৭৫
চারিদিকে সরবরাহের সুর সারাদিনমান
কী চাহিদা কাদের মেটায়।
মানুষের জন্যে মানুষের সব সম্ভ্রমের ভাষা, ভাঙাগড়া, ভালোবাসা
এতদিন পরে এই অন্ধ পরিণতির মতন
হয়ে গিয়ে তবুও কঠিন ক্রান্তি না কি?
কোলাহলে ভিড়ে গেছে জনসাধারণ;
জীবনের রক্তের বিনিময়ে ফাঁকি
প্রাণ ভরে তুলে নিয়ে পরস্পরের দাবি হিংসা প্রেম ঊর্ণাকঙ্কালে মিলে গিয়ে
তবুও যে যার নিজ অন্ধ কাঠামোর কাছে ঠেকে—অহরহ—
.
যখন দিনের আলোর তাপে শ্রান্ত বিকেল, তারা পৌঁছল ঘাটলায়। ভাঁটির সময়। জল নেমে গেছে। একেবারে ঘাটের কানা অবধি পৌঁছল না নৌকা। নদীর জলপ্রান্ত হতে থকথকে কাদা পাড় অবধি গিয়েছে। নৌকা হতে তক্তা পেতে দিলে গড়িয়ে লোক নামবে যেখানে, সেখানেও পায়ের পাতা-ডুবি কাদা।
তারাও নামল হাতে চটি নিয়ে, পায়ে কাদা মেখে। হাঁটু অবধি গুটনো প্যান্ট। তারা— সিদ্ধার্থ, হারাধন, তৌফিক। হারাধন মৌসুমিকে আনেনি সঙ্গে। আসতে চেয়েছিল সে। তবু আনেনি। আনলে রাত্রিবাস করতে হবে। এ বাড়িতে বউ নিয়ে এত লোক শোবে কোথায়!
মৌসুমি বলেছিল—সবার মধ্যেই শোব। তোমার মা-বাবা ভাই-বোন থাকতে পারলে আমি কেন পারব না?
হারাধন বিরক্ত বোধ করেছিল। বলেছিল—তুমি পারবে না কারণ তোমার অভ্যাস নেই।
—অভ্যাস করব।
—না।
—না কেন? লোকে শুনলে কী বলবে বলো তো? বছর ঘুরতে চলল বিয়ে হয়েছে। এখনও শ্বশুরের ভিটেতে রাত্রিবাস করিনি।
হারাধনের কান গরম হয়ে উঠেছিল। ভিটে! ওই এক ফোঁটা ধারার বেড়া দেওয়া বাড়ি, ওই পেতনির চরে ভাসমান জীবন, তার নাম ভিটে! ভিটে তাকেই বলে যেখানে আছে বংশ-পারম্পর্যের স্থায়িত্ব! যে-ভূমির অস্তিত্বই নেই এ দেশের ডাঙাজমির হিসেবে, তার ওপর ভিটে জন্মায় কী প্রকারে!
অতএব, তার মনে হয়েছিল, মৌসুমি ব্যঙ্গ করছে তাকে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, তারা কী! কেমন! কতখানি নিঃস্ব! কতখানি ভিখিরি প্রকৃতির! একেবারে হাতে-কলমে প্রমাণ করে দেবার জন্যই সে যেতে চায় ওই অকুলান গৃহে।
অপমানের বিনিময়ে পাল্টা অপমান হেনে দেবার অভিপ্রায় অতএব জেগেছিল তার। তবু, সংযমে, ভদ্রতার শ্লীল আচরণ টানতে টানতে সে বলেছিল— লোকের কথায় কী আসে যায়?
—অনেক কিছুই যায়। আমার খারাপ লাগে জানো! একসঙ্গে রাত্রিবাস না করলে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমার তো একটা সম্পর্ক তৈরি হওয়া উচিত। ওঁরা তো জানলেনই না আমি কেমন।
বলেছিল মৌসুমি। গুছিয়ে বলেছিল। তার কথা, তার বাক্যগুলি, কখনও খাপছাড়া নয়। একের পর এক নিপুণ দক্ষতায় সাজিয়ে তোলা এমন যেন তাকে অনায়াসে বলা চলে বাকশিল্পী। তার যুক্তির কাছে হারাধন প্রায়শই বিমূঢ় বোধ করে। পৌরুষের অহংকৃত জোর খাটিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। মৌসুমিকে বুঝতে চাওয়ার তাগিদ সে বোধ করে না, কিন্তু মৌসুমি নিজেকে বুঝিয়ে ফেলে, জানিয়ে ফেলে সে ঋজু অথচ আবেগপ্রবণ। সে যুক্তিবাদী অথচ তীব্র অভিমানী। তার সঙ্গে সারাক্ষণ অভিমান ভাঙতে ভাঙতে চলার চেষ্টা করে চলেছে মৌসুমি হারাধন টের পায়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাকে দেয় না প্রশ্রয়, দেয় না স্বীকৃতি বা সম্মান।
অনুগ্রহে পালিত সে, মেধাবী ও উন্মাদ প্রেমিক–সে জানে না, অভিমানী মানুষ-মানুষী যারা, অভিমান ভেঙে ভেঙে এলে, সমাদর না যদি পায়, তাহলে পাথর হয়ে যায়, জমাট পাথর হয় ক্রমে।
সে খবর জানে না সে। অতএব বলেছিল—তাই নাকি? তা হলে খুব ক্ষতি হচ্ছে সবার!
মৌসুমি, খানিক থমকে বলেছিল—তুমি জান আমি ঠিক বলছি। তাই ব্যঙ্গ করছ!
হারাধন বলেছিল—বেশি জানার দরকার কী! শেষে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুবে। তখন তোমার ওই লোকলজ্জা সামলাতে প্রাণান্ত হবে আমার।
—কী বলতে চাইছ তুমি?
—তুমি খুব ভালই বুঝতে পারছ আমি কী বলছি!
—এভাবে…এভাবে অপমান করতে পারলে তুমি আমাকে?
মৌসুমির চোখে জল এসেছিল। সে অশ্রুপাতে মন গলেনি হারাধনের। এই ক’মাসে সে বুঝেছে, মৌসুমি অল্পে কাঁদে। অল্পে রেগে যায়। দুঃখ পায় অল্পেই। যদিও তখন সে চাইছিলই দুঃখ দিতে। অপমানের বিনিময়ে অপমান। আঘাতের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত-এই তো পৃথিবীর নিয়ম। কোথাও এর ব্যতিক্রম নেই। স্বামী-স্ত্রী হোক, প্রেমিক-প্রেমিকা হোক, বন্ধু-বন্ধু হোক— প্রত্যাঘাত না করা অবধি স্বস্তি নেই। সহিষ্ণুতা দুর্বলতা মাত্র। কী তার দাম! ক্ষমা নির্বোধের ধর্ম! তাই নখরে নখর বসে। দাঁতে দাঁত। আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতে ও বিক্ষতে কেটে যায় জীবনের অর্থহীন সিংহভাগ। সে আর মৌসুমি, একসঙ্গে থাকতে শুরু করা যাবৎ, চলেছে এ নিয়মেই। যে-যার দাঁত ও নখরে তারা শান দিতে থাকে সারাক্ষণ। কাটে, ছেঁড়ে, আহত করতে চায় পরস্পরকে। তবু তাদের সম্পর্ক আছে। তবু তারা যৌনতায় আবদ্ধ হচ্ছে। তবু তাদের দাম্পত্য জীবন মুখর।
হারাধন জানে না সকল দাম্পত্যই এমনই এরকমই কি না। কাছ থেকে সে দেখেছে তার মা মৌসুমি ও অসিতস্যারের দাম্পত্য। তার মধ্যে কেবলই শৈথিল্য, কেবলই শীতলতা। হতে পারে সন্তানহীনতা তার কারণ, হতে পারে নিষ্প্রেম বন্ধন। প্রকৃত কারণ সে জানে না।
তাদের পরিবারে দারিদ্রের দারুণ দাপটে প্রেম এক অন্য রূপ নিয়ে আসে। দানাপানি খুঁটে নিতে নিতে সেখানে অন্য মায়ার পরিসর। খেতে বসলে, বাড়িতে, সে-ই পায় সেরা। দ্বিতীয় সেরাটি তার মা আলতা নিঃশব্দে নারানমুদির পাতে তুলে দেয়। এর মধ্যে কী আছে সে জানে না, প্রেম কতখানি, আর কতখানি নির্ভরশীলতার জন্য আত্মনিবেদন, বোঝে না সে। বরং রেজাউলের দাম্পত্যে সে পায় কিছু মধুরতা। একমাত্র ওখানেই সুখী সরল দাম্পত্যের পেনসিলে আঁকা রেখাচিত্র সে পায় কিছু পরিমাণ! কিন্তু তার দেখা আর কতটুকু! লোকের দেখার বাইরেও যে না-দেখার অনেকখানি জগৎ, দাম্পত্যের মাঝখানে জেগে থাকে অতি নিজস্ব গোপনীয়তায়, তা রম্য কী কদর্য, জানে দু’জন কেবল। যাকে ঘিরে গড়ে ওঠে দাম্পত্য। হারাধন সে, বিবাহের আগে কেবলই যৌনক্ষুধা মেটাবার তরে এক নারীদেহ চেয়েছিল। সেই কামনা চরিতার্থ করার পথ এই বিবাহ। বিবাহকে কেন্দ্র করে আগামির সরণি সে সাজায়নি স্বপ্ন দিয়ে। কোনও মধুরের প্রত্যাশা তার ছিল না। অমধুরের প্রত্যাশাও নয়। যা হয়, যা হচ্ছে, তারই মধ্যে দিয়ে যেতে হবে বলে যাওয়া।
সে ভাবে না বিশেষ। ভাবে না তার স্ত্রী মৌসুমির কথা। যতটুকু সময় দর্শনের, স্পর্শের, ততটুকুর জন্যই ওই নারী সকল অস্তিত্ব সমেত এসে দাঁড়ায় তার কাছে। তার বাইরে তার ভাবনার অনুভূতিময় আনন্দজগতে আছেন তিনি। মৌসুমি। হারাধনের স্ত্রীর নাম হতে মৌ ছেঁটে তিনি করেছেন সুমি। মৌ রেখেছেন নিজের জন্য।
এমতাবস্থায়, যখন সে নিয়ে যাচ্ছে এক ভবিষ্য নায়ককে তার গৃহে, যখন এক ভূমিখণ্ডের অস্তি ইতিহাস লিখে নিচ্ছে নিজস্ব ভাষায়, তখন সুমির কথা মনে পড়ে যাওয়াকে হারাধন শুভ দেখল না এতটুকু। সে জোর করে, যেন ঠেলে বার করে দিচ্ছে গৃহে আশ্রয়কামী পাগলকে, এমনই ভুলে রইল সুমির ভাবনা। বরং তার মনে পড়ল মৌসুমিকে। ক’দিন যাওয়া হয়নি। ক’দিন? সে সকলের অলক্ষ্যে কর গুনল। একদিন দু’দিন। দু’দিন? তার মনে হল, মৌসুমি প্রতীক্ষা করে আছেন এই সন্ধ্যায়। অভিমানী মুখ নিয়ে, চোখে ক্লান্তি জলভরা।
আজ নয়। অপেক্ষা করেছিলেন তিনি কাল। তিনি জানেন, আজ এই পেতনির চরে হারাধনের আসার কথা। এর মধ্যে কোনও দিন পেতনির চরে আসার বাসনা মৌসুমি প্ৰকাশ করেননি। সেদিন কী হয়েছিল তাঁর, বলেছিলেন, হঠাৎই কোনও ভূমিকা ছাড়াই, উদাস অন্যমনস্কতার ভিতর—আমাকে নিয়ে যাবি?
—কোথায়?
সে জিগ্যেস করেছিল।
—তোদের ওই পেতনির চরে।
—পেতনির চরে যেতে চাও তুমি!
সে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।
—কেন? যেতে নেই?
–না। তা কেন?
সে কথা খুঁজে পায়নি সহসা। কাজ থেকে ফিরে ক্ষুধার্ত বোধ করায় মৌসুমি তাকে খেতে দিয়েছিলেন। এমনিতেই তার জন্য তৈরি করা থাকে নানাবিধ পদ। যত রান্না মৌসুমি জানেন, উজাড় করে দিয়েছেন তার জন্য। রান্নার বই কিনে রেঁধেছেন নতুন নতুন পদ। সে যদি খেতে চায় কোনওদিন, যদি বলে—মা খিদে পেয়েছে—মৌসুমি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। আগল-পাগল হয়ে বলতে থাকেন—সেই তো, খিদে পেয়েছে আমার ছেলেটার, কী দিই! তোর জন্য যে শুধু একটু পুডিং করেছিলাম আজ। তাতে কি তোর হবে? চট করে একটু লুচি ভেজে দিই!
এইসব সময় মৌসুমি যেন এক অন্নপূর্ণা হয়ে উঠতে চান। পক্ষীমাতা, কথাটি শুনেছে হারাধন। শাবকগুলিকে আড়াল-আবডাল দেবার জন্য যে ডানাদুটি দিয়ে ঢেকে দেয় তাদের। ঠুকরে দেয় নিকটতর ক্ষতিসম্ভাবনার যা কিছু। পাখির চোখ তখন হয়ে ওঠে ত্রাসে বিস্ফারিত, রাগী, প্রতিহিংস্র। শাবকগুলির প্রতি অধিকারবোধ এবং সুরক্ষার উগ্র চাহিদায় সারা শরীরে ফুটে ওঠে বেপরোয়া অভিব্যক্তি।
মৌসুমিও এমন। এমনই। হারাধনকে তিনি ডানার আড়ালে রেখে দিতে চান সর্বদা। তাঁর সর্ব অবয়বে ফুটে থাকে আগ্রাসী অধিকারবোধের অভিব্যক্তি। সেই অভিব্যক্তির দর্শনে আরাম পায় হারাধনের মন। তৃপ্তি পায়। ওই ত্রস্ততা বাড়িয়ে তুলতে তার মন নিত্য ফিকির খোঁজে। স্ত্রী মৌসুমির সঙ্গে নানান ছন্দহারা মুহূর্তের গ্লানি মুখে চপচপে করে মেখে সে আসে। দাঁড়ায় মৌসুমির কাছে। তার ক্লিষ্ট মুখ দেখে মৌসুমির স্নেহ উথলে ওঠে। তিনি সকল উদ্বেগ গলায় ঢেলে জিগ্যেস করেন—কী হয়েছে হারাধন?
সে বলে-কেন আমাকে বিয়ে করতে বলেছিলে মা? আমার সব শান্তি গিয়েছে। আনন্দ গিয়েছে।
মৌসুমি বুকে চেপে ধরেন তার মুখ তখন। সে ওই পরিচিত গন্ধের বুকে নাক ঘষে ঘষে বৃত্তে ঠোঁট চেপে ধরে ব্লাউজের ওপর দিয়েই প্রথমে। বস্তুটি চিনতে বুঝতে খুঁজে নিতে অসুবিধে হয় না তার কারণ সে ছোঁয়া মাত্রই বৃত্তগুলি ব্লাউজের ওপর দিয়ে ফুটে ওঠে, যেন ছিঁড়ে বেরুতে চায় বস্ত্র-আবরণ।
সেদিন, সে খাচ্ছিল তখন, মৌসুমি তাঁর দূরের চেয়ারে। বিষণ্ণ। উদাসীন। ইদানীং বিষণ্ণতা বেড়ে গেছে তাঁর। গাম্ভীর্য বেড়ে গেছে। সে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে গাম্ভীর্য সরিয়ে দিতে চায়। যেন এক ভারী পর্দা সরাতে সরাতে সরাতে হাঁপ ধরে যাওয়া সে অবসন্ন হয়ে পড়ছে যখন, এতটুকু প্রসন্নতা উপহার দিচ্ছেন তাকে মৌসুমি। তাই নিয়ে খুশি সে। তাই নিয়ে সার্থক জীবন। মৌসুমী মায়ের মুখে এতটুকু প্রসন্নতা, এতটুকু হাসি দেখতে পাওয়াই এখন, ইদানীং তার প্রাণের উদ্দেশ্য।
সেদিন, তিনি বলেছিলেন—কখনও তো বলিসনি হারাধন, চলো, আমার সঙ্গে চলো।
সে বলেছিল—মা, তুমি জানো আমাদের বাড়ি…
–তোর বউকে তো নিয়ে গেলি। তখন তো মনে হল না ওই বাড়ির কথা। সঙ্কোচ হল না তো তোর। আমার চেয়ে তোর বউ তোর বেশি আপন তা হলে বল।
—মা, তুমি জানো, তোমার চেয়ে বেশি আপন আমার কেউ নেই।
—তাহলে নিয়ে চল আমাকে হারাধন! বউকে নিলে আমাকে কেন নিবি না?
–কী করবে তুমি মা? ওখানে তো দেখার কিছু নেই।
—সুমি কী করেছে?
—মা, ওকে নিয়ে যাওয়াটা ছিল ভদ্রতা। সামাজিক ভদ্রতা। তুমি তো জানো।
—সেই তো। আমার জন্য তো সামাজিক প্রয়োজন নেই। আমি তোর বাড়ি দেখতাম। তোর মা-বাবা। হারাধন, যেখানে বেড়ে উঠেছিস তুই, সেই মাটি কি আমার প্রিয় হতে পারে না?
বিস্ময়ে তাকিয়েছিল সে মৌসুমির দিকে। দেখেছিল। কী বলছেন ওই মহিলা! সত্য? এ কী! এ কি সত্য? বেড়ে ওঠার স্থল, সময় কাটাবার গৃহ, লেখার টেবিল, শোবার বিছানা —এ সমস্তই দর্শনীয় হয়ে ওঠে, স্মৃতিতাড়িত হয়ে ওঠে মহান মানুষের জন্য। তার মতো কারও জন্য তো নয়। অথচ সে একজনের কাছে, অন্তত একজনের কাছে হয়ে উঠেছে তেমনই পরম, তেমনই তুলনাহীন প্রিয়! চোখে জল এসেছিল তার। ধরা গলায় বলেছিল সে—মা! নিয়ে যাব তোমাকে!
জল, চোখ হতে উপচে নেমেছিল গালে। মৌসুমি উঠে এসেছিলেন। বুকে টেনে নিয়েছিলেন খাবারে পুরন্ত মুখ-মাথা। শান্ত স্বরে বলেছিলেন —কাঁদিস না। সোনা! খেতে খেতে কাঁদলে দুখী হয়।
তার খাওয়া হয়ে গেলে তাকে জড়িয়ে মৌসুমি বলেছিলেন— তোর অসিতস্যার কোথাও নিয়ে যায়নি আমাকে। আজ চব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে বারকয়েক কলকাতা গিয়েছি। তোর স্যারের বন্ধু আছেন, উজ্জ্বল পরামাণিক, উঠেছি তাঁদের বাড়িতে। ব্যস। ওইটুকু। কলকাতাতেও তো দেখার আছে কতকিছু! কোথাও নিয়ে যায়নি।
—আমি নিয়ে যাব।
—কোথায় নিয়ে যাবি?
—বল কোথায় যেতে চাও তুমি?
—দার্জিলিং, পুরী, রাজস্থান, পণ্ডিচেরি। নিয়ে যাবি?
—যাব।
—আর তোদের চরে?
—নিয়ে যাব মা।
—আমি তা হলে ব্যাগ গুছিয়ে রাখি?
–এবার হবে না মা। সিদ্ধার্থ যাচ্ছে আমার সঙ্গে। সঙ্গে তৌফিক বলে আরও একজন। এবারে অসুবিধে হবে তোমার। আমিও অন্য কাজে ব্যস্ত থাকব।
—এড়িয়ে যাচ্ছিস, না? আসলে তুই সুমিকে নিয়ে যাবি।
—মা!
রাগ করেছিল সে। মৌসুমির আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল। উঠে যেতে যেতে বলেছিল—এমন অবুঝ অভিমান তো তুমি করতে না মা! আমাকে আর বিশ্বাস করো না তুমি!
—করি, করি, করি।
মৌসুমি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তার ওপর।
—ছেড়ে যাস না! চলে যাস না!
আর্তনাদ করেছিলেন তিনি।
এক বিমুখ জেদ চেপে বসেছিল তার ওপর। মৌসুমিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল সে। এরকম হয়নি এর আগে কখনও। মৌসুমি ঠেলে দিয়েছেন তাকে। কিন্তু সে ফিরে এসেছে বারবার। সেদিন সে-ই ঠেলে চলে এসেছিল। মৌসুমির পিছুডাকে সাড়া দেয়নি। বিরক্তি ঘিরেছিল তাকে, ক্রোধী জেদ ঘিরেছিল। সারা জগতের অবুঝপনায় অসহায় লেগেছিল তার। মনে হয়েছিল, এমন একজনও কি নেই যে কোনও দাবি ছাড়া, অভিযোগ ছাড়া, ভুল বোঝা ছাড়া নির্মলতায় তাকে কাছে টেনে নেবে?
আজ কষ্ট পাচ্ছে সে মৌসুমির জন্য। মৌসুমির চেয়ে কাছের মানুষ আর কে হতে পারে! অতখানি ভালবাসা কে দিতে পারে তাকে! অতখানি ভালবাসা আছে বলেই অত অতৃপ্তি, অত ঘোর অতৃপ্তি তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ওই ঘোর সন্দেহ, ওই কুটিল অবিশ্বাসের আড়ালেই আছে এক তীব্র অধিকার। নির্যাতন করতে চাওয়ার ইচ্ছা। কষ্ট দিতে পারার আনন্দ। এও এক প্রেম। বোঝে সে। জানে সে। মৌসুমির সকল আচরণে তার প্রকাশ এমন—তোকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিতে পারি, আঁচড়ে-কামড়ে দিতে পারি, ফালা ফালা করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে পারি নুন-লঙ্কা। শুধু অধর বুলিয়ে স্নান করিয়ে দিতে পারি তোকে। শুধু ওষ্ঠ দিয়ে তোকে শুষে নিতে পারি।
চারিদিকে ধুলোমাখা হেমবর্ণ সন্ধ্যা। নারানমুদি আজ দোকানে বসে আছে টানটান। চরের বিজ্ঞজনের ভিড় তার দোকানেই আজ। হারাধনের জন্য লোকে তাকে দেখে কিছু সম্ভ্রমের চোখেই। তদুপরি আজ তার প্রাপ্তি কিছু বাড়তি সম্মান। কারণ সিধুবাবু আসবেন আজ খ্যাতিমান সিধুবাবু। নেতা সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। অতিথি হবেন নারানমুদির গৃহেই। এমন সজ্জন অতিথি পাওয়া কম সৌভাগ্যের নয়!
সিদ্ধার্থর থাকার ব্যবস্থা অনায়াসেই হতে পারত, দরিদ্রের মধ্যে অনতিদরিদ্র হকসেদ মণ্ডলের বাড়ি। কিন্তু সিদ্ধার্থ নিজেই তাতে রাজি ছিল না। বন্ধুর গৃহ থাকতে—তা সে যেমনই হোক—অন্যগৃহে আতিথ্য নেয় সে কী প্রকারে! যদিও রেজাউলও বন্ধু তার। অতি নিকটজন। কিন্তু সে এসেছে যখন হারাধনের সঙ্গে তখন আর অন্যত্র থাকার প্রশ্ন ওঠে না।
তবু হকসেদ মণ্ডল কালকের মধ্যাহ্নভোজনের দায়িত্ব নিয়েছেন অতি আহ্লাদে। দখলিকৃত এইসব চরের জমিজমায় চাষ-বাস করে তিনি দুধেভাতে রেখেছেন পরিবার ও সন্তানাদিকে। কিন্তু সারাক্ষণ মনে এক আশঙ্কা! এই বুঝি চরা ডুবে যায়! ভেসে যায়! এখানকার জমি বেচে অন্য কোথাও চলে যাবেন তার উপায় নেই, কারণ কানাকড়ি মূল্য নেই এ জমির। বিনা পাট্টায়-দলিলে চরের জমিজমা বিনিময় হয় কেবল চরের মানুষের মধ্যেই। ইদানীং কিছু ফড়ে ও দালালের আনাগোনা ঘটছে। সীমান্ত পেরিয়ে আসা লোকগুলো সামান্য মূল্যে জমি কিনে ঘাঁটি গেড়ে বসতে চায়। কেউ কেউ জমির কিছু অংশ বেচে দিয়ে কাঁচা টাকা পেয়েছে। কিন্তু পুরো জমি বিকিয়ে উঠে যাবে, সে উপায় নেই কারও। এই চরে যারা এসেছিল দখলদার তারা সবই ছিল ভূমিহীন, ছিন্নমূল লোক। এখানকার পুরো জমি বেচে যাবার জায়গা নেই। সঙ্গতিও তৈরি হয় না।
হকসেদ মণ্ডল, এক সমৃদ্ধ চাষি, তবু তাঁরও আছে, এমনই অসুবিধা। সরকারি স্বীকৃতি পেলে বহু কিছু সুবিধার পথ খুলে যায়। রেশন মিলতে পারে। কেরোসিন মিলতে পারে রেশনের দামে। জমিজমা বন্ধক দিয়ে নেওয়া চলে ঋণ। বিপর্যয়ে সরকারি সুবিধার প্রত্যাশা করা যেতে পারে। এবং…এবং হতে পারে স্থায়ী এক ঠিকানা। একটি ডাকঘর হতে পারে তখন এই চরে। কিংবা কে জানে, ডাকঘর না হলেও, নৌকা বেয়ে আসতে পারে ডাকপিয়ন। কে জানে, হয়তো ঠিকানার জোরেই এই চরা হয়ে উঠতে পারে এক চিরস্থায়ী ভূমিখণ্ড! এতগুলি বছর ধরে বেঁচে আছে যে-মাটি, তাঁদের ধারণ করে ধাত্রী হয়েছে যে, সে আরও একশো দু’শো তিনশো বৎসর কেন বাঁচবে না?
নারানমুদির দোকানের সামনে পৌঁছল সিদ্ধার্থরা যখন, ভদ্রজনেরা প্রত্যুদগমন করলেন।
—আসুন, আসুন, আমাদের পেতনির চর আজ ধন্য হল।
এমনই রব তুললেন তাঁরা। লুঙ্গি গেঞ্জি পরা কেউ, কেউ ধুতি পরা খালি গা, প্রাজ্ঞ মানুষগুলির চোখে-মুখে কর্মনিষ্ঠতার ছাপ। তাঁদের পেছনে যুবকের সারি। তাদের লাজুক মুখে লেগে আছে দিনশেষের নীলাভ আলোর রেশ। সিদ্ধার্থ বিব্রত বোধ করছিল এমন সম্বোধনে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। হারাধন হাসল। বলল— কী হল? চল।
—হ্যাঁ!
এগিয়ে গেল সিদ্ধার্থ। নারানমুদি এবং হকসেদ মণ্ডল সকলের আগে এসেছেন। ‘ভাল আছ তো বাবা?’ প্রশ্ন করছেন দু’জনেই। সিদ্ধার্থ প্রণাম করল নারানমুদিকে। হকসেদ মণ্ডলকে কদমবুসি করল। হর্কসেদ মণ্ডল জড়িয়ে ধরলেন সিদ্ধার্থকে অতি আন্তরিকতায়। বললেন— আমার ছেলের বন্ধু তুমি। তোমাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। আমরা, আমাদের চরা, তোমার মুখ চেয়ে আছে।
হকসেদ মণ্ডলের আলিঙ্গন হতে বেরিয়েই সে ধরা পড়ল নারানমুদির আলিঙ্গনে। এবম্বিধ আলিঙ্গনের ইচ্ছা ছিল না নারানমুদির। কিন্তু হকসেদ মণ্ডল সিদ্ধার্থকে বুকে টানলে তাকেও টানতে হয়। নইলে হারাধনের সঙ্গে সিদ্ধার্থর বন্ধুত্বের গৌরবে ভাগ কিছু কম পড়ে বুঝি-বা।
এক নাতিবৃহৎ জনতা এই আলিঙ্গন ইত্যাদি সান্ধ্যদৃশ্য ঘিরে ধরেছিল তখন। ছেলে কোলে রেজাউল এসে দাঁড়াল। সিদ্ধার্থ শিশুটিকে কোলে নেবার জন্য হাত বাড়িয়েছিল। তখন সে শুনতে পেল গান—ধনধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা-কচি স্বরের মিছিল এগিয়ে আসছিল তার দিকে। সিদ্ধার্থর বাড়িয়ে দেওয়া হাত নেমে এল আপনা-আপনি। সে অবাক হয়ে রেজাউলকে বলল—এ কী!
রেজাউল বলল—তোর জন্য। আপত্তি করিস না। দু’ঘণ্টা ধরে সেজে বসে আছে সব।
বড়রা পথ ছেড়ে দাঁড়িয়েছেন দু’পাশে। এগিয়ে আসছে ছোটদের মিছিল। মেয়েরা পরেছে শাড়ি। হাতে নিয়েছে মালা। কাগজের। ফুল নেই এ চরায় মালা গাঁথবার মতো। ছেলেরা নিয়েছে ছোট ছোট মোমবাতি। অন্ধকার হয়ে আসছে গাঢ়। দিন ও রাতের সন্ধিতে যেন রচিত হয়ে যাচ্ছে চিরন্তনের ছবি। অভিজ্ঞজনেরা পথ করে দিয়েছেন, নতুন প্রজন্ম বরণ করে নিতে আসছে এক নতুন নায়ককে।
সিদ্ধার্থ অভিভূত হয়ে গেল। এ ছবি যেন তার হৃদয়ে চিরমুদ্রিত হল। কিছু-বা লজ্জা, কিছু-বা বিস্ময়ের মধ্যে দিয়ে সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে গেল শিহরণ। এক বিশ্বাসে, এক প্রত্যয়ে ভরপুর হয়ে উঠল তার মন। এত প্রতিহিংসা সত্ত্বেও, এত হানাহানি অপরাধ সত্ত্বেও মানুষ আসলেই বড় ভাল। ভাল তার আবেগ। ভাল তার প্রীতি ও প্রত্যাশা। এই গানেরই মতো সুকোমল ধনধান্য পুষ্পেভরা দেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার জাগরূক হল তার মধ্যে।