এত আলো
আলো নিভে গেল।
এক-একটা আলো নেভার এক-এক রকম নিয়ম। প্রদীপের আলো যেভাবে নেভে ইলেকট্রিক বাল্ব সেভাবে নিভবে না। প্রদীপ নেভার আগে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে। বাল্বের বেলায় তা হয় না। সে নেভে ঝপ করে। এখানে অন্যরকম ঘটল। আলোগুলো প্রথমে কমতে কমতে একেবারে বিন্দুর মতো হল, তারপর নিভল। হল, মঞ্চ সব অন্ধকার, হলের বাইরের চাতাল সিঁড়ি অন্ধকার, মূল গেট অন্ধকার, গেটের মুখের ছোট্ট বাগান আর বাগানের মাঝখানের রঙিন আলোর ফোয়ারাটাও অন্ধকার।
মঞ্চে তখন নাটকের ফাইনাল রিহার্সাল চলছে। পরিচালক অর্ণববাবু এই নিয়ে তৃতীয়বার ফাইনাল রিহার্সাল করাচ্ছেন। এতে কেউ কেউ আপত্তি তুলেছিল। তাদের মতে, তিনবার কেন? ফাইনাল তো একবারই হয়। পরিচালক সেই আপত্তিতে কান দেননি।
রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময়ে প্রতিবছর নাটকের দায়িত্ব নেন সুনীলদা। এবারও নিয়েছিলেন। কিন্তু বিচ্ছিরি একটা গোলমাল হওয়ায় সুনীলদা ক্লাবে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। ক্লাবের ওপর মহল থেকে গোলমালের কথা চেপে রাখা হয়েছে। গোলমালের জিনিস চেপে রাখলে খুব তাড়াতাড়ি ফাঁস হয়ে যায়। এখানেও তাই হয়েছে। জানা গেছে, সুনীলদা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দীর্ঘ দশ বছর নাটক পরিচালনার জন্য এবার ক্লাবের পক্ষ থেকে তাঁকে একটা সংবর্ধনা দেওয়া হোক। বড় কিছু নয়, একটা ফুলের মালা আর একটা মানপত্র। সময় থাকলে মিনিট তিনেকের একটা ভাষণ, না থাকলে নয়। কর্মকর্তারা সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। তাঁরা বলেছেন, অসম্ভব। এলাকার কাউন্সিলর বটকৃষ্ণ হালদারকে এবার সংবর্ধনা দিতেই হবে। অনুষ্ঠানের সিংহভাগ খরচ তাঁর। সুতরাং অন্য কারও কথা ভাবাই যায় না। তারপর থেকেই সুনীলদা আসছেন না। ছেলেরা অবশ্য বলাবলি করেছে, কাজটা ঠিক হয়নি।
যাই হোক, ঠিক হল, পরিচালক যখন নেই তখন নাটক বাদ। এমন সময় অর্ণববাবুর খোঁজ মিলল। ভদ্রলোক মাসকয়েক হল কলকাতা থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছেন। পরিচালনার ব্যাপারে কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলেও ভদ্রলোক নাটক বিষয় নাকি কয়েকটি গম্ভীর ধরনের বই লিখেছেন। পরিচালনার প্রস্তাব শুনে গভীর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তিনি নাক কুঁচকোলেন। বলেন, ‘ইমপসিবল। এই মফস্সল শহরে নাটক! খেপেছেন? এখানে নাটক করবার মতো ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোথায়? ভাল স্টেজ আছে? থাকলেই বা তার ডেপথ কতটা? স্পট লাইট ক’টা আছে বলতে পারেন? অ্যাকুয়াস্টিকের কন্ডিশন কী? লোক হাসাব নাকি?’
শেষপর্যন্ত অনেক ধরাকরার পর ক্ষমা ঘেন্না করে ভদ্রলোক রাজি হলেন। যারা ক্ষমা ঘেন্না করে তাদের অত্যাচার সবসময়ই মারাত্মক হয়। এক্ষেত্রেও হয়েছে। কিন্তু মুখে কিছু বলা যাচ্ছে না।
অন্ধকারের প্রথম ধাক্কায় সবাই যখন চুপ তখন অর্ণববাবুর চিৎকার শোনা গেল—
‘লাইটস, লাইটস।’
কে যেন বলে উঠল, ‘হারামজাদা চেঁচায় কেন? ব্যাটা বেশি ওস্তাদ। কান ধরে এক থাবড়া দে তো।’
গ্রিনরুমে মোমবাতি জ্বলছে। লিকলিকে মোমবাতি, কিন্তু তেজ আছে। ক্লাব-কর্মকর্তাদের জরুরি মিটিং চলছে। ক্লাবের সেক্রেটারি বারীনদা বললেন, ‘তখনই বলেছিলাম হলের অবস্থা ভেরি ডেনজারাস। কোনও বিশ্বাস নেই। তাও ভাগ্যিস ইলেকট্রিকের গোলমাল, মাথায় যে ছাদ ভেঙে পড়েনি এই অনেক।’
বামাচরণবাবু প্রেসিডেন্ট। তাঁর মেজাজ সবসময় চড়ার দিকে। তিনি বললেন, ‘প্রতিবারের মতো ক্লাবের মাঠে প্যান্ডেল খাটালে কী অসুবিধে হত? মাঠে কি নাটক হয় না?’
অর্ণববাবু চোখ বুজে সিগারেট খাচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছে, গভীরভাবে নাটকের কথা ভাবছেন। আসলে তা নয়। চোখ বুজে একটু আগে শোনা গালিগুলো ভোলার চেষ্টা করছেন। পুরোটা ভুলতে পারছেন না। ‘হারামজাদা’ কথাটা ভুলে গেলেও ‘কান ধরে থাবড়া মারা’র ব্যাপারটা ভোলা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, ভুলতে সময় লাগবে। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘মাঠ হল ফুটবল খেলার জায়গা। নাটক করার নয়।’
অশোক রাগী গলায় বলল, ‘এত বছর তা হলে কী হয়েছে?’
অর্ণববাবু শান্ত গলায় বললেন, ‘নাটক নাটক খেলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনারা নাটক না করে ক্লাব থেকে সরাসরি খেলার ব্যবস্থা করলেই তো পারতেন। রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে নৈশ ফুটবল— বেশ নতুন ধরনের একটা জিনিস হত।’
সন্তোষ বলল, ‘এবার তো আলোর একটা ব্যবস্থা করতে হয়। ম্যানেজার ব্যাটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় ভিড়ে মিশে গেছে। এদিকে দর্শকরা আসতে শুরু করে দিয়েছে। কাউন্সিলর সাহেবেরও আসার টাইম হয়ে গেল।’
বারীনদা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘কেলেঙ্কারি কাণ্ড! অন্ধকারে বটকৃষ্ণবাবু এসে গেলে বিচ্ছিরি হবে। গেটের সামনে সবাইকে রেডি থাকতে বলো। স্টেজ সাজানো হয়েছে? সন্তোষ, কয়েকটা হ্যাজাকের ব্যবস্থা করা যায় না? এমারজেন্সি আলো নেই?’ সন্তোষ শুকনো গলায় বলল, ‘এত কম সময়ে ওসব হবে না বারীনদা। হ্যারিকেন আনতে পারি।’
অর্ণববাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনারা কি হ্যারিকেন জ্বেলে নাটক করবার কথাও ভাবছেন?’
বামাচরণবাবু দাঁত চিপে বললেন, ‘কেন আপনার অসুবিধে আছে?’ অর্ণববাবু বললেন, ‘না অসুবিধের কী আছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসে বহু নাটক মশাল জ্বেলে হয়েছে। ইউরোপিয়ান নাটকের ইতিহাস যদি আপনি পড়েন—।’
বামাচরণবাবু চিৎকার করে উঠলেন, ‘চুপ, একদম চুপ!’
সামান্য কেঁপে মোমবাতিটা নিভে গেল।
২
মানুষ সবসময় প্রার্থনা করে, প্রিয়জনের আসতে যেন দেরি না হয়।
লীলা উলটো প্রার্থনা করছে। সে চাইছে, তীর্থ যেন আসতে দেরি করে। নইলে সব মাটি হয়ে যাবে। এই অন্ধকারে তার সাজগোজ কিছুই দেখা যাবে না। লীলা আজ বাড়াবাড়ি রকমের সেজেছে। লাল সাউথ ইন্ডিয়ান শাড়িতে সবুজ পাড়, সবুজ ব্লাউজের হাতায় চওড়া লাল বর্ডার। বিনুনিতে রজনীগন্ধার মালা, কপালে চন্দনের টিপ, কানে সবুজ মিনের দুল। লীলা আজ গান গাইবে। গানের জন্য এত সাজগোজের দরকার হয় না। আসলে এর পেছনে গোপন একটা কারণ রয়েছে। আজ তীর্থ এখানে মাকে নিয়ে আসছে। এই মহিলা আজই প্রথম লীলাকে দেখবেন। অনেকটা পাকা দেখার মতো ব্যাপার। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে, ইন্টারভেলের সময় লীলা এসে তীর্থর মাকে প্রণাম করবে। উনি চিবুকে হাত দিয়ে বলবেন, থাক থাক মা। তোমার গলা ভারী মিষ্টি। আরে, মুখটা তো দেখছি গলার থেকেও বেশি মিষ্টি। তোমার বাড়ি কোথায় মা? লীলা ঠিক করে রেখেছে, এই প্রশ্নের উত্তর সে দেবে না। হবু শাশুড়িকে নিজের মুখে ঠিকানা বলাটা একটা লজ্জার ব্যাপার।
লীলা চুপ করে বসে থাকতে পারছে না। গত আধ ঘণ্টায় সে যে কতবার বাইরে ভেতর করেছে তার ঠিক নেই। এত ছটফট করার জন্য লীলার মেকআপের অবস্থা ভয়ংকর। ঘামে মুখে পাউডার প্রায় পুরোটাই নষ্ট। খানিক আগেই চন্দনের টিপ থেবড়ে উঠে গেছে। এখন বিনুনি থেকে রজনীগন্ধার পাপড়ি খুলে খুলে পড়ছে। তবে তার মন বেশ ভাল। কারণ তীর্থরা দেরি করছে। মনে হয়, অন্ধকারের খবর তীর্থ বাড়িতে বসেই পেয়ে গেছে। তীর্থ খুবই স্মার্ট ছেলে। এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও প্রেমিকের বুদ্ধির কথা ভেবে লীলার মুখ কিছুটা হাসিহাসি হল। এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল তীর্থ। পাশে তার মা।
তীর্থ অবাক হয়ে বলল, ‘কী হল লীলা, এত অন্ধকার কেন? মা, এর নামই লীলা।’
লীলার সারাশরীর অবশ হয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে, ছুটে পালাই। কোথা থেকে যেন সামান্য আলো এসে পড়েছে। সেই আলোয় তাকে নিশ্চয় পেতনির মতো লাগছে। এমনি পেতনি নয়, রংচং মাখা পেতনি। এমনি পেতনিকে দিলেও, রংচঙে পেতনিকে কেউ পুত্রবধূ হিসেবে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। সব আশা শেষ। লীলার কান্না পাচ্ছে। সেই কান্না চেপে অতি কষ্টে সে তীর্থর মাকে প্রণাম করল। মহিলা হাসিমুখে তাকে তুলে ধরলেন। বললেন, ‘বাঃ তুমি তো ভারী সুন্দর মেয়ে। আজকাল মেয়েরা বড় বিদঘুটে রকম সাজে। মুখে চড়া করে পাউডার, কপালে এত বড় চন্দনের টিপ, চুলে ফুল লাগিয়ে ন্যাকামির চূড়ান্ত। আমার অসহ্য লাগে! তুমি দেখছি সেসব কিছুই করোনি, ভারী সুন্দর। খুব খুশি হলাম মা। তোমার বাড়ি কোথায়?
লীলা এত অবাক হল যে পরিকল্পনা ভুলে গিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘আপনাদের বাড়ি থেকে খুব কাছেই, নেতাজি মোড় থেকে একটু বাঁদিকে গেলেই।’
মহিলা গলা নামিয়ে হেসে বললেন, ‘কাছে বলে কিন্তু বিয়ের পর ঘনঘন বাপেরবাড়ি যাওয়া চলবে না।’
লীলা লজ্জায় মুখ নামাল।
৩
ভল্টু বলল, মা, ‘ভয় করছে।’
তপতী বলল, ‘একদম বাড়াবাড়ি করবে না। তোমার সাত বছর বয়স হয়ে গেছে। অন্ধকারে ভয় পাবার মতো বয়স তোমার আর নেই। তা ছাড়া এখানে কত লোক আছে।’
ভল্টু বলল, ‘অন্ধকারে ভয় করছে না। মনে হচ্ছে, ভুলে যাব। স্টেজে উঠে বলতে শুরু করলেই ভুলে যাব।’
অনিরুদ্ধ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলল, ‘ভুলে গেলে ভুলে যাবি। ভয় পাওয়ার কী আছে? ছোটরা আবৃত্তি করার সময় একবার-দু’বার ভুলে না গেলে একদম মানায় না। গড়গড় করে মুখস্থ বললে মনে হয় পাকামো করছে।’ ভল্টু শব্দ করে হেসে উঠল। বাবা এসেছে বলে ভয় ভাবটা অনেকটা কেটে যাচ্ছে।
তপতী বিরক্ত গলায় বলল, ‘এ আবার কী কথা? ভুলে যাবে মানে?’
অনিরুদ্ধ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অতশত জানি না। তবে মনে হয় ভুলে গেলে বেশি হাততালি পাবে।’ ভল্টু আবার হাসল। অন্ধকারে তপতীর মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি একটু বেশি জেনে গেছ মনে হচ্ছে।’ তপতীর রাগ আজ অনিরুদ্ধর ভাল লাগছে। মাস দুয়েক হল তপতী বড় ধরনের একটা ঝগড়া করে ভল্টুকে নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে এসেছে। ঘোষণা করেছে, আর ফিরবে না। সত্যি সত্যি ফেরেওনি। আজ ছেলে এই অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করবে বলে অনিরুদ্ধকে খবর দেওয়া হয়েছে। আসবে না ভেবেও অনিরুদ্ধ এসে পড়েছে। স্ত্রীর ওপর অভিমান করা যায়, ছেলের ওপর করা যায় না।
অনিরুদ্ধ বলল, ‘চল ভল্টু, এই গরম হলের মধ্যে না পচে বাইরে গিয়ে আইসক্রিম খাই। সিটে মনে হচ্ছে ছারপোকা আছে।’
তপতী ধমকের গলায় বলল, ‘একদম বাইরে যাবে না। আইসক্রিম তো মুখেও তুলবে না। গলা বসে যাবে।’
অনিরুদ্ধ বলল, ‘তা হলে তপতী তুমি চলো। তুমি আইসক্রিম খাবে?’ ভল্টু আবার শুব্দ করে হেসে উঠল।
স্বামীর রসিকতা শুনলে দু’মাস আগেও তপতীর গা জ্বলে যেত। আজ জ্বলছে না। অন্ধকারের জন্যই কি এমন হচ্ছে? মুখ না দেখতে পেলে পুরনো মানুষকে কি অনেক সময় নতুন নতুন লাগে? কে জানে। হয়তো তাই লাগে। তবে একদিক থেকে ভাল হয়েছে। বাবার জন্য ছেলেটা হাসাহাসির মধ্যে আছে। এতে টেনশন কমবে। নইলে স্টেজে উঠে সব গুলিয়ে ফেলতে পারে। তবু তপতী রাগের ভান করল। বলল, ‘আজ হঠাৎ আমাকে আইসক্রিম খাওয়ানোর ইচ্ছে হল কেন?’
অনিরুদ্ধ বলল, ‘আজ একটা ভাল দিন। ভল্টু স্টেজে উঠছে। ঠিক আছে একটু চা খেয়ে আসি চলো। ওঠ ভল্টু। মনে হচ্ছে না তোদের ফাংশন আজ আর হবে।’
তপতী উঠতে উঠতে বলল, ‘আলবাত হবে। আমি এত কষ্ট করে শেখালাম, আর ওর আবৃত্তি কেউ শুনবে না?’
অনিরুদ্ধ বলল, ‘শুনবে না কেন? আমি শুনব। বাইরের বাগানে বসে শুনব।’
অন্ধকার বাগানে বসে অনিরুদ্ধ মুগ্ধ হয়ে ছেলের আবৃত্তি শুনল। ভল্টু একটুও না ভুলে গড়গড় করে বলে গেল, ‘নমস্কার, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, দুই আমি। বৃষ্টি কোথায় লুকিয়ে বেড়ায় উড়ো মেঘের দল হয়ে।’
আবৃত্তি শেষ হলে তপতী স্বামীর দিকে না তাকিয়ে বলল, ‘কেমন লাগল?’
অনিরুদ্ধ কথা বলতে পারছে না। সে মুগ্ধ। তার ছেলে এত সুন্দর আবৃত্তি শিখল কোথা থেকে? তপতীর কাছ থেকে? কই, তপতীর এই গুণের কথা তো তার জানা ছিল না! আশ্চর্য! সে অবাক চোখে তপতীর দিকে তাকিয়ে আছে।
তপতী ফিসফিস করে বলল, ‘আঃ ওরকম করে তাকিয়ে আছ কেন? ঢঙ।’ তারপর গলা তুলে ছেলেকে বলল, ‘বুঝলি ভল্টু , মনে হচ্ছে তোর পারফরমেন্স দেখে তোর বাবা পাগল হয়ে গেছে। না, আজ তোর বাবাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। চল, আমরা আজই কলকাতায় ফিরে যাই।’ ভল্টু হাততালি দিয়ে উঠল। এত অন্ধকারেও তিনজনের মুখ আলোয় ঝলমল করছে।
৪
অন্ধকারের মধ্যেই কাউন্সিলার বটকৃষ্ণ হালদার পৌঁছে গেছেন। তাঁর দুধসাদা অ্যামবাসাডার গাড়ি গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতি হওয়া বটকৃষ্ণবাবুর প্রধান কাজ। এর জন্য তিনি চাঁদা দেন। চাঁদার পরিমাণ অনুযায়ী আদর যত্নের ব্যবস্থা হয়। যেমন আজ এখানে বড় ব্যবস্থা হয়েছে। সংবর্ধনার ব্যবস্থা।
ক্ষমতাবান মানুষ অন্যদের ঘাবড়ে দিতে ভালবাসে। মানুষ ঘাবড়ানোর জন্য তাদের এক-এক জনের এক-এক রকম পদ্ধতি। বটকৃষ্ণবাবুর পদ্ধতিটি নতুন ধরনের। এই পদ্ধতিতে ঘাবড়ানোর সঙ্গে মানুষের জন্য সামান্য অপমান মেশানো থাকে। তিনি যখন কোনও অনুষ্ঠানে আসেন কখনও তাঁর নিজের গাড়ি থেকে নামেন না। তাঁর গাড়ি দেখে কর্মকর্তারা ব্যস্ত হয়ে ছুটে যায়। দরজা খুলে ধরে। মালা বাড়িয়ে দেয়। ভিডিও ক্যামেরা চালু হয়। সবাই ভাবে, এই উনি গাড়ি থেকে নামবেন। চাপা উত্তেজনা। বটকৃষ্ণবাবু তখন সবাইকে ভড়কে দেন। পেছনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ানো অন্য কোনও গাড়ি থেকে নেমে আসেন। গম্ভীরমুখে ধুতির কোঁচা ঠিক করেন। ভাবটা এমন যেন কিছুই হয়নি। শোনা যায়, একবার রিকশ থেকে নেমে আসার দৃষ্টান্তও নাকি আছে। তাঁর গাড়ি সামনে, তিনি রিকশতে পেছনে!
সেক্রেটারি প্রেসিডেন্ট সহ ক্লাবের বড়কর্তারা সবাই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। আলো না থাকলেও কাউন্সিলর মহাশয়কে স্বাগত জানানোর ব্যবস্থা হয়েছে। হ্যাজাক বা হ্যারিকেন এখনও আসেনি, তবে দুটো টর্চ এসেছে। তার মধ্যে একটাকে জ্বালাতে গিয়ে সামান্য চড়-থাপ্পড় দিতে হচ্ছে। রাস্তার ওপাশ থেকে অল্প আলো এসে পড়েছে। বটকৃষ্ণবাবুর সাদা গাড়ি এসে দাঁড়ালেও কেউ ছুটে গেল না। আসলে সবাই তাঁর কায়দা জেনে গেছে। নিজের গাড়িতে তো উনি থাকেন না। তা ছাড়া আজ ফুলের পাপড়ি ছোড়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ভুল গাড়িতে ছুড়ে ফুলের পাপড়ি নষ্ট করা যায় না। সবাই যখন কী করাবে ভাবছে, এমন সময় সন্তোষ সাদা গাড়ির পেছনে আসা একটা হুড তোলা রিকশ লক্ষ্য করে তীব্র বেগে ছুট লাগাল। চেঁচাতে লাগল ‘ওই তো। ওই তো উনি এসেছেন।’
রিকশ লক্ষ্য করে পাপড়ি ছোড়া শুরু হল।
সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা মানুষটা মাথা নামিয়ে হাঁটছে। মাথা না নামিয়ে উপায় নেই। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা বাচ্চা মেয়েরা থালা থেকে প্রবল বেগে গাঁদার পাপড়ি ছুড়ছে। সামনে বাজানো হচ্ছে শাঁখ। একেবারে পেছনে গালর্স স্কুলের ছাত্রীরা গান ধরেছে—‘মন্দিরে মম কে আসিল হে…। সকল দুয়ার আপনি খুলিল, সকল প্রদীপ আপনি জ্বলিল।’ শক্ত গান। ফলে সুর একটু ভুল হচ্ছে। কিন্তু আলো অন্ধকারের এই সুন্দর শোভাযাত্রায় সেই ভুলও ভারী চমৎকার লাগছে। সকলে হাততালি দিয়ে উঠল।
সিঁড়িতে উঠতে উঠতে সুনীলদা ধুতির কোঁচা দিয়ে চোখ মুছলেন। ভাগ্যিস আলো নেই। নইলে এরা তাঁর চোখের জল দেখে ফেলত। বাপ রে! পাজি ছেলেগুলো তাঁকে না জানিয়ে এত কাণ্ড করে রেখেছে।! সংবর্ধনার এত আয়োজন! তিনি ভাবতেও পারেননি, সত্যি সত্যি এরা মত বদলাবে, কাউন্সিলারের বদলে তাঁকে সংবর্ধনার আয়োজন করবে। ইস! না এলে কী খারাপটাই যে হত। যাক, রিকশতে আসায় তাও কিছুটা তাড়াতাড়ি আসা গেছে।
গাড়ি থেকে নেমে বটকৃষ্ণবাবু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কই কেউ এগিয়ে আসছে না তো! নিজের গাড়ি চেপে আসায় এত অবহেলা?
এদিকে আর এক কাণ্ড হয়েছে। সামনের ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কখন জানি পচা হলের ভেতর ঢুকে পড়েছে। প্রথমদিকে তার ভয়ভয় করছিল। এখন আর করছে না। সে অন্ধকারের মজা বুঝে গেছে। এখানে শালা ভাল পোশাকই বা কী আর তার ছেঁড়া হাফপ্যান্ট, ঝুলমাখা জামা-ই বা কী? অন্ধকারে সব একাকার। এই যে তার পায়ে জুতো নেই কেউ কি জানতে পারছে? ব্যাঙের মাথা পারছে। কখনও সে হলের ভেতর ঢুকে একেবারে সামনের গদি-মোড়া চেয়ারে পা তুলে বসছে, কখনও গ্রিনরুমে ঢুকে পাক মারছে। এই তো খানিক আগে ঝকঝকে বাথরুমে ঢুকে পেচ্ছাপ করে এল। আঃ, বাথরুমে পেচ্ছাপ করার মজাই আলাদা। ঝুপড়িতে ফিরে সবাইকে গল্প করতে হবে। পেচ্ছাপ করার গল্প।
এখন পচা স্টেজে উঠে এসেছে এবং সব থেকে বড় চেয়ারটায় বসে রয়েছে। সামনে পরদা ফেলা। কোথা থেকে যেন মোমবাতি না হারিকেনের আবছা আলো এসে পড়েছে। স্টেজে পচার বিরাট ছায়া। মনে হচ্ছে, আজ গোটা স্টেজই তার দখলে!
৫
একটু আগে উইংসের পাশে রাখা টুলে ধাক্কা খেয়েছে মন্দিরা। বাঁ পায়ের কড়ে আঙুল ফুলেছে, ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তার নাচ। তার দু’চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সবাই ভাবছে মন্দিরা বুঝি ব্যথার জন্য কাঁদছে। আসলে তা নয়। সে কাঁদছে আনন্দে। এইমাত্র তপন চুপিচুপি তার কাছে এসেছিল। অন্ধকারে কেউ দেখতে পায়নি। তার হাত ধরে ফিসফিস করে বলে গেছে, ‘একদম ঘাবড়াসনি মন্দিরা, আজ নাচ তোর দারুণ হবে। আমি ফার্স্ট রো-তে বসে থাকব, তুই ঠিক আমাকে দেখতে পাবি।’
মন্দিরার আঠেরো বছরের জীবন এমন আলোকিত আগে হয়নি কখনও। সেই আনন্দে সে কাঁদছে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল, সে নাচতে পারবে না। তপন তার হাত ধরবার পর মনে হচ্ছে, পারবে। ঠিক পারবে।
আলো নাকি হাসে। কিন্তু অন্ধকার? অন্ধকারও কি হাসতে পারে? যদি পারে, তা হলে সে এখন নিশ্চয়ই হাসছে। বাইরের অন্ধকারে কিছু মানুষের ভেতরের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে সে মুখ টিপে হাসছে।
খবর পাওয়া গেছে, মেরামতির কাজ প্রায় শেষের মুখে। আলো এখুনি জুলে উঠবে।