৯১
শরতে ফুটিছে সাধু
কুমুদের ফুল।
কোন দেশেত গিয়াছ সাধু
বিপদসঙ্কুল ।।
আমার কপাল পুড়ে
বিরহযন্ত্রণা।
নদীর ধারেত বসিয়া সাধু
কেবল দিন গুণা ।।
গুণিতে গুণিতে দিন
কখন ফুরাইল।
কুমিরে টানে জলে
থলে বাঘে কামড়িল ।।
আসিয়ো আসিয়ো সাধু
মোরে না রাখিয়ো একা।
ডুইব্যা মরমু আমি
আর না পাইবে দেখা ।।
.
ভোর-ভোর বেরিয়ে পড়বে ভেবেছিল তারা। হল না। গোমুণ্ডি গ্রামের বংশপিরের পূজা দিয়ে না এলে গ্রামের মানুষ দুঃখিত বোধ করছিল। অতএব তারা গিয়েছিল পিরের থানে। বংশপির এখানে হিন্দু-মুসলমান সকলেরই আরাধ্য। কবে, কোন যুগে তিনি এসেছিলেন। বলেছিলেন—এখানে বাঁশ ছাড়া অন্য বস্তু দিয়ে ঘর বেঁধো না। অভিশাপ লাগবে। টিকবে না সে ঘর। ভেঙে পড়বে।
অদ্যাবধি তারা মান্য করে আসছে এ বচন। অমান্য করার সঙ্গতি নেই। সাহসও নেই। আর সেই পিরের আগমন অবধি এই গাঁয়ের বাঁশে অমোঘ শক্তি। তারা দাবি করে, এ বাঁশে ঘুণ ধরে না। হতে পারে, ঘুণ ধরার দীর্ঘ স্থায়িত্ব এই বাঁশের দ্বারা নির্মিত গৃহগুলি লাভ করে না। তার আগেই উগলে ওঠা জলে বাঁশ ভিজে যায়। পচনে বা ভেসে যাওয়ায় অন্ত পায়।
তবু, মানুষের নির্বিরোধী বিশ্বাস, ক্ষতিহীন বিশ্বাস অমর্যাদা করা যায় না। লৌকিক দেবশক্তিকে মান্য করতেই হয়। এবং, মানুষকে বুঝতে গেলে তাদের বিশ্বাসকে বোঝা চাই আগে। যে-বিশ্বাস ক্ষতিকর নয়, তা একরকম। যদিও কুসংস্কারবিরোধীদের মতে সকল অলৌকিকে বিশ্বাসই কুবিশ্বাস। কিন্তু লোকচরিত্র অত সহজে সু এবং কু-এর মেরুতে স্থাপন করা যায় না। বিশ্বাস যেমনই হোক, তার বিলোপ সাধন প্রয়োজনীয় হলেও, বিশ্বাসে আঘাত করার আগে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা উচিত বলে সিদ্ধার্থর মনে হয়। অতর্কিত আঘাত করলে মানুষ আঘাত-প্রাপ্ত বিশ্বাসকেই আঁকড়ে নিতে চায়।
কাল অবধি এই পিরের বিষয়ে জানতে পারেনি সিদ্ধার্থ। আজ সকালে, ভোরই বলা যায় তখন, প্রথমে বিদায় নিচ্ছিল তারা নিজামত আলির কাছেই। তখন নিজামত আলিই তাদের পিরের দরগায় প্রার্থনা করে যেতে অনুরোধ করেন। সকল বৃত্তান্ত শুনে সিদ্ধার্থর মনে হয়েছিল, এই পির দূরদর্শী। বাস্তববোধসম্পন্ন। এমন আদেশ তিনি দিয়েছিলেন কারণ এই নিম্ন-জলাভূমি অঞ্চলে স্বাভাবিকের তুলনায় কিছু অধিক বৃষ্টিপাত হলেই বানভাসি হয়। বাঁশের বেড়া হলে, তবুও নৌকায় তুলে তা সংরক্ষণ করা যায়। জলের চাপে হঠাৎ গায়ে ভেঙে পড়লে, বাঁশের বেড়ার চাপে মৃত্যুও ঘটে না।
সে শ্রদ্ধাবোধ করেছিল সেই মৃত, জ্ঞানী মানুষটির প্রতি। গিয়েছিল পিরের দরগায়। দেখেছিল, দরগা বলে কিছু নেই। থান বলে কিছু নেই। কেবল কিছু বাঁশগাছের নিকট এক ঢিবি। হাজার বন্যাতেও এই ঢিবির মাটি ধুয়ে যায় না। এমনই স্তূপের মতো তা রয়েছে কতকাল। বংশপির আপনার সমাধি আপনি রক্ষা করে চলেছেন।
মুসলমানেরা সবুজ কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে সমাধি। জ্বেলেছে ধূপ, মোমবাতি। হিন্দুরা দীপ রেখে গেছে। ফুল রেখে গেছে। হিন্দু সামান্যই এ গ্রামে। পাঁচ ঘর মাত্র। বাকি সব মুসলমান।
পিরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তারা চলেছিল ধুলামাটি গ্রামের দিকে। যমুনা বিলের ধারে কলাবিবির শ্মশানের পর কলাবিবির জঙ্গল পেরিয়ে ধুলামাটি গ্রাম।
তারা কেউ কথা বলছিল না কোনও। ভাবছিল যে-যার নিজের মতো। সিদ্ধার্থ শুধু একবার জানতে চেয়েছিল বসির খানের কাছে, এখন এই পুজোর মরশুমে, বহু ভ্রমণার্থী আসবে মুর্শিদাবাদে, বসির খানের এই এক বড় উপার্জনের সময়, সেই ফেলে, সে কেন এল!
বসির খান বলেছিল, চতুর্থী হতে পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী হয়ে দশমীর দিন পর্যন্ত প্রচুর কথা বলেছে সে। ঘুরেছে প্রচুর লোক নিয়ে। উপার্জনও করেছে। সহসা, শেষ দিনে, অর্থাৎ দশমীর দিন, কলিজাখাকি বেগমের সমাধি দেখাতে দেখাতে সে অবসন্ন বোধ করেছিল। যারা আসে, তারা কেউ ইতিহাস ভালবেসে আসে না। সে তার মতো বলে যায়। চিৎকার করে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে শোনাতে চায় মুর্শিদাবাদের বহু বিচিত্র করুণ ইতিহাস। কিন্তু শুনতে আগ্রহী নয় কেউ। তারা জাহানকোষা কামানের ফুটোয় আঙুল ঢুকিয়ে দেয়। অশ্লীল তুলনা করে। কাটরা মসজিদের পবিত্র দেওয়ালে ইট দিয়ে নিজের নাম লিখে ফেলে। মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধির অসামান্য আবেদন বুঝতেও চায় না। সিরাজের সমাধিতে গিয়ে নীরবে দাঁড়ায় না দু’দণ্ড। এই ধুলায় মিশে যেতে থাকা ইতিহাস দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে না কেউ।
তার সহসা মনে হয়, এইসব মানুষ, এরা ওই কলিজাখাকি বেগমের চেয়েও নিষ্ঠুর। অজ্ঞান। সামান্য। তার ক্লান্তি বোধ হয় অতএব। সে তখন সিদ্ধার্থর সান্নিধ্য পেতে ইচ্ছুক হয়ে ওঠে। দু-চার দিন ঘুরে-ফিরে আবার সে উপার্জনে যাবে। এই শুরু হল মরশুম। এখন তো চলবেই। মার্চ এপ্রিল মে মাস পর্যন্ত। সারা শীত। সারা বসন্তে। গ্রীষ্মে।
কলিজাখাকি বেগমের ইতিহাস মুর্শিদাবাদের মানুষ জানে। কলঙ্কিত ইতিহাস বিষয়ে লোকে অধিক বিদিত। তাঁরই বিষয়ে ভাবতে ভাবতে বসির খান চলেছিল। তৌফিক ভাবছিল নিবেদিতা বাগচীর কথা। সিদ্ধার্থ ভাবছিল তার বিবিধ কর্ম বিষয়ে। নয়াঠাকুমার বিষয়ে। নন্দিনী, বোধিসত্ত্ব, হারাধন, এমনকী হরিহরপাড়ার বাজারে সেই নারীর কথাও তার মনে পড়ছিল। কেবল দুলুক্ষ্যাপাই কিছু ভাবছে কি না তা বোঝা যাচ্ছিল না। এই মুহূর্তে গাইছিল। তার গানের কথা শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। যদিও সে উচ্চগ্রামে গাইছিল না।
আল্লা কি মসজিদ বানাইলেন দুনিয়ার ভিতরে
তিন গম্বুজ তিনটি সিঁড়ি
ভিতরে তার খোদার ঘড়ি
রেখেছে নয় দরজা ছয়জনা মৌলবী ফিরে
কলিজাখাকি বেগমের কথা ভাবতে ভাবতে চলেছে বসির খান। তেমন বেগম এ যুগেও মেলে নিরন্তর। এমনকী, সে ভাবতে থাকে, এই সরকারি ব্যবস্থাপনা, যে নিরাপত্তা দেয় না, যে অন্ন দেয় না প্রতি মুখে, যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে না, অগণন মানুষকে যে শিক্ষার সুবিধা হতে বঞ্চিত রাখে, সদ্যোজাত শিশুর মাথায় যে চাপিয়ে দেয় ধর্ম ও ঋণ—স্বয়ং সেই ব্যবস্থাকেই কি কলিজাখাকি বলা চলে না?
তার অবসরপ্রাপ্ত মামার অবসরকালীন আমানত উদ্ধার করতে তাকে যেতে হয়েছিল শহর কলকাতায়। একজন তাকে বলল, কাল আসুন। সে কাল গেলে বলল, বিকেলে আসুন। সে বিকেলে গেলে বলল, এক হপ্তা পরে আসুন। সে এক হপ্তা পরে গেলে বলল, বিকেলে আসুন। সে বিকেলে গেলে বলল, পনেরো দিন বাদে খোঁজ নিন। সে পনেরো দিন বাদে গিয়ে দেখল লোক নেই। তার পরদিন গেল যখন, বলা হল, আবার এক মাস পর খোঁজ নিতে হবে। এবং যারা চেয়ারে বসে, তারা বড় করুণা করে। যারা চেয়ারে বসে তারা বড় হেয় করে। মানুষকে মানুষ বলে জ্ঞান করে না। কেন করে না? সরকারি কর্মচারী তারা। রাজশক্তি। একটা প্রশ্ন করার পর জবাব দেবার আগে পাশের জনের সঙ্গে বহু জরুরি কথা সেরে নেয়। একবার ডাকলে, তাকানোর আগে বহু জরুরি ভাবনা ভেবে নেয়। সে বার বার গিয়েছিল। বারবার গিয়েছিল। যেতে-যেতে যেতে-যেতে একদিন তিক্ত বলেছিল—এই ওপরতলায় উঠে এলে মানুষগুলোনকে খুব ছোট্ট ছোট্ট দেখায় না? মেপে দেখবেন। আপনিও খুব উঁচু না!
শেষ পর্যন্ত সে প্রাপ্য আদায় করতে পারেনি। সেই আহত লোকটি বলেছিল- যা পারেন করুন গিয়ে!
তার মামা অবশেষে রাসুদার সহায়তা প্রার্থনা করেছিলেন। নিজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন নিজেই। কিন্তু বসির খানের বুকে আগুন জ্বলেছিল। কেন এই অপমান? কোন সাহসে? রাজশক্তি? সরকারি কর্মের দম্ভ? সঙ্ঘবদ্ধতার অহংকার?
এই মুহূর্তে তার মনে হল, ওই ওরা, ওই রাজকর্মচারী, ওরা কেন নয় কলিজাখাকি এক-একজন? গোটা ব্যবস্থাই নয় কেন কলিজাখাকি? এইভাবে নাকাল করে, হেনস্থা করে সরকারি ব্যবস্থাপনা সত্যি কি খেয়ে নিচ্ছে না সাধারণের কলিজা? ছিঁড়ে-খুঁড়ে? হামলে?
কলিজাখাকি বেগম জিন্নতউন্নেসা মুর্শিদকুলি খাঁর একমাত্র কন্যা। নবাব সুজাউদ্দিনের স্ত্রী। শোনা যায়, একবার কঠিন অসুখ হল তাঁর। চিকিৎসক নিদান দিলেন প্রতিদিন একটি বালকের কলিজা হতে নিঃসৃত রস দ্বারা প্রস্তুত ঔষধ পান করলে তিনি সেরে উঠবেন।
জিন্নতউন্নেসা গোপনে শিশুহত্যা শুরু করলেন। প্রত্যহ এক-একটি শিশুর কলিজা তাঁর চাই। নবাবকন্যা তিনি, তাঁর প্রাণ বহুমূল্য!
এভাবেই চলতে চলতে একদিন তিনি সেরে উঠলেন। কিন্তু কলিজা খাওয়ার নেশা তাঁর গেল না। মানবশিশুর সুস্বাদু কলিজা আহারের ঝোঁকে একের পর এক শিশুহত্যা করে যেতে লাগলেন গোপন ঘাতক দ্বারা। একদিন নবাব মুর্শিদকুলির কানে খবর গেল। জিন্নতউন্নেসাকে জীবন্ত সমাধি দেবার আদেশ দিলেন তিনি।
ইতিহাসে এই কথা নেই। ইতিহাস বলে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের মৃত্যুর পাঁচ বৎসর পর জিন্নতউন্নেসার মৃত্যু হয়। লোকপরম্পরায় যে-বিবিধ গল্পকথা প্রচলিত, তার আছে এক অন্য ব্যাখ্যাও।
নবাব সুজাউদ্দিন থাকতেন কর্মসূত্রে ওড়িশায়। আর বেগম থেকে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদেই। সুজাউদ্দিনের চরিত্রদোষ ছিল। তিনি ছিলেন সুপুরুষ এবং নারীলোভী। জিন্নতউন্নেসার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না তাঁর। স্বামীসঙ্গ না পেয়ে তাঁরও এল রোষ। তাঁরও লাগল যৌবনের নেশা। বিশ্বস্ত লোক দ্বারা গোপনে এক-একটি নবযুবককে তিনি নিয়ে আসতে লাগলেন অন্তঃপুরে। যথেচ্ছ ব্যভিচার করে, ক্লান্তি এলে, সেই যুবককে হত্যা করত তাঁর লোক। মৃতদেহ হতে কলজে কেটে নিয়ে, সেই দেহ ফেলে দেওয়া হত দূরে।
বহু যুবকের মৃত্যুতে বিচলিত হলেন নবাব। তিনি চর নিযুক্ত করলেন। চর যে-সংবাদ দিল, তাতে আতঙ্কিত হলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। ধর্মপ্রাণ মানুষ তিনি। ধৈর্য ধরলেন। খবর গেল নবাব সুজাউদ্দিনের কাছে। সুজাউদ্দিন ছদ্মবেশে মুর্শিদাবাদে এলেন। তাঁর অপূর্ব কান্তি দেখে জিন্নতউন্নেসার লোক তাঁকে কৌশলে ধরে নিয়ে এল। জিন্নতউন্নেসা, নতুন যুবক ভ্রমে, ব্যভিচারিণী হতেই সুজাউদ্দিন আত্মপ্রকাশ করলেন। হাতে-নাতে ধরা পড়লেন বেগম জিন্নতউন্নেসা। নরহত্যা এবং ব্যভিচারের অপরাধে তাঁকে জীবন্ত সমাধি দেওয়া হল।
.
বসির খান ভাবতে ভাবতে চলেছিল। এর মধ্যে কি সত্য আছে? কোথাও? ইতিহাসে আছে, সুজাউদ্দিন মুর্শিদকুলি খাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর জিন্নতউন্নেসা সগর্বে নবাবের পার্শ্বে উপবিষ্টা ছিলেন। তা ছাড়া ইতিহাস এই নারীকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে। ইতিহাসে আছে যে, সুজাউদ্দিনের পত্নী এবং সরফরাজ খানের মাতা বেগম জিন্নতউন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা এবং গুণবতী মহিলা। মুর্শিদপত্নী, ধর্মপ্রাণা নাসেরাবানু বেগমের কন্যা হিসেবে, এই ভূমিকাতেই তাঁকে প্রত্যাশা করা যায়। এমনকী মুর্শিদকুলি খাঁ কর আদায়ের ক্ষেত্রে সাংঘাতিক কঠিন হৃদয়ের ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি ধর্মপ্রাণ ছিলেন। ইতিহাস তা মনে রেখেছে। রবি-উল-আওয়াল মাসের পয়লা থেকে বারো তারিখ পর্যন্ত মুর্শিদকুলি যে-উৎসব আয়োজন করতেন, যত জ্ঞানী সম্ভ পির ফকিরকে সেবা করতেন তা সর্বজনবিদিত। স্ত্রী ছাড়া অন্য নারীতে কোনও আসক্তি ছিল না মুর্শিদকুলির! এমন দম্পতির কন্যা জিন্নতউন্নেসা ধর্মকেই আশ্রয় করবেন, তা-ই স্বাভাবিক! তা হলে? কেন এই গল্প? কোন নিহিত সত্য আছে এর মধ্যে, যা ধরা যায় না?
উপার্জন নিয়ে ভাবে না সে। রাজনীতি গিয়ে ভাবে না। বোন দু’টির বিবাহ দেবে কবে, ভাবে না এ নিয়েও। ইতিহাস তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কল্পনায় হয়তো-বা নবাবি আমলের কোনও পথে হেঁটে চলে সে।
.
দুলু বাউলের গান চলছে অবিশ্রাম। ভাবনায় সঙ্গে সঙ্গে সকলেরই তা শ্রুতিগোচর হয়।
নাভির মধ্যে মক্কা শরিফ
কইরাছে ঠিকানা—
নাভির উপর বায়তুল মোকারম
কলিজাতে থানা—
দেলের ভিতর রাখিয়াছে
সোনার মদিনা।
সুরের দোলায় উদ্বেলিত হৃদয়ে তৌফিক ভাবছিল নিবেদিতা বাগচীর কথা। কী করছে সে এখন? সে ক’দিন শহরে থাকবে না শুনে ম্লান হয়ে গিয়েছিল তার মুখ। কিন্তু বাধা দেয়নি সে। বলেছিল—যদি যেতে পারতাম আমি!’ বলেনি যেয়ো না। বলেনি থাকো। বলেছিল- সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে আমার তৌফিক
ক্রমশ এই সম্পর্কের নির্ধারিত পরিণতির প্রতি দায়বদ্ধতা টের পাচ্ছে তৌফিক। কিন্তু সে তো সহজ নয়। সে দলের কাজে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করে বসে আছে। সিধুদা তার আদর্শ। সংগঠনের কাজ, দলের কাজই তার ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু প্রেম কর্তব্য-কর্মের বিচার করে আসে না। নিবেদিতা শিক্ষিত। নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারে। কিন্তু তার দায়িত্ব সে অস্বীকার করবে কী করে! এ ছাড়াও বাধা আছে বিস্তর। নিবেদিতা বয়সে তার চেয়ে বড়। ভিন্নধর্মী। তার কোনও অপরাধ না থাকলেও একটি জঘন্য ঘটনার দায়ে সে অভিযুক্ত। এক সামাজিক ক্লেদ তার জন্য রয়ে যাচ্ছে, যা তৌফিকের পরিবারের পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ নয়। পথে পথে পাথর ছড়ানো তারও। তবু পিছিয়ে আসার কথা সে ভাবে না। কারণ সে টের পায়, এ কোনও স্বাভাবিক ভাললাগার প্রেম নয়। নিবেদিতা তাকে আশ্রয় করেছে। সে নিবেদিতার প্রাণরক্ষা করেছিল। এখন নিবেদিতার প্রাণ হয়ে উঠেছে তৌফিক নিজেই। ঘর-ছাড়া মোল্লাগেড়ের বস্তিবাসী, উপার্জনহীন এবং দলের কাজে নিবেদিতপ্রাণ তৌফিক এক বিষাদ বোধ করে। ঘর ছেড়ে এসে তার মনে হয়েছিল সে পিছুটানহীন, মুক্ত, কোনও কিছুরই পরোয়া নেই তার। এমনকী সে মুসলমান সমাজের বিবিধ অহেতুক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কিছু আন্দোলন ক্রমশ গড়ে তুলবে, এমন স্বপ্নও দেখেছিল। অথচ এখন সমস্ত সংকল্পকে সরিয়ে দিয়ে একা জায়গা করে নিচ্ছে নিবেদিতা। সহসা, এই তীব্র প্রেমকে, সুন্দর স্বর্গীয় প্রেমকেই তার মনে হতে থাকে সমূহ বন্ধন। অসহায় বোধ করে সে। নিবেদিতার চেয়ে তার নিজস্ব আমিত্ব বড় হয়ে দেখা দেয়। নিবেদিতা তাকে আশ্রয় করেছে। আর সে? নিবেদিতার প্রাণ হয়ে উঠেছে তৌফিক। আর তার প্রাণে আছে কে? কোন জন? তাকে ছাড়া থাকতে পারবে না নিবেদিতা, এমনই তীব্র প্রেম আজ স্ফুরিত। কিন্তু তার ক্ষেত্রে কি এমন কোনও নির্ভরশীলতা আছে?
নিবেদিতাকে ভালবাসে সে। গভীর ভালবাসে। নিবেদিতার জন্য বহু কিছু করতেই সে প্রস্তুত হতে থাকছে। কিন্তু, করুণ বেদনায়, একথা নিজের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে সে, নিবেদিতার প্রতি সে এতটুকু নির্ভরশীল নয়। নিবেদিতাকে ছাড়া তার কষ্ট হবে, শূন্য লাগবে ঠিকই কিন্তু তার সংকল্পগুলি তার দ্বারা কিছুমাত্র প্রভাবিত হবে না। তা হলে? বিচলিত বোধ করে সে। তখন সিদ্ধার্থর কথা মনে হয় তার, সময়, সময়-ই বলে দেবে কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে! নিবেদিতার জন্য মূক বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে তার মন। বড় কষ্টের কালে তাদের দেখা হয়েছিল। মরণের মুখ থেকে তাকে ছিনিয়েই এনেছিল তৌফিক। চিরবন্ধুত্বের আশ্বাস দিয়েছিল। প্রেমের আবেগ বড় ভারী লাগে তবে! ভাবতে ভাবতে সে পথ চলে। শুনতে শুনতে, মেঠো পথে এগোয়, দুলুক্ষ্যাপার গান।
মালা জপে পঞ্চবেলা
কে কোথায় পেয়েছে আল্লা?
মক্কা ও মদিনায় গেলে
কই তাহার ঠিকানা মেলে?
হাজিগণকে শুধাইলে
সেথা হয় মানুষের মেলা।
যেয়ে দেখি জুম্মাখানা
তথায় গিয়ে খোঁজ পেলাম না
মানুষে খায় মানুষের খানা
আল্লা খায় না একতোলা
ওপর হতে দুলুক্ষ্যাপা এক সৌম্য ফকির। যেন সে ভাবছে না কিছুই। গানেরই ধ্যানে সে পাড়ি দিচ্ছে, দূরবর্তী ধুলামাটি গ্রামে সে গিয়েছে আগেই। ভয়াবহ সেই গ্রাম। এ বিষয়ে কিছুই সে সিদ্ধার্থকে বলেনি। যতটুকু নিজামত আলি বলেছে, সেটুকুই সকলের জানা। সে শুধু খুঁজে দেবে দুঃখের বেদনার গ্রাম যত। ঘুরে ঘুরে খুঁজে দেবে। এই তার স্বনিয়োজিত কর্ম। যদি সিদ্ধার্থ দেয় তাকে কোনও কাজ, সে করে দেবে। ময়না বৈষ্ণবীর মতোই সে নিয়েছে ভ্ৰাম্যব্ৰত। দেখবার দেখাবার ব্রত।
সংগীতের তলে তলে নানা কথা ভাবছিল সে। এমনকী বুড়িয়ার মুখ। যদিও, সেই মুখ তাকে তাড়িত করে না আর। সেই দেহ তাড়িত করে না। নানা স্বীকার ও অস্বীকারের পর, নানা গ্রহণ ও বর্জনের পর, হৃদয়ের গভীরতমে চোখ রেখে দেখেছে সে, তার আরাধ্যা হতে পারত বৈষ্ণবীই একমাত্র। ময়না বৈষ্ণবীই। তার জীবনে ওই মাত্র ক’মাসের তরে বুড়িয়ার আগমনের অবদান এই উপলব্ধি। সে এসেছিল বলেই, চূড়ান্ত দেহভোগের মধ্যে দিয়ে চূড়ান্ত হৃদয়বেত্তায় সে পৌঁছতে পেরেছিল। এখন, ঘুরে ঘুরে, সে ময়না বৈষ্ণবীকে পেয়ে যাচ্ছে যত, তাতে সে পূর্ণ হচ্ছে, পূর্ণতর হচ্ছে। সর্বত্র ঘুরে বেড়াত সেই নারী। সর্বত্র রেখে যেত তার শুভ ইচ্ছা। ভালবাসা।
যদিও সে জানে, তার এই ভাবনা বাউলরীতিসম্মত নয়। বাউল ইহবাদী। মৃতকে আগলে, মৃতকে সঙ্গী করে তার দিনযাপন চলে না। স্মৃতিমাধ্যমে আনন্দ বাউলের অভিপ্রেত নয়। কিন্তু দুলু বাউল সে, আপন আনন্দের পথ আপনি খুঁজে পেয়ে, নিয়মে রয়েছে অসম্মত। অংশত হলেও। কারণ, বিশ্বাস করে সে, নিয়ম পালনই বাউলজীবনের উদ্দেশ্য নয়। বাউলের উদ্দেশ্য আনন্দ। পরিপূর্ণ আনন্দ। তার সন্ধান পেলে নিয়ম তো তুচ্ছ হয়ে যাবেই।
সে কিছুর পরোয়া করে না তাই। আপন আনন্দে আপনি চলে। চাইলে, এই মুহূর্তেই সে পেতে পারত এক নারী। আপনাকে দিতে সে ছিল প্রস্তুত। সেই কবে থেকেই। আর কবে থেকেই সে করে আসছে প্রত্যাখ্যান। সে নারী জাহিরা। তখন সে ছিল গণিমিঞার নারী। এখন সে কার? এখন কি সে মুক্ত? সম্পূর্ণ আত্মস্বরূপিণী? তার চোখে ভেসে ওঠে এক গোপন পদসঞ্চার। তাকে প্রত্যাখ্যান করা, ইদানীং, সহজে সম্ভব ছিল না। জাহিরা বড় তীব্র, বড় বেপরোয়া এখন
এরই মধ্যে একদিন রাত্রি নিশীথে সে দুলুক্ষ্যাপার কাছে এসেছিল। বলেছিল—ক্ষ্যাপা! আর তো বাধা কিছু নাই। আমার প্রতি করুণাও কি হয় না তোমার?
সে বলেছিল—করুণা চাও কেন জাহিরা? করুণা দিয়ে কি কিছু পাওয়া যায়? তা ছাড়া তুমি স্বাধীন সমর্থ মানুষ, তোমাকে করুণা করব কেন?
—আমি যে পারি না। পারি না আর। তোমার লেগে প্রাণ ছটফটায়। শরীল ছটফটায়। কী করি আমি! যতদিন তোমাদের বাউল ছিল, সয়েছি। মুখ বুজে তার সকল সেবাযত্ন করেছি। এবার? এবার আমার দিন কাটে কী প্রকারে তা কও।
—খুঁজে নিতে হবে তোমাকে জাহিরা। তোমার যোগ্য লোক তোমাকে খুঁজে নিতে হবে।
—আমি তো পেয়েছি খুঁজে। তুমি গো। তুমি তো আমার সেই। প্রথম যেদিন তোমারে দেখলাম বাউল, সেইদিনই আমার সকল ভালবাসা তোমারে দিয়েছিলাম। অন্যজনের নারী বলে তুমি আমারে বারবার ফিরিয়েছ। এখন তো সে বাধা নেই।
—আমার তো বাধা আছে জাহিরা।
—বাধা, বাধা, কী বাধা?
ফুঁসে উঠেছিল সে। এক ছুটে দুলুক্ষ্যাপার নিকটে এসেছিল। হাত টেনে নিজের স্তনে রেখেছিল চেপে। ফুলে ফুলে উঠছিল তার বুক। অপমানে। উত্তেজনায়। সেই উত্তাল তরঙ্গমালা স্পর্শ করে দুলুক্ষ্যাপারও দেহে প্লাবন আসতে চেয়েছিল যে, তা সে নিজের কাছে অস্বীকার করে কী করে! কিন্তু সে সংযত হয়েছিল। হাত টেনে নিয়ে বলেছিল—তুমি তো জানো জাহিরা, আমি খুঁজে চলেছি। সেই খোঁজ সম্পূর্ণ না হলে…
কথা শেষ হয়নি তার। জাহিরা বলেছিল—খোঁজ খোঁজ! কীসের খোঁজ? ময়না বোষ্টুমিকে দেখলে তোমার চোখের আগুন জ্বলত না? আমি দেখিনি? মানুষটা মারা গেলে তুমি উধাও হয়ে যাওনি? কিন্তু কী তোমার প্রেম, অ্যাঁ? মানুষটা অমন করে মরল! আ হা হা হা! ভাবলে বুক ভেঙে যায় গো সকলের! আর তুমি কিনা এক মেয়েছেলে জুটিয়ে আনলে? যাকে দেখে বুকের নদী উছলে উঠত, তার মৃত্যুর বছর না পেরুতে নারী খুঁজে পেয়ে গেলে তুমি? কী বলো?
সে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। বলেছিল—সে আমার ভুল। সে আমার অসংযম! তা ছাড়া আমি তাকে খুঁজে আনিনি। সে আপন ইচ্ছায় আমার সঙ্গে এসেছিল। আমি তাকে নিরস্ত করতে চেয়েছিলাম।
—যাও! কথা বানিয়ো না। পুরুষ মানুষ তোমরা। পেটে বিদ্যে আছে। কথা তোমরা বানাতে পারো ভাল। কী পেলে ওই মেয়ের থেকে? অর্ধবয়সী মেয়ে তোমার। লজ্জা করে না? ওই তো সিড়িঙ্গে দেহ! কী পেয়েছিলে তুমি? বুক লেপা, পাছা লেপা। ন্যাকামিতে ভর্তি। গেল তো! মুখে চুনকালি দিয়ে লাথি দিয়ে গেল তো! ঠেকাতে পারলে? আটকাতে পারলে?
—আটকাতে তো চাইনি আমি জাহিরা।
—চাওনি না। ক্ষমতা ছিল না। সত্যিটা স্বীকার কর। সত্য স্বীকারে ডর কীসের?
—নর-নারীর সম্পর্কে বয়স কি কোনও হিসাব মানে জাহিরা?
—যাও, যাও! কানাঘুষোয় যা শুনি, তা-ই আসলে ঠিক।
—কী শোনো?
—শহরের বাবু মানুষ তুমি। লেখাপড়া জানা। আমাদের মতো আনপড় গ্রাম্য মেয়েতে তোমার রুচি নেই। মনে মনে তুমি আজও বাবু রয়েছ বাউল। আমি বুঝতে পারি।
—কিছুই বোঝো না তুমি।
সে যুক্তি দিতে চেয়েছিল।
—ময়না বৈষ্ণবীকে দেখে আমার চোখে আলো ফুটত, তুমি জানো।
—চুপ করো। সে ছিল সাধিকা। তার মতো মেয়েমানুষ তোমাদের জ্ঞানের শহর ছুঁড়লে একটাও পাবে না তুমি। কী তুলনা করছ! শহুরে চটকে ভুলেছিলে তুমি তা স্বীকার করো। সত্য স্বীকারে ডর কীসের?
সে শক্ত হয়েছিল কিছু-বা। এত কথা বলার স্পর্ধা আগে ছিল না জাহিরার। বুড়িয়ার কারণেই এই স্পর্ধা জন্মেছে। সে বলেছিল—তা এত রাত্রে আমাকে তোমার কী প্রয়োজন জাহিরা। এত কথা কইছ, পাশের ঘর হতে সব শোনা যায়।
—শোনা যাক! গুরু তোমাকে আদেশ দিয়ে যাননি? তুমি গুরুর আদেশ পর্যন্ত অমান্য করো কী সাহসে? এত রাতে নারী পুরুষের নিকটে কী প্রয়োজনে আসে তা তুমি জানো না?
—সাহসের কথা বলো তুমি জাহিরা? গুরুর আদেশ বিনা দেহমিলন করিনি আমি। একবারও করিনি। এত রাত্রে নারী পুরুষের কাছে যে প্রয়োজনে আসে, তার জন্য গুরুর আদেশের অপেক্ষা কি রেখেছ তুমি? সাহস তোমার কি কম? এই আখড়ার একটা নিয়ম-কানুন রয়েছে। ব্যভিচারের জায়গা এ নয়। তুমি কি মনে রেখেছ? আজ কি পথ ভুলে তুমি আসোনি আমার কাছে?
—কী বললে তুমি ক্ষ্যাপা? কী বললে? আমি ব্যভিচারিণী?
—নও? সত্যের কথা বলছিলে তুমি এতক্ষণ। সত্য স্বীকারে ডর কীসের?
—কী সত্য! কী! কীসের ব্যভিচার!
—যাও। নিজের শয্যায় যাও জাহিরা। তোমার মধ্যরাতের অভিসার আর কেউ না জানুক, আমি জানি। আমার কাছে এসো না আর। তোমাকে নিতে পারব না আমি।
—ক্ষ্যাপা!
জাহিরা কেঁদে ফেলেছিল। আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে মাথা নেড়েছিল সে বারংবার। সেই মুহূর্তে অসহায় দেখাচ্ছিল তাকে। দুলুক্ষ্যাপা তাকে কাঁদতে দিয়েছিল। কিছুক্ষণ অবিশ্রাম কেঁদে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করেছিল সে। গলায় কান্না জড়িয়ে বলেছিল সেই নারী তখন—কী করতাম আমি বলো! দেহের ক্ষুধা আমাকে বড় তাড়না করে। কী দাহ, কী দাহ! পুরুষের শরীলের তরে দেহে আগুন লেগে যায়। নদীতে দেহ ডুবিয়ে চান করেছি কতবার। তবু কি দাহ মেটে? মাথা পাগল-পাগল লাগে। দেহ পাগল-পাগল লাগে। পুরুষ দেখলে, সবল সুন্দর পুরুষ দেখলে মনে হয় ঝাঁপ দেই। দেহের তাড়না যে কোনও বাধা মানে না ক্ষ্যাপা! এই সবকিছুরই লেগে তুমিই দায়ী। তুমি তুমি।
—আমি? আমি কীভাবে দায়ী হই জাহিরা?
—আমারে নাও না! আমারে নাও না যে! কত চেয়েছি তোমারে আমি! আমার দেহ-মন জুড়ে তোমারেই চেয়েছি ক্ষ্যাপা! যদি একবার নিতে তুমি! একবার নিতে! তোমাদের গণি মিঞার নিকটে কী পেয়েছি আমি বলো? বাহ্যে-মুতে ভরিয়ে রাখত সারাক্ষণ। লালায়-গয়েরে ডুবিয়ে রাখত আমাকে। ওই অশক্ত আঙুল, ওই রোগা-ভোগা শরীর, তবু তাই দিয়েই শরীর ঘাঁটত আমার। নড়তে পারত না, তবু বুকে টিপুনি না দিলে ওর জ্বালা জুড়ত না যেন। ভেবে দেখেছ কোনওদিন, দুর্গন্ধ বার করছে শরীল হতে আর গয়ের তুলতে তুলতে আমাকে ঘাঁটছে! এই কি জীবন আমার? এই জীবন? লোকটা অসুস্থ বলে সয়েছি। কিন্তু আমার সুস্থ ইচ্ছা হতে নাই? সুস্থ দেহ পেতে নাই?
বলতে বলতে কান্নায় ভরে উঠেছিল সে আবার। দুলুক্ষ্যাপা বলেছিল—পেয়েছ তো জাহিরা। সুস্থ তরুণ পুরুষ। সুন্দর। যা চেয়েছিলে, পেয়েছ। আবার আমাকে চাই কেন?
—সে তো ক্ষণিক স্বপ্ন ক্ষ্যাপা! সে আর ক’দিন। এরকম গোপন জীবন, এ তো ভাল নয়। আমারে সুস্থ জীবন দাও বাউল। আমারে তুমি নাও
—তোমাকে নিতে পারব না আমি জাহিরা।
—পারবে না?
—না।
চলে গিয়েছিল সে। অনুরোধ করেনি আর। জাহিরার জন্য কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু কী করবে সে! জাহিরাকে নিতে চায় না তার মন। কেন চায় না? কেন? জাহিরাকে নিলে কি সে ময়না বৈষ্ণবীকে পাবার আনন্দ হারাবে? না। সে তো হারাবার নয়। ময়না বৈষ্ণবী ব্যতিরেকে অন্য কোনও নারীই হল ইহকাল, কিন্তু ময়না বৈষ্ণবী চিরকালের। সে কভু হারায় না। হারাবে না।
মোহনলালের বিয়ে স্থির হয়েছে সে জানে। হতে পারে, নয়াঠাকুমার মৃত্যুর জন্য সে-বিয়ে পিছিয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবে তেমনই দস্তুর। কালাশৌচে বিবাহ ঘটে না। কিন্তু বিবাহ তো হবেই। জাহিরা কি তা জানে না? জানে নিশ্চিতই। এই গোপন অভিসার দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্ভব কিছুতেই নয়।
সে বোঝার চেষ্টা করে, জাহিরা অন্য পুরুষে আসক্ত বলে কি তার হৃদয়ে জাহিরা সম্পর্কে কোনও নিষেধ আছে? না। সে ভাবে। না। নেই। তা হলে? এমন কাতর আবেদন নিয়ে যে-নারী আত্মনিবেদন করে, তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে তার চরিত্রের অহৈতুকী কাঠিন্য কি নেই?
সে অন্যমনস্ক সংগীত ঢালে গলায়। পথ চলে।
ও তুমি দেল হুজুর না চিনলে
তোমার নামাজ হবে কি রে?
দেলহুজুরে পড়ো নামাজ
আপনার মোকাম চিনে।
বে-আকারে সিজদা-দিলে
খ্যাপা সেই সিজদা কি হয় দলিলে
আকার ধরে দাও রে সিজদা
বসে থাকো এক ধ্যানে।
শ্মশানের নিকটে চলে এসেছিল তারা। একটি দেহ পুড়ছে। সেই পোড়া গন্ধে সিদ্ধার্থর হঠাৎ মনে পড়ে গেল ইস্কুলের দুর্ঘটনা। জোর করে অন্যমনস্ক হল সে। নিকটবর্তী এক খড়ো চালার নীচে ছোট কালীর মূর্তি। চালার দাওয়ায় শুয়ে আছেন এক সন্ন্যাসী। ধূলিমলিন কৃশ দেহ। পরনে রক্তাম্বর। চোখ বন্ধ করে তিনি শুয়ে আছেন। শ্মশানযাত্রীর দল ঘিরে আছে চিতাগ্নি।
অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসেছে তারা। এ হল কলাবিবির শ্মশান। আরও ঘণ্টা দু-তিন হাঁটলে তারা পৌঁছোবে ধুলামাটি। এক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে পথ। জঙ্গলের অধিকাংশই কলাবন। তারই ফাঁকে ফাঁকে বাঁশ, তুঁত, শিমুল, বাবলা এবং আরও বহু বিচিত্র গাছ। কালান্তর নিম্নভূমির অন্তর্গত এই বনে আজও বসত গড়ে ওঠেনি কেন, সে এক আশ্চর্য। অবশ্য বসত গড়েনি, তা-ই বা বলা যায় কী প্রকারে? এ বন আরও দীর্ঘ, আরও গভীর ও বিস্তৃত ছিল। গোমুণ্ডি, বাঘান প্রভৃতি গড়ে উঠেছে বৃক্ষ ছেদন করেই। হতে পারে কলাগাছের আধিক্যের জন্যই এ জঙ্গলের নাম কলাবিবির বন। নিজামত আলি বলছিলেন, বহু বর্ষ ধরে কলাবিবির বন হতে জলঙ্গী পর্যন্ত যে-অঞ্চল, এমনকী ভাগীরথী পর্যন্ত তার বিস্তার, এই ভূমি অভিশপ্ত। এই ভূমিতে আছে ডাকাতিয়া মানুষের পাপ।
সিদ্ধার্থর মনে পড়ছিল একথা। কী পাপ, জানে না সে। নিজামত আলি ব্যাখ্যা করেছিলেন, মানুষ সেখানে তাড়াতাড়ি রোগগ্রস্ত হয়, তাড়াতাড়ি মরে যায়।
কী এর কারণ, সে বুঝতে চেষ্টা করে। ভূমির অভিশাপে সে বিশ্বাস করে না। কোনও অলৌকিক নয়, হতে পারে কোনও পার্থিব সমস্যাই এ অঞ্চল হতে মানুষকে দূর রাখে। ধুলামাটি গ্রামের বিষয়ে কৌতূহল উদগ্র হয়ে ওঠে তার। তখন দুলুক্ষ্যাপা থমকে দাঁড়ায় এক মুহূর্ত। তার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে যায় সকলেই। দুলুক্ষ্যাপা অস্ফুটে বলে—অঘোরী এখনও রয়েছে দেখছি।
—অঘোরী?
জিগ্যেস করে সিদ্ধার্থ। দুলুক্ষ্যাপা বলে—চলো, বলছি। এখানে দাঁড়াবার দরকার নেই।
সে বলতে থাকে বৃত্তান্ত। এই পথে যেতে যেতে একদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। বেশিদিনের কথা নয়। শ্রাবণের শেষাশেষি। আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল সেদিন। বৃষ্টিও নেমেছিল দু-চার ফোঁটা।
এবং মনে করতে পারল সকলেই। সত্যিই বৃষ্টির উপক্রম হয়েছিল একদিন শ্রাবণে। বিজলি-বিদ্যুতের রেষারেষি এবং দু-চার ফোঁটা বারিপাতে, সকলেই আশা করেছিল, এসেছে শ্রাবণ। দেরিতে হলেও এইবার বুঝি এসে গেছে বর্ষাকাল। হতে পারে সেদিনই বৈরাগীঠাকুর চলেছিল এই পথে। অতএব তারা শুনতে থাকে সকল বর্ণনা।
.
এই পথে যেতে যেতে মেঘের ঘনঘটার মধ্যে সে দেখেছিল চিতা জ্বলছে। শ্মশানযাত্রী দু-চারজন। আর কুটিরের প্রান্তে ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন সন্ন্যাসী। এই ঘোর দুর্যোগের রাত্রে জঙ্গলে সে কোথায় যাবে আর, ওই কুটিরেই রাতটুকু কাটিয়ে দেবে ভেবে এগিয়ে গিয়েছিল। শ্মশানে মা কালীর কুটির, এ তো কোনও ব্যক্তিগত জায়গা নয়।
ডোমও থাকে না কেউ এখানে। পার্শ্ববর্তী গ্রাম হতে শ্মশানযাত্রীরা তাকে ডেকে আনে। পোড়ান হলেই সে গ্রামে ফিরে যায়।
কুটিরের দাওয়ায় সে বসল যখন, সন্ন্যাসী তাকালেন। রক্তবর্ণ চোখ। ভারী জটাজুট। রক্তাম্বর পরিহিত। দেখে ভক্তি জাগে না, জাগে ভয়। দুলুক্ষ্যাপার এ বয়সে ভয় বিষয়ে নিরাসক্ত থাকা সম্ভব বলে সে গুছিয়ে বসছিল ক্রমশ। আর একদল শবযাত্রী এল তখন। আগের চিতা নিভে এসেছিল। যমুনা বিলের নেমে আসা জলে ক্রিয়াকর্ম করে প্রথম দল এসে কালী প্রণাম করল। প্রণাম করল সন্ন্যাসীকেও। সন্ন্যাসী কারওকে কোনও কথা বললেন না, আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত অবধি তুললেন না। এই দলটি এক বৃদ্ধকে পোড়াতে এসেছিল। তাদের তেমন শোক-তাপ ছিল না। তারা চলে গেল।
দ্বিতীয় দলটি এসেছিল এক কিশোরকে নিয়ে। চিতা সাজানো হচ্ছে যখন, সন্ন্যাসী শবের নিকটে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিশোর শবদেহের নাভিতে আঙুল স্পর্শ করিয়ে অস্ফুটে বিড়বিড় করলেন কিছুক্ষণ। ছেলেটির পিতা ছিলেন শবযাত্রীদলে। তিনি সন্ন্যাসীর পায়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন—আমার বড় ছেলে বাবা! বাঁচিয়ে দাও ওকে। বাঁচিয়ে দাও।
গমগমে স্বর শোনা গেল সন্ন্যাসীর।
—ওঠ। কী হয়েছিল ছেলের?
—আন্ত্রিক হয়েছিল বাবা। বমি। দাস্ত। দু’দিনে মরে গেল। বাঁচাতে পারলাম না।
—কোন গ্রাম?
—ছোট গুমানিয়া বাবা।
—কাল তো ও গ্রামের দুটো মড়া এসেছিল।
—মড়কের মতো হয়েছে যে বাবা। এ ঘরে ও ঘরে হচ্ছে। আরও কত মরবে তার কে জানে? চোখ বুজলে যেন মাথার ওপর শকুনের ছায়া দেখতে পাই। বৃষ্টি নাই। রোগ-বালাই ক্রমশ বেড়ে উঠছে। হাসপাতাল নাই। ডাক্তার নাই। কে বাঁচাবে? কার কাছে যাব? আপনি ওরে বাঁচায়ে দেন বাবা। বাবা গো! দয়া করেন!
—চোপ! মড়া বাঁচাব! আমি কি ভগবান! যা। তাড়াতাড়ি দাহ করে ফিরে যা! বৃষ্টি আসবে। আমি বলে দিলাম, তোর ছেলে স্বর্গে যাবে, যা!
লম্বা লম্বা পায়ে সন্ন্যাসী ফিরে এলেন ধুনির কাছে। নিভু নিভু ধুনির আগুন উসকে দিয়ে তিনি দুলু বাউলের দিকে তাকালেন। বললেন—কী বাবাজি? গাঁজা-গুলি আছে?
—আছে।
—দাও। সেবন করি।
দুলুক্ষ্যাপা কলকে সাজাল। সন্ন্যাসী বাড়িয়ে দিলেন পৃথক কলকে তাঁর। দুলুক্ষ্যাপা তা-ও সাজিয়ে দিয়েছিল। একমনে গাঁজা টেনে সন্ন্যাসী জোর গলায় বললেন – ব্যোম! ব্যোম! বৃষ্টি দে মা! বৃষ্টি দে! বড় ভুখা আছি কতকাল!
দুলুক্ষ্যাপা এ কথার অর্থ বোঝেনি। গঞ্জিকা সেবন করে হালকা ধুমকি এসেছিল তার। সে দেখছিল, কিশোরের চিতা জ্বলে উঠেছে। দূরে অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে জ্বলজ্বলে চোখ শেয়ালের দল এসে জুটেছে। লোভে-লোভে থাকে ওরা। পর্যাপ্ত কাঠের অভাবে বহু যাত্রী আধপোড়া দেহ ফেলে চলে যায়। প্রচুর জল থাকলে দেহখণ্ড ভাসিয়ে দেয় যমুনা বিলে। অত্যন্ত আপনজনের দায় না থাকলে সেটুকুও করে না অনেকে। শেয়ালের দল সেইগুলি টেনে নিয়ে যায়। ভক্ষণ করে।
দুলুক্ষ্যাপা দেখছিল ইতস্তত ছড়ানো আছে ভাঙা হাঁড়ি, ছেঁড়া তোশক, বালিশ, কাপড়। তার সঙ্গে গোটা মেটে হাঁড়িও কিছু, যা শ্মশানযাত্রীরা ভেঙে দিতে ভুলে গেছে। কোথাও আছে স্তূপীকৃত ছাই, যাতে জল ঢালতে ভুলে গেছে।
সেই ওঁত পেতে থাকা শেয়ালের চোখগুলি দেখতে দেখতে সে খেয়াল করেনি সন্ন্যাসী উঠে গেছেন কখন। আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দুর্বোধ্য শব্দ উচ্চারণ করছেন তিনি—ওঁ, হুঁ, ঋ, লিঁ, ফট, ফোট, হুম্, হুম্…
শবযাত্রীরা দেখছে সন্ন্যাসীকে, শ্মশানযাত্রীরা দেখছে সন্ন্যাসীকে। হঠাৎ আকাশের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঝলক দিল বিদ্যুৎ। গুমগুম শব্দ ধ্বনিত হল চতুর্দিকে। শিয়ালগুলি হু-উ হু-উ হু-য়া রবে ডেকে ডেকে পালাতে লাগল জঙ্গলের দিকে। ঝোড়ো হাওয়া উঠল। কুটির যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। দুলুক্ষ্যাপা খুঁটির বাঁশ আঁকড়ে বসল। হাওয়ার হু-হু শব্দে বুকে কাঁপন লেগে যায়।
সন্ন্যাসী চিৎকার করতে থাকলেন—পালা! পালা! বজ্রপাত হবে! বজ্রপাত! মরবি মরবি! সব মরবি!
দারুণ জোর বাজ পড়ল নিকটেই। শবযাত্রীদের অধিকাংশ প্রাণভয়ে পালাতে লাগল। যাঁর ছেলে পুড়ছিল, তিনি অসহায়ের মতো সকলকে ডেকে ডেকে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। শব তখন আধপোড়া। বাতাসের শব্দের সঙ্গে মিশে গেল তাঁর গলা—কানা-আ—ই, রামপ্রসা— আ-আ-―দ, হারু— উউ তোরা যাস না-আ-আ-আ!
হুম্ হাম্ মন্ত্র বলতে বলতে সন্ন্যাসী ছুটে ছুটে বেড়াতে লাগলেন শ্মশানময়। হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। শবযাত্রীদের দু’জন ছেলেটির বাবাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল। কুটিরে দু’জনাও দাঁড়াতে পারে না ঠিকমতো। তা ছাড়া তাণ্ডবে ওই কুটির উড়ে যাবে যে কোনও সময়! তুমুল বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেল চারপাশ। সেই সঙ্গে ঘন ঘন বজ্রপাত। দুলুক্ষ্যাপার মনে হল, সে-ও এই শ্মশান ছেড়ে চলে যায়। চোখের সামনে নিভে যাচ্ছে কিশোরের চিতা। সব মিলিয়ে দুঃসহ সেই পরিবেশ।
আধঘণ্টাকাল। তারপরেই বৃষ্টি ধরে এল। হাওয়া কমে এল। আকাশ ফালা ফালা করে দিল না বিদ্যুৎ। সন্ন্যাসীর ধুনি নিভে গিয়েছিল। চারপাশে নিকষ অন্ধকার। সেই অন্ধকারেও দুলুক্ষ্যাপা সন্ন্যাসীকে চিহ্নিত করতে পারল। চিতার আশেপাশে তিনি ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছেন। সহসা একবার বিদ্যুৎ ঝলসে উঠলে সে দেখল, চিতার কাছে নিচু হয়ে, চিমটেয় করে কী যেন তুলে নিচ্ছেন সন্ন্যাসী। দুলুক্ষ্যাপা বুঝতে পারল না। বৃষ্টিতে তার পোশাক ভিজে গিয়েছিল। ঝোলাঝুলি ভিজে গিয়েছিল। সে কলকে সেজে, ভেজা দিয়াশলাই ঘষে ঘষে জ্বালাবার চেষ্টা করছিল।
দূর হতে লোকজনের গলা পাওয়া গেল এবার। সন্ন্যাসী চিতা ছেড়ে দ্রুত ফিরে এলেন। দুলুক্ষ্যাপা দেখল, তাঁর হাতে একটি মড়ার খুলি। কুটিরের কাছে ফিরে তিনি ধুনি জ্বালাতে শুরু করলেন আবার।
শবযাত্রীরাও আবার ফিরে এসেছে। আরও কিছু কাঠ, কিছু কেরোসিন তেল এনেছে সঙ্গে। আধপোড়া শবদেহটি নতুন করে পোড়াতে শুরু করল আবার। তাদের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিল দুলুক্ষ্যাপা। শ্মশানের চৌহদ্দি ছাড়তেই ওই প্রবল বর্ষণ এবং ঝড়ের আভাসমাত্র তারা পায়নি। শুনে, তাদেরই মতো বিস্মিত হতে হতে ঘুমিয়ে পড়েছিল দুলুক্ষ্যাপা। পুরো ঘুম তাকে বলা যাবে না। গাঁজার ধুমকিতে তন্দ্রা এসেছিল।
তন্দ্রা যখন ভাঙল, সে দেখল চিতা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। একটি লোকও আর নেই। কেবল সন্ন্যাসী ধুনির সামনে বসে মড়ার খুলি হতে কিছু তুলে তুলে খাচ্ছেন। তাঁর মুখচোখ চকচক করছে। তার থেকে ঝরে পড়ছে তৃপ্তি।
তাকে জাগতে দেখে সন্ন্যাসী বললেন—কী বাবাজি? চলবে?
দুলুক্ষ্যাপার খিদের বোধ হচ্ছিল। সে বলল— কী!
সন্ন্যাসী বললেন—বৃষ্টি নামিয়েছি। চিতা নিভিয়েছি। সে কি এমনি এমনি? নরমাংস! নরমাংস। কচি কিশোরের শরীর! খুব সুস্বাদু! খা খা!
চমকে উঠে দাঁড়িয়েছিল দুলুক্ষ্যাপা। চিৎকার করেছিল—নরমাংস! কী বলছেন আপনি! আপনি কি অঘোরী!
—অঘোরী! অঘোরী! হা হা হা হা।
দুলুক্ষ্যাপা আর দাঁড়ায়নি ওখানে। অন্ধকারেই হাঁটতে শুরু করেছিল। বহুদূর পর্যন্ত সন্ন্যাসীর হাসি তাড়া করেছিল তাকে। অঘোরী! অঘোরী! হা হা হা হা!
.
থমকে দাঁড়িয়েছিল সিদ্ধার্থ, তৌফিক এবং বসির খান। সিদ্ধার্থ জিগ্যেস করেছিল— ঠিক বলছেন আপনি বৈরাগী ঠাকুর? ওই লোকটা নরমাংস খায়!
—ঠিক বলছি বাবা!
—লোকটা তার মানে অন্ধকারে চিতা থেকে মাংস তুলে আনছিল!
অহ্ অহ্ ওয়াক! বিকট শব্দ তুলে রাস্তায় বসে বমি করল তৌফিক। বসির খান তার পিঠ ডলে দিতে লাগল। কাঁধের ঝোলা থেকে জলের বোতল বার করে ছিটিয়ে দিল চোখে-মুখে। একটু ধাতস্থ হয়ে তৌফিক বলল— সিধুদা! আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার… আমার বাচ্চাদের মনে পড়ছে।
তৌফিকের মাথায় হাত রাখল সিদ্ধার্থ। একটু আগে শবপোড়া গন্ধে তারও মনে পড়েছিল একথা। জোর করে সেই ভাবনা দমন করেছে সে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল—লোকটাকে পুলিশে দেব।
দুলুক্ষ্যাপা বলল—বাবা! ওরা অঘোরী! ওটাই ওদের ধর্ম। তবে এই অঞ্চলে অঘোরী আছে আগে জানতাম না।
—লোকটাকে পুলিশে দেব। যেতে পারবি তৌফিক?
—পারব।
—চলো বসির ভাই। লোকটাকে ধরতে হবে। দরকার হলে অন্যদিন যাব আমরা ধুলামাটি।
তারা ফিরে চলল শ্মশানের দিকে। দুলুক্ষ্যাপা বলল তাঁকে পাবেই না হয়তো।
—কেন? পাব না কেন?
জিগ্যেস করল সিদ্ধার্থ। দুলু বাউল বলল—ওঁরা আগে থাকতে অনেক কিছু টের পান।
—তাই নাকি? আমরা যে যাচ্ছি তা টের পেয়ে যাবে?
—পেতে পারেন। দেখো।
দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল তারা। শ্মশান হতে খুব বেশি দূর আসেনি। জঙ্গলের সরু পথে চলতে চলতে দেখল দূরে শ্মশানের ধোঁয়া। এমনকী শব পোড়ানোর গন্ধ এসে লাগল নাকে। কী-ই বা সময়! তবু শ্মশানপ্রান্তে এসে তারা দেখল কালীর ছোট কুটিরখানি শুনশান। কেউ নেই। এগিয়ে গিয়ে শবযাত্রীদের জিগ্যেস করল—একটু আগে যে সন্ন্যাসী ছিলেন ওই মন্দিরে, তিনি কোথায়?
তারা বলল— সন্ন্যাসী! তিনি কখন যেন চলে গেছেন।
— কোনদিকে?
—তা তো দেখিনি।
কোনও গ্রামের দিকে? কেউ দেখেননি?
—না। দেখিনি তো আমরা। তিনি শুয়েছিলেন ওখানে, তা-ই দেখেছিলাম। কখন গেলেন খেয়াল করিনি।
তারা আর কথা বাড়াল না। ফিরে চলল। দুলুক্ষ্যাপা বলল— আমি বলেছিলাম।
— হুঁ!
অন্যমনস্ক হয়ে গেল সিদ্ধার্থ। তার মনে হল, পৃথিবী কী বিচিত্র, ঘরের বাইরে পা রাখলেই একমাত্র তা জানা যায়।
তৌফিক বলল—গান ধরুন একটা বৈরাগী ঠাকুর। বিশ্রী লাগছে। বিশ্রী গল্প শোনালেন একটা।
—গল্প নয় বাবা। এ আমার অভিজ্ঞতা।
—ওই হল। এবার ভাল গান ধরুন।
তখন বসির খান বলল—বৈরাগী ঠাকুর!
—বলো বাবা।
—একটা অনুরোধ।
—কী?
—যে-গান গোমুণ্ডি থেকে আসবার সময় গাইছিলেন, সে-গান আর আমার সামনে গাইবেন না।
দুলু বাউল কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল—বেশ বাবা! আমি কারওকে আঘাত করতে চাইনি।
—এবার গান করুন। আপনার গান অসামান্য। আমাদের মন ভাল করে দিন বৈরাগী ঠাকুর।
দুলুক্ষ্যাপা হাসল। জ্ঞানী পুরুষের হাসি। তারপর নিচু স্বরে গান ধরল—
প্রেমের মরা জলে ডুবে না
যে-প্রেম করতে দু’দিন ডাকতে দু’দিন
এমন প্রেম আর কোরো না।
চণ্ডীদাস আর রজকিনী তারাই প্রেমের শিরোমণি
তারা এক মরণে দু’জন মরে
এমন মরা ক’জন মরে।
কাম রতিতে যার সাধনা
তার হবে না উপাসনা।
দেহে কাম থাকিতে প্রেম হবে না
ব্রজ গোপীর ভাব বিনে।
একটু থেমে ব্যাখ্যা করল দুলুক্ষ্যাপা-এ হল শব্দগান। মুর্শিদাবাদের এক সম্পদ। জানো তো? কবিগানের মতো এতেও আছে তরজার দুটি দল। এই যে গান গাইলাম, এ হল একজনের বচনের পাল্টি ব্যাখ্যা। সেই প্রাকবচনের আখর শোনাই—
বাঁকা নদীর বাঁকে দিন দুপুরে জোয়ার আসে
ডাঙ্গা ডহর যায় সে ভেসে বিদঘুটে বন্যা এসে
নাইতে গেলে বাঁকার ঘাটে বিদ্যাবুদ্ধি রয় না ঘটে
কাম নামে কুমির ছুটে চিবিয়ে চুষে খায় তারে।
গান সম্বল করে, স্মৃতি সম্বল করে, স্বপ্ন আঁকড়ে চলতে থাকে তারা, ধুলামাটি গ্রামের দিকে।