৮৯
আসিবে আসিবে কন্যা
আশ্বিনের এই ছিল বাসনা।
আসিল সে বসিল সে
সকল কথা বলিয়া গেল কই?
চোখের জলে ভাসিল দেশ
উমার মুখে চাহিতে পারি না।
বিদায় বিদায় বুক ফেটে যায়
শূন্য ঘরে একলা বসে রই।
.
কমরি বিলের পাশে গোমুণ্ডি গ্রাম। এ গ্রামেই রাত্রিবাস করছে তারা আজ। এ গ্রামেরই প্রান্তে জীবনের শেষটুকু ঢেলেছিল ময়না বৈষ্ণবী।
এই শেষ আশ্বিনের রাত্রি, এখনই আকাশ ঢালছে কিছু হিম। গভীর রাত্তিরে এই হিম কিছু-বা শীতার্ত করে তুলবে দেহ।
কালান্তর নিম্ন-জলাভূমি অঞ্চল। বহু পূর্বে গঙ্গা এই পথেই বয়ে যেত সাগরের দিকে। সরে যেতে যেতে গঙ্গার মরা সোঁতা স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়েছে বিলে। কিন্তু নদীর সেই স্রোতধর্ম, সিক্ততা সেই, আজও এ অঞ্চলের মৃত্তিকা আঁকড়ে আছে। তাই হিম তীব্র এ অঞ্চলসমূহে।
নিজামত আলির ছোট কুটিরের সামনে বসেছিল তারা। অনাবৃষ্টির খটখটে মাটি। বিলের কদমময় জল ঘন, কালো, ভারী। অপেয় এই জল। অস্বাস্থ্যকর। তবু এ গ্রামের এই-ই সম্বল। জলের ওপরে পড়া সর সরিয়ে সরিয়ে লোকে কলসিতে জল ভরে আনে। কেন না এ গ্রামে একটিও নলকূপ নেই। এই গ্রামে নেই, বাঘানে নেই। কলাবিবিতে নেই। সোনাটিকুরিতে নেই। এ নিয়ে তাদের কোনও অভিযোগও নেই। কার কাছে অভিযোগ? কোথায়?
তারা পান করে কালোজল। শঙ্কাহীন পান করে। আর জল, সে তো ওই বিলের জল সকলই গঙ্গার অংশ! তাতে প্রাণ সমর্পিত থাকে। বিলে প্রসারিত থাকলে যে কালিবর্ণ, তা কলসিতে উঠলে দিব্য স্বচ্ছতা। তারা ভরসা করে। ওই জলেই ভরসা করে। রোগজীবাণুসমেত জলে তৃষ্ণা মেটায় এবং মরে। মরতে মরতে আবার বেঁচেও যায়! একেই তো বলে জীবন। এই মরতে মরতে বেঁচে যাবার আশীর্বাদ—এই প্রাপ্তিই হে জীবন, হে জীবন, হে সুন্দর!
সমস্ত গ্রাম এই চরম দারিদ্রকে ঈশ্বরের প্রদত্ত শাস্তি বলে মানে। এই চরম অবহেলাকে খোদাতালার ইচ্ছা বলে মানে। অভিযোগ নিয়ে তারা কার কাছে যাবে?
সম্বৎসর দু’মুঠো অন্ন জোগাড়ে দিন যায়। বর্ষা এলে সকলি ভেসে যায় জলে। এই বাঁশের বেড়ার ঘর ও বসতি গুটিয়ে, সামান্য সম্বল থালা-বাটি আগলিয়ে যে-যার উঠে পড়ে ডিঙিনৌকায়। কবেকার নৌকা সব। বানিয়েও নেয় তারা কলাবিবির বন হতে কাঠ-কুটো কেটে। বড় নদীর বড় স্রোতে সে নৌকা তাল পায় না। বর্ষায় জলঙ্গী হতে উপচানো জল, ভাগীরথী হতে উথলানো জল বুকে ধরে ভরে ওঠে বিলগুলি আর তারও চেয়ে বেশি জল হলে ভেসে যাওয়া গ্রামে ডিঙিনৌকায় বাঁচে তারা জোর। এক-একটি নৌকায় দু’ঘর-তিনঘর। ভাসে। ভেসে যায় একটুকু ডাঙার সন্ধানে।
ওইসব ডিঙিনৌকা হতে কতদিন কতজনার সন্তান পড়ে গেছে জলে। কিংবা পলকা সে নৌকা ডুবে গেছে সংসারের ভারী চাপে সংসার সমেত। আর নৌকা—সেও সকলের আছে কই। সারা গ্রামে দু’চারখান। তাই নিয়ে ভেসে যাওয়া দূরে-দূরান্তরে। অথবা মাথায় নিয়ে সংসারের বস্তুগুলি, তারা যায় রেলপথের দিকে। এমনকী ঝুড়িতে চাপিয়ে সদ্যোজাত শিশু, তারা জল ভেঙে ভেঙে হাঁটে। আঃ! বর্ষা নেমেছে! ওঃ! বর্ষা কেটে গেলে আবার শুকনো জীবনে ফেরা! ক’টা দিন, বর্ষার এ ক’টা দিন জিইয়ে রাখো ঠাকুর! খোদাতালা। তোমারই কৃপা সব!
এমন সব কামনা সমেত তারা হাঁটে। হেঁটে যায় কখনও সড়কপথের দিকে। জল কম হলে সড়কের ধারে ধারে অস্থায়ী বসবাস করে। পাকা সড়ক ধরে চলে যায় গঞ্জে শহরে। জীবনধর্মে ভিক্ষা মেগে খায়। কিংবা চুরি করে। যা পায় হাতের কাছে, চুরি করে। চুরির বস্তু বেচে দু’টি পয়সা পেলে চাল কিনে খায়। খায়। শুধু খায়। আহার্যের সন্ধানে চোখ খোলা, বন্ধ করা চোখ। কী-ই বা তারা করে! প্রাণধারণের জৈবিক আগ্রহবশে আর কোনও ধর্ম নাই।
জল আরও বেশি হলে পাকা সড়কও ডুবে যায়। তখন তারা রেলের লাইন ধরে চলে। মাথায় বোঝা নিয়ে, কোলে শিশু নিয়ে, চলে সারি সারি। লাইনের নীচে পেতে রাখা পাটাতনে পা দিয়ে দিয়ে চলে যায় ইস্টিশন তক। খোলা প্ল্যাটফর্মে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলে যায় দিন। অনাহারে-অর্ধাহারে রুগ্ণদেহ তারা। রোগ দেহ। এভাবেই কাটিয়ে দেয় বর্ষার অতিরিক্ত জলের নির্বাসন।
বর্ষণ পরিমিত হলে তবু গ্রামে থাকা যায়। হাঁটুজলে থাকা যায়। তারই মধ্যে তারা চাষ করে ধান। সে হল সৌভাগ্যের বৎসর। গ্রামে থাকতে পারার, ধান্যসম্ভার গড়ে তুলতে পারার সৌভাগ্যের বৎসর। কোন বৎসর কেমন যাবে তার নিশ্চয়তা কী-ই বা! জানে না কেউ, আগামী বৎসর ভয়ংকর হয়ে উঠবে কি না। আশীর্বাদক হয়ে উঠবে কি না।
সড়কের ধারে ধারে, কিংবা রেলের ইস্টিশনে তাদের কাটে যে দিন, রোগক্লিষ্ট, অনিশ্চিত, অনাহারী সেই সকল দিনে আছে আরও এক সম্ভাবনা। হারিয়ে যায় শিশু। হারিয়ে যায় কিশোরী ও বালিকা মেয়েরা। এমনকী শিশুরাও হারায় মেয়েজন্ম নিলে। কখন কোথায় তারা লুপ্ত হয়ে যায়, জানে না কেউ, দেখে না। মেয়ের মা বুক চাপড়ে কাঁদে। মেয়ের বাপ গুম হয়ে বসে থাকে। অতঃপর কিছুকাল দুইবেলা ভাত ফোটে তাদের ছাউনিতে। রঙিন ব্লাউজ, ধপধপে সাদা গেঞ্জি ওঠে মা-বাপের গায়ে। কারও শোকে কোল পেতে দেয় না কেউ। কারও এ বৈভবে কেউ কৌতূহলী প্রশ্নও করে না। কারণ, তারা সকলেই জানে এ সত্য, নারীজন্ম, মেয়েজন্ম, মূলধন হয়ে ওঠে দরিদ্রের ঘরে। এমনকী রাত্তির গভীর হলে স্ত্রী-ধন বিক্রয় হতে থাকে। সড়ক ও ইস্টিশনের জীবন-যাপনে কামুক পুরুষ এসে শুরু করে লুঠতরাজ। অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করে যায় নারীদেহ। অনাহারী, অর্ধাহারী, বহুপ্রসবী ইত্যাকার হাড় কাঁকলাস দেহেও উপগামী পুরুষ রেখে যায় দু’টাকা-পাঁচটাকা। তা বেশ। তা বেশ এ বেশ্যাবৃত্তি। বেশ্যাবৃত্তি পৃথিবীতে শাশ্বত উপার্জনের পথ।
মরশুমি গৃহস্থ সব। মরশুমি পথবাসী। মরশুমি পিতা-মাতা, মরশুমি মানব-ব্যবসায়ী। মরশুমি গৃহবধূ, মরশুমি দেহোপজীবিনী!
.
বৃদ্ধ নিজামত আলি, তাঁর খোলা চোখ, সে-চোখে বুঝি-বা বয়সের পরদা পড়ে আছে। তিনি বিড়িতে টান দিয়ে আগুন স্ফুরিত করে বলেন—অর্ধেক অসৎ বাঁচি বাবু, অর্ধেক সৎ। আপনাদের নিকটে কী লুকাব! আপনেরা ভাল করতে এসেছেন। ভোটের সময় টাকা দিয়ে খাওয়া দিয়ে লোক ধরে নিয়ে যায়। এ ছাড়া কে কবে আমাদের জীবনের কথা শুনবে বলে এসেছে! আপনেরা এসেছেন। ভাল করতে এসেছেন। আপনদের সব বলি। অর্ধেক সৎ বাঁচি আমরা, অর্ধেক অসৎ। গ্রামে থাকলে, গেরস্তি করলে, আমাদের ন্যায়-নীতিবোধে কোনও কমতি নাই। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে বেরুলেই আমাদের বুকের খাঁচা খুলে সকল ভাল উড়ে যায়। পাখা মেলে উড়ে যায়। আমরা তার নাগালও পাই না। যেই গ্রামে ফিরি, তারা পোষা পাখিটির মতো উড়ে এসে আপনি ধরা দেয়। হাড়-পাঁজরের দাঁড়ে বসে মুখ ঘষে। তখন বিবি-মেয়ে কেউ বেচাল হয় না বাবু, হায়া রাখে। চুরি-চামারির কথা ভাবেও না কেউ। সব শিশু বুকে চেপে খেলা দেয় বাপ। কিন্তু দেখেন, এইবেলা কী করি! এই অনাবৃষ্টির বেলা! জলাভাবে ফসল ফলল না। নদীতে-বিলে মিলে না মাছ। গ্রাম ছেড়ে ভিক্ষায় যায় সকলে। বেলা পড়লে গ্রামে ফিরে আসে। এখন, ওই ন্যায়-নীতির পক্ষীটি বড় দিশেহারা বাবু।
তৌফিক সরল প্রশ্ন করেছিল —আপনারা বলছিলেন মেয়েরা হারিয়ে যায়। কোথায় হারিয়ে যায়? খোঁজেন না আপনারা?
—খুঁজলে কি আর পাওয়া যায়? যা হারিয়ে যায় তা কি আর ফেরে?
বৃদ্ধ নিজামত আলির স্বরে ব্যথার আভাস ফোটে। তৌফিক ঘন বিস্ময়ে স্ফুরিত থাকে তবু। ব্যথিতের আবেগ তার স্বরকে প্রকম্পিত করে দেয়। সে বলে—কত মেয়ে হারিয়েছে?
—তা প্রতি ঘরেই কোনও না কোনও মেয়ে। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন ঘরের বাসিন্দে আমরা। তা ধরেন না কেন, শতখানেক মেয়ে।
—কারওকে পাওয়া যায়নি? একজনকেও নয়?
—না।
তৌফিক স্তব্ধ বসে থাকে। এই মুহূর্তে যে-আঘাত সে পেয়েছে তা উপলব্ধি করে, তার জন্য কষ্ট পায় সিদ্ধার্থ। অজ্ঞতার আশিস হতে বঞ্চিত হচ্ছে তৌফিক। এমন নয়, জগদ্বিষয়ে তৌফিক সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। ইদানীং মোল্লাগেড়ের বস্তিতে বসবাস তাকে করে তুলছে নানা অভিজ্ঞতায় ধনী। তবু এক অভিজ্ঞতার পাশাপাশি এক অনভিজ্ঞতাও থেকে যায়। তেমনই তৌফিকের।
সিদ্ধার্থ জানে, ওইসব কন্যাশিশু, ওইসব বালিকা ও কিশোরীরা বিক্রি হয়ে যায়। তাদের কেনার জন্য নিরন্তর ঘোরে-ফেরে দালাল চতুর। তৌফিক এ বৃত্তান্ত জানে না এমন নয়। কিন্তু সে জানা ও এ জানায় তফাত বিস্তর। সে জানে, দালালেরা লোভ দেখিয়ে, ভুল স্বপ্ন দেখিয়ে নিয়ে যায়। মা-বাবার ভূমিকা সেখানে ঠকে যাবার। এই প্রবঞ্চনার মধ্যে তবু জিইয়ে রাখা যায় কিছু বা সম্মান। আহা বেচারা! বোঝেনি এমন জিঘাংসা জগতে চলে যাচ্ছে মেয়ে। যেমন ঘটেছিল কমলির বেলায়। এখানে মা-বাবার সঙ্গে চলে সরাসরি কেনা-বেচা দর ও দস্তুরি। মা-বাবার ভাবমুর্তির ক্ষেত্রে তা সহনীয় হয় না। সে জানে এই সমস্তই। এবং চুপ করে থাকে। কেউ প্রকাশ করবে এই সমস্তই, অপেক্ষা করে সে। এবং তার অপেক্ষা ধন্য করে কথা বলে একজন। রোগা হাড়-জিরজিরে সেই মানুষটার মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চোখদু’টি দপদপে। উবু হয়ে বসেছিল সে এতক্ষণ। খরখরে নিরুত্তাপ স্বরে সে বলে—অত বেশি ফালুনি হ্যাঁয়লি করতিছ ক্যানে? কয়ে দ্যাও, মেইয়া বিক্কিরি করে দিই হামরালোক।
—বিক্রি? বিক্রি করে দাও?
তৌফিক তার প্রাপ্ত আঘাতে গুঙিয়ে ওঠে প্রায়।
—হ্যাঁ। দিই। যে-বৎসর মোটামুটি ফসল পাই, বানের জলে ডুবে যাই না যে-বৎসর, ঘর-গেরস্থিতে খোদার কৃপা থাকে, সেই-সেই বৎসর আমরা ভাবতেও পারি না সন্তানকে বেচে দেবার কথা। কিন্তু আশ্রয়হীন হলেই, পেট ভুখা গেলেই, মানুষ আর মানুষ থাকি না আমরা বাবু। খিদে এক সাংঘাতিক অসুখ। এর চেয়ে বড় রোগ, বড় মহামারী আর নেই পৃথিবীতে। আর ওইসব ছাও-পাও ঘরে থেকে লাভ আছে। তাদের সুন্দর দেখায়। স্নেহ উথলায় দেখে। কিন্তু ইস্টিশনে বাস করলে না আছে স্নেহ, না আছে সুন্দর। না খেতে পেয়ে মারা যায় কত! রোগ-ভোগে মারা যায় কত! তার চেয়ে, যায় যেখানে, চলে যায়, খেয়ে-পরে বাঁচবে তো! বেঁচে তো থাকবে।
এ কথার পর, স্তব্ধ থাকে বিশ্বচরাচর। কেউ কোনও কথা বলে না। এমতাবস্থায় বলবারও থাকে না কিছু। একাদশী চাঁদের আলো উছলে মাটিতে পড়ে। এই কালান্তরের দারিদ্রপীড়িত গ্রামও তাতে হয়ে ওঠে মায়াময়। চৌর্যবৃত্তির নারী ও পুরুষ, শিশুবিক্রয়ের নারী ও পুরুষ তারা ছায়া-ছায়া ঘুরে বেড়ায়। ভিক্ষের চাল দ্বারা অতিথি সৎকারের আয়োজন করে। কারও ঘরে গত বৎসরের সুফলা ধানের চাল জমা ছিল কিছু-বা, সে-ও দুই মুঠো এনে দেয়। ভাতে ভাত, নুন, লঙ্কা—এই সম্বল। নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করে তারা। কেউ স্বপ্ন দেখতে চায়—ভাল হবে। আমাদের ভাল হবে।
কেউ শঙ্কিত—কী ভাল হবে? আমাদিগের কপালপোড়া। এর আর ভাল হবে কী?
কোনও পঞ্চায়েত সংগঠন নেই এখানে। জীবনের ঠিকঠিকানা নেই। বসবাসের ঠিকঠিকানা নেই, পঞ্চায়েত কে-বা গড়ে, কে ভাবে গ্রামীণ উন্নয়নের বিষয়ে। এমনই এই অঞ্চল। এমনই বাঘান, কলাবিবি এই সকল গ্রাম। এমনই ধুলামাটি।
একাদশী চাঁদের উপছানো রূপ তারা দেখেও দেখে না। জ্যোৎস্না ফুটলে একমাত্র পুলক, অন্ধকারে দৃষ্টি দেওয়া যায়। ডিবরি না জ্বেলেই কাজ সারা যায় বিবিধ। রেশন কার্ড নেই কারও। কেরোসিন আক্রা। ডিবরি জ্বালানোও বিলাসিতা প্রায়। রেশনে সস্তায় চিনি ডাল মেলে বলে রেশন কার্ড করেছিল কেউ। বন্যায় ভেসে গেছে।
সিদ্ধার্থর গলায় দলা পাকিয়েছিল শ্লেষ্মা। গভীর অন্ধকারে, অতল হতাশায় ডুবে যেতে চাইছে তার মর্ম, তার সৎ ইচ্ছাগুলি। কেন এতদিনে এতটুকু উন্নত হল না এ অঞ্চল! ভাঙন ও বন্যার প্রতিকারে ব্যয় হয় কোটি কোটি টাকা! কীভাবে ব্যয় হয়? কোন খাতে? সেইসবও জলে ভেসে যায় বুঝি!
শুধু রবিশস্য সম্বলে বাঁচে এ জীবন, নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু প্রয়োগ মাধ্যমে কিছু কি সুরক্ষা দেওয়া যায় না এখানে? যেত না?
হায়! সড়কের ধারে ধারে পচে মরে কত না জীবন! সিদ্ধার্থ সে হতাশায় মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে এবং পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়ায়। হতাশ হলে চলবে না। ভেঙে পড়লে চলবে না। সে তো দারুণ সমৃদ্ধি দেখবে বলে আসেনি এই গ্রামে। সে হাতের মুঠো শক্ত করে। বলে- যদি জীবন চলার মতো ব্যবস্থা হয়ে যায় কোনও দিন, ছেড়ে দিতে পারবেন, এইসব পেশা? এই চুরি-চামারি, ভিক্ষাবৃত্তি!
বৃদ্ধ নিজামত আলি বিষণ্ণ হাসেন। মাথা নাড়েন কতকবার। বলেন—ছেড়ে দেব। নিশ্চয় ছেড়ে দেব। ছেড়ে দিতে চাই। এইভাবে বাঁচতে কি ভাল লাগে বাবু? তবে কী, কেউ থাকে জন্মভিক্ষুক! জন্মকাঙাল! কে জানে, কার মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে উদগ্র ক্ষুধার আগুন! হাজার পেলেও তার মিটে না গো, মিটে না!
আকাশে চাঁদের দিকে তাকায় সে। তারাদের দেখে। অজস্র তারাদের ভিড়। সে কথা খোঁজে। কথা। উপযুক্ত কথা। যে কথাই অবলম্বন মানুষের। স্বপ্ন দেখায় কথা। ভালবাসায়। অমৃতমুরতিমতী বাণী! এমনকী ভেঙে তুবড়ে দেয়ও ওই কথাই।
নিজামত আলি বলেন তখন—এই কথা সে-ও বলত। যতবার আসত বলত।
—কে বলত? কে?
—বোষ্টুমি আসত যে। বলত।
দুলুক্ষ্যাপার কাঁপা গলা শোনা গেল এবার—কে? ময়না বোষ্টুমি? কী বলত সে? কী বলত?
—বলত, ছেড়ে দিয়ো। ভাল দিন এলে ছেড়ে দিয়ো দুষ্কর্ম। মানুষের এইসব করা সাজে না।
—আর? আর কী বলত সে?
—আমরা বলতাম, ভাল দিন আসবে কি? সুদিন সকলে দেখে না বোষ্টুমি! কত বৎসরকাল এইভাবে চলেছে। নবাবের আমলে, ব্রিটিশের আমলেও এইসব অঞ্চলে ছিল ডাকাতের বাস। পাশে ডাকাতপোতা গঞ্জই আছে একখানা। তা, ডাকাত হয়েছিল মানুষ কেন? কী লেগে? বলেন? অভাবের হতে বাবু। অভাবের হতে মানুষ চুরি-চামারি করে। ডাকাতিও করে। শেষে তা পেশা হয়ে দাঁড়ায়। নেশাও হয়। তা ডাকাতির নেশা বাবুলোকের কম কী! এই দেশ, মানুষজনা, তারা লুটে-পুটে নিচ্ছে না? ইস্টিশানে দেখেছি বাবু। কত কী দেখেছি। রেলবাবু ঘুষ নেয়। কেরানিবাবু ঘুষ নেয়। পুলিশবাবু ঘুষ নেয়। নেতাবাবুও নেয়। এগুলি ডাকাতি নয়? বলেন? ভদ্রবেশে ডাকাতি এইসব। তা তারা ডাকাতি করে লোভে। আরও আরও লোভে। খাওয়া জোটে, পরা জোটে, বাস জোটে, তবু লোভ করে। তাদের ইস্তিরির গায়ে সোনা-রূপা, তাদের সন্তান ইশকুলে যায়। তবু লোভ করে। সকলেই করে না। কেউ কেউ করে। যারা করে, তারাও ডাকাত। আমরাও। ছোট মুখে বড় কথা সাজে না বাবু। অন্যায্য কইলে মাপ করবেন। কিন্তু বলি কী, যার আছে, তার যদি লোভ হয়, যার নেই, তার লোভ না হবে কেন? গরিব মানুষ তারা, খেতে পেলে শুতে পেলে আর লোভ করবে না? একথা কি বলা যায়? কেউ কেউ করবে। কিন্তু কেউ কেউ ভালও হতে চায়। বয়স তিন কুড়ি পেরিয়েছে। কত কী দেখলাম। দু’ বৎসর আগে আন্ত্রিকে মারা গেছে আমার তিন ছেলে, বউ! রেল থেকে খাবারের প্যাকেট কুড়িয়ে খেয়েছিল। মারা গেছে। আমি বেঁচে আছি। মরে যাব কোনদিন। কথা কইতে ভয় নাই। কাকে ভয়? কিছু লোক ভাল হতে চায় বাবু। অর্ধেক সৎ বাঁচি আমরা বাবু, অর্ধেক অসৎ। এ কি জীবন, বলেন? এই কথা তারেও বলেছিলাম।
—কী বলেছিল সে? কী?
—বলেছিল, সুদিন আসবে। আসবেই। ঈশ্বরের ওপর আস্থা রাখো। তিনিই সব। কী বলব, ধুলামাটি গ্রামে, লোকে ডাকাতিও করে। দুই জেলায় পড়েছে ওই গ্রাম। মুর্শিদাবাদে, নদিয়ায়। পাশ দিয়ে জলঙ্গী রয়েছে। কিছু দূরে গেলে পায় ভাগীরথী। পায় আরও কিছুদুর গেলে বর্ধমান জেলা। তিন জেলা ঘুরে ঘুরে কুকর্ম সারে। সেই গ্রামে গিয়েছি আমি। পনেরো-কুড়ি বৎসর আগেই যা হোক! গিয়েছি! লোক সেথা আমাদেরই মতো বাবু। অসৎ বাঁচতে চায় না। কিছু বুদ্ধ আছে সে গ্রামে, আজও।
—বুদ্ধ? না বৌদ্ধ?
—ওই হল বাবু। বৌদ্ধ, বুদ্ধ সব একাকার। নিরন্ন হলে সব একাকার। সকলেই এক কথা বলে। একই চায়। হিন্দু যা চায়, মুসলমানে যা চায়, বৌদ্ধও তা-ই চায়। ধর্মের কারণে পরস্পর মারামারি কাটাকাটি করে না তারা। এখানে ধর্ম একটাই বাবু ক্ষুধা। ভুখা পেটের মানুষের ধর্ম বাবু সকল ক্ষেত্রেই এক। আর সেই ধুলামাটি গ্রাম, অভিশপ্ত। ধুলামাটি ও আশেপাশের যত গ্রাম, কলাবিবির বন হতে ওই জলঙ্গী, ভাগীরথী পর্যন্ত সব ডাকাতিয়া অঞ্চলের গ্রাম অভিশপ্ত। ডাকাতির পাপ, নরহত্যার পাপ সেখানে ভূমি জুড়ে লেগে আছে। সহজেই রোগ হয় সেখানে। লোকে মরে যায় সহজেই। এই জোয়ান মানুষ, করে-কর্মে খাচ্ছে, এই তার দেহ জুড়ে দগদগে ঘা। সে জানত। সে-ই জানত। ঘুরে ঘুরে বেড়াত সে। জানত সব। আমাদের আপনার ছিল সে। তাকে সব বলা যেত। কেবল মেয়েদের বিক্রি করে দেওয়া, কোনও দিন বলতে পারি নাই।
দুলুক্ষ্যাপা সোজা হয়ে বসেছে এখন। সাগ্রহে চেয়ে আছে নিজামত আলির মুখপানে। ময়না বৈষ্ণবী সংক্রান্ত কথা যেন শুষে নিচ্ছে সে। সিদ্ধার্থ দেখছে তাকে। পড়ছে তার শারীরিক ভাষা। পড়তে পড়তে বৈরাগী ঠাকুরের হৃদয় সে দেখতে পাচ্ছে অনাবিল স্বচ্ছতায়। দুলুক্ষ্যাপা বলছে—বলতে পারোনি কেন? মিঞা? কেন?
—সইতে পারত না সে। মেয়েদের বড় ভালবাসত বোষ্টুমি। ঘরের মেয়েছেলের গায়ে হাত তুললে বলত, ‘মেয়েদের সম্মান করো, মায়ের জাত, তাকে সম্মান করা মানুষের ধর্ম। এই দেশের ধর্ম।’ কার এতবড় বুক ছিল বাউল, তাকে বলবে? হয়তো জানত সে। হয়তো জানত না।
—জানত না। জানত না। জানলে আমরা বুঝতে পারতাম ঠিক। সে যে হৃদয় খোলসা দিত আমাদেরই কাছে। তবে কি, শুধু মেয়ে বলে না, সে মানুষকেই ভালবাসত। প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। মানুষের জন্য যার বুকে ভালবাসা আছে, তাকেও চিনতে পারত। যেমন এঁকে চিনেছিল। সিদ্ধার্থকে চিনেছিল।
সিদ্ধার্থ আকাশের দিকে চেয়ে আছে। কেন না তার মনে পড়ে যাচ্ছে ময়না বৈষ্ণবীকে। কী আকুলতায় তার হাত চেপে ধরেছিল নারী সেই! তারা ফিরছিল তেকোনা গ্রামে তখন! কী স্নেহকোমলতা ছিল সেই স্পর্শে! সে আজও অনুভব করতে পারে সেই ছোঁয়ার মুহূর্তটুকু। আকাশের দিকে চেয়ে আছে সে। এখানে কোথাও আছে ময়না বৈষ্ণবী। তারা হয়ে আছে।
নিজামত আলি এলোমেলো বলে চলেন— ঘুরে ঘুরে আসত সে। বিলের ধারে জলের পানে চেয়ে বসে থাকত। চলে গেল। মানুষকে ভালবেসে চলে গেল। ওঃ খোদা! এমন মৃত্যু যেন না হয় কারও! না হয়! বিশুদ্ধ মানুষ, তবু কোন পাপে এমন হল তার!
কিছুক্ষণ, জ্যোৎস্নার ওপর, অঙ্গাঙ্গী বিছিয়ে থাকল নৈঃশব্দ্য। কিছুক্ষণ। তারপর একজন বলল—আমিই প্রথম দেখেছিলাম। কুত্তাগুলান তাকে ঘিরে চিল্লা করছিল।
আর একজন বলল—ডাকছিল। করুণ ডাকছিল।
ওঃ! রক্তে বুক ভেসে গিয়েছিল।
শরীরে ছিল না কিছুই। একেবারে শেষ করে দিয়েছিল।
তুলসীর গোটের মালা ছিঁড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল!
এমনকী সে হতেও রক্ত ঝরছিল।
দেহে পিঁপড়ে ধরেছিল!
চুপ, চুপ করুন।
সিদ্ধার্থ চাপা সপাট ধমকে থামিয়ে দিল কথা। বলল— আর নয়। ওইসব আর নয়। কী হবে এ আলোচনায়!
.
আবার নৈঃশব্দ্য এল ঘিরে। কুকুর ডেকে উঠল করুণ কেমন। দুলুক্ষ্যাপা উঠে গেল জনসভা ছেড়ে। তার আলখাল্লা পরা দীর্ঘ দেহে পড়েছে চাঁদের আলো। মনে হচ্ছে, জ্যোৎস্না ধরে ধরে সে বুঝি পৌঁছে যাবে চাঁদে। তারপর, চাঁদ হতে এক লাফে ধরে নেবে তারা হয়ে যাওয়া ময়না বৈষ্ণবীকে।
সিদ্ধার্থর মনে হল, বৈরাগী ঠাকুরের কিছু রোদন প্রয়োজন। একান্ত রোদন। এখন সে জানে, সে নিশ্চিত, ময়না বৈষ্ণবীর তরে এ মানুষের হৃদয়ে আছে দুই কুল উপচানো ভালবাসা। তা রোদন বহায়। তা দাবি করে কিছু একান্ত সময়।
তার মনে পড়ে, ময়না বৈষ্ণবী একা এক আন্দোলন তুলেছিল। নারী পাচারের মতো এক গর্হিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিরুদ্ধে আন্দোলন তুলেছিল। একাকী। নিঃসম্বলে। সেই দেখে, ময়না বৈষ্ণবীকে দেখে, তারা কি পারে না, সকল বঞ্চনার বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে আন্দোলন?
কার বিরুদ্ধে আন্দোলন? কার বিরুদ্ধে?
সকল দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের বিরুদ্ধে! পচন ধরে যাওয়া দলীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে! কর্কটরোগগ্রস্ত কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে?
সে বলে ওঠে—আপনারা শুনুন, এক সুন্দর জীবনের লক্ষ্যে, সৎ জীবনের লক্ষ্যে, যদি প্রয়োজন হয়, আপনারা আন্দোলনে রাজি?
—আন্দোলন?
তারা বিস্ময়ে বলে। এই পঞ্চাশঘর দরিদ্রতম মানুষ, যে-বস্ত্র ধোয়, সে-বস্ত্র পরে, এমন মানুষ, কে তাদের আন্দোলনে ডাক দেয়!
সিদ্ধার্থ বলে চলে, কিংবা, কে জানে, হয়তো আকাশের সকল ব্যথিত নক্ষত্ররাজি, বলিয়ে নেয় তাকে দিয়ে, বলিয়ে নেয়—হ্যাঁ! আন্দোলন! ধরুন এমনকী অস্ত্র ধরতে হল আপনাদের? রাজি?
—অস্ত্ৰ?
—হ্যাঁ! ধরুন লড়াই করতে হল সেই অস্ত্র দিয়ে। রাজি?
—লড়াই?
—এবং সেই লড়াই, সেই সংগ্রাম, হতে পারে দীর্ঘ, দীর্ঘ সংগ্রাম। একেবারে হাতে হাতে ফল না-ও পাওয়া যেতে পারে। রাজি?
—দীর্ঘ সংগ্রাম?
—যদি হয়? যদি প্রয়োজন হয়?
—আপনার কথাগুলি নেতার মতো শোনায় না বাবু। মনে হয়, ঘরেরই ছেলে বুঝি আপনি। কোনও বক্তৃতা নাই, কিছু নাই। হ্যাঁ বাবু, সংগ্রাম করে জীবন সুন্দর হয়?
—অন্তত স্বপ্ন দেখা যায়। পাবার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া যায়। যা স্বাভাবিক পাবার কথা, না পেলে, গড়ে তুলতে হবে না?
—আমরা পারব?
—আমরা সবাই পারি, যদি চাই।
—আমরা বাঁচব তো? হ্যাঁ বাবু? মরে তো যাব না!
—মরা? কোন মৃত্যু? কোন মৃত্যু জানতে চান আপনারা?
—আমরা যদি অস্ত্র ধরি, আমাদের উলটোদিকে যারা সব থাকবে, পুলিশ, সৈন্যসামন্ত, তারা আমাদের মেরে ফেলবে তো!
—হ্যাঁ! মেরে ফেলতেও পারে। আমরা একজনও বেঁচে না-ও থাকতে পারি! কিন্তু ওই মৃত্যুর দ্বারা, প্রতিবাদী মৃত্যুর দ্বারা যে কল্যাণ রচিত হয়, তার ফল পায় ভাবীকাল!
—আমরা তো মরে বেঁচে আছি বাবু। যদি কোনও কাজে লাগি, বলবেন। বলবেন… একটি কিশোরী মেয়ে এসে দাঁড়ায় তখন। রিনরিনে গলায় বলে—মা বলে দিল, পাক হয়ে গেছে।
তাকে দেখে সিদ্ধার্থর বুক ভরে গেল। মনে হল, এই তো, এই মেয়েটি তো বিক্রি হয়ে যায়নি। কিছু থাকে। কিছু থাকে। যা থাকে, তাই নিয়েই এগিয়ে চলার কাজ শুরু করতে হয়।