৬৮
ভাদরে ভরিল নদী
দু’কূল পাথার।
উঠে যেতে করি মনে
না জানি সাঁতার ॥
উড়ে যেতে করি মনে
পক্ষ না দেয় বিধি।
এমন দশা করে গেল
পিয়া গুণনিধি ॥
.
বর্ষায় ভরা নদী বেয়ে আসেন ভদ্রা। দু’কূল ছাপিয়ে আশীর্বাদের ছড়া দিতে দিতে, রোদে-বর্ষণে হেসে-খেলে তাঁর আগমন। আষাঢ়ে রোপণ করা পরমান্নশালী ধানের শিশু চারাগুলির এ সময় কোমলতনু সবুজ লাবণ্যবতী হয়ে ওঠার কথা। গাছগুলির দিকেই তাকিয়ে ছিলেন বলাই মণ্ডল। বেড়ে উঠেছে চারাগুলি। কিন্তু তাদের যেন সেই লাবণ্য নেই। সেই শ্যামলিমা নেই। শ্যামলে লেগেছে টান। দেহে রুক্ষতা। এই ধানের জন্য লাগে বর্ষার জলে ভেজা নরম কাদামাটি। লাগে জমিতে টইটম্বুর জল। বর্ষা না হলে একা পাম্পসেট আর কত জল দেবে! তা ছাড়া বৃক্ষের সঙ্গে, তৃণ-গুল্ম-লতার সঙ্গে বর্ষার নিবিড় যোগ। পরমাত্মীয় যোগ বর্ষা না এলে বিষণ্ণ সবুজ বাড়বৃদ্ধি ঘটাতে বিমুখ। ধানের গাছ দেখে বলাই মণ্ডল বড় বিষাদগ্রস্ত তাই। কী এক অমঙ্গল তাঁর চারপাশ ঘিরে আসছে।
আমের বাগানে লেগেছে ভাঙন। ভাই ভিন্ন হয়েছে। তার ভাগের আমগাছগুলি নেই। কোনও করাতকলের ধারাল ধাতব পাতে তারা খণ্ড-খণ্ড হয়ে গেছে বুঝি-বা। তাদের শেষচিহ্নের মতো পড়ে আছে ভূমি-সংলগ্ন হালকা হলুদ কাণ্ডের অবশেষটুকু। এখন আমবাগানে গেলে বিশ্বের সকল শূন্যতা বুকে ধাক্কা দেয়। আগ্রাসী নদীটিও কী করুণ! অনাবৃষ্টিতে তার বুক শুকনো। শীতে হয়তো-বা বেরিয়ে পড়বে পাঁজর অবধি।
চারপাশে কেবল নিরুচ্চার হাহাকার। যাদের আউশ এবার মার খেল, তাদের ঘর শূন্য। কয়েক কাঠা জমি চাষ দিয়ে বাঁচে যারা, কিংবা সামান্য দু’-তিন বিঘে অবধি সম্বল, তারা একবেলা উপোস দিচ্ছে। মাটি শুকনো খটখটে। শীতের ফসলও ফলবে না এই মাটিতে। ভাগীরথী হতে টেনে আনা সরু সরু নালায় শুকনো কাদাই কেবল। তেমনি শরীর পোড়ানো গরম। এই চতুষ্কোনা গ্রাম জুড়ে কেবল অলক্ষ্মীর চরণপাত। ঘরে ঘরে অসুস্থ লোক। বারিপাত না হওয়ায় গাঁয়ে গাঁয়ে পানীয় জলেরও অকুলান। পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা ঘটিয়ে দেবে, তেমনও সম্ভবে না। বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃপ্রণালী নেই অধিকাংশ গৃহে। অতএব রোগ বাড়ে। বাড়ছে। খাদ্যের সংস্থান নেই, চিকিৎসা করায় কী প্রকারে!
বিজ্ঞানের দান ধানের উৎপাদনে এসেছে কিন্তু তার কল্যাণ সর্বত্রগামী হয়নি। এবং এই অধিক ফলনশীল বীজ মাধ্যমে সবুজের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলাকে সুনজরে দেখেননি বলাই মণ্ডল। তিনি লক্ষ করেছেন, উচ্চ ফলনশীল ধানের গাছ থেকে যে খড় আসে, তা ভঙ্গুর। খড়ের ঘর ছাওয়া যাচ্ছে না তাই দিয়ে। স্বল্প আয়ের কৃষক মজুর টিন বা টালি কেনার অর্থ পাবে কোথায়? উচ্চ ফলনশীলতার শস্য যা অতিরিক্ত আয় দিল, তা অতিরিক্ত ব্যয় করতেও বাধ্য করল! এর সঙ্গে আছে কীটনাশক। যা স্বাদ নষ্ট করে। স্বাস্থ্যের হানি করে। পশুপক্ষীর, কীট-পতঙ্গের প্রাণ কেড়ে নেয়। প্রকৃতিকে নাশ করে। কিন্তু এ কথা কেউ বোঝে না।
.
নদী খাল বিল শুকিয়ে গিয়ে সকল গ্রামেই বুঝি-বা এমন হতশ্রী দশা। পূজা-পার্বণ হল, ব্রত-শ্রীপাঠ হল, তবু নামল না বর্ষণ। প্রকৃতি-নির্ভর চাষি এই বাংলায়। তাদের দুর্ভাগ্য-সৌভাগ্য, শুভাশুভ মঙ্গলামঙ্গল চলাচল, প্রকৃতির খেয়ালের ওপর নির্ভর করে।
বলাই মণ্ডল পায়ে পায়ে তাঁর ভূমি পরিক্রমা করেন। নদীর কাছাকাছি আরও কিছু জমি আছে তাঁর। জেলেপাড়া ছাড়ালে সুকুমার পোদ্দারের সঙ্গে সঙ্গে আছে তাঁরও জমি। নিজের জন্য রাস্তার দিকের জমিই নিয়েছে কানাই। তাই বেচতেও পেরেছে।
বলাই মণ্ডল জমি বেচার কথা কল্পনাও করেন না। জমি হল কৃষকের প্রাণ। নদী যদি সবটুকু জমি খেয়ে নেয়, তবে কৃষকের প্রাণও খাবে। গ্রামের এতগুলি মানুষের যা হবে, বলাই মণ্ডলেরও তা-ই হবে। কানাই যেমন সন্দেহ করে, তেমন অনেক পরিমাণ অর্থ যদি সত্যিই সঞ্চিত থাকত তাঁর, কানাইয়ের জমি, কানাইয়ের আমগাছ তিনি কিনে নিতেন। ওই জমি, ওই গাছ তাঁর শোণিতধারা। এই পৃথিবী যখন দ্বন্দ্ব ও অমঙ্গলে ভরে যায়, তখন নিজের রক্তের দায় মেটাতে হয় এভাবেই। মেটাতেন, তিনি মেটাতেন। ক্ষমতা থাকলে বুকে করে রাখতেন। অন্য হাতে দিতেন না। তিনি দূরের দিকে চেয়ে থাকেন। দূরের অস্পষ্টতায় যেন দেহপোড়া ধরণীর ধোঁয়া। আর ঠিক ওই ধোঁয়ার আস্তরণের পরেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যের বিধিলিপি। বলাই মণ্ডল তাকিয়ে থাকেন। ধোঁয়া একটু সরে গেলেই ভবিষ্য পড়ে নিতে চান। কিছু আবাদি জমির পাশে পড়ে থাকা অনাবাদি জমির বৈষম্য কবিতা হয়ে পাক খায় অন্তরে তাঁর। হঠাৎ ইচ্ছে হয়, সেই পত্রিকাটি দেখতে। যাতে আছে তাঁর মুদ্রিত কবিতা, সকলের সামনে সেই পত্রিকা দেখতে তিনি লজ্জাবোধ করেছিলেন। পরের দিন কানাইয়ের আমবাগান কেটে ফেলার অভিভূত শোকে ওই পত্রিকা হতে শেষ পর্যন্ত দূরেই ছিলেন তিনি। সেই শোক এত ভারী হয়ে চেপে আছে যে, পত্রিকা অনাদরে আছে আজও। উল্টে দেখা হয়নি তাকে। পড়া হয়নি। মুখোমুখি বসা হয়নি নিজের মুদ্রিত নামের সঙ্গে। আজ এই শোকের বেলায়, শকুনের ছায়ার মতো নেমে আসা অলক্ষ্মীসম্পাতের সম্ভাবিত সময়ে কবিতার সেই পত্রিকা মনে পড়ে তাঁর। যেন হঠাৎ মনে পড়ল অনাদৃতা দুয়োরানির কথা। তাঁকে ছুঁতে ইচ্ছে করল। রাজানুগ্রহবঞ্চিতা দুঃখিনী বনবাসিনী সেই।
এ-ও তো জীবনেরই দান। ভাবলেন তিনি। এই কবিতার মুদ্রণ। কবিতাগুলির স্বয়ং বই হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। আজও কবিতা নির্বাচন করা হয়নি। বড় কঠিন এ কাজ। তাঁর কাছে প্রতিটি রচনাই প্রাণময়। প্রত্যেকেই চোখ মুখ হাত পা কোষ কলা সমৃদ্ধ শরীরী। নিজেরই মস্তিষ্কপ্রসূত প্রতিবিম্ব নিজের। কার প্রতি দেখাবেন পক্ষপাত? কোনও একটি খাতাই তবে দিয়ে দেওয়া যাক। সাম্প্রতিক খাতা কোনও।
তিনি বাড়ির দিকে চললেন। আজ দুপুরে বসবেন তাকে নিয়ে। মুখোমুখি বসবেন। আমবাগানে গিয়ে, কোনও একটি গাছে ঠেস দিয়ে দেখবেন স্বনাম। দেখবেন, মুদ্রণের পর কবিতা দূরের হয়ে যায় কি না। লেখা লিপির সঙ্গে মুদ্রিত লিপির অভিব্যক্তিতে পার্থক্য ঘটে যায় কি না।
বাড়ির কাছেই দেখা হল মাধব পিয়নের সঙ্গে।
—চিঠি আছে আপনার।
বলল সে। বলাই মণ্ডল অবাক হলেন—তাঁকে চিঠি লিখবে কে! হাত বাড়ালেন তিনি। পেলেন একটি মুখবন্ধ সাধারণ খাম। খামের ওপর সুন্দর হস্তাক্ষরে তাঁর নাম ও ঠিকানা লেখা। প্রেরকের নাম নেই। কেবল প্রাপকই নির্দেশিত। কে হতে পারে, ভাবতে ভাবতে ঘরে এলেন। মেয়েকে ডাকলেন – সুমি, কাঁচি আছে?
সুমি তৎপর। বলল— আনি বাবা।
একটি কাঁচি সে এনে দিল বলাই মণ্ডলের হাতে। তিনি আলোর দিকে উঁচু করে ধরলেন খাম। সরু করে কেটে নিলেন মুখ যাতে ভেতরের চিঠির কোনও ক্ষতি না হয়। সুমি দাঁড়িয়ে ছিল। সে তো জন্মাবধি কখনও দেখেনি তাদের বাড়িতে চিঠি। তাই তার বিস্ময় জেগেছে। এমনকী পুলক। তারা যেন হয়ে যাচ্ছে বড়ই গুরুত্বপূর্ণ, এই চিঠির মাধ্যমে। ভাবছিল সে। চিঠি। কে চিঠি লেখে, কোথায় বসে লেখে আর ছোট্ট বাক্সে পোস্ট করে দেয়। সেই বাক্স হতে কত-কত দূরে, কোন দূরে, কোন প্রান্তে পৌঁছে যায় সব। একজন পায় তাকে। কেউ পায়। কেউ দেয়, কেউ পায়। যদি ভাল দেয় চিঠিতে, তা হলে ভাল পায় যে পড়ে, সে। তার বুকে অকারণ আনন্দ ভরে এল। সঙ্গে শঙ্কা অকারণ। তার বাবা কী পেয়েছেন? ভাল, না খারাপ? সে বলল—কার চিঠি বাবা?
—জানি না। দেখি।
বেরুল চিঠি। ভাঁজ করা একটিমাত্র পাতা। বলাই মণ্ডল স্বাক্ষর দেখলেন—উজ্জ্বল পরামাণিক। সুমিকে বললেন—সেই যে ভদ্রলোক এসেছিলেন কলকাতা থেকে, তাঁর চিঠি।
সুমি কাঁচি নিয়ে চলে গেল। সম্ভবত খবরটা মায়ার কাছে যাবে। বলাই মণ্ডল আন্দাজ করলেন। পাখার হাওয়ার দিকে পিঠ করে বসে চিঠি পড়তে শুরু করলেন তিনি।
প্রিয়জনেষু,
প্রথম পত্রেই এই সম্বোধন করলাম। তার জন্য অনধিকারচর্চার অপরাধে ফেলবেন না আমাকে। আপনার কবিতা যতটুকু পড়ার সৌভাগ্য লাভ করেছি, আপনাকে দেখার সৌভাগ্যও যতটুকু হয়েছে, তাতে আপনাকে প্রিয় না বলে থাকি কী করে!
শত কবির ভিড়ে আপনার কবিতা যদিও এক ব্যতিক্রমী এবং সমৃদ্ধ সংযোজন, কিন্তু সেটুকু বললেই আপনাকে নিয়ে গড়ে ওঠা বিস্ময়ের কারণ সম্পূর্ণ বোঝা যাবে না। আপনার কাছে গিয়ে আমি যে দেখেছি এক অসামান্য দৃশ্য। চাষের জমির থেকে মাটি মেখে উঠে আসছেন কবি। আমি জানি না, পৃথিবীর ক’জন সম্পাদকের এ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
সত্যি বলতে কী, আমার বিস্ময় এখনও কাটছে না। আমি হয়তো কিছু বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ফেলছি। এই শহরে বসে তা যেন শোভন নয়। কিন্তু আমি তো সত্যিই অভিভূত।
ইতোমধ্যেই, আপনার প্রকাশিত কবিতাগুলির প্রশংসা আমি পেয়েছি। আমি জানি, এই শুরু। এর পরের পথ কেবলই আপনার জয়যাত্রা।
এবার শেষ প্রসঙ্গ। আপনি কি পাণ্ডুলিপি তৈরি করলেন? কবে নাগাদ নিতে যাব, যদি জানান খুব ভাল হয়। আমি না যেতে পারলেও, আমার বন্ধু যাবেন। যদিও আমার নিজের যাবার ইচ্ছেই ষোলো আনা। আবার আপনার সঙ্গে বসে দুটি কথা বলব, আপনার পরমান্নশালী ধানের ক্ষেত দেখব, আপনার আমবাগানের নিবিড় ছায়ায় বসে দেখব ঘোলা স্রোতে ভাগীরথীর বহে যাওয়া।
আপনার গাছগুলি ভাল আছে তো? পাড় বাঁধাবার দাবি করে যে-আন্দোলন সেদিন হচ্ছিল, তারই বা ফলাফল কী!
আমি বলি কী, ষাট বাষট্টি নয়, আপনি আমাকে দিন মোট একশোটি কবিতা। প্রথমে ভেবেছিলাম, ছোট ছোট কবিতাগুলি এক পাতায় দুটো-তিনটে ধরিয়ে দেব। কারণ চার ফরমার বইতে উৎসর্গ, সূচিপত্র, পরিচয় ইত্যাদির জন্য চলে যায় প্রায় ন’পাতা। হাতে যা থাকে তাতে টেনে-টুনে ওই ক’টি কবিতাই যায় বা তার চেয়েও কম। পরে ভেবে দেখলাম, আপনার কবিতার শক্তি, যত বেশি করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, ততই ভাল। বড় প্রকাশকের দরবারে একশোখানা কবিতাই নিয়ে যাব আমি। তার মধ্যে থেকে যা ওঁরা বেছে নেবেন, বাকি আমার পত্রিকার জন্য রইল। আর যদি সবই ওঁরা নিতে রাজি হয়ে যান, তা হলে তো কথাই নেই।
আপনার পত্রের প্রত্যাশায় রইলাম। নমস্কার নিবেদনে ইতি
উজ্জ্বল পরামানিক
.
বলাই মণ্ডল একবার পড়লেন চিঠি। শেষ করে, আবার পড়লেন। তখন মায়া এসে দাঁড়ালেন কাছে—হ্যাঁ গো, কী লেখা আছে চিঠিতে? খারাপ খবর নয়তো?
বলাই মণ্ডলের চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন মায়া। তাঁর শরীর বলাই মণ্ডলের কাঁধ স্পর্শ করে যাচ্ছে। স্ফুলিঙ্গ উঠছে সেই হালকা স্পর্শমাত্রই। কতদিন কাছে পাননি পরস্পরকে। বলাই মণ্ডল অল্প হেসে বললেন-— না। খারাপ কিছু না।
—সেই ভদ্রলোক লিখেছেন শুনলাম।
—হুঁ।
—বই হবে তো?
—সেই কথাই লিখেছেন। মায়া?
–গেল।
—বল।
—আমি যেন চারপাশে কেবলই অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পাচ্ছি।
—কেন বলছ এ কথা?
—আমবাগানটা জলে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টি হল না এ বছর। কানাইটা আলাদা সংসার করে চলে
—ভাইয়ে ভাইয়ে ভিন্ন তো হয়ই আজকাল। তারা সুখী থাকতে পারছিল না এখানে। এখন যদি আলাদা হয়ে ভাল থাকে, ক্ষতি কী!
—কী জানি! ভাল লাগে না মায়া। চারদিকে হাহাকার বাজে কেবল। ও গাছগুলো কেটে ফেলল। তার অভিশাপ লাগবে না তো?
—অত ভেবো না তো। গ্রামে তো আমরা একা নই। সবার যা হবে, আমাদেরও তা হবে। যাও, নেয়ে এস। রান্না হয়ে গেছে। খেয়ে নাও।
স্নান-খাওয়া করে পত্রিকাটি হাতে নিয়ে বেরুলেন বলাই মণ্ডল। মায়া দেখলেন। পত্রিকার মধ্যে রয়েছে সম্পাদকের চিঠিখানাও। কিছু বললেন না তিনি। বুঝলেন, স্বামী নিভৃতে বসবেন ওইগুলি নিয়ে। সংসারের কাজে মন দিলেন তিনি। কাজ তো কম নয়। ঘর-দোর পরিষ্কার রাখা, গোহাল নিকনো, জামা-কাপড় কাচা, বাসন মাজা, গোবর দিয়ে ঘুঁটে দেওয়া, ঠিলা বানানো। রান্না ছাড়াও তাঁকে করতে হয় এমন হরেক কাজ। এই বৃষ্টিহীন ভাদ্রের দুপুরেও একদণ্ড বসার উপায় নেই তাঁর।
তখন, পত্রিকা হাতে নিয়ে বলাই মণ্ডল পৌঁছলেন আমবাগানে। কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর ঠিকরোচ্ছে রোদ। সারা বাগান জুড়ে আর্ত শুষ্কতা। তবু, এই উত্তপ্ত ভাদ্রেও, আমগাছগুলির নীচে এক অপূর্ব আবেশ। তিনি কাটা গাছগুলির দিকে পিঠ করে দীপক নামের গাছে ঠেস দিয়ে বসলেন। সামনে বহে যাচ্ছে শীর্ণা ভাগীরথী। তার জলে রোদ্দুর পড়ে চোখ ঝলসাচ্ছে। এইখানে এসে তাঁর মন বিষণ্ণ হল আরও। তবু তিনি সম্পাদকের চিঠি খুললেন আবার। পড়লেন। পত্রিকা খুললেন। বসলেন নিজের মুদ্রিত নামের মুখোমুখি। পড়লেন কবিতাগুলি। তাঁর মনে হল এই বলাই মণ্ডল তিনি নন, এ অন্য কেউ। এই কবিতা তাঁর নয়। মুদ্রিত হয়ে এইসবই যেন অন্য কোনও লোকের অধিবাসী। তিনি হাত রাখলেন কবিতার গায়ে। বললেন—তোমরা চেন তো আমায়? আমাকে ছেড়ে চলে যাওনি তো?
হারুন আর আকবর আলি আমবাগানের মধ্যে দিয়ে জেলেপাড়ায় ফিরছিল। বলাই মণ্ডলকে দেখে দাঁড়াল দু’জনে। বই বন্ধ করে বলাই মণ্ডল বসতে অনুরোধ করল তাদের। বসল তারা। বিড়ি বার করে ধরাল। আলোচনা চলতে থাকল অনাবৃষ্টির বিষয়ে। প্রসঙ্গ একটাই এখন বৃষ্টিবিহীন এই পরিস্থিতি। এমনকী ভাঙনের প্রসঙ্গও উহ্য থেকে যাচ্ছে। গ্রামদেশে মরশুমি রোজগারের ওপর নির্ভরশীল জীবন। বেশি দূর ভবিষ্যতের দিকে তাকাবার অবকাশ নেই। বর্ষা হয়নি বলে মাঠে চাষ নেই। নদী-পুকুরে জল নেই। মাছ নেই। জেলেরা বেকার পড়ে আছে।
এইসব আলোচনার মাঝেই যেন ভূমিতে মৃদু কাঁপন টের পেল তারা। ভূমিকম্পের দোলা নয়। যেন কার পদভারে কম্পিত মেদিনী। তারা কথা বন্ধ করল। একটি ঝর-ঝর সর সর শব্দ উঠল সঙ্গে সঙ্গে, আর বলাই চিৎকার করলেন—এই এই এই।
এক লাফে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চিঠি ও পত্রিকা ছিটকে মাটিতে পড়ল। উন্মাদের মতো চিৎকার করছেন, চোখ দুটি ঠিকরে বেরুচ্ছে। তিনি ছুটে যাচ্ছেন—ধরতে হবে। ওকে ধরতে হবে। পড়ে যাচ্ছে। পড়ে যাচ্ছে।
আকবর আলি ও হারুন দেখেছে এতক্ষণে। ঝাঁকড়া ডালপালা নিয়ে, মোটা বলিষ্ঠ শাখা-প্রশাখা নিয়ে ধীরে ধীরে পড়ে যাচ্ছে একটি আমগাছ। বলাই মণ্ডল থরথর করে কাঁপছেন। জান্তব শব্দ বেরুচ্ছে তাঁর কণ্ঠ হতে। হারুন চিৎকার করছে—আকবর ভাই। লোকটা চাপা পড়ে মরবে। চল। চল।
ছুটে যাচ্ছে তারা। চিৎকার করছে—বলাইদা, সরে আসো। সরে আসো।
দু’জনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বলাই মণ্ডলের ওপর। তাঁকে হিঁচড়ে টেনে আনছে। বিমলার কর্কশ দেহকাণ্ডে ঘষে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে বলাই মণ্ডলের করতল। দু’জনের সবল বেষ্টনীর মধ্যে ছটফট করছেন তিনি। কেবলই বলছেন—পড়ে যাচ্ছে। ওকে না ধরলে নদীতে পড়ে যাবে। পাড়ের শুকনো বালুকাময় মাটির ওপর সবল তাঁকে জড়িয়ে আকবর আলি বলছে— সে ওমনিও যাবে। ওই গাছের চাপে মরতে চাও তুমি?
হারুন বলছে—গায়ের জোরে গাছের মরণ ঠেকাবে তুমি?
বিমলা পড়ছে তখনও। পড়তে পড়তে ছড়াক শব্দে সে যেন ডাল-পাতাসুদ্ধ মাথা আছড়াল নদীর বুকে। গুঁড়ির তলায় লম্বা-লম্বা শিকড় ছিঁড়ে খোঁচা-খোঁচা হয়ে আছে মাটির ওপর। বলাই মণ্ডল দেখছেন, মাটির সঙ্গে ছোট একটি কোণ রচনা করে পড়ে আছে বিমলা। ও তো পড়তই। পড়তই হঠাৎ। তবু, চোখের সামনে প্রিয় গাছের এই মৃত্যু দেখে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন বলাই মণ্ডল। আর চিৎকার নয়। কেবল গুঙিয়ে উঠে বললেন—মরে গেল। ও মরে গেল। ওঃ ওঃ ওঃ!
ঘাড় নিচু করে বুক-ফাটা বেদনায় কাঁদতে থাকলেন তিনি। শব্দ নেই। শুধু সারা দেহ কুঁকড়ে যাচ্ছে। নদীর পাড়ের বালি শুষে নিল তাঁর চোখের জল। মুখের লালা। গামছা জড়ানো আদুল গা থেকে ঝরে পড়া ঘামের বিন্দু। আত্মীয়-বিয়োগব্যথাকাতরতার মতোই দেখাল তাঁর কান্না। চোখে জল এসে গেল হারুনের। সে বলল—তা বল, কত বছরের গাছ!
.
আকবর আলি বলল—ফলন্ত গাছ। ভরে আম দেয় ফি বছর। তা ক্ষতি তো হলই, না? হারুন বলল—এ শুধু টাকার ক্ষতি নয় রে আকবরভাই। এ হল মনের ক্ষতি। আকবর আলি জবাব দিল—হুঁ। কাঠটা কেটে নিলে কিছু ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।
—দুর! তোর শুধু টাকার হিসেব।
—টাকা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না হারুন ভাই।
তারা বলাই মণ্ডলকে ডাকাডাকি করে। বাড়ি ফিরে যাবার পরামর্শ দেয়। কাজের সন্ধানে বেরিয়েছিল দু’জন। দুপুরের খাওয়া হয়নি এখনও। বেলা তিনটে গড়িয়ে গেছে। বলাই মণ্ডলকে একা ছাড়তে তবু তারা ভরসা পাচ্ছে না। হাওয়ায় হাওয়ায় খবর রটে গেছে, বলাই মণ্ডলের গাছ পড়েছে। জেলেপাড়া থেকে পিল-পিল করে বেরিয়ে আসছে লোক। ছেলে, বুড়ো, কচি শিশু কোলে বউ। এ এক দর্শনীয় বটে। অতবড় আমগাছ। কী রকম নিঃশব্দে পড়ে গেল। আরও যাবে। একে একে যাবে সব।
বিমলার দেহ মৃতদেহ বলে বোধ হচ্ছে না। কারণ তার পাতাগুলি এখনও সজীব। তবু তাকে মৃত জ্ঞানে ঘিরে দাঁড়িয়েছে লোক। এই প্রথম আমগাছ পড়া শুরু হল। এবার কার পালা? পোদ্দারের কোনও গাছের? নাকি জেলেদের ঘর কোনও? লোকে স্তব্ধ হয়ে দেখছে। খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে। চাষের জমি থেকে চলে আসছে চাষিরা। ভিড়ের মধ্যে নিজেকে সংযত করছেন বলাই মণ্ডল। ধীর পায়ে তিনি গিয়ে দাঁড়িয়েছেন বিমলার দেহের কাছে। তাকে স্পর্শ করছেন। কী পরম স্নেহ, কী মমতা! তাঁকে গাছের কাছে দেখে পরামর্শ ছুড়ে দিচ্ছে জনতা—কাঠটা বেচে দাও। না হোক দেড়-দু’হাজার টাকা দাম পাবে।
বলাই মণ্ডল উদ্ভ্রান্ত চোখ মেলে তাকাচ্ছেন জনতার দিকে। খবর পেয়ে এসেছেন সুকুমার পোদ্দার। বলছেন—শোক কোরো না বলাই। এ তো আমাদের জানা পরিণতি। কাঠটা ভাল লোকের কাছে বেচে দাও। তবু কিছু টাকা পাবে।
–না।
বলাই মণ্ডল গোঁজ হয়ে বলছেন।
–কী না?
বিস্মিত প্রশ্ন করছেন পোদ্দার। বলছেন—এ তো বেশ পুরনো গাছ। কাঠ খারাপ হবে না। আমি লোক ডেকে দেব।
—না। গাছ বেচব না আমি।
—কেন? গাছ তো এখানে থেকে থেকে পচে যাবে।
—যাক।
সুকুমার পোদ্দার কোনও কথা বলেন না। একে একে লোক ঘরে ফিরে যায়। কাজে চলে যায় যে-যার মতো। সুকুমার পোদ্দার বলাই মণ্ডলের পিঠে হাত রাখেন। বলেন—চলো। পাড়ে বোল্ডার ফেলা হবে। ভাঙন আটকে যাবে তখন।
—কবে?
শিশুর সারল্যে জিগ্যেস করেন বলাই মণ্ডল।
—শিগগির। খুব শিগগির।
সুকুমার পোদ্দার শিশুকেই সান্ত্বনা দেন। বলাই মণ্ডল মাথা নিচু করে ফিরতে থাকলেন তখন। যেন প্রিয়জনের অন্ত্যেষ্টি করে এই ফেরা। তাঁর মাথায় এলোমেলো চিন্তা। বিপুল অস্থিরতায় সেই চিন্তার জগতে স্থান পেল না ওই পত্রিকা ও চিঠি। হারিয়ে গেল পাণ্ডুলিপি তৈরির ইচ্ছা।
সারা সন্ধ্যা তিনি স্তব্ধ হয়েই রইলেন। তীর্থ বাবার পাশে পাশে রইল সারাক্ষণ। রাতে খাবার রুচি লাগল না কারও। কোনও মতে দুটি খেয়ে শুয়ে পড়ল সকলে। একা তীর্থ জেগে বসে রইল বই খুলে। টেবিলবাতির ছোট আলোকবৃত্তে ছোট ছোট অক্ষরগুলির মধ্যে নিবিষ্ট হতে চাইছিল সে প্রাণপণ। হঠাৎ তার কানে এল ঠক ঠক। কীসের শব্দ? কাঠঠোকরার? না। কাঠঠোকরার শব্দের চেয়েও ভারী এ শব্দ! তখনই ধরফর করে উঠে বসলেন বলাই মণ্ডল। বললেন—তীর্থ, শুনতে পাচ্ছিস?
—হ্যাঁ।
—কাঁদছে না? ওঃ ওঃ করে কাঁদছে। দিবা, এ দিবার কান্না। নয়তো স্বপ্না, নিশি ওদের কান্না! কাঁদছে! বিমলার জন্য কাঁদছে!
—বাবা। আমার মনে হচ্ছে গাছ কাটছে কেউ।
—গাছ কাটছে!
—যাবে বাবা?
—চল।
মায়াকে ডাকল তীর্থ। মায়া বললেন—আমিও শুনতে পাচ্ছিলাম শব্দটা। এখনও হচ্ছে না?
—হচ্ছে।
—একটা লাঠি নিয়ে যাও।
ছেলে লাঠি হাতে নিল। বাবা নিলেন টর্চ। অন্ধকার আকাশে কিছু মিটমিটে তারা। নিরালোকে বায়বীয় দেহগুলি পাশে পাশে যায়। টের পায় তীর্থ। বলাই মণ্ডল তীর্থকে ধাক্কা মারেন—সরে যা। দাঁড়া।
টর্চের আলো ধরে থাকেন তিনি। পথের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে ধীরে ধীরে পার হয়ে গেল একটি কালো কুচকুচে সাপ। তীর্থ লাঠি ধরল শক্ত করে। যত আমবাগানের কাছে যাচ্ছে তারা, তত শব্দ স্পষ্ট হচ্ছে। ঠক ঠক ঠক। এবারে দেখতে পাচ্ছে তারা, লণ্ঠনের আলো। অর্থাৎ লোক এসেছে। কেটে নিচ্ছে বিমলার কাঠ। কুঙুলের কোপ মারছে ঠক ঠক ঠক! যেমন, গো-মার্জার-সারমেয়র মৃতদেহ পড়ে থাকলে মাংস খুবলে নেয় কাক, শকুন! মানুষ খুবলায় মানুষকে। খুবলায় মানুষের সম্পদ। এখন তারা কেটে নিচ্ছে বিমলা নামের আম্রবৃক্ষের দেহ। অন্ধকার চিরে চিৎকার করছেন বলাই মণ্ডল—কে? কে? কে?
ঝপ করে নিবে গেল লণ্ঠন। দুপদাপ লাফিয়ে পড়ার শব্দ হল। জেলেপাড়ার দিকে দৌড়ে গেল কারা। তীর্থ বলল —আওয়াজ করলে কেন বাবা? ধরতাম।
—না।
বললেন বলাই মণ্ডল।
—না। ওদের হাতে কুভুল ছিল তীর্থ। আর মুখ চিনে কী হবে? শত্রু বাড়বে শুধু। বৃষ্টি নেই। আবাদ নেই। মাছ নেই। লোকে অভাবে পড়েছে রে তীর্থ। অভাব থেকেও তো লোভ আসে।
পায়ে পায়ে তারা এগিয়ে গেল গাছের কাছে। তখনও হেলে আছে বিমলা। পাতাগুলো তখনও সজীব। তার বুকের কাছে লেগে আছে কোপের পর কোপ। এই অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে বাকলের আড়ালে থাকা সাদা কাঠ। ক্ষতস্থানে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে নিজের তীব্র বেদনা ঢেলে দিলেন বলাই মণ্ডল। বললেন—কী নিষ্ঠুর!
তীর্থ বলল—এ তো বিমলা না?
—হুঁ। কাল একে বেচে দেব তীর্থ।
—দেবে?
—হুঁ। না হলে দশভূতে লুটে খাবে আমার বিমলাকে। তার চেয়ে ওর শেষটুকু আমাদের জন্যই থাক।
বিমলার কাণ্ড জড়িয়ে গাল চাপলেন তিনি। মনে হল, বিমলা মৃতদেহের মতো ঠান্ডা।
তীর্থ বলল—আমরা আজ পাহারা দিই বাবা। ওরা তো আবার আসতে পারে।
—হুঁ। চল। একটা লণ্ঠন আর মাদুর নিয়ে আসি। কাল বিমলার শেষ কাজ। তার আগে থাকি ওর সঙ্গে। তোর মাকেও বলে আসি।
—চল।
ফেরার পথ ধরল দু’জন। চলতে চলতে তীর্থর পায়ে লেগে ছিটকে গেল কিছু। তীর্থ বলল—কী লাগল?
বলাই মণ্ডল আশেপাশে টর্চ ফেললেন। দেখলেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কবিতার পত্রিকা। দুপুরে একে এনেছিলেন পড়বেন বলে। তীর্থ তুলে নিল। টর্চের আলোয় দেখে বলল—এটা এখানে এল কী করে?
—এনেছিলাম।
—এভাবে এখানে রেখে চলে গেছ?
—সম্পাদকের একটা চিঠিও ছিল।
—চিঠিটাও? ওঃ!
বাবার হাত থেকে টর্চ নিয়ে আঁতিপাতি করে আমবাগানে সম্পাদকের চিঠি খুঁজতে লাগল তীর্থ।