রাজপাট – ১০১

১০১ 

ডানা ভেঙে ঘুরে ঘুরে প’ড়ে গেলো ঘাসের উপরে;
কে তার ভেঙেছে ডানা জানে না সে;-আকাশের ঘরে
কোনোদিন—কোনোদিন আর তার হবে না প্রবেশ?
জানে না সে; কোনো এক অন্ধকার হিম নিরুদ্দেশ
 ঘনায়ে এসেছে তার? জানে না সে, আহা,
সে যে আর পাখি নয়-রঙ নয়—খেলা নয়—তাহা 
জানে না সে;—ঈর্ষা নয়—হিংসা নয়— বেদনা নিয়েছে তারে কেড়ে!
সাধ নয়—স্বপ্ন নয়—একবার দুই ডানা ঝেড়ে 
বেদনারে মুছে ফেলে দিতে চায়; রূপালি বৃষ্টির গান, 
রৌদ্রের আস্বাদ 
মুছে যায় শুধু তার, মুছে যায় বেদনারে মুছিবার সাধ। 

.

ফিরে আসছিল একা সে। একা। বিধুর বিষণ্নতায়। বুকের ভিতর তার বিচ্ছেদবেদনার ভার। বিচ্ছেদ, ভার লাঘবও করে দেয়। জমিয়ে তোলা যত ভারে নুয়ে পড়া মেরুদণ্ড দেয় সোজা করে। তবু, থাকে কিছু বিচ্ছেদজনিত যন্ত্রণা। তাকে এড়াবার সাধ্য নেই তার। 

সে ভাবছিল তার নিজেরই বলা কথা। সে বলেছিল, এ অভিমান নয় শুধু। তার চেয়ে বেশি কিছু। কিন্তু ব্যাখ্যা ছিল না তার কাছে। কেন ছিল না? তার তো সিদ্ধান্ত বিষয়ে কোনও দ্বিধা নেই। তবু কেন ছিল না? হৃদয়ের সত্যকে আশ্রয় করেছিল সে। উপলব্ধির সত্যকে। তবু ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। এ কী! এ কি অস্পষ্টতা? এ কি জটিলতা? সে বলতে পারত না স্পষ্ট করে, সে কী অনুভব করে? সে কি সরাসরি দাবি করতে পারত না, ওই লোকটিকে দল থেকে বহিষ্কার করুন! 

বললে কী হত? রাসমোহন দত্ত পালটা যুক্তি সাজাতেন। ওই লোকটির ওপর রাসুদার বিপন্ন নির্ভরশীলতা কি বোঝেনি সে? বুঝেছে! 

তা ছাড়া এমন সংহারী শক্তি এই দলে ঝাঁকে ঝাঁকে আছে। সর্বস্তরে আছে। বহিষ্কারের দীর্ঘ তালিকা কোথায় ঠেকবে, কে বলতে পারে! 

পরম নিষ্ঠাবান, সৎ নেতা যাঁরা রয়েছেন আজও, কী ভেবে বহিষ্কারের দাবি তাঁরা তোলেন না? দলীয় স্বার্থ ভেবেই তো! প্রত্যেকটি মানুষ আলাদাভাবে জটিল। আলাদাভাবে সৎ বা অসৎ। প্রত্যেকটি মানুষ পৃথকভাবে একক সংগঠন। কোনও নির্দিষ্ট আদর্শের ছাঁচে তাদের আদল দেওয়া যায় মাত্র। সমগ্র আচরণ ও ব্যবহারবিধি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এ কথা মনে রাখতেই হয়। মেনে নিতে হয় বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতিকারক আচরণ। বৃহত্তর স্বার্থের রক্ষার জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জনের সহজ তত্ত্ব। এ তত্ত্ব কার্যকরী কিন্তু গোল বাঁধে তখনই, যে-স্বার্থ ক্ষুদ্র ভাবা গিয়েছিল, তার ফলাফল ও পরিণতি যদি দাঁড়ায় গভীর ও সুদূরপ্রসারী। তবুও কোথায় একটা নির্ভরশীলতা থেকেই যায় অসৎ প্রকৃতির ওপর। তাড়াতে চাইলেও তাড়ানো যায় না। এই রাজনৈতিক বন্ধন—এখানে জট পাকিয়ে গ্রন্থিবদ্ধ হয়ে যায়, গ্রন্থি হয় জটিল। 

সত্য স্বচ্ছ। অস্পষ্ট নয়। সত্য সরল। জটিল নয়। তবু সত্যের রূপ ধরা পড়ে না অবিকল। কারণ সত্য স্বচ্ছ হয়েও অস্বচ্ছ, সরল হয়েও জটিল। কারণ সত্য একক নয়। একরৈখিক নয়। এক সত্যের মধ্যে জড়িয়ে থাকে আরও বহু সত্য। একাধিক সারল্যের সমাবেশে তৈরি হয় সত্যের দুর্বোধ্য জটিলতা। 

ভাবতে ভাবতে চলেছিল সে। পথের বাতিস্তম্ভগুলির তলায় তার ছায়া তাকে অনুসরণ করছিল। এখন প্রায় ঘুমন্ত এই আদি ব্রহ্মপুর ভূখণ্ড। প্রায়, কেন না, সকল ঘুমের মধ্যেও কোথাও ফুটে থাকে জাগরণ। কোনও পাখি জেগে থাকে। কিংবা কোনও নিশ্চুপ লোক। অথবা নিদ্রাহীন পাগল কোনও। যেমন, সে দেখেছিল, ধ্বস্ত ‘প্রথম পাঠ’ ইস্কুলের নীচে এক পাগল তরুণ, খানিক আগেই সিদ্ধার্থকে দেখামাত্র সে ছুটে এল। বলল—একটা খবর দিতে পারি আপনাকে। 

—কী! 

জিগ্যেস করেছিল সে। দেখছিল, সেই পাগল ইতস্তত তাকাচ্ছে চারদিকে। যেন-বা ভীত অস্থির। তার দেহের পরতে পরতে এখনও ময়লা বসেনি। শুধু রুক্ষতা আপাদমস্তক। আত্মীয় পরিবারের নজর এড়িয়ে সদ্য ঘরছাড়া বুঝি সে। সিদ্ধার্থ দেখছিল তাকে। সে বলেছিল- গোপন খবর। খুবই গোপন। ওরা যদি জানতে পারে, আমাকে খুন করে ফেলবে। 

—কারা? কী খবর? 

—বলব। আরেকদিন। এখন যাই। 

ফিসফিস করে বলেছিল কথা। মিশেছিল অন্ধকারে। এমত ব্যতিক্রমী জাগরণ পার হয়ে সে গৃহে প্রবেশ করছে যখন, এক আবাহন এল—সিদ্ধার্থ। শোনো। 

দাঁড়াল সে। এ কণ্ঠ তার নিত্যকার জানা নয়। তবু যেন পরিচিত লাগে। তখন অন্ধকার হতে বেরিয়ে আসছেন সেই স্বরের অবয়ব। একাকী। সিদ্ধার্থ দেখল, তিনি দেবেশ্বর সাধুখাঁ। 

ইতিমধ্যেই তাঁর দেহে এসেছে শীর্ণতা। মাথার চুলগুলি সম্পূর্ণ সাদা হয়ে গেছে। চোখের নীচেকার কালিমা পথবাতির আলোর নীচে স্পষ্টতর, যা দেখলে বেদনা জাগে, ভয় হয়, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফিনকি রক্তের ধারা। সিদ্ধার্থ তাঁকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। বলে—আপনি! 

দেবেশ্বর বলেন—এসেছি অনেকক্ষণ। রাসু এসেছিল, তাই আর ডাকিনি তোমায়। 

সে ত্রস্ত হয়। বলে—এতক্ষণ বাইরে রয়েছেন! ছি-ছি! এভাবে একা একা! 

—একাকীত্বে আমার আর ভয় নেই সিদ্ধার্থ। মারলে মারবে। ওই দেবতুল্য মানুষ যদি প্রকাশ্যে খুন হতে পারেন তা হলে আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা কিছু নেই, এটা মেনে নেওয়া ভাল। 

—দেবেশ্বরকাকা, স্কুলে আপনি আমার বাবার সঙ্গে পড়তেন। আপনি আমার পিতৃতুল্য। সেই অধিকারে বলছি, এত উদাসীন হওয়া ঠিক হয়নি আপনার। চলুন ভিতরে চলুন। 

—চলো। 

দেবেশ্বরকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল না সিদ্ধার্থ। বসল নীচেই। বসার ঘরে। সাবিত্রীকে যাতে বার বার দরজা খুলতে বন্ধ করতে না হয় তার জন্য চাবি নিয়ে বেরিয়েছিল সে। তবু তার সাড়া পেয়ে সাবিত্রী নীচে নেমে এলেন। কিছু লাগবে কি না জানতে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সিদ্ধার্থর, সাবিত্রীকে দেখলে মনে হয় এখন, তিনি কোনও স্নেহশীলা আত্মীয়াই বুঝি। দেবেশ্বর লেবু-চা চাইলেন এককাপ। সিদ্ধার্থও তা পান করার ইচ্ছে প্রকাশ করল। সাবিত্রী চলে গেলেন। 

দেবেশ্বর বললেন—তুমি জানো সিদ্ধার্থ আমি কী মানসিক অবস্থায় রয়েছি! 

—জানি কাকা। 

—পরপর দু’টো হত্যা সিদ্ধার্থ, আমি বিপর্যস্ত হয়ে গেছি। দাদার শোক সারাজীবনেও সামলে নিতে পারব না। তবু, সময় মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু জানো। ভেবেছিলাম, সময়ের পরতে পরতে সমস্ত ক্ষোভ, শোক, যন্ত্রণা চাপা পড়ে যাবে। সময়ের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে! এরই মধ্যে উনি চলে গেলেন! মানুষ বোধহয় ক্রমশ আরও নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে। আদিম হিংস্রতা ফিরে আসছে। দাদার মৃত্যুর প্রতিবাদে যে-মিছিল হয়েছিল, তাতে দল নির্বিশেষে লোকে যোগ দিয়েছিল। কেঁদেছিল জানো। লোকে কেঁদেছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি একা নই। কত লোক ভালবাসে দাদাকে! আবার একই দেখলাম। রাজীবজিকে আমরা ব্যক্তিগত পরিচয়ে জানি। দাদা ওঁকে গভীর স্নেহ করতেন। বলতেন, ‘রাজীবের মধ্যে একজন সত্যিকারের শিক্ষিত পরিশীলিত মানুষকে খুঁজে পাই আমি। ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চ ওঁর জায়গা নয়।’ সেই রাজীব—কী বীভৎসভাবে খুন হয়ে গেলেন। ওঁর জন্যও আমি দেখেছি লোকে কাঁদছে। যত অরাজনৈতিক মানুষ, তাঁরাও কাঁদছেন। যে-সব মহিলারা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে ভাবেন না পর্যন্ত, তাঁরাও এমনকী রাজীবকে স্মরণ করে কেঁদেছেন দেখেছি আমি। ওই সৌম্যকান্তি আধুনিক মনস্ক পুরুষ, ভারতবাসীর হৃদয়ে তিনি ধীরে ধীরে নেতার আসন গড়ে নিচ্ছিলেন। চলে গেলেন। বড় ফাঁকা লাগছে। কংগ্রেসের পক্ষে এই দু’টি ক্ষতি অপূরণীয়। মাঝে মাঝে সংশয় দেখা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, কংগ্রেস কি পুরনো মহিমায় পুনরুজ্জীবিত হতে পারবে? পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রচণ্ড শক্তি দরকার। এত বিপর্যস্ত আমি, এত শঙ্কিত, তবু আমি তোমার কাছে এসেছি এই রাত্রে। কেন জানো? 

—না কাকা। 

—সিদ্ধার্থ, তোমার মধ্যে প্রতিবাদের আগুন আছে। সে আগুনকে আমি শ্রদ্ধা করি। দাদার নৃশংস হত্যার বিরুদ্ধে তুমি যে-প্রতিবাদ করেছ সিদ্ধার্থ, আমরা কেউ তার কিছুমাত্র পারিনি। পুরো ঘটনার যথাযথ তদন্ত অবধি হল না এখনও। আমরা তা করাতে পারলাম না। 

সিদ্ধার্থ নীরব। স্থির শুনছে। দেবেশ্বর বলছেন—দাদা তোমাকে চিনেছিলেন। বলতেন, ছেলেটার মধ্যে আগুন আছে। একদিন ও জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু সি পি আই এম ওর দল নয়। কারণ সি পি আই এম তরুণ নেতৃত্বকে সহজে স্বীকৃতি দেয় না। এই দলের নেতৃত্ব দেয় পক্ককেশ তাত্ত্বিকরা। যতদিনে ওর নেতৃত্বের সুযোগ আসবে, ততদিনে ওর আগুন নিভে না যায়। 

সিদ্ধার্থ প্রতিবাদ করে এখানে। বলে—তা কেন? সমস্ত জেলায় সি পি আই এম-এর যুবনেতারা রয়েছেন। আমার তো মনে হয়, এই দল একেবারে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের থেকে নেতৃত্বক্ষমতা বেছে নিয়ে সংগঠিত করতে যতখানি তৎপর, ততখানি আর কেউ নয়। 

—একটা বিশেষ স্তর পর্যন্ত। তারপর? রাজ্য স্তরে ক’জন আছেন? 

—অনেকেই আছেন। স্বপ্ন সোম, ধীরাজ সরকার, খায়রুল করিম, সুমন চক্রবর্তী, শুদ্ধময় সেনগুপ্ত। 

—এঁরা কি সেই অর্থে তরুণ? 

—না। তবে বৃদ্ধও নন। এমনকী প্রৌঢ়ও নন কেউ। যথেষ্ট দায়িত্ব এঁদের দেওয়া হয়েছে।

—না। হয়নি। যাঁদের নাম করলে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় কে জানো? 

—কে? 

—শুদ্ধময় সেনগুপ্ত। কিন্তু দেখো, ওঁকে কোন কোন দপ্তর দেওয়া হয়েছে? সবচেয়ে গুরুত্বহীন, সবচেয়ে কম কাজের জায়গা। সে যাই হোক, এই নিয়ে তর্ক করতে আমি তোমার কাছে আসিনি। আমি জানি তুমি নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলছ। সতেরোই মে যে-মিছিল তুমি করেছ, তা ঐতিহাসিক। এ মিছিল তুমি কেন করলে? এ কি তোমার শক্তি প্ৰদৰ্শন? 

—না। এ আমার কাজ। 

—আমার বিশ্বাস, এ এক বিচ্ছিন্ন সাফল্য। তোমার ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে, তা প্রয়োগ করতে গেলে, তোমাকে কোনও দলে যোগ দিতে হবে। দলীয় পরিকাঠামো ছাড়া কাজ করা যায় না। একথা কি তুমি ভেবে দেখেছ? 

—ভাবছি। 

—সিদ্ধান্ত নিয়েছ কিছু? 

—না। 

—তুমি কংগ্রেসে যোগ দাও সিদ্ধার্থ। 

সাবিত্রী চা রেখে গেলেন। দু’টি মানুষ নিঃশব্দে চুমুক দিল চায়ে। মুখোমুখি চেয়ারের মাঝখানে ধ্যানী বুদ্ধের মতো বসে রইল নীরবতা। অবশেষে দেবেশ্বর বললেন – বলো, সিদ্ধার্থ। 

সিদ্ধার্থ সোজা তাকাল দেবেশ্বরের চোখের দিকে। পুরু কাচের অন্তরালে চিকিৎসকের দু’টি মোহময় চোখ। তার নীচে জমে দুঃখের হতাশার নিবিড় জমাট চাপ চাপ অন্ধকার। কোনও চিকিৎসায় আর তা সারানো যাবে না। কোনও প্রসাধনী ঘষে তা তুলে ফেলা যাবে না। এই সবই গভীর নিরিখ করে সে স্পষ্ট বলল—আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি পারব না। 

—কেন নয়? সিদ্ধার্থ? তোমার চারপাশ নিঃশত্রু নয়। একা তুমি কী করবে? কংগ্রেস একটি জাতীয় দল। ঐতিহাসিক দল। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের এই কোণঠাসা অবস্থায় তোমাকে পেলে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি। 

—আমাকে ক্ষমা করবেন। 

—ভেবে দেখো সিদ্ধার্থ। তুমি সি পি এম ছেড়েছ। সকলেই ভাবছে তুমি কংগ্রেসে যোগ দেবে। এমনকী পবিত্র জোয়ারদার পর্যন্ত তোমাকে দলে নিতে আগ্রহী। কিন্তু আমার বিশ্বাস বি জে পি-তে তুমি কখনও যোগ দেবে না। 

—আপনি ঠিকই বুঝেছেন। 

—তা হলে আর জায়গা কোথায় বলো? কংগ্রেসে তোমার যোগ দেওয়া নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। যেমন আসাদুর চায় না তুমি কংগ্রেসে আসো। কিন্তু আমরা অনেকেই চাই। এ নিয়ে জনমতও আমাদেরই পক্ষে। তোমার বাধা কোথায় সিদ্ধার্থ? যে-দল তঞ্চকতা করে ক্ষমতায় আসে, জোচ্চুরি করে, রিগিং করে হত্যা করে গণতন্ত্রকে, সেখানে তোমার মতো সৎ রাজনৈতিক কর্মীর স্থান কোথায়? সেই দল তুমি সর্বাংশে ছাড়তে পারছ না কেন? 

সিদ্ধার্থ সোজা হয়ে বসে। ভিতরে ভিতরে বোধ করে উত্তেজনা। বলে— সর্বাংশে ছাড়া সম্ভব নয় কারণ আমি যা শিখেছি, যা জেনেছি, তা ওই দলেই। তত্ত্বগতভাবে বা আদর্শগতভাবে দলের সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই। আমার প্রতিবাদ অন্য জায়গায়। সেটা আমি এখন ব্যাখ্যা করব না। কিন্তু আপনার কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলি, রিগিং করে সার্বিক জয় লাভ করা যায় না। জয়ের জন্য সাংগঠনিক জোর লাগে। আপনাদের তা নেই। বিরোধী দল হিসেবে আপনারা ব্যর্থ। যেমন পশ্চিমবঙ্গে শাসকদল হিসেবেও আপনারা ব্যর্থই ছিলেন। এ বারের কথাই ধরুন না। এবার তো রিগিং আটকানো হয়েছিল এখানে। তা হলে আপনারা আসতে পারলেন না কেন? তা ছাড়া রিগিং কারা শুরু করেছিল দেবেশ্বর কাকা? কংগ্রেস করেনি? কংগ্রেসের প্রদর্শিত পথেই চলছে আজকের অসততা। প্রকাশ্যে গুন্ডা দিয়ে ভয় দেখাত না আপনাদের নেতারা? সত্তরের দশককে ভুলিনি আমি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কোনও দিনই ওই সময়ের ইতিহাস ভুলবে না। 

—তখন তোমার বয়স কত সিদ্ধার্থ? 

—তেষট্টিতে জন্ম আমার। সত্তরের দশকে আমার বয়স দশ পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে কী? অত্যাচারের ইতিহাস জানতে গেলে শতাব্দীপ্রাচীন হওয়ার দরকার হয় না। কী দিয়েছিল তখন কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গকে? সেমি-ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিলেন আপনারা তখন। হাজার হাজার কমিউনিস্টকে হত্যা করেছেন। তার জন্য গ্রেপ্তার হয়নি একজনও। বাহাত্তরের বিধানসভা নির্বাচনে কী পরিমাণ রিগিং হয়েছিল মনে করে দেখুন। জরুরি অবস্থার সময় মানুষের জীবনের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন আপনারাই। হাজার হাজার মানুষকে জেলে পুরে কোনও বিচার ছাড়াই ফেলে রেখেছিলেন। সেইসব ভুলি কী করে বলুন? 

—তুমি এক দিক থেকে দেখছ সিদ্ধার্থ। তা ছাড়া কংগ্রেসের অবস্থান এখন অনেক পালটেছে। 

—কিছুই পালটায়নি। নিজেদের মধ্যে দলাদলি করে আপনারা দুর্বল হয়ে পড়েছেন, তাই। নইলে মনে করে দেখুন মাত্র দু’বছর আগে পাশের রাজ্যে কী হয়েছিল। 

—কীসের কথা বলছ? 

—কমিউনিস্ট পার্টি করার অপরাধে উমা মৌলিক নামে এক মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানো হয়েছিল প্রকাশ্য রাস্তায়। কারা করেছিল? কংগ্রেসেরই সমর্থক তারা। সমাজবাদী পার্টির উত্থান হওয়ায় ওখানে কংগ্রেস এখন কোণঠাসা। কিন্তু তাতে কী! 

—কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে তুমি দলীয় চরিত্র বলতে পারো না। 

—না। পারি না। কংগ্রেসে পরমেশ্বর সাধুখাঁর মতো নেতাও ছিলেন। এগুলো সবই বললাম আপনার সি পি এম-কে সমালোচনা করার জবাব হিসেবে। এবং এটা বোঝাবার জন্য যে আমি দল ছেড়ে দিয়েছি মানেই আমি কংগ্রেসে বা বি জে পি-তে যোগ দিতে যাচ্ছি না। 

—তোমাকে আর কিছুই বলার মুখ নেই আমার। কিন্তু সিদ্ধার্থ, ভেবে দেখো, এই যে তুমি মিছিল করলে, তোমার মিছিলের সাফল্য কিন্তু এ জন্যই যে, তুমি সি পি এম ছেড়েছ এবং মানুষ তোমার মধ্যে কংগ্রেসে যোগদানের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে। আমি নিশ্চিত, কংগ্রেসের সমর্থকরাই তোমার মিছিলকে সফল করেছিল। অতখানি আনুগত্যের সঙ্গে মিছিল করতে পারে একমাত্র কংগ্রেসিরাই। 

সিদ্ধার্থ চুপ করে রইল। এরকম একটি দাবি রাসুদাও করেছিলেন বলে মনে পড়ল তার। সে প্রতিবাদ করল না। দলমত বিচার করে সে মিছিলের আহ্বান জানায়নি। সে ছিল মানুষের জন্য মানুষের মিছিল। জীবনের জন্য মানুষের মিছিল। 

তার নীরবতাকে অগ্রাহ্য করে দেবেশ্বর বললেন— দাদার হত্যা আমাকে নতুন দায়ে ফেলেছে সিদ্ধার্থ। মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না করে আমার মুক্তি নেই। আগামী লোকসভা নির্বাচনে তুমি নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়াও। প্রচারের জন্য সমস্ত খরচ আমি দেখব। আমি জানি তুমি জয়ী হবে। এখুনি কংগ্রেসে যোগ না দিয়ে, সেইসময় কংগ্রেসকে সমর্থন করবে তুমি 

সিদ্ধার্থ হাসল। বলল—ভেবে দেখব। 

—ভাববে? 

—নিশ্চয়ই! আমার এখন অনেক ভাবনা। 

—তোমার এ কথা কি আমি সম্মতিসূচক ধরে নিতে পারি? 

—তা হলে আর আমার ভাবনার অবকাশ কী রইল? 

—উঠি তা হলে? 

—চলুন এগিয়ে দিই আপনাকে। 

—না না। আমি একাই চলে যাব। এমন গভীর রাত্রে কতদিন যে একা একা হাঁটিনি।

—আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে। আপনি না বলবেন না। 

—বেশ। চলো। 

আবার এক নীরব পথ চলা। যেন একই নাটক অভিনীত হয়ে চলেছে প্রহরে প্রহরে। আপন দুয়ারে পৌঁছে দেবেশ্বর বলছেন—তোমার বাবা আমার বন্ধু ছিল। 

—জানি। 

—ওর ওই ভয়ংকর পরিণতির কথা ভাবলে কষ্ট হয় আমার। 

সিদ্ধার্থ চুপ করে থাকল। কেন এসব কথা? ওই পরিণতিকে সে স্মরণ করতে চায় না।

দেবেশ্বর বলছেন তখন—তুমি আমাদের স্নেহের পাত্র। আবার শ্রদ্ধারও পাত্র তুমি। তোমার মঙ্গল হোক। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *