1 of 2

শকওয়েভ – ৪৮

আটচল্লিশ

ফরফর আওয়াজে জীবন ফিরে পেল একখানা প্যারাফিন ল্যাম্প, তার পর আরেকটা।

টেবিলের উপর দিয়ে উঁকি দিল রানা। দরজার গায়ের গর্ত সই করে ছুঁড়ে মারল একটা ল্যান্টার্ন। গর্তের এবড়োখেবড়ো কিনারে লেগে চুরমার হলো ওটা। ছড়িয়ে পড়া প্রোপেন গ্যাসে আগুন ধরে যেতেই চিৎকার শোনা গেল ওপাশে।

ছুঁড়ল ও দ্বিতীয় লণ্ঠনটা। নিখুঁত নিশানায় ফোকর গলে বেরিয়ে গেল ওটা এবার। টেবিলের আড়ালে নিচু হয়ে নিজের দেহ দিয়ে আড়াল করল রানা সেলেনাকে।

প্রায় একই সঙ্গে বিস্ফোরিত হলো সিলিণ্ডার দুটো। আগ্রাসী আগুন আর ইস্পাতের টুকরো ছিটকে ছড়িয়ে গেল চারদিকে।

বিস্ফোরণের ধাক্কায় কবজা থেকে খুলে গেল দরজাটা। সংলগ্ন দেয়ালের বেশ ক’টা তক্তা উপড়ে নিয়ে ছুটে এল রান্নাঘরে। বিকট আওয়াজে টেবলটপ ব্যারিকেডের গায়ে আছড়ে পড়ল ওটা।

আতঙ্কে ‘ওরে, মা, রে! গেছি!’ গান ধরল গুস্তাফ।

চামড়ায় ছেঁকা অনুভব করল রানা। আরও জোরে চেপে ধরল ও সেলেনাকে। লাল আগুনের মস্ত ফুটবল জ্বলন্ত প্যাসেজে পিছু হটতেই কমে এল জ্বালাপোড়া।

উঁকি দিল রানা ব্যারিকেডের উপর দিয়ে।

নরকের অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে কিচেনের বাইরেটা। প্যাসেজে ফিরে যাওয়ার উপায় আর নেই। তাতে যে কিছু যায়-আসে না, দেখতে পাচ্ছে সেটাও। কিচেন-দেয়ালের অর্ধেকটাই গায়েব। কেবিনের গোটা পিছনটাই উড়ে গেছে গ্যাস-বিস্ফোরণে।

উঠে দাঁড়াল রানা। উঠতে সাহায্য করল সেলেনাকে।

‘ঠিক আছ তুমি?’ জানতে চাইল উদ্বেগ নিয়ে।

‘অবশ্যই। তুমি আছ না?’ হাসিমুখে বলল ও। এখনও চেপে ধরে রেখেছে আহত হাতটা।

ধোঁয়ার আবরণ ভেদ করে ছুটল রানা ওকে নিয়ে। ঝড় বয়ে যাওয়া কামরা থেকে বেরিয়ে এল ব্যাক পোর্চে। পিছন পিছন টলোমলো পায়ে অনুসরণ করে এল গুস্তাফ।

লাফিয়ে নামল ওরা ঘাসের বুকে। বদ্ধ কামরার আগুন আর ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে এসে আশ্চর্য মিষ্টি লাগল ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শ। বিশুদ্ধ অক্সিজেন জুড়িয়ে দিল প্রাণ।

ফিরে তাকাল রানা জ্বলন্ত ধ্বংসস্তূপের দিকে। বিস্ফোরিত গ্যাসে কী হাল হয়েছে হামলাকারীদের, দেখতে পেল নমুনা। বিচ্ছিন্ন একটা হাত ছিটকে এসে পড়েছে আঙিনায়, আগ্নেয়াস্ত্র ধরে রেখেছে তখনও। কাছেই পড়ে আছে পাবিহীন জ্বলন্ত একটা ধড়।

‘সবাই কি শেষ, রানা?’ শব্দ করে শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা। ‘বলা মুশকিল,’ আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল রানা।

পরমুহূর্তে ধোঁয়ার ভিতর থেকে কালো দুটো মূর্তিকে ওদের দিকে ছুটে আসতে দেখে জবাব পেয়ে গেল প্রশ্নটার। হাতের অস্ত্র দেখে বুঝতে পারল রানা, অপেক্ষাকৃত দশাসই এবং পেশিবহুল লোকটাই গ্রেনেড শুটার। কেবিন থেকে অনেকটা দূরে ছিল বলেই হয়তো বেঁচে গেছে বিস্ফোরণ থেকে।

তার পিছনেরজন মাথায় ছোট আর পাতলা-সাতলা হলেও কম বিপজ্জনক নয়।

‘এসো আমার সঙ্গে!’ বলেই টান দিল রানা সেলেনার হাত ধরে।

ছুট লাগাল ওরা পোর্চের কাছ থেকে সরে যাওয়ার জন্য। আপাত আশ্রয়স্থল বলতে- সম্মুখ-খোলা

বলতে–সম্মুখ-খোলা লাকড়ি-রাখা ছাউনিটা। যদিও কতটুকু নিরাপত্তা দেবে ওটা, জানা নেই কারও।

ছুটতে ছুটতেই নিচু হয়ে পাশ কাটাল মোটরাইজড লগ স্প্লিন্টারের প্রমাণাকার স্টিল ফ্রেমের। ইস্পাতের গায়ে ঠং-ঠং বুলেট লেগে ছিটকে গেল এদিক-ওদিক। মোড় নিয়ে ঢুকে পড়ল দু’জনে ছাউনির ভিতর।

একটা অস্ত্র… যে-কোনও একটা অস্ত্রের জন্য দৃষ্টি দিয়ে সার্চ করছে রানা চারপাশটা।

তখনই টের পেল, ভিকান্দার নেই ওদের সঙ্গে!

পাগলা ঘোড়ার মত ঝোপজঙ্গলের দিকে ছুট লাগিয়েছে সাংবাদিক। নির্ঘাত ভেবেছে, ভেসে আসা কালো ধোঁয়ার মেঘ আড়াল দেবে ওকে।

ভুল! অসহায়ের মত চেয়ে দেখল রানা, দাঁড়িয়ে পড়ে সেমি-অটোমেটিক পিস্তল হোলস্টারমুক্ত করল মুখোশ পরা গ্রেনেড শুটার। এলোমেলো পা ফেলে প্রাণভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে গুস্তাফ ভিকান্দার। ওকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল।

হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল যেন গুস্তাফ। মাত্র এক মুহূর্তের জন্য। তার পরই ঝোপগুলোর উপর হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ে হারিয়ে গেল দৃষ্টির বাইরে।

পিস্তলটা হোলস্টারে পুরে সঙ্গীকে সঙ্কেত দিল দৈত্য। চক্কর দিতে শুরু করল ওরা ছাউনির ভিতর।

‘কোণঠাসা হয়ে পড়েছে রানা- সেলেনা। স্রেফ দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে বলে দেখতে পাচ্ছে না ওদেরকে আততায়ীরা।

একটা চেইন-স দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল রানার চোখ দুটো। তুলতে গিয়ে চোখে পড়ল চপিং ব্লকে গাঁথা লম্বা হাতলের কুড়ালটা।

দু’হাতে ধরল রানা কুড়ালের হাতল। হ্যাঁচকা টানে ধারাল অস্ত্রটা ছুটিয়ে আনতেই কোনা ঘুরে উদয় হলো প্রথম শুটার। হাতের আগ্নেয়াস্ত্র রানার দিকে তাক করা।

গর্জে উঠল ওটা।

‘ঠুনন্‌’ করে অনুরণন তুলে ছিটকে গেল বুলেট কুড়ালের ফলায় লেগে। অসংখ্য বারের মত আরও একবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল রানা।

পরের গুলিটা আসার আগেই সমস্ত শক্তিতে ছুঁড়ে মারল ও কুঠারটা। এক পাক ঘুরে কাত হয়ে গাঁথল গিয়ে ওটা লোকটার কলার বোনের উপর। কাঁধের উপর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন মাথাটা দেখে পেটের মধ্যে গুলিয়ে উঠল রানার।

প্রাণহীন শরীরটা লুটিয়ে পড়তেই অস্ত্রটা ছুটে গেল হাত থেকে। শেষ মুহূর্তের বিস্ময় ও আতঙ্ক এখনও স্থির হয়ে রয়েছে লোকটার চোখের মণিতে। এ দুনিয়া ছেড়ে অন্য লোকে পৌঁছে গেছে, কিন্তু এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সেটা।

ঝাঁপ দিল রানা কুঠারটার জন্য।

এক সেকেণ্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। বিশালদেহী শুটারের এআর-ফিফটিনের জবরদস্ত ফায়ার কাঠের গাদার পিছনে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল ওকে। লাকড়ির স্তূপের গায়ে ঝাঁকে ঝাঁকে বিঁধতে লাগল বুলেট, উড়তে লাগল চলটা।

এ অবস্থায় অস্ত্রটা হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে পড়তেই, উঁকি মেরে দেখতে পেল রানা, চেম্বারের সমস্যা ঠিক করায় ব্যস্ত বিশালদেহী। গুলি বেরোচ্ছে না এআর-ফিফটিন থেকে।

মূল্যবান একটা মুহূর্ত। ইস্পাত আর অ্যালুমিনিয়ামের নিস্ক্রিয় জড়বস্তু ছাড়া এ মুহূর্তে আর কিছুই নয় রাইফেলটা।

ছুটে গেল রানা লোকটার দিকে।

ওকে আসতে দেখল দানব। ডিসচার্জ না হওয়া বুলেটটা সরাতে পেরেছে চেম্বার থেকে। ম্যাগাজিনটা ফেলে দিয়েই ট্যাকটিকাল ভেস্ট থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিল আরেকটা। সড়াত করে বসিয়েছে ওটা রাইফেলের খোপে, দীর্ঘ এক ডাইভ দিয়ে হুড়মুড় করে পড়ল রানা লোকটাকে নিয়ে।

শুরু হলো গ্রিজলি ভালুকের সঙ্গে মানুষের মল্লযুদ্ধ।

শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যবহার করতে হলো রানাকে লৌহমুষ্টি থেকে মোচড় মেরে রাইফেলটা কেড়ে নেয়ার জন্য। নিজের দুই হাঁটু দিয়ে চওড়া শরীরটা চেপে ধরে রেখে আঘাতের পর আঘাত করে চলল বাঁট ঘুরিয়ে, যতক্ষণ না কালো মুখোশ চুইয়ে বেরিয়ে এল রক্ত।

‘কাদের লোক তুমি?’ কথাটা বলেই আরও দু’বার কুঁদোর বাড়ি মারল রানা। ‘জবাব দাও এক্ষুণি!’

কথায় নয়, জবাব এল শারীরিকভাবে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড জোরে রানার চিবুকে আছড়ে পড়ল ঘুসি।

ছিটকে পড়ল ও পিছনদিকে। ঝাপসা হয়ে গেছে মগজটা।

অরক্ষিত মুহূর্ত। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে যেন রানা। চেতনা শুষে নেয়ার পাঁয়তারা করছে সর্বগ্রাসী ব্ল্যাক হোল। পিটপিট করতে লাগল চোখ দুটো। বারংবার মাথা ঝাঁকিয়ে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে নিজেকে।

সময়মত ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে উঠতেই স্বাভাবিক আত্মরক্ষার তাগিদে লাথি হাঁকাল ও ঘুসির বর্ষণ প্রতিহত করতে।

লড়াইয়ে ফিরে এসেছে রানা। মরিয়ার মত যুঝতে যুঝতে এক গাছি চুল খামচে ধরতে পারল মাস্কের ভিতর দিয়ে। ভালুকদেহী মাথা ঝাঁকাতেই খাটো চুল সহ মুখোশটা খুলে চলে এল হাতে।

মাটিতে জড়াজড়ি করে নির্দয় মারামারির ফাঁকেও লোকটাকে চিনতে পারল রানা। প্যারিসে দেখেছিল একে। কঠোর মুখটা শীতল চোখে তাকিয়ে ছিল টানেলের মধ্যে গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করার সময়। আরেক বার ফ্লাইওভারের উপর থেকে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে।

হাতের কিনারা দিয়ে কোপ মারল রানা। টের পেল, নাক ভেঙে গেছে বদমাশটার। টু-শব্দটি পর্যন্ত করল না তার পরও। কোনও ধরনের ব্যথাবেদনাই অনুভব করছে না যেন। স্রেফ লড়ে যাচ্ছে রোবটের মত।

এড়াল রানা কণ্ঠার দিকে ছুটে আসা মুষ্ট্যাঘাতটা। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল দুই পায়ে। কিন্তু তৎপরতাটা খানিক মন্থর হয়ে যাওয়ায় এড়াতে পারল না লাথির আঘাত। আর এক ইঞ্চি নিচে লাগলেই চুর হতো হাঁটু।

পিছু হটল রানা টলোমলো ভঙ্গিতে। পিছনে থাকা কঠিন কিছুতে পা বেধে চিত হয়ে পড়ল ওটার উপর। শরীর অসাড় করে দেয়া যন্ত্রণার স্রোত বিদ্যুতের মত ছুটে এল শিরদাঁড়া বেয়ে।

নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে এবার ভালুকটা। এগিয়ে এল প্রতিপক্ষকে সমুচিত শিক্ষা দিতে। মুখের অর্ধেকটা ভেসে যাচ্ছে রক্তে।

দৌড় দিল সেলেনা কুড়াল গাঁথা লাশের উদ্দেশে। মরা মানুষটার বুকে এক পা তুলে দিয়ে সজোরে টান মেরে খুলে আনল কুড়ালের ফলা। অস্ত্রটা মাথার উপরে তুলে আমাজন নারীদের মত রণহুঙ্কার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সোনালিচুলোর উপর।

মৃত্যুফলা এগিয়ে আসতে দেখে শরীর পিছিয়ে নিয়ে কোপ এড়াল দানব। তবে ধারাল কুড়াল চিরে দিল ওর কমব্যাট ভেস্ট।

সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছে সেলেনা হামলাটার পিছনে। ভারি ব্লেডের ওজনে ঘুরে গেল শরীর। অরক্ষিত হয়ে পড়ল ও শত্রুর সামনে।

কষে কমব্যাট বুটের লাথি লাগাল লোকটা সেলেনার নিতম্বে। এমন বেকায়দাভাবে হুমড়ি খেল যে, কপালের পাশে ছাউনির ফ্রেমের চোখা কোনা লেগে জ্ঞান হারানোর দশা হলো ওর। ঘোলাটে মগজ নিয়ে পড়ে গেল ও ভারসাম্য হারিয়ে।

এদিকে ব্যথার মাঝেও বুঝতে পেরেছে রানা, লগ স্প্লিটার মেশিনের উপর পড়েছে ও। হাচড়ে-পাছড়ে চেষ্টা করল সোজা হওয়ার। তার আগেই ছুটে এসে ঘুসি হাঁকাল সোনালি-চুল।

ফের চিত হয়ে পড়ল অসহায় রানা। রক্তের নোনা স্বাদ ঠোঁটে। তারা দেখছে চোখের সামনে।

স্ট্যাটিক ভার্টিকাল কাটিং ব্লেডের বিপজ্জনক নৈকট্যে এমনভাবে আটকে গেছে ডান নিতম্ব, গড়ান দিয়ে সরে যাওয়ার উপায় দেখছে না। পা দুটোকেও পারছে না কাজে লাগাতে।

আরেকটা ঘুসি খেয়ে আরও বেশি লাল-নীল তারা ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে।

মেশিনের দিকে থাবা বাড়িয়ে স্টার্টার কর্ডে জোরসে টান দিল দানব। ফরফর করে ওঠার পরের মুহূর্তেই জান্তব গর্জন ছাড়ল পেট্রোল মোটর।

মুখের উপর থেকে রক্ত মুছে নিয়ে লালচে হাসি হাসল বিরাটদেহী। মেশিনের উপরদিকের ভার্টিকাল লিভার টানতেই মোটর হাউসিং থেকে বেরিয়ে এল স্টিলের র‍্যামার।

সময়মত মাথাটা পরিষ্কার হয়েছে রানার। হ্যাঁচকা ঝাঁকিতে শরীর মুচড়ে আলাদা হতে পারল ও যন্ত্র থেকে। আরেকটু হলেই র‍্যামারটা ঠেলে দিত ওকে ব্লেডের দিকে। টুকরো করে ফেলত ওকে তীক্ষ্ণধার ফলা।

মাটিতে লুটিয়ে পড়ল রানা। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে!

ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়ে অট্টহাসি হাসছে দানবটা। মেশিনের পাশ ঘুরে এসে ঝুঁকে দাঁড়াল রানার উপর।

‘ঈমানে বলছি—কীসের জন্যে এ চোর-পুলিস খেলা, সত্যিই জানা নেই আমার। কিন্তু তোমার মত একজনের মুখোমুখি লড়ার খায়েশ ছিল বরাবরই। কথা হচ্ছে, জনাবের দৌড় কি এটুকুই?’

দীর্ঘদেহীর দিকে চোখ তুলে চেয়ে আছে রানা।

‘দ্য নেম ইজ গিবসন… ডোনাল্ড গিবসন।’ রক্ত মেশা এক দলা থুতু ফেলে হাসল জেমস বণ্ডের ডায়ালগ ধার করা খলনায়ক। ‘রিপেয়ারম্যান বলে ডাকতে পারো আমাকে। তোমাকে খতম করার পর মজা করব তোমার বান্ধবীটাকে নিয়ে।’

বুট তুলল সে প্রচণ্ড পদাঘাতে রানার করোটি ফাটিয়ে দেবে বলে।

নিরেট কীসের ছোঁয়া লাগছে শ্রীরের নিচে,

বুঝে উঠতে দুই সেকেণ্ড লাগল রানার। প্রথমে ভেবেছিল, পাথর বুঝি ওটা। কিন্তু তার চেয়ে অনেক শীল জিনিসটা। চোখা আর সমতল।

পুরো শক্তি আর ওজনে নেমে আসছে গিবসনের কমব্যাট বুট, ধাঁই করে উপরদিকে ছুটে গেল রানার শরীরের তলা থেকে বেরিয়ে আসা কুড়ালের হাতল। ‘থ্যাপ’. করে রিপেয়ারম্যানের উরুসন্ধিতে আঘাত হানল হিকোরি কাঠ।

ভাঙা নাক কোনও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি গিবসনের মধ্যে। কিন্তু এবার আর পারল না নির্বিকার থাকতে। যন্ত্রণার চোটে মনে হলো, এক লাফে উঠে যাবে আসমান ফুঁড়ে। ‘ঘোঁত’ করে একটা গোঙানি ছেড়ে টলতে টলতে পিছাল বীরপুরুষ, কুঁচকি চেপে ধরেছে দুই হাতে।

সিধে হলো রানা। কুড়ালটা উল্টে নিয়ে ব্লেডের চ্যাপ্টা পাশ দিয়ে ধাঁ করে মেরে বসল রিপেয়ারম্যানের মুখে; একবার নয়, পর পর দু’বার।

গর্জনরত কাঠ চেরাইয়ের কলের উপর গিয়ে পড়ল গিবসন বেকায়দা ভঙ্গিতে।

‘মজা করবি, না?’ নিঠুর নিয়তির মত শোনাল সেলেনার গলা। শীতল ক্রোধ দু’চোখের তারায়!

তাকিয়ে দেখল রানা, দীর্ঘ পদক্ষেপে মেশিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। রক্ত লেপটে রয়েছে কপালের পাশে।

গিবসন সরে যাওয়ার আগেই ভার্টিকাল লিভার টানল সেলেনা। হাউসিং থেকে বেরিয়ে এসে লোকটার পাঁজরে ধাক্কা দিল ইস্পাতের র‍্যাম। মোটরের শক্তি ওকে খাঁজ কাটা ব্লেডের দিকে ঠেলে নেয়া শুরু করতেই মরণ-চিৎকার ছাড়ল রিপেয়ারম্যান।

বহু মানুষের বীভৎস পরিণতি দেখেছে রানা। কিন্তু এবারে বাধ্য হলো চোখ ফিরিয়ে নিতে। গিবসনের অমানুষিক আর্তচিৎকার আর নিষ্করুণ যন্ত্রের গায়ে উন্মত্ত পিটুনির আওয়াজই বলে দিল ওকে, কী ঘটতে চলেছে লোকটার ভাগ্যে।

তিন সেকেণ্ডের বেশি স্থায়ী হলো না খুনিটার চিৎকার। রক্ত মাখা মেশিনের এক পাশ দিয়ে ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়ল কাটা পা দুটো, কাঁপছে প্রচণ্ড আক্ষেপে। থপাস করে ধড়টা পড়ল আরেক দিকে। চোখ জোড়া চেয়ে রয়েছে নিষ্পলক। ইঞ্জিনের হুঙ্কার ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই কোথাও।

এগিয়ে গিয়ে স্প্লিটারের সুইচ অফ করে দিল রানা।

‘বদলা নিলাম!’ নিচু গলায় বলল সেলেনা।

মাথা ঝাঁকিয়ে তাকাল রানা জ্বলন্ত ধ্বংসস্তূপের দিকে। ঝোপগুলোর দিকে সরে গেল দৃষ্টি।

‘চলো, দেখি, ভিকান্দারের কী অবস্থা,’ বলল ও গম্ভীর গলায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *