1 of 2

শকওয়েভ – ১৯

উনিশ

ম্যাপের জিপিএস লোকেশন লক্ষ্য করে দীর্ঘ যাত্রার সময় কথা বড় একটা বলল না রানা।

সেলেনাও হারিয়ে গেছে নিজস্ব ভাবনা-চিন্তায়। চিঠির সংখ্যাগুলো নিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে রইল অনেকক্ষণ। তার পর দোমড়ানো কাগজটা সরিয়ে রেখে গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকল চিন্তিত ভঙ্গিতে।

অ্যালপিনার স্যাটন্যাভ সিস্টেম ব্যবহার করে এগিয়ে চলেছে ওরা গ্যাসপার ইলিয়েলের পারিবারিক এস্টেটের দিকে। প্যারিস ছাড়িয়ে আসার পর থেকে গাড়িঘোড়া কমে গেছে রাস্তায়, প্রায় নেই বললেই চলে।

ঘুমন্ত এক গাঁয়ের রেলওয়ে স্টেশনের প্রান্তসীমা ঘেঁষে ছুটছে বিএমডাব্লিউ। অনেকক্ষণ পর প্রধান সড়কের বদলে আঁকাবাঁকা গ্রামীণ রাস্তায় নামল ওরা। পাথরের উঁচু দেয়ালের সমান্তরালে এগোনো পথটার শেষ নেই যেন।

অবশেষে দেখা গেল বিকটদর্শন কালো লৌহফটক।

‘এই তো, পৌঁছে গেছেন আপনি!’ বেমানান উৎফুল্ল স্বরে ফরাসিতে ঘোষণা করল স্যাটন্যাভ।

ফটক থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল রানা। ভাবছে—কোনও রকম খবর-টবর না দিয়ে হুট করে তো চলে এল গভীর রাতে। কাউকে পাওয়া যাবে বাড়িতে?

গ্যাসপার লোকটা যদি ভিতরে থেকেও থাকে, নিশ্চয়ই খুশি হবে না এই অসময়ে অতিথি এসে হাজির হলে।

‘আবারও!’ লোহার গরাদেতে জড়ানো মোটা শেকলের সঙ্গে জাম্বো সাইজের তালা দেখে গুঙিয়ে উঠল সেলেনা। ‘আজ এই নিয়ে দ্বিতীয় বার।’

বেরিয়ে এল রানা গাড়ির দরজা খুলে। তুলে নিল বন্দুক ভরা ব্যাগটা।

‘তালা ওড়ানোর চিন্তা করছ নাকি?’ কণ্ঠে সন্দেহ, জানতে চাইল মেয়েটা।

না-বোধক মাথা নাড়াল রানা। ‘পরদাদার আমলের গাবদা এই তালা ওড়াতে চাইলে নাইন মিলিমিটারে কাজ হবে না। তা ছাড়া, এই নিশুতি রাত্তিরে মুর্দাদের ঘুম ভাঙিয়ে কী লাভ?’

লোহার গেটের দু’পাশের দেয়াল পরখ করল ও। সহজ হবে না পাথরের মসৃণ প্রাকার বাওয়া। তার চেয়ে বরং পা রাখার মত একাধিক খাঁজ রয়েছে ফটকে। বাধা বলতে, উপরের স্পাইকগুলো। তবে সতর্ক থাকলে ওগুলো কোনও ব্যাপারই নয়।

ব্যাগটা কাঁধে ঝোলাল রানা। উঠতে আরম্ভ করল ঠাণ্ডা গরাদে বেয়ে।

বড় করে একটা শ্বাস ফেলল সেলেনা। তার পর কাঁধ ঝাঁকিয়ে অনুসরণ করল সঙ্গীকে।

কাঁটার খোঁচা বাঁচিয়ে সতর্কতার সঙ্গে ওপারে নামল ওরা। তার পর চলতে শুরু করল নুড়ি বিছানো পথ ধরে।

টর্চলাইট ব্যবহার করল রানা। পথের নুড়ি আর দু’পাশের লনের গা ফুঁড়ে কুডজু ধরনের আগাছার আগ্রাসী বিস্তার। চারপাশেই ঝোপঝাড়ের বেপরোয়া বাড়বাড়ন্ত।

অচিরেই অনুধাবন করতে পারল ওরা, বর্তমান মালিকের কী নিদারুণ অবহেলার শিকার এক কালের জাঁকজমকপূর্ণ এই প্ৰপাৰ্টিটা।

ঝোপজঙ্গলের পাশ কাটিয়ে এগোতে এগোতে এক সময় দৃষ্টিসীমায় ধরা দিল আঠারো শতকের আলিশান শ্যাতো। রাতের আকাশের পটভূমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ওটার চোখা গম্বুজ আর চিমনিঅলা কালো অবয়ব।

দিনের আলোয়—অনুমান করল রানা—এলাকাটার মতই অবহেলিত দেখায় বাড়িটাকে।

তিন কুড়িমত জানালা হবে প্রাসাদবাড়ির সামনের অংশে। কোনটাতেই আলো জ্বলছে না। এ-বাড়ির কর্তাব্যক্তিটি হয়তো বেরিয়ে পড়েছে রোমাঞ্চকর নিশি- অভিযানে। আর নয় তো মদের বোতল কিংবা নির্বোধ কোনও রূপসীর সঙ্গে রাত্রি যাপন করছে কোনও বিছানায়।

‘অযথা এখানে সময় নষ্ট না করে চলো ভেতরে গিয়ে দেখা যাক, কী আছে,’ বলল রানা। বিশাল শ্যাতোর সামনে আর দু’পাশে আলো বুলিয়ে আনল ও। বুঝতে চাইছে, ঢোকার মত কোনও উপায় রয়েছে কি না।

সেলেনার মনোযোগ এদিকে নেই। দূরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে তর্জনী তাক করল ও। ‘একটু আলো ফেলো তো ওদিকে!’

জমিন পেরিয়ে কম্পমান স্পটলাইটের আকারে গিয়ে পড়ল উজ্জ্বল আলোকরশ্মি। সে-আলোয় দেখা গেল বাড়ন্ত গুল্মলতা আর গাছগাছড়ায় ভরা উদ্যানটা। এখন আর পানি ছিটায় না দেয়ালঘেরা প্রাঙ্গণে বসানো জলপরীর আদলে গড়া ফোয়ারাটা। পার্ক আর বনাঞ্চল চোখে পড়ছে ভাঙা বেড়ার ওপাশে। একখানা ক্লক টাওয়ার নিয়ে সুপরিসর আস্তাবলটাকে গ্যারাজে রূপ দেয়া হয়েছে।

‘কিছু নেই, ধুর!’ বিড়বিড় করল সেলেনা। ‘আমি আরও ভাবলাম…’

‘কী আশা করছিলে ওখানে?’

‘গোরস্তান।’ তেরছা চোখে তাকিয়ে আছে ও জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে।

‘গোরস্তান?’ রানা বিস্মিত।

উপরনিচ হলো মাথাটা। ‘বাহারি সমাধিফলকঅলা ছোটখাটো একটা পারিবারিক কবরখানা আর কী। ইলিয়েল বংশের অনেকগুলো প্রজন্ম কাটিয়েছে নিশ্চয়ই এ-বাড়িতে! মৃত্যুর পরেও পরিচিতজনের মাঝে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা।’

টর্চের আলো বুলিয়ে জরিপ করল রানা ডানে-বাঁয়ে। আরও কিছু স্থাপনা, দেয়াল আর গাছপালা ছাড়া চোখে পড়ল না অন্য কিছু।

‘তা, কবর খোঁজার দরকার পড়ল কেন হঠাৎ?’

‘গাড়িতে আসার পথে একটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়, বলল সেলেনা। ‘টর্চটা দাও দেখি আমাকে! ওখানে গিয়ে দেখে আসি, কী আছে ওদিকটায়। আমার অনুমান যদি ঠিক হয়, প্রাসাদে ঢোকার দরকারই পড়বে না।’

হাতবদল হলো ম্যাগলাইট।

শ্যাতোর পাশ ঘুরে বাগানের দিকে চলে যাওয়া চওড়া পথ ধরল সেলেনা। হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওর পিছু নিল রানা।

‘ওইত্তো!’ আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েটা।

আলোর টানেল অনুসরণ করে বৃত্তাকার এক অবকাঠামো দেখতে পেল রানা। নিচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দুটো স্ট্যাচু রয়েছে প্রবেশমুখের দু’পাশে।

গির্জা ওটা।

ম্যাগলাইটের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে কারুকার্যখচিত পাথর-দেয়াল আর কালের আঁচড়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ব্রোঞ্জের ক্রুশ-শোভিত বুরুজে।

‘গির্জা দিয়ে—’ শুরু করেছিল রানা, শোনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেনি সেলেনা। হাঁটা শুরু করেছে ওকে পিছনে রেখে।

অগত্যা সামনে বাড়তে হলো রানাকেও। মেয়েটার ভাবসাব ঠাহর করতে পারছে না বলে ধৈর্য হারাচ্ছে উত্তরোত্তর। এগিয়ে গিয়ে যখন ধরে ফেলল ওকে, ততক্ষণে পৌঁছে গেছে সেলেনা চার্চহাউসের ধনুকাকৃতি প্রবেশপথের সামনে। বন্ধ ওটা।

দরজার পাশে আলো ফেলে কিছু একটা খুঁজছে মেয়েটা। দেয়ালে বসানো ছোট এক ইলেকট্রনিক কিপ্যাডের উপর স্থির হলো আলোটা।

‘বাজি ধরতে পারো, রানা,’ বলল ও উৎসাহের সঙ্গে। ‘বৃথা যায়নি মগজকে খানিক ঘষামাজা করে নেয়াটা।’

উঁকি দিচ্ছে রানা মেয়েটার কাঁধের উপর দিয়ে। ‘বাজি জেতার জন্যে তর সইছে না আমার।’

তিন….. এক… পাঁচ… সাত… টিপল সেলেনা এক-এক করে।

এক সেকেণ্ড পরই চাপা একটা ‘বিপ’ ধ্বনির সঙ্গে ‘ক্লিক’ করে খুলে গেল ইলেকট্রনিক লক।

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সেলেনা রানার মুখের দিকে। সব ক’টা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে খুশিতে। নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ল ও দরজা খুলে।

ছোট একখানা মঞ্চের সামনে বেশ কিছু বেঞ্চি ও দু’পাশে কয়েকটা ধর্মীয় অয়েল-পেইন্টিং ছাড়াও গুচ্ছের ক্রুশ রয়েছে যেমনটা দেখা যায় টিপিকাল চার্চের অভ্যন্তরে। গির্জাগুলোতে।

‘বাজি জেতার জন্যে দোয়া চাইবে নাকি, রানা?’ প্রতিধ্বনিত হলো বাক্যটা। মজায় রয়েছে মেয়েটা।

জবাব দিল না রানা। মনে পড়ল, ক্যারেনের অ্যাপার্টমেন্টে কীভাবে টেনশনে রেখে গিয়েছিল সেলেনাকে। বোধ হয় সেটারই শোধ নিচ্ছে ও।

কী খুঁজে বেড়াচ্ছে মিষ্টির গন্ধ পাওয়া পিঁপড়ের মত?

‘থিয়োরিটা শেয়ার করলে কোনও সমস্যা আছে?’ বলল রানা ত্যক্তবিরক্ত স্বরে।

সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল সেলেনার বিজয়োল্লাস।

‘চার ডিজিটের দ্বিতীয় লাইনটার মানে তো বোঝা গেল একটু আগে,’ বলল ও উত্তেজিত কণ্ঠে। ‘বাকি ছিল শেষ লাইনটা। সেটারও মানে বোঝা গেল এই মাত্র!’

‘কী বোঝা গেল?’ জিজ্ঞেস করল রানা প্রশ্রয়ের সুরে।

‘তারিখ, রানা, তারিখ! পাঁচ ডিজিটের এক জোড়া তারিখ ওটা। দিন, মাস, বছরের উল্লেখ রয়েছে প্রতিটায়। একসঙ্গে লেখা বলে প্রথম দেখায় বোঝা যায় না কিছু। কিন্তু সিকিউয়েন্সে ভেঙে সাজাও, সাঁইতিরিশ বছরের ব্যবধানে তারিখ পেয়ে যাবে দুটো। একমাত্র যে-অংশটা মিসিং, সেটা হচ্ছে সেঞ্চুরি।’

‘মাই গড, সেলেনা! তুমি তো দেখছি কামাল করে দিলে!’ উজ্জ্বল হাসি ফুটল রানার মুখে। ‘এই প্রথম বাজিতে হারার জন্যে দুঃখ হচ্ছে না আমার।’

টর্চলাইটের আলোয় ছোট এক আর্চওয়ে দেখা গেল মঞ্চের পিছনদিকের দেয়ালে। ওখান দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে।

সেলেনাকে নিয়ে ওদিকে এগোল রানা।

জরাজীর্ণ সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে লোহার এক ভারি দরজা অবধি। পেল্লায় সাইজের হুড়কো আঁটা দরজায়।

‘বাজি জেতার জন্যে বলতে পারো এখন, ওয়াইন রাখার গুদাম ওটা,’ রগড় করল সেলেনা।

‘তা বলব না।’ আর্চওয়েতে উঁকি দিল রানা। ‘কারণ, কী ওটা, জানা আছে আমার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *