মণি

মণি

মণি আসছে।

ঠিক সাত বছর তিন মাস পর মণি তার ছেলে কাজলকে নিয়ে বিদেশ থেকে আজ আসছে। স্বামীর ব্যাবসা, ছেলের স্কুল, নিজের গবেষণার মতো নানা ধরনের ব্যস্ততায় সে অনেকদিন দেশে ঘুরে যাওয়ার সময় পায়নি। এতদিন পর পেল। অর্জুন অবশ্য এখনই আসতে পারছে না। তবে সেও আসবে! একমাস পর এসে সে ক’দিন থাকবে, তারপর স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে ফিরে যাবে। পাঁচ বছরের কাজল এই প্রথম তার মামার বাড়ি দেখতে পাবে।

স্বাভাবিকভাবেই আজ একটা আনন্দের দিন। ছোটখাটো আনন্দ নয়, বড় আনন্দ।

বড় আনন্দের সময় যে-কোনও বাড়িতেই হইচই হয়। পাশে বসে থাকলেও একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে গলা তুলে। চিৎকার করে ডাকাডাকি হয়। ছোটরা দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে একবার ওঠে, একবার নামে। তাদের মায়েরা গলা ফাটিয়ে ছেলেমেয়েদের বকতে থাকে। অবধারিতভাবে এইসময় কোনও একজন পা পিছলে পড়ে যায় এবং ব্যথা না লাগলেও কাঁদতে শুরু করে ভয়াবহ জোরে। আশপাশের বাড়ি থেকে সেই কান্না শোনা যায়। শুধু কান্না নয়, এ ধরনের আনন্দের সময় হাসাহাসিও হয় পাড়া-প্রতিবেশীকে জানিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেইসব হাসির কোনও কারণ থাকে না। তবু সবাই হাসে। যে-কোনও আনন্দঘন মুহূর্তে মানুষ কারণের থেকে অকারণে হাসতে বেশি ভালবাসে। হইচই যখন বেশ কান চালাপালার পর্যায়ে পৌঁছে যায়, বাড়ির অল্পবয়সিরা তখন প্রবল উৎসাহ অনুভব করে এবং বেদম জোরে ক্যাসেট বা সিড়ি চালিয়ে দেয়। হট্টগোলের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে তারস্বরে সেই গানবাজনা চলতে থাকে। কেউ কেউ সেই আওয়াজ কমানোর জন্য অনুরোধ করে বটে কিন্তু গানের দাপটে সেই অনুরোধ খুব সহজেই চাপা পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায়, যে ভুরু কুঁচকে আপত্তি তুলেছিল, সে মহানন্দে বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা নাড়ছে।

এ-বাড়িতে আজ কিন্তু উলটো ঘটনা ঘটছে।

আত্মীয়স্বজনে বাড়ি ভরতি। কিন্তু কোনও হইহট্টগোল নেই। বড়রা গলা নামিয়ে কথা বলছে। ছোটরা পা টিপে হাঁটছে। খুব জোর হাসি পেলে মেয়েরা মুখে হাত চাপা দিচ্ছে। হাত চাপা দিয়ে হাসতে গিয়ে দু’-একজন বিষম খেয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই।

সকালে চায়ের টেবিলে রমাকান্তবাবু ঘোষণা করেছেন, ‘আনন্দ হোক, উৎসব হোক, খুব ভাল কথা। কিন্তু হইচই চিৎকার চেঁচামেচি করা চলবে না।’ রমাকান্ত চৌধুরি মণির বাবা। আটষট্টি বছর বয়স। শক্ত সবল প্রধানত রাগী এই মানুষটি এ-বাড়ির কর্তা। হেড অব দ্য ফ্যামিলি। ফলে তাঁর কথা না মেনে কোনও উপায় নেই।

মণির দূর সম্পর্কের দাদা কল্যাণ কাল রাতেই বউ সুতপা মেয়ে চন্দনাকে নিয়ে আসানসোল থেকে চলে এসেছে। খুবই ফুর্তিবাজ মানুষ। কমপক্ষে এক হাজার জোকস্ সবসময় তার স্টকে থাকে। মণির বড় ভাই বাবলু, বাবলুর স্ত্রী কাকলি এবং বড়দি কণি কল্যাণকে খবর পাঠিয়ে প্রায় জোর করে নিয়ে এসেছে। তাদের মনে হয়েছে, মণির আসা উপলক্ষে বাড়িতে এরকম একটা মানুষের খুব দরকার। এই মানুষ হাসাহাসিতে নতুন একটা মাত্রা যোগ করতে পারবে। কাল রাতে পৌঁছেই কল্যাণ কাজ শুরু করে দিয়েছে। মোট দেড়শো মতো জোকস্‌ ইতিমধ্যে সে বলে ফেলেছে। গভীর রাত পর্যন্ত সেই জোকস্ কাণ্ড চলে। সুতপা বুদ্ধির রসিকতাগুলো তেমন ধরতে না পারলেও মোটা দাগেরগুলোতে খুবই হাসে। আজ সকালেও চায়ের টেবিলে ডিম নিয়ে সে একটা জোকস্ শুরু করেছিল। জোকসের বিষয়, বিদেশি ডিম এবং দেশি ওমলেট। মাঝপথেই রমাকান্তবাবু তাকে থামিয়ে দেন এবং গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ভেবেছিলাম তোমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। ভুল ভেবেছিলাম। এখন দেখছি খুবই দরকার আছে। তোমরা দেখছি ভুলে গেছ যে, ছোটবেলা থেকেই মণি একটু বেশিরকমের শান্তশিষ্ট। আমার মতোই সে চেঁচামেচি বা হট্টগোল পছন্দ করে না। এমনকী সে কখনও জোরে কথাও বলেনি। আশা করি তার ছেলেও সেরকম হয়েছে। সুতরাং তোমরা এমন কিছু করবে না যাতে তারা বিরক্ত হয় অথবা তাদের অসুবিধে হয়।’ কল্যাণ বলল, ‘মামা, এটা আপনি কী বলছেন? মণি যে আগের মতোই আছে সে সম্পর্কে কি আপনি নিশ্চিত? আপনি বোধহয় জানেন না যে, দীর্ঘদিন বাইরে থাকলে মানুষ পালটে যায়। অন্যরকম জলহাওয়া, অন্যরকম ফুড-হ্যাভিটির জন্যই এরকম হয়। আমার এক বুদ্ধিমান কাকা তেইশ বছর জাপানে থাকার পর ভীষণ বোকা হয়ে ফিরেছিলেন। হয়তো দেখবেন মণিও আর শান্ত নেই। খুব দুরন্ত হয়ে গেছে। বলা যায় না, বিল্টু মিন্টু তিতলির সঙ্গে বেডরুমেই হয়তো ব্যাডমিন্টন খেলতে শুরু করে দেবে।’ হাসি চেপে মণির পিসিমা বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ কল্যাণ। খাবারদাবারের জন্য এরকম হতে পারে। শুনেছি, জাপানিরা আরশোলা খায়। হয়তো তোমার কাকাও খেয়েছিলেন। তাই এরকম হয়েছিল। তবে আমাদের মণি তো আর আরশোলা খায় না। তার স্বভাব কেন পালটাবে?’ পিসিমার কথায় মণির ছোটমাসি কোনওরকমে হাসি সামলে বললেন, ‘পালটে না যাক, উলটোও তো হতে পারে। দেখবে মণি হয়তো আরও শান্ত হয়ে গেছে। সকাল বিকেল নিয়ম করে ধ্যান করছে।’ তিতলি খিকখিক করে হেসে বলল, ‘ওমা ধ্যান করবে কেন? মণিদিদি কি সন্ন্যাসী হয়ে গেছে নাকি? ছবিতে যে দেখলাম প্যান্ট শার্ট পরে গাড়ি চালাচ্ছে! সন্ন্যাসীরা পান্ট শার্ট পরে গাড়ি চালায় নাকি মা?’ মিন্টুর বাবা পরিতোষ সম্পর্কে এবাড়ির জামাই হয়। কিছু জামাইয়ের স্বভাব হল ট্যাঁক ট্যাঁক ধরনের কথা বলা। পরিতোষও সে রকম একজন জামাই। সে বাটার টোস্টে কামড় দিয়ে রমাকান্তবাবুকে বলল, ‘সে আপনি যাই বলুন মেসোমশাই, মেয়ে আসছে, নাতি আসছে, আপনার খানিক হইচই করা উচিত। কান্না যেমন চেপে থাকতে নেই, তেমনই আনন্দও শরীরের ভেতর থেকে বের করে দিতে হয়। নইলে বদ হজম হয়ে যায়। কী বলো কল্যাণ, কথাটা ঠিক কিনা?’ কল্যাণ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই রমাকান্তবাবু টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। গলা আরও গম্ভীর করে বললেন, ‘এটা কোনও বিতর্কের আসর নয়। মানুষ শান্তির জন্য ঘরে আসে। মণিও নিশ্চয় সে কারণে আসছে। আমি চাই তোমরা সেটা মনে রাখবে। এটাকে আমার নির্দেশ বলেই ধরতে পারো।’

ফলে যেটা এখন চলছে সেটা হল চাপা আনন্দ। চাপা আনন্দের মজা হল, এই সময় যে-কারও চোখ খুব উজ্জ্বল হয়ে যায়। এ-বাড়িতে এখন সেটাই হয়েছে। সকলে উজ্জ্বল চোখ নিয়ে চলাফেরা করছে। রমাকান্তবাবুর চোখদুটো সবথেকে বেশি। উজ্জ্বল।

প্রথমে ঠিক হয়েছিল মণি আর কাজল থাকবে দোতলায়। সেইমতো দোতলার পুবের ঘর রং করা হল। নীল রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কণি নীল পরদা কিনে আনল। কাকলি অনেক খুঁজে নিয়ে এল নীল রঙের ফুলদানি। তিতলি তার স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে নীল ফুলের নাম জেনে একটা তালিকা বানিয়ে ফেলল। সে ঠিক করেছে পিসি এলে নীল রঙের ফুলদানিতে নীল ফুল সাজাবে।

বাবলুও একটা কাণ্ড করে বসল। একদিন সন্ধেবেলা একটা এসি মেশিন ভাড়া করে এনে হাজির। সঙ্গে জনা তিন মুশকো ধরনের মিস্ত্রি। রমাকান্তবাবু বললেন, ‘এসব কী করেছিস! তোর বোন তো এখানে এসিতে থাকত না।’ বাবলু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না না, এটা মণির জন্য নয়। কাজলের গরম লাগতে পারে। সে তো কখনও এসি ছাড়া থাকে না। ওদের বাড়ি গাড়ি সবই তো হয় ঠান্ডা, নয় গরম৷ থাক, ওরা চলে গেলে খুলে ফেললেই হবে।’ সন্ধেবেলাতেই মিস্ত্রিরা ঘ্যাসর ঘ্যাসর করে জানলা কেটে সেই মেশিন বসিয়ে ফেলল। রমাকান্তবাবু মনে মনে খুব খুশি হলেও, মুখে বললেন, ‘উফ তোরা যা বাড়াবাড়ি করতে পারিস।’

ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় গোটা পরিকল্পনা বদলে গেল। এক রবিবারের দুপুরে রমলাদেবী মেয়ের পাঠানো ছবির অ্যালবাম খুলে বললেন, ‘অসম্ভব, দোতলার ঘরে মণিরা থাকতে পারবে না। বাবলু, তোর কি একবারও মাথায় এল না যে মণির অ্যালবামটা একবার দেখি! আশ্চর্য, সবকিছু আমাকে ভাবতে হবে!’ বাবলু অবাক হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে। অ্যালবাম কেন দেখব? অনেকবারই তো দেখেছি!’ রমলাদেবী বললেন, ‘ঘোড়ার মাথা দেখেছিস। মণির বেডরুমটা দেখেছিস একবার? নে দ্যাখ। জানলাটার দিকে একবার তাকা। দ্যাখ কী সুন্দর একটা গাছ। একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে মনে হচ্ছে। এবার আমাদের দোতলার জানলাটার সামনে গিয়ে দাঁড়া। ছিঃ, খুললেই পেছনের বাড়ির তেলচিটচিটে দেয়াল। দেয়ালের গায়ে জানলা। রান্নাঘরের জানলা। সারাক্ষণ পাঁচফোড়নের গন্ধ। ইস মাগো! মণি ও ঘরে কিছুতেই ঘুমোতে পারবে না।’ কণি বলল, ‘সে আর কী করা যাবে, আমরা তো আর একটা গাছ এনে পুঁতে দিতে পারি না। তা ছাড়া ছবিতে গাছটা দেখে মনে হচ্ছে রডোড্রেনডন। এই ভবানীপুরে রডোড্রেনডন কোথায় পাব মা? তবে পাশের বাড়ির রান্নাঘর এড়াতে হলে একতলায় ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দাদা-বউদি কদিনের জন্য উঠে গেল—।’ রমলাদেবী বললেন, ‘না, আমি সব দেখে রেখেছি। ব্যবস্থা হবে তিনতলায়। ছাদের ঘরে। আমি আর তোর বাবা ক’দিনের জন্য নীচে চলে আসছি। তিনতলার দক্ষিণের জানলাটা খুললেই একটা আমগাছ চোখে পড়ে। গাছটা অবশ্য একটু দূরে, রাস্তার ওপাশে। কিন্তু গাছ তো বটে।’

তিনতলায় ঘর বদল হল। এতে তিতলি খুব মুশকিলে পড়ছে। কারণ এবার ঘরের রং হয়েছে সবুজ৷ এখন সে সবুজ ফুল কোথায় পায়? সবুজ রঙের ফুল কি আদৌ হয়? তার জানা নেই।

মণির ছোটমাসি কাঁটা-চামচের দায়িত্ব নিয়েছেন। নিজে থেকেই নিয়েছেন। যে-কোনও ধরনের দোকানবাজার করার দায়িত্ব পেলে এই মহিলা, ভারী খুশি হন। প্রথমে তিনি বইপত্র ঘেঁটে কাঁচা-চামচ বিষয়ে একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরি করেছেন। এই জিনিস যে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। মহা উৎসাহে তিনি বেরিয়ে পড়েন। দোকান-বাজার প্রিয় মহিলারা কঠিন ধরনের জিনিস কেনার অর্ডার পেলে বেশি খুশি হন। ইনিও হলেন। নিউমার্কেট, এসি মার্কেট, বর্ধন মার্কেট চষে তিনি নানা ধরনের কাঁটা-চামচ কিনে ফেলেছেন কয়েকদিনের মধ্যেই। আইসড টি স্পুন, ডেমিটাস স্পুন, ভিনার ফর্ক, গ্রিল ফর্ক, ডেসার্ট ফর্ক, সালাড ফর্ক, টেবল স্পুন, পিয়ার্সড শুনা রমলাদেবী এরকমের কাঁটা-চামচ দেখে খুবই ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, ‘হ্যাঁরে কমলা, এগুলোর কোনটা কী কাজে লাগে জানা আছে তোর?’ কমলাদেবী বিরক্তমুখে বললেন, ‘বোকার মতো কথা বলিস না দিদি, আমার জানা থাকার দরকার নেই। আমি তো কাঁটা-চামচ দিয়ে খাচ্ছি না। মণিরা খাচ্ছে। তারা জানে কিনা সেটাই বড় কথা। মনে রাখবি বিদেশে থাকার সবথেকে বড় অভ্যেস হল কাঁটা-চামচ দিয়ে খাওয়া। সব অভ্যেস ছাড়া যায় কিন্তু এই অভ্যেস ছাড়া যায় না।

মণির ছোটমামা কলেজে পড়তে পড়তেই নানারকম ব্যবস্থা করে বিলেত চলে যান। যাওয়ার সময় সবাইকে বললেন, ‘এ-দেশে আর যাই হোক পড়াশোনা হবে না। পড়তে হলে অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের দেশে চলে যাওয়াটাই ভাল। সেখানেই আমি চললাম। তবে তোমরা চিন্তা কোরো না, তিন বছর পরে ফিরে আসছি। এসে এখানে কোনও ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করে যাব। মাইনেটা একটু কম হবে ঠিকই, কিন্তু তা হোক। নিজের দেশের জন্য কিছু স্যাক্রিফাইস তো করতে হবে।’ সবাইকে চমকে দিয়ে মাত্র তিনমাস পরে ছোটমামা ফিরে আসেন। বন্ধুরা অবাক হয়ে বলল, ‘কী হল রে! চলে এলি!’ মামা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘বড্ড ঠান্ডা। আমার আবার সর্দির ধাত কিনা।’ বন্ধুরা মুখ টিপে হাসল। তবে বিলেতযাত্রা একেবারে বিফলে গেল না। বিলিতি শিক্ষা তেমন না আনতে পারলেও, বিদেশ থেকে ছোটমামা বেশ কিছু আদবকায়দা নিয়ে এলেন। যেমন সুট-টাই (গরমেও পরেন), কথায় কথায় ইংরেজি (একেবারে অকারণে এবং কোনও কোনও সময় ভুলও), রাতে খাওয়ার আগে স্যুপ (বদহজম হলেও), ইংরেজি গান (না বুঝে)—এইসব আর কী! এই বয়সেও সেইসব কায়দাকানুন তিনি রক্ষা করেছেন, এবং অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। রবিবার বাড়িতে এসে বললেন, বড়দি, মণি-কাজলের মেনু কিছু ভাবলি?’ রমলাদেবী অবাক হয়ে বললেন, ‘মেনু! মেনু আবার কী? মণি কি নেমন্তন্ন বাড়িতে আসছে যে ওর জন্য আলাদা মেনু ঠিক করতে হবে? কী যে যা তা বলিস। আমরা যা খাই তাই খাবে।’ সুতপা বলল, ‘মামা, আমি কিন্তু একটা স্পেশাল আইটেম করে রেখেছি।’ ছোটমামা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী সেটা জানাতে পারি?’ সুতপা হাসিমুখে বলল, ‘তেঁতুলের আচার।’ মণির পিসিমা পাশেই ছিলেন। বললেন, ‘মেয়েটার জন্য বড়ি দিয়ে শুক্তো করব। আহা, ওখানে পায় না।’ বাবলু বলল, ‘আমি তো বাজারে বলে রেখেছি, রোজ ছোট মাছ চাই। আহা, মণিটা যে কতদিন তেলাপিয়ার ঝোল খায়নি। আচ্ছা মা, কাজল মাছটাছ খেতে পারবে তো? টেলিফোন করলে একবার জেনে নিয়ো তো।’ পিসিমা চোখ তুলে বললেন, ওমা, এ আবার কী বলছিস? কাজল কি বাঙালি নয়? তা ছাড়া মণি তো নিজেও রান্নাবান্না করে। মাছ কি ওদেশে পাওয়া যায় না?’ ছোটমামা অনেকক্ষণ সহ্য করেছেন। আর পারলেন না। টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে বললেন, ‘উফ তোমাদের এসব আদিখ্যেতাগুলো যে কবে বন্ধ হবে! বাইরে থেকে কেউ এলেই তাকে জোর করে শুক্তো, পোস্ত, পুঁইশাকের চচ্চড়ি, শিঙিমাছ খাইয়ে মেরে ফেলার জোগাড় করো। ন্যাকামির চূড়ান্ত।’ কমলাদেবী বললেন, ‘ওমা জোর করব কেন? মণি তো নিজেই কুচো চিংড়ি দিয়ে লাল শাক ভালবাসে।’ ছোটমামা বলল, বাজে কথা বলিস না। ভালবাসে না, বল, ভালবাসত। এখন মুখে কিছু বলতে পারবে না। মা, বাবা, পিসি, কাকিমারা দুঃখ পাবেন বলে গদগদ মুখে খাবে। বমি পাবে তাও খাবে। খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে। এগুলো টর্চার ছড়া আর কিছুই নয়। তোরা তো আর কখনও বাইরেটাইরে যাসনি, গেলেও ম্যাক্সিমাম পুরী। তোরা এ জিনিসের কী বুঝবি। এবার সাত বছর পর এসেছে, তোমাদের আদিখ্যেতা মার্কা খাবারের আতঙ্কে এরপর সাতাশ বছর পর আসবে। আমার কথাটা মিলিয়ে নিয়ো৷’ কমলাদেবী এবং রমলাদেবী দু’বোনই ভাইয়ের কথায় খানিকটা থমকে গেলেন। সত্যি তো অল্পদিনের জন্য হলেও সেও তো একবার বিদেশে গিয়েছিল। বিদেশ ফেরত মানুষের সুবিধে অসুবিধে সে ছাড়া আর কে বুঝবে? কমলাদেবী বললেন, ‘তা হলে কী হবে? কী খাবে ওরা?’ ছোটমামা মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ভাগনিদের ফুডের বিষয়টা দয়া করে আমার হাতে ছেড়ে দাও। দ্যাখো কী করি।’

ছোটমামা করেছেন। বেশ গুছিয়েই করেছেন। নানা ধরনের পিৎসা, স্যান্ডুইচ, পেস্ট্রি, বার্গার, বেকন, মেয়নিজ, চিজে ফ্রিজ বোঝাই হয়ে গেছে। রেডিমেড কোল্ড কফি, ফ্রুট জুস, সসও এসেছে। তবে মণির মা কাকিমারা একেবারে পুরোটা ছেড়ে দিতে পারেননি। তাঁরা নিজেদের মতো ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সেই ব্যবস্থায় মোচার ঘন্ট এবং ক্ষীরের পায়েস মূল আইটেম।

কাল সকালে মণির কাকা বিজয়কাস্তবাবু গুলটুকে নিয়ে গিয়ে গোপনে একটা কাজ করে এসেছেন। পাড়ার গাড়ি ভাড়ার এজেন্সিতে গিয়ে দিনসাতেকের জন্য একটা মারুতি গাড়ি ঠিক করে এসেছেন। ভাইঝিকে এসে তো বেরোতে হবে। আত্মীয়স্বজনের নেমন্তন্ন আছে, স্কুল কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আছে, হুস বলতে এ-শহরে ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। ট্যাঙস ট্যাঙস করে তো আর বাসে ট্রামে ঘুরতে পারবে না মেয়েটা। নিজে যদি বা পারে, কাজল বেচারির তো একেবারে অভ্যেসই নেই। গাড়িটা থাকলে সুবিধে। গুলটুর সঙ্গে কথা হয়েছিল, বিষয়টা কাউকে জানানো হবে না। সেইমতো গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। তবু আর পাঁচটা গোপন জিনিসের মতো ঘটনা দ্রুত জানাজানি হয়ে গেল। বিজয়কান্তবাবু লজ্জা লজ্জা মুখ করে ঘুরছেন আর ভাবছেন—না কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি। মণি তো আর কচি খুকি নেই। ধেড়ে ভাইঝিকে এত ভালবাসার কী আছে?

এয়ারপোর্টে সবাই যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল না। ঠিক ছিল দাদা, কাকা, আর ছোটমামা যাবে। তিতলি-গুলটু সকাল থেকে বায়না ধরেছিল। বাবলু বলল, ‘অত রাতে তোরা গিয়ে কী করবি? গাড়িতেই তো ঘুমিয়ে পড়বি। তা ছাড়া ঘুম-চোখে কাজল তোদের ভাল করে চিনতেও পারবে না। উলটে গুলিয়ে ফেলে বিচ্ছিরি একটা কাণ্ড হবে।’ পিসিমার একটু যাই যাই ইচ্ছে হয়েছিল। রমাকান্তবাবু বললেন, ‘বয়েস হয়েছে বয়েসের মতো ব্যবহার করো।’

রাত দশটায় বিরাট একটা গাড়ি নিয়ে তমালিকা এসে হাজির। তমালিকা মণির কলেজ-বন্ধু। তমালিকা বহু বছর এ বাড়িতে আসেনি। তবে ই-মেলে মণির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। সেও আজ এয়ারপোর্টে মণিকে রিসিভ করতে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে এখানে একবার ঢুঁ মেরে গেল। এসেই লাফালাফি শুরু করে দিল তমালিকা। বলল, ‘এয়ারপোর্টে কম করে সাতজনের যাওয়া চাই।’ রমাকান্তবাবু লাফালাফি পছন্দ করছিলেন না। যে-কোনও যাওয়া-আসার সময়টা ধীর স্থির থাকতে হয়। এই মেয়েটিকে তিনি আগেও বাড়িতে আসতে দেখেছেন। হালকা মনে পড়ছে, তখনও যেন লাফাত। তবে বয়স কম ছিল, মানাত। এখন কেন লাফাবে? তিনি বিরক্ত মুখে তমালিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেন দশ নয় কেন?’ তমালিকা হাসতে হাসতে বলল, ‘এমা এটাও বুঝলেন না? সাত বছর পর বলে সাতজন। যাক দেরি করবেন না, রেডি হন। ছোটরাও চলুক। একজন ছোট ছেলে আসছে তাকে রিসিভ করতে ছোটদেরই যাওয়া উচিত। নইলে তাকে অপমান করা হয়। তাই না মাসিমা?’ তিতলি, গুলটু, মিন্টু দাদুর নিষেধ ভেঙে আনন্দে চিৎকার করে উঠল।

দুটোর সময় প্লেন নামবে। রাত এগারোটায় হইহই করে গাড়ি বোঝাই লোক রওনা দিল। কল্যাণ এত রাতে কোথা থেকে যেন গাদাখানেক গ্যাসবেলুন জোগাড় করেছে। এটা নাকি তার একটা নতুন আইডিয়া। মালার বদলে রঙিন বেলুন দিয়ে মণিদের স্বাগত জানানো হবে। সবাই হাসতে হাসতে হাততালি দিয়ে উঠল। বেলুনগুলো গাড়ির জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে পতাকার মতো উড়ছে। মনে হচ্ছে তারাও যেন হাসছে। বড় সুন্দর লাগছে।

রমাকান্তবাবু বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে এনে বসেছেন। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। অল্প তাড়াতেই রমাকান্তবাবুর আজাল কাশি হয়। তাঁর উচিত ভেতরে চলে যাওয়া। কিন্তু তিনি ঠিক করেছেন মণিরা আসা পর্যন্ত তিনি বারান্দাতেই বসে থাকবেন। তাতে যদি একটু কাশি টাশি হয় হবে।

মণি এসেছে।

সাত বছর তিন মাস পর মেয়ে বিদেশ থেকে আসার পর কী হচ্ছে তা দেখবার জন্য বাইরের কারও নাক গলানো উচিত নয়। আমরাও গলাচ্ছি না। তা ছাড়া সবটা তেমন জানাও যায়নি। তবে সামান্য কয়েকটা সমসার কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন, মণি তিনতলার বদলে দোতলার হলঘরে মা, দিদি, বউদি এবং পিসিমার সঙ্গে মাটিতে টানা বিছানা করে শুচ্ছে। সে চেঁচিয়ে ছাড়া কোনও কথা শুরু করতে পারছে না এবং উচ্চস্বরে হাসি ছাড়া সেই কথা শেষ করতে পারছে না। পুঁইশাক, ডাঁটা চচ্চড়ি মৌরলা মাছ এবং আমের টক ছাড়া মা ও ছেলে ভাত মুখে তুলতে চাইছে না। ট্রামে এবং হাতে-টানা রিকশ চেপে তারা সারাদুপুর টইটই করে ঘুরছে। বিকেল হলেই কাজল গুলটু মিন্টুদের সঙ্গে ছাদে ফুটবল খেলতে ছুটছে। গোল হলে এত জোর লাফাচ্ছে যে ভয় হচ্ছে, ছাদ ভেঙে না যায়। সন্ধে হলে তিনতলার খোলা বারান্দায় প্রতিদিনই মুড়ি এবং তেলেভাজা সহযোগে গল্পের আসর বসছে। মণিই এই আসরের উদ্যোক্তা। তবে সমস্যা হল, এই আসরে সবথেকে জোরে হাসছেন যে-মানুষটা, তাঁর নাম রমাকান্ত চৌধুরী। এবাড়ির হেড অব দ্য ফ্যামিলি।

শোনা যাচ্ছে, তিনি নাকি এত হাসছেন যে, প্রায়ই তাঁর চোখে জল চলে আসছে। তিনি সবাইকে লুকিয়ে সেই জল মুছছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *