১০৪
অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে
বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!—
ধরা যাক দু’-একটা ইঁদুর এবার!’
জানায়নি প্যাঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?
জীবনের এই স্বাদ— সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের—
তোমার অসহ্য বোধ হ’ল;—
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে—গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্ত-মাখা ঠোঁটে!
.
বাড়ি থেকে অল্প দূরে অন্ধকারে দাঁড়াল তারা। চারদিক ঘুমন্ত, নিঝুম। বিজলির আলো ক্ষীণ! তলে তলে রয়ে গেছে গাঢ় অন্ধকার।
বাপিকে নিয়ে বীরা নামল গাড়ি থেকে। বীরা আর সফি। ঘুম-চোখ টেনে টেনে জাগিয়ে তুলছে বাপি। কতকালের ঘুম-তৃষ্ণা তার, কতকালের নিদ্রাহীনতার ক্লান্তি, সমস্ত কোষঝিল্লি অবসাদে অকর্মণ্য এখন। তাকে বুঝি অনন্তকালের তরে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
বীরা আর সফি, দুইজন, মির্জার লোক তারা চিনে নিচ্ছে বাড়ি। বসির খান বাপিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়িতে। তখন বীরা আর সফি নির্দিষ্ট দরজায় শব্দ করল টক টক টক।
— কে?
তন্দ্রাবিজড়িত স্বর ভেসে এল অন্দর হতে
—হাফি আছে?
সামান্য খুলে গেল দরজা।
—কে?
—হাফি আছে?
—ক্যান?
—বলবেন সুপারি এনেছি।
—সুপারি? এইডা অ্যাকডা সুপারি লাওনের সুময়? হামার দামাদ ঘুমাইলছে।
—যা বলছি করুন।
এতক্ষণে অন্ধকার ফুঁড়ে এল হাফি। আকারে বাপিরই অনুরূপ। লুঙ্গি পরা। গলায় গেঞ্জি ঢোকাতে ঢোকাতে সেই প্রথম স্বরকে বলল—আপনি ভেতরে যান। আমি দেখছি। দরজা দিয়ে দিন।
বেরিয়ে এল সে। বলল —ওদিকে চলেন।
সে জানতে চাইল না, আপনারা কে, কেন এসেছেন, আমি যে এখানে তা জানলেন কী করে? জানা বিধিসম্মত নয়। যা কাজ, বলবে আগন্তুক নিজেই। সে বলবে কাজের মূল্য।
বীরা বলল—ওদিকে চলো।
হাফি তাকাল—কোথায়?
—ওইদিকে গাড়ি।
সে যেতে থাকল। নিকষ কালো রাত্রি কেবল ধারণ করল ভারী কিন্তু সতর্ক পায়ের শব্দ। স্তিমিত আলোকবিন্দুর মধ্যে মুহ্যমান সত্তাপ। কার জন্য? কার? সুন্দর এই পৃথিবীতে হাজার হাজার ভুল পদক্ষেপ মার্জিত করবে কে? হাফি জানে সে এক পেশাদার হত্যাবাজ। হাফি, হাফি, একজন পিতা, একজন স্বামী, ভাই এবং একজন পেশাদার হত্যাকর্মী— সে স্পষ্ট এবং স্বচ্ছভাবে জানে না, সমাজের কোন স্থানাঙ্কে তার অস্তিত্বের স্থিতি ও বিলয়। হঠাৎ তার মনে হল, সে কয়ায় আছে, তা জানে মাত্র চারজন। এরা তবে তাদেরই কারও মাধ্যমে এসেছে। সে নিরাপদ বোধ করল। সঙ্গে অস্ত্র আছে সামান্যই। লুঙ্গির ভাঁজে কাঁকালে গোঁজা ছুরি। অস্ত্র ছাড়া সে বেরোয় না এক পা-ও। যদিও অস্ত্র হিসেবে এই ছুরি বিরাট কিছু নয়। তবু আত্মরক্ষা হতে পারে।
এগিয়ে যেতে থাকল সে। নিরাপদ। তার দু’পাশে দু’জন। বীরা আর সফি। গাড়ির নিকটে পৌঁছে সে ফিরে বলতে গেল—–কে কথা বলবে?
তখন চোখ গেল তার। বীরা ও সফির হাতে আগুন-হানা অস্ত্র। সে হাত তুলল তৎক্ষণাৎ। ছুরিতে হাত দিলে সর্বনাশ তা বোঝার বুদ্ধি সে হারায়নি।
—গাড়িতে ওঠো। পিছনে।
—কোথায় যেতে হবে?
—ওঠ শালা ডরপুক!
উঠল সে। মাথায় আলোড়ন চলছে। এরা কারা? কী চায়? গোপন কাজের আদেশ দেবার জন্য আরও বেশি গোপনীয়তা? যন্তরটা নেওয়া হল না সঙ্গে। ভুল—ভুল হয়ে গেছে। সে একটু উশখুশ করল। তার স্নায়ু শীতল। এখনও। তবু ভুল হয়ে যায়। যেমন সে ধরে নিয়েছিল কাজের কথা ওখানেই হয়ে যাবে। তাই যন্তর নিয়ে বেরোয়নি। ভুলের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তার আত্মবিশ্বাস টলে যায়। ছোট্ট পরির মতো মেয়েটা বুকে লেপ্টে ছিল। তার ঘ্রাণ নাকে আসে। অসংখ্য ব্যাঙের ডাকে কানে তালা লেগে যেতে চায়। তার সমস্ত শরীর অন্ধকারে সতর্কতা খোঁজে। পাশে বসে আছে একজন। কে, তা জানে না। দু’দিকের দরজা খুলে ঢুকে গেল সফি ও বীরা। বসির খান ও তৌফিক চলে গেছে পিছনে এখন। আধুনিক এ গাড়ির পিছনেও বসতে পারে আরও চারজন।
গাড়ি চলেছে। কোনও কথা নেই। পাশের মানুষটির স্পর্শ পাচ্ছে হাফি। দক্ষিণপার্শ্বে যে, তার স্পর্শ বড় চেনা। এই মুহূর্তে বিপদগ্রস্ত হতবুদ্ধি অবস্থায়, সে বুঝতে পারছে না, কার এ স্পর্শ। কেন চেনা লাগে!
সে স্থির বসে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে এরা কে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে! কেন নিয়ে যাচ্ছে! তাদের পেশায় কখন কী ঘটে যায় কে জানে! কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। সে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে। ভাবছে। কী করা যায়! সে কি কোনও প্রশ্ন করবে? আন্দাজে টের পাচ্ছে, গাড়ি চলেছে বহরমপুরের দিকে। দু’পাশের আঁধারে ধরা যায় না কিছু।
তখন একটি হাত এসে পড়ছে তার হাতে। চাপ দিচ্ছে। আশিরনখ কেঁপে উঠছে হাফি! বাপি! এ তো বাপির স্পর্শ! সে চিৎকার করছে, তুই!
তার মনে পড়ছে, বাপির পাগলামো বেড়েছিল। প্রচুর ভুল-বকা সমেত সে ঘর ছেড়েছিল। পালিয়েছিল বলা যায়। বাপির মতি-গতি ভাল লাগছিল না তার। বাপিকে সরিয়ে দেবে ভাবতে ভাবতে সে কালক্ষেপ করেছে কত! কতদিন! হায়! তখনই কেন সারেনি সে কাজ! এখন কি বাপি পুলিশ নিয়ে এল? পুলিশে ধরিয়ে দিল তাকে?
বাপি হাফির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল—এরা আমাদের ভালই করবে। যা জানতে চায় বলে দিস।
দাঁতে দাঁত পিষল হাফি। প্রচণ্ড ক্রোধ মাথায় গনগনে হয়ে উঠল। সেও বাপির কানের কাছে মুখ নিল। বলল—তা হলে তুই ধরিয়ে দিলি আমাকে? ভাই হয়ে ভাইয়ের সঙ্গে গদ্দারি করলি? কথা বলতে বলতে সে বার করে নিল ছুরি। এক ঝটকায় নিজেকে মুচড়ে নির্ভুল বিদ্ধ করল বাপির বুক।
চিৎকার করল, ছটফট করল বাপি। তারপর থির থির কাঁপতে থাকল। ঘামে ভিজে গেল দেহ! চিৎকার করছিল তৌফিক, বসির খান। এবং এত কিছু ঘটমান থাকতেই হাফি হিংস্র লাফ দিল বীরার ওপর। তার গলা কামড়ে ধরল। তার এক হাত দরজায়। যদি কোনওভাবে খুলে লাফ দিতে পারে। পালাবার মরিয়া চেষ্টায়, বাপির প্রতি ক্রোধে সে হিংস্র, উন্মত্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন। অতর্কিত এ আক্রমণে হতবুদ্ধি তারা, মির্জার হাত কেঁপে গিয়েছিল। সিদ্ধার্থ তার কাঁধ খামচে ধরল। বলল—সাইড করো। থামাও।
গাড়ি থামতে থামতে সফির আগ্নেয়াস্ত্র কথা বলে উঠল। একটি মৌহূর্তিক, ধীর, ভোঁতা শব্দ হল, বুহ্! বিদ্ধ হল! বিদ্ধ হল প্রাণ! একমুহূর্ত ইতস্তত করেছিল সে। ওস্তাদের আদেশ নেই গুলি চালানোর। তা ছাড়া অন্ধকারে কার গায়ে লেগে যায়। কিন্তু বীরার আর্তনাদে সে পাগল-পাগল হল, অস্ত্র ঠেকিয়ে দিল হাফির গায়ে। মারল।
বসির খান, হাফিকে ছাড়াবার জন্য পিছনের সিট থেকে তার চুল টেনে ধরেছিল। সেভাবেই এলিয়ে পড়ল হাফি। তার দেহ ঢলে পড়ল বাপির কোলে। বাপির দেহে তখনও ছিল কিছু প্ৰাণ। গরম রক্তস্রোত সমেত, শেষ প্রাণ সঁপে দিয়ে সে স্থির হল চিরতরে। দুই ভাই, প্রায় জড়াজড়ি করে মরে রইল গাড়ির আসনে। এই অন্ধকার প্রবল রাত্রি লিখেছিল মৃত্যুলিপি তা কে খণ্ডাবে?
রক্তের আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল গাড়িময়। তারা নেমে এল। বীরার হাত থেকে অস্ত্র পড়ে গেছে। গলা হতে নেমে আসছে রক্ত। সে রুমাল চেপে আছে। যদিও উত্তেজনায় এবং চলন্ত গাড়ির গতিতে ভারসাম্য রাখতে না পেরে হাফি তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেনি বীরার কণ্ঠপ্রদেশে। করলে, কে জানে, সে হয়তো বুনো কুকুরের মতো নলি ছিঁড়ে নিত। কৃন্তক বসায়নি সে। শ্বদন্ত নিষ্ক্রিয় রেখে উপরের নীচের ছেদক দন্ত দ্বারা ঘটিয়ে চলেছিল আমূল সর্বনাশ। আঘাতে, বীরার অস্ত্র ছিটকে পড়েছিল। সম্মুখে মরণ সে দেখেছিল বুঝি-বা। অসহায়ের মতো জিগ্যেস করছে সে—ওস্তাদ! মানুষের দাঁতের বিষ লাগলে নাকি লোক মরে যায়!
বসির খান জড়িয়ে ধরল তাকে। আশ্চর্য মানুষের মৃত্যুভয়! যে লোকটা অন্যের প্রাণ নিতে পারত, সে নিজেই প্রাণের ভয়ে কুঁকড়ে আছে নিরস্ত্র জনতার মতো। মানুষের মুখের বিষ, সে সর্বাধিক। চরম। অবাতশোষী জীবাণু সব, মুখের বিবরে থেকে ঘটায় বিষের ধারা। আর দংশন? বিষের কামড়? সে কি শুধু দাঁতে হয়! হয় না জিহ্বায়? কথার কামড়ে, মানুষের, শুধুমাত্র মানুষের কথার কামড়ে, জর্জরিত হয়ে যায় না কারও কারও সমস্ত জীবন?
সিদ্ধার্থ বলল—তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ভেবো না। তৌফিক, ওকে পেছনের সিটে বসিয়ে দে।
মির্জা বলল—হাঃ! কী অবস্থা! একসঙ্গে জন্মেছিল, একসঙ্গে পাপ করত, মরল একসঙ্গে! এদের কী করব সিধুভাই?
সিদ্ধার্থ আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। পাপের সঙ্গতে যায় পাপ। সে এদের মারবে ভাবেনি। নিয়ে যেত হয়তো পুলিশের কাছে। লিখিয়ে নিত সমস্ত স্বীকারোক্তি। হল না। পাপের সঙ্গতে পাপ যায়। এ পৃথিবী, এই আশ্চর্য পৃথিবী কত না বিস্ময় বৈপরীত্য ভরা। ভাইয়ের জন্য ভাই প্রাণ দেয়। আবার ভাই হয় ভাইয়ের হন্তারক। জড়িয়ে মড়িয়ে থাকা ওই রক্তাক্ত দেহদু’টি এনে দেয় জীবনের নানাবিধ অর্থের ইঙ্গিতময়তা। সে খোঁজে, ওই তারাদের। মৃত শিশু, যারা নক্ষত্র হয়ে আছে, তারা কি শান্তি পেল? না। পেল না। কারণ আসল অপরাধী রয়ে গেল অন্তরালে। তাকে ধরা যাবে কি কোনওদিন?
সে ঠান্ডা গলায় বলল—ওদের মাছের খাবার করে দাও।