বাদল সাঁঝে
কিছুই ঘটেনি, তবু প্রবালের মনে হচ্ছে আজ একটা অন্য রকম দিন। ঘুম থেকে উঠে মনে হচ্ছে অন্য রকম সকাল। দাঁত মাজতে গিয়ে মনে হল পেস্টের স্বাদটা অন্য রকম। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলার সময় মনে হল, তারা অন্য রকম ব্যবহার করছে। গাড়ি চালিয়ে অফিসে আসতে খেয়াল হল, ট্রাফিক পুলিশ তার দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে এবং দ্রুত গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। অফিসেও একই কাণ্ড। বেয়ারা, পিয়োন, ক্যাশিয়ার, পারচেজ ম্যানেজার তার সঙ্গে অন্য রকম ভাবে কথা বলছে। গম্ভীর কথার মধ্যেও একটা হাসিহাসি ভাব।
এরকম হওয়ারই কথা। যে-যুবকের বিয়ের সাত দিন বাকি থাকে তার সবকিছুই অন্য রকম লাগে। এর জন্য আলাদা ঘটনা ঘটার প্রয়োজন হয় না।
প্রবাল মনে মনে ঠিক করল, তার সবকিছু অন্য রকম লাগলেও সে একই রকম থাকবে। মন দিয়ে কাজ করবে। সেলস রিপোর্ট দেখবে, পারচেজ ম্যানেজারকে ডেকে ধমকাবে। লাঞ্চের পর সবাইকে নিয়ে মিটিং করবে। আজেবাজে কাউকে ঘরে ঢুকতে দিলে পিয়োনের ওপর রাগ দেখাবে। কোনও ফালতু টেলিফোন ধরবে না। সময় পেলে চারটে নাগাদ একবার মধ্যমগ্রামের সাইটে যাবে। বিয়ে এমন কোনও ঘটনা নয় যে সাত দিন আগে থেকেই লাফাতে হবে। এসব মেয়েদের মানায়। বাড়িতে মা, বড়দিদি, ছোটকাকিমা হইচই বাধিয়ে দিয়েছে। কাল সকালের ফ্লাইটে জয়পুর থেকে পিসি আসছেন। নেমন্তন্ন পর্ব অনেকদিন শেষ। তবু মা আজ সকালেও কষ্ট করে আরও তিন জনের নাম মনে করেছে এবং তাদের নেমন্তন্ন করতে বেরিয়েছে। বিয়ের বাজার পর্ব শেষ। শুধু কাল, পরশু, তরশু ‘ফিনিশিং টাচ বাজার’ হবে। পিসির জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। তিনি নাকি ‘ফিনিশিং টাচ বাজার’ বিষয়ে বিশেষ রকম হাত পাকিয়েছেন। জয়পুর থেকে তাঁকে আনা হচ্ছে।
প্রবাল মনকে শক্ত করল।
মন শক্ত হল না। কাগজপত্রে হাত দেওয়ার পরই তার মনে হল, অনসূয়াকে একবার টেলিফোন করলে কেমন হয়? ভাল হয় না। বিয়ের আলাপ-আলোচনা চূড়ান্ত হওয়ার পর যে কয়েকবার সে অনসূয়াকে টেলিফোন করেছে কোনওবারই কথাবার্তা বিশেষ এগোয়নি। অনসূয়া এগোতে চায়, পারে না প্রবাল। হবু বউয়ের সঙ্গে আলাপ জমানোর ব্যাপারটা কিছুতেই রপ্ত করতে পারছে না। এ বিষয়ে কোনও শর্ট কোর্স থাকলে ভাল হত। অনসূয়া সেদিন টেলিফোনেই বলল, ‘চলুন না প্রবালবাবু, শনিবার আমরা দু’জনে বাইরে কোথাও খাই। সন্ধের পর একটু মিলেনিয়াম পার্কে ঘুরলাম। তারপর পার্ক স্ট্রিটে কোথাও খেলাম। যাবেন?’ সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্মার্ট হবু বউয়ের এই প্রস্তাব লাফিয়ে গ্রহণ করার মতো প্রস্তাব। প্রবাল সিঁটিয়ে গেল। বলল, ‘শনিবার? না না শনিবার কী করে হবে? শনিবার আমাদের বোর্ড মিটিং।’
এরকম হওয়ার কথা নয়। আজকাল সম্বন্ধ-প্রেম খুব চালু জিনিস।
নিজের ওপর প্রবালের খুব রাগ হল এবং অফিসের কাগজপত্র সরিয়ে সে টেলিফোন তুলল। না, আজ সে অনসূয়াকে নিয়ে বেরোবেই বেরোবে। নিউমার্কেট গেলে কেমন হয়? মেয়েটা পছন্দমতো কিছু কিনতে পারে।
প্রথমবারেই লাইন পাওয়া গেল। শুধু পাওয়া গেল না, ফোন ধরল অনসূয়া নিজে। অনসূয়ার গলা শুনেই প্রবাল ঘাবড়ে গেল, কথাও আটকে গেল। সে ফোন নামিয়ে রাখে।
ফোন নামিয়ে জল খেতে খেতে প্রবালের মনে হল নিজের গালে একটা চড় মারে। আস্তে চড় নয়, জোরে চড়। বিয়ের সাত দিন আগে যে-পুরুষ হবু বউয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কথা আটকে ফেলে তার আস্তে চড়ে কিছু হয় না।
কথা ছিল, আজ বাইরের কোনও ফালতু লোকের সঙ্গে দেখা করবে না। রিসেপশন থেকে ইন্টারকমে খবর এল, একটি ছেলে দেখা করতে চায়। নাম বলছে হরি।
‘কী দরকার জেনে নিয়ে চলে যেতে বলুন। আজ কারও সঙ্গে দেখা হবে না।’
‘ছেলেটা বলছে, দরকার নাকি ওর নয়। দরকার স্যার আপনার।’
‘হোয়াট। আমার দরকার?’ প্রবাল অবাক হল।
ও-পাশ থেকে এবার আমতা আমতা করে জবাব এল, ‘স্যার, হরিবাবু বলছেন, উনি অনসূয়া ম্যাডামকে চেনেন।’
প্রবাল থমকে গেল। বলল, ‘তাই নাকি? লোকটাকে ভেতরে আসতে বলুন।’
দরজা ঠেলে যে-যুবক ঢুকল তার বয়স খুব বেশি হলে পঁচিশ-ছাব্বিশ। মুখ-ভরতি দাড়ি। ম্যানেজমেন্টে দুর্দান্ত রেজাল্ট করা প্রবাল এক মুহূর্ত খুঁটিয়ে অনেক কিছু দেখে নিল। ছেলেটা পরেছে নীল প্যান্ট, লাল চেক শার্ট। শার্ট ফুলহাতা, কিন্তু হাতা আটকানো নয়, আবার গোটানোও নয়। ঝ্যালঝ্যাল করছে। শেষ বোতামটা নেই। গলার কাছ থেকে সবুজ রঙের একটা চাদর ঝলছে বুক পর্যন্ত। খুব সম্ভবত মেয়েদের চাদর। সবকিছুই যথেষ্ট মলিন! কাঁধে ব্যাগ। কোনও এক কালে ব্যাগটার হলুদ রং ছিল। অনেকদিন হল সেই রংকে বিদায় দিয়ে ব্যাগ এখন তার নিজের পছন্দমতো রং নিয়েছে। সেই রঙের নাম ধুলো রং।
হাসিমুখে ছেলেটা বলল, ‘স্যার, ভাল আছেন?’
প্রবাল খুব বিরক্ত। বিরক্ত হওয়ারই কথা। এরকম একটা লোককে অনসূয়া চেনে? স্ট্রেঞ্জ! লোকটা এসে আবার সে-কথা জাহির করে বলছে? ছি ছি! অফিসের সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে, ‘স্যারের শ্বশুরবাড়ির লোক এসেছে।’ রাবিশ!
প্রবাল গম্ভীর হয়ে বলল, ‘বসুন।’
লোকটা বসল। কাঁধের নোংরা ব্যাগটা নামিয়ে রাখার আগে হাতের তালু দিয়ে চকচকে টেবিলের ওপর থেকে অদৃশ্য ধুলো সরাল। এখনও সে মুখ নর্মাল করেনি। হাসিমুখই আছে। হাসির কী ঘটল? অসহ্য।
‘স্যার, আপনার ঘরটা মনে হচ্ছে বেশিমাত্রায় ঠান্ডা। ঠান্ডাটা খানিকটা কমাননা যাবে নাকি? আমার আবার জ্বরজ্বর হয়েছে। কাল রাতে বৃষ্টিতে ভিজে গোলমাল করে ফেলেছি। বৃষ্টিতে ভিজলেই স্যার আমার গোলমাল হয়। অথচ না-ভিজেও পারি না। কী মুশকিল বলুন দেখি।’
আধুনিক ম্যানেজমেন্টের একটা নিয়ম হল, অপ্রয়োজনীয় কথা বেশিক্ষণ চলার আগেই আলোচনার বিষয় নিজের হাতে নিয়ে নিতে হয়। প্রবালও নিল। সে বলল, ‘কেন, পারেন না কেন? আপনার ছাতা নেই বুঝি?’
‘আছে স্যার, কালও ছিল। আসলে রাতের বৃষ্টি হল প্রকৃতির একটা অতি আশ্চর্য জিনিস। অন্ধকার থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি জলের ফোঁটা এসে পড়ছে। কোথা থেকে তারা আসছে, কোথায় যাচ্ছে, বোঝা যায় না। তখন গায়ে মেখে দেখতে হয় সত্যি কিনা! এই গায়ে মাখতে গিয়েই মাঝে মাঝে ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলি। আপনি স্যার এয়ার কন্ডিশনটা একটু কমিয়ে দিন।’
না, এ-লোকের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার হবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রবালের ইচ্ছে করছে, লোকটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে। করা যাবে না। হবু বউকে যে চেনে তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া যায় না। সে উঠে এসে মেশিনের সুইচ বন্ধ করে এল।
ঠান্ডা গলায় বলল, ‘হরিবাবু, বলুন আপনার কী দরকার?’
লোকটা হাসল। বলল, ‘তাড়ার কী আছে? সাত দিন বাদে আপনার বিয়ে। আজ নিশ্চয়ই ফাইল খুলে বসবেন না? তা ছাড়া দরকার স্যার আমার নয়, আপনার। আপনি এক কাপ চা দিতে বলুন। গলাটা উসখুস করছে। চা আছে তো? কফি কিন্তু চলবে না স্যার। বৃষ্টি-ভেজা উসখুস গলায় কফি কোনও কাজ দেয় না। চা দেয়। বেস্ট মেডিসিন হল ভাঁড়ের চা। স্যার ভাঁড়ের ব্যবস্থা হবে? সামনের ফুটপাথের দোকানটা থেকে যদি এক ভাঁড় চা আনাননা যেত।’
হয় লোকটার স্পর্ধা আকাশছোঁয়া, নয় পাগল। পাগল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আচ্ছা ঝামেলা হল।
প্রবাল ইন্টারকমে চায়ের অর্ডার দিল। এমন সময় টেলিফোন বাজল। ফোন। ধরতেই বুকটা ধক করে উঠল প্রবালের। ভয়ের ধক নয়, আনন্দের ধক। ও-পাশে অনসূয়া।
‘হ্যালো, প্রবালবাবু বলছেন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন, বলছি।’
‘দেখুন না ফোনটা মনে হয় ডিসটার্ব করছে। কতক্ষণ ধরে আপনাকে ট্রাই করছি। একটু আগে একটা ফোন এসে কেটেও গেল।’
‘তাই বুঝি? টেলিফোন অফিসে একটা কমপ্লেইন করতে হবে।’
‘প্রবালবাবু, বিকালে আপনার একটু সময় হবে? ভাবছিলাম একবার নিউমার্কেট যাব। ক’টা কেনাকাটা ছিল। মা বলছিল, আপনি থাকলে ভাল হয়। দু’জনে পছন্দ করে নিতে পারি। এই ধরুন পরদার কাপড়, একটা জুট কার্পেট।’
‘মনে হচ্ছে পারব। আপনাকে একটু পরেই ফোন করে ফাইনাল করছি।’
ফোন নামিয়ে প্রবাল বলল, ‘হরিবাবু, এবার আপনার কথাটা বলুন।’
লোকটা চেয়ার টেনে এগিয়ে এল। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এখন এঘরে কেউ ঢুকবে না তো?’
‘না, ঢুকবে না। দয়া করে আপনি একটু তাড়াতাড়ি করুন। আমার জরুরি কাজ আছে।’
‘ঠিক আছে স্যার, আমি তাড়াঁতাড়িই করছি। অনসূয়া নামের যে-মেয়েটিকে আপনি ক’দিন বাদে বিয়ে করছেন তাকে আমি ভালবাসি। অনেকদিন থেকেই ভালবাসি। কলেজে প্রথম যেদিন ওর সঙ্গে আলাপ হল, বলতে পারেন প্রেমে পড়েছি সেদিন থেকেই। অনসূয়া একেবারে অন্য রকম মেয়ে স্যার। দারুণ মেয়ে। এই মেয়ের প্রেমে না-পড়াটাই অন্যায়। আমি সেই অন্যায় কাজ করতে পারিনি। আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম। পাগলের মতো প্রেম। যাকে বলে ম্যাড-প্রেম। হা হা।’
চেয়ারটা কি দুলে উঠল? প্রবাল টেবিলে হাত রাখল। খুব রাগ হলে মনে হয় মাঝেমধ্যে মাটি কাঁপছে। এটা অসম্ভব কোনও ব্যাপার নয়। রাগ হল এক ধরনের হরমোন প্রতিক্রিয়া। সেই প্রতিক্রিয়া সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে মুহূর্তের জন্য এলোমেলো করে দিতে পারে। এই দোলাচলের মধ্যেই প্রবাল ভেবে ফেলল, তার সামনে দুটো পথ। এক, লোকটাকে মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে দেওয়া। এটা হল হবু স্বামীর পথ। দু’নম্বর পথ হল, মাথা ঠান্ডা রেখে বিষয়টা এখানেই শেষ করে ফেলা। প্রথম পথ হল কেলেঙ্কারির পথ। কেচ্ছার পথ। দ্বিতীয় পথ হল দক্ষ ম্যানেজারের পথ।
বেয়ারা চা নিয়ে ঢুকল। লোকটা হাসিমুখে বলল, ‘ভাই, শুধু চা আনলে? বিস্কুট নেই? খালি পেটে চায়ে আবার অ্যাসিড হয়। থাক শুধু চা-ই দাও। এরপর থেকে যখনই কাউকে চা দেবে দুটো করে বিস্কুট দেবে, কেমন?’
প্রবালের হাতের ইশারায় হতভম্ব বেয়ারা চলে গেল। সে দু’নম্বর পথটাই নিল। দক্ষ ম্যানেজারের পথ। অল্প হাসল এবং বলল, ‘হরিবাবু, এই তা হলে আপনার কথা? এটা জানাই আমার দরকার ছিল বলছেন?’
চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে লোকটা বলল, না স্যার, এটা জানা আপনার দরকার ছিল না। এটা অনেকেই জানে। হরি যে অনসূয়ার প্রেমে পাগল ছিল, তার পেছনে ঘুরঘুর করত, চিঠি দিত, এসব ভবিষ্যতে লোকমুখে নিশ্চয়ই শুনতে পেতেন। বাঃ, চা-টা তো চমৎকার! অনেকে চা ভাল করতে কাগে এলাচ ফেলে। সেটা আর তখন চা থাকে না, হয়ে যায় এলাচা। এলাচা মোটেই ভাল চা নয়, খারাপ চা। তাতে চায়ের স্বাদ হাকে না, মনে হয় এলাচ গাছের পাতা খাচ্ছি। এটা সেরকম নয়। আর এক কাপ পেলে ভাল হত। জ্বর ভাবটা বোধহয় বাড়ছে। যাক, স্যার যেটা আপনার জানা দরকার সেটা হল, আমি অনসূয়ার প্রেমে পড়লেও অনসূয়া মোটেও আমার প্রেমে পড়েনি। একেবারেই পড়েনি। সত্যি কথা বলতে কী সে আমাকে খানিকটা ঘেন্নাই করত।’
‘কেন, ঘেন্না করত কেন?’
‘কী যে বলেন স্যার, ঘেন্না করবে না। আপনার উড বি স্ত্রী ফোর ইন ওয়ান। সুন্দরী, শিক্ষিতা, ধনী, বুদ্ধিমতী। আর আমি হলাম ভিখারি পাগলা গোছের একটা মানুষ। সে কোন দুঃখে আমার প্রেমে পড়তে যাবে? আপনি কি খেপেছেন? অনসূয়া আড়ালে কী বলত জানেন? বলত, হরিপাগলা। সামনেও বলত। হা হা।’
এতক্ষণে প্রবালের খানিকটা নিশ্চিন্ত লাগতে শুরু করেছে, ইন্টারেস্টিংও। হবু বউয়ের প্রেমে পড়ে কোনও তরুণের পাগল হয়ে যাওয়ার গল্প মনের মধ্যে একটা ‘গর্ব গর্ব’ ব্যাপার আনে দেখা যাচ্ছে।
মন হালকা করে প্রবাল চেয়ারে হেলান দিল। বলল, ‘তারপর কী হল হরিবাবু?’
‘কিছুই হল না। কলেজের পালা চুকেবুকে গেল। ভাবলাম, চাকরিবাকরি পেলে লাস্ট একটা ট্রাই নেব। চাকরি স্যার এখনও হয়নি। আর হবে বলে মনে হয় না। কলেজের এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে গতকাল হঠাৎ দেখা কলেজ স্ট্রিটে। বলল, তোর সেই অনসূয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে রে। ভেবে দেখলাম বিয়েটা ভাল কিন্তু কথাটা ভাল নয়। অনসূয়া আমার কেন হতে যাবে? আমি বাজি রেখে বলছি, আমার নামও অনসূয়ার এখন আর মনে নেই। বিশ্বাস না হলে আপনি নিজে জিজ্ঞেস করে দেখবেন স্যার। দেখলে চিনতেও পারবে কিনা সন্দেহ। বিয়ের মুখে এ ধরনের কথা ছড়ালে গোলমাল পাকায়। স্ত্রীর সম্পর্কে স্বামীর মানে মিথ্যে সন্দেহ জাগে। তাই খোঁজখবর নিয়ে সোজা আপনার কাছে চলে এলাম। খোলাখুলি সব জানিয়ে গেলাম। ব্যস, আর কোনও গোলমালের চান্স রইল না। স্যার, আপনার কাছে জ্বরের কোনও ট্যাবলেট আছে? জ্বরটা জমিয়ে এসেছে মনে হয়।’
যে-কাজ করা উচিত নয় প্রবাল সেই কাজ করল। সে উঠে দাঁড়িয়ে হরির কপাল স্পর্শ করল।
‘একী! বেশ জ্বর তো! গা পুড়ে যাচ্ছে। দাঁড়ান ওষুধ আনিয়ে দিচ্ছি। ডাক্তার দেখাবেন? সামনেই একটা ডিসপেনসারি আছে। রাস্তাটা পেরোলেই। বসুন আপনি, বেয়ারাকে ডাকি। সে নিয়ে যাক আপনাকে।’
হরি হাসল। বেশি জ্বরের একটা ক্ষমতা আছে। সে মানুষকে যেমন কষ্ট দেয় তেমনি একটা মায়া-ভরা হাসিও দেয়। সেই হাসি দেখলে সুস্থ মানুষেরও হিংসে হয়। মনে হয়, এই সুন্দর হাসি আমার নেই কেন? প্রবালের হল।
‘থাক স্যার। আসবার সময় দেখলাম আকাশ বড় সুন্দর কালো করে এসেছে। ফেরার পথে যদি বৃষ্টি নামে তখন ভিজব। ভিজলে আর জ্বরের কথা মনে থাকবে না। আমি বরং উঠি। সাধারণত আপনার মতো পজিশনের মানুষরা খুব নিচুর দিকের মানুষ হয়। আপনি একজন চমৎকার মানুষ। সাধারণ চমৎকার নয়, অসাধারণ চমৎকার।’
ফুলশয্যার রাতে বৃষ্টি নামল। তুমুল বৃষ্টি। প্রবালের তিনতলার ঘরের সঙ্গে বিরাট বারান্দা। জাপানি কায়দার আকাশ-খোলা বারান্দা। বৃষ্টির ফোঁটা সেখানে দারুণ হইচই বাধিয়ে দিয়েছে।
অনসূয়া ফিসফিস করে বলল, ‘চলো গিয়ে ভিজি।’
‘সেকী! এত রাতে ভিজবে!’
‘ক্ষতি কী? সবাই তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ দেখবে না। অন্ধকারের বৃষ্টি হল একটা আশ্চর্য ব্যাপার। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি জলের ফোঁটা কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাচ্ছে বুঝতেই পারবে না। এই বৃষ্টি গায়ে নিতে হয়। প্লিজ, চলো।’