রাজপাট – ১০৩

১০৩ 

যখন চিনির দাম বেড়ে গেছে ভয়ংকর
তারা খায় স্বেচ্ছায় নুনের পরিজ।
সমস্ত ভন্ডুল হয়ে গেলে সব পৃথিবীর, 
মসৃণ টেবিলে বসে খেলে যায় ব্রিজ।
জীবনকে স্বাভাবিক নিশ্বাসের মতো মেনে নিয়ে 
মঞ্চে বক্তৃতা দেয় কর গুনে-কুকুর ক্ষেপিয়ে। 
বলে গেল অত্যন্ত অদ্ভুত এক টুপিব্যবসায়ী নেমে এসে, 
যেখানে সম্ভ্রম করা সমুচিত সেখানে ভাঁড়ের মতো হেসে। 

.

‘প্রথম পাঠ’ স্কুলের সামনে একা এসে দাঁড়াল সিদ্ধার্থ। রাত্রি গভীরে গড়ায়নি এখনও। সবে দশটা। রিকশা চলাচল করছে। কিন্তু এরই মধ্যে পথে জনবিরলতা। 

তার আশেপাশেই রয়েছে মির্জা। তৌফিক। বসির খান। একটা সিগারেট ধরিয়ে ল্যাম্পপোস্টের পেছন দিকে দাঁড়িয়েছে সিদ্ধার্থ। একটি অনুমানভিত্তিক পরিকল্পনা করেছে তারা। হতে পারে এই অনুমান তাদের নিয়ে যাবে বাঞ্ছিত সমাপ্তির শেষ যবনিকাপাতে। জীবনের সমস্ত রহস্যজটিলতাকে যদি স্বচ্ছ ও সরল করে দেয়া যেত! আঃ! সে হত সুখের সময়, সে হত এক রোদ্দুরের প্রকাশ। ভাবছে সিদ্ধার্থ। লক্ষ রাখছে। 

দাঁড়াতে হল না বেশিক্ষণ। সে এল। দাঁড়াল সিদ্ধার্থর পাশে। নিঃশব্দে। সিদ্ধার্থ টেরও পেল না। হঠাৎ সে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল—আগুন আছে? 

চমকে তাকাল সিদ্ধার্থ। সেই পাগল। সেই রকমই উশকোখুশকো কিন্তু পরিষ্কার। সিদ্ধার্থ কোনও কথা না বলে দিয়াশলাই এগিয়ে দিল। তখন সেই পাগল বলল— সিগারেট আছে? 

সিগারেট এগিয়ে দিল সিদ্ধার্থ। পাগল তা ধরাল। টানল লম্বা করে। দিয়াশলাই সিদ্ধার্থকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল—রোজ ভাবি আর আসব না। তা হলে আসি কেন? 

সিদ্ধার্থ বলল—কেন? 

সে সতর্ক হল। আজ ব্যবস্থা করা আছে। মির্জার ছেলেরা ঘিরে আছে চারপাশ।

পাগল বলল—গোপনীয়। খুব গোপনীয়। বললেই ফ্যাঁস্‌স্‌স্‌! 

হাত দিয়ে গলার নলি কেটে দেবার ভঙ্গি করল সে। বলল— পালিয়ে এসেছি। আমাকে খুঁজছে তো। তবে এটাই সবচেয়ে ভাল জায়গা। এইখানে আসবে না। মরে গেলেও না। এখানে এলেই তুলোর বীজের মতো শিশুবীজ। লক্ষ লক্ষ শিশু। ও তখন মেয়েকে খুঁজবে। লক্ষ লক্ষ শিশুর মধ্যে নিজেরটা খুঁজবে। পাবে না। আলাদা করে চিনতে পারবে না। ও তখন পাগল হয়ে যাবে। পাগল হতে কে চায় অ্যা। আমি চাই না। ও চায় না। তাই ও এখানে খুঁজবে না। আর সব জায়গা খুঁজবে। 

—কে খুঁজবে? কেন? 

—যদি বলে দিই সব! আগুন নিয়ে খেলা করা ভাল নয়। 

হঠাৎ এক দৌড়ে গিয়ে সিঁড়ির ওপর বসল পাগল। ‘প্রথম পাঠ’ স্কুলে প্রবেশের প্রথম দু’টি ধাপ, তার ওপর। তারপর কাঁদতে শুরু করল। ইঁঃ হিঃ ইঁঃ হিঃ শব্দ উঠছিল তার স্বরে। মুখ বিকৃত হয়ে গেল সম্পূর্ণ। মুখের বিবর বৃহৎ করে দুলে দুলে সে কাঁদছে। সিদ্ধার্থ দেখল তার নাক দিয়ে মোটা হয়ে ঝুলে পড়ছে শিশুঘাণ। তার সমস্ত শরীর ঘৃণায় গুলিয়ে উঠল। এই পাগলের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে না। মায়া জাগিয়ে তোলে না। এমনকী এই লোকটির চোখে সে উন্মাদনা দেখছে না। চোখ দু’টি চঞ্চল ঠিকই। কিন্তু সতর্কও। হতে পারে এই লোকটি সবে এলোমেলো হতে শুরু করেছে। সম্পূর্ণ পাগল হয়ে যায়নি। সে দ্রুত ভাবতে থাকল। এই কান্না দেখে কি লোক জমে যাবে না? এত রাত্রে তার সম্ভাবনা কম। এবং হতে পারে, ইদানীং প্রায়ই এই ঘটনা ঘটছে বলে লোকের ঔৎসুক্য কমে গেছে। 

এই লোকটির বলা কথাগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকল সে। টুকরো টুকরো শব্দ ঘুরতে লাগল মস্তিষ্কে। আঘাত করতে থাকল। সহসা তার চেতনা ঝাঁকুনি খেয়ে জেগে উঠল। পাপ করা সহজ। কিন্তু পাপ পরিপাক করা দারুণ কঠিন। ন্যায়-নীতিবোধ, বিবেক দংশন ইত্যাদি মানুষকে সহজে অব্যাহতি দেয় না। জেলে, সে জানে, সারি-সারি বসে থাকে মানসিক ভারসাম্য হারানো মানুষ। সে দেখেছে। জেলের অধিকর্তার সঙ্গে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছে একদিন। একটি ঘরে সারিবদ্ধ বসে ছিল তারা। সরল নিষ্পাপ মুখ। ভাষাহীন। তারা যে গিয়েছিল, দাঁড়িয়েছিল কাছে, তার জন্য তাদের দৃষ্টিতে ঔৎসুক্য ছিল না কোনও। পলক পড়ছিল না পর্যন্ত অনেকের। জীবন্ত মর্মরমূর্তির মতো সব। এত নিরুত্তাপ, নিরুত্তেজ ছিল তারা যে, সিদ্ধার্থর কষ্ট হচ্ছিল। সে শুনতে পাচ্ছিল এই শত মানুষের হৃদয়ের চাপা নিরুচ্চার কান্না 

অধিক খুনের আসামিই তারা ছিল। 

একবার শিউরে উঠেছিল সে নিজের কথা ভেবেও। হত্যার সিদ্ধান্ত তাকে কোনও পরিতাপ দেয়নি। তার স্নায়ু কি তবে অধিক শক্তির অধিকারী? 

ওই প্রকোষ্ঠের সামনে সে অধিকক্ষণ দাঁড়াতেও পারেনি। চলে এসেছিল। 

জীবন ও মৃত্যু সর্বদা সংলগ্ন পরস্পর। তবু জীবিতের কাছে মৃত্যুর দুঃসহ ভার বেদনার।

সে হারাধনের জন্যও চিন্তিত হয়েছিল। এবং মনে হয়েছিল তার, রাজনৈতিক হত্যার জন্য মানুষের স্নায়ু সহস্র বর্ষ ধরে প্রস্তুত থেকেছে। ব্যক্তিগত কাজের জন্য নয়। এ কারণেই হয়তো বা তার বিবেকদংশন হয়নি দীপেন হাজরাদের জন্য। এ কারণেই যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাষ্ট্রনেতা পাগল হয়ে যায় না। সহস্র হত্যা ও রক্তাক্ত দিবস-রজনী পার করেও স্বাভাবিক থাকে সৈন্যরা। 

সে সোজা গেল পাগলের সামনে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোনও ভূমিকা না করে বলল—তুমি হাফি, না বাপি? 

কান্না থেমে গেল লোকটার। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকল সে কিছুক্ষণ। মুখের হাঁ বন্ধ হল না। চোখের পলক পড়ল না। বোধহয় নিশ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াও সে ভুলে গেছে। 

তাকে দেখে ধীরে ধীরে আশা জাগছে সিদ্ধার্থর মনে। সম্পূর্ণ আন্দাজে, অনুমানে, সে এ প্রশ্ন করেছিল। ধরে নিয়েছিল, বৃথা যাবে। যেতেই পারে। তবু করেছিল। কিন্তু এই পাগল লোকের স্তম্ভিত ভাব তাকে উত্তেজিত করছে। 

তখন পাগল বলছে—আপনি আমাদের চেনেন? 

—চিনি। 

বলছে সিদ্ধার্থ। 

—আপনি আমাদের নাম জানেন? 

বলছে পাগল। 

হঠাৎ সমস্ত উত্তেজনা এবং আশঙ্কা ছাপিয়ে হাসি গুড়গুড়িয়ে উঠল সিদ্ধার্থর বুকের মধ্যে। এমত সংলাপ ভূতের রাজার সঙ্গে করেছিল গুপি-বাঘা। 

হাসির দমক গিলে ফেলে সে বলল—নাম জানি। ধাম জানি। কিন্তু তোমরা একরকম দেখতে বলে কে কোনটা বুঝি না। তুমি কে? 

—আমরা যমজ তো, তাই।

—তুমি কে? 

—সব কাজ একসঙ্গে করি। 

—তুমি কে? 

—এই স্কুলে আগুন দিয়েছিলাম। হ্যাঁ হ্যাঁ দিয়েছিলাম। ওকে না করলাম। বাচ্চাদের মারিস না। আহা! আ হা হা! শুনল না ও! শুনল না! আঃ! ইঃ হিঃ ইঃ হিঃ আ আ। আমি ঘুমোতে পারি না-আ-আ-আ। আমাকে ঘুমোতে দাও। ঘুমোতে দাও। ওঃ! সারাক্ষণ মাথার মধ্যে কচি বাচ্চাগুলো! ইঃ হিঃ ইঃ হিঃ! আ আ! 

কাঁপছিল সিদ্ধার্থ। এত সহজভাবে পেয়ে গেল! এত এত এত সহজ! চরম উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে গেল তার। সে তাকাল আশেপাশে। কেউ শোনেনি তো? দেখেনি তো? হাত নাড়ল সে। মির্জার ছেলেরা একটি বাইক নিয়ে এসে দাঁড়াল। 

সচকিত পাগল পালাতে যেতেই ধরে ফেলল তারা। সিদ্ধার্থ অন্ধকারের দিকে গেল। ঠিক করা আছে। মির্জার ছেলেরা একে নিয়ে যাবে খাগড়ার দিকে। তারা আলাদাভাবে যাবে। 

দূর থেকে দেখল সে, নিপুণ হাতে পাগলের মুখ চেপে ধরে প্রায় তাকে তুলে বসিয়ে দিল বাইকে একজন। অন্যজন দারুণ গতিতে চালিয়ে দিল বাইক। সে চিন্তিত হল। মাঝখানে বসে পাগল কিছু করে ফেলতে পারে। ঝাঁপ দিতে পারে। চিৎকার করতে পারে। মির্জা বলল—ভেবো না, সিধুভাই। ওরা সামলে নেবে। 

মির্জার আনা গাড়িতে উঠে বসল তারা। যেতে যেতে সিদ্ধার্থ বলছিল তার সঙ্গে পাগলের সংলাপ। এখন আর তার হাসি পাচ্ছিল না। হিংস্র হয়ে উঠেছে তার মন। সে একে একে প্রত্যেকের চোখ দেখার চেষ্টা করছে। একই হিংস্রতা সকলের চোখে। তার মনে হল, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠা ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোনও মানবিক গুণ অচল, নিরর্থক। হিংসা বন্ধ করতে গেলে প্রতিহিংসা নিবৃত্ত করা চাই। সিদ্ধার্থ বোঝে না, কতদূর, কত রক্তপাত, কত প্রাণহানি পর্যন্ত এই নিবারণ! হিংসার বদলে সহিষ্ণুতা, হিংসার বদলে শান্তির প্রস্তাব— তত্ত্ব হিসেবে বড়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং সহজ। কিন্তু বাস্তবে সম্ভব কি? 

খাগড়ার এই এলাকায় মির্জার কাছের লোক সাত্তারের বাড়ি। এই বাড়ি মির্জার গোপন ব্যবসার একটি কেন্দ্রও বটে। সিদ্ধার্থ এখানে আগে এসেছে কয়েকবার। 

একটি ঘরের মেঝেয় পড়ে আছে পাগল। হাত দু’টি পিছ মুড়ে বাঁধা। ভীত চাহনিতে দেখছে চারপাশ। সিদ্ধার্থকে দেখামাত্র সে ডুকরে কেঁদে উঠল—আমাকে বাঁচান। আমাকে মারবেন না। আমাকে বাঁচান। 

সকলে ঘিরে বসল তাকে। সিদ্ধার্থ জিগ্যেস করল—তুমি কে? 

—আমি? আমি বাপি। 

—সব বলো। হাফি কোথায়? তোমাদের এ কাজ করতে কে বলেছিল? কেন বলেছিল? তুমি কি সত্যি পাগল? 

—আপনি তো সিধুবাবু?

—হ্যাঁ। কেন? 

—আ-আমাকে বাঁচান। আমি আর রক্ত মাখতে চাই না। মা কসম! আল্লার কিড়া। আমি চাই না। রক্ত মাখতে চাই না। সিধুবাবু, সিধুবাবু, আমি খোলা বাঁচব না? সৎ বাঁচব না আর? আপনাকে বলব। সব বলব। সেদিন রাত্তিরে বলতাম। কিন্তু মনে হল ওরা দেখছে। 

—কারা? 

—ওই… ওই… ওরা! ওরা সব জায়গায় আছে বাবু। ঘরে, বাইরে, জুবানে, খিলাফে, হত্যায়, পৈশাচিকে! 

— বাজে কথা থামাও। তুমি বলো কী করেছ। কীভাবে করেছ? কেন করেছ? কত টাকার বিনিময়ে এই জঘন্য কাজ করা সম্ভব? কে তোমাদের এ কাজ করতে বলল? 

—সিধুবাবু, সিধুবাবু আমার বুক ফেটে যায় গো! আমার সিনায় ছ্যাঁকা লাগে। পোড়া মাংসের ছ্যাঁকা লাগে। আমি খেতে পারি না, শুতে পারি না। 

—পশুপতিবাবুকে তুমি কী বলবে বলেছিলে? 

—না। পাগল দেখাবার জন্য বলেছিলাম। পাগল হইনি তো আমি। ভান করি। ভান না করলে মেরে ফেলত আমাকে। আর কী বলব, ভান করতে করতেই একদিন হয়তো পাগলা বাপি হয়ে যাব আমি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, পাগলা বাপি। ওরা তখন পাগলা বাপিকে জানে মেরে দেবে। 

—কেন? 

—আমি ধরা দিতে চেয়েছিলাম। পুলিশে ধরা দিতে চেয়েছিলাম। এ কি একটা জীবন? এ কি বেঁচে থাকা? খুনের পেশা কি একটা পেশা? বুড়ো-ঝুড়ো মারি, সেও একরকম। কিন্তু শিশু? অতগুলি শিশু! ঘুমোতে পারি না। ওরা সারি সারি সামনে এসে দাঁড়ায়। কতদিন, কতদিন ঘুমোইনি সিধুবাবু! আঃ! পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। পারি না। মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মৃত্যুভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই। পাগল সেজে বেঁচে আছি। নইলে ওরা এতদিনে আমার নলি কেটে দিত। 

অসংলগ্ন বাক্যের মধ্যেকার নিহিত সারবত্তা গ্রহণ করতে থাকে সিদ্ধার্থ। তার স্নায়ু শীতল হয়। মায়া জাগে না, জাগে না এই অর্ধ্বোন্মাদের প্রতি। সে দু’হাত বুকের কাছে রেখে পরমেশ্বর মহাকালের মতো তাকায়। প্রশ্ন করে—কারা? 

—হাফি! হাফির লোক! ওকে বলেছিলাম, চল, পালিয়ে যাই। ভালভাবে বাঁচি। পরিশ্রম করব। ওর একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে। পরি। একেবারে পরি। মেয়েটার দিকে তাকালে আমি আগুন দেখতে পাই। শুধু আগুন দেখতে পাই। 

—পুলিশে যাওনি কেন? 

—কী হবে গেলে? মেরে দেবে। যারা কাজ দিয়ে থাকে, তাদের লোক থাকে পুলিশে। মেরে দেবে। পাগল বানিয়ে দেবে পিটিয়ে পিটিয়ে। ভয় করল। ভাবলাম, লোকে বলে, সিধুবাবু বড় নেতা, তার কাছে গেলে সমাধান পাওয়া যায়, আমিও যাই। বলি। বাকি শিশুগুলোকে তো আপনারাই বাঁচিয়েছেন। যাই। বলি। তাতে যদি ঘুম হয়। যদি একটু ঘুম হয়। ওঃ! কতদিন ঘুমোইনি বাবু 

—কে তোমাদের কাজ দিয়েছিল? 

—জানি না! বিশ্বাস করেন, জানি না।

—হাফি কোথায় আছে এখন? 

—কয়ায় আছে। 

—তোমাদের বাড়ি কয়ায়? 

—না। গুধিয়ায়। হাফি ঘুরে ঘুরে থাকে। এর মধ্যে জিয়াগঞ্জে একটা শরিকি মামলায় একজনকে হাপিশ করার কাজ নিয়েছিল। তারপর থেকে কয়ায়। শ্বশুরবাড়িতে। 

মির্জা শুনছিল। জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ। ক্রোধ, ঘৃণা, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষ মেশানো সকলের চোখে। তারই মধ্যে মির্জার চোখে অতিরিক্ত বিস্ময়। গুধিয়া এখান থেকে আধঘণ্টার পথ। এরই মধ্যে গজিয়ে ওঠা দু’জন পেশাদার সম্পর্কে খবর পৌঁছয়নি তার কাছে। কেন? সে সচকিত হয়। খবরের উৎসগুলো যথাযথ কাজ করছে না তার। সে দাঁতে দাঁত পেষে। আরও সাবধান হতে হবে তাকে। আরও বেশি সতর্ক। শুধু নিজের জন্য নয়। সিদ্ধার্থর জন্যও সে এই প্রয়োজনীয়তা বোধ করে। ইদানীং সিদ্ধার্থর নিরাপত্তা বিষয়ে সে চিন্তিত হয়ে উঠছে। তার কাছে খবর আছে, মিছিল করার পর, সিদ্ধার্থর এই বিপুল শক্তি যাদের অভিপ্রেত নয়, তারা গোপনে একত্রিত হয়েছিল। সি পি আই এম-এর মিহির রক্ষিত, আর এস পি-র আনিসুর রহমান, কংগ্রেসের আসাদুর রহমান। এঁরা কেউ-ই সিদ্ধার্থকে নিজের নিজের দলে প্রত্যাশা করেন না। এমনকী সিদ্ধার্থর সকল শক্তিকে পুঁটো করে দেওয়ার পক্ষে এঁরা অবিচল। এককাট্টা। যে-কোনও সময় সিদ্ধার্থর ওপর নেমে আসতে পারে চরম আঘাত। সিদ্ধার্থকে এ বিষয়ে সাবধান করে দেবে সে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু নিরাপত্তার পরিকল্পনা করবে। সিদ্ধার্থর কিছু হলে নিজেকে সে ক্ষমা করবে কী প্রকারে? সিদ্ধার্থর সম্পর্কে আগ্রহী একজন। সে মির্জার কাছে চোরাগোপ্তা অস্ত্র কেনে। লোক খাঁটি। মির্জা লোক চেনে। সিদ্ধার্থর জন্য তার জান কবুল। এখন সিদ্ধার্থর পক্ষে ভাল বহরমপুর ছেড়ে যাওয়া। কিন্তু কীভাবে এ কথা বলা যায়, মির্জা জানে না।

কিন্তু এই যদি জানকারি হয় তার, এই যদি যোগাযোগের নমুনা হয়, তবে সিদ্ধার্থ কী করে তার ওপর নির্ভর করবে? 

সে বলল—কতদিন করছ এ কাজ? 

—তা পাঁচ বৎসর। সব মিলিয়ে তারও অধিক। হাত পাকছিল চোদ্দো-পনেরো হতে। 

—কার কাছে কাজ শিখেছ? 

—বহুজনের কাছে। তবে ছাড়া ছাড়া। নিজেরাই নিজেদের গুরু আমরা। গুধিয়ায় আমাদের বাস আজ তিন বছর। তার আগে ছিলাম আমরা মালদহে। তার আগে ছিলাম ইসলামপুরে। প্রথম কাজ শিখেছিলাম যখন কাটিহারে থাকি। 

স্বস্তির শ্বাস ফেলল মির্জা। তা হলে এরা গুধিয়াতেই তৈরি হয়নি। হলে সে জানতই নিশ্চিত। সে সিদ্ধার্থর দিকে তাকাল। বলল—এবার কী করব আমরা? 

—হাফিকে ধরতে যাব। বাপি আমাদের পথ চিনিয়ে দেবে। কী বাপি? দেবে তো?

বাপি কান্না শুরু করল আবার। অনন্ত বিলাপ হতে সংলাপ চুরি করে হাঁ-মুখ কাঁদতে লাগল। তাকে দেখাল পাগলের মতোই। দুলে দুলে বলতে থাকল সে-আমি বলেছিলাম। মারিস না। শিশুগুলোর কী দোষ? মারিস না। ও শুনল না। বলল এরকমই নির্দেশ আছে। ইঃ হিঃ ইঃ হিঃ ইঃ হিঃ! হুঁ হুঁ হুঁ আ আ আ! 

সিদ্ধার্থ তাকে জিগ্যেস করল আবার—কে তোমাদের কাজ দিয়েছিল? 

—অ্যাঁ? 

—সুপারি দিয়েছিল কে? 

—জানি না। বিশ্বাস করেন। মুখ ঢেকে এসেছিল। সব টাকা আগাম দিয়েছিল। জানি না কে।

—তুমি যে বললে পুলিশে ওদের লোক থাকে। জানলে কী করে? 

—এতদিন লাইনে আছি, আন্দাজ হয়। 

—চলো। হাফিকে দেখিয়ে দেবে? 

—বাবু। মারবেন না তো আমাকে অ্যাঁ? মারবেন না তো? ইঁ হি হি! বাবু মরণকে বড় ভয় লাগে। কিন্তু মরণ চোখের সামনে নাচে। কোনদিন হাফি মেরে দেবে! না হলে পুলিশ মেরে দেবে! পাগল সেজে কি আর জীবন পাওয়া যায়? হ্যাঁ বাবু? জীবন পাওয়া যায়? মরণের আগে একটা ভাল কাজ করে গেলাম। স্বীকার করে গেলাম। ওঃ ওঃ ওঃ! ওই ফুলকচি শিশুগুলি। ইঃ ইঃ হিঃ হিঃ হিঃ। আ আ আ। 

আবার গাড়িতে উঠল তারা। বাপিকে নিয়ে বসেছে মির্জার দলের ছেলেরা। তার হাত খুলে দেওয়া হয়েছে। তাদেরই সঙ্গে পিছনের আসনে তৌফিক। সামনে চালকের আসনে মির্জা নিজেই। সঙ্গে আছে সিদ্ধার্থ ও বসির খান। রাত্রির অন্ধকার চিরে যেতে যেতে তাদের মনে পড়ছিল সেই রাতের কথা। বসির খানের বোনকে উদ্ধার করতে চলেছিল তারা। সেদিন তৌফিক ছিল না। সেদিনের অভিযান আরও অনেক বেশি অনিশ্চিত ছিল। কঠিন ছিল আরও। 

যেতে যেতে সিদ্ধার্থ পিছনে তাকাল একবার। দেখল, বাপি ঢুলছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *