১১১
শ্রাবইন্যা মেঘের ধারা
চোক্ষে ঢালে পানি।
জমিনে পড়িয়ে কান্দে
আভাগী জননী ॥
.
ঘোর তিমিরে এক ছেয়ে গেছে গগন মেদিনী। গুরুগুরু নীরদ গরজনে স্তব্ধ আঁধার জাগরিত ত্রাসে। চির তিমিরাচ্ছন্ন এসেছে শ্রাবণ ঘনঘোর। কড়কড় বাজের শব্দ পঞ্জরাস্থি ফাটিয়ে বিধিয়ে দিল ভয়। কী হবে! কী হয়! কী হয়! যেমনই ছিল না বৃষ্টি এক বৎসরকাল, তারই পরিপূরণ-কল্পে শ্রাবণ এনেছে বারি অকুল পরিমাণ! এ কী! এ কী! এ কী এ!
নদনদী-অধ্যুষিত জেলার মানুষ বহু বৎসরকালের অভিজ্ঞতায় জানে, কী বিভীষিকাময় এই হঠাৎ উথালি হাওয়া এলোমেলো। কোন সর্বনাশের ইশারা এঁকে দেয় আকাশের চিত্রপটে বিদ্যুতের ফলা। থামে না এ বরষণ। থামে না। ধরে না। অবিরাম অনর্গল পড়ে।
বজ্র-বিদ্যুৎসহ মেঘ, মেঘ, মেঘপুঞ্জ নিয়ে এসে যাবে শ্রাবণ, এমনই প্রত্যাশিত। ভরন্ত করে দিয়ে নদ-নদী খাল-বিল বাঁওড় পুকুর দহ—কিছু-বা ডুবিয়ে হাঁটুজলে, সেই আনে সম্বৎসর সমৃদ্ধি বারতা। কল্যাণরুদ্র সে তখন। হরষিত ভৈরব। কিন্তু অনাবৃষ্টির পরবর্তী এ বৎসর, এ কী, এ কী, এ কে! এই রুদ্রভৈরব! এই মত্ত, জটাজুট খুলে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া মেঘপুঞ্জ পুঞ্জ পুঞ্জিত কেশভারের ওই চাপ চাপ খণ্ড খণ্ড রাশি রাশি প্রলাপ বিলাপ এ কার এ কার সে কি ওই মত্ত উন্মত্ত কালভৈরব তাঁর গুরু স্বর বজ্র স্বর ঘোর নির্ঘোষ এ তাঁর মহানৃত্য মেদিনী দ্যুলোক কম্পিত ত্রস্ত করা মহানৃত্য সতীর শীতলদেহ কাঁধে নিয়ে মহানৃত্য কী ক্রোধ কী অঝোর বর্ষণপ্রবণতা!
ক্ষান্তি নেই ক্ষান্তি নেই কেবলই এক ঝরে পড়া বিশাল আকাশ জুড়ে যেন বা ভৈরব সেই উত্তপ্ত মাথা শান্তির নিমিত্ত অতল সাগরজলে ডুবিয়েছিল আর জল সমেত তুলে নিয়ে মাথা করেছে আন্দোলিত ঘোর শব্দে দারুণ পবন উড়ে আসে আর ঝরে পড়ে জল ফোটায় ফোঁটায় সহস্র ফোঁটায় বারি ঝরে ঝরে পড়ে ঠাস শব্দে চড়বড় চড়বড় যেন চড় ও চাপড় পড়ে শরীরের তটে জাগে ভয় জাগে শঙ্কা কী ঘোর কী সর্বনাশ পাতাল হতে ফুঁসে উঠবে শত শত ফণা আকাশের ফলিত জটাভার রুদ্রভৈরব সে কালভৈরবের জটাভার হতে নেমে আসবেই শত ফণিনীর তীব্র কাম তীব্র রোষ পূরিত অগ্নিনিশ্বাস আকুলতা পরস্পর জড়িয়ে জড়িয়ে এ মেদিনী ভূভাগ এই ধরিত্রী ধরণী কেঁপে যায় ভেসে যাবে স্ফুরিত খণ্ডিত আবিল।
এমতাবস্থায় নদী উছলায়। এলোমেলো উথাল-পাথাল হাওয়া ঢেউ তোলে জলে। উন্মত্ত জলরাশি, নিষ্ঠুর ঢেউয়ে এমনকী দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে কাতরায়।
.
অনেকখানি ধসে গেছে জেলেপাড়া। জলের ধাক্কায় ক্ষয় লাগা মাটি গুঁড়ো গুঁড়ো ভেসে যায় জলে। জলে গলে জল হয়ে যাওয়া মাটি ভুলে যায় শিকড়ের অন্তরঙ্গ টান। আরও এক তীব্র টানে, কিংবা অসহায় গলে যাওয়া তার, অসহায় ভেসে যাওয়া, যাবতীয় বৃক্ষরাজি সমূল নিরালম্ব নিরাশ্রয় করে।
এভাবেই চলে গেছে সহকার বৃক্ষগুলি একে একে। বর্ষা চলে গেলে, জল নেমে গেলে, তবে ভাঙন পর্যাপ্ত, সে অপেক্ষা না করে, ভেসে গেছে মাটি। গাছগুলি তাদের জীবন্ত সমাধি হল সলিলে। ভাগীরথী নদীর বুকে সরলরেখার মতো তারা ভেসে গেল। আর বলাই মণ্ডলের বুকে সহস্র চিহ্নিত কাটা দাগ। ফালা ফালা করে দেওয়া দাগ সুগোপন
প্রাণে ধরে বিক্রয় করেনি তো সহকারবৃক্ষগুলি সে। তারা ভেসে গেল। আমবাগান জুড়ে গর্ত গর্ত ভাঙা ভাঙা গোলাকার। তাতে জল ভরা। বলাই মণ্ডল বড় নির্বাক হয়ে আছে। মাঠময় জল থইথই। লোকেরা আশঙ্কা করে। বড়ই আশঙ্কা করে বিপুল বন্যার। এই উথালি-পাথালি হাওয়া, এই হিমেল সজল বায়ু, এ ভাল নয়, ভাল নয়।
ভাগীরথী আমবাগান গিলে কোনাকুনি আঘাত করেছে জেলেদের উদাসী বসত। কারও দেওয়াল খসে গেছে। ভিত জুড়ে চওড়া ফাটল। ভরা নদী, হাওয়ার প্ররোচনায় সেরে নিতে চায় যার যত ভাঙন-কল্পনা!
এত ভরা নদী, উন্মত্তা এত, রুদ্রধর্মে, বিষের কামড়ে কখন ঢুকে পড়ে গ্রামে, গুরু গুরু ভয় বুকে বাজে। লোকে কাজ ফেলে দেখে নদী। ও নদী, নদীরে, কত দূর এল, খেল কত, জলের সম্ভারে চাপা, বোঝাও যায় না ভাল।
বিপন্ন চতুষ্কোনা গ্রাম। বিপন্ন। এমতাবস্থায় শহর বহরমপুর, সে-ও কিছু নিরাপত্তাহীন। নদী যে শহর নগর গ্রাম মানে নাকো। তার সকলে অভিরুচি। অতএব সন্ত্রস্ত গৃহ-গৃহান্তর।
.
নিরাপত্তাকল্পে নেতৃবৃন্দ পথে নেমেছেন। বিধায়ক নিখিলেশ চৌধুরীর বিরুদ্ধে উন্মত্ত, সরব মিহির রক্ষিত। ওই গ্রাম, ওই চতুষ্কোনা গ্রাম বাঁচাবার তরে তাঁর অতুল আন্দোলন কে-বা ভোলে। বোল্ডার ফেলে জলের বিরুদ্ধে শক্তপোক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যবস্থা তিনি কবেই করেছিলেন। বাকি ছিল সামান্য কাজ। সেই সামান্যতা উড়ে যেত কবেই যদি তিনি বিধায়ক হতেন। এতদিনে বেঁধে যেত পাড়, বানর দ্বারা সমুদ্রবন্ধন কৌশলে ও দক্ষতায়।
হল না তা। হল না বলেই চতুষ্কোনা বিপন্ন আজ। মিহির রক্ষিত, অতএব, অস্থির ও ক্রুদ্ধ। তিনি, নওয়াজ এবং অন্যান্য অনুচর সহচর সমেত তাই উপস্থিত চতুষ্কোনায়। লোক তাঁকে ঘিরে আছে। সুকুমার পোদ্দার স্বয়ং তাঁর মাথায় ছাতা ধরে আছেন। কেন না, অঞ্চলে পরাস্ত এই নেতা। যথার্থ ক্ষমতাবান তবু, কারণ রাজ্যের রাজপাটের ধ্বজা ধরা আছে এঁরই দলপতির হাতে। একবার হেরেছেন, তাতে কী? জিতবেন আরবার। জয়লাভ করবেনই এ জীবনের তটে কোনও দিন।
লোকারণ্য পাড়। সকলেরই প্রত্যাশা, পাড় বাঁধা হোক, বেঁধে দেওয়া হোক, যেন- তেন-প্রকারেণ প্রতিরুদ্ধ হোক বন্যার সম্ভাবনা।
—বোল্ডারের বাঁধ অধিক দিন টিকে না।
—অধিক দিন না টিকুক, এক বৎসর তো টিঁকে।
—হ্যাঁ। এই হল কথা। এক বৎসর সামাল তো দিই আগে। পরেরটা পরে ভাবা যাবে।
—হ্যাঁ। নইলে ঘর-সংসার নিয়ে যাব কোথা? সেই তো ভেসে ভেসে বেড়ানো। গেল বৎসর খরা গেল। ঘর শূন্য। ঋণে ধারে গলা ডুবে গেছে। এ বৎসর বন্যা হলে সামাল দেব কী প্রকারে?
—আবার সেই পাকা সড়কে প্লাস্টিকের ছাউনি তুলে বাস। নদীর এ যা রূপ দেখছি, সড়কও না ভাসিয়ে দেয়।
উথালি বাতাস, মানুষগুলিকে ঠেলে ফেলে দিতে চায়। বৃষ্টির দাপট যেন ঝড়ো আভাসের মতো। বজ্র-বিদ্যুৎ সশব্দে ভেঙে পড়ে মাথার ওপর। চিরকালের চেনা নদী উন্মত্তস্রোতা হয়ে অচেনা করে দেয় সম্পর্কের যতেক শিলমোহর।
পূর্তবিদ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে দেখছেন। এই নদী আগ্রাসী হয়ে উঠবে যে কোনও সময়, ডুবিয়ে ভাসিয়ে দেবে গ্রাম-গ্রামান্তর। যে ক্ষয় লেগেছে পাড়ে, যে ভাঙন, এ মুহূর্তে রোধ করা যাবে না তা। তিনি জানেন। মাঝখানে জেগে ওঠা ওই চর, ওই পেতনির চরের জন্য, মাটি ভেঙেচুরে শরীর বাঁকিয়ে নেবে নদী। জলে ভর-ভরতি দেহ পরিসর করে নেবে প্রবাহিণী হতে।
আরও আগে, কেন ঘটেনি এমন, সেই তাঁর আশ্চর্য লাগে। তরুণ পূর্তবিদ তিনি। অভিজ্ঞতা, কম। পঠন ও জ্ঞানের পুঁজি সম্বল। পূর্বতন পূর্তবিদ রায়ের স্থলে এসেছেন ন্যায় নিষ্ঠা সততার আদর্শ বুকে করে। স্বপ্ন তাঁর, গড়ে তুলবেন, এই ভারতের বৃহৎ প্রকল্প যত। রূপায়িত করবেন, জনকল্যাণী যতেক পরিকল্পনা। পদ্মের পাপড়ির মতো বড় বড় চোখে তাঁর সে স্বপ্ন আঁকা আছে।
বড় বড় চোখ, পদ্মের পাপড়ির মতো। বিস্তৃত আঁখিতট আকর্ণবিশেষী। তাই নাম তাঁর পুণ্ডরীকাক্ষ। বন্ধুরা বদলে দিয়ে গড়েছিল পিণ্ডির কাক। তার থেকে কেটে-ছেঁটে রয়ে গিয়েছিল পিণ্ডিটাই। হাওয়ায় ভাসে সে নাম। সর্বত্র প্রচারিত হয়ে গেছে বায়ুমন্ত্রে।
বজ্র মাথায় করে, বন্যা সমাগত রেখেও নামের বিষাদ তাঁর ঘোচে নাই। পি দত্ত বলেন পরিচয়ে।
আহা! হতে পারত আরও কত নাম! কমলাক্ষ, নলিনাক্ষ, পদ্মাক্ষ—সব ছেড়ে পিতামহী রেখেছিলেন নাম, পুণ্ডরীকাক্ষ।
পুণ্ডরীকাক্ষ, তরুণ তিনি, দীর্ঘ দেহে নির্মেদ শীর্ণতা, তীক্ষ্ণ নাসিকায় গুরুভার চশমার কাচে বৃষ্টি পড়ে দিঠি ঝাপসা করে দেয়। এই হু-হু বাতাসেও তাঁর দেহ হতে স্বেদ নামে। অবিরল নামে। কী করবেন তিনি? এই ঘন শ্রাবণের ধারাপাতে, আসন্ন বন্যায়, বিধ্বংসী সম্ভাবনায়, এতগুলি মানুষের জীবনযাপন তাঁর দিকে চেয়ে আছে প্রতিকার-প্রত্যাশা নিয়ে। তিনি সমাধান করবেন কী প্রকারে?
তাঁর পূর্বতন পূর্তবিদ রায় বিধান দিয়েছিলেন, বোল্ডার-প্রাচীর দিলেই হবে সমাধান। কিন্তু তাঁর প্রশিক্ষা তা বলে না। এই মুহূর্তে, এই ভারী বর্ষণে, কিছুই করার নেই নদীর গতিবিধি লক্ষ করা ছাড়া। বর্ষা পার হয়ে গেলে যতখানি জমি-ডাঙা বাঁচানো যায়, চেষ্টা করতে হবে। এখন তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে দাঁড়িয়ে আছেন যত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তাঁর মনে হয়, তাঁদের উচিত, যত শীঘ্র সম্ভব, গ্রামের মানুষের জন্য সাময়িক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।
তিনি মুখ ফুটে তা বলবেন কি না ভাবেন, আর ভাবনা মিলিয়ে যায় তাঁর। কেননা জনতা দাবি তোলে, বোল্ডার-প্রাচীর গাঁথার অনুমতি দেওয়া হোক।
মিহির রক্ষিত বলেন—শ্রীরায় ছিলেন অভিজ্ঞ পূর্তবিদ। তিনি বলেছিলেন, বোল্ডার-প্রাচীর গাঁথলে ভাঙন আটকানো যাবে। নদী ভরে গেলে জলও সেরকম ঢুকতে পারবে না। আপনি এই মুহূর্তে তার অনুমোদন করুন। এখুনি, সামরিক তৎপরতায় কাজ শুরু করুন।
তরুণ পূর্তবিদ পি দত্ত, পদ্মের পাপড়ির আকর্ণবিস্তৃত চোখ তুলে চারপাশে অসহায় তাকান। সহস্র দৃষ্টি তাঁর দিকে। স্নায়বিক চাপে তাঁর জিহ্বা অসাড় হয়ে আসে। হাত কাঁপে। পা কাঁপে। সম্মুখে নেতৃবৃন্দের জটিল-কুটিল মুখ। চারপাশে অসহিষ্ণু প্রত্যাশিত মুখের দেওয়াল।
তবু, পুণ্ডরীকাক্ষ তিনি, বিন্দু বিন্দু শক্তি সঞ্চয় করেন, বৃষ্টি ভেদ করে, সরল কণ্ঠে বলেন— শ্রীরায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, এই বৃষ্টিতে বাঁধ দেওয়া সম্ভব নয়। পাথরের বাঁধ হলে ও নয়।
মিহির রক্ষিত মুখ-চোখ বিকৃত করেন। শ্লেষ ফুটিয়ে তোলেন নিখুঁত, আপন শ্রীকণ্ঠে, বলেন—কেন? বোল্ডার কি শিলা হয়ে জলে ভেসে যাবে?
বৃষ্টিভেজা জনতা হা-হা হাসে। গুম-গুম মেঘের আওয়াজ। দন্তরুচি ঝলসে দিয়ে আকাশ সেও বুঝি বৈদ্যুতিক হাসে। পি দত্তর বুকেও গুম্-গুম্ বাজে ভয়ের কাঁসর-ঘণ্টা। কতই না খবর শুনেছেন, উত্তেজিত জনতার হাতে চরম প্রহার, তাঁর ভয় করে, বড় ভয় করে মারামারি, অশালীন খিস্তি-খেউড়। আগাগোড়া এ জীবনে পাঠমগ্ন সুশীল মানুষ, ভয়ে ভয়ে তবু তিনি অনমনীয় থেকে যান সিদ্ধান্তে। বুঝতেও পারছেন, হবে না, লাভ হবে না কিছু, তবু কী করে বলেন, কী করে ভরসা দেন, এতগুলি মানুষকে রক্ষার আশা দিয়ে প্রবঞ্চনা করেন তিনি কী প্রকারে! কোথায় যাবে তাঁর শিক্ষা, তাঁর সততা, তাঁর ন্যায়বোধ?
তাঁর শিক্ষা, তাঁর সততা, তাঁর ন্যায়বোধ, স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে চায়। অকম্প্র প্রদীপশিখার মতো থাকতে চায় সিদ্ধান্ত অনড়। তিনি বলেন—কোটি কোটি সরকারি টাকা জলে চলে যাবে। লাভ নেই। আপনারা বরং জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে থাকুন।
মিহির রক্ষিত চিৎকার করেন—এই বিপন্ন পরিবারগুলিকে দেখেও আপনি কোনও ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করছেন? আপনি পাবলিক সার্ভেন্ট। জনগণের চাকর আপনি। ভুলে যাচ্ছেন কি সেকথা? এতগুলো পরিবারকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন আপনি? এ চলবে না। এ চলবে না।
তাৎক্ষণিক স্লোগান-নির্ঘোষ ওঠে—এ চলবে না, এ চলবে না।
আমাদের দাবি মানতে হবে।
মানতে হবে, মানতে হবে।
বোল্ডার ফেলতে হবে।
ফেলতে হবে, ফেলতে হবে।
পিণ্ডিবাবু মুর্দাবাদ।
মুর্দাবাদ, মুর্দাবাদ।
তখন একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়। সেই গাড়ি হতে সপারিষদ নেমে আসেন কংগ্রেসের আসাদুর রহমান এবং আর এস পি-র আনিসুর রহমান। দলের অনুচরবৃন্দ তাঁদের মাথায় ছাতা ধরে। বিগলিত হাস্যে প্রত্যুদগমন করেন মিহির রক্ষিত।
—আসুন আসুন। আমি ধন্য আপনারা কথা রেখেছেন।
তিনি দুই নেতাকে সঙ্গে করে নদীর ভয়াবহ প্রবণতা বোঝান। জল ঢুকবে বহরমপুর শহরেও এবার, তা নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা হয়।
উপস্থিত জনতা দেখে, সকলেই একযোগ, এককাট্টা। পাড় বাঁধাবার আন্দোলনে সব দল তাদের পাশে আছে। ভয় নেই। এইবার ভয় নেই।
আর পুণ্ডরীকাক্ষর ভয় বাড়ে। আকর্ণবিসারী চোখে বাড়ে ত্রাস। তিনি উপলব্ধি করেন চাপ আরও চাপ। তিন-তিনটি শক্তিমান রাজনৈতিক দলের চাপ
অঝোর ধারায় নামে বৃষ্টি। তারা বেপরোয়া। বেপরোয়া বৃষ্টির ফোঁটারা। রাজনীতি রেয়াৎ করে না তারা, নদীতে খালে বিলে বাঁওড়ে দহে জল বাড়িয়ে চলে শ্রাবণবর্ষণ। বিষণ্ণ বলাই মণ্ডল কথাটি বলেন না। কাগজ-কলম নিয়ে গৃহকোণে স্তব্ধ বসে আছেন সেই প্রত্যুষ হতে। লেখেননি একটি বর্ণও। তীর্থ বলছে—বাবা, কী করছ? কিছুই তো লেখোনি!
—চুপ!
বলাই মণ্ডল ঠোঁটে আঙুল রাখছেন।
—চুপ! চুপ!
ফিসফিস বলছেন তিনি।
—জোরে কথা বলিস না! চলে যাবে!
তীর্থ চাপা স্বরে বলছে—কে চলে যাবে বাবা? কে?
—সে। সে। জলের তলায় যা লুকিয়ে আছে কতকাল কতযুগ। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে যাকে খুঁজেছি, সে। সে-ই। আমবাগানে, আমবাগানে, কতদিন দেখেছি তাকে, ছুঁতে গেছি যেই, মিলিয়ে গিয়েছে। সে আসবে। আসবে। চুপ করে শোন, শুনতে পাচ্ছিস? পায়ের শব্দ? শোন শোন।
—কার বাবা? কার?
—সেই শ্রেষ্ঠতমা, পৃথিবীর প্রত্যেক কবি যাকে ছুঁতে চায়। কাব্যলক্ষ্মী সে, দেখা দেয়, ধরা তো দেয় না তীর্থ। পৃথিবীর সব কবি, তাকে পাবার জন্যই, কোল পেতে বসে থাকে। সেই শ্রেষ্ঠতমা কবিতা। সে আসছে। আসছে। চলে যা তুই তীর্থ। তুই থাকলে সে না-ও আসতে পারে। আর একবার যদি সে ধরা দেবে বলে আসে, আর যদি তাকে… যদি তাকে… শোন তীৰ্থ, চলে যা তুই! আর দেখিস তো বাবা, এ ঘরে কেউ যেন না আসে! দেখিস তো!
তীর্থ বলাই মণ্ডলের চোখের দিকে তাকায়। সেই চোখে কী যেন টালমাটাল, কী যেন এলোমেলো। বুকের তলায় মোচড় লেগে যায়। ব্যথা করে ওঠে কণ্ঠ। সে ঠোঁট চেপে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। আকাশ-বাতাস জুড়ে কী এক ভয়! সেই ভয় ঘরেও তাড়া করে তাকে। তার তরুণ হৃদয় দ্বারা সে বোঝে, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব। অসহায় কান্না পায় তার। ইচ্ছে করে, কারওকে আঁকড়িয়ে ধরতে, বলতে ইচ্ছে করে, বাবার আচরণ কীরকম অচেনা লাগছে তার। ভয় লাগছে। হায়! কাকে সে বলে। একবার বদরকাকার কথা তার মনে হয়। কিন্তু বদরুদ্দিন সে এখন আন্দোলনে ব্যস্ত। আপন কাকার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় নেই। সে চুপচাপ আঙিনায় বারিপাত দেখে। স্ফুরিত বিদ্যুৎ দেখে আকাশের।
তখন, স্লোগানের ভঙ্গিতে রব ওঠে চারিদিকে। মিহির রক্ষিত বদরুদ্দিনকে ডেকে নেন পাশে। বলেন—বদর, বোঝাও এঁদের। এই দত্তবাবুর মতলব ভাল নয় বোঝাও।
বদরুদ্দিনকে এক মুহূর্ত দ্বিধান্বিত দেখায়। তখন মিহির রক্ষিত গলা তোলেন—ভাইসব, আপনাদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করবে সমস্ত চক্রান্ত। আপনারা দাবি জানান। আজ আপনাদের পাশে আমরা সকলেই আছি। ইনি আপনাদের জন্য সরকারি অর্থ খরচ করতে চান না।
তরুণ পুণ্ডরীকাক্ষ কিছু বলতে চান। বোঝাতে চান। তাঁর স্বর ঢেকে যায় বজ্রনাদে। তখন তিনি অসহায় তাকালেন আশেপাশে। তাঁর দলের অধিকারিক যত, নীরব, বিমুখ, তাঁর সমর্থনে নেই কেউ।
তখন জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। একজন মন্তব্য করে—কী? সরকার বাপ নাকি আপনার? আপনার বাপের টাকা যাবে?
—পুঁতে রাখব এখানে।
—জলে ডুবিয়ে দেব।
তখন ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এল সে। সে সিদ্ধার্থ। সে এসেছে কখন আর দাঁড়িয়েছে ভিড়ে জানে না কেউ। সে বলল— আপনারা উত্তেজিত হবেন না।
তাকে দেখে জনতা থমকায়। থমকায় নেতৃবর্গ। এবং তাঁদের বুকে বিষ ফেনিয়ে ওঠে। সিদ্ধার্থ বলে— ইনি ঠিকই বলেছেন। ইনি যথেষ্ট শিক্ষিত এবং সমঝদার। ইনি নদীবিজ্ঞান জানেন। বাঁধের প্রযুক্তি জানেন। আপনারা বুঝতে পারছেন না কেন, বোল্ডার দিয়ে পাড় বাঁধানোর কাজ শেষ হতে না হতেই নদী ফুলে উঠতে পারে। তা ছাড়া পাড়ের মাটি নরম এখন বোল্ডারের চাপে তা বসে যাবে। পাড় আরও দ্রুত ভাঙবে। বোল্ডার নদীগর্ভে চলে গেলে বাড়তি জল উপচে আরও বেশি করে ভাসিয়ে দেবে গ্রাম। এঁর কথা যুক্তিসঙ্গত। বোঝার চেষ্টা করুন আপনারা। ভাঙন বা বন্যা এইভাবে আটকানো যায় না। তার চেয়ে আসুন আমরা অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করি।
মিহির রক্ষিত, সিদ্ধার্থর কথা শেষ হওয়া মাত্র, চিৎকার করেন—এ দলত্যাগী। বিশ্বাসঘাতক। এর কথা বিশ্বাস করবেন না।
আসাদুর রহমান বলেন-এ আপনাদের অধিকার কেড়ে নিতে চায়।
আনিসুর রহমান বলেন—এ এই সংযুক্ত আন্দোলন বানচাল করে নিজের শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই হীন চক্রান্তে ভুলবেন না। বন্ধুগণ, মনে রাখবেন, এ আপনাদের জীবনের বিপন্নতা।
জনতার বুকে জাগে দ্বিধা, সিধুবাবু তিনি, দলত্যাগী বটে, কিন্তু তাঁর মতো জনদরদি কে আছে? লোকে মতামতে ভাগ হয়ে যায়। একদল গর্জায়, সিধুবাবু নিপাত যাও। পিণ্ডিবাবু নিপাত যাও।
অন্যদল চুপ করে থাকে। নিষ্ক্রিয় থাকে তারা। সিদ্ধার্থর প্রতি গড়ে ওঠা গভীর বিশ্বাসে স্থির হয়ে থাকে।
নেতৃবৃন্দ এই দ্বিধা অনুভব করে। এখন, সিদ্ধার্থকে কথা বলতে দিলে, সে, হতে পারে, প্রভাবিত করে ফেলবে গোটা গ্রাম। মিহির রক্ষিত নওয়াজকে ইশারা করেন। নওয়াজ সে ইশারা চালিত করে দেয়। একজন উম্মত্তবৎ ছুটে এসে আঘাত করে সিদ্ধার্থকে। আচমকা। ঘিরে ধরে আরও কয়েকজন। সিদ্ধার্থকে মারতে থাকে তারা। হইচই ওঠে। কেউ কেউ পালিয়ে যায় আরও বড় অঘটনের শঙ্কায়। প্রহার-বৃত্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে সফি ও বসির খান। সিদ্ধার্থকে আগলে পালটা মার দেয় নিপুণ শিক্ষণে।
মিহির রক্ষিত এই সুযোগ সদ্ব্যবহার করেন। প্রমাণ করে দিতে চান তিনি কত বড় জনকল্যাণকামী। চিৎকার করেন—আরে, বদর, নওয়াজ, থামাও। এসব কী! জনতা উত্তেজিত হয়ে গেলে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে নাকি?
বদরুদ্দিন এবং নওয়াজ এগিয়ে গেল কথামতো। প্রহার বা হানাহানি নিরস্ত করতে প্রয়াসী হল তারা। তাদের হস্তক্ষেপ-মাত্র দ্রুত ভিড়ে মিশে গেল প্রহারের হাত তোলা লোকজন। শুধু দু’জন আটকে রইল সফি ও বসির খানের হাতে। নেংটি ইঁদুরের মতো লটপট করতে থাকা দুটি বলিষ্ঠ যুবক।
সিদ্ধার্থ পড়ে গিয়েছিল। সর্বাঙ্গে কাদামাখা। উঠে দাঁড়াল সে। কিছু-বা লেগেছে তার। কিন্তু এটুকু নেবার ক্ষমতা তার আছে। সে মুখ মুছতে মুছতে বলল—ওদের ছেড়ে দাও সফি। চলো, আমরা ফিরে যাই। অনেক কাজ আছে।
কারওকে বিদায়-সম্ভাষণ সে জানাল না। চলে গেল একটি বাইকে আরোহণ করে। কিছু লোক দেখল ব্যথিত। কিছু লোক দেখল বিরক্ত। তারা চলে গেল।
মিহির রক্ষিত, প্রহার মিটে যাবার পূর্বেই সুকুমার পোদ্দারকে বলেছিলেন—এত গোলমালে কোনও সিদ্ধান্ত হয় না। আমরা পঞ্চায়েত দপ্তরে বসতে পারি কি?
—নিশ্চয়ই।
বলেছিলেন সুকুমার পোদ্দার। পুণ্ডরীকাক্ষ দত্তকে নিয়ে তাঁরা সদলে চলে গেলেন পঞ্চায়েতে। একটি ঘরে, একটি টেবিলের প্রান্তবর্তী চেয়ারে বসানো হল তাঁকে।
বাইরে অঝোর বৃষ্টি। সকলের পোশাক ভিজে গেছে। পি দত্ত দেখলেন তাঁকে ঘিরে উত্তেজিত কিন্তু শীতল সব মুখ। সেই মুখগুলি তাঁকে শোণিতাক্ষ দেখিয়ে ফিরতে লাগল। চাপ দিতে লাগল। চাপ চাপ স্নায়ুচাপ। বোল্ডার ফেলা। বোল্ডার ফেলা। পাড় বাঁধানো। আপৎকালীন এ ব্যবস্থা। অনুমতি দিন। অনুমতি দিন। না দিলে …
কুলুকুলু ঘেমে যাচ্ছেন তিনি। স্নায়বিক চাপে ঠোঁট কাঁপছে। হাত-পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। নদীবিজ্ঞানের পাঠ নিয়েছেন। পড়তে পড়তে শান্ত চোখে পুরু কাচের চশমা। হায়! রাজনৈতিক জটিল কুটিল চাপ সহ্য করার পাঠ নেওয়া হয়নি। জানা হয়নি, ন্যায়-নীতিবোধের শিক্ষা উপড়ে নিলে কতখানি ব্যথা হয় বুকের পঞ্জরে! তাঁর চারপাশে লোহিতাক্ষ মুখগুলি ফিরছে। বলছে—মাকে দেখতে চান…
—স্ত্রীকে দেখতে চান…
—সন্তানকে দেখতে চান…
—থাকতে চান সুস্থ সবল …
তরুণ পূর্তবিদ, স্নায়বিক তাড়নায়, ভয়ে, ত্রাসে, আত্মগ্লানিতে, স্বপ্নভঙ্গের কারুণ্যে ভেঙে পড়লেন ক্ষয় লাগা ভূখণ্ডেরই মতো।