৭৩
ভাদ্রমাসে শাস্ত্রমতে
শুভ কার্যে মানা।
এই মাসে না হইব বিয়া
কেবল আনাগুনা॥
দিন কয়েক হল একটি ছেলে প্রসব করেছে আফসানা। ছেলেটি হয়েছে স্বাস্থ্যবান। ফর্সা গোল-গোল হাত। কচি ভরাট মুখে টানা নাকটি তর-তর করছে। ক্ষুদে গোলাপি জিভ সে বের করছে লালচে পাতলা ঠোঁট দুটির বাইরে। এমন শিশু পেয়ে সকলের আহ্লাদ হওয়ার কথা। তবু আকবর আলির বাড়িতে সকলের মুখ বিবর্ণ, বিষণ্ণ
এই নিয়ে মৎস্যজীবী আকবর আলির তিনটি পুত্র জন্মাল। একটি মেয়ে। সুখের কথা পুত্রসন্তানে ঘর ভরে যাচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হল, সুখ অনেকানেক শর্ত সাপেক্ষ। তার এটা চাই, ওটা চাই, সেটা চাই। নইলে সে পরিপূর্ণ হয়ে ফোটে না। আকবর আলির গৃহেও তার ব্যতিক্রম নেই। তাদের হল জেলেঘর। নদীর জল শুকোলে জেলের গৃহে সুখ আসে কী প্রকারে!
আকবর আলি ভেবেছিল বর্ষা পেরিয়ে গেলেই রবি-উল-আওয়াল মাসে একটা ভাল দিন দেখে দুই ছেলের সুন্নৎ করিয়ে নেবে। মহম্মদ আলির সঙ্গে কথাও বলেছিল। বর্ষায় মাছের মরশুম। ব্যস্ততার কাল। শরতেও তার অনুষ্ঠানটা করে ফেলা যায়। সুন্নতে খরচ তো আছেই। দুই ছেলের একই সঙ্গে হলে কিছু ব্যয়সংকোচ হয়। আবার দু’বারের খরচ একবারেই করা হচ্ছে বলে একটু হাতও খোলা যায়।
সব পরিকল্পনা ধুলোয় মিশিয়ে দিল অনাবৃষ্টির শুখা নদী। বর্ষায় মাছ উঠল না। ভাদরের ভরা নদীর পরিবর্তে এখন তলানি জল। স্তব্ধ হয়ে আছে অর্থাগম। বিড়ি বাঁধার টাকা একমাত্র ভরসা। কিন্তু আকবর আলির ঘরে সে-উপার্জনও তলানি। কারণ আফসানার হাত অচল। একা খালেদা তাঁর বৃদ্ধ আঙুলে আর কত বিড়ি বাঁধবেন! তাঁর হাত চলতে চলতে অসাড় হয়ে যায়। গাঁটে গাঁটে ব্যথা করে। তা ছাড়া প্রসব করে আফসানা একেবারেই শয্যাগত হয়ে পড়েছে। রান্না-বান্না, ঘরের কাজ, উঠোন ঝাড়ু, গোবর দিয়ে ঠিলা বানানো—ইত্যাদি হরেক কাজের সামাল দিতে গিয়ে খালেদা দিশেহারা। ভারী মাস নিয়েও আফসানা যতদিন সম্ভব বিড়ি বেঁধেছে। ঘরের কাজ সামাল দিয়েছে। খালেদাকে কিছু বুঝতে দেয়নি। কিন্তু এখন তার রোগা শরীর। দুর্বল সে। ছেলে কোলে দাঁড়াতে অবধি পারছে না। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ছে। এই আকালের সময় তাকে ভাল করে খাইয়ে-দাইয়ে মোটা-সোটা সুস্থ করে তুলবেন খালেদা—তার উপায় নেই। দু’বেলা খাওয়া জোটানোই শক্ত হয়ে পড়েছে। পরিমাণে কম কম নিয়ে একবেলার চালে দু’বেলা চালাচ্ছেন খালেদা।
আফসানার আপত্তি সত্ত্বেও আকবর আলির মেয়ে টিনাকে এখন নিয়মিত বিড়ি বাঁধতে বসাচ্ছেন খালেদা, আট পেরিয়ে ন’য়ে পড়বে মেয়ে। তার সরু সরু চাঁপাকলি আঙুলে বিড়ি বাঁধার কাজে সে হয়ে উঠছে নিপুণ ও ক্ষিপ্র। কিন্তু তার বালিকাবেলার চাপল্য ঘোচেনি। মাঝে-মাঝে বিড়ি বাঁধা ছেড়ে খেলতে চলে যায়। আফসানার স্থির, একনিষ্ঠ রোজগারের জায়গা নিতে পারে না সে কোনওভাবেই।
আফসানা যে কী এই সংসারে, কতখানি, তা এখন টের পাচ্ছে সকলেই। উদয়াস্ত অবিশ্রাম পরিশ্রম করে নিজেকে ক্ষইয়ে ফেলেছে সে। তার মূল্য চুকিয়ে দিচ্ছে এই সংসার কিছু-বা সহানুভূতি তার জন্য প্রদর্শন করে। সে এক হাড়-কাঁকলাস এখন। কথা বলতেও হাঁফিয়ে যায়। তার জন্য নেই ডাক্তার, নেই বদ্যি। তাকে বাসে চাপিয়ে ওই শহর বহরমপুরের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাবে কেউ, তা মনে পড়েনি কারও। সে শুকিয়ে যাচ্ছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে, সে রোগগ্রস্ত, এ বড় দুঃখের। কিন্তু তার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। এমনই দস্তুর। সংসারের জন্য হাড় কালি করা বধূগুলির এমনই পরিণাম। জন্ম হতে খোদার মর্জিতে পাওয়া সুস্বাস্থ্যের জোরে সকল সয়ে টিকে গেল তো গেল ওই খালেদার মতো, নইলে আর কী-ই বা করার থাকতে পারে!
সারাক্ষণ তিরিক্ষি হয়ে আছে খালেদার মেজাজ। ভরপেটা খাওয়া নেই। তার ওপর এত পরিশ্রম। ঘরে কাক-শালিক বসতে পারছে না তাঁর অবিরত চিৎকারে। মোবারক আলি পর্যন্ত বিড়ি তুলে নিতে সাহস করছে না।
নদীতে মাছ নেই। তাই মোবারক আলি সারাক্ষণ হাতখরচের দু’চারটি টাকা পাবার জন্য ঘুরঘুর করেও কিছু পাচ্ছে না। সে গজগজ করছে। আর ক’টা দিন। মাস ফুরোলেই বেতন পেয়ে যাবে সে। মাটি কাটা শুরু হয়েছে। রাস্তা উঁচু হবে। অনির্বাণকে ধরে মোবারক আলি মাটি কাটার তদারকিতে নেমেছে। অনির্বাণ তাকে পছন্দই করছে সে টের পায়। কোন কর্মের ফল যে কখন কাজে লাগে! ওই যে ওইটুকু সহানুভূতি সে দেখিয়েছিল একদা, অনির্বাণ তারই জন্য তাকে গুরুত্ব দিয়ে বসে আছে। সুকুমার পোদ্দারের কাছাকাছি যাবার সাহস পায়নি এখনও মোবারক আলি। তবে শাহেনশার ছেলে হল বাদশাজাদা। ভবিষ্যতের শাহেনশা। ভবিষ্যতে সুকুমার পোদ্দারের রাজত্ব অনির্বাণ পোদ্দারই পাবে। অতএব ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনির্বাণের ওপর প্রভূত আস্থা রাখে মোবারক আলি। নিজের ওই আশিকির মাখো-মাখো অবস্থা থেকে যেভাবে ছিটকে বেরুল সে, তাতে ভবিষ্যৎ সাফল্য বিষয়ে অনির্বাণের ওপর আস্থা রাখাই যায়।
অশোক এবং কানাই মণ্ডলের সঙ্গে ব্যবসায় নামার স্বপ্ন আজও বজায় রেখেছে মোবারক আলি। শহরে কী ঝকঝকে দোকান করেছে ওরা! তবে তার আগে টাকা জমানোর জন্য আপাতত অনির্বাণকেই অবলম্বন করেছে সে। জেলেঘরে জন্ম হয়েও আমির মানুষ মোবারক আলি। একদিন সে হয়ে উঠবে জনাব মোবারক আলি। ঝকঝকে স্যুট পরে গাড়ি থেকে নামবে। অর্থের শতেক প্রয়োজন থাকলেও মাটি কাটা তার পোষায় না। সে অতএব তদারকি করছে। চোখ-কান খোলা রাখছে। লোকজনের আলটপকা মন্তব্য মনে মনে টুকে নিচ্ছে। অনির্বাণের কাছে সকলই চালান করে তার বিশ্বাসভাজন এবং নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠছে দ্রুত। পকেটে রাখছে একটি পেন এবং নোটবই। কে এল, কে গেল, কাজ করল কতক্ষণ—তার হিসেব রাখছে আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে। তিন ক্লাসের বিদ্যে। তা-ই কেমন কাজে লাগছে! এখন অল্প অল্প আফসোস হচ্ছে মোবারক আলির। আরও দু’ ক্লাস যদি পড়ে নিত!
অতএব, আর ক’দিন পরেই মোবারক আলি এক রোজগেরে মানুষ। কী পাবে, না পাবে সে বলেনি বাড়িতে কিছু। কাজ করছে, তা-ও বলেনি। অন্যের মুখে শুনে যদি জানে তো জানুক। সে শুধু খেল দেখবে তখন। বাড়িতে নিজের গুরুত্বটা দেখবে। এইবেলা তার বিয়ের কথাও ভাবা হবে নিশ্চয়ই। মনে মনে সে পরিতোষ লাভ করে। এই হল তার বিয়ের সঠিক সময়। কারণ বাড়িতে এখন একজন মেয়েমানুষ বড়ই প্রয়োজন।
তবে প্রয়োজন যতই থাক, মোবারক আলি আকবর আলির মতো বিবিকে দিয়ে বিড়ি বাঁধাবে না। দশ পুরুষের চোখের সামনে নদীতে নাইতে পাঠাবে না। আলাদা গোসলখানা বাড়ির মধ্যেই গড়ে দেবে। কিন্তু এখনই যদি বিয়ে করে, তবে তা সম্ভব হবে না। তা হলে? সময় নিতে হবে। এখন কিছুদিন আর পাঁচটা বউয়ের মতোই থাকুক তার বিবি। পকেটে রেস্ত এলেই সে রকম ফেরাবে। আর রেস্ত যে আসবেই, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই তার। মাটি কাটছে পনেরো জন, খাতায় নাম লেখা আছে পঁচিশজনের। অন্তত দশজনের দৈনিক ভাঁওতা মজুরি চলে যাচ্ছে ঠিকাদারের পকেটে। এর সাক্ষী থাকছে কে? মোবারক আলি। অতএব সাক্ষ্যের নজরানা হিসেবে বেতন ছাড়াও কিছু বাড়তি থাকবে তার। এরপর আসবে পাথরের হিসেব। বোল্ডার ও পাথরকুচির পরিমাণ। আসবে পিচের ড্রামের হিসেব। সব কিছুরই নজরদারি সে-ই যে পাবে, আভাস দিয়েছে অনির্বাণ। এরপর পাড় বাঁধাবার কাজটা যদি ইনশাল্লাহ্ বলে লেগে যায় তা হলে লাখের জল কোটিতে গড়াবে বন্যার জলের চেয়েও দ্রুত। সুকুমার পোদ্দারের চেয়েও বড়লোক হয়ে যাবে নাকি তখন অনির্বাণ? না। তা হয়তো হবে না, তবে কোটি টাকার ভাগ হতে মোবারক আলি যা পাবে তা মহম্মদ আলির বাপের জন্মে কেউ দেখেননি। অতএব এখন ফাঁকা পকেট সে সয়ে যাচ্ছে। এরপর গোটা পরিবারকে ভেলকি দেখাবে। কিন্তু নিজের বিয়ের কথা কী করে উত্থাপন করা যায়?
এমনই সব ভাবতে ভাবতে রাস্তার দিকে রওনা হল মোবারক আলি। দারুণ রৌদ্রদাহের জন্য রাস্তার কাজ হচ্ছে ভোর ছ’টা থেকে এগারোটা পর্যন্ত। ওদিকে আবার বিকেল তিনটে থেকে ছ’টা অবধি কাজ হবে।
যেতে যেতেই মেয়েটিকে দেখল সে। কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে শাড়ি পরা। পিঠে লম্বা বিনুনি। বয়স আন্দাজ করা যায় না। ষোলো থেকে বাইশের মধ্যে হতে পারে। হাতে একটা বালতি নিয়ে গোবর কুড়োচ্ছে। রোজই ভোরবেলা কুড়োয় এমন। ইদানীং প্রায়ই মোবারক আলির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার। কারণ মোবারক আলির বাড়িতেও সে যায়। আফসানার শিশুকে কোলে নেয়। খালেদার সঙ্গে কথা কয়। ‘চাচি-চাচি’ ডাকে। মোবারক আলি জানে, মেয়েটির নাম মায়মুনা। এই বয়সে মায়মুনার বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। হয়নি কেন? মুসলমানের ঘরে এত ধিঙ্গি বয়স পর্যন্ত মেয়ে অনূঢ়া থাকে না। গ্রাম দেশে হিন্দুর মেয়েও থাকে না। দু-একজন থাকে, তুলতুলি যেমন ছিল, তার তো ওই পরিণতি। আসলে এসব মানায় শহরে। সেখানে সতেরো কেন, সাতাশেও মেয়েরা দিব্যি কুমারী! আপন মনে ফিচেল হাসে সে। বিয়ে না করে থাকে, কুমারী থাকে কিনা কে বলবে? তা হলে মায়মুনা? সে কি কুমারী? জানে না মোবারক আলি। তবে এই মায়মুনাকে তার ভাল লাগে। এই মেয়েটিকেই বিয়ে করলে কেমন হয়? সে ভাবতে ভাবতে যায়।
মায়মুনারা এখানকার ভূমিজাত নয়। বছর দুয়েক আগে মায়মুনার বাপ এ গাঁয়ে ছ’কাঠা জায়গা কিনে বসবাস শুরু করেছে। খোদাবক্স নামে এই লোকটা জেরাত আলির জান-পহেচান মানুষ। আত্মীয় হওয়াও বিচিত্র নয়। প্রথম বছর খোদাবক্স পরিবার আনেননি। এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে একাই থাকতেন কুটির বেঁধে। পরিবার এনেছেন এই বছরখানেক হল। সম্ভবত মায়মুনা এসেছে তারও পরে। কারণ মায়মুনা একবছর আগে থেকে দৃশ্যমান নয়। মায়মুনার দাদা কিংবা ভাই, খোদাবক্সের বড় ছেলে ইসমাইল আকবর আলির নৌকায় ভিড়েছে, এ খবরও জানা আছে মোবারক আলির। মেঘনায় নৌকা চালানো ছেলে ইসমাইল—মাঝি ভাল।
মোবারক আলির বাবা মহম্মদ আলির সঙ্গে খোদাবক্সের জানাশুনো হয়েছে ভালই। মাঝে-মাঝে তিনি আসেন। গল্পগাছা করেন। খোদাবক্স আদতে জেলে। পাকেচক্রে হয়েছেন কৃষক। একটিমাত্র পুরনো নৌকা সম্বল করে তাঁরা পাঁচজন জেলে মাছশিকার করতেন অন্য দেশে। একবার ভরা মেঘনায় নৌকায় জল উঠতে লাগল। কোথায় কখন ফুটো হয়েছিল ফুটো কপালের মতোই, তাঁরা টের পাননি। বালতি-বালতি জল ছেঁচেও কোনও ফল হল না। নৌকার মায়া বড় মায়া। ছাড়াও যাচ্ছিল না তাকে। কোনওভাবে যদি টেনে পাড়ে নেওয়া যায়, ছ্যাঁদা সারিয়ে-সুরিয়ে আবার ব্যবহার করা যাবে। নতুন নৌকা মানে বিপুল বিনিয়োগ। তাঁদের সে-ক্ষমতা কোথায়? অতএব জান বিপন্ন করে নৌকা আগলে রাখা চলল। কিন্তু একটা সময় এলই, প্রাণের মায়া নৌকার চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিল। জাল, দাঁড়, সেঁচুনি, বালতি, মাছের চুবড়ি ফেলে দিয়ে ডুবু-ডুবু নৌকা থেকে জলে ঝাঁপ দিলেন সকলে। ভরা মেঘনার গভীর জলে নির্ভীক মাঝি আর পাকা সাঁতারু জেলের দলকে বড় বড় মাছের মতোই কসরত করতে হয়েছিল ডাঙায় পৌঁছবার জন্য। সাঁতরাতে সাঁতরাতে দেহ যখন অচল প্রায়, বুকে আর দম নেই, জিভ বেরিয়ে পড়েছে, তখন মনে হয়েছিল, জলের মছলিদের ডাঙায় তোলা মানুষগুলানকে নদী যেন ষড়যন্ত্র করে ডাঙার মছলি বানিয়ে জলে এনে দম নিংড়ে নিচ্ছে।
দেহগুলি পাড়ে এসে অচৈতন্য অবশ হয়ে ছিল। সাধের নৌকাখানার জন্য, জীবিকার একমাত্র অবলম্বন নৌকাখানার জন্য শোক করার অবকাশ ছিল না। ডাঙার বায়ু খেয়ে, পেট থেকে জল বার করে ক্লান্ত দেহগুলি নিঃসহায় নিঃসম্বল যখন গৃহে পৌঁছল, তখন চোখে অন্ধকার। চারপাশে অন্ধকার। করবে কী এখন! খাবে কী! মহাজনের কাছে গলা অবধি দেনা। ওই এক নৌকা সম্বলে সকলে দিনাতিপাত করেছে। ঋণ-ধার করে বিবাহ সুন্নতাদি আচার-অনুষ্ঠান করেছে। সেই ভরসাই যখন গেল, তখন অন্ধকার ছাড়া থাকে কী!
এতকাল ছিল ভাগের ব্যবসা। এবার শুরু হল মজুরি। এতকাল মাছ যা পেত, পাঁচজন ভাগাভাগি করে লভ্যাংশ সরাসরি পেত। তার জন্য, জীর্ণ নৌকাখানার বরাদ্দ রাখা হয়নি। পাঁচজনের বস্তু বলেই, বোকার মতো, তার হাল ফেরাবার চেষ্টা না করে তার ভরাডুবি ঘটিয়েছে। কথায় বলে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না। পথ বলো, ঘাট বলো, পুকুর বলো, বাড়ি বলো, দশের মালিকানা হলেই তাতে লাগে অবহেলার ছাপ। ফল হল ওই মজুরি। পরের নৌকায় জল ঘাঁটতে গেলেন খোদাবক্স। তাতে আয় যা হল, দু’বেলার সংসার চলে না। মহাজনের ঋণ শোধেন কী প্রকারে! মহাজন নিত্য আসে। গালাগাল দিয়ে যায়। আদালতে যাবে আর জেল খাটাবে বলে শাসায়। ভিটেমাটি অধিকার করে পথে বসাবে, এমন সম্ভাবনার কথা বলতেও ছাড়ে না। খোদাবক্স তখন মহাজনের হাতে-পায়ে ধরেছিলেন। মাস দেড়েক সময় নিয়েছিলেন। বলেছিলেন আল্লার নামে শপথ করে—দয়া করেন। সমস্ত শোধ দেব। শুধু একটু সময় দেন। এই ভিটেটুকু ছাড়া আর সম্বল নাই। এটাই বিক্রয় করে দেব। যাতে ভাল দাম পাই তার জন্য একটু সময় দেন হুজুর। বিপদে পড়েছি জানলে জমির দাম উঠবে না।
সময় দিয়েছিল মহাজন। কসাইয়ের কসাই যে, তারও আছে হৃদয়। সেই হৃদয়ের খপ্পরে পড়েছিল সে। আর কপাল ভাল বলতে হবে খোদাবক্সের। সেইসময় জেলেপাড়ায় দালাল ঘোরাফেরা করছিল ওই এলাকায় জমির সন্ধানে। শুঁটকির কারখানা হবে। খোলা হাওয়ায় দড়িতে শুকনো বালি কিচকিচে শুঁটকি নয়। একটা কোম্পানি বসাবে যন্ত্রপাতি। পরিষ্কার ঝকঝকে শুঁটকি বানিয়ে সুদৃশ্য প্যাকেটে মুড়ে বাজারে ছাড়বে। সেই কারখানার জন্য জমি-জায়গা চাই।
সব দেখে-শুনে খোদাবক্স গভীর চিন্তামগ্ন হয়েছিলেন। ভিটে বিক্রি করে টাকা তো পাওয়া যাবে ভালই, তারপর? সেই টাকা মহাজনকে দিলে পথের ভিখিরি হয়ে যেতে হবে। বিবি-বাচ্চা নিয়ে থাকবেন কোথায়? খাবেন কী? ভেবে-ভেবে কূল-কিনারা মেলে না। চুলে-দাড়িতে দ্রুত পাক ধরল। নদী টানে। জালের মধ্যে ধরা পড়া মছলিদের ডানা ঝাপটানো খলবল শব্দের স্মৃতি হৃদয়ে আবেগ তুলে দেয়। কিন্তু চৌদিকে দুর্ভাগ্য ও অনিশ্চয়তার কালো প্রাচীর। ভাবতে ভাবতে পাগল-পাগল দশা খোদাবক্সের কাছে মুশকিল আসান হয়ে পৌঁছল এক মানুষ তখন। সীমান্ত পারাপারের দালাল সে। বুদ্ধি দিল—পালাও। ভারত নামের ওই দেশে পালাও। ওই দেশ কারওকে ফেলে না। যে আসে, যত আসে, থেকে যায়। সে নাকি কত মহাযুগ ধরে এমনই হয়ে আসছে। আর তোমার তাতে অধিকার নেই-ই বা কেন! এদেশ-ওদেশের ভূ-মৃত্তিকা অখণ্ডই ছিল একদিন। সুতরাং অধিকারের এক অতীত টানে তুমি সেখানে বসত করতেই পার গিয়ে, চেপে বসে, কোনওক্রমে পরিবারের সবার নামে রেশন কার্ড বাগিয়ে নিতে পারলেই আর চিন্তা নেই। ভিটেমাটি বিক্রি কর। আমাকে দস্তুরি দাও। সব ব্যবস্থা করে দেব। নিয়ে যাব এমন জায়গায়, বেড়া টপকালেই সোনার দেশ। পশ্চিমের ওই বাংলা হল স্বর্গরাজ্য। ওখানে কোনও চেনাজানা আছে কি?
আছে। খোদাবক্স মনে করতে পেরেছিলেন। দূর, অতিদূর সম্পর্কের আত্মীয় দু’চারজন।
ব্যবস্থা পাকা হল। আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ হল। জমি বিক্রি করে, ভিটে ছেড়ে একরাত্রে নেহাতই সামান্য সম্বল করে পালালেন। ওই সীমান্ত পারাপারের দালাল প্রায় পির-গাজির মতো মহত্ত্বে খোদাবক্সের জীবনে এনে দিল নতুন চাঁদের কিরণ। কিছু খরচ করতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী! মহাজনের গলা অবধি ঋণ শুধতে সব চলে যেত। বছরখানেক গোটা পরিবার এবাড়ি-ওবাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। সেই কষ্টের দিন পেরিয়েছে। এবারে তাঁরা স্থিত। কিন্তু স্থিতি সকলের কপালে সয় না। নদীর ভাঙন কী বস্তু ওই দেশে জেনে এসেছেন তিনি। রঙে-ঢঙে-প্রকারে এপারে-ওপারে তাঁর চোখে বিশেষ প্রভেদ নেই। চতুষ্কোনায় ভাঙন লাগা দেখে খোদাবক্সের বুক দুরদুর করে। এই অনাবৃষ্টিতে তাঁরও জ্বলে যাওয়া ক্ষেত। সংসারে আধপেটা খাদ্য। এত কষ্ট করে, এত কায়দা-তরিবত করে একটু থিতু হলেন। তা-ও কি নসিবে সইবে না? সম্মুখের অপার নদীর কাদাগোলা জলের তলানি দেখলে বেদনা জাগে অন্তরে।
ঠাঁই গড়তে আরও কয়েকটি জায়গা দেখেছিলেন খোদাবক্স। কিন্তু নদীর ধারে ছাড়া বসত গড়তে মন লাগেনি। জেরাত আলির ভিটেয় পৌঁছে ভেবেছিলেন–বাঃ! এই তো সুন্দর। সামনে নদী। মেঘনা না হোক, ভাগীরথী! কোনওদিন জুটে যাবে সুযোগ, ভেসে পড়বেন নদীতে। কপালে যদি থাকে, কে বলতে পারে, নৌকাও হয়ে যাবে হয়তো একদিন!
অবসর পেলেই নদীর ধারে ধারে ঘুরে বেড়ান খোদাবক্স। জেলেডিঙি থেকে মাছের আঁশটে গন্ধ উঠে আসে। তাঁর প্রাণ আনচান করে। ভরা নদীর বুক স্বপ্নের মতো উঠে আসে চোখের সামনে। তবু ভাল, ছেলেটাকে দিতে পেরেছিলেন নৌকায়।
জেলেপাড়ায় ঘোরাঘুরি করে বেশ দেখে-বুঝে নিয়েছিলেন খোদাবক্স। প্রবীণ অভিজ্ঞ চোখ তাঁর ঠিক চিনেছিল আকবর আলিকে। ছেলেটি খাটিয়ে, উদ্যমী, ভদ্র। এমন মানুষের তাঁবেই ছেলেকে দেওয়া উচিত। এমন দক্ষ ও কর্মঠ লোকই ইসমাইলকেও দক্ষ হিসেবে গড়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করবে। কালক্রমে, বলা যায় না, ওই স্বপ্ন, ওই নিজস্ব নৌকার স্বপ্ন, সফল হয়েও যেতে পারে। এমনকী আকবর আলি নিজেও আরও একটি নতুন নৌকার স্বপ্নে বিভোর, খোদাবক্স জানেন। সুকুমার পোদ্দারের এবারকার ঋণ শুধেই দ্বিতীয় নৌকার জন্য ঝাঁপ দেবে আকবর আলি। দুটি নৌকার মালিক হয়ে গেলে আকবর আলির সংসার-তরণী ডুববে না কোনওদিন সে ভরসা খোদাবক্সের আছে। আর ওই জমির লাগোয়া বাগান, তা জায়গা কম কী! ভিটে ছাড়া কাঠা চারেক হবে। তাতেও ফলে সম্বৎসরের সবজি। এবং এই অনাবৃষ্টিতেও, জলে মাছ না থাকায়, বৃদ্ধ মহম্মদ আলি সারাদিন বাগিচার জন্য পরিশ্রম করে করে তার চেকনাই বাড়িয়েছেন। ধু-ধু.নিফসলি জমিগুলি দেখে দেখে ক্লান্ত চোখ খুশি হয়ে ওঠে মহম্মদ আলির বাগিচা দেখলে। চমৎকার ফলেছে সেখানে ঝিঙে, ডাঁটা, বেগুন।
খোদাবক্সের মস্তিষ্কে রং খেলে। হিসেব-নিকেশ হয়। মায়মুনা এমন ঘরে শাকে-ভাতে থাকবে ভালই। চোখের সামনেই থাকবে। তালাক পাওয়া মেয়ে তাঁর। সেখানেও আছে এক বলার কথা। তিনি বুকে চেপে আছেন। ভাল বর আর এখানে কোথায় সন্ধান করবেন? খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, আকবর আলির কোনও বদখেয়াল, নেশাভাঙ নেই।
মতলবটা আগে মাথায় আসেনি। ইদানীং আফসানাকে দেখে, ওই বাড়ির বেসামাল অবস্থা দেখে মনে জেগেছে। ক’দিন আর বাঁচবে বউটা? বাঁচলেও, ওই রোগা-দুবলা শরীরে সংসারের বোঝা বইতে পারবে কেন! তা ছাড়া আকবর আলি জোয়ান— যুবক পুরুষ। স্বাস্থ্যবতী নারী ছাড়া তার চলে কী প্রকারে! শরীরের ক্ষুধা না মিটলে কাজে সে প্রেরণা পাবে না। চরিত্রেও ঢুকে পড়তে পারে অশুদ্ধি। একথা কি আকবর আলি বোঝে না? বোঝেন না কি মহম্মদ আলি? খালেদাবিবি? বোঝেন নিশ্চিতই। এবং এই হল প্রস্তাব করার উপযুক্ত সময়।
অনেক ভাবনা-চিন্তা করে সন্ধ্যা পেরিয়ে মহম্মদ আলির নিকটে উপস্থিত হলেন খোদাবক্স। আকবর আলি ঘরে ছিল না। প্রকাশকে সঙ্গে নিয়ে সে বসেছিল নৌকায়। এই অনাবৃষ্টিতে নদীতে মাছ নেই। রোজগারের উপায় ভাবছিল তারা। সরকারি সমবায় বিলগুলিতে তবু আছে কিছু মাছ। তাদের লোভ হচ্ছে। খুবই লোভ হচ্ছে ওই বিলগুলি হতে মাছ চুরি করে আনে। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। সমবায়ের জেলেরা পালা করে বিল পাহারা দিচ্ছে। মাছ-চুরির সম্ভাবনা প্রবল এখন। কিন্তু পাহারা সত্ত্বেও চুরি সম্পূর্ণ বন্ধ আছে তা নয়। গোটা বিল পাহারা দেওয়া শক্ত। ফাঁকফোকর দেখে চুরি যারা করছে তাদের দলে যায়নি আকবর আলি ও প্রকাশ। চুরি করা যাদের স্বভাব নয়, পেশা নয়, তারা চৌর্য-অভিলাষের লেজ চেপে ধরে শেষ পর্যন্ত। নিরুপায় চুরির ইচ্ছাকে তাড়িয়ে দিতে চায়। এমনই ইচ্ছার নিশপিশে অবস্থিতিকে দাঁতে দাঁতে পিষে দমন করছিল আকবর আলি। মাছ পাচ্ছে না বলে মন খারাপ তার। আফসানার জন্য মন খারাপ। বেশ কয়েকমাস ধরে বঞ্চিত যৌনক্ষুধাও কামড় বসায় মনে। দেহে। মস্তিষ্কে। উত্তপ্ত আবহাওয়ায় সারা দেহ তপ্ততর হয়। কী করবে সে দিশা পায় না। জমানো তহবিলে হাত পড়েনি এখনও। প্রাণ গেলেও সে-তহবিলে হাত দেবে, এমন ইচ্ছা আকবর আলির নেই। আফসানাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত সে বুঝতে পারছে। কিন্তু হাতে টাকা নেই। যাবতীয় খরচের জন্য হয় ঋণ করতে হবে, অথবা টাকা তুলতে হবে। দু’টিতেই তার আপত্তি। অতএব সে নিশ্চেষ্ট থাকছে। নিজেকে বোঝাচ্ছে, গরিবের ঘরে রোগবালাই হলে আল্লাতালাই ভরসা। সে আর কী করতে পারে!
আফসানা নিজে কখনও চিকিৎসকের কাছে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেনি। জানতে চায়নি, তারই উপার্জন হতে কিছু অর্থ তার চিকিৎসায় ব্যয় করা যেত এমন দাবি সে করতে পারে কি না। বরং তার হয়ে দু’ একবার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন খালেদাবিবি। বলেছিলেন—আফসানাকে একবার শহরে নিয়ে যা।
আকবর আলি বলেছিল—টাকা কোথায়? ভাত জুটছে না ভালমতো। দেখছ তো অবস্থা।
—ভাত না জুটলেও রোগা-ভোগা মানুষের চিকিৎসা তো করাতেই হবে। সরকারি হাসপাতালে তো পয়সা লাগে না।
—নিয়ে-যাওয়া নিয়ে-আসার খরচ নেই? তা ছাড়া দেবে একগাদা ওষুধ। সেসব তো হাসপাতাল থেকে দেবে না। নিজেদের পকেট উলটে কিনতে হবে।
—তা হলে হবে। মেয়েটা তো এতদিন আয় দিয়েছে। এবার তার জন্য একটু খরচ হবে তো হোক।
আকবর আলি ক্রুদ্ধ হয়েছিল। বলেছিল—কী বলো তুমি মা? হাতে টাকা নেই। আমি কি শেষ পর্যন্ত জমানো টাকা ভাঙব?
—দরকার হলে ভাঙবি।
—তুমিই দাও তা হলে টাকা। কারণ ও টাকায় হাত দেব না আমি। তিল তিল করে জমানো টাকা আমার। আর একটা নৌকা কিনতে পারলে কী সুখের দিন আসবে বলো তো মা! একটা নতুন নৌকা! আঃ! কতদিনের স্বপ্ন আমার। আর ওই টাকায় কিনা তুমি আমায় হাত দিতে বল! নৌকার টাকা বিবির জন্য খরচা করতে পারব না আমি। অত যদি মনে হয় তবে তুমি দাও টাকা।
—আমার টাকায় তো বাপু চাল কেনা হচ্ছে। আমি কি টাকা জমাই? না শাড়ি-গয়না বানাই! আজ অবধি নিজের জন্য একটা কিছু করেছি? কত সাধ ছিল, নাকে একটা ছোট্ট হিরের ফুল পরব! সোনাই জুটল না, তা হিরে! সংসারের ঘানি টানতে টানতেই সব শেষ।
—তা হলে আর কিছু করার নেই।
এই সমস্ত কথাই অবশ্য আফসানার আড়ালে হয়েছিল। মহম্মদ আলি সব শুনে পরে ধমকেছিলেন বিবিকে—তোমার কি মাথা খারাপ হল? পয়সা ভেঙে তুমি বউয়ের চিকিৎসা করাবে? হাল দেখছ না সংসারের? ওর পেছনে খরচ করে শেষ পর্যন্ত আকাল পড়লে কি না খেয়ে মরবে সব?
খালেদা বলেছিলেন—মেয়েটা চোখের সামনে মরবে তাই বলে? একবার চিকিচ্ছে হবে না?
—মরবে কেন? তুমি তো ওষুধ-বিষুধ দিচ্ছ। তাতেই সেরে উঠবে।
—সেরে আর উঠছে কোথায়? শুনলাম সতীর থানের ওষুধ অব্যর্থ। কোথায় কী!
এরপরে আর কথা বাড়াননি খালেদা। ঘরের পুরুষের বুদ্ধির ওপর নির্ভর করতে হয়। তাতেই মঙ্গল। এমনই শিক্ষা তাঁর। মেয়েদের জীবনের কি আর কোনও দাম আছে? জীবন হল পুরুষের জন্য। মেয়েরা হল কাজের কাজি। ভোগের বস্তু। সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। মেয়েদের ওপর আর মায়া করে কে! তবু তাঁর বুকের মধ্যে আফসানার জন্য দরদ ভরে থাকে। মায়ের মন। তা ছাড়া মেয়েটাও বড় লক্ষ্মী। সংসারের জন্য মুখ বুজে প্রাণপাত করেছে। ভরা মাস নিয়ে খেটেছে। পুরুষরা তার কষ্ট কী বুঝবে। মেয়ের কষ্ট মেয়েতেই বোঝে। শাশুড়ি হলে কী হয়! খালেদার নারীহৃদয়ে দরদ পাকিয়ে ওঠে। অন্যদের থেকে পরিমাণে কিছু বেশি ভাতই দেন তিনি আফসানাকে। মেয়েটা যেন খাবার শক্তিও হারিয়েছে। কী রকম নিস্পৃহ চোখে তাকায়। সে চাহনিতে প্রাণের বড় অভাব। খালেদা কালে-ভদ্রে আফসানার চুলের জট ছাড়াতে বসেন! কী সুন্দর নরম সুগঠিত ছিল মেয়েটা। এখন তার গায়ে হাতে হাত পড়লে খালেদার গা শিরশির করে। মনে মনে একা-একাই বলেন—মেয়ের নাম ফেলি। পরে নিলেও গেলি, যমে নিলেও গেলি।
যাবার জন্যই আসে মেয়েরা। যতক্ষণ গতর, ততক্ষণ কদর। শ্বশুরবাড়ির রস তাকে চিনির পাকে পোড়ায়, বিষের পাকে ঝোরায়। খালেদা, নিজে এক শাশুড়ি হওয়া সত্ত্বেও এই সকলই বিড়বিড় করেন। মেয়েছেলে কাদার ঢেলা, ঝপাস করে জলে ফেলা। শ্বশুরবাড়ি আর জল— তফাত কী!
শুনতে বটে শ্বশুরবাড়ি
বড় সুখের চাঁই।
কিন্তু সেথা ঝাঁটা ছাড়া
আর কিছু নাই॥
খালেদা মুখ বাঁকান। এই কিছুদিন ছিল কেবল আফসানা, আফসানা। সে ছাড়া বাড়ির লোকের চোখে অন্ধকার। এমনকী ছেলের চোখে বধূটির প্রতি প্রেম উছলাতে দেখেছেন তিনি। হায়! সেই প্রেম বধূর শরীরের সঙ্গে সঙ্গেই শুকিয়ে হাড় কাঁকলাস। ভাবলে তাঁর মুখ বিস্বাদ হয়ে যায়। আপন মনে বকেন— আমার অসুখ করলেও তা হলে তোরা ফেলে রাখবি আমাকে। চিকিচ্ছে করাবি না। হাক থুঃ এ সংসার! কাদের জন্য কী করছি!
এই বিতৃষ্ণার মধ্যেও তিনি হাঁফাতে হাঁফাতে সবই করছেন। সংসারের ঘুরন-চাকিতে ঘুরে মরা জান-প্রাণ। সহজে তার থেকে মন সরে না। স্বামীতে মন যায়। পুত্রে মন যায়। বিতৃষ্ণা ছাপিয়ে উঠে আসে আশা-ভরসা। পুরুষের বোধ-বুদ্ধি বেশি। তাদের কথায় ভরসা করেই এসেছেন যে এতকাল। তাঁর স্বামী, তাঁর ছেলে—তারা মানুষ চমৎকার। সংসারের হালই এমন তারা কী করবে! মায়ের মন মানে না। ন্যায়-অন্যায় সাজাতে সাজাতে কখন মন ঢলে পড়ে স্বামী-পুত্রের পক্ষে।
মাছ চেনে গভীর জল
পাখি চেনে ডাল।
মায়ে জানে পুতের মায়া
জিয়ে যত কাল।।
টানা-দোটানার মধ্যেই সুস্থ মানুষেরা দল রচনা করে বসে। আফসানা তা টের পায় না। দুধের শিশুকে বুকে নিয়ে সে বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকে। তার নিজের ঘরে সে থাকে না এখন। কোণের দিকের ছোট এ ঘরখানিতে বাচ্চা হলে তারই ঠাই হয়েছে এতকাল। এ হল বিয়োন-ঘর। তার ননদেরাও এ ঘরেই বিইয়েছে। প্রসূতির পক্ষে একটেরে ঘরখানি শান্ত। কিন্তু দমচাপা। সে নিয়ে তার খেদ নেই। এ ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায় সবজির বাগান। পড়ন্ত বেলায় হলুদ ঝিঙেফুল দেখে দেখে তার সময় গেল। এখন সারা মাচান জুড়ে ফলে আছে লম্বা লম্বা সুঠাম ঝিঙে। এই অনাবৃষ্টির কালেও তাদের ফলন দেখে বুক জুড়োয়। সে শিশুটিকে দুধ দিতে দিতে ঠায় বসে দেখে। মহম্মদ আলি ঝুঁকে-পড়া দেহটিকে সোজা করে নিয়ে টিপে টিপে ঝিঙে পেড়ে নিয়ে যান। সেই ঝিঙে পাক হয়ে ভাতের সঙ্গে আফসানার ঘরে আসে। আফসানা মনে মনে পাকশাল দেখে। মনে মনে শাশুড়ির জন্য কষ্ট পায়। আহা! কত কষ্ট হচ্ছে মানুষটার। দুর্বল ঝিম-ধরা হাতে দুরন্ত ছেলে-মেয়েগুলিকে আদর করে সে। বলে—একটু কাজ-কাম কর। আম্মির কষ্ট লাঘব কর তোমরা। কথা শুনো।
ছেলে-মেয়েরা তার কাছে ঘেঁষতে চায়। কিন্তু দুর্বল সে। রোগগ্রস্ত। তার কাশির শব্দে উঠে আসে ঘঙঘঙে নিষেধ। সে কীরকম ভয়ে গুটিয়ে যায়। খালেদার এনে দেওয়া ওষুধ খায় ভক্তি ভরে আর প্রত্যাশা করে, সেরে উঠবে একদিন। সুস্থ হবে। সমস্ত দিন এই এক ঘুষঘুষে জ্বরের ক্লান্ত কপালে হাত রেখে পড়ে থাকতে হবে না তখন। দিনভর আল্লাতালার কাছে সে মোনাজাত করে। সুস্থ করে তোলো খোদা। এ দেহ সুস্থ করে দাও। এমনকী গোপনে সে সতীর থানের উদ্দেশে মানসিক সংকল্প রাখে। কী হবে? কী অন্যায় হবে যদি সে সতীর কাছে নিজের সুস্থতা মানত করে! সে তো দেখেছে, তাদের গ্রামের পিরগাজিতলায় সিন্নি দিয়েছে হিন্দুরা। তাতে তো কোনও অপরাধ হয়নি! সে কোথাও ব্যক্ত করেনি তার সংকল্প। সুস্থ হলে চুপ করে গিয়ে পুজোর নামে দু’টি টাকা দিয়ে আসবে। কিংবা বলবে খালেদাকেই। শাশুড়িকে চেনে সে। তার সংকল্প শুনে খালেদা তিরস্কার করবেন না, এই ভরসা আছে।
সুস্থ হয়ে উঠবেই সে। উঠবেই। কবে? কবে? তার ভয় একটাই। নিবিড় অন্ধকার হয়ে সেই ভয় তাকে ঘিরে রাখে সবসময়। নিজের কঙ্কালসার দেহ দেখে সে, আর মনে মনে অবিশ্রাম কান্না ঝরায়। চিরকালের ভয় তার। আবাল্য, আজন্মকালের ভয়! যদি নিকে করে আকবর আলি! যদি করে! তার এই দেহের অবস্থা! যদি কামাতুর হয় মানুষটা, আর মেটে না চাহিদা তার, যদি নিকে করে আবার, আফসানা দোষ দেবে কাকে? নিজেকেই তো! নিজের কপালকে!
অতএব, নিজের স্বাস্থ্যকেই সে দেয় দোষ, দেয় অভিসম্পাত। সমস্ত অভিযোগের তির দিয়ে বিদ্ধ করে নিজেকেই। অন্ধকার ঘরের অন্ধকারের অধিক কোণে নিজের অস্থিসার শরীরকে লুকিয়ে ফেলতে চায়। স্বাস্থ্যবান শিশুটি তার দেহনির্যাস টেনে নেয় দ্রুতগতিতে। সে মনে মনে চলে যায় সুন্দর সময়গুলিতে। তার আর আকবর আলির দেখা স্বপ্নে। স্বপ্নাধিক সুন্দর সময়ে। তার শরীরকেই নৌকা করে ভেসে যেত আকবর আলি যখন, বলত— আর একটা নৌকা হোক, ঋণ-ধার শুধে নিই, তোমার সারা অঙ্গ গয়না দিয়ে ঢেকে দেব আমি।
সে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে চাইত। কী বলবে সে, কী করবে, দিশেহারা, বলত —কী কথাই কও মিঞা। সারা অঙ্গ গয়নায় ঢাকলে কতখানি সুনা লাগবে কত্তও!
—সব দিমু তুমারে। জগতের সকল সুনা ঢালিয়া দিমু দেহে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলত সে। ‘এইখানে দিমু। এইখানে, এইখানে, এইখানে।’
বলত আর কামড়ে কামড়ে ধরত তার অঙ্গগুলি। তার স্তন, তার নাভি, তার যোনিদেশের নিকটবর্তী মাংস। সে শিউরে শিউরে উঠত আর ভাবত—কী পাগল! কী পাগল লোকটা! এইসব জায়গায় বুঝি গয়না পরে কেউ! সোনা পরে!
এখন, এই হাড়সর্বস্ব দেহেও, তার জাগল শিহরণ। স্মৃতিচারণের ভিতর, গভীর সুখে, সে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। কিন্তু সুখ সইল না বেশিক্ষণ। তার মনে পড়ে গেল সেই প্রসঙ্গ। কতবার কথা হয়েছে তার সঙ্গে আকবর আলির। নিকে করতে সে ছিল নারাজ। দু’টি পরিবারের পোষণ- পালন কি সোজা কথা? এমনই বলেছিল সে। তখন সে, তার স্বভাববিরুদ্ধভাবে একটি কূট প্রশ্ন তুলেছিল। বলেছিল—তা হলে কি তুমি সেইসময় আর এক বিবি আনবে, যখন তোমার হবে প্রচুর উপার্জন এবং বহুজনকে পালন-পোষণ করার ক্ষমতা?
আকবর আলি তার মুখ চুম্বন করে বলেছিল—না রে পাগলি না। তুমি বিবি আমার একমাত্র চাঁদ। আসমানে চাঁদ থাকে ক’টা? কে কবে দেখেছে দু’টো চাঁদ?
সে আকবর আলির শক্ত বুকে লেপ্টে যেতে যেতে ভেবেছিল, এই বুকের আসমানে সে সত্যিই বুঝি চাঁদ একজন। সেই চাঁদ এখন ক্ষয়ে যাওয়া। চাঁদে ক্ষয় লাগে যদি, আসমানের কি ইচ্ছে করবে না আরও এক নিটোল চাঁদ পেতে?
নৌকার পাটাতনে বসে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদই দেখছিল তখন আকবর আলি। নিকে করার কোনও সাধ জাগছিল না তার মধ্যে। আশঙ্কায় ভরে থাকা বুক কেবল নিংড়ে বার করছিল হতাশাগ্রস্ত বায়ু। মোটামুটি গুছিয়ে আনতে আনতে হঠাৎই এই অনাবৃষ্টির বছর। চারদিক যেন খাঁ-খাঁ করছে। মহরম মাসে যে হাহাকার করে তারা ধর্মীয়ভাবে, তারই প্রতিধ্বনি যেন লেগে আছে আনাচে-কানাচে, নৌকার পাটাতনে, গাছের প্রশাখায়। জলের অভাবে এবার বাইচ হল না পর্যন্ত। অথচ কত আশা করেছিল সে। এবার প্রথম পুরস্কার জিতবেই তার সিরাজ নৌকা। তার আর প্রকাশের দক্ষতা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ইসমাইলের দক্ষতাও সে দেখেছে। সিরাজের নাগাল পায়নি কেউ গত বৎসরেও। এবার বাইচে ভাল পুরস্কার পাবার কথা ছিল। হল না। হল না কিছুই। তার চোখে ভাসে নদীভরা জল। এপারে দাঁড়ালে ওপার দেখা যাবে না এমনই বিস্তার। জলের ওপর নাক ভাসিয়ে রাখা শুশুকের মতো জেগে থাকবে পেতনির চর। জলের সেই রূপ, সেই শান্ত গভীর বয়ে যাওয়ার ওপর ভেসে যায় শরতের ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ। তার শ্রবণে এসে আঘাত করে বদর-বদর হাঁক। জয় মা গঙ্গা ধ্বনি। নদীর জোয়ারের টইটম্বুরে টঙ্কার লাগায় মানবহৃদয়ের বিপুল উৎসাহ। আকবর আলির অর্ধভুক্ত পেটে ক্ষুধা জাগে। অভুক্ত দেহে ক্ষুধা জাগে। শ্রমে আসক্ত পেশিগুলির ক্ষুধা জাগে। সকল ক্ষুধার তাড়নায় অস্থির-অস্থির সে বিড়ি ধরায়। দীপ্র গরমে ঊরু অবধি লুঙ্গি গুটিয়ে বলে—প্রকাশ। বড় দুঃসময় এল। কোনওদিকেই যে কোনও পথ পাচ্ছি না।
প্রকাশ তাকিয়েছিল নিঃসীম অন্ধকারে। জেলেঘরে এক বছর বারিপাত না হলেই দুঃসময়। এর থেকে আর মুক্তি কী। এ যেন রোজকার একমুঠো চালের ভিক্ষে। একমুঠো জীবন উপার্জন কর আর বাঁচো একমুঠো। সামনে পড়ে আছে বহু দূর পথ। সেই পথের কোথায় কী আছে কারও জানা নেই। কিন্তু সম্পন্ন ব্যক্তি কিছু হিসেব করে রাখে আগাম। কারও হিসেব মেলে, কারও মেলে না। যার মেলে, তার পথ সুগম হয়ে থাকে। কোনও খানাখন্দ নেই, জীবনের পথ চলতে থাকে নিখুঁত।
শহরে জীবনবিমার বড় বড় বিজ্ঞাপন দেখেছে প্রকাশ। তাতে লেখা থাকে নানারকম হিসেব। এখন এই খাতে টাকা জমা করলে আপনার সন্তানের একুশ বছর বয়সে পাবেন জমা আমানতের চতুর্গুণ। আঃ! কত সব জাদুসমাধান! আপনার বয়স যখন পঁয়ষট্টি তখন কারও ওপর নির্ভর করতে হবে না যদি আপনি এখনই একটি ‘জীবনপ্রগতি’ করেন। জীবনের জন্য ধাপে ধাপে সাজিয়ে রাখা পরিকল্পনা! পদে পদে এমন সব হিসেবি সম্ভার সাজানো যেত যদি, খুব বেশি কিছু নয়, বরং এরকম—আসুন, ‘অনাবৃষ্টি-ভরসা’ খাতে জমা করুন। অনাবৃষ্টিতে আপনি পেয়ে যাবেন ভরসা।
না। হয় না এরকম। প্রকাশরা বিজ্ঞাপনের দিকে হাত বাড়ালে বিজ্ঞাপন আরও ওপরের দিকে উঠে যায়। সে যত লম্বা করে হাত, বিজ্ঞাপন তত দূরের, দূরের, যেন আকাশের বুকে লকেটের মতো লটকানো। তারা হল পিঁপড়ের মতো কণা-কণা খাদ্য সংগ্রহ করা মানুষ। পিঁপড়ের মতোই যে-কোনও কিছুর পদচাপে তাদের সংহার হতে পারে। তাদের জীবনের কী-ই বা দাম! আজ সে তার বউ সন্ধ্যার একটি সোনার রুলি নিত্য কুণ্ডুর কাছে বাঁধা দিয়েছে। দু’ বৎসরের কড়ার। ফিরিয়ে নিতে না পারলে রুলি হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাদের ঘর হতে এভাবেই একটি একটি করে চলে যায় সোনা-রুপার অলংকার, কাঁসা-পেতলের থালা-বাসন।
নিত্য কুণ্ডু বলছিলেন—বাঁধা দিবি? গৃহলক্ষ্মীর অলংকারে এত তাড়াতাড়ি হাত দিস না প্রকাশ। রাখ। অল্প সুদে টাকা নে বরং।
সে রাজি হয়নি। বলেছিল—কী লাভ কাকা! সুদে টাকা বাড়লে সেই গৃহলক্ষ্মীর অলংকার দিয়েই হয়তো শুধতে হবে। তাতেও না কুলোলে ভিটে যাবে। কী দরকার!
—যা ভাল বুঝিস।
নিত্য কুণ্ডু টাকা গুনে দিয়েছিলেন। প্রকাশের অভিনেতা বাপ ছিলেন নিত্য কুণ্ডুর খাঁটি স্যাঙাত। সেই সম্পর্কের সম্মানে কুসীদজীবী স্বর্ণবণিক নিত্য কুণ্ডুও প্রকাশের নিরন্তর সংগ্রাম দেখে স্নেহসিক্ত হয়েছিলেন। সেই বিচারেই, ওই রুলির বাজারদরের তুলনায় কিছু বেশি টাকা ই তিনি দিয়েছিলেন প্রকাশকে। প্রকাশ তার জন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু কতদিন চলবে ওই টাকায়? একটা কিছু করতেই হবে। বর্ষা আসতে এখনও এক বছর দেরি।
আকবর আলির নীরবতা সহ্য হচ্ছিল না। সে বলল —চুপ মেরে গেলি কেন প্রকাশ? কথা ক।
–কী কব?
—তার আমি কী জানি! আমি কি শালা তোর পোঁদে সেঁধিয়ে কথা খুঁচিয়ে তুলব?
প্রকাশ গায়ে মাখল না এই তিরস্কার। এগুলি তাদের অন্তরঙ্গ দেওয়া-নেওয়া। সে যদিও আকবর আলির ক্ষেত্রে থাকে কিছু সংযত, কারণ, হাজার বন্ধু হলেও, আকবর আলির নৌকায় সে কাজ করে। সে বলে কথা বন্ধ হয়ে গেছে।
—হুঁ! সুরও যে গুনগুনোস না। গান বন্ধ করলে জান বাঁচাবি কী দিয়ে প্রকাশ? এখনও যে অনেকদিন।
–পরপর ক’বৎসর ভাল গেছে তো। দুঃখের অভ্যাস চলে গেছে আকবর ভাই।
—সেই হল গে কথা। মানুষ সুখ বড় তাড়াতাড়ি রপ্ত করে ফেলে।
—ভাবি আছেন কেমন?
—ভাল না।
—তারে একবার হাসপাতালে নিয়ে যাও আকবর ভাই।
—হুঁ!
আকবর আলি চুপ করে যায়। এ প্রসঙ্গ বড়ই অস্বস্তিকর। সে চায় না এমন আলোচনা। কিন্তু সে না চাইলেই লোকে চুপ করে থাকবে কেন? প্রকাশ আকবর আলির নীরবতায় কথা নিক্ষেপ করে। উদাস ও দুঃখী গলায় বলে—ভাবিরে দেখে একটি খারাপ সন্দেহ জাগে। যদি বলি তবে দোষ নিয়ো না আকবর ভাই।
—না। তোর আবার আমার নিকটে দোষ কী!
—বিড়ি বাঁধেন ভাবি। ওই জ্বর। ওই রোগা দেহ। তাঁরে কালব্যাধি না ধরে।
—তুই বলছিস যক্ষ্মা?
—বিচিত্র না।
–হায় খোদা!
তারা দু’জনেই চুপ করে যায়। স্পষ্ট কথাগুলি বলে ফেলে বিব্রত বোধ করে প্রকাশ। আর আকবর আলির বুকে শঙ্কা ঘনিয়ে আসে। যক্ষ্মা অতি ছোঁয়াচে রোগ। সত্যি যদি এ রোগ হয় আফসানার তা হলে ওই কচিদেহ সন্তানকেও তা গ্রাস করতে পারে। সে দোলাচলে ভুগতে থাকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই কি ভাল তা হলে। সারা বাড়িসুদ্ধ লোককে রোগগ্রস্ত করে তোলার চেয়ে সময় থাকতেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। হঠাৎ আফসানার ওপর রাগ হয় তার। কেন সে এই রোগ বাঁধিয়ে বসল! কত লোকই তো বিড়ি বাঁধছে। সকলেরই কি আর যক্ষ্মা হচ্ছে! এ যেন আকবর আলিকে, এই অনাবৃষ্টিতে, আরও বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র। সে বিরক্তি গোপন করতে পারে না। ব্যক্ত করে ফেলে। বলে শালি যেন আমার পেছনে শত্তুর হয়ে লেগেছে!
এই মুহূর্তে তার মনে পড়ে না আফসানার সঙ্গে যাপিত সকল মধুযামিনী। মনে পড়ে না, চারটি সন্তানের জন্ম দিয়ে, সংসারে হাড় কালি করে খেটে, বিড়ি বেঁধে দুটি রোজগার আফসানা করত বলেই, সে ঋণ শুধতে পারছিল। এমনকী সে ভুলে যায়, আফসানাকে সুখী করার দায় ছিল তার। তার সারা অঙ্গ সোনায় মুড়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল সে।
প্রকাশ বলে—ভাবিরে দোষ দিয়ে লাভ নাই। এ হল আমাদের নসিবের দোষ। আর রোগ যে ধরেছেই, তা তো নয়। তবে ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া ভাল।
আকবর আলি বলে—নিয়ে যে যাব সদরে, টাকা কই? ওষুধ দিতে হবে, পথ্যি দিতে হবে।
—সে নিয়ে যেতে কুড়ি টাকা খরচ। যক্ষ্মার ওষুধ শুনেছি সরকারি হাসপাতালে বিনি পয়সায় দেয়। ছুঁচ ফুঁড়িয়েও ওষুধ দেবে বুঝি কিছু। পথ্যি তো যা পাবে তাই। আমাদের ঘরে আর কে কবে ঘি-ছানা খাচ্ছে!
—তা কুড়ি টাকা, সে-ই বা এখন পাই কোথা? মা একা রোজগেরে। তা দিয়ে চাল কেনা চলছে।
—আমি দিচ্ছি ধার।
—তুই? পাবি কোথা? চলছে কী করে তোর?
—বউয়ের রুলি একটা ছিল সোনার। বাঁধা দিলাম নিত্য কুণ্ডুর কাছে। তার থেকে পঁচিশ টাকা নাও তুমি।
—কী যে বলিস! তোর ধারের টাকা থেকে আমি ধার নেব? আমাকে তুই এমন চশমখোর ভাবলি প্রকাশ?
—না না। তা কেন? সময়ে অসময়ে তোমার হতে টাকা নিই না আমি?
—সে অন্য কথা। ধারই যদি করতে হয় তবে তোর ধারের টাকা হতে কেন? অন্য কোথা হতে নেব।
.
আজ রাত্রি এগারোটায় জোয়ার আসবে। নৌকা ভাসাবে তারা তখন। রোজই ভাসায়। খলসে, পুঁটি, ছোট রুই, কাতলা পায় যার দাম দিয়ে নৌকা সারাইয়ের আলকাতরা পাওয়াই ভার। উজানের হাত ফসকে চলে আসা দু’-একটি ইলিশও যে না পেয়েছে এমন নয়। কিন্তু আড়তদারের কাছে একটি-দুটি ইলিশের কোনও দাম নেই। সব জেলেরই লক্ষ্য সুকুমার পোদ্দারের বাড়ি। কেউ কেউ চুবড়ি বাসের মাথায় চাপিয়ে বহরমপুরে চলে যায়। পাড়ায় পাড়ায় মাছ ফিরি করে আসে। সামান্য মাছ নিয়ে আকবর আলি আর প্রকাশও গিয়েছে ক’দিন। বাসে করে গিয়ে, সারাদিন ঘুরে, বাইরে খেয়ে, উপার্জন যা হয়েছে তাতে পড়তা পোষায়নি। তবু যাওয়া ছাড়া অন্য পথ নেই। এ শুধু পেটচুক্তির প্রশ্ন নয়। এর মধ্যে আছে অমোঘ টান একপ্রকার। জলের টান, মাছের জন্য চকিত জাল ফেলা, অতলে লুকিয়ে থাকা রুপোলি মাছের খেলা—এই এক জীবন তাদের। একে ছাড়া বাঁচা কি যায়? মৎস্যগন্ধা তরণী তাদের, জেলে ছাড়া অন্য লোকের সে গন্ধে গা মুচকানি দেয়। কিন্তু তাদের ভাল লাগে। তাদের জীবন থেকে ওই মেছো গন্ধকে পৃথক করা যায় না। যারা চাষ করে খায়, তাদেরও অবস্থা একই প্রকার। ফসল উপার্জনের পথ, কিন্তু ফসলই জীবন। মাটির সঙ্গে, জলের সঙ্গে, গাছ-গাছালির সঙ্গে সম্পর্ক যাদের—কী এক গভীর রহস্যময়তায় তারা জীবনকে মিশিয়ে দেয় ওইসব সত্তার সঙ্গে! এর অর্থ সকলে বোঝে না। সুকুমার পোদ্দার বোঝেন না। বোঝে তাঁর জমিতে খাটা চাষিরা। বোঝে তাঁর জমিতে বর্গা পাওয়া কৃষকরা—যারা মাটি ঘাঁটে। ছানে। জমি থাকলেই হয় না, তার সঙ্গে সংসর্গের আনন্দ অন্য। মাছের মহাজন বোঝে না, জানে না, জেলের সঙ্গে জলের সম্পর্ক কতখানি! জানে যারা—ওই আকবর আলি, প্রকাশ, ইসমাইল, তারা জলে না গিয়ে পারে না। আর মাছ একেবারেই কম হলে ভাগাভাগি করে আপন সংসারের খোরাকি করে নেওয়া। এর মধ্যে অনেকদিন শূন্য জাল নিয়েও ফিরেছে তারা।
আকবর আলি স্থির করে, অপেক্ষা করবে ক’দিন। শহরে গিয়ে মাছ বেচলে পাঁচ টাকা অন্তত লাভ হয়। তা-ই সরিয়ে রাখবে আফসানার জন্য। পাঁচদিন গেলে পঁচিশ টাকা। কিন্তু ওই ডাকঘরের তহবিলে হাত দেবে না কিছুতেই। ওই টাকা তার স্বপ্ন। তার ভবিষ্যৎ। ওই টাকা তার সিরাজের সঙ্গিনী লুত্ফা নৌকার জন্য। তার নিজের জীবনের চেয়েও বেশি কিমতদার তার নৌকা! তার পরিকল্পনা ব্যক্ত করে না সে প্রকাশের কাছে। ঘনিষ্ঠতা যতই হোক, স্বপ্নের কথা বেশি বলতে নেই। তা হলে স্বপ্ন ক্ষয়ে যায়।
আকাশ থেকে তারা খসে পড়ছিল একটা। আকবর আলি উত্তেজিত চিৎকার করে—চা প্রকাশ। চেয়ে নে। চাচা।
—কী কী কী!
—তারা তারা তারা!
দু’জনেই পাটাতনের ওপর উবু হয়ে পড়ে। খসে পড়া তারার কাছে একজন মোনাজাত করে, অন্যজন প্রার্থনা জানায়। এক লহমার জন্য দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেছে কল্পপূরণের জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। কবে সে মারা গেছে! তার মরণের আলো পৃথিবী হতে দৃশ্যমান যখন তখন সেই নক্ষত্র লুপ্ত। মহাশূন্যে নিঃশেষ। তবু সে মানবের স্বপ্ন-নিরূপণেয়। লহমার তরে দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায় সে, আর তাকে খুঁজে ফেরে মানবের প্রার্থনা। কত কিছু চাওয়ার, পাওয়ার। সকল কামনা-বাসনার দল ওই বিলীয়মান আলোকপিও অনুসরণে ফেরে। মাথা কোটে নৌকার পাটাতনে। দাও দাও। দিয়ে যাও কিছু। ওগো তারা। যাবার আগে যাও গো আমায় ভরিয়ে দিয়ে। দাও সমৃদ্ধি, দাও নদীভরা ইলিশ। দাও সুখ, দাও অর্থ। দাও বধূটির সুস্থ পুরন্ত শরীর। দাও দাও ওই নিত্য কুণ্ডুর নিকট হতে সোনার রুলি ফেরত আনার ক্ষমতা।
তারা মাথা তোলে দু’জনেই। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসে। দু’জনের নিরুচ্চার প্রার্থনা সমান্তরালে যেতে থাকে দূরে, দূরে, কত আলোকবর্ষ দূরে! আকবর আলি বিড়ি ধরায় আবার। প্রকাশ হাত বাড়িয়ে দেয়। এই ছোট বিড়ি দু’টান দিয়ে ফিরিয়ে দেয় আকবর আলিকে। আকবর আলি শেষ টান মেরে সামান্য অবশেষ ছুড়ে দেয় জলে। বলে—তোর বউ খুব কাঁদল না প্ৰকাশ?
প্রকাশ এই আচমকা প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল। বলল—কেন বলো তো আকবর ভাই?
—ওই! গায়ের সোনা খুলে নিলি।
—না। কাঁদে নাই।
—কাঁদে নাই?
—না। সে জানে। গরিবের সোনা এমনি করেই যায়। উলটে কান্না আমারই পেয়েছিল আকবর ভাই। মায়ের গয়নাগুলো একটা একটা করে যেতে দেখেছিলাম। ছিল আর কী! ছিলই তো সামান্য। সেও সব গিয়েছিল। এখন বউয়ের যাচ্ছে। নিজের অপদার্থতার কথা ভেবে সত্যি চোখে জল এসেছিল আমার। তা সন্ধ্যা বলল, ‘মন খারাপ কর কেন? মেয়েছেলের মতো কাঁদছ? ছিঃ। ও তো তুমি পরে ছাড়িয়েই আনবে।’ বললাম, ‘না যদি পারি?’ বলে, ‘গড়িয়ে দেবে আবার। ভাল সময় এলে এর দ্বিগুণ আদায় নেব আমি। ছাড়ব না।’ কী বলব আকবর ভাই! মেয়েমানুষ এক আশ্চর্য জাত! মাকেও দেখেছি, বউকেও দেখলাম। ও খুব ভাল করে জানে, সোনা গড়াবার সামর্থ নেই আমার। তবু ভাব করে এমন, যেন কালই একটা জমিদারি পাব আমি।
আকবর আলি চুপ করে থাকে। এবার আফসানার জন্য মন খারাপ হতে থাকে তার। তার বিবিও তো এমনই লক্ষ্মী, এমনই বুঝদার। মুখ ফুটে একটি জিনিসও তো চায়নি সে আজ অবধি! কেবল একটিই দাবি তার। একটিই নিষেধ। আকবর আলিকেই সে চায় গোটাগুটি। মানুষটার ভাগ কারওকে দিতে চায় না। এ দাবির ন্যায্য-অন্যায্য বাড়তি কমতির বিচার নেই। এক মানুষের কাছে মানুষীর দাবি। এ দাবি চিরন্তন। তা পূরণেরই আশ্বাস আকবর আলি দিয়ে এসেছে আফসানাকে। সে জানে না, কল্পনাও করেনি এমনকী, এই আশ্বাস ভাঙার প্রস্তাব করছেন তাদেরই আঙিনায় বসে খোদাবক্স মাঝি। ইসমাইলের পিতা। জেলে ছিলেন তিনি পেশায় এতকাল, এখন জেলে নন আর। বরং হেলে। পারিবারিক পেশা ইসমাইলের মধ্যে বর্তিয়ে তৃপ্তি খুঁজছেন। হাতে বিড়ি নিয়ে আঙিনায় বসেছেন তাঁরা। খোদাবক্স, মহম্মদ আলি এবং পাকঘরে ভাত ফোটাতে ফোটাতে মাঝে মাঝে এসে দাঁড়াচ্ছেন খালেদা। কাজ হতে ফিরেছিল মোবারক আলি। নিজে মাটি-কাটা শ্রমিক না হলেও মাটির দুনিয়ায় তারও হাতে পায়ে লেগে যায় মাটি। সে মাটি ধুয়ে পোশাক পাল্টাতে এসেছিল। অশোক এসেছে অনেকদিন পর। কিছু আড্ডা, কিছু আলোচনা সেরে নেবে মোবারক আলি। অসম্ভবের স্বপ্নকে সম্ভাব্য করে নেবার জাল বুনবে। বেরুবার আগে ঘরে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিল সে খানিক। নিষ্কর্মা মানুষ, তবু কিছু কামে লেগেছে। দাঁড়িয়ে থেকে, বকাবকি করেও হয় কিছু পরিশ্রম। তদুপরি কিছু কিছু বোল্ডার আসছে এখন। পাকুড় থেকে গাড়ি করে আসছে। তারও তদারকির দায়িত্ব পড়েছে মোবারক আলির ওপর। পড়বে সে জানত। কিছু-বা গর্বও আছে তার এ কারণে। কাজটায় বাবুয়ানি আছে। জেলের পো নিষ্কর্মা মোবারক আলি হঠাৎ হয়ে উঠেছে ঠিকেদারের ডানহাত, লোকে ঈর্ষাও বোধ করে নিশ্চয়ই। মোবারক আলিকে হেলাফেলা করতে পারে না। সে অতি পরিতোষের সঙ্গে পা নাচাচ্ছিল শুয়ে শুয়ে। অন্যমনস্কতার মধ্যেও তার কানে আসছিল আঙিনার কথাবার্তা। খোদাবক্স বলছিলেন—একলা হাতে ভাবি আর কুনদিক সামাল দিব্যান।
খালেদা ভারী দেহে কাঁপন তোলেন। মাথার ঘোমটা টেনে নেন খানিক। বলেন —তা আর বুঝে কে! বউটার রোগ হওয়া ইস্তক বিশ্রাম নাই আর।
খোদাবক্স মাথা নাড়েন। কথা গুছোন মনে মনে। মহম্মদ আলি বলেন—হ্যাঁ। বয়স হয়েছে আপনার ভাবির। এখন আর সংসার সামাল দিতে পারে না। বয়সকালে একা হাতে করেছে তো সব। তার স্বাস্থ্য আকবরের বিবির মতো এমন নাজুক, এমন ভাঙা-ভাঙা ছিল না।
প্রশংসায় খুশি হয়ে ওঠেন খালেদা। দৃপ্ত পা ফেলে হেঁসেলে যান। খুশি গলায় হাঁকেন চা খাবেননি?
–করো। তা করো। স্যাঙাত এসেছেন।
আকাশের তারার আলোয় ভরা উঠোনে দু’-একটা জোনাকি বাড়তি আলোক দিয়ে যায়। মহম্মদ আলির শ্বাসটানা ভারী আওয়াজ উঠোনময় ঘোরে। খালেদা হাঁসফাঁস করতে করতে চায়ের আয়োজন করেন। মোবারক আলিকেও একটু সাধতে হয়। কারণ কাজ-কাম করছে সে। লায়েক হয়েছে। খালেদা হাঁকেন-ও মোবারক! বাপ আমার! চা খাবিনি একটু!
—খাব।
জবাব দেয় সে। তার পা নেচে ওঠে আরও দ্রুত ছন্দে। এই তো, এই তো, গুরুত্ব পাচ্ছে সে। গুরুত্ব পাচ্ছে। সে তো জানতই হবে এমন। তার টাকা রোজগারের সম্ভাবনা দেখা দিতেই পাল্টে যাচ্ছে দুনিয়া। বেশ বেশ বেশ। সে সোল্লাসে গুনগুনিয়ে গান ধরে। সুরে-বেসুরে বেরিয়ে আসে উদ্ভট আওয়াজ—গজব কা ইয়ে দিন সোচো জারা, এ দিওয়ানাপন….
খোদাবক্স বলেন তখন—ভয়ে বলি, না নিৰ্ভয়ে?
মহম্মদ আলি বলেন —ভয়ের কী স্যাঙাত? বলেন যা প্রাণে চায়।
স্তিমিত চোখের কোণে জমে থাকা পিচুটি নখের কোণে তুলে নেন মহম্মদ আলি। মুছে ফেলেন লুঙ্গিতে। পাকঘর হতে চায়ের বাস আসে। খোদাবক্স বলেন—আপনাগোর ঘরে এখন একজনা জুয়ান মাইয়ার দরকার।
—তা লাগে।
মত দেন মহম্মদ আলি। খোদাবক্স ফস করে বলে বসেন— আমার মাইয়াডারে নিকা বসাইয়া দেন আপনের পোলার লগে।
মহম্মদ আলি তাকান খোদাবক্সের দিকে। ক’বার কেশে গলা সাফ করে বলেন-আমার ছোট ছেলেটি, সে তো কাজ-কাম করে না কিছু। তার সঙ্গে কারও বিয়ে হয় কী প্রকারে? কোন ভালমানুষের বেটির সর্বনাশ করব আমি? হ্যাঁ, ঢুকেছে বটে সে একটা কাজে। কিন্তু তার কি কোনও ভরসা আছে? কাজ তো ওই। রাস্তা বানানো হয়ে গেলেই বেকার নিকম্মা ফের বেকার হয়ে যাবে।
মহম্মদ আলির কথা শুনে গান থেমে গেল মোবারক আলির। একটু আগেই ফুলে-ফেঁপে ওঠা আত্মপ্রসাদ চুপসে গেল এক নিমেষে। পা নাচানো থামিয়ে সে উৎকর্ণ হল। গায়ে এক চিড়বিড়ানি ভাব। সেকি গরমে, না মহম্মদ আলির মন্তব্য শুনে, সে ঠাহর পেল না। এ দিকটা সে ভেবে দেখেনি। রাস্তার ঠিকেদারি, তারপর পাড় বাঁধাবার ঠিকেদারি, এই অবধি অনির্বাণের সৌজন্যে সে উপার্জনক্ষম থাকল। তারপর? সত্যিই কি আবার বেকার হয়ে যাবে? নাকি অনির্বাণ নিজের কোনও কাজে লাগিয়ে দেবে তাকে! সে এক মুহূর্তে স্থির করে, ভোট এলে খুব খাটবে এবার সুকুমার পোদ্দারের জন্য। লোকে বলবে বটে রঙ বদলানো গিরগিটি। তা বলুক, যাক। বাপ-বেটা দু’জনকেই খুশি রাখতে পারলে আর ভাবনা থাকবে না কিছু। সংশয় কাটিয়ে খোদাবক্সের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকল সে।
খোদাবক্স বলছেন—ছোট ছেলে নয়। আমার মানে, কী বলব, পছন্দ আপনার বড় ছেলেটিকে। মরদের মতো মরদ সে। কী শক্তি, কী গর্ব, কী ক্ষমতা! জোয়ান ছেলে আপনার। তার বিবি অমন রোগাভোগা হলে চলে কী প্রকারে? আপনাদের তা ভাবা উচিত।
মহম্মদ আলি বলেন—কথা ঠিক। তবে…
—তবে আর কী! স্যাঙাত, মেয়ে আমার কোঁয়ারি নয়। বিয়ে বসেছিল সে ষোলোতেই। দুঃখের কথা কইব কী! সীমান্ত পেরিয়ে আসার সময় এক পুলিশের নজরে পড়ে গেল মেয়ে আমার। প্রায় একরকম জোর করেই বিয়ে করল মেয়েটাকে। বয়সে মায়মুনার প্রায় দ্বিগুণ। বছর খানেক না যেতে তালাক দিয়ে দিল।
—কেন? তালাক দিল কেন?
খালেদা এসেছেন চা নিয়ে। শুধোচ্ছেন প্রশ্ন। মায়মুনা তাঁর পছন্দের মেয়ে। স্বাস্থ্য ভাল মেয়েটার। আচার-গতিকও ভাল। তালাক পাবার কথা তো ছিল না মেয়ের। খোদাবক্স, দাড়িতে আঙুল চালিয়ে দেন। বলেন—আপনাদের কাছে লুকোবার নেই কিছু। সন্দেহবাতিক ছিল লোকটার। নিজে তো সারাদিন থাকতে পারত না। বর্ডারের ডিউটি থেকে বাড়িতে আসত মাসে দু’মাসে। নিজেরই বড় ছেলে, ওই আপনার ছেলেরই মতো বয়স, তার সঙ্গে সন্দেহ করত। মারধোর করত। ঘরে আটকে রাখত। দিনের পর দিন খেতে দিত না। অত্যাচার চরমে উঠলে মায়মুনা খবর দিল আমাকে। আমি গেলাম। মায়মুনা আমার পায়ে পড়ল। কেঁদে বলল, ‘আব্বা, আমারে নিয়ে চলো। মরে যাব আমি এখানে থাকলে।’তা আমি নিয়ে আসতে চাইলাম। বুড়ো শকুন আমাদের ভয় দেখাল। বলে, ‘বর্ডার দিয়ে পালিয়ে এসেছ তোমরা। তোমাদের ধরিয়ে দেব।’ কী করব কিছু বুঝি না। লোকে বলল, ‘পঞ্চায়েতে যাও। খুলে বলো সব কথা। ‘ গেলাম পঞ্চায়েতে। বললাম সব। প্রধানের নির্দেশে পার্টিতে হাজার টাকা চাঁদা দিতে হল। সালিশি বসিয়ে বুড়োকে তালাক দিতে বাধ্য করল ওরা। বলল, ‘তালাক না দিলে তোমার নামে নালিশ করব। তুমি বর্ডারে পয়সা নিয়ে লোক পারাপার করাও।’ কাজ হল। মেয়ে আমার ঘরে ফিরে এল। কী করব! গরিব মানুষ আমরা। কত না বিপদ। খোদা মারেন যখন, সবদিকে মারেন।
অপলক চোখে চেয়েছিলেন খালেদা আর মহম্মদ আলি। শুনছিলেন মায়মুনার কথা। আহা! ফুলের মতো মেয়েটা। কষ্ট পেয়েছে কতই না। খালেদার আপত্তি নেই এই মেয়েকে ঘরে নিতে। তবে কথা হল, আকবর আলি মত করবে কি না। সংসারে এখন একটি বাড়তি পেট আনা কি সম্ভব? তবে হ্যাঁ। বিড়ি বাঁধার কাজটা শিখিয়ে নিতে পারলে শেষ পর্যন্ত আয় দেবে ওই মেয়ে।
হিসেবগুলি খালেদার মাথায় চলে। মহম্মদ আলিরও। তাঁরা ভাবতে থাকেন। আর ঘর হতে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় মোবারক আলি। দুঃখিত তার মন। বিভ্রান্ত তার বুদ্ধি। এঁরা এখনও তাকে বিয়ের কাবিল মনে করে না। অথচ এখন সে এক যোগ্য পুরুষ তো বটে। তার কাজের বা উপার্জনের নিশ্চয়তা নেই। আকবর আলিরই কি আছে? এই শুখা মরশুমে তার হাত খালি যাচ্ছে না? শালা হারামি, কঞ্জুস, খরচ হবে ভয়ে বিবির চিকিচ্ছে করায় না।
মায়মুনা মেয়েটিকে ভাল লেগেছিল তার। সে অন্ধকার পথে চলে। ঠোক্কর খায় ইটে পাথরে, আর ভাবে। মায়মুনার নিগৃহীত জীবনের কথা ভেবে দুঃখ বোধ করে। সে বুঝি-বা এক ভালবাসাই টের পায় নিজের বুকের ভেতর ওই মায়মুনা মেয়েটির প্রতি। হায়! সে বুঝি আকবর আলিরই বিবি হবে শেষ পর্যন্ত। কী এক কষ্ট তাকে আচ্ছন্ন করে দেয়। এমন কষ্ট সে পায়নি ইতিপূর্বে। তার বুক টনটন করে। সমস্ত কোষে, পেশিতে, অস্থিপঞ্জরে তা ছড়িয়ে যায়। পেয়ার-মহব্বৎ ইশারা হয়ে দেখা দেয় তার জীবনে। সহসা এক দৃশ্যের কথা তার মনে পড়ে যায়। সে-দৃশ্যে ফুটে ওঠে অনির্বাণ আর তুলতুলি। তাদের ঘনিষ্ঠতার স্মৃতি মোহিত করে দেয় ধান্দাবাজ, কামচোর, স্বার্থপর মোবারক আলিকে। তার জানতে ইচ্ছে হয়, তুলতুলি মরে গেল কেন! আত্মহত্যা করল কেন! কোন বেদনায়। সে-বেদনা মোবারক আলির ধরা-ছোঁয়ার অল্প দুরে বসে রইল নীরবে। মোবারক আলি দুঃখের ভিতর থাকতে থাকতে ক্রুদ্ধ হল, ক্রোধের গনগনে আঁচে গড়ে তুলল প্রতিহিংসা। এর শোধ তুলবে সে। তুলবেই। ওই কোলের ছেলে, আকবর আলি, ওই সংসারের একমাত্র চিরাগ, আকবর আলি, তাকে দেখে নেবে এক হাত। এরা তার কেউ নয়। কেউ নয়। এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে যারা, এমন দুর-দুর ছাই-ছাই, যেন মোবারক আলি এক মানুষই নয় মোটে, গাঁয়ের বেওয়ারিশ কুকুরই একজন, এমন যাদের মনোভাব তার প্রতি, তারা আপন নয়। কখনও নয়। এ সবই হল সাজানো। আপনার আপনার কিছু নয়, জগৎ কেবল মায়াময়। গাঢ়, দুরন্ত অভিমান বিষ হয়ে ওঠে তার মনে। দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে এগোয় সে। আর ভাবে, টাকার কথা। টাকা টাকা টাকা। এ দুনিয়া টাকার বশ। নিন্দাপবাদ ও প্রত্যাখ্যানের জ্বালা তার শিরা-উপশিরায় নিঃশব্দে প্রবাহিত হয়। সে স্থির করে, নিজের এ কষ্টের কথা বলবে না কারওকে। বলবে না। সে নিজেই স্থির করে নেবে তার জীবন। নেবে। কেন নয়?
তার ভাবনার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অনাগ্রহী তার পিতামাতা রোজগেরে বড় ছেলের বিষয়ে ভাবেন তখন। মহম্মদ আলি তাঁর কাশি সামলে বলেন—কিন্তু আমাদের পক্ষে তো এখন খরচ-খরচা কিছু করা সম্ভব না। বুঝতেই তো পারেন। এই অনাবৃষ্টির বর্ষ। ঘরে ওই বেরোজগেরে ছেলে। রুগ্ণ বউ।
খোদাবক্স হাঁ-হাঁ করে ওঠেন। বলেন—কিছু না, কিছু না। আপনাদের খরচ করার প্রশ্নই ওঠে না। আকবর আলি আমার দামাদ হলে খুশিতে তাকে হাজার পাঁচেক দেব আমি। এ আমার শেষ সম্বল। মেয়েকে সুখী দেখতে এটুকু আমি দেব। আমরা হলাম জেলে। পাল্টিঘরে বিয়ে না হলে মেয়ের সুখ আসে না। আপনারা রাজি হয়ে যান। কথায় বলে—
জেলের মাইয়া শোয়
মাছের চুবড়ি আইন্যা বেটি
মাথার কাসে থোয়
মহম্মদ আলি বলেন—ভেবে দেখি। ছেলের সঙ্গেও কথা বলতে হবে।
—তা তো ঠিকই। বলেন। আমি আসব আবার দু’দিন বাদে।
খোদাবক্স উঠে পড়েন। আকবর আলির ছেলেমেয়েগুলি ঘরে কলরব করছে। শিশুসন্তান বুকে আগলে নেতিয়ে পড়ে আছে আফসানা। খালেদা এসে স্বামীর মুখোমুখি বসলেন। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন—
কনের মায় কনে বাখনায়
আমার মেয়েটি ভাল।
ধান সিজানো হাঁড়ির চেয়ে
একটু কিছু কালো ॥
—কী বলো?
জিগ্যেস করলেন মহম্মদ আলি। খালেদা বলেন—এই বলি যে মেয়ে তো দোষযুক্ত। তাই না বাপের এত জোরাজুরি! তালাকের ইতিহাস শুনলে লোকে ওই মেয়ে আর ঘরে নেবে? প্রথমেই ভাববে সতীনপোর সঙ্গে আশনাই সত্যি ছিল। কাঁচা বয়সের মেয়ের কি আর বুড়োয় মন লাগে? কথায় বলে—
যুবতীর কোল
শিঙ্গিমাছের ঝোল।
বুড়ার পাতে পথ্যি দিলাম
তাইতেও অম্বল ॥
—তুমিও কি তাই মনে করো নাকি?
—কীসের?
—মেয়ের দোষ আছে।
—না না। মায়মুনা মেয়ে ভাল। সে আমি দেখেই বুঝেছি। তবে এত কথা বলি অন্য কারণে।
—কী?
—চাপ দাও। আরও দু’-তিন হাজার বাড়বে।
—হুঁ। আমিও ভাবছিলাম। নিজে থেকেই যদি পাঁচ দেয় তবে চাপ দিলে আরও তিন দেবে না কেন? ভিটে বেচে শুঁটকি কোম্পানির হতে লোকটা কামিয়েছিল ভাল। তবে আমাদের তো খরচ বাড়বে। একটা গোটা মানুষের খোরাকি।
—খোরাকির ভাবনা কোরো না। সে আমি বিড়ি বাঁধা শিখিয়ে নেব। কথায় বলে—
কাঠের ভেতর পিঁপড়ে বলে—
চিনি নইলে খাবুনি।
চিন্তামণি চিন্তা ক’রে
জোগান তারে আপুনি
জোয়ান ছেলেটার কথাও তো ভাবতে হয়। আফসানা বিছানায় পড়া ইস্তক কেমন মন-মরা হয়ে থাকে। তা আফসানা কষ্ট পাবে ঠিকই। কিন্তু আমিও যে আর একলা পারি না।
—তা ঠিক। দেখি ছেলের সঙ্গে কথা বলি আগে।
তাঁদের কথার মধ্যেই ঢুকে পড়ে আকবর আলি। খেয়ে-দেয়ে নৌকা ভাসানোর প্রস্তুতি নেবে সে। ফিরতে ফিরতে হয়তো রাত্রি একটা-দু’টো বাজবে। তাকে দেখে মহম্মদ আলি ডাকেন। সে এসে বসে বাপ-মায়ের কাছে। সাংসারিক কোনও জরুরি বিষয়, এমনই প্রত্যাশা করে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মহম্মদ আলি বলেন খোদাবক্সের প্রস্তাবের কথা। অনায়াস আপত্তি উঠে আসে তার মুখে। সে কেবল বলতে যায় তার আপত্তির কথাই না, বলতে যায় এসব ভাবার মতো মনের অবস্থা নেই তার। কিন্তু মহম্মদ আলি তাকে থামিয়ে দেন। খুলে বলেন টাকা-পয়সা ইত্যাদির কথা। খালেদা বলেন বিড়ি বেঁধে উপার্জনের সম্ভাবনার কথা। আকবর আলি তখন থমকায়। সকল প্রস্তাব, সকল সম্ভাবনার ওপর দিয়ে তার না-কে বৃহৎ করে তুলতে পারে না। চারপাশে ঝিম ধরে আসে রাত্রি। সে সম্পূর্ণ অভিনব অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব মস্তিষ্কে ধরে মধ্যরাত্রির জোয়ারে নৌকা ভাসায়। ইসমাইলকে দেখে তার মনে পড়ে ইসমাইলের বোন মায়মুনার কথা। সারাক্ষণ অন্যমনস্ক জাল ফেলে সে। এবং তার অন্যমনস্কতার সুযোগে সকল মাছ জালের ফাঁক দিয়ে পলায়ন করে। গভীর রহস্যময় মৎস্য সব, তারা টের পেয়ে যায় আকবর আলির হৃদয়ে তুফান। ঘণ্টা তিনেক কসরত করে শূন্য জাল হাতে করে ফেরে তিনজনা। তিনজনের ব্যর্থতাজড়িত প্রলম্বিত শ্বাস ভাদরের শুষ্ক বায়ুতে মিশে যায়। ক্ষয়যুক্ত মাটি চাকলা-চাকলা খসে পড়ে জলে। নদী চুপিসাড়ে এগিয়ে আসে এক-পা এক-পা করে। অনাবৃষ্টিতাড়িত চতুষ্কোনার মানুষ পেটে খিদে নিয়ে, মুখে আশ্বাস নিয়ে, বুকভর্তি আতঙ্ক নিয়ে ঘুমোয়।
কেবল আকবর আলি এক ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। তার ঘুম আসে না। আর ঘুম এল না বলে যাবতীয় ভাবনা-চিন্তা তাকে ঘিরে ধরল। এই মৎস্যবিহীন বৃষ্টির আকালেও আব্বাজানের কথা, মায়ের কথা সে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। পরিস্থিতি বিচার-বিবেচনা করে দেখতে থাকল। একা সংসার টানতে খালেদার কষ্ট হয় একথা অস্বীকার করতে পারল না সে। সকলের রান্না করে, রুগি সামলে, ঘর পরিষ্কার করে, ছেলেমেয়েদের আগলে রাখা—এক অসম্ভব কাজ। একাদিক্রমে প্রতিটি সমাধান-সম্ভাবনাই তাকে ঠেলে দিল ইতিবাচক উত্তরের দিকে। গরম ঘরের মধ্যে আদুল শুয়ে থাকা আকবর আলির পায়ে এসে লাগল শুখা ভাদরের হাওয়া। সেই হাওয়ায় শিউলির গন্ধ। এমন অনাবৃষ্টিতেও শিউলির তিক্ত শাখা ও পত্রাবলীর মধ্যে শিউলি ফুলের ফুটে ওঠা ইঙ্গিত এনেছে শরতের। কিন্তু এই গন্ধ আকবর আলির ঘ্রাণে পৌঁছোল আফসানার খুসবু হয়ে। আফসানার বুকে, বাহুমূলে, নাভিতে, নাভির নীচেকার নরম ঘন অন্ধকারে সে যে কতদিন পেয়েছে এই গন্ধই। এতটুকু শব্দ যাতে বাইরে না পৌঁছোয় তারই প্রয়াসে তাদের নীরব যৌথ ছটফটানি কী পরম সুখের!
সে ভাবল। ভাবতেই থাকল। হৃদয় উদ্বেল হল তার। হৃদয় হতে ধমনী বয়ে কোষে কোষে চলে গেল উষ্ণ রক্তের স্রোত। কোনও প্রতিকূলতা, কোনও দারিদ্র, কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য, অর্ধ ভোজনের পীড়া বা যন্ত্রণা, অনাবৃষ্টি বা জীবনের অনিশ্চয়তার কোনও দৌরাত্ম্য এই স্রোতের প্রতিবন্ধক হতে পারে না। মানুষকে সজীব রাখে এই স্রোত, গতিশীল রাখে সকল বন্ধুর পথে রক্তাক্ত ক্ষতময় তবু।
অতএব, আকবর আলি সে, তার কী এক আকাঙ্ক্ষায় দেহ প্রবল হল। দেহবোধ হল উন্মাদ। কোনও কিছু জড়িয়ে জাপটিয়ে ধরতে চাইল শরীর। কতদিন উপোসি শরীর! সে শয্যার এ পাশে এল। ফের গেল ওই পাশে। খামচে ধরল চুল। বালিশ আঁকড়ে নিল বুকে। এক আশ্চর্য কঠিন ব্যথা বুক হতে নেমে এল লুঙ্গির গিঁটের তলে। আরও আরও নেমে এল। স্থিত হল লিঙ্গভাগে। সুঠাম লিঙ্গটিকে উত্থিত করে দিল। এক নরম পিচ্ছিল যোনিপথের তরে হাহাকার উঠে এল সে-উত্থানে। সে এক উন্মাদপ্রায় উঠে এল শয্যা হতে। নিঃশব্দ পায়ে চলতে থাকল।
মহম্মদ আলির ঘরের সামনে একফালি জায়গায় শুয়ে আছে মোবারক আলি। তার পাশ দিয়ে, উদ্দাম যৌন অভিলাষে, হেঁটে এল সে। দাঁড়াল ছোট অপরিসর ঘরের দরোজায়। অন্ধকারে অভ্যস্ত চোখে দেখে নিল অবস্থান। ঘুমন্ত আফসানার শাড়ি তুলল এক ঝটকায়। আফসানা শব্দ করল—আঁ।
আকবর আলি চাপা গলায় বলল—চুপ! আমি!
গোঙানির মতো শব্দ করল আফসানা। আকবর আলি টের পেল আফসানার শরীর গরম। জ্বরতপ্ত। দয়া এল না তার। নিবৃত্তি এল না। মনে পড়ল না তার প্রকাশ বলেছিল, হতে পারে আফসানার কোনও বিশ্রী ক্ষয়রোগ। সে একটানে সবল দুই হাতে পা দুটি ভাঁজ করে দিল। এক টানে করে নিল প্রবেশ-পরিসর, যেন দরোজার পাল্লা হাট খুলে দেওয়া। আফসানা রোগা হাতে আকবর আলির বুকে ধাক্কা মারল। আকবর আলি শক্ত হাঁটুতে চেপে ধরল আফসানার পেট। আফসানার রোগা দুর্বল দেহে পাকিয়ে উঠল অন্ধকার। সেই অন্ধকার তার মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করে দিল। আকবর আলি কঠিন আঙুলে খাবলে ধরল তার নিস্তেজ স্মৃতির মতো স্তন। লিঙ্গ প্রবেশের মুখে আছে রক্তাক্ত কাপড়ের বাধা। এক হাতে ঠেলে সরিয়ে প্রবেশ করল সে। সমস্ত শক্তি দিয়ে দ্রুত দ্রুত দ্রুত গমন করল। আফসানার অস্থিগুলি তার দেহচাপে মড়মড় শব্দ করল। দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে অর্ধচেতনে শুয়ে আছে আফসানা। টের পেল আকবর আলি। সারা দেহ স্বেদসিক্ত করে প্রক্রিয়ার উত্তুঙ্গে পৌঁছে সে হাঁপাতে হাঁপাতে থামল যখন, টের পেল ভেজা- ভেজা গরম। তার দেহে লেগে আছে। লুঙ্গিতে লেগে আছে। সে ভয় পেল। রক্ত! এত রক্ত! আঙুলে নিল সে ওই গরম সিক্ততা। শুঁকল। মূত্রের কটু গন্ধ লাগল নাকে। এতক্ষণে ঘোর কাটল তার। বুঝল সে, জ্বরের আচ্ছন্ন ঘোরে, যন্ত্রণায়, প্রস্রাব করেছে আফসানা। করে ফেলেছে। এতক্ষণে মনে পড়ল তার, হতে পারে আফসানা যক্ষ্মার রোগী। এবং যক্ষ্মা সংক্রামক। গা গুলিয়ে উঠল তার। সারা শরীর কাঁপতে থাকল। আফসানাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। আফসানা কঁকিয়ে উঠল—আঁ! আঁ!
ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠল শিশুটি। খোলাবুকে পড়ে থাকা আফসানা কোনও মতে পাশ ফিরল। শুকনো, নিষ্পেষিত দুধের উৎস এক নরম বৃত্ত শিশুর ঠোঁটে স্পর্শ করানো মাত্র চুপ করে গেল সে। আকবর আলি টলতে টলতে ফিরে এল ঘরে। স্ত্রীকে পরিচর্যা করার কথা ভাবল না। উন্মত্ত কামনার নিবৃত্তিজনিত সুখের কথা ভাবল না। হাতড়ে হাতড়ে একখানা গামছা নিয়ে উঠোনে রাখা জলের বালতি হতে জল ঢালতে লাগল গায়ে। তলানিটুকুও নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত থামল না।
জলের শব্দে, বালতির শব্দে আলগা ঘুম ফেলে উঠে এলেন মহম্মদ আলি। প্রায় চারটে বাজে। এই তাঁর ওঠার সময়। বললেন—এত রাতে স্নান করিস কেন?
—গরম লাগে।
সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে ঘরে চলে গেল আকবর আলি। বিছানায় চিত শুয়ে যায়মুনাকে নিকে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে।