1 of 2

শকওয়েভ – ২৩

তেইশ

আধ কিলোমিটারমত সরে এসেছে ওরা দুর্গবাড়িটা থেকে। ছোট একটা শহর পড়েছিল এখানে আসার পথে, অন্ধকার মেঠো পথ ধরে ত্বরিত পা চালাচ্ছে শহরটার উদ্দেশে।

দূরাগত সাইরেনের বিলাপ কর্ণগোচর হলো এমন সময়। চোখে পড়ল লাল-নীল ঝলকানি।

‘এদিকে এসো!’

রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকের নিবিড় জঙ্গলে আত্মগোপন করল ওরা। সুতীব্র চিৎকার ছেড়ে যতক্ষণ না চোখ রাঙাতে রাঙাতে জায়গাটা পেরিয়ে গেল গাড়িগুলো, তার আগপর্যন্ত গাছপালার আড়ালেই থেকে গেল ওরা।

আবার নীরবতার চাদরে ঢাকা পড়ল সব কিছু।

পকেটে হাত ঢোকাল রানা।

‘কাকে ফোন করছ?’ সেলেনার জিজ্ঞাসা।

‘কাউকেই না। এখন আর ব্যবহার করা যাবে না এটা।’ মাটিতে ফেলে দিল ও ফোনটা। এক খণ্ড পাথর কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ি মেরে টুকরো করল যন্ত্রটা, তার পর ধুলোয় ছড়িয়ে দিল সেগুলো পা দিয়ে।

‘আমার পরিচয় সম্ভবত জেনে গেছে ওরা,’ ব্যাখ্যা করল রানা। ‘অতএব, ট্র্যাকিঙের সম্ভাবনা যত কমানো যায় আর কী।’

‘যাক, সান্ত্বনা পেলাম।’

অন্ধকারেও মেয়েটার সাদা দাঁতগুলো দেখতে পেল রানা। ট্রেন ধরতে হবে আমাদের।’ গম্ভীর হলো ও। ‘পা চালাও।’

.

একজনও জনমনিষ্যি নেই ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশনটাতে।

সেলেনা যখন নিজেদের জন্য কফি আনতে গেল মেশিন থেকে, এই ফাঁকে টাইমটেবল চেক করল রানা। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে আসছে রাতের শেষ প্যারিসগামী ট্রেনটা।

টিকেট কিনল ও অটোমেটিক ডিসপেন্সার থেকে। একটা পে-ফোনে ঢুকে ভাংতি পয়সা দিয়ে ডায়াল করল টম হার্ডির মোবাইল নাম্বারে।

‘আমি,’ বলল রানা ঘুমজড়িত হ্যালো-র জবাবে। ‘বেশিক্ষণ কথা বলতে পারছি না। বাট দ্য বটম লাইন ইজ: ঠিক আছি আমি… ঠিক আছে সব কিছু।’

এত বছরের পরিচয়ে জানা আছে হার্ডির: রানার ঠিক আছে-র মানে হতে পারে অনেক কিছু।

‘ঠিক থাকলেই ভালো,’ বলল ও ঘুমজড়ানো কণ্ঠে।

‘আর শোনো… অ্যালপিনার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শিগগিরই তোমার ওখানে চাঁদবদন দেখাতে যাচ্ছে পুলিস। তার আগেই গাড়িটা খোয়া গেছে বলে রিপোর্ট করতে হবে। জলদি জলদি করে ফেলো তো কাজটা…

এক্ষুণি। বলবে—সম্ভবত মিসিং ওটা দিন কয়েক আগে থেকে; কিন্তু এই মাত্র টের পেয়েছ তুমি। বুঝতে পেরেছ, কী বলেছি?’

‘কার পোঁদে আঙুল দিয়েছ, রানা?’ অ্যালপিনা মিসিং শুনে ঘুম-টুম হাওয়া হার্ডির।

‘সে যাক… যোগাযোগ রাখব আমি। যা বললাম, মনে রেখো কিন্তু! কিচ্ছু জানি না আমি অ্যালপিনার ব্যাপারে।’ বন্ধু বেচারা আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারার আগেই কানেকশন কেটে দিল রানা।

লঘু পায়ে মিলিত হলো ও সেলেনার সঙ্গে। স্টেশন প্ল্যাটফর্মের একটা প্লাসটিকের বেঞ্চে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল মেয়েটা। রানার দিকে একটা পেপার কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘গুয়ের পানির মত লাগছে স্বাদটা।

বিস্বাদ কফিতে চুমুক দিতে লাগল ওরা।

‘ভবঘুরের মত দেখাচ্ছে আমাদের।’ ট্র্যাকের ওধারের এক জানালায় নিজেদের অবিন্যস্ত প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সেলেনা।

‘সেকা হাঁসের গন্ধ আসছে তোমার গা থেকে।’ প্রচ্ছন্ন হাসল রানা।

‘ধন্যবাদ প্রশংসার জন্যে।’ ভেংচি কাটার ভঙ্গি করল মেয়েটা। ‘তোমার অবস্থাও আমার চেয়ে বেশি ভালো নয়, এক শ’ ভাগ গ্যারান্টি দিতে পারি।’

ট্রেন এল। প্রায় ফাঁকা এক ক্যারিজে উঠে আসন নিল ওরা পিছনদিকে।

গোবেচারা গোছের কয়েকজন মাতাল ছাড়া সহযাত্রী বলতে নেই আর কেউ। ঘরঘর আওয়াজে ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করলে টলোমলো পায়ে আইলে এসে দাঁড়াল ওদের একজন, মুখে না ধরানো সিগারেট। আগুন চাইল রানার কাছে।

অপারগতা জানাতে হলো ওকে। শ্যাতোর লঙ্কাকাণ্ডে খুইয়েছে লাইটারটা।

কুকুরের মত বাতাস শুঁকছে মাতাল। সেকা হাঁসের গন্ধ পাচ্ছে বোধ হয়। সন্দিগ্ধ কৌতূহলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল হদ্দ নোংরা বেশবাসঅলা রানা-সেলেনাকে।

‘এই অবস্থা কেন তোমাদের?’ জানতে চাইল।

‘ভূমিকম্প,’ সংক্ষেপে জবাব দিল রানা।

দোস্তদের কাছে ফিরে গেল মদ্যপ পা টেনে টেনে। লোকগুলোর চাউনি দেখে মনে হচ্ছে, অষ্টম আশ্চর্য দেখতে পাচ্ছে বুঝি চর্মচক্ষে।

‘কী, রানা?’ শুকনো হাসল সেলেনা। ‘এখনও বিশ্বাস হয়নি তোমার?’

‘ব্যাখ্যাও করতে পারছি না, অস্বীকারও নয়, ‘ ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর রানার। ‘বাদ দাও ওসব। আগের বার থেমেছিলে যেখানে, শুরু করো ওখান থেকে।’

‘উইদ প্লেজার, স্যর।’ কুর্নিশের ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকাল মেয়েটা। মনে মনে গুছিয়ে নিল বক্তব্য। ‘টাইম মেশিনে করে আঠারো শ’ আটানব্বই সালের নিউ ইয়র্ক শহরে যাওয়া যাক, চলো। টেসলা তখন হিউস্টন স্ট্রিটের বেইসমেন্ট ল্যাবোরেটরিতে বসে -‘

‘সার্বিয়ান না লোকটা?’ বাধা দিল রানা।

‘ছিলেন। স্টেটসে পাড়ি জমান আঠারো শ’ চুরাশি সালে, টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে কাজ করার জন্যে।’ সাল- তারিখ ভালোই মনে থাকে সেলেনার। ‘পরে নাগরিকত্ব পান আমেরিকার :

‘এবার একটা ঘটনা বলি, শোনো। নিউ ইয়র্কেই ঘটেছিল ঘটনাটা… এক শ’ বছরেরও বেশি আগে। আজ যে- ডিভাইসটা জীবন বাঁচাল আমাদের, ওটারই আদি রূপের প্রোটোটাইপ ডিজাইন এবং নির্মাণের পর স্বভাবতই ট্রায়াল দিয়ে দেখতে চাইলেন টেসলা। কিন্তু কাহিনী কী, জানো… যে-বাড়ির বেইসমেন্টে ল্যাব, ওটারই রেজোনেন্ট ফ্রিকিউয়েন্সিতে টিউন করলেন তিনি যন্ত্রটা। খেপাটে বিজ্ঞানী বলে কথা!

‘কথিত রয়েছে—মেশিন যখন চালু করা হলো, প্রথমে একটা গুঞ্জন শুনতে পেলেন টেসলা ও তাঁর সহকারীরা। কড়াক করে একটা আওয়াজ হলো এর পর। আরও একবার আওয়াজটা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঁপতে আরম্ভ করল গোটা বিল্ডিং। শুধু তা-ই নয়, একই ফ্রিকিউয়েন্সির যত দালানপাট ছিল আশপাশে, রেহাই পেল না কোনটাই।

‘বুঝতেই পারছ, কী ঘটতে পারে এর পর! তুমুল হাঙ্গামা বেধে গেল এলাকায়। সবাইকে সচকিত করে ফায়ার ডিপার্টমেন্ট আর পুলিস বাহিনী এসে হাজির অকুস্থলে। শেষ পর্যন্ত কী ঘটত, কে জানে! মেশিনের কার্যক্ষমতা দেখে স্বয়ং টেসলাই দিশেহারা হয়ে পড়েন। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি হারিয়ে হাতুড়ির বাড়ি দিয়ে বন্ধ করেন ওটাকে। সবাই ধরে নিল, বড় মাত্রার কোনও ভূমিকম্প হতে যাচ্ছিল নিউ ইয়র্কে।’

মাথা দোলাল রানা।

‘কিন্তু ওই ফলাফলেই সন্তুষ্ট রইলেন না টেসলা,’ বলে চলেছে মেয়েটা। ‘অ্যালার্ম ক্লকের সমান দ্বিতীয় আরেকটা অসিলেটর তৈরি করলেন তিনি। ওয়াল স্ট্রিটের এক কনস্ট্রাকশন সাইটে চলে গেলেন ডিভাইসটা নিয়ে। দশতলা এক দালানের সাপোর্ট বিমে আটকে দিলেন যন্ত্রটা।

‘কয়েক মিনিটের মধ্যেই—পরে বলেছেন নিজের রিসার্চের ব্যাপারে—ককাতে আর কাঁপতে শুরু করল গোটা স্ট্রাকচার। জান বাঁচাতে আতঙ্কিত ওঅর্কাররা নিচে নেমে এল। ভেবেছিল, ধসে পড়তে চলেছে বিল্ডিংটা।

‘এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মাঝে মেশিনটা পকেটে পুরে সটকে পড়লেন টেসলা। যা জানার, জানা হয়ে গেছে তাঁর। ওঁর কথা থেকেই কোট করছি আমি: ‘ধুলোয় লুটিয়ে দিতে পারি আমি আস্ত এক বিশাল অট্টালিকা।’ … খানিকটা বিশ্বাসযোগ্য শোনাচ্ছে এখন?’

তার পরও হজম করতে কষ্ট হচ্ছে রানার। ‘ওরকম এক যন্ত্রই বানিয়েছে তোমার বান্ধবী! ‘

মাথা ঝাঁকাল সেলেনা। ‘ওরটা আপডেটেড, এই যা। মূল কনসেপ্ট কিন্তু খুবই সিম্পল। মাত্র পাঁচ পাউণ্ডের এয়ার প্রেশার দেয়া হতো অরিজিনাল অসিলেটরের নিউম্যাটিক পিস্টনে।

‘হিউস্টন স্ট্রিটের এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে শুরুতে নিউ ইয়র্ক অথোরিটির কাছে লুকোছাপা করেন টেসলা। পরে দাবি করলেন, ওই পাঁচ পাউণ্ড প্রেশারই ধসিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং, ইস্ট রিভারে ডুবিয়ে দিতে পারে ব্রুকলিন ব্রিজ।

‘তাত্ত্বিকভাবে, স্ট্রাকচার যত বড় হবে, ততই সুবিধে সেটাকে ধ্বংস করা। কারণ, ভর বাড়লে কমে যায় রেজোনেন্ট ফ্রিকিউয়েন্সি।

‘ক্ষমতার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই যন্ত্রটার। কী বলেছিলাম, মনে আছে, রানা? টেসলা বিশ্বাস করতেন, পৃথিবী দু’খণ্ড করে ফেলার ক্ষমতা ধরে ওঁর অসিলেটর। যথেষ্ট বড় মেশিন হলে সত্যিই অসম্ভব নয় সেটা।’

‘বড় মানে কত বড়?’ পাগল পাগল লাগছে রানার নিজেকে।

‘যতটা ভাবছ, ততটা নয়। টেসলা নাকি দাবি করেছিলেন, দু’শ’ পাউণ্ড আর উচ্চতায় ফুট তিনেক হলেই পৃথিবীর মাঝ দিয়ে যে-কোনও দূরত্বে চালিকাশক্তি ট্রান্সমিট করতে পারবে মেশিনটা। এসব আমি শুনেছি ক্যারেনের মুখে। ভুল বলেনি বোধ হয়।

‘এ তো ভয়াবহ কাহিনী!’ পেটের মধ্যে ফড়িং উড়ছে রানার।

‘তবে আষাঢ়ে গল্প যে নয়, নিশ্চয়ই স্বীকার করবে এবার! নিজের চোখেই তো দেখলে ওটার ক্ষমতার দৌড়।’

অসহায় ভঙ্গিতে শ্রাগ করল রানা। ‘ঠিক আছে। বিশ্বাস করলাম তোমার কথা। তবে একটা প্রশ্ন আছে। কেন ব্যাপকভাবে পরিচিত নয় এরকম একটা জিনিস? উপযোগিতার দিক থেকে বিবেচনা করলে, এর গুরুত্ব তো কম হওয়ার কথা নয়!’

‘কারণ রয়েছে, রানা। অকল্যাণের আশঙ্কায় আরও অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ আবিষ্কারের মতই বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দি হয় টেসলার এই উদ্ভাবন, জগৎবাসীর কাছে হয়ে ওঠে অস্পৃশ্য। নিষিদ্ধ এসব আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে অনন্ত জীবনের সম্ভাব্যতা কিংবা মৌলিক পদার্থকে সোনায় পরিণত করার গুমর। সেজন্যেই খুব কম লোকে জানে মহান এই বিজ্ঞানীর অবদান সম্পর্কে। মূল ধারার অ্যাকাডেমিক রিসার্চ সার্কেলে, স্রেফ উল্লেখ করো লোকটার নাম, গবেট হিসেবে বিবেচিত হবে তুমি।’ রহস্যময় হাসি সেলেনার ঠোঁটে। ‘নিজের সায়েন্স ক্যারিয়ারের বড় একটা অংশ কাটিয়ে দিয়েছি আমি ‘অস্পৃশ্য’ এই সমস্ত জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করে। আমার মতন অল্প যে ক’জন নাড়াচাড়া করে এগুলো নিয়ে, নিজেদের স্বার্থেই গোপনীয়তা বজায় রাখতে চায়। ঠিক যেভাবে উনিশ শ’ চল্লিশ সালের রসওয়েল-কাণ্ডকে ইউএফও এবং এলিয়েন সম্পর্কিত রটনা বলে চালিয়ে দিয়েছে আমেরিকান সরকার… গোপন এয়ারক্রাফট টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে, এই সত্যকে গোপন রাখা খুবই দরকার ছিল সেসময়ে।’

‘বলছ, মার্কিন সরকারের যোগসাজশ রয়েছে টেসলার আবিষ্কার ধামাচাপা দেয়ার পিছনে?’

‘শুরুতে অত্যন্ত সমীহের চোখে দেখা হতো টেসলাকে। নানান ধরনের গোপন বিধ্বংসী অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টের জন্যে লক্ষ লক্ষ ডলার আর্থিক সহায়তা দেয়া হয় তাঁকে ওয়ার ডিপার্টমেণ্ট থেকে। যদিও অস্ত্রগুলোর কোনটিই আলোর মুখ দেখেনি। উনিশ শ’ সতেরো সালে তারবিহীন এক ইঞ্জিনের পেটেণ্ট নেন টেসলা। তাঁর দাবি অনুসারে, দশ হাজার মাইল দূর থেকে, স্রেফ একটা লিভারের সাহায্যে গোটা একটা নৌবহরকে হাওয়া করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে ওটা। এর বছর কয়েক পর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন হব হব করছে, তথাকথিত পার্টিকেল ডেথ বিম উইপনের পরিকল্পনা পেশ করেন তিনি। একবার মাত্র রশ্মি ছুঁড়েই শত্রুর বিমানবহর কিংবা লাখো সৈন্যের আগুয়ান বাহিনীকে ধ্বংস করতে সক্ষম নাকি ওটা—অনেকটা মিথোলজির দেবতা থরের বজ্রের মত। বৈদেশিক আগ্রাসন থেকে কোনও জাতিকে রক্ষা করতে কতখানি কার্যকর অস্ত্র, ভেবে দেখেছ, রানা?

‘তবে তত্ত্বীয় স্তর পেরোতে পারেনি কখনও এসব পরিকল্পনা। বরঞ্চ প্রয়োগসিদ্ধ প্রজেক্ট হিসেবে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে ছিল জুলিয়াস ওপেনহেইমারের পারমাণবিক বোমা; জয় করে নেয় সরকারের ধন-মন— দুই-ই। ‘

‘শুনে খুশি হলাম যে, ফেল মেরেছে টেসলার কুপরিকল্পনা।’ হাঁপ ছাড়ল রানা। ‘ওই জিনিসের অস্তিত্ব থাকলে ছারখার হয়ে যেত দুনিয়া।’

‘তবে কর্তৃপক্ষ তার পরও আগ্রহ হারায়নি টেসলার প্রতি,’ বলে যাচ্ছে সেলেনা। ‘উনিশ শ’ তেতাল্লিশ সালের জানুয়ারি মাসে, ছিয়াশি বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন নিকোলা টেসলা। তিনি তখন দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। মারা যাওয়ার পর এফবিআই এজেন্ট, অফিস অভ এলিয়েন প্রপার্টি এবং ওয়ার ডিপার্টমেন্টের কূটচালে হাওয়া হয়ে যায় টেসলার জাদুকৌশল। আইনের প্রভাব খাটিয়ে অস্ত্রের গোপন ফর্মুলা, ব্লুপ্রিন্ট ও যাবতীয় ডিজাইন প্ল্যান সরিয়ে ফেলা হয় নিরাপদ বলয়ে। কথিত রয়েছে—টেসলা মারা গেলে, জে. এডগার হুভার এবং কতিপয় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার অলিখিত নির্দেশে সে-মাসের কোনও এক সময়ে নিউ ইয়র্ক হোটেলের কামরায় হানা দিয়ে ভাঙা হয় বিজ্ঞানীর সিন্দুক। জীবনের শেষ বছরগুলো ওই হোটেলেই কাটিয়েছেন তিনি। আরও একটা ভল্টের চাবি গাপ করা হয় গভর্নর ক্লিনটন হোটেল থেকে— ‘

‘যেটার ভিতর ছিল ঘোড়ার ডিম আর হাতিমি বা বকচ্ছপ-জাতীয় কিছু,’ ফাজলামো করল রানা।

‘মোটেও না!’ কড়া চোখে তাকাল সেলেনা। ‘ওই সিন্দুকেই মারণরশ্মি মেশিনের প্রোটোটাইপ ওঅর্কিং মডেল রেখেছিলেন টেসলা।’

ঝমঝম করে ছুটে চলেছে রেলগাড়ি। দুলছে ওরা ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে। আর মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বে রয়েছে প্যারিস সিটি।

সামনের সিটে পা তুলে দিয়ে শরীরটা নিচু করে নিল রানা। চোখ রাখল জানালার বাইরে। তলিয়ে দেখছে মেয়েটার কথাগুলো।

‘কী হলো, রানা?’ ওকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল সেলেনা। ‘বিশ্বাস হলো না আমার কথা?’

‘আজকের পর, আইনস্টাইন এলিয়েন ছিলেন বললেও বিশ্বাস করব আমি।’ সোজা হলো রানা। ‘সমস্যা সেটা নয়। ‘

‘সমস্যা তা হলে কোনটা?’

‘আর ইউ সিরিয়াস? তুমি যা শোনালে, সেটার মানে দাঁড়াচ্ছে—এসব নিয়ে মাতামাতি করার জন্যে সরকারের সিক্রেট এজেন্টরাই হত্যা করেছে ক্যারেনকে!’

‘তবে আর বলছি কী? বিকৃতমস্তিষ্ক সিরিয়াল কিলারের থিয়োরি প্রতিষ্ঠা করা খুবই সহজ ওদের জন্য, জাস্ট নকল করতে হবে কিলারের মোডাস অপারেণ্ডি। বরাবর ফলো করা হচ্ছে এ ধরনের টেকনিক।

‘তুমিই দেখো না, এ পর্যন্ত কী কী ঘটেছে আমাদের চারপাশে! ইংল্যাণ্ডের এক ছোট্ট গাঁয়ে ট্র্যাক করল আমাকে—লেলিয়ে দিল খুনি! প্যারিস চলে আসার পরও কীভাবে জানি খোঁজ পেয়ে গেল আবার… হোমিং ডিভাইস লাগিয়ে দিল গাড়িতে! কীসের ইঙ্গিত করছে এগুলো?’

‘বেশ,’ মেনে নিল রানা। ‘তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া গেল—যা যা বললে, সবই সত্যি। সেই উনিশ শ’ তেতাল্লিশ সালে এফবিআই এবং অন্যান্য সরকারি গুপ্তচরেরা হন্যে হয়ে উঠেছিল উন্মাদ এক বিজ্ঞানীর এমন এক অস্ত্র হাতে পাওয়ার জন্যে, যেটার সাহায্যে মারণরশ্মি পাঠানো যায় চাঁদের দেশে… পুরাণের মেডিউসার মত চোখের পলকে পাথরে পরিণত করা যায় গোটা একটা সেনাবাহিনীকে… আরও কত আগডুম-বাগডুম!

‘আসল সমস্যাটা এখানেই। যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলছি আমরা, তোমার-আমার জন্মের বহু বহু আগেকার কল্পবিজ্ঞান বলা যায় এগুলোকে। এখন, টেসলার দাবি অনুযায়ী যদি কাজও করে থাকে ডিভাইসগুলো; কোনও ধারণা রয়েছে তোমার, কতটা অচল বলে বিবেচিত হবে আজকের যুগে? আজ আমাদের হাতে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে; লড়াইয়ের ময়দানে ব্যবহারের জন্যে রয়েছে ড্রোন, রোবট, ইউরেনিয়াম ওয়ারহেড আর জীবাণু-অস্ত্র সহ খুনজখমের এমন সব মারাত্মক হাতিয়ার, যেগুলোর কাছে টেসলার সৃষ্টিকে মনে হবে সাদা-কালো আমলের ফ্ল্যাশ গর্ডন সিনেমার প্রযুক্তি।’

‘তা-ই, না?’ বেজার হয়েছে সেলেনা। ‘ঠিক কী বলতে চাইছ, বলো তো, রানা!

‘সিম্পল। এ যুগের রিসার্চাররা এসবে নাক গলিয়ে বিপদ ডেকে আনবে বলে মনে হয় না আমার। অন্তত এতগুলো বছর পর তো নয়ই! অন্য কোনও রহস্য রয়েছে এর মধ্যে।’

হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল সেলেনা। ‘কী ধরে নেব তা হলে? এমন কোনও যন্ত্র আবিষ্কার করেছিল মেয়েটা, যেটা কারও কল্পনাতেও আসেনি? হুম… হতে পারে। ওটার জন্যেই হয়তো ফেউ লেগেছিল ওর পিছনে।’

সেক্ষেত্রে, কী কারণে চেষ্টাও করল না লোকগুলো জিনিসটা দখলে নেয়ার? কেন গোর দিল টন কে টন পাথরের নিচে?’

গার সেইন্ট-ল্যাজারে ঢোকার আগপর্যন্ত মজে রইল ওরা রহস্যটা নিয়ে। অনেক তর্কবিতর্কের পরেও পৌঁছনো গেল না কোনও উপসংহারে।

শোরগোল তুলে ট্রেন থেকে নামল মাতালের দল। এর পর নীরবে বেরিয়ে এল রানা আর সেলেনা।

হাতে গোনা কয়েকজন শেষ রাতের যাত্রী দেখা যাচ্ছে প্রাচীন আর আধুনিক স্থাপত্যরীতির সম্মিলনে গড়া প্যারিসের অন্যতম প্রধান স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। ইস্ট এন্ট্রান্স দিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা রু্য সেইন্ট-ল্যাজারে।

অল্প কিছু গাড়িঘোড়া চলছে রাস্তায়। সকাল হতে ঢের দেরি এখনও।

ইতিউতি চাইল রানা ক্যাবের আশায়। পঁচিশ গজ দূরের ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ধূসর একখানা মার্সিডিসকে। পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না সেফহাউসে পৌঁছুতে।

ক্যাবের দিকে এগোচ্ছে, এ সময় এক লোককে লক্ষ করল সেলেনা আড়চোখে। স্টেশন এন্ট্রান্সের কাছে, বদখত চেহারার এক ঘড়ির ভাস্কর্যের নিচে দাঁড়িয়ে চুরুট ফুঁকছে। পরনে জিনস আর হুডি।

স্পষ্টতই নজর রাখছিল এন্ট্রান্সে। ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে চুরুট ফেলে দিয়ে কদম চালাল ওদের উদ্দেশে। গতি বাড়ছে প্রতি পদক্ষেপে।

ওরা ক্যাবস্ট্যাণ্ডে পৌঁছনোর আগেই সান্ধ্য পোশাক পরা একটা দল উদয় হলো রাস্তার কোনা ঘুরে। তিন পুরুষ, তিন মহিলা। রঙ্গতামাশার বহর দেখে মনে হচ্ছে, বেজায় ফুর্তিতে কেটেছে রাতটা।

ওরাই আগে দখল নিল ক্যাবটার। দুমদাম করে বন্ধ হলো মার্সিডিসের দরজা। ছুটল গাড়ি রু সেইন্ট-ল্যাজার ধরে।

‘সাবওয়ে ধরতে হবে আমাদের,’ সিদ্ধান্ত নিল রানা।

ঘন ঘন পিছনে চাইছে সেলেনা। উদ্বেগ ফেটে বেরোচ্ছে ওর চোখ থেকে। কোনও ভুল নেই, ওদেরই পিছু নিয়েছে হুডিঅলা। হাত দুটো পকেটে ভরে দিয়ে পা চালাচ্ছে অধোবদনে।

‘রানা!’ আর চুপ থাকা সম্ভব হলো না মেয়েটার পক্ষে। ‘আপদ জুটেছে আমাদের পিছনে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *