১০০
মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভাল।
এইখানে পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।
তাদের সম্রাট নেই, সেনাপতি নেই;
তাদের হৃদয়ে কোনো সভাপতি নেই;
শরীর বিবশ হলে অবশেষে ট্রেড-ইউনিয়নের
কংগ্রেসের মতো কোনো আশা-হতাশার কোলাহল নেই।
অনেক শ্রমিক আছে এইখানে।
আরো ঢের লোক আছে
সঠিক শ্রমিক নয় তারা।
স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিধি
থেকে ঝরে এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃতবৎ ঘোরে।
.
রাসুদা এর আগে এসেছেন কয়েকবার তাদের বাড়িতে। সে সবই তাদের দারুণ দুর্বিষহ অবস্থায়। যখন সে আর বোধিসত্ত্ব দিনযাপন করছে শোকের পর্বতশ্রেণি পার হতে হতে।
তারপর এই এলেন রাসুদা। এখন শোক সিদ্ধার্থর কাছে ধরা দেয় অন্য রূপে।
বসে আছে তারা। মুখোমুখি। সিদ্ধার্থর বিছানায়, প্রাচীন আমলের রেলিং তোলা খাটে পিঠ দিয়ে। রাসুদা বলছেন—এ আমার ব্যক্তিগত অনুরোধ। সিধু, তোকে আমাদের প্রয়োজন। এ রাজ্যের কর্ণধার হয়ে উঠবি তুই একদিন। আমি জানি। এই দলকে নেতৃত্ব দিবি তুই।
সিদ্ধার্থ বলছে—এসব বলবেন না আমাকে রাসুদা। আপনি জানেন আপনাকে কতখানি শ্রদ্ধা করি আমি। আজ আপনি নিজে এসেছেন। আমি না বলতে পারি না। কিন্তু সে আমার মনের বিরুদ্ধে যাওয়া হবে। এভাবে কতদিন টানা যায়?
—কেন এত জেদ করছিস? হ্যাঁ, তোর অভিযোগ থাকতে পারে। সত্যি কথা বলতে গেলে অভিযোগ আমাদের প্রত্যেকেরই আছে অল্প-বিস্তর। কিন্তু সে অভিযোগ আমরা কার কাছে করব! দল আকারে বেড়ে উঠলে তার মধ্যে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধিও ঢুকে পড়ে। আমরা তাকে চিহ্নিত করব। তার থেকে দলকে মুক্ত করব। এ তো আমাদেরই কাজ। আমরা তো অন্যান্য দলের মতো অভিভাবকের ভাবমূর্তিতে বিশ্বাস করি না। কোনও গডফাদার বা মাদারগডেস আমাদের নেই। আমরাই আমাদের ভুল। আমরাই আমাদের শুদ্ধ। অভিযোগ করলে তা আমাদেরই গায়ে এসে পড়বে। হ্যাঁ, ত্রুটি থাকলে সংশোধন করতে হবে। আমরা তো কেউ সংশোধনবিরোধী নই।
—সংশোধন করবেন রাসুদা?
—নিশ্চয়ই তোর অভিযোগে যুক্তি থাকলে কেন করব না?
—মানুষই আমাদের শক্তি, দলে এসে আমি এ শিক্ষা পেয়েছিলাম।
—নিশ্চয়ই।
কিন্তু আমরা কি মানুষের থেকে সরে যাচ্ছি না? আমাদের সমস্ত কাজ কি দলকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে না? সমর্থন অভিমুখী সমস্তই। যেন সমর্থনের বিনিময়ে আমরা হাতে তুলে দিতে রাজি যাবতীয় সুযোগ। এ এক অদ্ভুত বাণিজ্য রাসুদা। কিন্তু আমার আস্থা আছে। সুযোগ্য নেতৃত্বের হাতে এই প্রবণতা আমরা রোধ করতে পারব। তখন প্রকৃত জনকল্যাণমুখী হয়ে উঠবে সমস্ত কাজ। কিন্তু এ ছাড়াও যে আরও আছে রাসুদা। মহম্মদ খানের মতো মানুষের চোখ উপড়ে নেবার অত্যাচার করে কারা? বাচ্চাদের স্কুলে আগুন ধরিয়ে দেবার জন্য কারা লোক নিয়োগ করে? পরমেশ্বর সাধুখাঁর মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষকে কারা নৃশংসভাবে হত্যা করে? এর বিহিত হোক আগে।
—আমার একটা ঘটনার কথা বলি তোকে?
—বলুন।
—চুয়াত্তর সালের কথা। এই শহরেই সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলাম কাজে। হঠাৎ দেখি, একটি বউ তার স্বামীকে বুকে করে বসে আছে। লোকটার মাথা চোখ নাক ঘিরে ধারালো কোপের দাগ। রক্ত পড়ছে। গোঙাচ্ছে লোকটা। কেউ তাদের সাহায্য করছে না। দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল কয়েকজন। জিগ্যেস করলাম—কী হয়েছে! বলল, এর ভাই সি পি এম করে তো, তাই মেরেছে। কংগ্রেসের লোকেরা মেরেছে। ভাইকে পায়নি। একে মেরেছে।’ সতু দত্তর কথা জানিস তুই সিধু। কংগ্রেসি গুণ্ডাদের হাতে খুন হয়েছিল ওই সময়। জয়েনুদ্দিনের কথাও তুই জানিস। কেয়া ঘোষ, ইমদাদুল…কত নাম করব?
—ওরা যা করেছিল আমরাও তাই করব তা হলে সিধুদা? আমরা তা হলে ওদের জমানা পালটাতে চেয়েছিলাম কেন?
—আমরা কি কিছুই পালটাইনি?
—হ্যাঁ, পালটেছি। আমরা বর্গা করেছি। জনজীবনে এই ধারণা আমরা এনেছি যে একটা পাখিকেও গান গাইতে গেলে পাড়ার দাদার অনুমতি নিতে হয়। আমরা অনেক কিছু করার পরেও মহম্মদ খানের চোখ উপড়ে নেওয়া হয়।
—মহম্মদ খানের ব্যাপারটা গুন্ডাদের কাজ।
—কারা পুষত সে গুন্ডা? তারা গ্রেপ্তার হল না কেন?
—সিধু, দীপেন হাজরা সম্পূর্ণ নিখোঁজ আজও। কেন? সাধারণত এ ধরনের লোক গা ঢাকা দেয় এবং আবার ফিরে আসে।
—সে তো পুলিশের জানার কথা।
—সিধু, এখানে কেউ নেই। শুধু তুই আর আমি।
সিদ্ধার্থ এক মুহূর্ত থমকায়। সে কি বলবে? সমস্ত ঘটনা?
না। মুহূর্তে সে সকল আবেগ সরিয়ে একজন সচেতন রাজনৈতিক মানুষ হয়ে যায়। তার সমস্ত অন্তরাত্মা বলে— না।
এবং, এই গোপনীয়তার মধ্যে আছে যে অবিশ্বাস, তার জন্য অনুতাপ বোধ করে সে। দুঃখ পায়। সে বোঝার চেষ্টা করে, তা হলে কি তার মধ্যে কোথাও নিরাপত্তার অভাববোধ হয়েছে এই দলত্যাগের কারণে? ক্রমে ক্রমে সে হয়ে উঠছে এমনকী শ্রদ্ধেয় রাসুদা সম্পর্কেই সন্দিহান!
এক বিষাদের ভেতর তার হৃদয় ছটফট করে। কিন্তু এখন তার মস্তিষ্ক সজাগ। হৃদয়ের কাছে মস্তিষ্ককে পরাস্ত হতে সে দেয় না। সে ঠান্ডাভাবে বলে—আমার কাছে যতদূর খবর আছে, এ
ওদের দলের গোলমালের ফল।
সিধুদা সিদ্ধার্থর চোখের ওপর চোখ রাখেন। বলেন—স্কুলের বিষয়ে তুই কী জানিস?
—জানি না। সন্দেহ করি।
—কাকে? কেন?
সিদ্ধার্থও সরাসরি তাকায় রাসুদার চোখের দিকে। বলে-রাসুদা। এখানে আমি আর আপনি কেবল। বলুন না আপনি কিছু সন্দেহ করেন না?
—সন্দেহের বশে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া কি ঠিক?
—না। শুধু সন্দেহ বললে কম বলা হয়। এটা অনুমান। রাসুদা, অনুমান-ক্ষমতা মানুষের সম্পদ। কারণ যুক্তিবোধ-মাধ্যমেই আসে অনুমান।
—কিন্তু অনুমান তো প্ৰমাণ নয়।
—আমি প্রমাণ করে দিতে পারি। কিন্তু তার পদ্ধতি সহ্য হবে না আপনাদের।
—আমার কথা রাখবি না তুই সিধু?
—আমি দুঃখিত রাসুদা।
—কী চমৎকার মিছিল করলি। লোক তোকে ভালবাসে। সারা মুর্শিদাবাদে এই বয়সেই এত জনপ্রিয়তা আর কারও ছিল বলে আমার জানা নেই। কিন্তু তোর তো শত্রুও বাড়ছে। কোনও দলের আশ্রয় তোর দরকার। কিছু ভেবেছিস এ বিষয়ে? তুই কংগ্রেসে যাচ্ছিস বলে প্রচার আছে। আমি তা বিশ্বাস করি না।
—না। যাব না। আপনি ঠিকই বলেছেন।
তবে একটা কথা তোকে ভেবে দেখতে হবে সিধু, এই যে তোর মিছিলের সাফল্য, এ কিন্তু এ জন্যই যে তুই সি পি আই এম-এর গুরুত্বপূর্ণ যুব সদস্য। আমি নিশ্চিত, সি পি আই এম-এর সমর্থকরা তোর মিছিলকে সফল করে তুলেছে। কারণ অতখানি শৃঙ্খলা, অতখানি উৎসাহ, এ রাজ্যে আমাদেরই একমাত্র আছে। মিছিলের যে-পরিকল্পনা তুই করেছিস, তার মধ্যে অভিনবত্ব আছে। কিন্তু ভেবে দেখতে হবে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই শৃঙ্খলা এবং জীবনের উন্নয়নের বোধ গড়ে তুলেছিল কমিউনিস্ট পার্টিগুলিই।
সিদ্ধার্থ চুপ করে শুনছে। এবার বলল— লোকসাধারণের মধ্যে সুস্থ জীবন প্রাপ্তির অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করেছে বামপন্থী দলগুলি। এ তো ঐতিহাসিকভাবে সত্য। কিন্তু দেখো সিধুদা, তা যেমন সার্বিক হয়ে ওঠেনি, তেমনি অধিকার সচেতন মানুষগুলিরও যে একটা কর্তব্যের দায় আছে, সেই মাত্রাবোধও চর্চিত হয়নি। অধিকার এবং দায়িত্ব পাশাপাশি চলে। এটাও কি ভেবে দেখার বিষয় নয় যে, অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে গিয়ে আমরা মাতৃভূমির প্রতি আমাদের কিছু অঙ্গীকার ও দায়িত্ব ভুলিয়ে দিচ্ছি না তো? চারদিকে এত দুর্নীতি কেন? কামচোর মনোবৃত্তি কেন?
—কাজ করলে তবেই শেখা যায়। কারণ ফলাফল দেখে তবেই সংশোধনের প্রশ্ন আসে। আমরা সমস্তই শুধরে নিচ্ছি। শুধরে নেব। তার জন্য সময় চাই। নেতৃত্ব চাই। তোর সেই ক্ষমতা আছে। কিন্তু তুই তো ছেড়ে চলে যাচ্ছিস।
—এভাবে বলবেন না রাসুদা।
—অভিমান তোকে অনমনীয় করেছে, সিধু।
—এ শুধু অভিমানের প্রশ্ন নয়।
—তা হলে?
—আমি ঠিক জানি না। ঠিক ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না।
—তা হলে নিখিলেশদার সঙ্গে কাজ কর তুই। উনি তোকে চান। আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে ওঁর। কখনও সেরকম বুঝলে দলে ফিরে আসার পথও খোলা রইল তোর। পর পর দু’টো মৃত্যু সিদ্ধার্থ। অত্যন্ত মর্মান্তিক। জেলায় পরমেশ্বর সাধুখাঁ। কেন্দ্রীয় স্তরে রাজীব গাঁধী। এই মৃত্যু কাম্য নয়। সমর্থনযোগ্য নয়। এই দুই হত্যার জন্যই আমার কষ্ট আছে। কিন্তু ভেবে দেখেছিস কি, এই দুই হত্যার দৌলতে কেন্দ্রে, রাজ্যে, জেলায় কংগ্রেস সহানুভূতির সমর্থন পেয়ে যাবে অনেকখানি। এই সময় আমাদের তো উচিত আরও বেঁধে বেঁধে থাকা। নয়? বল?
—না রাসুদা। বিভিন্ন ঘটনার পরিণতি যে-কোনও দলকেই সামলাতে হয়। তা ছাড়া সহানুভূতির সমর্থন দীর্ঘস্থায়ী হয় না কখনও। এই দু’টি হত্যার কারণে আমি সিদ্ধান্ত বদলাতে পারি না। আর এস পি-তে যাব না আমি। হয় দলে থাকব, নয় দলের বাইরে।
—ভেবে দেখিস আমার কথা।
—ভাবব রাসুদা।
রাসুদা বিছানা হতে নেমে দাঁড়ান। সিদ্ধার্থও নামে। বলে—রাগ করলেন রাসুদা?
—না রে। তোর মধ্যে এতখানি প্রতিবাদ আছে, এ তো ভাল লক্ষণ। আমি বড় বেশি স্থিত হয়ে গেছি রে। আমার মধ্যে আর প্রতিবাদের আগুন নেই।
—একা যাবেন?
—একাই এসেছি।
—চলুন পৌঁছে দিই আপনাকে।
—তারপর তো তুই একা ফিরবি। সেটা ঠিক হবে না সিধু —না না। অত ভয় পাবার কিছু নেই। চলুন।
নির্জন পথ। কোথাও একটিও রিকশা নেই। তারা হেঁটে যায় পাশাপাশি। কথা বলে অতি কম। রাসুদা হারাধনের বিষয়ে জিগ্যেস করেন। সে উত্তর দেয়। হারাধন জেলে আছে। ধুঁকছে। এবং পনেরো মিনিটের পথ সুদীর্ঘ লাগলেও ফুরিয়ে আসে একসময়। রাসুদা সিদ্ধার্থর হাত ধরেন—আসি!
—হ্যাঁ রাসুদা।
—সাবধানে যাস।
—যাব।
—আমি যে গিয়েছিলাম তা…
-–বলব না।
—আসি।— রাসুদা।
—বল।
—ব্যক্তিগত সম্পর্ক হিসেবে রাসমোহন দত্তর কাছে কি সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় যেতে পারে কখনও?
—পারে। যখন মনে হবে, আসিস।
—রাজনৈতিক বৈরোধিত্য ব্যক্তিগত সম্পর্ককে মেরে ফেলে না তো!
—না সিধু। আমার বিশ্বাস, ফেলে না। যদি কোনও দু’টি মানুষ তা বজায় রাখতে চায়।