১১৬
নাকের নথ বেচিয়া মলুয়া
আষাঢ় মাস খাইল।
গলায় যে মতির হার
তাও বেচ্যা খাইল ।।
শায়ন মাসেতে মলুয়া
পায়ের খাড়ু বেচে ।।
এত দুঃখ মলুয়ার
কপালেতে আছে।
হাতের বাজু বাঁধা দিয়া
ভাদ্র মাসে খায়।
পাটের শাড়ি বেইচ্যা মলুয়ার
আশ্বিন মাস যায় ॥
.
জেলেপাড়া চলে গেছে সম্পূর্ণ। বন্যায় ধুয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি বাঁশ-কাঠ-ইট দিয়ে যতখানি গড়েছিল ধার ঘেঁষে—তার চিহ্নমাত্র নেই।
বলাই মণ্ডলের আমবাগান আগেই গিয়েছিল। সুকুমার পোদ্দারের যতটুকু ছিল, এই সকালেই পড়ে গেছে। নদী এখন বয়ে যাচ্ছে সুকুমার পোদ্দারের বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে, বলাই মণ্ডলের রান্নাঘর গ্রাস করে আঙিনায় এক্কা-দোক্কা খেলতে খেলতে। পোদ্দার ও মণ্ডলের নদীঘেঁষা উর্বরা জমিও এমনকী নেই।
ভেঙে পড়ছে, ভেঙে পড়ছে পাড়। নিকটেই দাঁড়িয়ে আছে লোক। বহুলোক। সারা গ্রাম। সেচদপ্তর। নেতৃবর্গ। চোখের সামনে পাড় ভাঙছে।
স্ত্রী ও পুত্রবধূকে, প্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান জিনিসপত্র সমেত বহরমপুরে পাঠিয়ে দিয়েছেন সুকুমার পোদ্দার। নিজের দাওয়ায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন বলাই মণ্ডল। তীর্থ বলছে— বাবা চলো!
বলাই মণ্ডল তাকাচ্ছেন শূন্য চোখে—কোথায় যাব?
—আপাতত যা পারি জিনিসপত্র নিয়ে সড়কের দিকে যাই।
—নিজের জায়গা ছেড়ে কোথায় যাব?
—বাবা, বাড়ি ভেঙে পড়বে যে কোনও সময়।
—না।
—চলো বাবা!
—না।
সকাল দশটা অবধি ঘটেছে ভাঙন। তারপর থেমে আছে। শূন্য শোকাতুর দৃষ্টিগুলিতে সামান্য আশার ঝিলিক, বুঝি-বা থেমে গেল আপাতত। হয়তো সময় দেবে আরও কিছুদিন! হয়তো!
হতাশ অসহায় কান্নায় ভেজা লাল চোখ। কেউ কেউ প্রকাশ্যে শব্দ করে কাঁদছে। হল না। পুর্ণ সংসার গড়ে তোলা হল না। গুছিয়ে তোলা হল না কিছুই। পেতে পেতেও পাওয়া হল না শান্তি-সুখ! পূর্ণ চক্রবর্তী অপলক দেখছেন নদী। বুঝি-বা কারও রোদনধ্বনি শ্রুতিগোচর হল তাঁর! ঠোঁট বেঁকে গেল। শরীর কাঁপতে শুরু করল। পূর্ণ চক্রবর্তী কাঁদতে লাগলেন। চাপা কান্না প্রকাশিত হতে লাগল। ডুকরে ডুকরে উঠতে লাগলেন তিনি। তাঁর ঘ্রাণে লাগছে পোড়া গন্ধ। কোথা হতে আসে এ গন্ধ? কেন আসে? এই নিঃস্ব অবস্থায় কেন এ গন্ধ তাড়া করে? শ্মশান চলে গেছে নদীগর্ভে। তা হলে কি শ্মশানের পুনরুত্থান হল? শ্মশান কাছিয়ে এল মানুষের বুকে?
প্রায় মূর্ছিত মাকে ধরে বসেছিল বর্ষা। পূর্ণ চক্রবর্তীকে কাঁদতে দেখে ফুঁসে উঠল সে—চুপ করো! তোমার পাপে সব গেল বাবা! এবার মরণ হবে আমাদের! মরণ!
পাপ! পাপ! পূর্ণ চক্রবর্তী কাঁদতে ভয় পেলেন। চুপ করে গেলেন সহসা। শুনতে থাকলেন, গৃহহারা সর্বহারা নিঃস্ব লোকের কান্না বাতাসে ভাসে।
বন্যা ভাসিয়ে দেয়। নিয়ে নেয় বহু কিছু। তবু সামান্য ফিরিয়েও দেয়। কিছু-বা প্রতিশ্রুতি রাখে ভবিষ্যতের। কিন্তু এ ভাঙন, এই গ্রাস নিমেষে সম্পন্ন গৃহস্থকে ভিখিরি করে দেয়। এখন এই সর্বস্বান্ত ভিখিরি হয়ে যাওয়া দেখছে লোক। বর্তমান খসে পড়ছে চোখের নিকটে।
আশা! তবু আশা! বুঝি-বা থেমে গেল! বুঝি-বা সময় দিল মানুষকে! ভিড়ে দাঁড়িয়ে গালাগালি দিচ্ছিলেন তাজু মিঞা। বলাই মণ্ডলের বৃদ্ধ মুনিষ। সকল ক্রোধ ও বিপন্নতা মিলে লালা নিঃসরণের মতো বেরুচ্ছিল কুবাক্য-কলিজাখাকি তুই শালি! কলিজাখাকি তুই! তোর মরণ নেই!
.
হায়! জানে না সে! জানতেও চায় না! গঙ্গার মৃত্যু হলে মারা যাবে ভারতীয় সভ্যতা! তার পূত পবিত্র জলকে দূষিত করেছে মানুষ, আবর্জনা ঢেলেছে গায়ে, মল-মূত্রে ভরিয়েছে, বিষাক্ত রাসায়নিক মিশিয়েছে অবলীলায়। তাকে শুশ্রূষা করেনি। নিরবধিকাল সে যা দিয়েছে মানুষের সভ্যতাকে-তার মর্যাদা রাখেনি মানুষ! তারই জলে পূজা করে তাকেই লাঞ্ছিত করেছে। তার বুকের মধ্যে ঘূর্ণি পাক খায়। বিষের ঘূর্ণি, পাপের ঘূর্ণি, অনাচারের ঘূর্ণি। তবুও সে কাঁদে। মানুষকে ভালবেসে আছাড়ি-পিছাড়ি খায়। তার প্রকৃতি—এই তার প্রকৃতি—প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রকৃতি স্বয়ং কী প্রকারে যায়?
সাধারণ গেরস্ত মানুষ—তারা জানে কী? কেবল প্রার্থনা জানায়। ভাল রেখো, ভাল রেখো। শেখেনি—যার তরে বাঁচা, তাকেও বাঁচিয়ে রাখতে হয়!
চতুষ্কোনায় কারও গৃহে উনুন জ্বলেনি আজ। যাদের বসত ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী এখন, তারা বাঁধা-ছাঁদা করছে। যা পারে, যতটুকু সঙ্গে নিতে পারে!
দু’ঘণ্টা হয়ে গেল, নাকি তিন ঘণ্টা, নদী আর খাচ্ছে না।
—রাক্ষসী! রাক্ষসী! আর কত খাবি তুই! তোর ক্ষুধা মেটে না রে! আপনাকে খা তুই! আপনাকে খা সর্বনাশী!
লোকে ফিরে যাচ্ছে এবার। যে যার কাজে ফিরে যাচ্ছে। যাদের সকল গিয়েছে, তারা সড়কে ছড়িয়ে বসে করছে হা-হুতাশ। তাদের শিশুগুলি ক্ষুধায় অস্থির! কাঁদছে! ভাঙেনি এখনও যাদের, তারা ভাঙনের ভয় বুকে করে ফিরে যাচ্ছে।
তখন হঠাৎ কাত হল পোদ্দারের বাড়ি। চিৎকার করে উঠল বংশির মা–বাবু গো!
দুদ্দাড় বেরিয়ে এল ভেতরে ছিল যে ক’জন। লোকজন পালাচ্ছে দূরে। পালাচ্ছে। সুকুমার পোদ্দার, এক, কঠিনতম মানুষ, চোখে জল উপচে উঠছে তাঁর। অনির্বাণ বাবাকে ধরে আছে। ধরে আছে শক্ত করে। নদী কারওকে ক্ষমা করে নাই। কারওকেই দয়া করে নাই। পোদ্দারের বৃহৎ বাড়ি কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে। ফুটো জাহাজের মতো চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে জলে, চলে যাচ্ছে। কাত হতে হতে, পড়তে পড়তে, ডুবে গেল সমগ্র প্রাসাদ! এক নারী, প্রৌঢ়া, পৃথুলা, খোলা চুল, ধকধকে চোখ—হাসছে—হি হি হি হি ওঃ ওঃ হি হি হি!
কে? কে? কে?
কে ওই নারী? সে কি গঙ্গা? গঙ্গা স্বয়ং
কলুষবিনাশিনী, পাপপ্রক্ষালনী, শোক-তাপ সুস্নিগ্ধকারিণীসে কি পাপ নিতে নিতে, দোষ নিতে নিতে উন্মাদিনী হল? বিষের জ্বালায় জর্জরিত আপন অঙ্গে আপনি আবিল, ধ্বংস করে নাচে তাই! নাশ করে হাসে! গঙ্গা! তুমি গঙ্গা!
সহদেব দাস স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেন তখন—চলো আশা! ছি ছি! অন্যের সর্বনাশে হাসতে নেই!
—হাসব হাসব হাসব! বেশ করব হাসব! আ হা হা হা! ওঃ ওঃ ওঃ!
কাঁদেন, তিনি কাঁদেন, বলতে থাকেন উন্মাদিনী—আমার মেয়েটাকে মেরে ফেললি! তোদের সব যাবে না? যাবে না? ধনে-প্রাণে নাশ হবে তোদের! নির্বংশ হ তোরা! নির্বংশ হ! মর মর মর!
অনির্বাণ থরথর করে কাঁপছে। তার চোখ-মুখ লাল। সুকুমার পোদ্দার শোক ভুলে ছেলেকে জড়িয়ে ধরছেন। অনির্বাণ বিস্ফারিত চোখে দেখছে—ওই ওই ওই তো! সবুজ চাদর উড়িয়ে ও কে? ও কে?
পড়ে গেল বাড়ি। ভরা নদীর জল ধীরে ধীরে টেনে নিল সব। এখন সে স্থান শূন্য। জল জল জল কেবল! এই ছিল, এই নেই! এতদিনের নিরাপত্তা, নির্ভরতা, স্মৃতি ও সংসার—এই ছিল, এই নেই! কতটুকু এ জীবন, কতটুকু এ প্রাণ? জীবন ক্ষণমাত্র। মহাকালের প্রবাহণে বিন্দুবৎ। জীবন বিন্দুমাত্র। এই ছিল, এই নেই। তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের মিলিত ইন্দ্রজাল। মুহূর্তের শব্দ। যতি।
সোয়া বারোটায় চলে গেল পঞ্চায়েত দপ্তর। সাড়ে বারোটায় চলে গেল বলাই মণ্ডলের বাড়ি। একটায় চলে গেল কলাবাগান গোটা।
লোকে পিছু হঠছে। হঠছে। ভিড় বাড়ছে। এসেছে পুলিশের জিপ। সড়কে দাঁড়ানো সার সার গাড়ি। হতবাক অসহায় দেখছে সবাই। কাঁদছে। কাঁদছে। সংকোচ নেই। লজ্জা নেই। কাঁদছে।
এতক্ষণ গ্রামের উত্তরভাগ ঘিরে ভিড় জমেছিল। এবার দক্ষিণ হতে এল উন্মাদ চিৎকার! পাগলের মতো ছুটে আসছে কয়েকজন— পালাও! গ্রাম ছেড়ে পালাও! গোটা গ্রামে ফাটল গো ওওও!
লোকে ত্রাসে দেখছে। অবিশ্বাসে দেখছে। বড় বড় ফাট ধরছে মাটিতে। লম্বা লম্বা ফাট ধরছে। তারা ছুটছে! কতদূর এ ফাটল! কতদূর! জানে না! জানে না! ছুটছে! ছুটছে! খলবল খলবল শব্দ উঠছে নদীতে! কী তৃপ্তি! সকল বিনাশ করে কী তৃপ্তি নদীর! প্রাণভয়ে চলে যাচ্ছে সব। ছুটছে! এ ওকে ঠেলে দিচ্ছে! এ ওর হাত ধরে টানছে! সড়কও কি গর্ভে যাবে? যাবে? জানে না! জানে না কেউ! লোকারণ্য সেখানে! তিলমাত্র জায়গা নেই! ওই ওই ভেঙে পড়ল জমি খানিক! ওই গেল মোল্লাপাড়া। গোয়ালাপাড়া গেল! পালাও পালাও পালাও! ঘরে যারা ছিল, বেরিয়ে আসছে ত্রাসে! ভয়ে! জানে না কী করবে! কোথায় যাবে! শুধু কান্না জানে! একটি বধূ ছেলে কোলে এল, গোঙাচ্ছে—ওগো! ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম! ঝিনুকবাটি ফেলে এলাম! আনব! নিয়ে আসি? ছেলেটার মুখের খাবার। নিয়ে আসি?
সে ছেলে দিল স্বামীর কোলে! ছুটে গেল! হায়! পৌঁছতে পারল না! তার আগেই পড়ে গেল ঘর! বুক ফাটিয়ে কেঁদে উঠল বধু—ওগো! আমার ছেলেটার খাওয়া হল না! হল না!
.
তিনটের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল গ্রাম। সড়কের পনেরো-কুড়ি মিটার দূরে এসে, সব খেয়ে শান্ত হল নদী! তৃপ্তির উদগার তুলে পড়ে রইল হরিণ-গেলা ময়ালের মতো শ্লথ।
তখন, রোরুদ্যমান জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে গলা তুললেন মিহির রক্ষিত, বিপন্ন মানুষের সুবন্ধু তিনি, বলতে থাকলেন —–বন্ধুগণ! আমরা আপনাদের পাশে আছি! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা আমরা করব!
—পুনর্বাসন? শয়তানের বাচ্চা। তোদের জন্য এরকম হল! তোদের জন্য!
মিহির রক্ষিতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে সিদ্ধার্থ। ঠোঁট চেপে কাঁদছিল সে এতক্ষণ! মানুষের অসহায়তায় দুর্দশায় কাঁদছিল! এখনও সে কাঁদছে! ফুঁসছে। ক্রুদ্ধ বাঘের মতো থাবায় ধরেছে মিহির রক্ষিতের টুটি, ঝাঁকাচ্ছে, না ছিঁড়ে শান্তি নেই!
মিহির রক্ষিত চিৎকার করছেন—অঁ অঁ অঁ অঁ!
ছুটে এসেছে তৌফিক—সিধুদা! ছাড়ো! ছেড়ে দাও! পাগলামি কোরো না!
পুলিশ আসছে। নেতৃবর্গ আসছেন। চিৎকার করছেন। তখন নওয়াজ, মিহির রক্ষিতের প্রিয়জন সে, বিশাল ও বলিষ্ঠ হাতে ছিনিয়ে নিচ্ছে সিদ্ধার্থকে। তারপর প্রহার করছে! মারের পর মার! মারের পর মার! মারের পর মার! তৌফিক, আড়াল করতে চেয়ে, পড়ে যাচ্ছে যখন, নওয়াজ পা দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে তৌফিককে!
পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ছে ক্রোধের ওপর। সকল ক্রোধ, সকল মারের ওপর। পুলিশ, তারা শান্তিরক্ষক!
তখন শান্ত নদীটি বয়ে যাচ্ছে পটে আঁকা ছবিটির মতো। কে বলবে, ওই নদীর তলায়, খানিক আগেও একটা আস্ত গ্রাম ছিল! গৃহস্থী ছিল কত! কত শোকগাথা! মানুষের কত প্রাচীন ইতিহাস ধরা ছিল সেই গ্রামে! কে বলবে? চতুষ্কোনা আজ হতে বিপন্ন স্মৃতিকথা!