2 of 3

রাজপাট – ৮২

৮২ 

জাহ্নবী জননী দেবী,           আইলেন এই ডুবি, 
এই তিন ভুবনে প্রতীকার। 
সুর-নর-নিস্তারিণী            পাপ-তাপ-নিবারণী, 
কলিযুগে হেত অবতার ।। 
ধন্য ধন্য বসুমতী,            যাহাতে গঙ্গার স্থিতি, 
ধন্য ধন্য ধন্য কলিযুগে। 
শতেক যোজনে থাকে            গঙ্গা গঙ্গা বলি ডাকে, 
শুনে মনে চমৎকার লাগে ।।
পক্ষিগণ থাকে যত,            তাহা বা কহিব কত, 
করে সদা গঙ্গাজল পান।
দুরে রাজচক্রবর্তী,           যার আছে কোটি হস্তী,         
সেই নহে পক্ষীর সমান ।।
গয়াক্ষেত্র বারাণসী,            দ্বারকা মথুরা কাশী, 
গিরিরাজ গুহা যে মন্দর।
এসব যতেক তীর্থ,            বিষ্ণুর সব মহত্ত্ব, 
সর্বতীর্থ গঙ্গাদেবী সার ।।

ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা ছিলেন মহাভিষ। তিনি পরম সত্যবাদী এবং ন্যায়পরায়ণ। একাদিক্রমে সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ করে তিনি পুণ্যফল লাভ করলেন। এমন চরম পুণ্যদ্বারা দেবরাজকে প্ৰসন্ন করে স্বর্গে বসবাসের অধিকার প্রাপ্ত হলেন। 

একদিবস দেবগণ কমলযোনির আরাধনা করছেন, বহু রাজর্ষি এবং মহারাজ মহাভিষ ও সেখানে উপস্থিত আছেন, এমন সময় সরিদ্বরা গঙ্গা ব্রহ্মার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিমিত্ত তথায় উপস্থিত হলেন। 

এ যাবৎ বায়ু মৃদুমন্দ বইছিল। হঠাৎ তা প্রবল বেগ ধারণ করল এবং এক ঝটকায় উড়িয়ে দিল অপরূপা গঙ্গার বক্ষআবরণী। 

সেই দেখে দেবতারা লজ্জায় অধোবদন হলেন, কিন্তু মহাভিষ চেয়ে রইলেন অপলক, নিঃসঙ্কোচে, বাহ্যজ্ঞানহীন। গঙ্গার রূপলোভ তাঁর চোখে ঠিকরে উঠল। ব্রহ্মার তা নজর এড়াল না। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন—মহারাজা মহাভিষ! সকল পুণ্য সঞ্চয় করিয়াছিলে তুমি। ইহাতেই স্বর্গে তোমার স্থান হইয়াছিল। এক্ষণে দেখিতেছি তুমি দেবলোকের উপযুক্ত পাত্র নই। অতএব মর্ত্যলোকে তুমি জন্মগ্রহণ করো। 

মহাভিষের চৈতন্যোদয় হল। অন্তরাত্মা হায়-হায় করে উঠল তাঁর। দৃষ্টি সংযত করে তিনি ভাবলেন—এ কী করিলাম! এত কষ্টে অর্জিত পুণ্য, সকলি হারাইলাম! 

তিনি ব্রহ্মার পদপ্রান্তে মাথা রেখে বললেন—হে দেবাদিদেব, হে পরমপিতা, ক্ষমা করুন। 

ব্রহ্মা বললেন—যে বাক্য বলিয়াছি তাহা অন্যথা হইবার নহে। কিন্তু তোমাকে ক্ষমা করিলাম। তুমি ভূলোকে জন্মগ্রহণ করো। তোমার পুনঃ স্বর্গপ্রাপ্তি হইবেক। 

মহাভিষ বললেন—হে দেব, আমাকে ঔরস নির্বাচন করিবার অধিকার দিন। 

—দিলাম। 

—আপনি এই বর দিন, যাহাতে আমি রাজা প্রতীপের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিতে পারি।

—তথাস্তু! 

এইরূপ কথোপকথন হলে গঙ্গা ফিরে এলেন। সেই প্রত্যাবর্তনকালে মহাভিষকে চিন্তা করতে করতে তিনি পথ চললেন। পথিমধ্যে দেখলেন, বসু নামক দেবগণ মূর্ছিত এবং বিকলেন্দ্রিয় হয়ে পথে পড়ে রয়েছেন। এই বসুগণ বিষয়ে গঙ্গা অবহিতা। দক্ষরাজ কন্যা বসুর গর্ভে এবং ধর্মের ঔরসে এই অষ্টবসুর জন্ম। অন্য সকল দেব ও দেবীর মতোই এই বসুগণ পরিচিত নামান্তরে। কোথাও তাঁরা ধর, ধ্রুব, সোম, অনল, অনিল, সাবিত্র, প্রত্যূষ, প্রভাস। কোথাও দ্রোণ, প্রাণ, ধ্রুব, অর্ক, অগ্নি, দোষ, বাস্তু ও বিভাবসু। কোথাও ভব, ধ্রুব, সোম, বিষ্ণু, অনিল, অনল, প্রত্যূষ ও প্রভব। অন্য কোনওখানে তাঁরা বহুরূপ, ত্র্যম্বক, সাবিত্র, দ্যু, সুরেশ্বর, জয়ন্ত, পিনাকী, অপরাজিত। এই অষ্টবসু—ভব, ধ্রুব, সোম, বিষ্ণু, অনিল, অনল, প্রত্যূষ ও প্রভব, গঙ্গাকে দেখামাত্র আর্তনাদ করে উঠলেন। গঙ্গা তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন—তোমরা কী নিমিত্ত এরূপ দুর্দশাগ্রস্ত হইয়াছ? তোমাদিগের কি কোনও অনিষ্ট ঘটনা ঘটিয়াছে? 

বসুগণ বললেন—সরিদ্বরে! আমরা সস্ত্রীক বশিষ্ঠ আশ্রমে বিহার করিতে গিয়াছিলাম। একদিবস সায়ংকালে ভগবান বশিষ্ঠ প্রচ্ছন্ন বেশে উপবিষ্ট ছিলেন, আমরা অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত মহর্ষির যথাবিধি সম্মান না করিয়া প্রস্থান করিতেছিলাম, তৎকালে দ্যু-এর পত্নী বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনীকে দর্শন করতঃ উহাকে হরণ করিতে প্ররোচনা দেন। স্ত্রীর প্ররোচনায় দ্যু নন্দিনীকে অপহরণ করিলে আমরা সাময়িক বিভ্রান্তিবশতঃ উহাকে নিবৃত্ত করি নাই। তৎক্ষণে বশিষ্ঠ প্রকট এবং ক্রোধান্বিত হইয়া এই অপরাধে আমাদিগকে ‘মনুষ্যযোনি প্রাপ্ত হও’ বলিয়া অভিসম্পাত করিয়াছেন। সেই ব্রহ্মবাদীর বাক্য কদাপি অন্যথা হইবার নহে। আমরা অন্যায় স্বীকার করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিলে তিনি আশীর্বাদ করেন আমাদিগের মর্ত্যলোকে স্বল্প কাল ভোগ করা ভিন্নতা নাই। তদোপরি দ্যু-এর ভোগ সুদীর্ঘকালের। কারণ তাহার অপরাধ গুরুতর। এক্ষণে আমরা আপনার আগমন প্রতীক্ষা করিতেছি। আপনি আমাদিগের প্রতি প্রসন্ন হউন। আমরা আপনার গর্ভ ভিক্ষা করি। আপনি নবকলেবর ধারণপূর্বক ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হউন। আমাদিগের সৃষ্টি বিধান করুন। সামান্য মানুষীর গর্ভে আমরা জন্মগ্রহণ করিতে পারিব না। 

গঙ্গা বসুগণের প্রার্থনায় সম্মত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মর্ত্যে কোন মহাপুরুষ তোমাদিগের জনক হইতে পারেন? 

—প্রতীপ রাজার ঔরসে শান্তনু নামে এক সুবিখ্যাত ভূপাল ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিবেন। তিনিই আমাদিগের জনক হইবেন। 

গঙ্গা প্রসন্না ও সম্মতা হয়ে বললেন—তোমাদিগের অভিলষিত এবং সেই রাজার প্রিয়কার্য আমি অবশ্যই সম্পাদন করিব। 

বসুগণ বললেন—হে ত্রিপথগে! আপনার পুত্র জন্মিবামাত্র সলিলে নিক্ষেপ করিবেন। অধিককাল যেন আমাদিগকে ভুলোক-যন্ত্রণা সহ্য করিতে না হয়। 

—তোমরা যাহা বলিলে আমি তাহাই করিব। কিন্তু রাজার যাহাতে একটি পুত্র জীবিত থাকে, তাহার কোনও উপায় স্থির করো। কারণ সেই পুত্রার্থী ভূপতির মৎসহবাস নিতান্ত নিষ্ফল হওয়া কোনও ক্রমেই বিধেয় নহে। 

—আমরা স্ব স্ব বীর্যের চতুর্থভাগের অর্ধাংশ প্রদান করিব। তাহাতেই তাঁহার পুত্রলাভ হইবে। কিন্তু হে পতিতপাবনী, আপনার সেই পুত্র মহাবলপরাক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি চিরকুমার এবং অপুত্রক হইবেন। অষ্ট বসুর বীর্যে মহীয়ান তিনি ভীষণ চেতনাসম্পন্ন হইবেন। কিন্তু এই ভূমণ্ডল তাঁহার বংশধারণ করিবে না। 

গঙ্গা অপেক্ষা করতে লাগলেন, কবে শান্তনুর জন্ম হয়। একদিন পৃথিবীর অধিরাজ সর্বভূতহিতৈষী প্রতীপ স্বয়ং ভাগীরথীতীরে যজ্ঞানুষ্ঠান করতে এলেন। দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন তিনি। রাজার রূপ ও গুণে মোহিত হয়ে গঙ্গা স্ত্রীরূপ ধারণ করে রাজর্ষির দক্ষিণ ঊরুতে উপবেশন করলেন। রাজা ধ্যান হতে জাগ্রত হয়ে বললেন, কল্যাণী! তুমি কী নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছ? তোমার কোন প্রিয়কার্য সম্পাদন করিতে হইবে তা আমাকে বলো। গঙ্গা বললেন—মহারাজ! আমি অন্য কোনও বস্তু অভিলাষ করি না। আমি আপনার অনুরাগিণী। আমাকে গ্রহণ করুন। 

রাজা প্রতীপ বললেন, আমি তা পারি না। 

—মহারাজ! প্রণয় অভিলাষিণী রমণীকে প্রত্যাখ্যান করা গর্হিত কর্ম। আপনি ধরার অধীশ্বর। আপনি কী প্রকারে এরূপ প্রত্যাখ্যান করেন? 

—হে বরবর্ণিনি! আমি দীক্ষিত। পরদারপরিগ্রহে বা অসবর্ণা স্ত্রীতে গমন করিলে আমার অধর্ম হইবে। 

—রাজা! আমি অগম্যা নহি। নিন্দনীয়া নহি। আমি দিব্যাঙ্গনা। আমার দ্বারা আপনার কোনও রূপ অনিষ্ট হইবে না। আপনার প্রণয়পাশে আকৃষ্ট হইয়াছি। আমাকে ভজনা করুন। পরকলত্র বোধে প্রত্যাখ্যান করিবেন না। 

—কল্যাণী! আমি কাম নিবৃত্ত করিয়াছি। তোমার আহ্বানে অসাধু হইতে পারিব না। তন্মধ্যে তুমি কামিনীভোগ্য বাম ঊরু পরিত্যাগ করিয়া পুত্র ও পুত্রবধুসেব্য দক্ষিণ উরুদেশে উপবেশন করিয়া আমার পুত্রবধূস্থানীয় হইয়াছ। সুষাভোগ্য দক্ষিণোর আশ্রয় করিয়াছ বলিয়া তুমি আমার পুত্রবধূ হইলে। আমি অঙ্গীকার করিতেছি, আমার পুত্রের সহিত তোমার বিবাহ হইবে। 

অতঃপর মহাভিষ রাজা প্রতীপের ঔরসে জন্মগ্রহণ করলেন। শান্তিপরায়ণ রাজার পুত্র হওয়ায় তাঁর নাম হল শান্তনু। প্রতীপ তাঁর সুযোগ্য পুত্র শান্তনুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে অরণ্যে গমন করলেন। মৃগয়া ছিল শান্তনুর প্রিয় এবং উপভোগ্য কর্ম। একদিন মৃগয়ায় প্রচুর পশু সংহার করে ক্লান্তিবশত একাকী ভাগীরথীতীরে উপনীত হলেন। তাঁর দৃষ্টি গেল এক সুললিত নবযৌবনার দিকে। তাঁর রূপ হতে আলো ঠিকরোচ্ছিল। শরীর হতে নির্গত হচ্ছিল যৌবনবনকুসুমের গন্ধ। তাঁর সূক্ষ্ম স্বচ্ছ পরিধেয় বস্ত্রের আড়াল হতে ফুটে উঠছিল পদ্মবর্ণ দেহ, সুগভীর নাভি, পদ্মসদৃশ যোনির আভাস। রাজা শান্তনু মুগ্ধ অনিমেষ নয়নে এই নারীকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। সেই নারীর বিশাল লোচনেও ফুটে উঠল রক্তিম অনুরাগ। সর্ব অঙ্গে বিভঙ্গে তিনি হয়ে উঠলেন অতৃপ্ত কামিনী। 

রাজা শান্তনু আর থাকতে না পেরে ওই নারীকে প্রিয় সম্ভাষণ করে বললেন—হে কৃশাঙ্গি! দেব, দানব, গন্ধর্ব, অপ্সরা, যক্ষ, পন্নগ ও মনুষ্য ইহার মধ্যে তুমি কোন জাতিকে অলংকৃত করিয়াছ? আমার বাসনা হইতেছে, তোমার পাণিগ্রহণপূর্বক তোমার সহবাসে যৌবন চরিতার্থ করি। 

সেই অনন্যারূপিণী বললেন —মহারাজ! আমি আপনার মহিষী হইতে সম্মতা আছি। আমি অগম্যা নহি। নিন্দনীয়া নহি। কিন্তু মহারাজ আপনার নিকট আমার শর্ত আছে। সেই শর্ত দ্বারা আপনাকে প্রতিজ্ঞাবন্ধনে বন্দি হইতে হইবে। 

রাজা জিগ্যেস করলেন- কী সেই শর্ত? তুমি অবশ্য বলো। প্রেয়সি! তোমার সকল প্রিয়কার্য আমি সম্পাদন করিব। 

গঙ্গা বললেন—মহারাজ! আমি আপনার মহিষী হইলে পর যে-সকল কার্যের অনুষ্ঠান করিব তাহা ভাল হউক বা মন্দ হউক, প্রিয় হউক বা অপ্রিয় হউক, তদ্বিষয়ে আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিবেন না, নিষেধ করিবেন না, তন্নিমিত্ত আমার প্রতি কোনও অপ্রিয়বাক্য প্রয়োগ করিতে পারিবেন না। মৎকৃত কার্যের ব্যাঘাত জন্মাইলে বা প্রদত্ত শর্তের ভঙ্গ হইলে আমি তৎক্ষণাৎ আপনাকে পরিত্যাগ করিব। 

রাজা সম্মত হলেন। এই শর্ত পালনের গুরুভার সম্ভাবনার কথা তাঁর মনে এল না। গঙ্গার অলৌকিক রূপ তাঁর কূটনীতিজ্ঞ বুদ্ধিকে অবশ করেছিল বুঝি! তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন। অলোকসামান্য স্ত্রীরত্ন লাভ করে তাঁর প্রীতির অন্ত রইল না। নিরন্তর গঙ্গার সন্তোষবিধান করাই রাজার প্রধান কর্ম হয়ে উঠল। ভাগীরথী হাব-ভাব-বিলাস ও সম্ভোগাদি দ্বারা রাজা শান্তনুর চিত্তহরণ করলেন। শান্তনু ক্ষণকালের জন্যও মহিষীর অদর্শন সহ্য করতে পারতেন না। 

দিন যায়। মাস যায়। গঙ্গার গর্ভে পর পর সাতটি পুত্রসন্তানের জন্ম হল। প্রত্যেকটি পুত্রের জন্মের পরেই গঙ্গা স্বতীরে গমনান্তে সদ্যজাতকে জলে নিক্ষেপ করে বললেন— এই আপনার প্রিয় কার্য করিলাম। আপনাকে আমি প্রসন্ন করিব। 

এতগুলি সন্তানের এমন মৃত্যু রাজা সহ্য করতে পারছিলেন না। কিন্তু তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিছু বললে যদি গঙ্গা তাঁকে ছেড়ে চলে যান, তাই সংযত রইলেন। 

অতঃপর পুনর্বার গঙ্গার গর্ভে পুত্র জন্মাল। রাজা শান্তনু দেবলক্ষণযুক্ত সেই পুত্রের মুখদর্শন করে গভীর মায়ায় আপ্লুত হলেন। তাঁর চিত্তে প্রবল আশঙ্কা দেখা দিল। এরও কি প্রাণনাশ করবেন গঙ্গা? শর্ত স্মরণে থাকা সত্ত্বেও তিনি সংযত থাকতে পারলেন না। বললেন, প্রেয়সি! এই পুত্র তুমি বিনষ্ট করিয়ো না। তুমি কে? কী নিমিত্ত আত্মজদিগের প্রাণ বধ করিতেছ? হে পুত্রঘাতিনি! পুত্রহিংসা অপেক্ষা গুরুতর পাপ আর কিছুই নাই! এই গর্হিত নিষ্ঠুরাচরণে ক্ষান্ত হও! 

তখন সেই নারী বললেন-হে পুত্রকাম! আমি তোমার পুত্র বিনষ্ট করিব না। এক্ষণে প্রতিজ্ঞা স্মরণ করো। আমি অদ্যাবধি তোমার সহবাস পরিত্যাগ করিলাম। আমি মহর্ষি জহ্নুর কন্যা গঙ্গা। ঋষিগণ আমার সেবা করিয়া থাকেন। কেবল দেবকার্য সাধনার্থ তোমার ভার্যা হইয়াছিলাম। যে সন্তানগুলি সলিলসমাধি দিয়াছি তাঁহারা সাধারণ নহেন। মহাতেজা বসুগণ বশিষ্ঠের অভিশাপে মনুষ্যযোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সাধারণ মনুষ্যরমণীর গর্ভে উহারা অকুলান বলিয়া আমি মনুষ্যদেহ ধারণ করিয়াছিলাম। তোমা ভিন্ন পৃথিবীতে অপর কোনও পুরুষ তাঁহাদের পিতা হইতে পারেন না, আয়া ভিন্ন অপর কোনও স্ত্রীও উহাদের জননী হইবার যোগ্য নহেন। তুমি ইঁহাদিগের জনক হইয়া অক্ষয় লোকসকল জয় করিয়াছ। আমি বসুগণের নিকট অঙ্গীকার করিয়াছিলাম যে আমার পুত্র হইয়া জন্মিবামাত্র আমি তাঁহাদের মনুষ্যজন্মের ক্লেশ হইতে মুক্ত করিব। আমি তাহাই করিয়াছি। বসুদিগকে মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপ হইতে মুক্ত করিয়াছি। আমিও সুবিশাল প্রতিজ্ঞা পালন করিলাম। এক্ষণে স্বস্থানে গমন করিব। তোমার মঙ্গল হউক। সাত বসু মুক্ত হইলেও একজনের ভোগ কিছু দীর্ঘ। তিনি আমার অষ্টম গর্ভজাত। ইনি গাঙ্গেয়। নদীজ। সত্যব্রত। এই পুত্রকে গঙ্গাপুত্র বলিয়া পালন করিয়ো। ইনি মহাবল। মহাচেতন। 

এই বলে গঙ্গা জলে বিলীন হলেন। বসুগণের বীর্যের ভাগে দেহপ্রাপ্ত দেবব্রত হলেন মহাপরাক্রমশালী শ্রেষ্ঠপুরুষ ভীষ্ম। ভীষ্মের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মহাভারতের মহাযুদ্ধের সূচনা হল। তারপর ঘটে গেল কত কিছু। কিন্তু গঙ্গার সেই বসু-উদ্ধারের স্বভাব গেল না। আজ এত বৎসর পরেও তিনি কোনও সন্তানকে ভাসিয়ে দেন, ডুবিয়ে মারেন। কোনও সন্তানের জন্য আনয়ন করেন পলি ও জনকল্যাণ। সুস্বাস্থ্যে সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে সে। কিন্তু কাকে ডোবাবেন তিনি, কাকে ভাসাবেন, বাঁচাবেনই বা কাকে, কেন, কে তাঁর বসুগণ, কে তাঁর দেবব্রত জানতে ও পারেন না অদ্যাবধি জন্মানো হাজার শান্তনু! 

মহর্ষি বাল্মীকি লিখেছিলেন শ্লোক— 

বরমিহ গঙ্গাতীরে শরটঃ করটঃ 
কৃশঃ শুনীতনয়ো ন হি দূরতরস্থঃ। 
অযুত-শত-বরনারীভিঃ পরিবৃতঃ
করিবরকোটীশ্বরো নৈব হি নৃপতিঃ ॥ 

—এই গঙ্গাতীরে বরং কৃকলাস কাক কিংবা ক্ষুদ্র কুকুরশাবক হয়ে থাকাও ভাল। কিন্তু দূরে বহুসহস্র উত্তম রমণীগণে পরিবৃত কোটি গজরাজের অধিপতি হওয়াও ভাল না, এমনকী রাজা হওয়াও ভাল না। 

এমনই মাহাত্ম্য এ গঙ্গার। কিন্তু পতিতপাবনীর আগ্রাসনে ঘরবাড়িপরিবার সম্পদসঙ্গতি চলে যায় যার, তার গতি বলা নেই কোনও পুরাণকথায়। কোনও শ্লোকে। গঙ্গার মারণরূপ কি তবে জেগে উঠল এই কলিতেই? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *