উপত্যকা

উপত্যকা

রণবীর অভিভূত, মুগ্ধ। খুশিতে তার লাফাতে ইচ্ছে করছে। রামকৃষ্ণ সি-বিচে স্নান করতে গিয়ে যদি তার পা মচকে না যেত, তা হলে নিশ্চয় এখন সে একটা লাফ দিয়ে ফেলত। তবে নিজে লাফাতে না পারলেও তার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে লাফাচ্ছে। বহুদিনের স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। কয়েক মিনিট আগে যে-ছবি সে তুলেছে সেই ছবি তাকে যে ‘ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেবে তা নয়, এক ধাক্কায় বিশ্বখ্যাত করে তুলবে। বলা যায় না, সুইডেন বা মরিশাসের কোনও প্রদর্শনীতে আমন্ত্রণও পেয়ে যেতে পারে। ভাগ্যিস সে এই উপত্যকায় বেড়াতে এসেছিল। ভবানীপুরের ছেলে হয়েও বন্যপ্রাণীদের ওপর ছবি তোলার ইচ্ছে রণবীরের সেই ছোটবেলা থেকে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় রণবীর লক্ষ করে দেখেছে, বন্যপ্রাণী বিষয়ক ছবি তোলার ব্যাপারে ভবানীপুরে তেমন কোনও সমস্যা নেই। তার ক্যামেরা যথেষ্ট দামি, জুম লেন্সও আছে। ছবি প্রিন্ট করার জন্য ভাল স্টুডিয়োর কানও অভাব নেই এখানে। সমস্যা বন্যপ্রাণী নিয়ে। ভবানীপুরে কোনও বন্যপ্রাণী নেই। তাই এবার সুযোগ পেয়ে একটা দলের সঙ্গে সে বেরিয়ে পড়েছে। হাওড়া থেকে মাদ্রাজ মেলে ওয়ালটেয়ার। ইচ্ছে ছিল ওখানকার সমুদ্রে নৌকো করে ঘুরে ডলফিনের ওপর কিছু কাজ করবে। ওয়ালটেয়ারে অনেকরকম ব্যবস্থা আছে, কিন্তু নৌকো করে ডলফিনের ছবি তোলার কোনও ব্যবস্থা নেই। রণবীর খুবই হতাশ হয়। মনের দুঃখে ক’দিন ঘুরে বেড়ায়। সমুদ্রে স্নান করে। ইডলি-ধোসা আর টক ডাল খায়। তারপর টুরিস্ট বাসে চেপে পাহাড় টপকে এই আরাকু ভ্যালিতে এসে পৌঁছেছে। ভেবেছিল আসার পথে মাঝে মাঝে বাস থামিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে যাবে। জঙ্গলে ঢুকে যাবে ক্যামেরা হাতে। দলের অন্যরা সেই প্রস্তাব শোনেনি। বাস থামাতে দেয়নি, উলটে হেসেছে। সবথেকে বেশি হেসেছে সুজলা। চোখ গোল করে বলেছে, ‘ও কাজও করতে যাবেন না রণবীরবাবু। এখানে বাঘ আছে। আপনাকে তো খাবে না, আপনার দামি ক্যামেরাটা ছিনতাই করে পালিয়ে যাবে।’ রণবীর দেখেছে, সুন্দরী অবিবাহিত মেয়েরা খুবই ফাজিল ধরনের হয়। সে আর বেশিদূর এগোয়নি।

আরাকু উপত্যকায় দু’দিন কাটিয়েও কোনও সুবিধা হয়নি রণবীরের। সুবিধা হল আজ। ফিরে যাবার ঠিক মুখে। ‘ভ্যালি ভিউ’ গেস্ট হাউসের সামনে বিরাট লনে বাস রেডি। মালপত্র তোলা শেষ। ট্যুরিস্ট পার্টির বত্রিশজন বাসে উঠতে যাবে এমন সময় দেখা গেল, বাস বিগড়েছে। ভালরকম বিগড়েছে। টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করছে না। ড্রাইভার মিস্ত্রি ডেকে এনেছে। কাজ শুরু হয়েছে। সেই ফাঁকে রণবীর ক্যামেরা হাতে চলে এল গেস্ট হাউসের পিছনে। নির্জন বাগানে। ঠিক বাগান নয়, অনেকটা জুড়ে ঝোপঝাড়, অল্প কিছু ফুলগাছের টব। পাহাড়ের দিকে মাথা ভোলা কতগুলো ঝাপসা গাছ।

সেখানেই কাণ্ডটা ঘটল। রণবীরের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার কাণ্ড।

এদিক-ওদিকে দেখতে দেখতে রণবীরের হঠাৎ চোখে পড়ে, গাছের ওপর দুটো বাঁদরছানা। বাঁদরছানা গাছের ওপরই থাকবে। সেটাই তাদের থাকার জায়গা। এই দৃশ্যে উৎসাহিত হওয়ার কথা নয়। ‘গাছে বাঁদর’— এই ছবি তুলে বিখ্যাত ‘ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার’ হওয়া খুবই শক্ত কাজ। তুবু রণবীর উৎসাহিত হয় এবং পটাপট ছবি তুলতে শুরু করে। আশ্চর্য ঘটনা হল, এই ফোটো সেশনের মাঝখানে ছানাদুটো এক-এক করে আরও অনেককে ডেকে আনল। সাইজ দেখে রণবীর নিশ্চিত যে এরা ছানাদুটোর বাবা, মা, দাদু, ঠাকুমাই হবে। এরা ফ্যামিলি ফোটো চাইছে! দুর্দান্ত! দারুণ! ভাবা যায় না। কিছু না ভেবেই রণবীর পটাপট শাটার টিপতে লাগল। শেষে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলিয়ে হুপহাপ শব্দ করে সপরিবারে তারা আবার উধাও হল পাতার আড়ালে।

এর পরেও আনন্দে পাগল না হয়ে থাকা যায় না। বাঁদরের ফ্যামিলি তাকে দিয়ে গ্রুপ ফোটো তুলিয়েছে! এই অত্যাশ্চর্য ঘটনা দুনিয়ায় আর কখনও ঘটেছে বলে রণবীরের জানা নেই! এখনই এই ঘটনা কাউকে জানানো উচিত। সবথেকে ভাল হয়, সুজলা নামের ফাজিল মেয়েটাকে জানালে। অপমানের একটা জবাব হবে। কিন্তু মুশকিল হল, আলাপ হওয়া সত্ত্বেও গত দশদিন ধরে মেয়েটা তার কোনও কথাই ঠিকমতো শুনতে চাইছে না। রণবীর সিদ্ধান্ত নিল, আজ যে করেই হোক এ-ঘটনা মেয়েটাকে শুনিয়ে ছাড়বে। তারপর বলবে, ‘দয়া করে এ-ছবির কপি চাইবেন না। দিতে পারব না।’

বাংলা থেকে অনেক দূরে হলেও ‘ভ্যালি ভিউ’ গেস্ট হাউসের ম্যানেজার বাঙালি। তাঁকে সবাই ‘ঘোষবাবু’ বলে জানে। বদরাগী মানুষ হিসেবে তিনি এই উপত্যকায় বিশেষ পরিচিত। রাগের সঙ্গে তার আবার আছে টেনশনের অসুখ। সেই ঘোষবাবুর এই মুহূর্তে একসঙ্গে অনেকগুলো ইচ্ছে করছে। তার মধ্যে প্রথম ইচ্ছে হল, দোতলার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করার ইচ্ছে। যেহেতু দোতলার বারান্দা থেকে লাফালে মৃত্যুর সম্ভাবনা খুবই কম এবং পা ভাঙার সম্ভাবনা খুবই বেশি, সেহেতু এই ইচ্ছে আপাতত মন থেকে তিনি দূরে সরিয়ে রেখেছেন। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে তখন ভাবা যাবে।

তিনি বিরক্ত মুখে দোতলার বারান্দায় পায়চারি করছেন। করতেই হবে। বত্রিশজনের দল আটকে পড়েছে। সব কলকাতার পার্টি। বাস নিয়ে দু’দিনের জন্য আরাকুতে বেড়াতে এসেছিল। ঘর নিয়েছিল মোট এগারোটা। একতলার ডরমেটরিটা পর্যন্ত। আজ সকালেই ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। বাটার টোস্ট, কলা, ডবল ডিমের ওমলেট। সবকটা ওমলেট ডবল ডিমের হয়নি। ডিম কম পড়েছিল। তাই ডিমের বদলে কিছু প্লেটে গেছে ডবল কলা। সকালেই পার্টির ঘর ছেড়ে দেওয়ার কথা। পার্টি ঘর ছেড়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাসে উঠতে পারেনি। কারণ বাস নড়ছে চেষ্টা চলছে, তবে তিন ঘণ্টা হতে চলল, দু’বার গোঁ গোঁ ধরনের আওয়াজ ছাড়া বাস তেমন কিছু করতে পারেনি।

বাস সারানোর দায়িত্ব গেস্ট হাউসের ম্যানেজারের নয়। ট্যুরিস্ট পার্টিকে হাত ধরে পাহাড় টপকে ওয়ালটেয়ারে পৌঁছেও তাঁকে দিতে হবে না। তবু এতগুলো কাচ্চাবাচ্চা মেয়েছেলে যতক্ষণ চোখের সামনে আটকা পড়ে রয়েছে ততক্ষণ তাঁর রক্তচাপ বাড়বেই। বেড়েই চলবে।

নিজের পাড়ায় ঘুরেও তাকায় না, অথচ বিদেশ বিভুঁইয়ে হাতের কাছে বাঙালি পেলে বাঙালি আদিখ্যেতা শুরু করে। দাদা, কাকা, মামা বলে এমন করবে যেন একটু পরেই গলা ধরে ঝুলে পড়বে। এরাও শুরু করেছে এবং ক্রমেই তা বাড়াচ্ছে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েও লোকগুলো আবার ফিরে এসেছে এবং লাউজ্ঞে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছে। ভাব করছে, এই গেস্ট হাউস তাদেরই। তাঁবুর মতো ভাঁজ করে তারা কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছে। ঘোষবাবুর ইচ্ছে করছে দারোয়ান ডেকে এদের বের করে দিতে। খুবই ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছেন না। বরং গোডাউন খুলে অতিরিক্ত চেয়ার বের করে দিতে হয়েছে। একটু আগে দলের সবথেকে বিচ্ছু টাইপের ছেলেটা। এসেছিল। ছেলেটা খানিক আগে বল মেরে রান্নাঘরের একটা কাচ ভেঙেছে। ভেঙে কোনও লজ্জা নেই। এসে হাসিহাসি মুখে বলল, ‘ম্যানেজার কাকু, পায়খানা পেয়েছে।’ যেন ভারী হাসির কথা। এইসময় যে-কোনও সভ্য মানুষের উচিত ছেলেটির কান টেনে ছিঁড়ে ফেলা। দুঃখের বিষয় ঘোষবাবু উচিত কাজ করতে পারলেন না। তার বদলে অ্যাটাচড বাথরুম দেওয়া একটা ঘর খুলে দিতে বললেন। দেওয়ার পর দেখা গেছে, শুধু এই বালকের নয়, বড়দেরও ঘরের প্রয়োজন। তবে তারা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। ছোটরা যা পারে বড়রা তা পারে না। ফলে একটা ঘরে হল না। দুটো ঘর লাগল। এই ঝামেলার দলে একটি কমবয়সি মেয়ে তার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে। একাই এসেছে। ঘোষবাবুর এখন মনে হচ্ছে, এরা হল ন্যাকামির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। বৃদ্ধার ডান পায়ে গোলমাল। এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে মেয়ের হাত ধরে উপত্যকা বেড়াতে এসেছেন। একে ন্যাকামি ছাড়া কী বলা যাবে? কিছুই বলা যাবে না। কিছুক্ষণ আগে বৃদ্ধার শরীর খারাপ লাগছিল। ঘোষবাবুকে রান্নাঘর থেকে লেবুর শরবত আনাতে হয়েছে। সেই শরবত-বৃদ্ধা এখন মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় বসেছেন। বাসের জন্য উদ্বেগ নেই, বাড়ি ফেরার চিন্তা নেই, পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। ভাবা যায়!

ঘোষবাবুর ভয়ংকর রাগ হচ্ছে। গা চিড়বিড় করছে। ইচ্ছে করছে বৃদ্ধার কাছে যান। গিয়ে বলেন, ‘দিদিমা, আপনাদের যদি ওই পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে তা হল আর দেরি করবেন না। বসে না থেকে এখনই রওনা দিয়ে ফেলুন। কোনও অসুবিধে হবে না। টুক টুক করে হাঁটলে মা-মেয়ে সন্ধে নাগাদ পৌঁছে যাবেন। একটা টর্চ দেব?’

দলে আবার কয়েকটা কলেজ-পড়ুয়া ছেলেমেয়ে আছে। ঘোষবাবু বিরক্ত হয়ে দেখছেন, আজকালকার ইয়ং বাঙালি ছেলেমেয়েদের কোনও দায়িত্বজ্ঞান নেই! বাস খারাপ। এতগুলো লোক ফিরবে কী করে, বাচ্চাগুলো খাওয়াদাওয়া কী করবে, দরকার হলে অন্য গাড়ির খোঁজ করতে হবে কিনা— কোনও চিন্তাই নেই। উলটে এসে বলল, ‘টিভিটা খুলে দিতে বলুন তো। শ্রীলঙ্কা-নিউজিলান্ডের খেলা হচ্ছে।’ ঘোষবাবুর বলতে ইচ্ছে করল, ‘কেন ভাই, তোমরা কি শ্রীলঙ্কার সিটিজেন? তোমরা ওদের খেলা দেখবে কেন?’

কিন্তু সে কথা বলা গেল না। টিভি খুলে দেওয়া হল। যত সময় যাচ্ছে গোটা ট্যুরিস্ট পার্টি যেন তত নিশ্চিন্ত হচ্ছে। ঘুরছে, ফিরছে। একদল তো আবার সিঁড়ি জুড়ে বসে গান ধরেছে, ধিতাং ধিতাং বোলে।

বাস খারাপ, আর এদের মনে যেন আনন্দের জোয়ার এসেছে। আশ্চর্য, খুবই আশ্চর্য!

তপন হালকা গলায় বলল, ‘ধুস, বসে থাকতে থাকতে পায়ে খিল ধরে গেল। যাই একটু ঘুরে আসি। মন্দিরা, তুমি যাবে?’

মন্দির ঠান্ডা গলায় বলল, ‘না আমি যাব না। তুমিও যাবে না।’

‘সেকী, আমি যাব না কেন! একটু চক্কর মেরে এলে ক্ষতি কী? একটু পরেই তো চলে যাব। এমন চমৎকার জায়গা। লাস্টবার চোখ মেলে দেখে নাও।’

‘ক্ষতি আছে। চক্কর মারার নাম করে তুমি আসলে ডিভোর্সি মেয়েটার কাছে যাবে। কী মনে করছ, আমি বুঝতে পারি না?’

‘মন্দিরা, এসব কী বলছ? ক’দিন ধরেই তুমি এটা বলছ। বেড়াতে এলে সকলের সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় হয়। তা ছাড়া আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। ওরা শুনলে কী ভাববে?’

‘খুব খারাপ ভাববে। কিন্তু দেখছে তাতে আরও খারাপ ভাবছে। বাবা সুন্দরী মেয়ের বুড়ি মাকে নিয়ে ধ্যাস্টামো করছে, তার জন্য পাতিলেবুর শরবত আনাচ্ছে, এটা দ্যাখার চেয়ে কিছু খারাপ কথা শোনা ভাল।’

‘মাসিমা অসুস্থ হয়ে পড়লেন আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকব? লেবুর শরবত আমি বানাইনি। ম্যানেজারকে বলতে উনিই চটপট করে এনে দিলেন।’

‘তপন, বাজে কথা বোলো না। চুপ করে। আমার মাথা ধরেছে। হাত সকলেরই আছে। তারা তো দেখলাম হাত গুটিয়েই বসে রইল। তা ছাড়া শুধু আজ তো নয়, এখানে আসার পথে বোর কেভসের অন্ধকারে তুমি নাকি ডিভোর্সিটার হাত ধরেছিলে? এই নিয়ে অনেকে ফিসফিস করছে।’

‘ছি মন্দিরা। ডিভোর্সি ডিভোর্সি করছ কেন? চন্দনা শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে। ভেরি স্যাড কেস। এত কম বয়েস। আর আমি মোটেই চন্দনার হাত ধরিনি। মেয়েটা সিঁড়িতে পড়ে যাচ্ছিল। আমি পাশে ছিলাম, ও-ই চট করে আমাকে ধরল। ফর আ সেকেন্ড। তুমি থাকলেও ধরতে।’

‘ও বাবা, দশদিনেই সব জানো দেখছি। চন্দনা, মাসিমা, শ্বশুরবাড়ি, স্যাড কেস, কিছুই বাকি নেই! দত্তগিন্নি কাল ডিনারে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিলেন, ব্যাটাছেলেগুলোর খালি ছুকছুক। পাহাড় দ্যাখ। জঙ্গল দ্যাখ। সিনসিনারি দেখতে এসেছিস না মেয়েছেলে দেখতে এসেছিস? কী লজ্জা!’

এমন সুন্দর জায়গায় এসে মন্দিরার সঙ্গে ঝগড়া করে লাভ নেই। তপন দূরের পাহাড়ের দিকে তাকাল। তিনটে পাহাড় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। রোদ আর ছায়ায় তিনজনের তিনরকম সবুজ রং। তাদের পায়ের কাছে আর একরকমের সবুজ কফি খেত। কফি খেতের পাশ দিয়ে লাল মাটির পথ চলে গেছে ইউক্যালিপটাস বনের দিকে। সেই পথ যাকে দ্যাখে তাকেই হাতছানি দিয়ে ডাকে। একটু আগেই কুয়াশা উঠে আসছিল পাহাড়ের তলা থেকে ঘন কুয়াশা। রোদ ওঠায় সেই কুয়াশা কেটেছে। আহা, এমন কি একজনও নেই যে ওই পথ ধরে হেঁটে যাবে?

বাস থেকে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

ছায়াতে বসে থাকলেও তপুর চোখে সানগ্লাস। তপু সহজে সানগ্লাস খোলে না। সবসময় সানগ্লাস পরার শিক্ষা সে পেয়েছে ফিল্মস্টারদের কাছ থেকে। পত্রপত্রিকা এবং টিভি ভাল করে লক্ষ করলেই দেখা যাবে স্টাররা সবসময় কালো চশমায় চোখ কে রাখতে পছন্দ করে।

তপু অবশ্য ফিল্‌মস্টার নয়। সে বারো ক্লাসের ছাত্রী। কিন্তু তার ধারণা, এই অসামান্য রূপ নিয়ে সে বেশিদিন ছাত্রী থাকতে পারবে না। তাকে শিগগিরই ফিল্‌মস্টার হয়ে যেতে হবে। তাই সানগ্লাসের মতো ছোটখাটো ব্যাপারগুলো আগে থেকে সে অভ্যেস করে রাখতে চাইছে। মা জিনিসটার গুরুত্ব ঠিক বুঝতে পারছে না। নইলে আরাকু ভ্যালি বেড়াতে আসার সময় মেয়েকে কেউ পলিটিক্যাল সায়েন্সের বই আনতে বলে না। তপুর গভীর বিশ্বাস, একদিন সকলেই বুঝবে। মা-ও বুঝবে। অটোগ্রাফ দেওয়ার দিন এল বলে। তা আর খুব দূরে নয়।

ফিল্‌মস্টার হওয়ার পাশাপাশি সানগ্লাস তপুকে আর একটা দিক থেকে খুব সাহায্য করছে। মা, বাবা, ছোটকাকা এবং কাকিমার পাশে বসেই সে মুকুল নামের ছটফটে যুবকটির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে। কেউই বুঝতে পারছে না। মুকুল এখন মন্দিরা মাসির ছেলের সঙ্গে বারান্দায় ক্রিকেট খেলছে। ব্যাট নিয়ে এমন কায়দা করছে যেন রনতুঙ্গা। ওকে দেখেই এমন করছে। তা করুক। আর কেউ না বুঝলেই হল।

গতকাল এখানকার বোটানিকাল গার্ডেনে যাওয়ার সময় বাসের সামনে সিটে বসে গান করছিল। সুতনুকা কনুই দিয়ে ঠেলে বলল, ‘দ্যাখ তপু, জানোয়ারটা আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে কেমন গান ধরেছে। গলা তো হাঁড়িচাচার মতো।’

আমাদের শুনিয়ে না ছাই। তপু একশো টাকা বাজি ফেলে বলতে পারে, গত আটদিন যাবত মুকুল যা-যা কেরামতি করছে সবই কেবলমাত্র তার উদ্দেশে। সুতনুকাটা আসলে জেলাস হয়ে পড়েছে। দশদিনের আলাপেই মেয়েটাকে ভাল করে বোঝা হয়ে গেল। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে অথচ হাবভাব করে যেন বিরাট বোদ্ধা। হিংসুটি নাম্বার ওয়ান। আরে বাবা, তোকে দেখতে হল গিয়ে ভূতেদের রানির মতো। তোকে দেখে মুকুলের মতো স্মার্ট ছেলে টসকাবে কেন? আজ বাস ছাড়লে সে মুকুলের কাছাকাছি বসবেই বসবে। সুতনুকাকে ধারেকাছে ঘেঁষতে দেবে না। আজই একটা হেস্তনেস্ত চাই।

এরকম একটা প্রতিজ্ঞা করবার পর পরই তার কাছে সুতনুকা এল। সিঁড়ির ওপর উঠে গা ঘেঁষে বসল। চোখমুখ সন্দেহজনক লাল। হিংসুটিটা আজ নীল সালোয়ার পরেছে। তপুর মনে হল, আজ তাকে দশদিনের মধ্যে সবথেকে খারাপ দেখাচ্ছে। কালো মেয়েদের নীল রঙে মানায় না। তাদের পরতে হয় হালকা রং।

‘তোকেই খুজছিলুম তপু।’ ফিসফিস করে বলল সুতনুকা।

‘কেন, বাস ঠিক হয়ে গেছে নাকি?’

‘প্রায় হয়ে গেছে। তবে তার থেকেও একটা দারুণ ব্যাপার হয়েছে।’

‘কী ব্যাপার?’

‘আরে শোন না।’ সুতনুকা তপুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘মুকুল একটু আগে আমার হাতে একটা কাগজ গুজে দিয়েছে।’ বলতে গিয়ে সুতনুকার মুখ আরও লাল হয়ে উঠল। এখন বোঝা যাচ্ছে, এই লাল হল লজ্জার লাল।

তপু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তাই বুঝি? তা কী লেখা তাতে?’

সুতনুকা হেসে তপুকে ছোট্ট ঠেলা মারল। বলল, ‘যাঃ, বলব কেন? মুখে বলতে পারব না। এই নে পড়।’

তপু একা লনে এসে দাঁড়িয়েছে। সত্যিই বাস প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। বাইরে রোদ থাকলেও এখন তার আর চোখে সানগ্লাস নেই। একটা অ্যাম্বাসাড়ার গাড়ি এসে দাঁড়াল। ‘ভ্যালি ভিউ’ গেস্ট হাউসে নতুন কোনও ট্যুরিস্ট এসেছে। তারা সুটকেস নামাচ্ছে। একটি তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়ে গাড়ি থেকে নেমেই তার দিকে ছুটে এল। হাতে খাতা পেন।

‘গাড়ি থেকেই আপনাকে চিনতে পেরেছি দিদি। আপনি ইন্দ্রাণী হালদার। একটা অটোগ্রাফ দিন প্লিজ।’

তপু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘না, আমি ইন্দ্রাণী হালদার নই।’

‘কী বললেন ? কারা আপনাকে দিয়ে ছবি তুলিয়েছে বললেন?’

সুজলাকে আজ যে-কোনও দিনের থেকে সুন্দর দেখাচ্ছে। কথাটা ঠিক কিনা বলা শক্ত। কারণ, গত দশদিন ধরে রণবীরের রোজই এরকমই মনে হয়। তবে এই মুহূর্তে সুজলার বন্যপ্রাণী বিষয়ক ফোটোগ্রাফিতে উৎসাহ দেখে সে অবাক।

রণবীর বলল, ‘বাদরেরা। আ গ্রুপ অফ মাঙ্কিস। মাঙ্কি ফ্যামিলি বলা ভাল৷ হোল ফ্যামিলি। চিলড্রেন, উইথ দেয়ার ফাদার, মাদার। এমনকী দাদু ঠাকুমাকে পর্যন্ত ডেকে আনল ওরা। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে না?’

সুজলা হেসে ফেলল। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে রইল রণবীরের দিকে। তারপর হেসে বলল, ‘না, বিশ্বাস হচ্ছে না।’

রণবীর দমে গেল। মুখ নামিয়ে বলল, ‘ও।’

‘তবে আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে আপনার কিছু যায় আসে না। বাঁদর ফ্যামিলি যে আপনাকে ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার বলে মেনে নিয়েছে এবং ডাকাডাকি করে আপনাকে দিয়ে ফোটো তুলিয়েছে এটা একটা দারুণ খবর। এখানকার বাঁদরেরা দেখছি গুণের কদর বোঝে।’

‘আপনি ঠাট্টা করছেন?’

‘হ্যাঁ, করছি। আপনি কি ওদের ঠিকানাটা লিখে নিয়েছেন?’

‘কাদের ঠিকানা?’

‘কেন বাঁদরদের। বাঃ ওদের ছবি পাঠাতে হবে না? বাঁদর ফ্যামিলি, কেয়ার অফ আরাকু ভ্যালি, ভায়া ওয়ালটেয়ার। নিয়ার রেল লাইন।’

রণবীর আরও দমে গেল। না, মেয়েটাকে ছবির কথা মোটেই বলা ঠিক হয়নি। এই হল মুশকিল। যেখানে যেটা বলার নয়, সেখানে সেটা সে বলে ফেলে। রণবীরের দিকে তাকিয়ে সুজলা আবার হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে, ওদের না পাঠান আমাকে এক কপি পাঠাবেন। কী, পাঠাবেন তো?’

রণবীর প্রতিজ্ঞা করেছিল এই ছবি সে সুজলাকে কিছুতেই দেবে না। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হল। সে মাথা নামিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ পাঠাব।’ তারপর আবার একটা গোলমাল করে বসল। যেখানে যা না বলার তাই বলে বসল।

‘সুজলা, আপনি একটু এদিক ফিরে দাঁড়াবেন? পাহাড়গুলোকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রোখে আপনার একটা ছবি তুলব।’

সুজলা ভুরু কুঁচকে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কেন?আমি কি বন্যপ্রাণী?’

হল কী! বাঁদরেরা মনে হয় আজ রণবীরের মনে সাহস জুগিয়েছে। সেই সাহসেই রণবীর বলল, ‘আসলে, এরকম সবুজ পাহাড়ের সামনে সবুজ শাড়ি পরে ছবি তোলার চান্স আপনি চট করে আর পাবেন না।’

সুজলা পিছন ফিরে পাহাড়ের দিকে তাকাল। তারপর গাঢ় গলায় বলল, ‘ঠিক আছে তুলুন। চট করে তুলবেন। বাস মনে হয় ঠিক হয়ে গেছে।’

‘কোথায় গিয়েছিলে?’ অরুণ গম্ভীর গলায় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

কৃষ্ণা হেসে উত্তর দিল, ‘রেল লাইনের ধারে। ট্রেন দেখতে গিয়েছিলাম।’

অরুণ আরও গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কেন? তুমি কি পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গা? ঘনঘন ট্রেন দেখতে যাওয়ার কী আছে? বাস খারাপ হয়ে গেছে। কীভাবে ফিরব তার ঠিক নেই, খাওয়াদাওয়ার চিন্তা নেই, কলকাতা ফেরার টিকিট শুনছি এখনও কনফার্ম হয়নি, একটু আগে দেখলাম ওয়াটার বটলটা লিক করছে, আর তুমি ট্রেন দেখতে চলে গেলে! স্ট্রেঞ্জ!’

কৃষ্ণা আবার হাসল। বলল, ‘এখানে থেকে গেলে কেমন হয় বলো তো? আমার তো মনে হয় দারুণ হয়। ট্রেন লাইনে একটা গুমগুম ধরনের আওয়াজ হয়। এখন শুনে এসে মনে হচ্ছে, ওটা আসলে শব্দ নয়। ট্রেনের কথা। পাহাড়গুলোর সঙ্গে ট্রেন কথা বলছিল। আমার এখন মনে হচ্ছে, ট্রেনের সঙ্গে এই উপত্যকার সঙ্গে পাহাড়গুলোর গোপন প্রেম আছে। তোমার কী মনে হচ্ছে?’

অরুণ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ‘সর্বসময় রসিকতাটা কোনও যোগ্যতা নয় কৃষ্ণা। তাই যদি হত তা হলে চাকরির পরীক্ষাগুলোতে জেনারেল নলেজের পাশাপাশি রসিকতার পরীক্ষা নেওয়া হত। তুমি এখানে এসে ভয়ংকর বাড়াবাড়ি করেছ। সেটা কি তুমি বুঝতে পারছ? মনে হচ্ছে না বুঝতে পারছ। কাল রাত তিনটে অবধি বারান্দায় বসে থেকে। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, তাই তুমি নাকি অনেক কিছু দেখেছ। আমি কিছু বলিনি। একটু আগে সিঁড়িতে বসে কতগুলো অপরিচিত আধ-দামড়া লোকের সঙ্গে গান করছিলে। তবু আমি কিছু বলছি না। এমন একটা জঘন্য জায়গায় আসাটাই অনর্থক। এমন হলে আমি আসতাম না। যাক চলো, বাস ছাড়বে। ব্যাগটা ধরো।’

কৃষ্ণা অরুণের হাত থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। দূরে তাকিয়ে বলল, ‘ওমা! দ্যাখো, দ্যাখে দ্যাখো অরুণ, মালার মতো একটা মেঘ কেমন পাহাড়টাকে ঘিরে ফেলেছে! দ্যাখো দ্যাখো। ওমা! পাহাড়টাতে মনে হচ্ছে নীল। নীলপাহাড়! বিউটিফুল। এক মিনিট দাঁড়াও প্লিজ। মেঘটা এক্ষুনি চলে যাবে। একটু দেখে নিই।’

অরুণ সামনে তাকিয়ে দেখল। এবং ‘জঘন্য জায়গার দৃশ্য দেখে অরুণ ও মুগ্ধ হয়ে পড়ল। তবু সে মনকে কঠিন করল। কৃষ্ণার সামনে এ-ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ করা মানে তাকে উসকে দেওয়া। আবার হয়তো বলবে, ‘ওরা যাচ্ছে যাক। আমরা দু’দিন থেকে যাই।’

তবে এত ভেবেও অরুণ পারল না। সে দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলল। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কৃষ্ণা, আসার সময় তুমি বাসে জানলার ধারে বসেছিলে। ফেরার সময় কিন্তু আমি বসব।’

কৃষ্ণা পাহাড় থেকে মুখ ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল। হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, বসবে।’

বাস হর্ন দিতে শুরু করেছে।

বাস ঘনঘন হর্ন দিচ্ছে। সকলকে ডাকছে। একটানা বাসের হর্ন শুনতে মোটেই ভাল লাগে না। অসহ্য লাগে। তবে এখন খুবই মিষ্টি লাগছে।

ঘোষবাবুর ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। বড় ফাঁড়া কেটেছে। ঘণ্টা চারেক একেবারে ঝড় বয়ে গেল। লনে ক্রিকেট খেলার নামে জানলার কাচ ভাঙা, সিঁড়িতে বসে গানের নামে কান ফাটানো চিৎকার, লাউঞ্জে আড্ডার নামে হ্যা হ্যা করে হাসি। সামান্য টেনশনটুকু নেই! বেড়াতে বেরিয়েছিস বলে কাণ্ডজ্ঞান হারাবি? গেস্ট হাউসের অন্য গেস্টরা ইতিমধ্যে কমপ্লেন করে গেছে।

ঘোষবাবু দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বাসে মালপত্র উঠে গেছে। লোকজনও উঠে পড়েছে। বাস যদি আজ সারানো না হত তা হলে গোটা পার্টি এখানেই থাকতে চাইত। ঘর নেই বললে এরা শুনত? ঘোড়ার ডিম শুনত। বলত, ‘বারান্দাতেই শোব। এখানেই কম্বল দিন। বেশ মজা হবে!’ কাচ্চাবাচ্চা মেয়েছেলে নিয়ে বারান্দায়? এতক্ষণ দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এরা তাও করতে পারে। বাপ রে! আপদ বিদায় হচ্ছে। আপদ তো নয়, আপদের দল।

বাসে ওঠার আগে দত্ত নামের লোকটা একবার এসেছিল। ট্যুরিস্ট দলের লিডার এটাই। বাস খারাপ হওয়ার পর ভয়ে কোথায় যেন কেটে পড়েছিল। বাস ঠিক হয়ে গেছে জেনে ব্যাটা আবার টাইফাই লাগিয়ে লিডার সেজে হাজির। বজ্জাতটা এখানে এসে দু’-চারটি তেলুগু শিখে নিয়েছে। ন্যাকামি। এসে দাঁত বের করে বলল, ‘ভোজনম তোরগু তায়া? খাবার পাওয়া যাবে?ভেরিনিলু তোরগু তায়া? ভাত পাওয়া যাবে?’

ঘোষবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আপনাকে বাংলায় অনুবাদ করতে হবে না। আমি তেলুগু জানি না, খাবারটাবার কিছু পাওয়া যাবে না।’

নির্লজ্জটা তাও দাঁত বের করে বলল, ‘মঞ্চিদাণ্ডি। ধন্যবাদ। মিরু মঞ্চিওয়ারু। আপনি একজন ভাল লোক।’

উফ! আবার বাংলা করে দিচ্ছে? আচ্ছা অসভ্য তো! ভাল লোক কিনা একটু পরেই বুঝতে পারবে ব্যাটা। কাউকে না জানিয়েই বাচ্চাগুলোর জন্য স্যান্ডুইচ, ডিমসেদ্ধ, কলা আর মিষ্টি প্যাকেটে করে বাসে তুলে দিয়েছেন ঘোষবাবু। এদের চিন্তা না থাকুক, তাঁর চিন্তা আছে। বাচ্চাগুলো কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে? ধেড়েগুলো গান গেয়ে পেট ভরাক। বেশ হবে। শাস্তি হবে।

বাস ছেড়ে দিচ্ছে। চাকা গড়াচ্ছে। ঘোষবাবু দেখলেন, বড় বড় কাচের জানলা দিয়ে চলন্ত বাস থেকে ওরা হাত নাড়াচ্ছে। আদিখ্যেতা, চরম আদিখ্যেতা। তাঁকে দেখে হাত নাড়ার কী আছে? যেন কতদিনের আলাপ! ছোটরা নাড়ছে ঠিক আছে, তা বলে ধেড়েগুলো হাত নাড়বে? আচ্ছা মুশকিল তো।

ভীষণ বিরক্ত হয়ে ঘোষবাবুকেও হাত তুলতে হল এবং নাড়তে হল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর চোখে জল! নিশ্চয় হতচ্ছাড়া বাসের ধোঁয়ার জন্য। ঘোষবাবু রুমাল বের করলেন।

‘ভ্যালি ভিউ’ গেস্ট হাউসের ম্যানেজার দোতলা থেকে নেমে ভয়ংকর এক বিস্ময়ের মধ্যে পড়লেন।

মেয়ে তার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বসে আছে। তারা যায়নি। মেয়েটা বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে।

‘একী! আপনারা গেলেন না?’

মেয়েটা হাসল। চেয়ার ছেড়ে উঠে এল। বলল, ‘না ম্যানেজারবাবু। আমরা আর একটা দিন থেকে যাব ঠিক করেছি। মা’র খুব ইচ্ছে ওই পাহাড়টা পর্যন্ত একবার ঘুরে আসবে। আমি বারণ করলাম, শুনল না। দেখি যতটা পারা যায় যাব। রোদ পড়ে গেলে একটা গাড়ি নিয়ে বেরোব না হয়। কী ? যাওয়া যাবে না ম্যানেজারবাবু?’

‘না। যাওয়া যাবে না।’ ঘোষবাবু কঠিন গলায় বললেন।

মেয়েটা আবার হাসল। বলল, ‘আমি জানি যাওয়া যাবে না। তবু যাব। আপনি একটা টর্চ দিন তো। ফিরতে যদি রাত হয়ে যায়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *