2 of 3

রাজপাট – ৮৭

৮৭

আশ্বিন মাসে দুর্গাপূজা 
মায়ের আগমনে। 
মলুয়া মানত করে 
মায়ের চরণে ॥ 
কোন বা দেশে গেল সে যে 
কোন বা গহীন বনে। 
রক্ষা করো তারে মাগো 
ধরি দুই চরণে ॥ 

দাহ অবধি অপেক্ষা করেনি সে। শ্মশানযাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে শ্মশান পর্যন্ত গিয়ে বিদায় নিয়েছিল। বৈরাগীঠাকুর দুলুক্ষ্যাপাকে সঙ্গে নিয়ে সে চলেছে। মরালী হতে পায়ে পায়ে চলে যাবে হরিহরপাড়া। মরালী হতে, কারণ মরালীতেই রয়েছে হিন্দুর শ্মশান। তেকোনায় কোনও শ্মশান নেই। 

বিষাদবিধুর মন নিয়ে সে চলেছিল। এই চিরবিচ্ছেদ বড় বেদনার। বার্ধক্য সত্ত্বেও যারা থাকেন সতেজ, ব্যক্তিত্ববান, চিরযৌবনবান যাঁরা, অজর, যেমন বোধিসত্ত্ব, তাঁদের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। 

এই তো, কালও ভাল ছিলেন তিনি। সতেজ সবল ছিলেন। আজ তাঁর এই হঠাৎ মৃত্যুতে কেঁদে উঠল সারা গ্রাম। শুধু চাটুজ্যেরাই নয়। সারা গ্রাম আজ মাতৃহারা হল। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এক দীর্ঘ যুগের অবসান ঘটে গেল তেকোনায়। 

বেঁচে থাকা তাঁর, একপ্রকার আশ্বাস রচনা করত গ্রাম জুড়ে। নবমী, নয়মি, নয়া—সাক্ষাৎ ভগবতী হয়ে এই গ্রামে ছিলেন। এই নবমীতে একাশি পূর্ণ হল তাঁর। একখানি গরদের থান পরে, কপালে দিয়ে চন্দনের টিপ, সদ্যস্নাত সাদা চুলের গোছা ছড়িয়ে দিয়ে পিঠে তিনি এক পবিত্রতার প্রতিমূর্তি সকলজনের হৃদয় শান্ত করেছিলেন। আছেন, তিনি আছেন। 

আজ তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এক যুগ চলে গেল। এক কাল চলে গেল। আত্মীয়বিয়োগ ব্যথায় কাতর সিদ্ধার্থ ভাবছিল তাঁরই কথা। 

ভোরবেলা ওঠাই তাঁর অভ্যাস চিরকাল। বেলা গড়িয়ে যায় দেখে সাতটা নাগাদ নন্দিনী এসে শাশুড়ির ঘরের আবজে রাখা দরজা ফাঁক করেছিলেন। কী হল? মানুষটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন কি? 

বিছানায় ছিলেন না তিনি। নন্দিনী অবাক দেখেছিলেন, টেবিলে লণ্ঠন জ্বলছে ওই সকালেও। আর চেয়ারে বসে, টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছেন তাঁর শাশুড়ি। তিনি কাছে গিয়ে বললেন—এ কী! মা! আপনি সারারাত বিছানায় ঘুমোননি! মা! 

সাড়া নেই কোনও। 

নন্দিনী আবার ডাকলেন—মা! উঠুন! বেলা হল! 

সাড়া নেই। 

— মা! 

নন্দিনী শাশুড়ির বাহু স্পর্শ করলেন। সেই বাহু, যার দু’ আঙুলের খাঁজে তখনও রয়েছে একখানি খোলা কলম। সেই হাতেই তাঁর মাথা। অন্য হাত ঝুলে আছে। মুখের কাছে শান্ত পড়ে আছে চিঠি একখানা। অসমাপ্ত। শেষদিকে অক্ষরগুলি এঁকেবেঁকে দুর্বোধ্য! 

নন্দিনী বাহু স্পর্শ করে টের পেলেন ঠান্ডা! গাল স্পর্শ করে টের পেলেন ঠান্ডা! তিনি চিৎকার করে উঠলেন – মা! 

মেয়েকে লিখছিলেন চিঠি। চিঠিখানা আছে। সকল অসমাপ্ত জীবনের মতো অসমাপ্ত চিঠিখানা আছে। মানুষটা চলে গেছেন। লিখতে লিখতে, লিখতে লিখতে, লেখা থামিয়ে চলে গেছেন। কী লিখছিলেন তিনি? কী? 

কল্যাণীয়া 

মা পাঞ্চালি, 

তোমাকে দেখিতে মন ব্যাকুল হইয়াছে। এই পূজায় বড় বিষণ্ণ বোধ করিয়াছি। এমন তো হইবার কথা ছিল না। সকলেই আসিয়াছে। শিশুকন্যা লইয়া পল্লবী পৰ্য্যন্ত। শুধু তুমি আসো নাই। জানিতাম আসিবে না। তবু মাতৃহৃদয় বাধা মানে কই! মা ভগবতীর মুখে নিরন্তর তোমারই মুখ দেখিলাম। এই বৎসর মায়ের মূর্তির বিসর্জ্জন হইল না। খরায় ভৈরবের জল শুষ্ক। নিমজ্জন হইবে কোথায়? মন কু ডাকে। এই সকল কথা আর কাহাকেও বলিতে পারি না। 

গতকল্য আমার একাশি পুরিয়াছে। কী জানি, কী হয়! তোমাকে দেখিতে ইচ্ছা করে খুব। 

আজ মনে বড় বেদনা পাইলাম। কাহাকে বলিব এই কথা? আমারই রক্ত-মাংস সব। আমারই সত্তা। কাহাকে বা দোষ দিব? তবু মনে বড় ব্যথা পাইয়াছি। 

পল্লবী, শুভ্র, শৌভ, মোহন, মধু সকলে পরামর্শ করিয়া আমাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল। কোথায় জানো? তোমাদের ঠাকুরঘরে। জোর করিয়া স্পর্শ করাইল বিগ্রহে, সিংহাসনে! 

এ তো আমি চাহি নাই! সত্য বলিব, আমার এইটুকুই ছিল। এই অভিমানটুকু। ইহারই মধ্যে আমি আপনার সত্তাটুকু বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলাম। 

স্ববর্ণে বিবাহ করি নাই বলিয়া পিতা আমাকে চিরকালের জন্য ত্যাগ করিয়াছিলেন। সেই ত্যাগ আমি গ্রহণ করিয়াছিলাম। তাহার জন্য শোক করি নাই। শ্বশুর-শাশুড়ি, বিলম্বে হইলেও, আমাকে গ্রহণ করিয়াছিলেন। পিতৃ-মাতৃস্নেহ আমি পাইয়াছি তাঁহাদের নিকট। আমার কোনও অভিযোগ কাহারও প্রতি নাই। কিন্তু সকল স্নেহের মাঝে, সেই যে কোথায় এক নিষেধ রহিয়া গেল, অনুচ্চারিত অকথিত সেই নিষেধ, আমি জোর করিয়া তাহা ভাঙ্গিয়া দিতে পারিতাম। দিই নাই। তাঁহারা আমার অঙ্গ স্পর্শ করিতেন না। একদিন করিলেন, যখন আমি মা হইলাম। তাঁহারা আমার পাক খাইতেন না। একদিন খাইলেন। যখন আমি এই পরিবারের উত্তরাধিকারী ভূমিস্থ করিলাম। আমি বহিরাগত অস্পৃশ্য ছিলাম। সন্তান মাধ্যমে এই গৃহে আমার অন্তর্ভুক্তি ঘটিল। সমাজ নারীকে পুরুষের পরিচয়ে পরিচিতা করে। সন্তানের মাতা হইয়া তাহার অধিকার। স্বামীর পত্নী হইয়া তাহার অধিকার। আমি সমাজের এ বিধান মর্মে স্বীকার করি নাই। নেহাৎ অশিক্ষিতা কি আমি? সন্তানে যেমন পিতার রক্ত আছে, তেমনই মাতারও আছে। নারী মানুষ হিসাবে পূর্ণ। আমরা সকলেই সারদার অংশ। সারদা স্বয়ং ভগবতী! 

এত কথা কেন লিখিতেছি জানি না। সংসার আমাকে লইয়া বহু খেলা খেলিয়াছে। আমার শ্বশুর মহাশয়, শাশুড়ি আমাকে কোল দিলেন, কিন্তু কী এক অলঙ্ঘ্য বিস্মরণে কখনও নিত্যপূজার অধিকার, ঠাকুরঘরে প্রবেশের অধিকার উচ্চারণ করিলেন না। গঙ্গাজলে সকল কলুষ, সকল পাপ ধৌত হয়, কিন্তু জন্মদাগ মুছে, সে শক্তি স্বয়ং ত্রিভুবন-তারিণীর নাই! জগতে কতই দেখিয়াছি, কতই বুঝিয়াছি। আজ হৃদয়ে কেবল তোমাদের জন্য মায়া। আপনার কথা কাহাকে বলিব? সে তো স্বভাব নহে। তবু, আজ আমাকে কথায় ধরিয়াছে। আপনার সকল কথা, সকল দুঃখ উজাড় করিয়া দিতে প্রাণ চাহিতেছে। বয়সের হাত ক্লান্তি বোধ করে। অসাড় হইয়া আসিতে চায়। লিখনে গতি নাই। শৃঙ্খলা নাই। তবুও বলিতে সাধ হইয়াছে। কাহাকে বলিব? তুমি কন্যাসন্তান। তোমাকেই বলি। তুমি বুঝিবে। 

পূর্ণ ত্যাগ ও পূর্ণ গ্রহণ-দুই পিতা-মাতার মধ্যস্থলে আমি ওই নিষেধের বৃত্তে একলা রহিয়া গিয়াছিলাম। মানুষ তো আমি। কন্যাই শুধু নহি। বধুই শুধু নহি। মাতাও শুধু নহি! আমি তো মানুষ। যাঁহারা আমাকে ত্যাগ করিলেন, তাঁহারা আমার হৃদয়ের কথা ভাবিলেন না। যাঁহারা হৃদয় ভাবিয়া আমাকে গ্রহণ করিলেন, তাঁহারা সম্মান সম্পূর্ণ করিলেন না। মানুষ হিসাবে আমার কী পরিচয় হইল? কোথায় পরিচয় হইল? আমি কে? কোন পরিবারের? এই পরিবার যদি আমাকে কোল দিল তবে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিকে পূজা করিবার অধিকার কেন দিল না? সত্যই কি আমি গৃহীত হইয়াছিলাম? আমি হৃদয়ের অভ্যন্তরে যাঁহাকে পুষ্পাঞ্জলি দিয়াছি, সেই ঈশ্বরের কোনও জাতি নাই, ধৰ্ম্ম নাই, উচ্চবৰ্ণ- নীচবর্ণ নাই। জগদীশ্বরী-বিশ্বেশ্বর আমার আমার পূজা নেন। সামান্য গেরস্তের সামান্য ঠাকুরকে আমি ত্যাগ করিয়াছিলাম। 

এই জিজ্ঞাসা, এই অভিমানই আমার সম্বল ছিল। আমার আত্মসম্মান ছিল ইহাতেই। তাহা ভাঙিল। আজ বুঝিয়াছি, আমি কেহ নই, বধু হইয়াও কেহ ছিলাম না, মাতা হইয়াও কেহ ছিলাম না, এমনকী আমার পৌত্র-পৌত্রী সব অপেক্ষা করিয়াছিল, সিংহাসন স্পর্শ করাইয়া আমার সম্পূর্ণতার … তুমি বুঝিবে…আমি…. 

.

এরপর আর নেই। আর পড়া যায়নি যা ছিল। এরপর সব শূন্য। সব। নয়াঠাকুমা তিনি; নবমী, নয়মি, নয়া তিনি…তাঁর অনুপস্থিতির মতোই বিশাল শূন্য সাদা পাতা 

সিদ্ধার্থর চোখে জল এসে যাচ্ছিল। মনকে দৃঢ় করছিল সে। দৃঢ়তর করছিল। মানুষ আসে। ভালবাসে। চলে যায়। যারা থাকে, তাদের অনেক কাজ। তারও অনেক কাজ। সামনে পড়ে আছে দীর্ঘ যুদ্ধের আহ্বান। সে মনে মনে নয়াঠাকুমাকে প্রণাম করে। এবং ভবিষ্যতের দিকে, ধূলামাটি গ্রামের দিকে, এই জেলা মুর্শিদাবাদের এবং এই দেশ ভারতবর্ষের সকল মানুষের তরে রচনা করে অমর অক্ষুণ্ণ অগ্রগমনের পথ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *