1 of 2

শকওয়েভ – ৩৪

চৌত্রিশ

‘কোথায় কেটেছে, দেখি!’ সেলেনার কণ্ঠে উদ্বেগ।

শাখা-রাস্তা দিয়ে যতখানি সম্ভব, দ্রুত ছোটাচ্ছে রানা ছোট্ট গাড়িটাকে। যত দূর সম্ভব, সরে যেতে চায় গোলমাল থেকে।

টিসু বের করল সেলেনা পকেট থেকে। তালু নয়, হেয়ারলাইনের ঠিক নিচেই হয়েছে ক্ষতটা। রক্তটুকু মুছে ফেলল যত্নের সঙ্গে।

‘যতখানি বাজে দেখাচ্ছে, ততটা না বোধ হয়,’ মন্তব্য করল।

‘পরে দেখব, কতটুকু কী হয়েছে।’ একটা গর্তে পড়ল রানা ডায়ানটাকে নিয়ে। দুর্বল সাসপেনশনের উপর বিপজ্জনক ভঙ্গিতে কাত হয়ে গেল গাড়ি।

পেডাল চেপে ধরল ও কমজোরি ইঞ্জিন থেকে শক্তি নিংড়ে নেয়ার জন্য। কিছুই ঘটল না একটা সেকেণ্ড। তার পরই কেশে উঠে আপত্তি জানাল সিত্রোঁ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপরে উঠছে যেন ইঞ্জিন-মিটারের কাঁটা। ফাস কেলাস … দৌড়ের চেয়ে সামান্য বেশি গতি ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার নেই এই মুড়ির টিনের কাছ থেকে।

একটু পর পরই রিয়ার-ভিউ মিররে দৃষ্টি দিচ্ছে রানা। নিশ্চিত হতে চায়, আরও কেউ পিছে লেগেছে কি না।

না, আশঙ্কাটা অমূলক। এবারকার মত নিশ্চিন্ত ওরা।

মাইল কয়েক পেরিয়ে আসার পর গাড়ির গতি কমিয়ে আনল রানা। দুর্জনদের এড়াতে গিয়ে আইনের লোকের নজরে পড়ার মানে নেই কোনও। আরেকটা বাঁক এগিয়ে আসতে দেখে জান খারাপ করে ছাড়ল গিয়ারবক্সের।

এক শ’ একটা দোষত্রুটি সত্ত্বেও, প্যারিস শহর থেকে বের করে আনতে সক্ষম হলো ওদের ফাস কেলাস সিত্রোঁ। রংচঙের কারণে। জনসাধারণের দৃষ্টি এড়ানো সহজ হলো না বটে, তবে অবাঞ্ছিত কোনও চরিত্র ছিল না এদের মধ্যে।

এনথার্টিন রুট ধরে উত্তর-পশ্চিমে যেভাবে গাড়িটাকে ছুটিয়েছে রানা, বিগড়ে যে যায়নি, এ-ই অনেক। ইঞ্জিনের একটানা গর্জনের মাঝে কথাবার্তা চালানো খুবই দুষ্কর। উপায়ান্তর না দেখে জানালায় মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সেলেনা।

ঘণ্টা কয় চলার পর ফিউল নেয়ার জন্য থামতে হলো এক মোটরওয়ে সার্ভিস স্টেশনে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া গেল সেখানে। শুকিয়ে আসা রক্ত ধুয়ে ফেলল রানা। ময়লা টি-শার্টটা পাল্টে পরে নিল সদ্য পাট ভাঙা নতুন আরেকটা। এই একটাই স্পেয়ার ছিল ওর ব্যাগে।

কমপ্লেক্সের ভিতরের এক দোকান থেকে প্রি-প্যাক্‌ড্ বার্গার আর পানির বোতল কিনে নিল ওরা। গাড়িতে বসেই লাঞ্চ সারল তড়িঘড়ি।

খাওয়াদাওয়ার পর পে-ফোন খুঁজতে লাগল রানা চলতে চলতে। আবার ধরা পড়ার আশঙ্কায় একা ছাড়তে চাইছে না সেলেনাকে।

ব্যস্ত লোকেদের জন্য সুবিধার নয় বলে মোবাইলের এই যুগে চাট্টিখানি কথা নয় পাবলিক ফোনের হদিস পাওয়া। এদিকে মোবাইলের অসুবিধা হলো, প্রতিটা গতিবিধি ট্র্যাক করা যায় এর মাধ্যমে।

‘এটাও গ্লোবাল কন্সপিরেসির অংশ, রানা,’ বলল সেলেনা গম্ভীর, ভারি স্বরে। ‘কে, কখন, কোথায়, কী করছে; ঠিক ঠিক জানা চাই ওদের। কয়েন-অপারেটেড ফোনগুলোই বোধ হয় টেলিকমিউনিকেশনে প্রাইভেসির প্রশ্নে শেষ ভরসা। তবে এগুলোও যে থাকছে না বেশি দিন, সেটাও চোখ বুজে বলে দেয়া যায়।’

দুটো সার্ভিস কমপ্লেক্স পেরোনোর পর গ্রাফিতি আঁকা এক টেলিফোন কিয়স্কের সন্ধান মিলল একটা রিসাইক্লিং ব্যাঙ্কের পিছনে।

চেহারাসুরত শোচনীয় হলেও ডায়ালটোন ঠিকই রয়েছে টেলিফোনে। এক মুঠো কয়েন ভরে ডায়াল করল রানা লুকা ব্রেযনেভের মোবাইল নাম্বারে।

‘আজই কোনও এক সময় সুইডেনে ল্যাণ্ড করছি আমরা,’ জানাল ও বিলিয়নেয়ারকে। ‘ক্লিয়ারেন্স দরকার সেজন্যে। জাকউইক বলে এক জায়গায় যেতে হচ্ছে ওখানে।’ বলল রানা নামটা বানান করে। ওখান থেকে দূরে নয়, এমন ছোটখাটো কোনও এয়ারকিন্ডের খোঁজ দিতে পারেন?’

‘কোত্থেকে কথা বলছ, রানা?’

‘লিজিয়ার কাছে এক মোটরওয়ে সার্ভিস থেকে।’

‘ফোনবুথের নাম্বারটা দাও,’ বললেন ব্রেনেত। ‘দেখছি, কী করা যায়।’

‘তো?’ রানা রিসিভার রাখলে জানতে চাইল সেলেনা।

‘অপেক্ষা করতে হবে। গাড়িতে গিয়ে বসো তুমি।’

পরবর্তী প্রতিটা মিনিটকে যন্ত্রণাময় এক–একটা ঘণ্টার মত দীর্ঘ মনে হলো রানার কাছে। সাত মিনিট পর পে- ফোনটা বেজে উঠতেই, ছোঁ মেরে তুলে নিল রিসিভার।

‘স্টকহোমের পাঁচ শ’ মাইল উত্তরে, ল্যাপল্যাণ্ডের বুনো অঞ্চলে একটা জাকউইক দেখতে পাচ্ছি ম্যাপে… ওটার কথাই বলছ তো, রানা?’ জিজ্ঞেস করলেন লুকা ব্রেযনেভ।

‘জাকউইক নামটা ছাড়া আর কিছুই জানি না আমি, মিস্টার ব্রেনেভ,’ বলল রানা গোবেচারার মত।

‘পাণ্ডববিবর্জিত জায়গা ওটা। কিচ্ছু নেই পাহাড়-জঙ্গল ছাড়া।’

‘তা-ও বলুন…’

‘কাগজ-কলম রয়েছে সাথে?

ল্যান্ডিং পয়েন্টের নামটা বানান করে বললেন ব্রেনেত। জাকউইক থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে এয়ারফিল্ডটা। সেই সঙ্গে দিলেন কো-অর্ডিনেট।

‘খুব বেশি ভিড়-টিড় হয় না ওখানে,’ যোগ করলেন তিনি। ‘অনুশীলনের জন্যে সুইডিশ মিলিটারি ব্যবহার করে ওটা মাঝে মধ্যে। কাজেই, জায়গার অভাব নেই ল্যাণ্ডিঙের জন্যে।’ আরও বললেন, ‘দু’শ’ নটিকাল মাইল পাড়ি দিতে হবে এয়ারফিল্ডটায় পৌঁছনোর জন্যে। হিসেব বলছে, কোপেনহেগেনের পর ফিউল নেয়ার দরকার পড়বে তোমার। থিসটেড নামে ছোট এক এয়ারপোর্ট রয়েছে নর্দান ডেনমার্কে… অনির্ধারিত প্রাইভেট ফ্লাইট ল্যাণ্ড করতে পারে। রিফিউল করে নিয়ো ব্রেযনেভ করপোরেশনের ট্যাব থেকে। শুধু একটা রেফারেন্স নম্বর দিতে হবে ওদেরকে।’ বললেন ব্রেনেড নাম্বারটা। ‘বেসিকালি পৃথিবীর যে-কোনও জায়গা থেকে কোম্পানি অ্যাকাউন্ট ফিল-আপ করার সুবিধা দেয় এটা। …থিসটেডের কো-অর্ডিনেট বলছি, লিখে নাও।’

লিখল রানা খসখস করে।

‘আর ক্লিয়ারেন্স?’

‘ধরে নাও, সেটাও পেয়ে গেছ।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, মিস্টার ব্রেনেভ। অনেক উপকার করলেন!’

‘তুমি যা করেছ, সে-তুলনায় কিছুই না।

শেষ হলো আলাপ।

বসল রানা গাড়িতে এসে।

দ্বিতীয় বারের মত যাত্রা হলো শুরু।

পঁচানব্বই মিনিটের কিছু পরে ওরা যখন এয়ারস্ট্রিপে এসে পৌঁছল, অন্তিম ককানি ছাড়ছে তখন সিত্রোঁর ইঞ্জিনটা। উঠতে উঠতে লাল দাগ ছাড়িয়ে গেছে টেম্পারেচার গজ। ধোঁয়া বেরোচ্ছে বনেটের নিচ দিয়ে।

গাড়ি থেকে বেরিয়েই সীমানা-বেড়ার দিকে হাঁটা ধরল রানা।

আগের জায়গাতেই পাওয়া গেল ব্রেনেভ এসটি-ওয়ান টার্বোপ্রপটাকে। ঝকঝক করছে সূর্যের আলোয়। ছালচামড়া তুলে কঙ্কাল বানিয়ে দেয়নি ওটাকে ছিঁচকে চোরেরা।

‘তা হলে সুইডেন?’ রানার পাশে এসে দাঁড়াল সেলেনা। ‘সুইডেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *