1 of 2

শকওয়েভ – ১৮

আঠারো

অ্যালপিনা চালু হতেই ফোনের দিকে হাত বাড়াল উল্টো দিকের রাস্তায় দাঁড়ানো কালো পুযো ফাইভ জিরো এইট-এর দুই আরোহীর একজন

‘সচল হয়েছে টার্গেট,’ জানিয়ে দিল ওপ্রান্তের কাউকে। ‘এখনও সাথে রয়েছে পুরুষটা।

মনমাট্রা থেকে অ-নে-ক দূরে, সিংহাসনের মত উঁচু এক চেয়ারে সমাসীন বৃদ্ধ লোকটা রয়েছে নিজের আরামদায়ক অফিসে। হাতের সুদৃশ্য চায়না কাপে গরম কফি।

অধিকাংশ লোকই স্রেফ চিফ হিসাবে চেনে ডেস্কের পিছনের বয়স্ক মানুষটাকে। বাইফোকাল চশমার পুরু লেন্সের ভিতর দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে চিফ এ মুহূর্তে হাই- ডেফিনিশন অনস্ক্রিন একটা ইমেজের দিকে। লিটল ডেণ্টনের এক পার্কবেঞ্চে বসে গল্প করছে এক যুবক ও যুবতী।

সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ওই ঘটনার পর, সফিস্টিকেটেড ফেইশাল রিকগনিশন সফটওয়্যারে দেয়া হয়েছিল লোকটার ফোটোগ্রাফ। আইডেন্টিটি ম্যাচের জন্য অ্যানালাইয করা হয়েছে ক্লাসিফায়েড রেকর্ডগুলো। যাচাই-বাছাই শেষে যে- নামটি বেরিয়ে এসেছে, সেটি হলো: মাসুদ রানা চৌধুরী।

যে-অর্গানাইজেশন পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত প্রবীণ চিফের উপর, সেটার হাত অনেক লম্বা। মাসুদ রানা সম্বন্ধে সর্বশেষ তথ্যগুলো হাতে আসার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে, ঠিক কী ধরনের লোকের সঙ্গে টক্কর লেগে গেছে তাদের। ইংল্যাণ্ডের এক পাড়াগাঁয়ে কেন লেজেগোবরে হয়ে গেছে অতি সাধারণ একটা ক্লিন-আপ অপারেশন, তার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা মিলছে এখন।

ইস, বড় ধরনের একটা ভুল হয়ে গেছে ওদের হিসাবে! যদিও এর দায় পুরোপুরি বর্তায় না অ্যাসাইনমেন্টের দায়িত্ব নেয়া পেশাদার দু’জনের উপর।

পরাজয়ের বেদনা পোড়াচ্ছে বৃদ্ধ চিফকে। তবে সেটা খুব তীব্রভাবে নয়। ভুল মানুষেরই হয়। এমনতরো ভুল যাতে আবারও না হয়, সেটাই নিশ্চিত করতে হবে এখন।

দুটো প্রশ্নের শুধু জবাব পাচ্ছে না এখনও। মাসুদ রানা নামের লোকটা কীভাবে জড়িয়ে গেল সেলেনা বার্নহার্টের সঙ্গে? দ্বিতীয়ত: কোথায় লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল ওরা?

ভেবে কোনও কূলকিনারা পাচ্ছে না বৃদ্ধ। ক্যারেন ল্যানকাউমের অ্যাপার্টমেন্ট-বাড়িটায় যদি নজর রাখার ব্যবস্থা না হতো, হয়তো আর পাওয়াই যেত না ওদেরকে। অত্যন্ত ধুরন্ধর ব্রেইন এই মাসুদ রানা লোকটার!

অনেক পরিচয় ওর।

রানা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির কর্ণধার ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর। পৃথিবীর প্রায় সব বড় বড় শহরে শাখা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। ব্যবসা করছে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে।

আমেরিকান সংস্থা ন্যাশনাল আণ্ডারওয়াটার অ্যাণ্ড মেরিন এজেন্সি বা নুমা-র অনারারি প্রজেক্ট ডিরেক্টর। আবার সাগরগামী মস্ত সব জাহাজের বিশাল বহরের মালিকও সে। অর্থাৎ, টাকার অভাব অন্তত নেই।

নাম করেছে শৌখিন আর্কিয়োলজিস্ট ও সফল ট্রেজার হান্টার হিসাবে। মেক্সিকো, উরুগুয়ে, পেরু এবং আরও অনেক দেশে অবিশ্বাস্য সব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার রয়েছে তার।

কয়েক বার হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে বের করেছে জঙ্গল-পাহাড়-মরুভূমি ও সাগর ছুঁড়ে।

চ্যাম্পিয়ন কার-রেসার, দক্ষ স্নাইপার, ফার্স্ট ক্লাস কমাণ্ডো, জাতিসংঘের অ্যান্টি-টেররিস্ট অর্গানাইজেশনের স্পেশাল এজেন্ট… পরিচয়ের লিস্টটা আরও অনেক লম্বা।

পদকের শেষ নেই বাংলাদেশ আর্মির সবচেয়ে কমবয়সী এ-মেজরের। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স নামে এক সরকারি সংস্থায় যোগ দেয়ার জন্য আর্লি- রিটায়ারমেন্ট নিয়েছে সেনাবাহিনী থেকে। এমনকী সিআইএ-রও কোনও অপারেটর নেই, যাকে তুলনা করা যাবে এর সঙ্গে।

এরকম কোয়ালিফিকেশনঅলা কেউ যে এমন চালাক- চতুর হবে, এ আর বিচিত্র কী! করিতকর্মা এবং সামর্থ্যবান হয় এরা। কই মাছের জান দিয়ে পাঠানো হয় দুনিয়ায়। কোনও প্রতিবন্ধকতাই আটকে রাখতে পারে না এই প্রজাতির মানুষগুলোকে।

এ ধরনের চরিত্রগুলোর প্রতি গোপন দুর্বলতা রয়েছে চিফের, ঈর্ষা করে অন্তর থেকে। এর কারণ, নিজেও সে এক সময় ছিল ঠিক এই রকম। এখন ভাবলে মনে হয়, আরেক জনমের ঘটনা সেগুলো।

ডেস্কে ঠেস দিয়ে রাখা সর্বক্ষণের সঙ্গী ওয়াকিং স্টিক দুটো দেখল বৃদ্ধ। একটা আবলুস কাঠের, আরেকটা আইভরির। জটিল হস্ত-নকশা রয়েছে বিশেষভাবে বানানো এই ছড়ির রুপোর হাতলে। ব্যবহারই যখন করতে হচ্ছে, ভালো কিছু নয় কেন!

মাসুদ রানার মত এমন ওয়ান-পিস ক্যারেকটারকে মাইনাস করাটা যে অপূরণীয় ক্ষতি, মনে মনে স্বীকার করল বৃদ্ধ। কিন্তু প্রজেক্টের স্বার্থে আর তো কোনও বিকল্প নেই এ ছাড়া! পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে যারাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রত্যেককেই বিসর্জন দিতে হয়েছে পিতৃদত্ত প্রাণটা। সংখ্যায় কম নয় তারা। রানার বেলায় এর ব্যতিক্রম হবে কেন?

প্রজেক্টের এই পর্যায়ে এসে, কোন্ সিস্টেমে আউট করা হচ্ছে, সেটার কোনও গুরুত্ব নেই বৃদ্ধের কাছে। কেবল একটা বিষয় ছাড়া—যেভাবেই হোক, উপড়ে ফেলতে হবে পথের কাঁটা। দরকারে ব্যবহার করবে সমস্ত রিসোর্স আর ক্ষমতা। দুটোর কোনটারই কমতি নেই চিফের। স্রেফ একটা আঙুল নেড়ে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করতে পারে যে-কারও।

‘ট্র্যাকিং ডিভাইস লাগানো হয়েছে তো গাড়িতে?’ জানতে চাইল নাটের গুরু।

‘হয়েছে, বস।’

‘গুড। কী করতে হবে, জানো তোমরা।’

ফোন রেখে দিল চিফ। হেলান দিল চেয়ারের পিছনে। হাড্ডিসার হাত দুটো আর্মরেস্টে রেখে আঙুল পুরল আঙুলের খাপে। একই সঙ্গে মুদে এল চোখ দুটো।

শিগগিরই জানা যাবে শিকারের গন্তব্য। এর পর অবস্থা বুঝে দেবে প্রয়োজনীয় নির্দেশ। মাত্র দুয়েকজনের জন্য প্যারিসের অর্ধেক লোককে বলির পাঁঠা বানানোর মানে হয় না কোনও।

লো-প্রোফাইল অপারেশনের গ্র্যাণ্ডমাস্টার বৃদ্ধ। ঋদ্ধ সে পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *