১০৬
পৃথিবীতে যত ইতিহাসে যত ক্ষয়
মানবের সাথে মানবের প্রাণবিনিময়ে অবিনয়
.
নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ তখন বাংলার সিংহাসনে আসীন। মুর্শিদাবাদ তাঁর রাজধানী। ঔরঙ্গজেবের পৌত্র আজিম-উস্-শান তখন বাংলার শাসনকর্তা। তাঁর পুত্র ফারুখশিয়র তাঁর প্রতিনিধিত্ব করছেন।
বাংলা মুলুক হতে প্রচুর রাজস্ব সংগ্রহ করে বাদশাহ ঔরঙ্গজেবকে প্রেরণ করে মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁর প্রিয় পাত্র। সুতরাং আজিম-উস্-শান বা ফারুখশিয়রের তুলনায় তাঁর ক্ষমতা অধিক বললেও অত্যুক্তি হয় না। অতএব, নবাব নাজিমি লাভ করে মুর্শিদকুলি বাংলায় আপন শাসননীতি প্রয়োগ করলেন। বিশেষত জমিদাররা তাঁর শাসনদণ্ডের কঠোরতায় উত্যক্ত হয়ে উঠলেন।
কিন্তু রাজা উদয়নারায়ণ রায় সে-পর্যায়ে পড়েন না। রাজশাহির জমিদার তিনি। এবং বিপুল রাজশাহি পরগণার মধ্যে তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শাসন-শৃঙ্খলা।
আর রাজশাহি এক পরগণা মাত্র নয়। সে সময় রাজশাহি ছিল চাকলা। পদ্মার উভয়পারে বিস্তৃত ছিল তার সীমানা। বর্তমান মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, সাঁওতাল পরগনা এবং রাজশাহির সকল নাগরিক রাজা উদয়নারায়ণকেই রাজস্ব প্রদান করত।
মুর্শিদকুলি খাঁ স্থানীয় জমিদারদের বিশ্বাস করতেন না কখনও। কয়েকজন আমিন নিযুক্ত করে জমিদারি থেকে রাজস্ব আদায় করতেন তিনি। ব্যতিক্রম হিসেবে যে দু’একজন জমিদার তাঁর আস্থাভাজন ছিলেন, তাঁদের মধ্যে রাজা উদয়নারায়ণ রায় অন্যতম। মুর্শিদকুলি উদয়নারায়ণের ওপর শুধু সন্তুষ্টই ছিলেন না, তাঁর প্রতি প্রশ্রয়সুলভ প্রীতি প্রদর্শনেও কোনও কার্পণ্য ছিল না। রাজা উদয়নারায়ণ নবাবনিষ্ঠ, চতুর, সূক্ষ্মবুদ্ধি, সুশাসক এবং কর্মকুশল। মুর্শিদকুলি নিজে যেমন, ঠিক তেমনই। এ যেন এক অঙ্কের নিয়ম। ঔরঙ্গজেব বাদশা যে যে- কারণে মুর্শিদকুলির প্রতি প্রীত, মুর্শিদকুলিও সেই কারণেই উদয়নারায়ণের প্রতি প্রীত, মুগ্ধ এবং নির্ভরশীল।
নবাবের প্রীতি বজায় রাখতে উদয়নারায়ণ যথেষ্ট যত্নবান। তিনি এটা সার বুঝেছিলেন, প্রভূত পরিমাণ রাজস্বই মুর্শিদকুলির আস্থাভাজন থাকার প্রধান উপায়। সুতরাং তাঁর রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি প্রজাপীড়নের পর্যায়ে চলে গেল। শোষিত ও পীড়িতের কান্না তাঁর প্রাসাদ দেউড়িতে মাথা কুটে কুটে ফিরতে লাগল। কিন্তু নবাবরঞ্জনে ব্যগ্র রাজা প্রায় বধির। প্রায় অন্ধ। তিনি কারওকে অব্যাহতি দিলেন না। প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষ উপস্থিত হল। সঙ্ঘবদ্ধভাবে না হলেও, ইতস্তত ছোট-বড় গোলযোগ ঘটতে লাগল রাজা উদয়নারায়ণের রাজত্বে।
পীড়িত হতে হতে, শোষিত হতে হতে, সম্পূর্ণ মুখ থুবড়ে পড়ার আগে মানুষ একবার বিদ্রোহ করে অন্তত। প্রাণের ধর্মে করে। ঘুরে দাঁড়ায়। প্রাণ ছাড়া কিছুই হারাবার না থাকলে মানুষ বেপরোয়া হতে পারে। সারা পৃথিবীতেই মানুষ রেখেছে এমনই নজির।
সুতরাং উদয়নারায়ণের সুশাসিত শৃঙ্খলাপরায়ণ রাজশাহি চাকলার শৃঙ্খলা ভাঙল। নবাব মুর্শিদকুলি উদয়নারায়ণের সাহায্যার্থে দুইশত সুশিক্ষিত সেনানি সমভিব্যাহারে জমাদার গোলাম মহম্মদ এবং কালিয়া জমাদারকে পাঠালেন। প্রেরণ করার আগে তাদের আদেশ দিলেন— তোমরা রাজার অধীন থেকে সম্পূর্ণভাবে তাঁর আদেশ প্রতিপালন করবে। যখনই যা আবশ্যক হবে, উদয়নারায়ণের আদেশপ্রাপ্তিমাত্র তদ্দণ্ডেই তা সম্পাদন করবে।
সৈন্য সহায়তায় উদয়নারায়ণ রাজশাহি চাকলার শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন। বিদ্রোহের আগুন দমন করা হল। চিৎকার রুদ্ধ করা হল। অভুক্ত কৃষকও খাজনা না দেবার কথা যাতে ভাবতে না পারে—তার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হল।
ক্রমে রাজা উদয়নারায়ণের শাসনে এবং গোলাম মহম্মদের কার্যনিপুণতায় রাজশাহি বাংলার আদর্শ জমিদারির উদাহরণস্বরূপ হল। সে আদর্শের অন্তরালে ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর কেউ শুনল না। দেখল না পীড়িতের চোখের জলে ভেজা মাটি। বুকে বাঁশ চেপে দমিত বিদ্রোহ, প্রাচীরের আড়ালে থাকল সম্মুখে শান্তির ছদ্মবেশ নিয়ে
একদিন একজন ফকির এলেন মুর্শিদকুলির দরবারে। নবাবকে তিনি বললেন—রাজা উদয়নারায়ণ আপনার অধীন। কিন্তু তাঁর শাসনের কৌশল এবং সাফল্য বাংলার নবাবকেও হার মানায়।
এই প্রশংসায় মুর্শিদকুলির মনে সামান্য ঈর্ষা হল। কিন্তু সূক্ষ্ম ঈর্ষাকে বশে রেখে উদয়নারায়ণের জন্য গর্ব বোধ করলেন তিনি।
ইতিমধ্যে উদয়নারায়ণ বোধপ্রাপ্ত হলেন। প্রজার কান্না তাঁর বধির শ্রবণে করাঘাত করল। বিচক্ষণতা লুপ্ত হতে হতেও নবাঙ্কুর প্রকাশে ফিরে এল রাজহৃদয়ে। উদয়নারায়ণ প্রজার মনোরঞ্জনে মন দিলেন। কারণ একটি শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল এর মধ্যে, যে, প্রজাশোষণই একমাত্র উদ্দেশ্য হলে হাজার সেনানী দিয়েও রাজত্বে সম্পূর্ণ শৃঙ্খলা আনা যাবে না। যে-শৃঙ্খলা, যে-আইন মানুষকে অভুক্ত রাখে, মানুষ তাকে মান্য করে না। শৃঙ্খল জ্ঞানে ভেঙে ফেলতে চায়। অতএব, প্রজাদের বশীভূত রাখার ইচ্ছা হল তাঁর। জিযৃক্ষা হল। এবং এই বশীভূত রাখার প্রধান উপায় তিনি বুঝলেন, শোষণের পাশাপাশি কিছু কল্যাণবিধান করা। যেমন করের হার বৃদ্ধি করো, শুল্ক ধার্য করো, কিন্তু গ্রামে গ্রামে কূপ খনন করে দাও। অতিথিশালা খোলো। পথে পথে রাখো জলসত্রের ব্যবস্থা। উপভোগ্য উৎসবাদির আয়োজন করো রাজব্যয়ে।
পূর্বে প্রজাপরায়ণ প্রজাহিতৈষী বলে তাঁর খ্যাতি ছিল। সেই খ্যাতি পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি আপন সম্পদের কিছু অংশ প্রজার জন্য ব্যয় করতে লাগলেন। প্রজারা তাঁকে সুখ্যাতির চূড়ায় তুলে দিল। ধন্য ধন্য পড়ে গেল চতুর্দিকে। কিরীটেশ্বরীর প্রাচীন মন্দিরের চারপাশ জঙ্গলে ভরে ছিল। রাজা তার সংস্কারসাধন করলেন। মন্দিরের অদূরে গড়লেন একটি পোড়ামাটির শিবমন্দির। বিশাল শিবলিঙ্গ অপূর্ব কারুকার্যময় মন্দিরে শোভা পেল। তার সামনে খনন করা হল একটি ছোট্ট পুকুর। এই পুকুরের জল শিবলিঙ্গে সিঞ্চন করা হবে। দেবীর আরাধনা করে, দেবতার প্রতিষ্ঠা করে রাজা উদয়নারায়ণ স্বয়ং প্রজাদের চোখে দেবোপম হলেন।
একদিন সেই ফকির আবার এলেন মুর্শিদকুলির দরবারে। বললেন—রাজা যদি হতে হয়, তবে উদয়নারায়ণের মতো হওয়া উচিত। আপন রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধি করেন যিনি, প্রজার হিতসাধনের জন্য যিনি আপন কোষাগার শূন্য করে দেন, তিনিই তো প্রকৃত রাজা। বহুকাল আগে হর্ষবর্ধন নামে একজন রাজা ছিলেন এমনই মহান।
মুর্শিদকুলি প্রকাশ্যে হর্ষ অভিব্যক্ত করলেন বটে, কিন্তু মনের গভীরে ঈর্ষা কিছু জটিল হল তাঁর। দিকে দিকে চর পাঠিয়ে যে-সংবাদ তিনি সংগ্রহ করলেন তাতে তাঁর সন্তোষ বিধান হল না। শুনলেন, লোকে বলে, উদয়নারায়ণই প্রকৃত রাজা। নবাব তো সেদিনের। তা ছাড়া প্রজার ভালমন্দের দিকে নবাবের দৃষ্টি আছে, এমন তো বোঝা যায় না। বাংলা ভাষাটি পর্যন্ত তাঁর আয়ত্তে নেই। প্রজাদের তিনি ভালবাসবেন কী প্রকারে?
মুর্শিদকুলির ক্রোধ হল। ঈর্ষা হল। ক্রোধে ঈর্ষায় মণ্ড পাকিয়ে উঠল। এবং বড় বেদনায় ভরে গেল তাঁর মন। কী জানে তাঁর সম্বন্ধে এখানকার মানুষ! কতটুকু জানে? বাংলামায়ের কোলেই তাঁর জন্ম হয়েছিল তা জানে কি? জানে কি, তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান?
কষ্টে, গ্লানিতে, অসহায়তায় তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। কিন্তু এই কষ্ট বড় গোপন। বড় একার। আজ আর কেউ তার সন্ধান জানে না। তিনিও জানাতে চান না ব্রাহ্মণসন্তান তিনি। দারিদ্রের কারণে তাঁর পিতা তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন একজন মুসলমান বণিকের কাছে।
কী ছিল তাঁর পিতার নাম? মনে নেই মনে নেই! হায়! এ যে বড় লজ্জার! বড় যন্ত্রণার! পিতৃপরিচয়হীনতা যে বড় যন্ত্রণার! অন্তত যদি নামটি মনে থাকত তাঁর, অন্তত গ্রামের নামটিও যদি মনে থাকত, তিনি খুঁজতেন। নিশ্চিতই খুঁজে বার করতেন তাঁর আত্মীয়-পরিজন। হতে পারে, তাঁর সেই পিতা আজও জীবিত।
তাঁর কোষাগারে কাজ করে দুই অতি বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণ কর্মচারী। দুই ভাই তারা। তাদের দেখলে মুর্শিদকুলির বুকে বাৎসল্য জাগে। এক-একসময় নিজের শ্মশ্রুগুম্ফহীন কিশোর মুখের প্রতিচ্ছায়া দেখতে পান তাদের মুখের আদলে। তাঁর ইচ্ছা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ওই দুই যুবককে আলিঙ্গন দেবার জন্য। কিন্তু তিনি সংযত থাকেন। আদ্যন্ত ধর্মপরায়ণ তিনি। পাঁচ ওয়ক্ত নামাজ পড়েন। নিয়মিত কুরআন পাঠ না করে জলস্পর্শ করেন না। সংযম তাঁর করায়ত্ত! তবু, হৃদয়ের সেই তীব্র আলোড়ন নিজের কাছে কী করে লুকোবেন?
কে জানে এসব? কে জানে, ভাগ্য তাঁকে সমস্ত দিয়েও কীভাবে নিষ্ঠুর খেলা খেলে তার সঙ্গে?
ব্রাহ্মণ কর্মচারী তাঁর কম নেই। কিন্তু ওই টান আর কারও প্রতি তিনি বোধ করেন না। কেন? কেন? কেন ওই দুই যুবক তাঁকে টানে? এই কি রক্তের টান? তারা কি কেউ হয় তাঁর? ভাই! রক্তের সম্পর্ক কি সত্যিই ব্যক্তির অজ্ঞাতে পরস্পরকে চিনে নেয়?
তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, ওই দুই ব্রাহ্মণযুবার পিতা জীবিত নেই। যদি থাকতেন, যদি প্রমাণিত হত তিনিও ওই পিতার সন্তান, তা হলে সেই পিতার কাছে কী চাইতেন তিনি? সন্তানের স্বীকৃতি? হিন্দু ব্রাহ্মণের জন্মার্জিত জীবন?
না। চাইতেন না। পালক পিতার কাছে অপরিসীম স্নেহ যত্ন পেয়েছেন তিনি। তাঁরই শিক্ষার কল্যাণে আজ তিনি বাংলার নবাব। ঔরঙ্গজেব বাদশার আস্থাভাজন। বহু ধনসম্পদ ও সম্মানের অধিকারী। পালক পিতার ধর্ম তিনি গ্রহণ করেছেন। তিনি এখন মনেপ্রাণে মুসলমান। হিন্দু ধর্মের প্রতি কোনও আগ্রহ, কোনও আকর্ষণ নেই তাঁর! মহম্মদ হাদি থেকে হয়েছেন করতলব খাঁ। করতলব খাঁ থেকে হয়েছেন মুর্শিদকুলি খাঁ। তাঁর আদি নাম কবে মুছে গেছে। জীবনের কাছে তাঁর কোনও অভিযোগ নেই।
তবে?
একটিমাত্র অভিমান আছে তাঁর। মানুষ যে-জন্মের কাছে চিরঋণী—তাকে তিনি অস্বীকার করবেন কী প্রকারে! তাই সকল পূর্ণতা সত্ত্বেও একটিমাত্র অভিমান হৃদয়ের কোণায় আজও রয়ে গেছে। পিতার প্রতি পুত্রের অভিমান।
পিতার সঙ্গে দেখা হলে কী জিগ্যেস করতেন তিনি? সে প্রশ্ন তৈরি আছে তাঁর। নবোতিপর পিতাকে তিনি জিগ্যেস করতেন—পুত্রবিক্রয়ের অর্থে আপনার কতদিনের অন্নসংস্থান হয়েছিল?
কিন্তু একথা কারওকে বলার নয়। প্রাণাধিক বেগম নাসিরাবানুকেও নয়। অতএব সকল বেদনভার একা একা বয়ে চললেন তিনি। ঈর্ষাগ্নি নেবাতে কুরআন পাঠের সময় বাড়িয়ে দিলেন।
.
গোলাম মহম্মদ তখন উদয়নারায়ণের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছেন। তাঁর কর্মকুশলতা দ্বারা রাজাকে বশীভূত করেছিলেন। উদয়নারায়ণ এবং গোলাম মহম্মদের যুগ্ম ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। দু’জন কর্মকুশল ব্যক্তির একত্রিত হওয়া চিরকালই সামান্য শক্তিকে শতগুণে বর্ধিত করে। অতএব মুর্শিদকুলি খাঁ এই ঘনিষ্ঠতাকে সুনজরে দেখলেন না। রাজা উদয়নারায়ণের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি তাঁর নিজের পক্ষেই অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াল। ঈর্ষা এবং ভয়! বাংলা-বিহার- উড়িষ্যার প্রবল প্রতাপান্বিত নবাব, বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের আস্থাভাজন—তাঁরও ঈর্ষা আর ভয়! এমন কোনও শক্তিকে বাড়তে দেওয়া যায় না, যা প্রতিপক্ষ হিসেবে সমান ক্ষমতাধর। উদয়নারায়ণ যদি নবাবের অনুগত না থাকেন? যদি বাংলার মসনদ অধিকার করার লোভ হয় তাঁর? যদি আধিপত্য হয়ে ওঠে দুর্জয়? না না না! এমন হতে দেওয়া যায় না! অতি যত্নে, অত্যন্ত ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ধীরে ধীরে এই মসনদ তিনি অধিকার করেছেন। তাঁর নারীলোভ নেই। অর্থলোভ নেই। কিন্তু ক্ষমতা চাই তাঁর। আরও আরও ক্ষমতা! নিরঙ্কুশ একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা!
সুতরাং এই শক্তি খর্ব করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন তিনি। সুযোগ মিলে গেল অচিরেই।
প্রজাহিতে ব্যয় করতে গিয়ে রাজকোষ প্রায় তলানি হয়ে যাওয়ায় উদয়নারায়ণ সৈন্যদের নিয়মিত বেতন দিতে পারেননি। সে সময় এরকম হলে প্রজাদের কাছ থেকে সরাসরি প্রাপ্য আদায় করে নিতে পারত সৈন্যরা। এবারে প্রাপ্য আদায়ের নামে সাধারণ প্রজাদের ওপর ঘোর অত্যাচার শুরু হল। রাজা উদয়নারায়ণ সহসা এর কোনও প্রতিবিধান করতে পারলেন না। সংবাদ নবাবের কানে গেল। সে-বছর খরা চলছিল। উদয়নারায়ণ রাজস্ব সংগ্রহ করে নবাবকে পাঠাতে পারেননি। সংবাদ পাঠিয়েছেন, উপযুক্ত সময় এলেই যথেষ্ট রাজস্ব তিনি সংগ্রহ করে পাঠাবেন। নবাব আস্থা রাখতেই পারতেন। কোনও অসুবিধে ছিল না। এই আস্থা রাখা, প্রজাবাৎসল্যের প্রতি প্রশ্রয় এক রাজকীয় গুণ। নবাবি মর্যাদার পরিচায়ক। কিন্তু তিনি বলে পাঠালেন—দেরি করা চলবে না। বহু লক্ষ টাকার রাজস্ব এখনই চাই। বলা বাহুল্য, উদয়নারায়ণ আদেশ পালন করতে পারলেন না। নবাব এই সুযোগও নিলেন। উদয়নারায়ণ এবং গোলাম মহম্মদকে দমন করার জন্য তিনি মহম্মদ জান নামে একজন সেনাপতিকে সসৈন্যে পাঠালেন রাজশাহি চাকলায়।
এ খবরে উদয়নারায়ণ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এত সামান্য কারণে নবাব তাঁর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাচ্ছেন কেন? তিনি ভাবতে থাকলেন, কোথায় এর কারণ। ভাবতে ভাবতে উপলব্ধি এল তাঁর। তিনি বুঝলেন, নবাব তাঁর শৌর্যে ঈর্ষান্বিত। তিনি যদি এখন নবাবের পদপ্রান্তে পড়ে বশ্যতা স্বীকার করেন, তা হলেও লাভ হবে না। নবাবের অভিলাষ একটাই। রাজা উদয়নারায়ণের বিধ্বংস।
তিনি গোলাম মহম্মদ এবং কালিয়া জমাদারের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। তাঁরা দু’জনেই নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরামর্শ দিলেন। যুদ্ধ হল। অন্য পথও বা কী ছিল! সংহার যখন অনিবার্য অপেক্ষা করে তখন যুদ্ধ কেবল মরণের মর্যাদা ও তাৎপর্য বৃদ্ধি করে। অতএব যুদ্ধ হল। রাজা উদয়নারায়ণ পরাজিত হলেন।
উদয়নারায়ণের রাজধানী ছিল বড়নগরে। পরাস্ত হয়ে তিনি বড়নগর ত্যাগ করলেন। চলে গেলেন বীরকিটি। এখানে তাঁর একটি সুরক্ষিত ভবন ছিল। এর নিকটেই জগন্নাথপুরের গড়। সেই গড়ে, আরও বড় যুদ্ধের জন্য সৈন্য সমাবেশ করতে লাগলেন তিনি। অবশেষে নবাবসৈন্য সেই অবধি পৌঁছল। তখন জগন্নাথগড়ের কাছে মুড়মুড়ের ডাঙায় শুরু হল যুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রথমেই গোলাম মহম্মদ নিহত হলেন। সৈন্যরা মনোবল হারাল। বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধ করতে করতে নবাবসৈন্যের হাতে কচুকাটা হল তারা।
উদয়নারায়ণের কাছে গেল এ সংবাদ। সেনাপতির মৃত্যু হয়েছে। সকল সৈন্য বিনষ্ট। তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। তাঁর মনে পড়ল কত হিন্দু-মুসলমান জমিদার মুর্শিদকুলি খাঁ-র দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন। কী নিষ্ঠুর, ভয়ংকর সেই অত্যাচারের পদ্ধতি। তাঁর দুই প্রতিনিধি নাজিম আহম্মদ এবং রেজা খাঁ যথেচ্ছভাবে এই অত্যাচারের প্রক্রিয়া সম্পাদন করেছেন। কুৎসিত নারকীয় সেইসব অত্যাচারের পদ্ধতির অবগতি সত্ত্বেও, মুর্শিদকুলির কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়নি। তিনি বলেননি— এই গুনাহ্ বন্ধ হোক! বোঝেননি— ধর্মপরায়ণতা কেবল সুফি-সন্ত-ফকির সেবার মধ্যে, কুরআন পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অর্থ ও ক্ষমতার তীব্র আকাঙ্ক্ষী মুর্শিদকুলি খাঁ। রাজস্ব আদায়ের জন্য যে-কোনও উপায় অবলম্বনেই তাঁর নীরব সমর্থন ছিল।
অতি ভয়ংকর সেই প্রক্রিয়ার কথা স্মরণ করতে লাগলেন উদয়নারায়ণ। তাঁর সারা দেহ কণ্টকিত হল। সাহসী পুরুষ তিনি। শারীরিক নিগ্রহ তাঁকে ভীত করে না। কিন্তু ওই সকল প্রক্রিয়ার মধ্যে যে অপমান নিহিত, তারই সম্ভাবনায় তিনি বিচলিত হলেন।
কী বিচিত্র সেই অত্যাচারের পদ্ধতি! নাজিম আহম্মদ এবং রেজা খাঁ নিত্যনতুন অত্যাচারের উপায় আবিষ্কার করতেন।
কারও পায়ে দড়ি বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা হত। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে কিংবা শীতের তীব্র হিমে খোলা গায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হত উন্মুক্ত জায়গায়। সেইসব চলেছে অদ্যাবধি। এ ছাড়াও আছে বৈকুণ্ঠ। হিন্দুরাজাদের জন্য উপহাস করে তৈরি একটি গভীর গর্ত। তার মধ্যে নিত্য জমা পড়ে মৃত পশুদের শবদেহ। কীটে পরিপূর্ণ, দুর্গন্ধময়, বিকট, উৎকট সেই গর্তে ডুবিয়ে দেওয়া হয় ধৃত জমিদারের মুখ। শুধু বিদ্রোহের নয়, অধিকাংশই রাজস্ব বাকি পড়ার অপরাধ। মাননীয় জমিদারের মুখ সেইখানে ডুবিয়ে দিয়ে পৈশাচিক হাসেন রেজা খাঁ। নাজিম মহম্মদ। বলেন—দেখে নে শালা! কুত্তার বাচ্চা! পশুর অধম। তোর বৈকুণ্ঠ দেখে নে।
লজ্জা লজ্জা! কী লজ্জা! কী অপমান! ওই মূর্তিমান বিভীষিকার হাত থেকে মুক্তি নেই এমনকী মুসলমান জমিদারের। তাঁদের জন্য আছে সাকির পেয়ার পদ্ধতি। পাজামার দড়ি ফাঁক করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটি ক্ষিপ্ত বেড়াল। তার আগে বহুক্ষণ বস্তাবন্দি করে রাখা হয় সেই মার্জারকে। বেরুবার জন্য ছটফট করে করে ক্ষিপ্ত হিংস্র বেড়ালকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পাজামার গর্তে। সেটি তখন সমস্ত পাশবিকতায় আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় দেহের নিম্নভাগ। প্রভূত রক্তপাতে অসহ্য যন্ত্রণায় নেতিয়ে পড়েন মাননীয় জমিদার।
এ সকলই চিন্তার সর্বনাশে দ্বিবিধ প্রতিক্রিয়া হল উদয়নারায়ণের। লজ্জা, ঘৃণা, অপমানে বিবমিষা এল। এবং এল ক্রোধ। প্রথমে তিনি ভাবলেন, যা কিছু সৈন্য আছে তা-ই নিয়ে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু অবধি খরচ করবেন। শোধ নেবেন এ অত্যাচারের। কিন্তু পরক্ষণেই হতোদ্যম হয়ে পড়লেন তিনি। হায় হায় করতে লাগলেন! যখন এ সকল অত্যাচারের বিষয়ে শুনেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন শৌর্যে ক্ষমতায় বিরাট। তখন তাঁর মনে বিদ্রোহ জাগেনি। বরং গভীর আনুগত্য ছিল মুর্শিদকুলির প্রতি। নবাবের সামান্য দাক্ষিণ্যে, সামান্য প্রিয় সম্ভাষণে ধন্য হয়েছেন তখন। আজ তিনি সকল হারিয়েছেন। রাজার দাক্ষিণ্য স্ফুলিঙ্গের মতো ক্ষণস্থায়ী। মাটির পুতুলের মতো ভঙ্গুর। এ তিনি জেনেও জানেননি। বুঝেও বোঝেননি। আজ বিদ্রোহ করে কী লাভ!
এবারে ভয় ধরল তাঁর মনে। যুদ্ধে আত্মবিসর্জন দিলে তাঁর পরিবারবর্গের কী হবে! হয়তো তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। জোর করে ধর্মান্তরিত করা হবে!
এই পরিণতি স্মরণ করে তিনি শিউরে উঠলেন। স্থির করলেন, যুদ্ধ নয়। সপরিবারে পলায়ন করবেন।
পুত্র সাহেবরাম এবং সকল অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গে নিয়ে বীরকিটির রাজভবন ত্যাগ করে সুলতানাবাদের পর্বত অঞ্চলে আত্মগোপন করলেন উদয়নারায়ণ। কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়ার ভয় তাঁকে তাড়া করে ফিরতে লাগল। আতঙ্কিত অবস্থায় স্থান থেকে স্থানান্তরে ভ্রমণ করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর চেয়েও অন্তঃপুরিকাদের বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল বেশি। অবশেষে তিনি দেবীনগরে উপস্থিত হলেন। এখানেও তাঁর একটি বাসভবন ছিল। কিন্তু দেবীনগরে পৌঁছবার কিয়দ্দিনের মধ্যেই নবাবের সৈন্যরা তাঁকে বন্দি করল। পুত্র সাহেবরাম সহ কারাবাসের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হলেন তিনি। নিষ্ঠুর অত্যাচার ভোগ করতে করতে একদিন পিতা-পুত্র উভয়েরই জীবনাবসান হল।
শোনা যায়, বন্দি হওয়ার পর, নবাবের দরবারে নীত হওয়ার পূর্বে, উদয়নারায়ণ অন্তঃপুরিকাদের বলেছিলেন-তোমরা দেখো। আমাদের বংশের একটি শিশুও যেন ধর্মান্তরিত না হয়। আমরা গিরিধারীর পূজক, মদনগোপালের পূজক, দেবী অপরাজিতার আশীর্বাদের সন্তান। আমাদের নিকট ধর্মান্তর অপেক্ষা প্রাণনাশ শ্রেয়। যদি ধর্ম রক্ষা করতে না পারো, সপরিবারে বিষপান কোরো।
.
হয়তো বিষপান করতে হয়নি তাঁর পরিবারকে। হয়তো অনুগত শৌর্যবান রাজার প্রতি কিছু দয়া-দাক্ষিণ্য ছিল মুর্শিদকুলির অন্তরে। প্রবল ধর্মপরায়ণ নবাব হয়তো অকারণ হত্যা ও অত্যাচারের জন্য আত্মগ্লানি ও পাপবোধে আক্রান্ত হয়েছিলেন। শোনা যায়, রাজা উদয়নারায়ণের মৃত্যুর পর নবাবের দুরারোগ্য ব্যাধি হয়। মাথার যন্ত্রণা! নিরন্তর অনিবার মাথার যন্ত্রণা! কোনও ওষুধে সারে না। কোনও চিকিৎসায় ফল ফলে না। একদিন স্বপ্ন দেখলেন, সতীর কিরীট থেকে যাঁর উত্থান–সেই দেবী কিরীটেশ্বরীকে। দেবী বলছেন—রাজা উদয়নারায়ণের খনন করা শিবের পুকুরের জল পবিত্র। এই জল পান করলে রোগ সারবে।
নবাব চললেন পুকুরের জল পান করার জন্য কিরীটেশ্বরী মন্দিরের দিকে। মুসলমান নবাব। মন্দিরে প্রবেশ করলেন না। চারপাশের শান্ত বনাঞ্চল তাঁর চিত্ত স্নিগ্ধ করে দিল। বটগাছের তলায় সারি সারি মাটির মন্দিরে লেগে থাকা শান্তি আশীর্বাদের মতো স্পর্শ করল তাঁকে। তিনি বহুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন মন্দিরের দিকে। অভিব্যক্তি নিরুত্তেজ! কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে তুমুল আলোড়ন! চোখ শুষ্ক! কিন্তু চোখের আড়ালে অসীম একাকী কান্না! মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। নবাব পায়ে পায়ে পুকুরের দিকে চললেন। নবাবি পোশাক খুলে সামান্য আচ্ছাদন সম্বলে নামলেন পুকুরের জলে। তাঁর জানু ডুবল। কোমর ডুবল। এই মাত্র গভীরতা! তিনি নমাজের ভঙ্গিতে হাত প্রসারিত করলেন। দাঁড়ালেন পশ্চিমে মুখ করে। ওষ্ঠ-অধর নড়ল। কী বললেন নবাব, পারে দাঁড়িয়ে কেউ শুনতে পেল না। তিনি অঞ্জলিভরে জল নিলেন। পান করলেন। একবার। দু’বার। তিনবার। আঃ! কী আরাম। ব্যথা চলে যাচ্ছে। যন্ত্রণা চলে যাচ্ছে! দু’ফোঁটা জল তাঁর চোখের থেকে গড়িয়ে পড়ল। নবাব সংকল্প করলেন, এই পুকুর কেটে বড় করবেন। দীর্ঘিকা গড়বেন।
অদ্যাবধি রয়েছে সেই দীঘি। উত্তর-দক্ষিণে নয়। পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত।