৯৬
চৈত্রে চাতক পাখি
ডাকে পিয়া পিয়া।
বিধাতা বঞ্চিত কৈল
হাতে নিধি দিয়া ।।
পলাশ কাঞ্চন যত
বিকশিত ফুল।
আর নি প্রাণের নাথ রে
আসিবে গোকুল ॥
.
দশদিন বহরমপুরের যক্ষ্মা হাসপাতালে কাটিয়ে এসেছে আফসানা। সামান্য স্বাস্থ্য ফিরেছে তার। এখনও রোগা-ভোগাই দেখতে লাগে তাকে। তবু, একেবারে হাড়-কাঁকলাস অর্ধচেতন অবস্থা হতে ফিরেছে সে।
দশদিনের জন্য দুধের শিশুটিকে শাশুড়ির কাছে রেখে গিয়েছিল। তাদের পড়শি নুরুল মাঝির বউ তারই সঙ্গে সঙ্গে পোয়াতি হয়েছিল। কোলে তারও শিশু থাকায়, এই দশদিন খালেদা নুরুল মাঝির বউ ইমতিয়ানার কাছেই বারবার নিয়ে গিয়েছিলেন আফসানার শিশুটিকে। আপন সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে আফসানার সন্তানকেও স্তন্য দিয়েছে ইমতিয়ানা।
আফসানা শিশু ফেলে যেতে চায়নি। এমনকী আকবর আলি প্রথম যেদিন তাকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, সেদিনও তীব্র আপত্তি করেছিল। বলেছিল— আমার অসুখ আপনি সারবে। এখন এই খরার সময়, রোজগারপাতি বন্ধ, এখন কেন আমায় নিয়ে হাসপাতালে যাও!
ধুঁকতে ধুঁকতে বলেছিল সে। কাশতে কাশতে বলেছিল। রোগা হাড়-কাঁকলাস শরীরের খাঁচা বেঁকে-চুরে যাচ্ছিল ওই কাশির দমকে।
বুঝি-বা কিছু করুণাও হয়েছিল আকবর আলির। মায়া হয়েছিল। নরম পেলব তুলোর মতো মায়াটান ফুটেছিল চোখে তার। সে বলেছিল—এমুন কথা কয়ো না বিবি। তুমি না আমার আসমানের চান্দ! চান্দের এমুন ক্ষয়া ক্ষয়া দশা দেখলে পরানে বড় বাজে।
আফসানা গলে যাচ্ছিল। ভেসে যাচ্ছিল। আঃ! কতদিন, কতদিন পর এমন বুক জুড়ানো প্রাণ জুড়ানো কথা। যেমন শৈশবে, মোটা মোটা গুলঞ্চের শাখা ধরে দোল খেত সে, তেমনি ওই কথাগুলোই বুকে আঁকড়ে আবেশে দোল খেয়েছিল সেদিন। গায় পাখি-ই, যায় পাখি-ই, ওড়ে পাখি-ই, ঘোরে পাখি-ই। গায় পাখি-ই, যায় পাখি-ই, ওড়ে পাখি-ই, ঘোরে পাখি-ই!
অতএব, ধুঁকতে ধুঁকতে, টলতে টলতে সে গিয়েছিল। বাসরাস্তা অবধি গিয়েছিল কোনও মতে।
কতদিন পর এই বেরুনো তার। কতদিন পর এই পথ-ঘাট দেখা। রোগ ভুলে সে কেবলই দেখছিল চেয়ে। বাসের জানালা হতে পিছলে চলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। ওই একটা গোরু। আহা নধর। গলায় কাঠের ঘণ্টা দোলে। তার শব্দ শুনতে পেল না আফসানা, তবু সে জানে, শব্দ উঠছে ঠাপ ঠাপ, ঠপ-ঠরর।
ওই পথের ধারে ধারে কত ঘর-উঠোন। ন্যাংটো শিশুরা গড়াচ্ছে ধুলোয়। আহা, বৃষ্টিহীনতার ধু-ধু মাঠ। রোদ্দুরে শুকোচ্ছে ঠিলা। জোড়া বলদ নিয়ে রাস্তা দিয়ে চলেছে একজনা। কে জানে, দারিদ্র-পীড়নে বিক্রি করে দেবে কি না।
এবং একসময় শহর ধরা দিয়েছিল চোখে। সে, আকবর আলির সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল হাসপাতাল। তারপর আবার যাওয়া গ্রামে, শিশুটিকে রেখে হাসপাতালে আসা ফের। ডাক্তার বলেছিলেন, সাত থেকে দশদিনের জন্য ভর্তি হতে হবে। মাত্রই সাত থেকে দশ দিন। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, সে চিরকালের জন্য শিশুটিকে ছেড়ে যাচ্ছে। তীব্র বিচ্ছেদযন্ত্রণায় সে কাঁদাকাটা করেছিল। খালেদা তার অবস্থা দেখে বলেছিলেন—কত বড় নসিব তোমার! এমন স্বামী পেয়েছ! জেলেপাড়ার কটা বিবির অসুখ করলে হাসপাতালে নিয়ে যায় বলো তো! খোদার নাম করে যাও। রোগ সারিয়ে এসো। এ যা রোগ, এবার সারা বাড়িতে ছাইবে। আর শোনো, তোমার এঁটো পানি দিয়ো না কারওকে বাপু। থাল-বাসন সব আলাদা থাকবে তোমার। জুঠা খাবার-দাবার দিয়ো না সন্তানগুলিকে। আর চুমা খেয়ো না। ছোটটাকে শুধু বুকের দুধ দেবার সময় কাছে নেবে। অন্য সময় দূরে রাখবে। ছেলের জন্য অমন হেদিয়ে মোরো না। ছেলে চিরকাল কোলের থাকে? কথায় বলে—
ছোট ছেলে বড় হলে কী করবে মায়।
বর্ষা বাদল শুকিয়ে গেলে কী করবে নায়
কোল থেকে যত তাড়াতাড়ি নামাতে পারবে ততই স্বস্তি।
গিয়েছিল সে। সেখানে চিকিৎসা হয়েছিল তার। তার বুকের অসুখ। এ রোগ মারণ রোগ। ছোঁয়াচে। সেই বুকের অসুখের চিকিৎসা করিয়ে ফিরেছিল। ওষুধ-বিষুধ নিয়ে, প্রতি মাসে একবার করে ডাক্তার দেখিয়ে যাবার নিদানসমেত ফিরে এসেছিল। শিশুটিকে দেখার জন্য, ছোঁবার জন্য, হৃদয় উথালি-পাথালি করছিল তার। আকবর আলি তাকে বাড়ির নিকট অবধি পৌঁছে দিয়ে বলেছিল—তুমি যাও। আমি একটু কাজ সেরে আসছি।
সে একাই এসেছিল গৃহে। গৃহের নিকট হতেই সে শুনতে পাচ্ছিল খালেদার স্বর। সে বুঝতে পারছিল, কাজ করতে করতে ছড়া শোনাচ্ছেন খালেদা। কিন্তু শোনাচ্ছেন কাকে? সে ছাড়া ধৈর্যশীল শ্রোতা খালেদা কাকেই বা পান!
এই ছড়া শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে তারও। ধীর পায়ে, ধুঁকতে ধুঁকতে সে হাঁটে আর ভাবে। মুসলমানের ঘরে সম্বৎসরের উৎসবাদির কাল ধরা আছে এতে।
মহরমে ডাহের চাঁদ দশ দিনে খানা,
শফর তেজির চাঁদ ত্রিশ দিনে মানা।
রবিয়ল আওয়ালের ওয়াকতের চাঁদ বারো দিন বাতি,
রমজানের চার চাঁদে করিবেক শাদি।
শাবানে সোবরাতের চাঁদ চৌদ্দ দিনে বাতি,
রমজানেতে রোজা আর শওয়ালেতে ঈদ।
জেলকদেতে কাম নাই জেলহজ্বে বকরিদ।
উঠোনে পা রাখতেই সে দেখেছিল শাশুড়ি খালেদা বিড়ি বাঁধছেন। তাঁর পাশে, আফসানার শিশুটি কোলে করে বধূবেশে বসে আছে মায়মুনা। আফসানাকে দেখেই দৃষ্টি নত করেছিল সে। আফসানা খুশি হয়ে বলেছিল—অ মা! মায়মুনা! তুমি বুঝি বিয়ে বসেছিলে? কবে গো? কই আগে কিছু বলো নাই? কার সঙ্গে হল?
কথা বলতে বলতে শিশুটির দিকে হাত বাড়িয়েছিল সে। ওই দুধের শিশুও, কী এক অভিমানে, কেঁদে উঠেছিল, ক্ষুদে ক্ষুদে হাত-পা নেড়ে কান্নার ভাষায় বলেছিল—মা, আমাকে ফেলে তুমি কোথায় গিছিলে?
আফসানা মায়া ভরে বলেছিল— আসো ধন, আসো।
তারও চোখে জল এসেছিল প্রায়। তখন ধমক দিয়েছিলেন খালেদা—এ কী! হাসপাতালের কাপড় ছাড়া নাই, হাত-পা ধোয়া নাই। বাচ্চা নিচ্ছ! বাচ্চা কি পালিয়ে যাবে? মায়মুনাও তো ওর আরেক মা, নাকি?
আরেক মা! সে থমকে গিয়েছিল! আরেক মা মানে কী! মায়মুনা কথা বলে না কেন? তবে কি ও আকবর আলির…না না! সে কী করে হবে? সে কি জানত না তবে? সেদিনও তো তাকে আসমানের চান্দ বলল আকবর আলি! যত্ন করে শহরে নিয়ে গেল চিকিৎসা করাতে। তা হলে কি মোবারক আলিই বিয়ে করে আনল মায়মুনাকে?
এমত ভাবনায় খুশি হয়ে উঠেছিল সে। বলেছিল—অ মা! আমি নাই! আর মোবারকভাই বিবি নিয়ে এল! এ কিন্তু ঠিক হল না!
—মোবারক না।
খালেদা যান্ত্রিকভাবে বললেন।
—ও তোমার ঘরের শরিক আফসানা। তোমার বুইন। আকবর নিকে করেছে ওকে!
কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েছিল আফসানা আঙিনায়। নিকে করেছে! নিকে! আকবর আলি নিকে করেছে! ঘামে ভিজে যাচ্ছিল তার শরীর। মায়মুনা শিশুটিকে নিয়ে উঠে গিয়েছিল সামনে থেকে। তার মনে হচ্ছিল সে মরে যাবে। মরে যাবে নির্ঘাৎ। অকথ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। সারিয়ে আসা বুক ফেটে যাচ্ছিল চড়-চড়-চড়াৎ শব্দে, যেভাবে বরফ ফাটে পাহাড়ে পাহাড়ে। প্রাণবায়ু কণ্ঠের কাছে এসে পাখা ঝাপটাচ্ছিল যেন বনবেড়ালের দাঁতে ঝুলে আছে জীবন্ত শালিক। তবু সে মরে গেল না। তবু সে ভাবল, নিকে করল তার অনুমতি বিনাই! এ কি অধর্ম করল না আকবর আলি? অ মিঞাছায়েব, আমারে কইলা না ক্যান? নিকা করবা বইলাই আমারে হাসপাতালে নিছ? অ মিঞাছায়েব…
খালেদা বলছিলেন—তা কী আর করা! তুমি তো বাপু মড়া হয়ে আছ! কত বড় প্রাণ বলো আমার ছেলেটার। তালাক দিয়ে তোমার এই কালরোগসহ তোমাকে বাপের বাড়িতে তো পাঠাবার কথা ভাবেনি। এমনকী নিকেও করতে চায়নি প্রথমে। কিন্তু জোয়ান ছেলের চলে কী করে বলো? কথায় বলে—
মাগমরা মিনসের কোথা ঘরে থাকে আঁটুনি।
গুজর ঘাটের জল শুকালে জবাব পান পাটুনি
আফসানা নিথর বসেছিল কত দীর্ঘ সময়। নাকি সামান্যক্ষণ মাত্র। তার সময়ের বোধ চলে গিয়েছিল। খালেদা বলেছিলেন—ওঠো আফসানা। স্বামীর ভাগ কারওকে দেবে না এমন নসিব করে আসে ক’জনা? জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে দেখছ না! মেয়েদের মূল হল গতর! যতক্ষণ গতর ততক্ষণ কদর। তা, আকবর নিকে করেছে এ বরং ভাল। নইলে কোন আঘাটে-কুঘাটে যেত। সে কি ভাল হত? কথায় বলে—
নারীর দোষে পুরুষ নষ্ট
সংসার নামায়।
রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট
প্রজা কষ্ট পায় ।।
এক বুক দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল আফসানা। রোগ নয়, দারিদ্র নয়, পরিশ্রম নয়—এসবের কোনও কিছুকেই আফসানা ভয় করেনি। সে শুধু স্বামীকে ভাগ করে নিতে রাজি ছিল না। হায়! সেই সাধও ভেসে গেল কোথায়! কিছুই রইল না তার। চারিপাশ শূন্য হয়ে গেল। বেঁচে থাকা বিস্বাদ হয়ে গেল তার। অ মিঞাছায়েব, আশমানের চান্দ কইছিলা তুমি আমারে? কইছিলা, চান্দ কয়খান হয়? একখানৈ! অ মিঞাছায়েব…
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে। কাঁদেনি। শুধু ভেবেছিল, এরা তাকে বলল না কেন? আকবর আলি বলল না কেন? কেন লুকিয়ে নিকে করল? অ মিঞাছায়েব…
ধীর পায়ে ঘরে গিয়েছিল সে। তাদের শোবার ঘরে নয়। সে বুঝেছিল, ওই ঘর, অনেক দিনের জন্য মায়মুনার। কিংবা হয়তো চিরকালের জন্যই। সে গিয়েছিল তার ছোট ঘরটিতে। কাপড় ছাড়তে ছাড়তে নিজের হাড়-কাঁকলাস চেহারার দিকে দেখে দেখে ভাবছিল, খালেদার কথাই ঠিক। মেয়েমানুষের কী বা দাম এ সংসারে! আকবর আলি যে তাকে তালাক দেয়নি, এই জন্যই তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।