চুয়াল্লিশ
‘এনার্জির পরিভাষায়, রিখটার স্কেলে নয় দশমিক পাঁচের বেশি শক্তিসম্পন্ন ছিল ভূমিকম্পটা,’ ব্যাখ্যা করছে গুস্তাফ। ‘ক্ষমতায় তিন গিগাটন টিএনটির কাছাকাছি। উনিশ শ’ আট সালে টুঙ্গুসকাতে যে-ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটাকেও ছাড়িয়ে গেছে বহু গুণে। এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় থার্মোনিউক্লিয়ার ডিভাইস যে-বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, সেটার মাত্রা পৌঁছেছে মাত্র পঞ্চাশ মেগাটনে। মঙ্গোলিয়ার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করলে টারাকার ভূমিকম্পটাকে ঢিল ছোঁড়ার ফলে পুকুরের পানিতে ওঠা তরঙ্গ বলা যায়।’
‘কী বলতে চাইছেন?’ ভ্রু কুঁচকে গেছে সেলেনার। ‘ধীরে ধীরে শক্তি বাড়াচ্ছে ওরা?’
নড করল সাংবাদিক।
‘এমনই বিচিত্র আর কাকতালীয় যে আলতাই পর্বতের ধ্বংসযজ্ঞ, ‘অপ্রাকৃতিক’ ছাড়া অন্য কিছু ভাবার উপায়ই নেই। যদিও মনে হয় প্রাকৃতিক। একটু একটু করে ভলিউম বাড়াচ্ছে ওরা, পরীক্ষা করছে প্রযুক্তিটার সক্ষমতার দৌড়। আমার বিশ্বাস, এখন পর্যন্ত যা যা দেখেছি আমরা, স্রেফ রিহার্সাল ওগুলো।’
আরও গভীর হলো মেয়েটার ভ্রুর ভাঁজ। ‘কীসের রিহার্সাল?’
দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে শ্রাগ করল গুস্তাফ। ‘বলতে পারব না। ক্যারেনেরও জানা ছিল না। তবে আমার ধারণা, মিলফোর্ড ব্রাউন জানত সম্ভবত।’
‘কে এই লোক?’
‘আমাদের সূত্র অনুসারে, সিআইএ অপারেটিভ ছিল এই ব্রাউন। এ ছাড়া ক্লাসিফায়েড কোনও এজেন্সিও দলে টেনে নিয়েছিল ওকে, সন্দেহ করি; সরাসরি যারা এসবের নেপথ্যে রয়েছে কিংবা নেই। আমার যা মনে হয়… একটু বেশিই জেনে ফেলেছিল লোকটা, ডেক্সটার ফ্লেচার নামে সত্যসন্ধানী এক মার্কিন সাংবাদিকের কাছে খানিকটা প্রকাশ করে গুমর। গত সেপ্টেম্বরে আমি আর ক্যারেন যখন ফ্লেচারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি ফ্রাঙ্কফুর্টের ‘ফ্রি আর্থ’ সিম্পোজিয়ামে, বেশি কিছু বলেনি আমাদের লোকটা। খালি বলেছে, বিশাল কিছু একটা ঘনিয়ে আসছে। আতঙ্কিত মনে হয়েছিল তাকে। বার বার তাকাচ্ছিল কাঁধের উপর দিয়ে।’
‘বিশাল কিছু কী রকম?’
‘বলতে পারব না। ‘ডুডে’ বলে গোপন কোনও প্রজেক্টের প্রসঙ্গ তুলেছিল লোকটা। অচিরেই দুনিয়ার সামনে গুমর ফাঁসের পরিকল্পনা করছে ও আর ব্রাউন, এটা ছাড়া অবশ্য বলেনি আর কিছু। সর্বকালের সবচেয়ে … কী বলে… আলোচিত ঘটনা নাকি হতে যাচ্ছিল
যাচ্ছিল ওটা। ছিল বললাম—কারণ, ওটা আর ঘটবে না কখনও। আলাপের দিন কয়েক বাদেই শুনি, ক্যালিফোরনিয়াতে—যেখানকার বাসিন্দা লোকটা—একটা ট্রাক পিষে দিয়েছে ওর গাড়ি। সঙ্গে ভিতরে থাকা ফ্লেচারকেও। স্পটডেড। একই সময়ে, ম্যালিবুর কাছে মাছ ধরতে গিয়ে ‘দুর্ঘটনাক্রমে’ ডুবে মরল ব্রাউন। কাকতাল? আমাদের তা মনে হয়নি।’
‘তার মানে,’ মুখ খুলল রানা। ‘আমরা আর জানতে পারছি না, প্রজেক্ট ডুমডেটা আসলে কী জিনিস!’
‘উঁহুঁ… উপায় রাখেনি কোনও। ফ্লেচার আর ব্রাউনের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকেই আতঙ্ক পেয়ে বসল আমাকে। ক্যারেন আর আমি সরাসরি দেখা করেছি সাংবাদিকের সঙ্গে, আলাপ করেছি পাবলিক প্লেসে। কে বলতে পারে, নজর রাখা হয়নি আমাদের উপর? মেয়েটাকে বলেছিলাম, অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা; আমাদের উচিত এসব ছেড়েছুড়ে পিছিয়ে আসা। খুব বেশি গভীরে ডুব দিলে পথ থাকবে না ভেসে ওঠার। কিন্তু ও কানই দিল না আমার কথায়।’
‘নিজের মর্জিমাফিক চলত আমার বান্ধবী,’ আফসোস করল সেলেনা। ‘একবার কিছু মাথায় ঢুকেছে তো, ওকে আর নড়ানো যাবে না ওখান থেকে।’
রানার ইচ্ছা হলো, বলে: ‘তুমিও তা-ই। ‘
জানালায় একটা নড়াচড়া দৃষ্টি কেড়ে নিল ওর। তাকিয়ে দেখল, আরও পাখি এসে যোগ দিয়েছে ছোট্ট ঝাঁকটার সঙ্গে। লোভীর মত ভিড় করেছে ওরা খাবারের চারপাশে। চঞ্চুর ঘায়ে ছিটকে যাচ্ছে হ্যাম আর রুটির টুকরো।
‘আরও জোর করা উচিত ছিল ওকে।’ কাঁধ জোড়া কাঁপছে গুস্তাফের। নাক টানল ফোঁত করে। ‘জোর খাটানো উচিত ছিল আরও! আমারই দোষে মরতে হলো মেয়েটাকে। আর এখন…’ দু’চোখে ভীতি নিয়ে চাইল সে রানা-সেলেনার মুখের দিকে। ‘আসবে ওরা আমাকে খতম করতে! হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি আমি! এত দিন নিরাপদেই ছিলাম। এখন আর পালাব কোথায়? বেরোতে গেলেই ধরা পড়তে হবে ওদের চোখে।’
লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সেলেনা। সহানুভূতির হাত রাখল কাঁধে। ‘সুইডেন থেকে বের করে নিয়ে যাব আপনাকে। কিচ্ছু টের পাবে না কেউ। কী বলো, রানা?’ সমর্থনের আশায় চাইল ও এমআরনাইনের দিকে।
‘পারবেন?’ খানিকটা উজ্জ্বল হলো যেন গুস্তাফের চেহারা। ‘কীভাবে করবেন সেটা?’
‘উড়ে বেরিয়ে যাব ওদের নাকের ডগা দিয়ে,’ বলল সেলেনা গর্ব করে। ‘প্লেন আছে আমাদের।
‘প্লেন! কোথায়?’
‘এয়ারস্ট্রিপে। অল্প কয়েক ঘণ্টা লাগবে আপনার ল্যাণ্ড রোভারে করে ওখানে পৌঁছুতে।’
‘যে-কোনও মুহূর্তে তৈরি আমি,’ জানিয়ে দিল গুস্তাফ।
‘কী বলো তুমি? …রানা!
‘দুটো প্রশ্ন আছে আমার,’ রানার উত্তর। ‘এক, কোথায় নিয়ে রাখা যায় এঁকে? দুই, নিজেরা এর পর কোথায় যাচ্ছি আমরা? আমার তো মনে হচ্ছে, পৌঁছে গেছি কানাগলির শেষ মাথায়।
‘না বোধ হয়।’ কী যেন ভাবছে গুস্তাফ। ‘সব কথা বলিনি আপনাদের।’
কিন্তু এরই মধ্যে শোনার আগ্রহ হারিয়েছে রানা। আরেকটা নড়াচড়া মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে ওর। পাখির দল ছত্রখান হয়ে গেছে আচমকা, ছিটকে উড়ে উঠে লুকিয়ে গেল গাছের নিরাপদ আশ্রয়ে।
লাফ দিয়ে সিধে হয়ে দ্রুত পায়ে জানালায় চলে গেল মাসুদ রানা।
‘কী হলো, রানা?’ রানার ভাবভঙ্গি দেখে চোখ জোড়া বিস্ফারিত হলো সেলেনার।
তীক্ষ্ণ চোখে গাছগুলো নিরীখ করছে রানা। না, নড়ছে না কিছু। নিথর হয়ে আছে অরণ্য। যেমনটা হওয়া উচিত।
হয়তো সামান্য বাতাসেই ভয় পেয়ে উড়ে গেছে সদাসতর্ক পাখিগুলো। কিংবা হয়তো আগুয়ান কোনও শিকারি প্রাণী… শেয়াল অথবা যে-কোনও কিছুই হতে পারে ওদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ।
কিন্তু তার পরও…
রানার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন জানান দিতে চায় কিছু।
‘রানা!’ নিদারুণ উদ্বেগ ঝরছে সেলেনার কণ্ঠে। ‘কিছু কি দেখেছ তুমি?’
‘না। তবে টের পাচ্ছি…
‘কী?’
‘কেউ রয়েছে বাইরে…’