৭৮
ডাইনীর আয়নায় চোখ তুলে যখনই তোমারে আমি ডাকিতাম
আমার নিকটে এসে বলে যেতে—এই আমি, এই আমি আছি’
কোথাও অনেক দূরে চলে গিয়ে হঠাৎ আমার কথা মনে হলে
মুহূর্তে আসিতে তুমি কাছে
(ডাইনীর কার্পেটে চ’ড়ে)
সে সময় দিনে রাতে যত বার গিয়েছি মরিয়া
সেই—সেই—পুরোনো সে ডাইনীর ওষুধ পেয়েছ তুমি ততবার
ততবার বাঁচায়েছ—
জেগে উঠে পেয়েছি দুধের ঘ্রাণ আমি
তোমার বুকের থেকে ঝরিতেছে।
মৌসুমি ফোন করেছিলেন তার দপ্তরে। ভারগ্রস্ত সে-স্বর।
–একবার আসতে পারবি ছুটির পর?
সে বলেছিল—হ্যাঁ। সে তো যাবই। তুমি তৈরি থেকো। তোমাকে নিয়ে বেরুব।
—না।
–না? না কেন?
—যাওয়া হবে না হারাধন। তুই আয়।
সেই হতে অস্থির হয়েছে সে কেবলই। হাতে কাজ ছিল। না হলে আগেই বেরিয়ে পড়ত। অসিতস্যার কলকাতায় গিয়েছেন। মা একা বাড়িতে সে জানে। আজ কেনাকাটা করতে যাওয়া হবে না শুনে একপ্রকার স্বেদ-পুলক অনুভব করছিল সে। সম্পূর্ণ একা পাবে সে মাকে। প্রশ্নহীন, বিকারহীন সে থেকে যাবে রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত। কারও প্রত্যাগমনের আশঙ্কায় উৎকর্ণ হবে না।
কিন্তু মায়ের ওই গলা! সে কেন! পুলক হতে শঙ্কায় পৌঁছল সে। কিছু কি হয়েছে? কী হল! মৌসুমি, মৌসুমি, মৌসুমি মনে মনে জপ করল সে। ‘আমার মৌসুমি’ কথাটি ভাবল সে এমন যেন আসলে শব্দটার ওপর বুলিয়ে দিল পালক। শরীরের গন্ধ পেল সে। কতদিনের চেনা। কতকালের প্রিয়। তাঁকে গভীর করে ভাবলে তাঁর সমস্ত প্রাণ হারাধনকে ঘিরে ধরে। এই সব সে চায়। এ ছাড়া সে বাঁচবে না। কৈশোর খণ্ডন করে তারুণ্য প্রথম আসন পেতেছিল মৌসুমি মায়ের সান্নিধ্যে। তিনি শাড়ি বদলাতেন তারই সামনে। সে মুখ নিচু করলে বলতেন—মায়ের কাছে ছেলের লজ্জা কী! নেই। লজ্জা নেই। সমস্ত লজ্জা ঠেলে সে আজ এক মানুষ এসে দাঁড়ায় দরজায়।
অসিতস্যারের বাড়ির কাছে পৌঁছল সে যখন, জানল না, মৌসুমি লক্ষ রাখছেন জানলার পর্দার আড়াল হতে। সে কাছাকাছি আসতেই, দ্রুত পায়ে এসে দরজা হাট খুলে দিলেন তিনি। কেদারায় বসলেন চুল এলিয়ে। আলুথালু। ভেঙে পড়া। আলো নেভানো রইল।
হারাধন এসে ডাকল—মা!
সাড়া নেই।
—এ কী! দরজা খোলা এমন! মা!
মৌসুমি নীরব
—আলো জ্বালনি কেন মা?
নিজেই আলো জ্বেলে দিল সে। দরজা বন্ধ করে দিল। ছুটে গেল মৌসুমির কাছে। তাঁকে স্পর্শ করে বলল—এ কী! এভাবে বসে আছ কেন মা! কী হয়েছে!
ডুকরে কেঁদে উঠলেন মৌসুমি। হারাধন তাঁকে কাছে টেনে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল—মা! সোনা মা আমার। কী হয়েছে বলো! কেঁদো না। তুমি কাঁদলে তোমার হারাধন কষ্ট পায়। তুমি কি হারাধনকে কষ্ট দিতে চাও!
মৌসুমি হারাধনের পেটে মুখ ঘষছেন। বলছেন—হারাধন! হারাধন!
—বলো মা।
–ও হারাধন! হারাধন!
—বলো মা। বলো। বলো।
—তোর বউ হারাধন… তোর বউ সুমি… আমাকে আমাকে… দারুণ অপমান করেছে রে। দারুণ অপমান। আমি সইতে পারছি না রে! হা হা হা! সইতে পারছি না।
হারাধন ঝাঁকুনি দিচ্ছে মৌসুমিকে। বিস্ফারিত হয়ে গেছে চোখ তার। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। সে বলছে—বলো! আমাকে বলো! কী অপমান! কোথায় করল সুমি? কেন করল!
—চড় মেরেছে! আমাকে চড় মেরেছে!
—চড় মেরেছে! মৌসুমি! তোমাকে! কী বলছ তুমি!
ক্রোধ! বিস্ময়! উত্তেজনা! যাবতীয় আঘাত তাকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। থর থর করে কাঁপে সে। মৌসুমি বলতে থাকেন—একা একা ভাল লাগছিল না। তোর বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখেই সুমি বলল, ‘এখন এলেন! আপনার তো সন্ধ্যায় আসার কথা’। আমি বললাম, ‘আমার ছেলের বাড়িতে আমি যখন-তখন আসব’। হঠাৎ ক্ষেপে উঠল, ‘কীসের ছেলে ও আপনার? কীসের? আমাদের জীবনটা শেষ করে দিচ্ছেন আপনি’। আমি ওর হাত ধরতে গেলাম। বলতে গেলাম শান্ত হও। কিন্তু ও এক ঝটকায় আমার হাত ছাড়িয়ে, আমার হাত ছাড়িয়ে…আমাকে…আমাকে…
হারাধনের পেটে মুখ রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি আবার। সেই ভেঙে পড়া মুখ মাথা পেট থেকে নেমে, ক্রমশ নেমে এসে থামল উপস্থবিন্দুভাগে। কান্নার আবেগে, অপমানের যন্ত্রণায় মৌসুমির তা খেয়ালই রইল না। খেয়ালই রইল না স্ফীত হয়ে উঠছে জাদুদণ্ড। সেখানে প্রবল স্ফীতির যন্ত্রণা বোধ করছিল হারাধন। সে মৌসুমির দুই বাহুমূলে হাত দিয়ে বলল চলো মা। শোবে চলো। ওকে আমি চরম শাস্তি দেব মা। সব মারের শোধ নেব আমি।
মৌসুমিকে জড়িয়ে ধরে সে নিয়ে চলল শোবার ঘরের দিকে। তার সমস্ত ক্রোধ ফুটে উঠছে। ক্রোধের সঙ্গে, প্রহারের স্পৃহার সঙ্গে আদরের তীব্র বাসনা ফুটে ফঠছে। সারা শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। আদর, মৌসুমির আদর চাই। সে না দিলে তা কে দেবে! মৌসুমিকে সে ভাল না বাসলে কে বাসবে! তার স্ত্রী যে অপমান করে, তা মুছে দিতে হবে তাকেই। তার স্ত্রী চড় মারলে—আঃ আঃ চড় মারলে চড় চড় চড় মারলে—সে ঠোঁট দিয়ে শুষে নেবে সকল প্রহার। সে, হারাধন, সে, মৌসুমি-মাকে কষ্ট পেতে দেবে না। সে আরও দৃঢ় সংকল্পে, তীব্র ইচ্ছায় চেপে ধরে মৌসুমি-মায়ের শরীর। মৌসুমি, যেন হাঁটতে পারছেন না এমন, পা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চললেন। বলতে থাকলেন—না না না। ওকে কিছু বলিস না তুই। ছেলেমানুষ।
—মা! এত মহান তুমি! এত ভাল! তোমার পা ধোয়া জল খাওয়া উচিত ওর মা! চিৎ শুয়েছেন মৌসুমি। ছটফট করছেন। বসন সরে গেছে বুক হতে। হাঁটু অবধি উঠে এসেছে প্রান্তভাগ। বলছেন—ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার! ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!
—ওকে আমি শান্তি দেব মা। দেবই। তুমি বারণ কোরো না।
—না না। ছেড়ে দিস। ওকে ছেড়ে দিস।
দাঁতে দাঁত পিষছে হারাধন। তার ইচ্ছে করছে, তখুনি গিয়ে মৌসুমির মাথা ছিঁড়ে নেয় ধড় হতে। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্ত হাতে-পায়ে গায়ে মেখে উল্লাস নৃত্য করে। কুচিকুচি করে কেটে ফেলে তার দেহ। শেয়াল-কুকুরের খাবার হিসেবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়! কিন্তু এই মুহূর্তে মাকে ছেড়ে সে যায় কী প্রকারে!
সে অতএব বলতে থাকে—শান্ত হও মা! শান্ত হও! আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি তোমার গায়ে। আদর করে দিচ্ছি।
তার হাত, কাঁপা হাত, মৌসুমির কপাল, বুক, পেট, নাভি হয়ে নেমে আসে পায়ের পাতা পর্যন্ত। উঠে যায়। নেমে আসে। উঠে যায়। মৌসুমি এক ঝটকায় পাশ ফেরেন। শাড়ির প্রান্ত উঠে আসে আরও। আবার চিত সাঁতারের মতো ভেসে ওঠেন তিনি। বড় খোলামেলা এ শরীর এখন! বড় মোহ! বড় মাদকতা! হারাধন অশান্ত হয়ে ওঠে! অস্থির! একটানে ছিঁড়ে নেয় বুক-ঢাকা জামাটির হুক। বক্ষবন্ধনী না থাকায় নির্বাধ হয়ে যায় স্তন। নির্বাধ হয়ে যায় সকল মুহূর্ত। সকল আবেশ। উরুসন্ধিতে হাত রাখে সে। টের পায় উষ্ণতা। টের পায় ইচ্ছুক, থরোথরো পেশিগুলি। এই প্রথম। এই প্রথম এই স্পর্শ। কী নরম! কী উন্মাদ! কী অপার! তখন ঝাঁপিয়ে পড়েন মৌসুমি তার ওপর। বিকারগ্রস্তের মতো বলেন—তুই আমার। তুই আমার! হারাধন তোকে আমি আর কারও হাতে কেন দিলাম! কী করলাম আমি! কী করলাম!
অনাবৃত হয় ত্রিশ স্পর্শ না করা পুরুষের বুক কাঁধ পিঠ। অনাবৃত হয় মাংসল পেট। উন্মুখ লিঙ্গ ছেড়ে নেমে আসে পোশাক। মধ্য চল্লিশ নারীর হাত তাতে ঝাঁপ দেয়। মুঠিতে তুলে নেয় রতিসুখ। মৌসুমি আর্তনাদ করেন—নে নে নে।
পিচ্ছিলতায় মাখামাখি হয়ে যায় অপমান। গ্লানি। মিথ্যাচার। সততা। দাম্পত্য। প্রেম।
তখন পাড়ের মাটি ভেঙে পড়ে ঝুরঝুর করে। অন্তঃস্থ মাটি সব গলে গলে যায়। ভূ-ত্বকে জেগে ওঠে ফাটলে ফাটল। ভূমির চেয়েও যা ভারী, তার চাপে ধরণীর নাভিশ্বাস ওঠে। মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে মরে নদী। মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে উন্মাদিনী নাশের তরে প্রধাবিতা হয়! মাতৃডাক— পৃথিবীর পবিত্রতম আহ্বানের মা-মা-মা ধ্বনি ঝাঁপ দেয় গঙ্গাগর্ভে। ভেসে যায়, ওই ভেসে যায়।