জানার।’

‘আমাদেরও পিছু নিয়েছে ওরা,’ কথা জোগাল রানা। ‘দয়া করে সাহায্য করুন আমাদের। কারা এরা?’

সে এক বিরাট ইতিহাস…’

‘বলুন, সমস্যা নেই। বহু দূর থেকে এসেছি আমরা শোনার জন্যেই।’

‘হ্যাঁ, বলছি। বসুন আপনারা। সব কথাই বলব আমি আপনাদের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *