2 of 3

রাজপাট – ৭৪

৭৪

নগরীর রাজপথে মোড়ে মোড়ে চিহ্ন প’ড়ে আছে;
একটি মৃতের দেহ অপরের শবকে জড়ায়ে 
তবুও আতঙ্কে হিম–হয়তো দ্বিতীয় কোনো মরণের কাছে।
আমাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, নারী, হেমন্তের হলুদ
ফসল ইতস্তত চ’লে যায় যে যাহার স্বর্গের সন্ধানে; 

.

কিছু দাগ ছাড়া দেহ টানটান। ক্ষত নিরাময় হয়ে দেহ-ত্বকে ছোপ ধরা। ভ্রূপল্লবে কচি রোম, পুড়ে যাওয়া রোমের তলায়। ছোট ছোট করে ছেঁটে দেওয়া চুলে আগুনের চিহ্নমাত্র নেই। চোখের গভীর দৃষ্টি গভীর, গভীরতর, দৃঢ়। বহু যাতনার ধাতা এখন সে। বহু অপমরণের অসহায় দ্রষ্টা। তবু তাকে ফের স্বপ্নের নিকট যেতে হয়। সকলই দুঃসময়ের পর আসবে সুসময়—এমনই স্বপন মুকুট করে নিতে হয় কল্যাণের পথে। কোনও তিথ্যমৃতযোগে তরে যাবার তিতীর্ষ নয় সে। 

এই দেশ এবং দেশের মানবের প্রতি তার আছে যে ভালবাসা, স্বদেশপ্রেম শব্দটি দিয়ে প্রকাশ করলে শোনায় সেকেলে। স্বদেশপ্রেম তৎকালে ছিল। স্বাধীনতার পূর্বভাগে। এখন স্বদেশপ্রেমের নাম রাজনীতি। নিঃস্বার্থ স্বদেশসেবা এবং স্বার্থপরতার রাজনীতি চিহ্নে, পরিচয়ে, ব্যঞ্জনায় মিলেমিশে একাকার। 

সে মনে মনে গড়ে তুলছে এক স্বদেশপ্রেমই বুঝি-বা। কারণ একটি ছোট গণ্ডিতে সে আবদ্ধ করে না তার ভাবনা, তার অনুভূতি। সে ভাবে দেশকে। সে যখন গ্রামের পথে হাঁটে, তখন এমন ভাবনাকেই কেবল প্রশ্রয় দেয় না যে, সে দেখছে এই জেলা মুর্শিদাবাদেরই পথঘাট। এইগুলি তার খ্যাতির সম্বল। তার ক্ষেত্র-প্রস্তুতি। বরং তার মনে হয়, এই পথঘাট, এই দারিদ্র, এই দুর্গত মানুষ—এরা ভারতীয়, এরা এ দেশের। 

দেশের ভাবনা একটি অনুভূতি। একটি হৃদয়ভাব। বোধ। যেমন ন্যায়-নীতির বোধ সকল মানবে সমান সাড়া জাগায় না, তেমনই দেশাত্মবোধও। দুর্লভ এ বোধ। কিন্তু কল্যাণময়। যার এ বোধ আছে, তাকে, এবম্বিধ ভাবের ধারণের জন্য সচেষ্ট থাকতে হয়। কারণ এমন বোধের অনেকখানি জুড়ে থাকে আবেগ। তার বিস্তার আছে যেমন, হ্রাসও আছে। এই অস্থায়ী আবেগটুকুকে অভ্যাস দ্বারা স্থায়ী ও স্থিত করে তুলতে পারলে তা হয়ে ওঠে সকল সময়ের প্রেরণা। 

সে চেষ্টা করছে তার আবেগকে এমনই স্থিতিরূপ দিতে। সে জানে জীবনের আদর্শকে গ্রহণ করতে হয় প্রাণের সঙ্গে। তা বড় সহজ কাজ নয়। পথের দু’পাশে সাজিয়ে রাখা আছে বিবিধ লোভনীয় সম্ভার। অর্থের লোভ, খ্যাতির লোভ, ক্ষমতার লোভ। সহজ, মসৃণ, পত্নী ও সন্তানাদিসহ এক জীবনেরও প্রলোভন বুঝি। আরও হাজার বিষয়। সেই সকল লোভের ফাঁদ এড়িয়ে পথ চলা সহজ নয়। এমনকী পরিস্থিতি এমন যে, সকল নীতিবোধকেও বলা যায় না সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। স্থান-কাল-পরিস্থিতির বিচারে এখন নীতির বিচার। 

বোধিসত্ত্ব বলেন—সকল কর্মের হিতাহিত, সুফল, বিফল সমস্ত নির্ভর করে নিষ্ঠার ওপর। আত্যন্তিক নিষ্ঠার ওপর। যখন যে-লক্ষ্য গড়বে, ব্যক্তিগতকে বিসর্জন দিয়ে প্রাণ যদি ওই লক্ষ্যগত করতে পার তো তোমার জয় নিশ্চিতই। 

সে জানে, এ সত্য। এই বক্তব্য সত্য। এর কোনও অন্যথা নেই। সে তো খুলে খুলে ফেলে দিচ্ছেই একটি একটি করে সকল ব্যক্তিগত। এবং তার দৈব, তার নিয়তি, তাকে ক্রমশই করে দিচ্ছে একা। এই একাকিত্ব হতে সে চলেছে এক পূর্ণ সমর্পণের দিকে। মানব কল্যাণের কাছে উৎসর্গ করে দিতে চায় সে জীবন। উৎসর্গ এবং সমর্পণ-এখানেই সমস্ত দুঃখ-যন্ত্রণার ক্ষতিপূরণ। সৈ জেনে গেছে, জীবন ক্ষণিক, সে জেনে গেছে শক্তির সীমাবদ্ধতা। সময়ের কালচক্র ইতোমধ্যেই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে অতর্কিত মৃত্যুর অমোঘ আঘাত কী মর্মান্তিক! এরপর আর কী থাকে মানুষের—কোনও আদর্শের কাছে প্রাণপাত করা ছাড়া? 

সে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হতে পারবে না। যেমন বিপুল শোকের পরেও বোধিসত্ত্ব পারেননি। তারা দু’জনেই মৃত্যু-আকীর্ণ পথ হেঁটে যায় জীবনের পূজা দিতে দিতে। তাই তারা কর্মময়। 

ব্যক্তির সত্যতা সে অস্বীকার করে না। সে মনে করে প্রত্যেকটি মানুষই বাঁচে দু’টি সত্তায়। ব্যক্তিসত্তায় এবং জাতিসত্তায়। জাতির কতক পৃথক লক্ষণ আছে, বৈশিষ্ট্য আছে। আলাদা করে চেনালে কোনও ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যর সঙ্গে তা মিলে যেতে পারে, আবার বিপরীতও হতে পারে তা। কিন্তু জাতির মধ্যে ব্যক্তি ঢুকে থাকে যে পরিমাণ, ব্যক্তির মধ্যে সেই পরিমাণেই জাতির প্রবেশ। সকল বৈশিষ্ট্য ধরে এক-একটি জাতিকে একটি ব্যক্তিমাত্রই, জাতি-আত্মা জাতি-সংস্কৃতি মিশ্রিত ব্যক্তিমাত্রই, ধরে নিতে হয়। 

ব্যক্তিকে বুঝতে না চাইলে, তার বৈশিষ্ট্যগুলির ধারণা না করলে যেমন সম্পর্ক দৃঢ় হয় না, তেমনি জাতিকে না চিনলে, না বুঝলে জাতির সার্বিক কল্যাণ সম্ভব নয়। সে চায় বুঝতে এটুকুই তার সম্পদ। 

হারাধনের সঙ্গে পেতনির চরে যাবে সে আজ। তৌফিক যাবে তার সঙ্গে। 

স্কুলের রহস্য মেটেনি আজও। কোনওদিন মিটবে সে আশা রাখে না সিদ্ধার্থ। সে তার সন্দেহের নিরসনকল্পে প্রকৃত সত্য জানার জন্য লোক নিয়োগ করেছে। ভরসা রাখে সে, জেনে যাবে কোনও দিন। কারণ অপরাধীর জগতে থাকে ফিসফিসে প্রচার। একজন অন্যের খোঁজ রাখে নিজেরই স্বার্থে। সকল কর্মের হাল-হদিশ না জানলে যেমন আত্মরক্ষা সম্ভব হয় না, তেমনি আক্রমণও করা যায় না দরকারমতো। 

একথা সকলেরই কাছে পরিষ্কার যে স্কুলের ঘটনা ঘটিয়েছে যারা, তারা ঠান্ডা মাথার পেশাদার অপরাধী। মির্জার মতে তারা এলাকার নয়। এলাকার হলে সে জেনে যেত এতদিনে কার কীর্তি। সারা মুর্শিদাবাদ মালদহ জুড়ে আছে তার অনেক স্বদল বৃত্ত। বিরোধী বৃত্তও বহু। দলগুলির পারস্পরিক ভাব-নির্ভাবের মধ্যে তার নিরন্তর আনাগোনা। সেখানেই তার খবরাখবরের উৎস। তার উৎস এড়িয়ে ঘটবে না কিছু এই বিশ্বাস তার আছে। 

—তোমার সন্দেহ হয় না কারওকে? 

প্রশ্ন করেছিল মির্জা। সিদ্ধার্থ বলেছিল—সন্দেহ হয় বলেই তো মুশকিল। 

মির্জা বলেছিল—এ জগৎকে আমি বুঝতে পারি না সিধুভাই। এই সভ্যতার ভদ্রতার দুনিয়া। এখানে সবকিছুই বড় অন্ধকার। সবকিছুতেই গোপন ষড়যন্ত্র। এখানে ভাই ভাইকে বিশ্বাস করে না। বন্ধু বন্ধুকে না। এখানে দু’জনের দেখা হলে কথা বিনিময় হয়, কিন্তু, হয়তো দু’জনেরই দৃষ্টির পিছনে থাকে খুনের পরিকল্পনা। এ দুনিয়ায় ঘৃণা স্পষ্ট নয়, রাগ স্পষ্ট নয়, হিংসা প্রতিহিংসা—স্পষ্ট নয় কোনওটাই। শত্রুকে শত্রু বলে চিনতে পারার আগেই এখানে শত্রু চরম আঘাত করে বসে। 

সিদ্ধার্থ শুনছিল। ভাবছিল। তার ও মির্জার জগৎ আলাদা। এই দুই জগতের মাঝখানে কি সে বিরাজ করে? নাকি মির্জার জগতের সঙ্গে এই জগতের প্রকৃতপক্ষে তফাত কিছু নেই। ওপরের সুদৃশ্য মোড়ক খুললেই বেরিয়ে পড়ে রিরংসা। পৃথিবীর সকল সুন্দরকে দলে মুচড়ে ধর্ষণ করে ভোগ করার রমণ-প্রবণতা। 

মির্জার জগৎ সেই তুলনায় অনেক বেশি স্পষ্ট। হিংসা বা শত্রুতা সেখানে গোপনীয় নয়। বধ করার ধর্ম তারা পরস্পরের সঙ্গে পালন করে পাশব সরলতায়। এই কি ভাল? 

সে মনে করে, ভাল নয় কোনওটাই। তার বা মির্জার জগৎ। হতে পারে মির্জার জগৎ মির্জার পক্ষে ভাল। তার জগৎ তার পক্ষে। কারণ যে যার দুনিয়ায় অভ্যস্ত। ভাল হোক, মন্দ হোক, অভ্যাসকেও মানুষ পছন্দ করে বসে অনায়াসে। এমনকী অধিকার করে ফেলে এমন যে ছাড়তে বললে পরিহার করার চেয়ে মৃত্যুকে মনে করে শ্রেয়। অভ্যাসকেই ধর্ম মনে করে বসে। 

মির্জার দেখাকে সে অস্বীকার করে না। তার স্বভাবমতো সকল দেখাকেই দেয় সে সম্মান। সকল দেখাকে দেখতে দেখতে ভাবতে ভাবতেই দরকারমতো, নিজের হৃদয়ে গড়ে ওঠা স্বপ্নের জগৎ বিষয়ে কিছু রদবদল ঘটিয়ে নেয়। সে জানে, যা কিছুই সুন্দর রাখার জন্য চাই সহৃদয়তা। হৃদয় হারালে মানবিক গুণের প্রধানতম গুণই হারায়। 

নিবেদিতা বাগচীর স্কুল নিয়ে এখনও রয়েছে টানাপড়েন। একেবারেই বন্ধ আছে ‘প্রথম পাঠ’। হয়তো বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। 

এই দুর্ঘটনার প্রকৃত তদন্তের দাবি চেয়ে পথে নেমেছিল কংগ্রেস। আর নিবেদিতা বাগচীর গ্রেপ্তারের দাবিতে থানা ঘেরাও করেছিল আর এস পি-সি পি আই এম জোট। মিহির রক্ষিত নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওই ঘেরাও আন্দোলনে। পথসভা, জনসভা, ধিক্কার প্রস্তাব-বাদ যায়নি কিছুই। জেলা সভাধিপতি এক বিবৃতিতে মন্তব্য করে বসেছেন—ওই মহিলা এখনও বেঁচে আছেন কোন মুখে? শেষ পর্যন্ত নিবেদিতা বাগচীকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরমেশ্বর সাধুখাঁর তৎপরতায় জামিনে ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল তাকে। কিন্তু দুর্ঘটনার অসহ পোড়া গন্ধ নিবেদিতা বাগচীর ঘ্রাণে লেগে আছে সর্বক্ষণ। পুলিশি গ্রেপ্তারের কালি বারবার ধুলেও উঠছে না। বিভ্রান্ত সে। দিশেহারা। রাতের পর রাত ঘুমোচ্ছে না সে। তার মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য চিকিৎসকের সাহায্য প্রয়োজন হচ্ছে। সে এমনকী পথে বেরুতে পারছে না। যেতে পারছে না বস্তি এলাকায় পড়াবার কাজে। তাকে দেখলেই লোকে বলছে, আঙুল তুলে বলছে, ওই সে! ওই মহিলা! ওঁর স্কুল! জেলা সভাধিপতির ওই প্রকাশ্য মন্তব্য তার গলায় দুলছে ফাঁসির দড়ির মতো। 

নিবেদিতা ওই কথার পরের ব্যঞ্জনাটুকু বুঝে নিচ্ছে। সকলেই যেন বলতে চায়, বাচ্চাদের মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী! তার সঙ্গে ভাগ্যের এইরকম সংঘর্ষে সে ছিটকে পড়েছে এক কোণে। মেরুদণ্ড দুমড়ে-মুচড়ে চিরকালের জন্য ভাঙা-চোরা হয়ে গেছে। পুলিশ, উকিল, আদালত প্রভৃতি অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত বলয়ে সে তার অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক পিতার সঙ্গে ঘুরে মরছেই কেবল। কতদিনের এ পর্ব সে জানে না। কবে সে এর থেকে মুক্তি পাবে, জানে না। তার জীবন, এভাবেই, অসম্মানে অপমানে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হওয়ার জন্য, এমনই বিপর্যস্ত ধারণায় সে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল জলের নিকটতর। 

অনাবৃষ্টির শুখা ভাগীরথী জোয়ারে তবুও এমন ভরাট না হয়ে পারে না যে একটি মানুষের দেহকে সে দিতে পারবে না আশ্রয়! মায়ের পঞ্জিকা খুলে নিবেদিতা দেখেছিল রাত্রি দশটায় আছে জোয়ার। সে, তার সহকর্মিণীদের সঙ্গে পরামর্শ করার আছে, এবং যাবার আছে পরমেশ্বর সাধুখাঁর কাছে, এমনই অছিলায় সন্ধ্যায় বেরিয়েছিল একা। এখানে-ওখানে আঁধারতলিতে ঘোরাফেরা করে সে শ্মশানের নিকটে গিয়েছিল। ভাগীরথী সংলগ্ন বাঁধানো পরিচ্ছন্ন শ্মশানে চিতা জ্বলছিল তখন। কারও দেহপোড়া ধূম বেরিয়ে আসছিল অনর্গল। সে দূর হতে দেখেছিল কিছুক্ষণ। তার কানে এসেছিল শিশুদের পোড়া চিৎকার। পোড়া গন্ধ কচি দেহগুলির। তার শরীর কাঁপছিল। স্বেদ সঞ্চারিত হয়েছিল আশিরপদ। সে, যেন-বা কোনও অবলম্বন প্রয়াসে, অসংলগ্ন পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল। পারঘাটার বাঁধানো সিঁড়িতে বসেছিল একা। মনে হয়েছিল তার, এই পৃথিবী দুলছে। কিংবা সে নিজে কোন সুদূর মহাশূন্যে হয়েছে নিক্ষিপ্ত সেখানে শূন্যে নিরালম্ব ভাসমান সে অসহ বেদনবোধে শিউরে শিউরে উঠছে। যেন এক রোগের সংক্রমণ। দুরারোগ্য রোগের আক্রমণে অনড় নিষ্ক্রিয় সে। কোনও দিন, কোনও নিরাময় আসবে না তার জন্য। 

একা বসে থাকা, শিশুপ্রেমী নিবেদিতা বাগচীর একজোড়া চোখ হতে কতক্ষণ হয়েছিল নিঃশব্দ অশ্রুপাত! সে জানে না পারঘাটায় এসেছিল কতজন, নৌকা ঠেকেছিল কি না। কতজন শ্মশানযাত্রীই বুঝি, স্নান সেরে গিয়েছিল কি না। যদিও এ ঘাট শ্মশানের ঘাট নয়। তবু, অদুর শ্মশানের গন্ধ শবযাত্রী হয়ে ভেসে আসে ঘাটে। সে জানে না কত জন, কত গন্ধ, কত লোক। একা মেয়ে বসে আছে ঘাটে, দেখে, নিঃশব্দ বিস্ময় নিয়ে চলে গেছে কতজন। আলোকময় নয় এ স্থলী! তবু মেয়ে বলে চেনা যায় তাকে। লোকে ভাবে সবহারা শোকগ্রস্ত মেয়ে। আলো নেই বলে সে, হৃদয়হারা, দুর্ভাগা, শোকগ্রস্ত নিবেদিতা বাগচী বলে চেনা পড়ে নাই। আকাশেও বুঝি এক বিষাদ ঘনিয়েছিল তাকে ঘিরে মেঘহীন। 

কতক্ষণ, কতক্ষণ জানে না সে। একটিও লোক আর নেই ধারে-পাশে। জোয়ারের জল ধার করে নদী শব্দ করে ছলচ্ছল। জল বাড়ে। শুখা নদীপাড় যেন-বা পিপাসায় শুষে নেয় জলের উচ্চতা। 

নিবেদিতা, আকাশ ভাবেনি, আনন্দ ভাবেনি, ভাবেনি গোলাপকুঁড়ির প্রেম। কেবল শোকের নিমগ্নতায়, অপমান কলঙ্ককালিমা দেখে ধীরে ধীরে নেমে এসেছিল। তাই তো! সে বেঁচে আছে কেন? কী প্রকারে? সে এক ধাপ, এক ধাপ নেমে এসেছিল। শাড়ির আঁচল দিয়েছিল হাওয়ায় উড়াল। কোনও বাতিঘরে জ্বলা আলো নিভে গিয়েছিল। শ্মশানেও চিতা নেই। কুকুর-শেয়ালের তরে রাখা নেই একখণ্ড অদগ্ধ মাংস। 

সে নেমেছিল। জলের নিকট, নিকটতর ধাপে পা ডুবে গেল, সে শেষ ক্রন্দন মর্ত্যভূমে রেখে যাবে বলে ফুঁপিয়ে উঠল একবার আর নামল এক ধাপ। পায়ের গোছ অবধি জল। পায়ের তলায় কর্দমপিছল ধাপ। সে জানে না আর এক ধাপ নামলেই ধাপ শেষ কি না। জলের অতল কি না। স্থির হৃদে, মরণের উন্মত্ততা সবলে ছানিয়ে, সে সব শেষ করে দেবে বলে ঝাঁপ দিল। 

উথাল-পাথাল জলে উথালি-পাথালি, সন্তরণ জানে না সে ডুবছিল, ভাসছিল, জলে-ডোবা দমবন্ধ যাতনায় জ্ঞানহারা প্রাণের মহিমায় অন্ধকারে হাত তুলেছিল। তার গৌর হাতে সোনার দু’গাছি চুড়িতে নক্ষত্রের আলো পড়া সোনালি ঝিলিক। 

তাই দেখে জলে ঝাঁপ দিল একজন। সুদক্ষ সাঁতারে সে পৌঁছল ডুবন্ত মেয়ের কাছে। হাতের আন্দাজে প্রথমে ধরল গলা, আর তারপর অভ্যস্ত শিক্ষায় ধরল চুল। এক হাতে সাঁতরে সামান্য সময়, সে পেল পারঘাটা। ধীরে ধীরে, যত্নে সন্তর্পণে দেহটিকে তুলে নিল সে। শেষ ধাপে শুইয়ে দিল। ভেজা শাড়ি তখনও জড়িয়ে ছিল দেহ। শ্মশানের হালকা আলোর বিকিরণে সে দেখল জমাট যৌবনা দুটি স্তন। এক মুহূর্ত সংকোচ করল সে। তারপর, সকল জড়তা ভুলে, সে, নারীতে অনভ্যস্ত সুদেহী তরুণ, পেটে চাপ দিয়ে বার করে নিল অপ্রাকৃত গঙ্গাজল। মেয়েটির সিক্তদেহ পরম স্নেহে জড়িয়ে দুই ঠোঁট ফাঁক করে ফুঁ দিল সে। হাত ও পায়ের পেশিতে ঘষে ঘষে তাপ এনে দিল। 

মেয়েটির দেহে সামান্য কম্পন জেগেছিল। ধীরে ধীরে চোখ মেলল সে। এবং বন্ধ করল। একটি মাতাল চলেছে পথ দিয়ে। জড়িত স্বরে গাইছে—জিনা য়াঁহা মরনা য়াঁহা ইসকে সিবা যানা কাঁহা … 

পথের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্তে এঁকে-বেঁকে চলেছিল সে, যেন ধরিত্রীই তাকে টলিয়ে দিচ্ছিল এমন। কিন্তু অমন টলমলে মাতাল লোকটিও ঘাটলার দিকে নজর করল। এগিয়ে এসে বলল— কী ভাই? ডুবে যাওয়া কেস নাকি? আত্মহত্যা? আহা! আহা! মরতে হলে এমন জায়গাতেই মরা ভাল। পাশেই শ্মশান—শ্মশান! গঙ্গা দিল দেহ! সে দেহ শ্মশানে পু-ড়-ল! আ-হা! জিনা যাঁহা মরনা য়াঁহা… 

ধাপে ধাপে নেমে আসছিল মাতাল। যুবকটি কড়া স্বরে বলেছিল-যান আপনি! এখানে কী? 

—অঃ! মেয়েছেলে? ইস্তিরি নাকি? 

তরুণ যুবক সে। রুখে দাঁড়াল। বলল—না গেলে ওই ওপর থেকে জলে ঠেলে ফেলে দেব আপনাকে। 

—যাস্‌সি রে বাওয়া, যাসি। অত কথা কীসের? তোমার ইস্তিরি যখন! অ্যাঁ? জিনা যাঁহা মরনা য়াঁহা…. 

টলতে টলতেই ফিরে গেল সেই মাতাল। সেই যুবক তরুণ তখন ত্রস্তে ডাকল—নিবেদিতা! নিবেদিতা! জাগো! ওঠো! নিবেদিতা! 

সে চোখ খুলল যেভাবে পাপড়ি মেলে ফুল—এমনই মনে হল তরুণের। সেই চোখে ঘোর ছিল। যেন না-চেনা জগতে এসে পড়া প্রাণী। চিত শোয়া সে-দেহের দৃষ্টি দেখল বিরাট কালচে নক্ষত্রবিঘোষিত আকাশের চালচিত্রে একটিমাত্র মুখ। যেন এ মহাজাগতিকে সে এবং ওই মুখ একমাত্র অস্তি। আর কিছু নেই। পরপর সাজানো তারা সরলরেখায়। এক বিপুল অন্তরীক্ষের পরে নক্ষত্র ফুটে-থাকা, তারই নিকটতম সিক্ত যুবকের মুখ। সে মুখের সংলগ্ন নিবেদিতা। 

নিবেদিতা বলল— কে? 

কম্পিত, দুর্বল স্বর। নিশ্চিত মরণের মুখ থেকে ফিরে দিশেহারা। তার মন এ মুহূর্তের অভিবাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন নয়। সে বলল— কে? 

যুবক বলেছিল—আমি তৌফিক। চিনতে পারছ আমাকে? মানে, চিনতে পারছেন? 

এতক্ষণ দারুণ উদ্বেগ উত্তেজনা তাকে রেখেছিল ছলনাহীন। নিবেদিতা চোখ খোলামাত্র এসেছে ছলনা। এসেছে, হৃদয়ের সহজ উৎসার আবেগ ঢাকা ভদ্রতার পুরু আবরণ। নিবেদিতা, মৃত্যুর আকর্ষণ হতে, গাঢ় অন্ধকারের জটিল মুষ্টি হতে ছাড়া পেয়ে, অর্ধঅচেতনে বোঝেনি কিছুই। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বহু দূরের দুর্বল গলায় সে বলেছিল—তৌ-ফি-ক! তৌ-ফি-ক! 

—চিনতে পারছেন? উঠে বসুন! দেখুন লোক এসে যাচ্ছে। 

—উঠব? 

—হ্যাঁ। উঠে বসুন। 

—আমি কোথায়? 

—আমি ধরছি। আপনি উঠে বসুন নিবেদিতা। 

—আমি পারব না। উঠতে পারব না কোনওদিন। আমি ভেঙে গিয়েছি তৌফিক।

সে হু-হু কাঁদে বেসামাল। তার শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। তরুণ তৌফিক তখন কান্নারই মতো বোধ করে অন্তরে। বলে—উঠুন। পারবেন। আমি ধরছি আপনাকে নিবেদিতা। 

—আপনি তৌফিক জানেন না, আমি ভেঙে গেছি। পারব না। আমি পারব না। 

—পারবেন আপনি। আসুন। বেশি দেরি করলে পুলিশ এসে পড়তে পারে।

—পুলিশ? ওঃ! 

নিবেদিতা কেঁপে উঠল আর একবার। তৌফিক নিবেদিতার নীচের ধাপে বসে তার পিঠের তলায় হাত রাখল। ধীরে ধীরে তুলল তাকে। নিবেদিতা তৌফিকের গলা জড়িয়ে ধরেছিল। প্রাচীন ব্রহ্মপুর জনপদে, ভাগীরথী নদীর পাড়ে রচিত হয়ে চলল এক চিরন্তন ছবি ওই অসীম নির্জনতায়। একজন বাড়িয়ে দিচ্ছে নির্ভরতার হাত, অন্যজন সে-হাত অবলম্বন করছে। এখানে কোনও ধর্মপরিচয় নেই। জাতি নেই। বর্ণ নেই। কোনও বস্তুগত আদান-প্রদানের চুক্তি পর্যন্ত নেই। এমন মুহূর্তের মতো মধুর, নিবিড় ও পবিত্র দৃশ্য পৃথিবী দেখেনি কতদিন! এই দৃশ্যদর্শনের আবেগে আকাশের নক্ষত্রচোখ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ভাদ্রের অনাবৃষ্টির বাতাসে লেগেছিল স্নিগ্ধ আবেশ। জোয়ারের জলে ছলাৎছলে ছিল রমণীয় ইঙ্গিতময়তা। নিবেদিতা উঠে বসেছিল। 

—এই তো পারলেন। পারলেন না? 

বলল তৌফিক। 

নিবেদিতা বলল—আঃ! এই ঘাটে…এই ঘাটে…আমি তো মরতে এসেছিলাম। 

—উঠুন নিবেদিতা। আমরা ওপরে গিয়ে বসি। আমাকে ধরুন। আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। ধরুন আমাকে। 

উঠছিল তারা। পরস্পরকে ধরে ধাপে ধাপে উঠছিল। নিবেদিতা কাঁদছিল আকুল—কেন বাঁচালেন? আমাকে কেন বাঁচালেন? 

–বসুন এখানে। একটু শুকিয়ে নিন। আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব তারপর 

বসল তারা। তৌফিক নিবেদিতাকে আর স্পর্শ করছিল না। কিন্তু নিবেদিতা তার দুটি হাত আঁকড়ে ছিল। হা-হা কান্নার ভিতর ক্রমাগত বলছিল—কেন বাঁচালেন? আমার যে মৃত্যু ভাল ছিল। 

—সবাই তো মরে যাব আমরা একদিন। তার জন্য তাড়া করে লাভ কী! আত্মহত্যাকে গুনাহ মানা হয়। পাপ। 

—পাপ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে। আমার আর নতুন কী পাপ হবে বলতে পারেন? 

—কিছু পাপ হয়নি আপনার। যা ঘটেছে তার জন্য আপনি দায়ী নন। 

—নই? 

শিশুর মতো সরল প্রশ্ন করে নিবেদিতা। এবং সেই প্রশ্নের উত্তরের ওপর জীবন বাজি রেখে নির্ভর করে সম্ভবত। তৌফিক তার হাতে চাপ দিয়ে বলল না! 

—যদি কেউ থাকত ওই ক্লাসরুমে তা হলে এমন হত না! 

—এটা ঘটে গেছে। স্কুলে এমন পরিস্থিতি হতেই পারে যখন ক্লাসে টিচার নেই। তার জন্য আপনি নিজেকে অপরাধী ভাবছেন কেন? 

—আমি যে আর পারছি না। সারাক্ষণ বাচ্চাদের কান্না শুনতে পাই। 

—আপনাকেই সবার আগে বিশ্বাস করতে হবে নিবেদিতা, যে আপনার দোষ নেই। যা হয়েছে তার চেয়ে বেশি দুঃখজনক আর কিছু হয় না। কিন্তু তার জন্য আপনি দায়ী নন। 

—পুলিশ আদালত পার্টি ঝামেলা দোষারোপ সব মিলিয়ে আমি যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি। সারাক্ষণ মনে হয় সবাই আমার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। 

—যদি দেখায়, তাতে কী! সত্য একদিন প্রকাশ পাবেই। সেই লোকদুটোর কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন আপনি? কেউ আপনাকে দোষ দিল মানেই আপনি দোষী নন। নিজের মধ্যে সাহস না রাখলে আপনি লড়বেন কী করে? 

—কেন এরকম হল? কেন? আমি তো কারও ক্ষতি করিনি! 

—ক্ষতি না করেও লোকের ক্ষোভের পাত্র হয়ে যায় মানুষ। জীবন তো সোজা সরল কিছু নয়। আপনি কি চান না দোষী ধরা পড়ুক! শাস্তি পাক! 

—চাই। চাই। 

—তা হলে? শেষ পর্যন্ত লড়াইটা না চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন কেন? 

—আমি যে আর পারছি না তৌফিক! একা, বড় একা লাগে। আর…আর কী ভীষণ খারাপ লাগে বাচ্চাগুলোর জন্য। ইচ্ছে করে পালিয়ে যাই কোথাও! কিন্তু কোথায় যাব? 

—এত তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন? ঘটনা ঘটেছে এক বছরও হয়নি। এখনই এই অবস্থা? আপনার বাবা-মায়ের কথা ভাবুন তো! আপনার জন্য তো তাঁরাও এই বয়সে লড়ছেন। ওই বাচ্চার বাবা-মায়ের কথা ভাবুন! 

—আর বলবেন না! আর বলবেন না! ওঁদের কথা ভাবলে আমি মরে যাব। মরে যাব আমি। তৌফিক আপনি আমাকে বাঁচালেন কেন? আমি মরে গেলেই যে বাঁচতাম। 

—কোনও কোনও লড়াই লম্বা হয় নিবেদিতা। তার আদি থাকে কিন্তু অন্ত দেখা যায় না শত চেষ্টা করলেও। আপনার লড়াইটা সেইরকম। আপনাকে লড়তে হবে। সেটাই আপনার জীবন এখন। এই লড়াইয়ের বাইরে আর আপনার কিছু থাকতে পারে না। 

—তৌফিক, আপনার সঙ্গে থাকলে আমার ভরসা জাগছে। আমার ইচ্ছে করছে, আর কোথাও যাব না, কেবল এভাবেই বসে থাকব চিরকাল। 

—আমি আছি নিবেদিতা। 

—কীভাবে আছেন আপনি তৌফিক? আপনার পার্টি আমার বিরুদ্ধে। 

তৌফিক চুপ করে গিয়েছিল। সে তো জানত না এক ঘণ্টা আগেও, এই কথা সে বলবে। হঠাৎ ভরসা হয়ে উঠবে নিবেদিতা বাগচীর। জানত না কিছুই। নিবেদিতা বাগচীর স্কুল নিয়ে তাদের দলের কর্মকাণ্ড সমর্থন করেনি সিদ্ধার্থ। সে-ও করেনি। কিন্তু সিদ্ধার্থ এবং সে-ও কিছুটা অসুস্থ থাকায় তারা সরাসরি বিরুদ্ধাচারও করেনি। সে জানে সিদ্ধার্থ অনেক বড় কাজের পরিকল্পনায় নিবেদিত। স্কুলের বিষয়ে সে আগ্রহী কিন্তু এইখানেই নিজেকে আবদ্ধ করে রাখলে তার চলবে না। সে নিজেও সিদ্ধার্থর স্বপ্নরচনার সঙ্গী। 

দিন দশেক হল সে বাড়ি ছেড়ে মোল্লাগেড়ের বস্তিতে এসে উঠেছে। ঘর ছাড়ার বিষয়ে আলোচনা করতে বসলে সিদ্ধার্থই তাকে এই পরামর্শ দিয়েছিল। বলেছিল—ওই অঞ্চলে থাকলে তোর খরচ কম হবে। আমার বাড়িতে তুই থাকতেই পারিস। কিন্তু সেখানে একরকম দায়বদ্ধতা এসে যাবে। আমার বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে তুই প্রাণ খুলতে পারবি না। আশ্রয় হারানোর ভয়ে বিকিয়ে যাবি তুই। 

ঠিক। একেবারেই ঠিক। এই সকল কথাই সর্বাংশে মেনে নিয়েছিল তৌফিক। সিদ্ধার্থর স্পষ্টবাদিতা তাকে চিরকাল মুগ্ধ করে। সে শুনছিল সিদ্ধার্থর কথা। সিদ্ধার্থ বলেছিল— কম খরচে চালিয়ে নিতে পারবি তুই ওখানে। এখনও বিয়ে করিসনি। সুতরাং পরিবেশ নিয়ে মাথা না ঘামালেও তোর চলবে। বরং বস্তি অঞ্চলে থেকে তুই সংগঠনের কাজ করতে পারবি। ওখানকার কিশোর তরুণদের সংহত করে কাজে লাগাতে পারবি। তোর একটা আস্তানা থাকলে আমিও তোর সঙ্গে বস্তিতে কাজ করব অনেক বেশি করে। লক্ষ করে দেখিস, এইসব অশিক্ষিত জায়গাগুলোয় ভোটের সময় ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগানো হয়। এবারও হবে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি এই মানুষগুলিরই। এখানে তুই থাকলে এদের বোঝাতে পারবি। 

কথা বলতে বলতে দম নিয়েছিল সিদ্ধার্থ। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলেছিল—শুরু করতে চাই তৌফিক, পালটে দিতে চাই এই সংকীর্ণ স্বার্থপর রাজনৈতিক প্রবণতা। কিন্তু কোথা থেকে কীভাবে শুরু করব, এখনও জানি না। 

তার ব্যয়ভার সিদ্ধার্থই নিয়েছিল। তৌফিক সে নিয়ে খুব চিন্তাও করেনি। তার ঘর ছেড়ে আসায় দুঃখিত বাবা তাকে মাসান্তে কিছু টাকা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। কারণ ছোট ছেলেটির প্রতি তাঁর স্নেহ ও শ্রদ্ধা কিছু কম ছিল না। একা মানুষের আর কত লাগে? অতএব মোল্লাগেড়ের বস্তিতে একটি ছোট ঘর নিয়ে সে এক পৃথক জীবন শুরু করেছে। দলের কাজে দিন চলে যাচ্ছিল। ফেরে যখন সে, তখনও বস্তি জেগে থাকে। শ্রান্ত-ক্লান্ত খেটে-খাওয়া মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়লেও, ঘুমোয় না মতলববাজ, মাতাল, জুয়াড়ি, চোর-ডাকাতের দল। 

এইসময় কিছুক্ষণ গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ানোর অভ্যাস তৌফিক করেছিল আপন খেয়ালে। যে কখনও বস্তিতে থাকেনি, তার পক্ষে সহসাই মানিয়ে নেওয়া ওই পরিবেশ—কষ্টকর। সময় লাগবে জানে সে। কিংবা হয়তো কোনওদিন মন থেকে মানিয়ে নেওয়া যাবে না। সিদ্ধার্থ বলে—রাজনৈতিক কর্মীদের থাকার জায়গার কোনও পছন্দ-অপছন্দ থাকতে নেই। হাটে মাঠে বনে জঙ্গলে যেখানে ঠাঁই মিলবে, সেখানেই হবে তার বসত। 

সে মানে সিদ্ধার্থর কথা। সেভাবেই নিজেকে সে প্রস্তুত করতেও চায়। যেন, সেই প্রস্তুতিরই পর্ব হিসেবে আজন্ম চেনা নদী ভাগীরথীর তীরে সে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। কথা বলে। ভাবে। যেন বস্তিজীবনে দেখা সকল ময়লা, নোংরা, অপরিচ্ছন্নতা, সকল ছুড়ে দেওয়া গালাগালি, শিশুদের সকলই অশ্লীল বাক্য, সকল মাতাল পুরুষের নারীকে প্রহারের কুদৃশ্য সে একে একে জলাঞ্জলি দিয়ে আপনাতে আপনি পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। 

আসলে নদী এক সম্যক তৃপ্তি সে মানে। নদীর কাছে দাঁড়ালে, স্তব্ধ দাঁড়ালে কিছুক্ষণ, ভাবনার ক্ষুদ্রতাগুলি ঝরে ঝরে পড়ে। মতি পায় বিস্তার। সকল জড়তা গতি পেয়ে উদ্দেশ্যগামী হয়। এবং নদীর পাড়ে দাঁড়ালে আত্মহননকামী মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যায়। যেমন সে রুখে দিল নিবেদিতা বাগচীর মৃত্যু। 

নিবেদিতা বাগচীর প্রশ্ন ও তৌফিকের নীরবতার ফাঁকে ফাঁকে হাওয়া এসে শুকিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল শরীর। তৌফিক ভাবছিল উঠবে কি না। পৌঁছে দেবে কি না নিবেদিতা বাগচীকে এখনই, বাড়ি অবধি। কিন্তু তার আগে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দরকার। সে বলেছে—”আমি আছি।’ কেমন সেই থাকা? কীভাবে? 

সে বলল—আমি জানি! আপনার বিরুদ্ধে যা করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে পড়ে আপনি হয়ে গেছেন দাবার ঘুঁটি। নিবেদিতা, আজ আমি আপনার সকল যন্ত্রণার চূড়ান্ত প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলাম। এরপর, আমি আপনাকে ছেড়ে যেতে পারি না। আমি আছি। কীভাবে জানি না। কিছু করতে পারব কি না জানি না। কিন্তু করার ইচ্ছে নিয়েও তো বন্ধু হয় মানুষ। হয় না? 

—হয়। 

—তা হলে? 

—আমি এখন কী করব তৌফিক? 

—লড়াই চালিয়ে যাবেন। পিছু হঠবেন না। 

—তা ছাড়া? বলুন? ওই স্কুলই তো সব ছিল আমার। আর তো কোনওদিন স্কুল গড়তে পারব না আমি! আর তো পড়াতে পারব না! মায়েরা ভরসা করে আর তো শিশুদের দেবে না আমার হাতে! 

—নিবেদিতা! জীবন কি এটুকুই? 

—মানে? 

এই তপ্ত ভাদরে, তাদের ভেজা শরীরে জড়িয়ে যাচ্ছিল স্নিগ্ধ আরাম। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ক্লান্ত মেয়েটি তবু কথা কয়ে যাচ্ছিল ছেলেটির সঙ্গে। এমন নির্জনে, এমন অন্ধকারে, পাশে রেখে শ্মশান, সম্মুখে রেখে নদী, সে অসহায় খুলে দিতে চাইছিল নিজেকে যা সে পারেনি এ যাবৎ! 

কাকে সে বলে এত কথা? এত বেদনার, বিপন্নতার কথা? যারা আছে পাশে, তারা আরও অসহায় বয়সের ভারে। মেয়ের ভবিষ্যৎ কার হাতে দিয়ে যাবে—এমন ভাবনায়। এখন যে তাকে উদ্ধার করল চরম পর্যায়ে দুই বার, তাকে সে বিশ্বাস করে অকৃপণ, না হলে কাকে দেবে বিশ্বাস? তৌফিক তার কাছে সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকা সাহসী তরুণ। সেও তাই আঁকড়ায়। আঁকড়ে ছিল মনে মনে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া ভেসে উঠবার প্রাণ, জেগে উঠবার প্রাণ। তার সমগ্র হৃদয় একটুকু সান্ত্বনা সহানুভূতির জন্য তৃষার্ত হয়ে ছিল। সে, নিবেদিতা বাগচী, বয়স আঠাশ, ইংরাজি ভাষায় স্নাতকোত্তর বিদ্যা লাভ করা, প্রস্তুত ছিল একটি সবল সুন্দর পিঠে মাথা রাখবে বলে, যেখানে মাথা রেখে কাঁদা যায়, বলা যায় ভয়ের কথা, আশঙ্কার কথা। 

তৌফিক বলেছিল—জীবন কি শুধু এই বহরমপুর? এখানেই বড় হওয়া? এখানেই যাপন? আরও এক বৃহৎ পৃথিবী পড়ে আছে নিবেদিতা। সিধুদা কী বলে জানেন? 

–কী? 

–বলে, অনাদৃত ভারতবর্ষ পড়ে আছে তৌফিক। ধুলোমাখা। অনাহারে ক্লিষ্ট। রোগে জর্জরিত। তাকে কোলে তুলে নিতে হবে। ঔষধ দিতে হবে। সারিয়ে গড়ে দিতে হবে সুস্বাস্থ্য। 

—কী সুন্দর! 

—এভাবে ভাবতে শেখা যায় নিবেদিতা। কাজের অভাব নেই কোনও, যদি আপনি কাজ চান। একটু সামলে নিন। দেখবেন কাজ আপনি আপনার সামনে পড়ে আছে। 

সে নিবেদিতার হাতে চাপ দিয়েছিল। কথার আবেগ হতে ফিরে দেখেছিল মুখ। আলোর ম্লানিমায় সে-মুখ ফ্যাকাশে লাগছিল। সে বলেছিল—চলুন! 

—কোথায়? 

–বাড়ি। অনেক রাত হল। 

—বাড়ি যাব? 

—হ্যাঁ। মন শক্ত করুন। আমি আছি নিবেদিতা। আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন? 

–হ্যাঁ। এর চেয়ে বেশি বিশ্বাস কী করে করতে হয় আমি জানি না। 

—তা হলে কথা দিন। 

–কী? 

—আর আত্মহননের চেষ্টা করবেন না। 

—আর…আর…না। 

—আবার কষ্ট হবে। আবার মনে হবে পারছেন না। আবার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে। তখনও না। 

—না। তৌফিক! 

—বলুন। 

—আমার যখনই বিপন্ন লাগবে, অস্থির লাগবে যখনই, আমি কি….আমি কি…. 

—বলুন। 

—আমি কি, মানে, যেতে পারি আপনার কাছে? 

—হ্যাঁ। পারেন। যখন আপনার প্রাণ চাইবে নিবেদিতা। এখন উঠুন। 

নিবেদিতা উঠতে গিয়ে টলে পড়ছিল। তাকে শক্ত হাতে ধরেছিল তৌফিক। কিছুক্ষণ, হয়তো-বা প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি সময়, তারা জড়িয়ে ছিল পরস্পর। নিবেদিতার মাথা, আঠাশবর্ষীয় মাথা এসে লেগেছিল তৌফিকের, চব্বিশ তৌফিকের বুকে। তৌফিক, কোনও প্রস্তুতি বিনা, নিজের অজান্তে, যেন দৈবের প্ররোচনায়, ওষ্ঠ চেপে ধরেছিল সিক্ত চুলে। 

ধীরে ধীরে উঠছিল তারা। নীরবে। নতমুখে নিবেদিতা। বুঝতেও পারছিল না, জীবন কোথায় এনে পৌঁছে দিচ্ছিল তাদের। হাতে হাত রেখে তারা চলেছিল। সম্পর্ক গড়েছিল পরস্পরের সঙ্গে। সম্পর্ক! সমস্ত জীবন পাশাপাশি শুয়ে বসেও কখনও গড়ে ওঠে না শেষ পর্যন্ত। আবার পলকে তা তৈরি হয়ে যায়। 

উল্টোদিক হতে দ্রুত হেঁটে আসছিলেন একজন। তাঁর হাতে জ্বলন্ত টর্চ। তিনি পশুপতি বাগচী। রাত গড়িয়ে যায় দেখে তিনি উতলা হয়েছিলেন। দু’-একটি জায়গায় ফোন করে জেনেছিলেন নিবেদিতা যায়নি। স্ত্রীর কাছে উদ্বেগ চাপা রেখে বেরিয়ে পড়েছিলেন। শ্রীলেখা, তাঁর স্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন—এখনও আসছে না, দিতা কোথায় আছে? 

পশুপতি কোনওভাবে বলেছিলেন—রোকেয়ার বাড়িতে। রাত হয়েছে। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। 

তিনি জানতেন রোকেয়ার বাড়িতে টেলিফোন নেই। শ্রীলেখার ইচ্ছে হলেও ফোন করতে পারবেন না। 

বাড়ি হতে বেরিয়ে কিছুক্ষণ ভেবেছিলেন পশুপতি। প্রথমে ভেবেছিলেন সাধুখাঁর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। পরে মনে হয়েছে, যেখানে যাবার কথা, যায়নি যখন, তখন ওখানেও তাকে পাওয়া যাবে না। এখুনি এখানে-ওখানে গেলে হইচই বেঁধে যাবে জানতেন। এক কলঙ্কের ওপর অন্য কলঙ্কের বোঝা টানতে তাঁর ইচ্ছে হয়নি। দারুণ উদ্বেগের মধ্যেও অনুমান করার চেষ্টা করেছিলেন, কোথায় যেতে পারে সে? 

ফোর স্কোয়ারের মাঠে? 

না। 

জেলখানার দিকটায়? 

না। 

কলেজের মাঠে? 

না। 

বাজারে? 

না। না। 

কালীবাড়িতে? 

না। 

মসজিদের পাশটায়? 

হতে পারে। 

স্টেশনে? 

হতে পারে। হতে পারে। 

স্টেশনে? 

না। এইসময় নির্জনতা খোঁজে মন। সন্ধ্যায় ব্যস্ত স্টেশনে যাবে না সে। 

মসজিদের পাশটায়? 

ওখানে নির্জনতা আছে। কিন্তু সে কি যাবে এমন কোনও জায়গায় যেখানে তাকে চিনে ফেলা যায়? সে তো এখন পরিচিতের চোখ এড়িয়ে থাকতে চায়। 

তা হলে? নদীর পাড়ে? নদীর পাড়টা ভাবা হয়নি। 

নদীর পাড়। হ্যাঁ হ্যাঁ নদীর পাড়। কিন্তু দীর্ঘ নদীপাড়ে কোথায় খুঁজব তাকে? 

যেখানে জনবিরলতা। কোথায়? কোনদিকে? 

হতে পারে, হতে পারে শ্মশানের দিকটায়। 

শ্মশান! শ্মশান! 

হ্যাঁ! ওখানেই নির্জনতা! অচেনা বৈরাগী মানুষ! শোকতাপগ্রস্ত! ওখানেই তাকে চিনবে না কেউ! কিন্তু…কিন্তু…নদীপাড়ে যাবে কেন সে! এত রাতে সে যাবে কেন একা! 

যেতে পারে। 

তা হলে কি…তা হলে কি… হায়! একা কেন ছাড়লাম তাকে? এখন বিকল তার মন। কেন ছাড়লাম! 

পশুপতি ঘেমে উঠেছিলেন। এই বয়সে পৌঁছে এত ভার, এত উদ্বেগ, এত এত অসম্মানের পীড়নে ন্যুব্জ তিনি ভারী অনিচ্ছুক পায়ে, ভয়ে ভয়ে পৌঁছেছিলেন শ্মশান-নিকটবর্তী। দূর থেকে দেখেছিলেন ওই একজোড়া মানুষ। আসছে তারাও। কে তারা? কে? দিতা না? সঙ্গে কে? কে? 

তৌফিক চিনতে পেরেছিল। এই মানুষটির তত্ত্বাবধানে গিয়েছে তার সাতটি বছর। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। এই মানুষের হাঁটাকে তারা ভয় পেয়েছে, শ্রদ্ধা-সমীহ করেছে, আড়ালে বন্ধুদের মধ্যে নকল করেছে কতবার। অতএব, অন্ধকারে, টর্চ হাতে মানুষটির ক্লেশজর্জর পা ফেলার স্খলিত ভঙ্গিও তাকে চেনা হতে বিরত রাখতে পারেনি। সে হাত ছেড়ে দিয়েছিল নিবেদিতার। বলেছিল- আপনার বাবা আসছেন। 

—বাবা! 

—হ্যাঁ। বলুন তো, মানুষটাকে কতদূর ছুটিয়ে এনেছেন আপনি! 

ছিছিক্কারের গ্লানিতে ভরে গেল নিবেদিতার মন। সে দেখল পশুপতি মাঝপথে থমকে দাঁড়িয়েছেন। শ্মশানবাসী যতেক কুকুর ডাকাডাকি করছে চারপাশ ঘিরে। তারা কাছাকাছি যেতেই পশুপতি বলছেন—দিতা! তুই এখানে কোথায়? কেন? 

নিবেদিতা কথা বলতে পারছিল না। তৌফিক আড়াল করল তাকে। বলল—স্যার, আমি তৌফিক। চিনতে পারছেন তো আমাকে? 

পশুপতি কোনওক্রমে বললেন—হ্যাঁ। তুমি… তুমিই তো…তোমাকে… 

—স্যার, এখন আর কথা নয়। বাড়ি চলুন। বলছি। 

—চলো। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন পশুপতি। সে কি মেয়েকে ফিরে পাবার স্বস্তিতে, নাকি দুর্বহ বেদনার ভারে, তৌফিক বুঝতে পারেনি। সে নিবেদিতা ও পশুপতির সঙ্গে বাড়ি অবধি গেল। আলোয়, নিবেদিতার মধ্যে স্পষ্ট হল ঝোড়ো সময়ের ইঙ্গিত। শ্রীলেখা চিৎকার করলেন—কী হয়েছে তোর? দিতা? এ কী! 

তৌফিক নিবেদিতাকে বলল—আপনি যান। পোশাক পাল্টে আসুন। 

নিবেদিতা চলে গেলে সে সংক্ষেপে বলল দুর্ঘটনার কথা। বলল— কোনও প্রশ্ন করবেন না। বকাবকি করবেন না। কাছছাড়া করবেন না এখন। সময় দিন। ঠিক হয়ে যাবে। 

আতঙ্কিত মুখগুলি নির্বাক শুনল। শ্রীলেখা তার হাত চেপে ধরলেন—তুমি না থাকলে কী হত বাবা? 

সে বেরিয়ে এল। পথে এসে মনে হল বড় ক্লান্ত। একা একা বস্তিতে ফিরতে তার ইচ্ছে করল না। পায়ে পায়ে সে চলে গেল সিদ্ধার্থর বাড়ি। ওখানেই থেকে গেল। ভেজা ময়লা পোশাক পাল্টে পরল সিদ্ধার্থর পোশাক। পাশাপাশি শুয়ে সব কথা বলল সিদ্ধার্থকে। এমনকী, হঠাৎ সে চুম্বন করেছিল, সে-কথাও। সিদ্ধার্থ বলল—যদি ভালবাসতে পারিস, সে তো ভাল। ওঁর ভালবাসা দরকার এখন। 

—এটা কি ভালবাসা বলা যায়? 

জানতে চাইল তৌফিক। 

—কেন যাবে না? 

বলল সিদ্ধার্থ। 

—ভালবাসা ধীরে ধীরে, বহু ঘটনা পার করে গড়ে ওঠে নাকি সবসময়? কোনও দস্তুর নেই এমন। ক্ষণমুহূর্তেও তার জন্ম হতে পারে। 

—তোমার কি মনে হয় ওঁর ওপর দায় আসতে পারে? 

—মনে হয় না। দমকলের বিবৃতি এখানে বড় ভূমিকা নিচ্ছে। সে-বিবৃতি ওঁর বিরুদ্ধে নয়। বিদ্যুতের তারে হঠাৎ বিপর্যয় হলে ওঁর কিছু করার থাকে না। যে-লোকদুটির কথা শোনা গেছে, অন্য শিক্ষকরাও তাদের দেখেছেন। শুনেছেন তারা ছাতে যাবার অনুমতি চেয়েছিল। সুতরাং মিহির রক্ষিতের আনা অবহেলার প্রচার টিঁকবে না। পুলিশের বিবৃতিকে উনি কিছুটা বিকৃত করিয়েছেন। কিন্তু তাতে কী যায় আসে? বিশেষজ্ঞের তদন্ত বিবৃতি এখনও বাকি আছে। 

—সেখানেও যদি মিহির রক্ষিত প্রভাব খাটিয়ে নেন? 

—অত সহজ হবে না। সাধুখাঁরা আছেন ওদের পেছনে। ওঁদের ক্ষমতা কম নয়। আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে তৌফিক। আর কিছু করার নেই। দেখা যাক ওই হাফি আর বাপির পাত্তা পুলিশ লাগাতে পারে কি না! কিংবা অন্য কেউ যদি হদিশ দিতে পারে! 

—সিধুদা! 

—বল। 

—আমি জানি না আমি প্রেমে পড়লাম কি না। যদি পড়ি, তা হলে এই সম্পর্কের দায়বদ্ধতা আমাকে বইতে হবে। আমাদের কাজে তা বিঘ্ন ঘটাবে না? 

—এসব ভাবনার সময় আসেনি এখনও। দুর্বল মুহূর্তে অনেক অনুভূতি আসে। পরে মিলিয়ে যেতেও পারে। আগে দেখ কী হয়! তা ছাড়া, তৌফিক, ভালবাসা খুব সৎ আর সুন্দর যদি হয়, কোনও কাজেরই বাধা হয় না। 

—তুমি প্রেমে পড়েছ? 

—আমি? 

সিদ্ধার্থ ম্লান হাসে। চুপ করে থাকে অতঃপর কিছুক্ষণ। তারপর বলে—যদি নির্দিষ্ট কোনও মেয়ের প্রতি বলিস, মানে প্রেম—– আজও আসেনি আমার মধ্যে। 

তারা পাশাপাশি ঘুমিয়েছিল। এবং আরও এক নতুন সকাল। সে-সকালে তৌফিক চোখ মেলে প্রথম ভেবেছিল নিবেদিতা বাগচীর কথা। 

আজ সকালে তৌফিক গিয়েছিল নিবেদিতার কাছে। প্রায়ই যায়। বাড়িতেই যতটুকু সাক্ষাৎ। প্রকাশ্যে তারা বেরয়নি কখনও। তাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে যায় নিবেদিতার মুখ। সে-ও ওই সান্নিধ্যটুকুর জন্য সতৃষ্ণ অপেক্ষা করে। সারাক্ষণ, বহু কাজের ফাঁকে নিবেদিতার মুখ মনে পড়ে তার। এরই নাম বুঝি প্রেম! সে বুঝতে চেষ্টা করে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *