কোন ভাঙনের পথে

কোন ভাঙনের পথে

গ্রিলের নকশা হল পাতার মতো। অথচ রোদের জন্য বারান্দার গ্রিলের যে ছায়া পড়েছে তাকে পাতার মতো দেখাচ্ছে না। দেখাচ্ছে ফুলের মতো। সম্ভবত প্রকৃতি এই সকালে পাতা আঁকতে চায়নি। ফুল আঁকতে চেয়েছে। প্রকৃতির এটাই মজা। সে যা চায় তাই হয়। সত্যি না হলেও হয়।

বেতের চেয়ার টেনে ফুলের ছায়ায় রজতবাবু বসে আছেন। তবে তাঁর ফুল-পাতায় মন নেই।তাঁর মন টাইম পত্রিকায়। টাইম পত্রিকা তিনি পড়তেন না। সময় পেলে তিনি পড়তেন খবরের কাগজ। তাও পুরো খবরের কাগজ নয়। শুধু হেডিং। কিন্তু গতমাসে তিনি ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার পদে প্রোমোশন পেয়েছেন। তারপর নিয়ম করে ভারী জাতীয় কিছু পড়াশুনো শুরু করেন। এখন যেটা পড়ছেন সেটা শুধু ভারী নয়, ভয়াবহ। ভয়াবহ এই প্রবন্ধের নামও ভয়াবহ। ‘ডেথ রো’। মৃত্যুর সরণি। লেখকের নাম চার্লস পি আলেকজান্দার। লেখার বিষয় হল, ‘অবলুপ্তির পথে যেসব প্রাণী’। এ সম্পর্কে রজতবাবুর আসলে কোনও উৎসাহ নেই। কিন্তু উপায় নেই। প্রোমোশনের পর থেকে তাঁকে এই ধরনের কাজ কিছু করতে হচ্ছে।

প্রবন্ধে লেখা হয়েছে, পৃথিবীর মোট পঁচিশটি প্রাণী এখন ভয়ংকর অবস্থার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। যে-কোনও দিন দেখা যাবে তারা আর নেই। এদের মধ্যে সব থেকে আতঙ্কে আছে চিন দেশের গিবনরা। তাদের সংখ্যা এখন মোটে আটচল্লিশ অথবা উনপঞ্চাশ। ভিয়েতনামের টনকিন স্নাব-নাজড নামের বানরদের অবস্থাও মোটে ভাল নয়। সব মিলিয়ে শ’খানেক টিকে আছে কিনা সন্দেহ। ভিয়েতনামের গোল্ডেন হেডেড লাঙুরও প্রায় তলানিতে। পড়ে আছে দেড়শো জনে। ‘প্রাইমমেট স্পেশালিস্ট গ্রুপ অফ দ্য স্পিসিজ’ নামে একটি সংস্থা এ ব্যাপারে একটি দু:খজনক তালিকা তৈরি করেছে। তালিকা এরকম— নাইজেরিয়ার ক্রস রিভার গরিলা (মাত্র দেড়শোটি), ভিয়েতনামের লাঙুর (খুব বেশি হলে দুশো), ব্রাজিলের নর্দান মুরিকুউ (তিনশো হবে কিনা সন্দেহ), মাদাগাস্কারের গোল্ডেন ব্যাম্বু লেমর (একহাজার জনকে নিয়ে বেঁচে আছে)…।

তালিকা পড়ে রজতবাবুর মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি পত্রিকা বন্ধ করলেন। কে জানে কবে মানুষও উঠে আসবে এই তালিকায়। একসময় মন খারাপ হলে তিনি মেয়ের সঙ্গে গল্প করতেন। আজকাল করেন না। সময় নেই। বাবা-মেয়ে, কারওই সময় নেই।

অথচ আজ একটু আগে পর্যন্ত রজতবাবুর মন ভাল ছিল। ভাল থাকার কারণ দুটি। এক নম্বর কারণ হল, আজ রবিবার। দু’নম্বর কারণ হল, গতকাল অফিসে একটা বড় সমস্যা সামলানো গেছে।

কাল পারচেজে একটা ছোট ধরনের চুরি ধরা পড়ে। টাকার অঙ্ক বেশি নয়। হিসেব করে দেখা গেছে, সাত-আট হাজারের মতো। বড় কথা হল, চুরিটা চলেছে অনেকদিন ধরে। চুরি ছোট হলেও এটা বড় ধরনের ব্যাপার। এতদিন ধরে চুরি চলল, তা হলে ম্যানেজমেন্ট কী করছিল? এই ঘটনা রজতবাবুর কেরিয়ারকে একটা প্রশ্নচিহ্নের মুখে এনে ফেলে। কেরিয়ারের সামনে সব ভাল কিন্তু প্রশ্নচিহ্ন ভাল নয়। ইউনিয়ন লিডার তাপস সরখোলের সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে সেই প্রশ্নচিহ্ন দূর করা গেছে। বড় সুন্দরভাবেই করা গেছে। পারচেজের এক কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে কাল বিকেলের মধ্যে। পুরো বরখাস্ত নয়, সাময়িক বরখাস্ত। আপাতত মাইনে বন্ধ। অফিসে প্রবেশ নিষিদ্ধ। এরপর তদন্ত হবে। তারপর চূড়ান্ত শাস্তি।

‘সরখেল, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? আমরা সাসপেনশনের নোটিশ ধরাচ্ছি। কিন্তু লোকটা যদি সত্যি সত্যি অপরাধী না হয়?’

‘স্যার, আপনারা হলেন ম্যানেজমেন্ট। আমরা হলাম কর্মী। আপনারা যদি এমন কথা বলেন তা হলে আমরা চলব কী করে? দেশ চলবে কী করে? ম্যানেজমেন্টের মাসল কথা হল, অ্যাকশন। নো হাঙ্কি পাঙ্কি। ঠিক ভুল এসব ভাববে কেরানিরা। ম্যানেজাররা নয়।

রজতবাবু ভেবে দেখলেন, সরখেল কথাটা ঠিকই বলছে। লোকটার প্রকৃতি হারামজাদা ধরনের। হারামজাদা ধরনের লোকেরা এমন অনেক ধরনের খারাপ জিনিস ভাবতে পারে যা মাইনে করা ম্যানেজাররাও পারে না।

‘সরখেল, লোকটাকে কি আমি চিনি?’

‘কোন লোকটাকে সার?’

‘যাকে সাসপেন্ড করা হচ্ছে, ওই যে মাধব না কী বললে? তাকে দেখেছি কখনও?’

‘না স্যার। মনে হয় না দেখেছেন। গত বছর কি স্যার আপনি কর্মীদের বার্ষিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন?’

‘মনে পড়ছে না।’

‘আমার মনে পড়ছে। বসেদের সবকিছুই আমার মনে থাকে। আপনি যাননি।’

‘তাই হবে। তুমি যখন বলছ, তখন নিশ্চয়ই যাইনি। গেলে কী হত?’

‘সেই অনুষ্ঠানে মাধব নাকে গিটার বাজিয়েছিল।’

রজতবাবু অবাক হলেন। বললেন, ‘কী বাজিয়েছিল? নাকে কী বাজিয়েছিল?’

‘গিটার। মাইকের কাছে নাক এনে, একটা ফুটো টিপে ধরে, হাতের তালু নাড়িয়ে নাড়িয়ে চোখ বুজলে অবিকল গিটারের মতো শোনাবে। অনেকটা এইরকম স্যার, এই যে—’

সরখেল নাক টিপে বাজিয়ে দেখাতে গেল। রজতবাবু বলেন, ‘থামো থামো। রাবিশ।’

সরখেল এক গাল হাসল। বলল, ‘এইজন্যই লোকটার নাম আমি আপনাকে বললাম। বললাম কিনা? ওর বিরুদ্ধে চুরির কেস কেন? খুনের কেসও দিতে পারেন। ছাগলটা ব্যা ব্যা করে ডাকতেও পারবে না। আপনার এত বড় অফিসে এরকম ছাগল আর একটাও পাবেন না। এক কাপ চা বলবেন স্যার?’

ছুটির আগেই চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হল। মাধব কর্মকার নামে সাঁইতিরিশ বছরের লোকটি এমনিতেই যথেষ্ট বেকুব প্রকৃতির। টাইপ করা চিঠি হাতে পেয়ে আরও বেকুব বনে গেল।

দিল্লিতে রজতবাবু ফ্যাক্স পাঠালেন। তাতে চুরির খবর ছোট করে, অ্যাকশনের খবর বড় করে জানানো হল।

এরপরে মন ভাল না থেকে উপায় আছে? উপায় নেই। তবু প্রাণী বিষয়ক ভয়ংকর প্রবন্ধ রজতবাবুকে ভারাক্রান্ত করল। তিনি বারান্দা থেকে উঠে রান্নাঘরের সামনে এলেন।

‘আর এক কাপ চা হবে?’

‘হ্যাঁ, হবে। তুমি ঘরে গিয়ে বসো। পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ বিমলাদেবী মুখ না ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন।

একমাস আগে হলে উত্তর অন্যরকম হত। কর্মক্ষেত্রের প্রোমোশন মানুষকে সংসারেও প্রোমোশন দেয়। আজকাল স্বামী দিনে দশ কাপ চা চাইলেও বিমলাদেবী আপত্তি করেন না।

রান্নাঘরে বিমলাদেবীর সঙ্গে রয়েছে রতনের মা। বিমলাদেবী বসে আছেন মোড়ায়। রতনের মা মেঝেতে উবু হয়ে। তবে তার বসার মধ্যে একটা অস্বস্তি ভাব। চট করে সেটা ধরা যাবে না। তার কোঁচড়ে খানপাঁচেক পাউরুটি লুকানো। ঠোঙায় চালান করার আগেই গিন্নি ঢুকে পড়ায় সেগুলো কোঁচড়ে রাখতে হয়েছে। তবে পাউরুটি নিয়ে রতনের মায়ের সমস্যা নয়। আপাতত সমস্যা একটা শিশি নিয়ে। ছোট শিশি। তার মধ্যে আছে সর্ষের তেল। সেট রাখা হয়েছে আঁচল চাপা দিয়ে।

বিমলাদেবীর হাতে একটা খাতা। এই খাতা খুলে তিনি পড়ছেন। রতনের মা মন দিয়ে শুনছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে বয়স্কশিক্ষার কোনও শিবির।

রজতবাবু রান্নাঘর থেকে সরে গেলেন। বিমলা কি সত্যিই কোনও সোশ্যাল সার্ভিস খুলে বসল? হতেও পারে, বড় এ পদের কর্তাদের স্ত্রীরা নাকি এরকম করে। কিন্তু এইভাবে রান্নাঘরে?

আসলে শিক্ষারই শিবির। রন্ধনশিক্ষা। সম্প্রতি বিমলাদেবী রতনের মাকে ভাল কিছু রান্না শেখানোর চেষ্টা করছেন। বাড়ি এখন আর আগের মতো নেই। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারের বাড়িতে অতিথি এলে পোনা মাছের ঝোল দেওয়া যায় না। আগে যা হবার হয়ে গেছে। নতুন কিছু খাবারদাবার নিজেকে শিখতে হবে। রান্নার মাসিকেও শেখাতে হবে।

সেই শেখানোর কাজ চলছে। তবে এখন শিক্ষার থিয়োরিটিকাল পর্যায় চলছে। থিয়োরিটিকাল শেষ হলে সবে প্র্যাকটিকাল। হাতেকলমে রান্নার পর্যায়। এখন বিমলাদেবী নানারকম রান্নার প্রণালী বলবেন, রতনের মা আগ্রহ নিয়ে শুনবে। এতে দু’জনেরই শেখা হবে।

আজও বিমলাদেবী বলছেন।

‘মন দিয়ে শোনো রতনের মা। আজকের খাবারটার নাম একটু নটঘট কিন্তু। নাট গ্রিন কোকোনাট আইসক্রিম। এই খাবার তৈরির উপকরণ হল গিয়ে তোমার, ডাবের জল দেড় কাপ। ডাবের শাঁস ৪ টেবিল চামচ। চিনি ৪ অথবা ৫ চামচ। দই ৩ টেবিল চামচ। মিষ্টি দই নয়। টক দই। লেবুর রস ১ চা-চামচ। পিপারমেন্ট এসেন্স সামান্য কয়েক ফোঁটা। বুঝলে রতনের মা?’

রতনের মা মাথা নাড়ল। বোঝা তো দূরের কথা, সে কিছুই শুনছে না। সে আঁচল দিয়ে তেলের শিশিটা মুড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। তার তাড়া আছে। নীচে রতন আসবে। এক ফাঁকে এসব তাকে সাপ্লাই করতে হবে। পাউরুটি পেলে বাড়িতে ব্রেকফাস্ট হবে। তেল গেলে রান্না বসবে। তাড়া অনেক, এই দিকেই তার মন পড়ে আছে। গরিব মানুষের এমন কিছু এক্সট্রা মন থাকে না যে তার একটা মন থাকবে এখানে, একটা থাকবে বাড়িতে। তাকে মন একদিকেই দিতে হয়। আর সেটা নিজের এবং বাড়ির লোকের খাবারের দিকে।

‘এবার তা হলে প্রণালী শোনো রতনের মা! এই যে উপকরণ নিলে, এগুলোকে প্রথমে একসঙ্গে মেশাতে হবে। এরজন্য তুমি ব্যবহার করবে মিক্সি। দেখো, হাতে মেশাতে যেয়ো না যেন।’

রতনের মা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ঠিকই।’ ভাবটা এমন যেন, বাড়িতে এই রান্নায় সে দু’-একবার মিক্সি ব্যবহার করেনি বলে তাকে যথেষ্ট ঠকতে হয়েছে। সে আর ঠকতে চায় না।

‘তারপর তোমাকে সবটা রেখে দিতে হবে ফ্রিজে। ভালমতো ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশন করতে হবে।’

রতনের মা অবাক হয়ে বলল, ‘সেকী দিদি! রান্না হল না। তার আগেই পরিবেশন?

বিমলাদেবীর কাছে ও ব্যাপারটা খটকা লেগেছে। তিনি বললেন, ‘বড় ব্যাপার এরকমই হয়। সব রান্না যে রান্না করতে হয় তাতো নয়।’

‘দিদি, একটা কথা বলব?’

‘বলো।’

‘দাদাবাবু তোমার তৈরি টিফিন এক দিনও কিন্তু খাচ্ছেন না। রোজই টিফিনবাক্স ফেরত আসছে।’

বিমলাদেবী গম্ভীর হয়ে গেলেন, ‘রতনের মা, তোমার দাদাবাবু স্কুলে পড়ে না। গতমাসে তার একটা প্রোমোশন হয়েছে। তোমার দাদাবাবু যেটা নিয়ে যান সেটা টিফিন নয়। লাঞ্চ। আর বাক্সটাও টিফিন বাক্স নয়, লাঞ্চ বক্স। যেটা জানবে না সেটা জেনে নিয়ে বলবে। এতে লজ্জা নেই। কিন্তু ভুল বলায় লজ্জা আছে। তুমি চা বানাও।’

ঘটনা বড় নয়। কিন্তু গুরুতর। গতমাসে টেলিফোনে প্রোমোশনের খবর শুনেই বিমলাদেবী নিউমার্কেট গিয়েছিলেন কেনাকাটা করতে। দুটো টাই আর একটা লাঞ্চ বক্স কেনেন।

লাঞ্চ বক্স এ-দেশের নয়, মেড ইন চায়না। গোল থ্যাবড়া সেই বাক্সের ওপর সবুজ রঙের ড্রাগনের ছবি। লাল জিভ বের করে আছে। খাবার বাক্সে জিভ বের করা ড্রাগনের ছবি মানায় না। হ্যাংলার মতো লাগে। রজতবাবু যখন এই বাক্স খোলেন তখন ঢাকনা উলটো করে রাখেন। সকাল থেকেই এটা নিয়ে বিমলাদেবী খুব একটা হট্টগোল বাধিয়ে দেন। ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করেন। বাড়িতে রান্নার জন্য আলাদা লোক আছে। কিন্তু স্বামীর লাঞ্চ বক্সের দায়িত্ব তাঁর নিজের। অন্যকে নাক গলাতে দেন না। বলেন, ‘বুঝলে রতনের মা, লাঞ্চ বক্স হল একটা আলাদা ব্যাপার। এ কি তোমার পোনা মাছের ঝোল না মুসুরির ডাল? বাবু কি তোমার আগের মতো আর আছেন? কত বড় প্রোমোশন হয়েছে। আমি বইতে পড়েছি, বিলেত আমেরিকায় লাঞ্চ বক্স খুললে বোঝা যায় অফিসার কত বড়। এই বাক্সে খাবার দিতে হয় অনেক মেপে জুগে, প্রেস্টিজ বুঝে।’ বিমলাদেবীর মাপজোপ একই রকমের থাকে। প্রতিদিনই রজতবাবু ড্রাগনের মুখ সরিয়ে দেখেন, ভেতরে স্যান্ডুইচ জাতীয় একটা ব্যাপার। সেই স্যান্ডুইচ মুখে তোলা যায় না। পাউরুটি কাঁচা থাকে। শশা শক্ত। এক কামড় খেলে বিকেলের দিকে ঢেঁকুর দেয়।

বিমলাদেবী এইসময় একটি বইও কিনেছিলেন। নাম, ‘হাউ টু বি আ বিগ অফিসার: ওয়ান হান্ড্রেড আনটোল্ড সাজেশনস।’ বড় অফিসার হবার জন্য একশোটি অকথিত পরামর্শ। বইয়ের মলাটে মোটা একটা লোক হাত-পা ছড়িয়ে ফাইলের ওপর শুয়ে আছে। টাই এলোমেলো, একপাটি জুতো খুলে পড়েছে। পাশে মিনি স্কার্ট পরিহিতা এক মহিলা দাঁড়িয়ে। সম্ভবত তিনি ডিকটেশন নিচ্ছেন। বইয়ের এক জায়গায় বলা হয়েছে, অফিসে যোগ্য বস হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হলে লাঞ্চ টাইমে অবশ্যই কাজের অভ্যেস ত্যাগ করতে হবে। শত কাজ থাকলেও নয়। লাঞ্চে টিফিনে কাজ করবে কেরানিরা। বসেরা নয়। এই সময়গুলোতে একটা ভানের মধ্যে থাকতে হবে। এই ভান হবে বিশ্রামের চেয়ারে হেলান দেওয়া থাকবে মাথা। খুব ভাল হয় যদি পা-টা একটু নাড়ানো যায়।

অফিসে পা নাড়াতে না পারলেও এখন রজতবাবু খাটে আধশোয়া অবস্থায় পা নাড়াচ্ছেন।

বিমলাদেবী চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, ‘একটা কথা বলব?’

‘অবশ্যই বলবে।’

‘তোমার প্রোমোশন কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়?’

‘মনে হয়, যায় না। প্রোমোশন তো আর উপাধি নয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন নাইট উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।’

‘আসলে আমার মনে হয়, তুমি এত বড় পদের যোগ্য নও।’

‘কেন?’

‘কারণ তুমি এখনও উঁচুপদের লোকদের মতো চলতে শেখোনি। তুমি নাকি স্যান্ডুইচ খাও না? ফিরিয়ে আনো? ঠিক আছে, সোমবার থেকে তোমাকে অ্যালমুনিয়ামের বাক্সে রুটি আলুরদম দিয়ে দেব।’

রজতবাবু কথা ঘোরালেন। বললেন, ‘মেয়ে কি উঠেছে?’

‘জানি না। তোমার আদিখ্যেতার মেয়ের খবর তুমি জানো।’

‘তোমার আদিখ্যেতার নয়?’

‘না নয়। ইদানীং ওনার নাকি নাম নিয়ে কী সমস্যা হয়েছে। শুনেছ সেকথা? দ্যাখো এই ধেড়ে বয়েসে যদি মেয়ের আবদারে তার নাম বদলাতে পারো।’

রজতবাবু অবাক হলেন। নাম নিয়ে সমস্যা!

হেমন্ত মাসে জন্মালে নাম হওয়ার কথা হৈমন্তী। কিন্তু হেমন্ত মাসে জন্মিয়েও বৈশাখীর নাম হৈমন্তী হয়নি। হয়েছে বৈশাখী।

বৈশাখী এ ব্যাপারে তার মাকে জিজ্ঞেস করেছে। বিমলাদেবী বলেছেন, ‘তোর বাবার ইচ্ছে ছিল মেয়ে হলে নাম দেবে বৈশাখী। তুই হবার পর আর তাই মাসটা দেখা হয়নি। তোর বাবার ইচ্ছেটাই দেখা হয়েছে।’

‘ছেলে হলে কী হত? বাবা কি কোনও নাম ঠিক করেছিল?’

‘না। তার বাবার বিশ্বাস ছিল মেয়েই হবে। মেয়েই হয়েছে। কেন তোর কি বৈশাখী নামে কোনও অসুবিধে হচ্ছে? এতদিন তো হয়নি। কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল, এখন আবার নাম নিয়ে অসুবিধে কীসের?’

‘হ্যাঁ, অসুবিধে হয়েছে।’

‘কী অসুবিধে শুনতে পারি?’

‘না, পারো না মা। অসুবিধেটা গোপন আর ব্যক্তিগত।’

বিমলাদেবী বিরক্ত হলেন। বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। একুশ বছরের কোনও তরুণী যদি তার মাকে বলে, অসুবিধে গোপন এবং ব্যক্তিগত, তা হলে বিরক্ত হবারই কথা। বাবার আশকারায় মেয়েটা এমন হয়েছে।

‘এমন কী গোপনীয় যে আমাকে বলা যায় না? তোদের রকমসকম বুঝি না বাবা।’

‘বুঝতে পারবে না।’

এতদিন হয়নি, কিন্তু এখন নিজের নাম নিয়ে বৈশাখী সত্যি একটা ছোট অসুবিধেতে পড়েছে। তবে সেই অসুবিধে কাটিয়ে ওঠা গেছে। যদিও যে-পথে কাটানো গেছে, সে-পথ বৈশাখীর খুব একটা পছন্দ হয়নি, মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁতে ভাব রয়েছে।

কম্পিউটারে ইমেল খুলতে গেলে ‘পাসওয়ার্ড’ লাগে।

‘পাসওয়ার্ড’ কাউকে বলা যায় না। খুব প্রিয় মানুষকেও নয়। বলা যায় শুধু কম্পিউটারকে। ব্যক্তিগত এবং গোপন এই ‘পাসওয়ার্ড’কে হতে হবে ছ’অক্ষরের। বৈশাখী ভেবেছিল, সে তার নিজের নামটাকেই ব্যবহার করবে। করা যায়নি। ইংরেজি বানানে বড় হয়ে যাচ্ছে। তখন ভাবল, তা হলে সেই পাসওয়ার্ড হবে ‘হৈমন্তী’ বা ‘হেমন্ত’। সেক্ষেত্রেও তার সঙ্গে একটা মিল থাকছে। জন্মমাসের। কিন্তু সেখানেও সমস্যা। এ বা আই শব্দদুটো অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত দিতে হয়েছে ‘বর্ষা’। এটা তার কেমন কেমন লাগছে। হেমন্ত মাসে জন্মানো বৈশাখী নামের একটি মেয়ের কম্পিউটার কোড হচ্ছে ‘বর্ষা’। খুঁতখুঁত করার মতো বিষয়।

বৈশাখী ঘরে এসে কম্পিউটার খুলল। অন করল ইন্টারনেট। ‘বর্ষা’ লেখার পর নীল দাগের ওপর ফুটে উঠল ‘নিউ মেল ফর ইউ’। অর্থাৎ তোমার জন্য নতুন চিঠি এসেছে।

সত্যি এসেছে। বৈশাখী চিঠি খুলল। আজও সেই এক লাইন। উচ্চারণ মিলিয়ে ইংরেজি অক্ষরে লেখা। বৈশাখী পড়ল— ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে।’

গত সপ্তাহ ধরে এই কাণ্ড চলছে। কম্পিউটারের জটিলতম পথ হয়ে এরকম একটি মাত্র লাইন আসছে।

গতকাল যেমন এসেছিল—‘হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি’। তার আগের দিন এসেছিল— ‘আমার এ গান শুনবে যদি তুমি’। দু’দিন পাওয়া গেছে— ‘এসেছিলে তবু আসো নাই’ এবং ‘রাঙিয়ে দিও যাও গো এবার’।

বাংলা কথা ইংরেজি অক্ষরে লেখা বলে একটু কষ্ট করে পড়তে হয়। উচ্চারণ মেলাতে খানিকটা সময় লাগে।

বৈশাখী চিন্তার মধ্যে পড়েছে। এটা কি কোনও প্রেমপত্র? প্রেমপত্র কি এক লাইনের হয়? যদি হয় তা হলে কে পাঠাচ্ছে? যেখান থেকে আসছে তার ইমেল নম্বর থাকছে। কিন্তু সেটা থেকে জায়গা ধরে ফেলার মতো কম্পিউটার-বিদ্যা বৈশাখীর এখনও হয়নি। কাউকে জিজ্ঞেস করলে সমস্যা মিটে যাবে। সবথেকে ভাল হত এ ব্যাপারে যদি সুনন্দর সঙ্গে কথা বলা যেত। সুনন্দ বুদ্ধিমান ছেলে। শুধু বুদ্ধিমান নয়। খুবই বুদ্ধিমান! ডাক্তারির ফাইনাল পরীক্ষায় সে চমৎকার ফল করেছে। এখন মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন। এ ধরনের সমস্যার সে সহজেই সমাধান করে দেবে।

কিন্তু তাকে কিছু বলা যাবে না। আসল প্রেমিককে কম্পিউটার-প্রেমিকের কথা বলা যায় না। কম্পিউটারের হিংসে নেই কিন্তু প্রেমিকের হিংসে আছে।

আজ চিন্তার সঙ্গে তার একটু মন খারাপ লাগছে। বৈশাখী কম্পিউটার বন্ধ করে চুপ করে বসে রইল। গত সাতদিন তার শুধু লোকটা কে— এই কথাটাই মাথায় এসেছে। কী লিখেছে সেটা মনে থাকেনি। আজ লেখাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে’। এর মানে কী?

বৈশাখীকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। একুশ বছরের এক তরুণীর মন খারাপ করে দেওয়ার পক্ষে এই লাইন যথেষ্ট।

বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বৈশাখী হাসল। কাজের চাপে বাবার শরীরটা একটু খারাপ হয়ে গেছে? তাই হবে। মানুষটা ভাল, কিন্তু বিচ্ছিরি রকমের কেরিয়ার-পাগল হয়ে পড়েছে। বুড়ো বয়সে আবার প্রোমোশন টোমোশন পেয়ে একেবারে ন্যাতাজোবরা তাবস্থা।

‘বাবা এসো।’

রজতবাবু চেয়ার টেনে বসলেন। মেয়েটা ঘরটাকে ছিমছাম করে রেখেছে। সবুজ বিছানার চাদর। সবুজ পরদা। টেবিলের ওপর একটা সবুজ টেবিলক্লথ।

‘ভাল আছিস বৈশাখী? তোর সঙ্গে কতদিন ভাল করে গল্প করা হয় না।’

বৈশাখী মিথ্যে রাগের ভঙ্গি করে বলল, ‘হবে কী করে বললা? তুমি অফিস নিয়ে যা করছ। তুমি একা নও মা-ও করছে। সেদিন দেখি রান্নাঘরে রতনের মা’র সঙ্গে পর্যন্ত ইংরেজিতে কথা বলছে! সবকিছুর একটা লিমিট আছে।’

রজতবাবু শব্দ করে হেসে উঠলেন।

‘কেন, আমার উন্নতিতে তুই খুশি হসনি?’

‘না, হইনি।’

‘আমিও হইনি। কিন্তু কী করব বল? এটা একটা গোলকধাঁধা। ঢোকা শক্ত, কিন্তু বের হওয়া আরও বেশি শক্ত। তুই বড় হ, তুইও বুঝবি। তোর বর যখন তার কাজে উন্নতি করবে, তুইও তোর মায়ের মতো ফরফর করে ইংরেজিতে কথা বলবি।’

‘আমি এখনই ফরফর করে ইংরেজি বলতে পারি।’

রজতবাবু অন্য প্রসঙ্গে গেলেন।

‘হ্যাঁরে, তোর মা বলছিল, তোর নাকি নাম নিয়ে কী একটা সমস্যা হয়েছে? তুই মাকে বলেছিস? সত্যি?’

‘আমার হয়নি বাবা। কম্পিউটারের হয়েছে।’

মেয়েটার হয়েছে কী? মাথাটাথা গেল নাকি? না, কম্পিউটার কিনে দিয়ে ভাল হয়নি মনে হচ্ছে।

‘ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটু বিস্তারিত শুনতে পারি কি?’

‘না, পারো না। কারণ এটা একটা গোপন ব্যাপার। তবে তোমার চিন্তা নেই। সমস্যাটা আপাতত সলভ হয়েছে।’

‘হলেই ভাল।’ রজতবাবু উঠলেন। তবে চিন্তা নিয়েই উঠলেন। উঠতে উঠতে। রজতবাবু বললেন, ‘সুনন্দ ভাল আছে? ওর সঙ্গে বহুদিন দেখা হয় না।’

‘দেখা হবে কী করে। ও আজকাল খুব কম আসে। আর এলেও সকালের দিকে আসে। তুমি তখন থাকে না।’

‘ঠিক আছে ছুটির দিন দেখে ডিনারে ডাকো একদিন। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করা যাবে। কথাও হবে।’

‘হাসপাতালে ছুটির দিন নেই। তবে আজ হয়তো আসবে। রোববার ডিউটি হালকা থাকে।’

রজতবাবু খুশি হলেন, ‘ভেরি গুড। এই বয়সে ছুটি আবার কী? তা ছাড়া ডাক্তারদের ছুটি ভাল কথা নয়। তাদের একটা সোশ্যাল রেসপনসিবলিটি থাকে।’

বৈশাখী বলল, ‘তবে তোমার কিন্তু ছুটি থাকা উচিত। তুমি বাড়াবাড়ি করছ বাবা। একদিন হুট করে বিছানায় পড়বে, তখন তুমি আর মা দু’জনেই ভাল করে টের পাবে।’

রজতবাবু হাসলেন। বললেন, ‘না রে এখন পড়লে চলবে না। খেলতে নেমে আহত হওয়া প্লেয়ারের জন্য কারও সহানুভুতি থাকে না। যাক আমার কথা ছাড়। তোর মা বলছিল, তুই নাকি সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকিস? এটা কিন্তু ঠিক নয়। ঘরদোরের কাজকর্ম তো কিছু শিখতে হবে।’

‘তুমি তো শিখলে না। মাকে এবার বসাব ভাবছি। ঘরদোরের কাজ শেখার জন্য কম্পিউটারের মতো ভাল জিনিস আর হয় না। কত যে ওয়েবসাইট এখন হয়েছে, তুমি ভাবতেও পারবে না। এই ধরো রান্না। রান্নার লেটেস্ট সাইট হল, ‘আম্মাস ডট কম।’

‘ওরে বাবা সেটা আবার কী জিনিস?’

‘উফ! বাবা, তুমি দেখছি একেবারে ব্যাকডেটেড! দক্ষিণ ভারতীয় রান্না শেখানোয় এই সাইট এখন এক্সসেলেন্ট। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড পপুলারিটি। গ্রামের একজন মহিলাকে দিয়ে রান্না শেখানো হয়।’

‘একদিন দেখাস তো।’

‘আজই সন্ধেবেলা হতে পারে। আজ তো রবিবার। মাকে ডেকে নেব।’

‘কম্পিউটার দেখে রান্না শিখতে কি তোর মা রাজি হবে? মনে হয় না হবে।’

বৈশাখী হাসল। বলল, ‘রাজি না হলে ক্ষতি নেই। তা হলে মাকে দেখাব, আশ্রম অনলাইন ডট কম।’

‘সেটা আবার কী?’ রজতবাবু ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করলেন।

বৈশাখী বলল, ‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এই ওয়েব সাইট হল ধম্মকম্মের ওয়েব সাইট। মা দেশের সব বড় বড় মন্দির দেখবে। সেখানকার দেবদেবীর ছবি দেখতে পাবে। অডিওতে ভেসে আসবে মন্ত্র, সন্ধ্যারতির ঘণ্টা। মা চাইলে অন লাইনেই প্রসাদ পাঠিয়ে দিতে পারবে। আর কী চাও?’

‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তোর কম্পিউটারে এতসব আছে?’

কখন যে বিমলাদেবী পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন বাবা মেয়ে দু’জনের কেউই বুঝতে পারেনি। তিনি কথা বলতে দু’জনেই চমকে উঠল।

‘কাজ হাতেকলমে শিখতে হবে না? বিয়ে থা হলে সবই শিখতে হবে— রান্না পুজো সবই। কম্পিউটারটা কি শাশুড়ির হাতে ধরিয়ে দিবি?’

বৈশাখী উঠে মায়ের হাত ধরল। হাসতে হাসতে বলল, ‘ও তুমিও শুনেছ তো। ভালই হল। আজ সন্ধে থেকেই তোমার লেসন শুরু। আফটার ওয়ান উইক ইউ ফল ইন লাভ উইথ দ্য কম্পিউটার। বাবার দিকে আর ফিরেও তাকাবে না। স্বামী তোমার যত বড় অফিসারই হোক না কেন। ৰাবা তখন দেখবে সুড়সুড় করে তোমার পাশে এসে বসেছে। গুনগুন করে গাইছে, চিনিতে পারিনি বঁধু তোমার এই আঙিনা। তাই দেরি হল যে দেরি হল যে তোমার কাছে আসিতে।’

‘ঠাট্টা করিস না বৈশাখী। চড় খাবি। তোর বিয়ে থা’র আর বেশি দেরি নেই। সুনন্দ আর একটু দাঁড়ালেই ওদের বাড়ির সঙ্গে কথা বলব। ওদের ইন্টার্নশিপ আর কত বছরের’?

বৈশাখী মুখ নামিয়ে বলল, ‘আজ হয়তো ও আসবে, একেই জিজ্ঞেস কোরো না।’

বৈশাখীর মন খারাপ ভাবটা অনেক কমে গেছে। বাবার সঙ্গে কথা বললে এরকম একটা আশ্চর্য ঘটনা হয়। মনটা ভাল হয়। ছোটবেলার একটা ঘটনা আজও বৈশাখীর খুব মনে পড়ে। একদিন সে খুব কেঁদেছে। কেঁদে কেঁদে একেবারে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। বাবা অফিস থেকে ফিরে বলল, ‘তুমি নাকি আজ কাঁদছিলে? তোমার মা বলল।’

‘হ্যাঁ, কেঁদেছি। কেন কেঁদেছি তুমি কি জানতে চাও বাবা?’

‘না, জানতে চাই না।’

‘জানলে তোমারও কান্না পাবে।’

‘ওরে বাবা তা হলে জানতে হবেই। কারণটা বলে ফেল তো মা’

‘আমার সবথেকে আদরের পুতুলটার নাকটা ভেঙে গেছে।’

বাবা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘খুবই দুঃখের ব্যাপার। পুতুলের নাক ভাঙা কান্নাকাটি করার মতোই জিনিস। ইস আমারও কাঁদা উচিত ছিল। তোমার মা কি কেঁদেছে?’

বৈশাখী বলল, ‘না মা কাঁদেনি, আমাকে বকেছে।’

রজতবাবু মেয়েকে হাসতে হাসতে আদর করলেন। চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। কোলে তুলে কপালে চুমু খেলেন। বললেন, ‘এরপর থেকে তুমি এরকম দুঃখের কিছু ঘটলেই আমাকে জানাবে। আমিও তোমার সঙ্গে কাঁদব।

এরপর বহুবারই তাঁকে মেয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে মিথ্যে কান্না কাঁদতে হয়েছে৷ বড়রা মিথ্যে কান্না কাঁদলে ছোটদের অসুবিধে হয়। তাদের চোখে জল আসে না। তার বদলে মুখে হাসি এসে যায়। বৈশাখীরও তাই হয়েছে। মাঝপথেই তাকে বহুবার হাসতে হাসতে কান্না থামাতে হয়েছে।

এখনও মন থেকে ভারটা দূর হয়ে গেল। তবে চিঠির লাইনটা এখনও যায়নি, ‘কোন ভাঙনের পথে এলে।’ কে এল?

মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে বিমলাদেবী স্বামীকে খবর দিলেন, নীচে একটা লোক এসেছে। স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।

একতলার বসার ঘরে অনেকগুলো সোফা। তবু লোকটা বসেনি, দাঁড়িয়ে আছে জড়োসড়ো হয়ে।

পোশাক খুবই নিম্নমানের। নীল রঙের জামার হাতায় ঘাম মুছে একটা সাদা ভাব এনে ফেলেছে। কলারের ভেতর দিকে সাদা কাপড়ের পটি। সেলাইয়ের সময় ভাবা হয়েছিল, পটিটা বুঝি বাইরে থেকে দেখা যাবে না। তা হয়নি। দেখা যাচ্ছে। প্যান্ট বাদামি আর খয়েরি মেশানো। এ হল না-কাচা রং। এই রঙের প্যান্ট না কেচেও অনেকদিন পরা যায়। যাদের জামা প্যান্ট সংখ্যায় কম থাকে তারা এই ধরনের না-কাচা রঙের পোশাক পরে। সাধারণত এদের প্যান্ট ঝুলের দিকে ছোট হয়। এর ঝুলের দিকে বড় হয়েছে। সম্ভবত তা হয়েছে বেল্টের অভাবে। মনে হচ্ছে কোমরের কাছটা ঢলঢল করছে। নইলে ঘনঘন প্যান্ট টেনে তুলছে কেন? মুখে না-কাটা হালকা দাড়ি।

রজতবাবু পায়ের দিকে তাকালেন। মানুষকে ভাল করে বুঝতে হলে তার জুতো দেখতে হয়। পোশাক দিয়ে মানুষ তার অবস্থা লুকোতে পারে। দরিদ্র মানুষ ধার করা দামি জামা পড়ে বড়লোক সাজার চেষ্টা করে। বড়লোক ইচ্ছে করে পুরনো তাপ্পি মারা প্যান্ট পরে করুশা পেতে চায়। জুতোর ক্ষেত্রে এ জিনিস করা যায় না। ধরা পড়ে যায়।

এই লোকটার পা খালি। সম্ভবত জুতো বাইরে খুলে ঢুকেছে।

লোকটার আর একটা বিশেষত্ব রজতবাবুর চোখে পড়ল। এর হাতে একটা ছোট বাক্স। খুবই ছোট। বড় জিনিস যেমন চট করে চোখে পড়ে, তেমনি ছোট জিনিস চোখে পড়ে। সমস্যা হয় মাঝারিতে। মাঝারিদের চোখ টানার কোনও ক্ষমতা নেই।

একটু কাছে গিয়ে রজতবাবু বুঝতে পারলেন বাক্সটা মিষ্টির। তিনি বহুদিন এত ছোট মিষ্টির বাক্স দেখেননি। তবে তিনি খুশি হলেন। হাতে করে কিছু নিয়ে আসা ভাল লক্ষণ। একটা বশ্যতা ধরনের ব্যাপার থাকে। সেটা ছোট না বড় সেটা আসল নয়।

রজতবাবু লোকটাকে বসতে বললেন না।

‘কী হল ভাই, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না? কোথা থেকে এসেছেন? কেউ পাঠিয়েছে?’

লোকটি এবার কথা বলল, গলার স্বর খুবই মিনমিনে। যেন এখানে এসে পড়ে খুবই অন্যায় করেছে।

‘না স্যার, কেউ পাঠায়নি। আমি নিজেই এসেছি।’

‘আহা, জোরে কথা বলুন। ফিসফিস করছেন কেন? কোথা থেকে এসেছেন?’ একটু ধমকের সুরেই রজতবাবু বললেন। ধমকে কোনও কাজ হল না। ধমক শুনে লোকটার গলা আরও নেমে গেল।

‘স্যার, আমি লিলুয়া থেকে আসছি।’

রজতবাবু এবার বেশ বিরক্ত হলেন। গরিবদের এই দোষ। কিছুতেই সাহায্যের কথা সরাসরি বলতে পারে না। অনেক ধানাই-পানাই করে। দশবার ভাবে সাহায্যের কথা বলব কি? না থাক, পরে আর একদিন বলব। বড়লোকদের এই দোষ থাকে না। বোঝাই যাচ্ছে লোকটা চাকরি বা অর্থ সাহায্য চাইতে এসেছে। এখন আর বলতে পারছে না। ইদানীং তাঁর কাছে এই দু’ধরনের লোকই বেশি আসে। কে আসে বড় কথা নয়, বড় কথা হল, কার কাছ থেকে আসে। রেফারেল বুঝে কথা শুনতে হয়। তারপর বলতে হয়, ‘আচ্ছা পরে দেখব। খবর পাঠাব।’ এই উজবুকটা কার কাছ থেকে এল? বিরক্তিতে রজতবাবু সম্বোধন বদলালেন।

‘চটপট বলো কী চাই। আমাকে এখুনি বেরোতে হবে।’

‘স্যার, আপনার জন্য একটু মিষ্টি এনেছিলাম।’

‘ঠিক আছে। এসব আবার কেন? টেবিলের ওপর রাখো।’ রজতবাবু কপট রাগের ভান দেখালেন।

‘স্যার বেশি কিছু নয়, ক’টা শোনপাপড়ি। ট্রেনের কামরায় ফেরি করছিল।’

রজতবাবু দারুণ অবাক হলেন। ট্রেন থেকে শোনপাপড়ি কিনে কেউ যে তাঁর বাড়িতে আসতে পারে তা ভাবতেও পারছেন না।

চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘তুমি কি শোনপাপড়ি দিতে এতদূর এলে?’

‘না স্যার। ঠিক শোনপাপড়ি দিতে আসিনি। ভেবেছিলাম অন্য কিছু কিনব। পরিবার বলল, অত বড় মানুষটার কাছে যাচ্ছ, খালি হাতে যেয়ো না। কিছু একটা নিয়ে যেয়ো। শোনপাপড়ি স্যার হঠাৎ ট্রেনে পেয়ে গেলাম। ফেরিওয়ালাটাকে দেখে খারাপ লাগল। একটা প্যাকেটও বিক্রি হচ্ছে না।’

মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে রজতবাবু বললেন, ‘কেন? বিক্রি হচ্ছিল না কেন? দাম খুব বেশি চাইছিল বুঝি?’

ছেলেটা থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘না স্যার। দাম বেশি নয়। দাম কমই। তবে স্যার প্যাকেটে খুব মাছি বসছিল।’

রজতবাবুর রাগ বিস্ময়ের দিকে মোড় নিচ্ছে। নেবারই কথা। প্রথমত শোনপাপড়ি ট্রেনের, তার ওপর মাছি খাওয়া। লোকটা কি পাগল? তিনি খুব নরম গলায় বললেন, ‘ভাই, তোমার মাথায় কি গোলমাল আছে? তুমি কি পাগল?’

‘না স্যার।’

‘তা হলে কতগুলি মাছি নিয়ে এই সাতসকালে তুমি আমাকে বিরক্ত করতে এসেছ কেন? তোমার কি মনে হয় সকালের চায়ের সঙ্গে আমি মাছি খাই?’

লোকটা ভয়ে এবার দু’পা পিছিয়ে গেল।

‘ভুল হয়ে গেছে স্যার। আমি বরং এটা নিয়ে যাই।’

সে এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর থেকে বাক্সটা তুলে নিতে যায়। রজতবাবু নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত করলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে ওটা থাক। তুমি কী জন্য এসেছ?’

আপনাকে একটা প্রণাম করতে এসেছিলাম। অনেকদিন আপনার আন্ডারে কাজ করেছি স্যার। সেই অর্থে আপনি হলেন অন্নদাতা। পরিবার বলল, যাও প্রণাম করে এসো। ছেলেমেয়ে নিয়ে তো ওঁর জন্যই বেঁচে ছিলাম। আমার পরিবার স্যার বেশিরভাগ সময় ভুল কথা বলে। কিন্তু ভেবে দেখলাম এই কথাটা ঠিক বলেছে। তাই চলে এলাম।’

রজতবাবু এক মিনিট থমকালেন। লোকটা কী বলছে, আন্ডারে কাজ করত মানে? লোকটা কে? ঘাড়ের কাছে একটা চিনচিনে ভাব হচ্ছে না? তিনি সম্বোধন বদলালেন। শান্ত গলায় বললেন, ‘আপনাকে তো চিনতে পারছি না।’

‘স্যারে’র শান্ত গলা শুনে লোকটা যেন খানিকটা স্বস্তি পেল। বলল, ‘আমাকে আপনার চিনতে পারার কথা নয় স্যার। একেবারে সামান্য পোস্টে কাজ করতাম। অতদিন কাজ করলাম পারচেজে, অথচ দেখুন সেখানেই অনেকে আমাকে চিনত না। আপনি কীভাবে চিনবেন স্যার? আপনি ছিলেন আমাদের সবার ওপরে। ছোটখাটো। সব লোককে চিনতে হলে তো হয়েছে?’

পা যেন টলে উঠল! রজতবাবু অসম্ভব রকমের একটা ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি টেবিলের একটা দিক চেপে ধরলেন। স্বাভাবিক থাকতে হবে। খুব স্বাভাবিক। লোকটা যেন ভয়টা বুঝতে না পারে। ও কি রিভলবার জাতীয় কিছু বের করবে? ছোরা? এ ধরনের লোকেরা কী দিয়ে মারে? চিৎকার করবেন? চিৎকার করলে দোতলা থেকে বিমলা বৈশাখীরা যদি শুনতে না পায়? সেই সুযোগে লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। পারে না, পড়বেই। যাকে তিনি কাল চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন সে ঝাঁপিয়ে পড়বে না তো কি পা চেপে ধরবে। সময় নিতে হবে। সময় পেলে পরিস্থিতি বদলে ফেলা যায়।

তিনি ফিসফিস করে বললন, ‘মাধববাবু, আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন কেন?’

‘স্যার, বাড়িতে আসতাম না। অফিসেই যেতাম। কিন্তু সেখানে ঢোকা আমার বারণ।’

‘আপনি কী চান?’

‘আমি কিছু চাই না স্যার।’

‘তা হলে এলেন কেন?’

লোকটা একগাল হেসে বলল, ‘এই যে বললাম স্যার, প্রণাম করতে। পরিবারও আসতে চাইছিল। বলল, মানুষটাকে দেখে আসি। একদিনও তো দেখালে না। আর সুযোগ হবে কিনা ঠিক নেই। ওকে নিয়েই আসতাম স্যার। ভেবেছিলাম, একবার নিয়েই আসি। হল কী স্যার ল্যান্ডাভ্যান্ডাগুলোও আসতে চাইল। অতগুলোকে নিয়ে কলকাতায় আসার খরচ তো কম নয়। অনেক টাকার ব্যাপার। এখন তো বুঝে শুনে চলতে হবে। পরিবারকে বললাম, থাক দরকার নেই। আমি প্রণাম জানালেই হবে।’

লোকটাকে ঘাবড়ে দিতে হবে। তার মধ্যে নিশ্চয় নীচে কেউ এসে পড়বে।

রজতবাবু দুম করে বললেন, ‘মাধববাবু, আপনি যে চুরি করেছেন তার নির্দিষ্ট প্রমাণ কোম্পানির কাছে আছে।’

মাধব এই কথায় গুরুত্ব দিল না। বলল, ‘স্যার, একটু জল হবে?’

‘ঠিক আছে আপনি বসুন। আমি জলের জন্য বলে আসছি। চা খাবেন? বসুন আপনার সঙ্গে কথা আছে।’

এটাই সুযোগ। জল আনার নাম করে দোতলায় গিয়ে পুলিশকে ফোন করতে হবে। এটা কোন থানা? গড়িয়াহাট না বালিগঞ্জ? মনে হচ্ছে গড়িয়াহাট। গড়িয়াহাট থানার ফোন নম্বর কত? ফোন করে পুলিশকে কী বলতে হবে? একজন বাড়িতে ঢুকে পড়েছে? ঠিক কী বললে পুলিশ আসে। মনে হচ্ছে মাথাটা টলমল করছে। ঘাড়ের চিনচিনে ব্যথাটা হাত বেয়ে নেমে আসছে না?

‘স্যার, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? আপনাকে কি পরব? বসুন না। বসুন। ফ্যানের সুইচটা কোন দিকে স্যার? বউকে ডাকব? এই যে শুনছেন, কে আছেন শুনছেন—’

কেউ আসার আগেই রজত চৌধুরী, ওয়ার্কস এন্ড ওয়ার্কসের সদ্য পদোন্নতি হওয়া ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, জ্ঞান হারিয়ে এক নোংরা পোশাকের হতদরিদ্র মানুষের কোলে তুলে পড়লেন।

অন্ধকার কেটে আলোর বিন্দু। ধীরে ধীরে আলোর বিন্দুগুলো যোগ হয়ে মেয়ের মুখ। মেয়ের মুখ স্পষ্ট হল। বৈশাখী জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন লাগছে বাবা?’

দোতলায় নিজের ঘরে শুয়ে আছেন রজতবাবু। ফ্যান চলছে। একটা নয়, দুটো ফ্যান চলছে। তাও বিমলাদেবী একটা হাতপাখা নিয়ে মাথায় হাওয়া করছেন।

‘কেমন লাগছে? কেমন আছ?’

রজতবাবু ফিসফিস করে বললেন, ‘ভাল, ভাল আছি। চিন্তা কোরো না। একটু জল দাও।’

‘তুমি শুয়ে থাকে, আমি মুখে ঢেলে দিচ্ছি।’

‘ঠিক আছে। আমি পারব।’

জলের গ্লাস পাশেই ছিল! মাথা তুলে এক চুমুক জল খেলেন রজতবাবু। বরফ শীতল জল। খেতে ভাল লাগল। আর এক ঢোক খেলেন। কী হয়েছিল? অজ্ঞান হয়ে গেলেন কেন? স্ট্রোক ধরনের কিছু? বুকে কি ব্যথা ছিল? রজতবাবু বুকে হাত দিলেন। সেরিব্রাল? হাত পা নাড়ালেন। না, ঠিক আছে। যেটাই হোক, সেন্স খুব দ্রুত ফিরে আসছে। শুধু একটা ঘোর। তবে ঘুমের ঘোর নয়। মনে হচ্ছে অনেক খাটাখাটনির পরে ঘোর।

স্ত্রী কন্যার দিকে তিনি তাকিয়ে অল্প হাসলেন। বললেন, ‘চিন্তা করিস না। আমি ঠিক আছি। আমি একটু উঠে বসব।’

‘একদম না বাবা। ডাক্তার না আসা পর্যন্ত নড়বে না।’

‘ডাক্তারকে ফোন করেছিস?’

‘করেছিলাম। বাড়ি নেই। চেষ্টা হচ্ছে, কাছাকাছি যদি কাউকে পাওয়া যায়। আমি সুনন্দকে ধরবার চেষ্টা করেছি। আউটডোরে ফোন বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না।’

রবিবার ডাক্তার পাওয়া শক্ত। তবু মাধব একজনকে আনতে পেরেছে। ডাক্তার এনে সে ঘরের বাইরে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার প্রেশার মেপে বললেন, ‘মনে হচ্ছে না হার্ট কিছু। প্রেশারটা লো। সম্ভবত গ্যাসের প্রবলেম। লো প্রেশারে গ্যাস হলে অনেক সময় এরকম হয়। ফর আ সেকেন্ড ব্ল্যাক-আউট হয়ে যায়। পড়ে যাবার সময় মাথায় লাগালে বিপদ হত। আমি হার্টে তো কিছু দেখছি না। টেনশন খুব যাচ্ছে? পরিশ্রম?’

মুখের কথা কেড়ে নিলেন বিমলাদেবী।

‘প্রচণ্ড ডাক্তারবাবু। খুব খাটছেন। সারাদিনই অফিস আর অফিস। তার ওপর গত মাসে বড় একটা প্রোমোশন হয়েছে। একসঙ্গে ভবল প্রোমোশনের মতো। খাটনিও ডবল হয়ে গেছে।’

বৈশাখী কড়া চোখে মায়ের দিকে তাকাল। এই অবস্থায় কেউ প্রোমোশনের কথা বলে?

ডাক্তার মাথা নাড়লেন, ‘না না একদম রেস্ট। ক’টাদিন সব স্টপ নো টেনশন। একটা ইসিজি করতে হবে। তারপর দরকার হলে কার্ডিওলজির কারও সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু পেশেন্টকে তো মুভ করানো যাবে না। পোর্টেবল মেশিন এনে করিয়ে নিন। যত তাড়াতাড়ি হয় তত ভাল। পারলে রিপোর্টটা একবার দেখিয়ে নিয়ে আসবেন। দুটো অবধি চেম্বারে আছি।’

পোর্টেবল ইসিজি মেশিনের খোঁজে বৈশাখী আবার সুনন্দকে ফোন করল। এবার আর অসুবিধে হল না। আউটডোরে টেলিফোন বাজার একটু পরেই মহিলা অপারেটার ধরল। ডা. সুন্দর নাম শুনে ধমকের গলায় বলল, ‘ধরুন দেখছি।’ সাত মিনিট ধরে থাকার পর ফোন কেটে গেল। বিমলাদেবী বিরক্ত হলেন। খুবই বিরক্ত। তিনি মেয়ের ঘরে গিয়ে বললেন, ‘এ কেমন কথা? এমার্জেন্সির সময় যদি ডাক্তারকে না পাওয়া যায় তো কখন পাওয়া যাবে?’

মানুষ দোযে-গুণে তৈরি হয়। বৈশাখীর দোষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সুনন্দর নিন্দে করলে সেই দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে। সুনন্দর কোনওরকম সমালোচনা সে সহ্য করতে পারে না। এটাই তার বড় দোষ। একবার তার কলেজের বন্ধু চন্দ্রলেখা বলেছিল, ‘তোর বয়ফ্রেন্ডের সব ভাল। শুধু একটা দোষ।’

বৈশাখী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী দোষ?’

‘তোর বন্ধু অসভ্য দিকে তাকায়। আমার সঙ্গে যখন কথা বলছিল তখন লক্ষ করেছি।’

‘অসভ্য দিকে মানে?’

‘অসভ্য দিকে মানে বোঝো না? ন্যাকা।’

চন্দ্রলেখার সঙ্গে সেদিনের পর আর কথা বলেনি বৈশাখী। এখনও সে মায়ের ওপর বিরক্ত হল।

‘ডাক্তার তো জানে না যে এই বাড়িতে অসুখ হয়েছে। জানলে নিশ্চয় তাকে পাওয়া যেত।’

‘সুননন্দ তো বাইরের লোক নয়। তোর বাবার এরকম অবস্থা আর সে খবর পাবে না?’

‘মা, তুমি মিথ্যে ওকে দোষ দিচ্ছ। ও এখনও বাইরের লোক। আর তা ছাড়া ও তো আর টেলিপ্যাথি জানে না যে বাবার খবর হাত গুণে জানবে। যাই হোক, ড্রাইভারকাকু কি এসেছে? তা হলে আমি গিয়ে ওকে নিয়ে আসব।’

বিমলাদেবী বললেন, ‘রবিবার তো ড্রাইভার আসে না।’

‘তা তুলে আমি নিজে ড্রাইভ করে যাই।’

বিমলাদেবী ভয় পেলেন, ‘না, না। তোর বাবা যদি এই অবস্থায় শোনে আবার কিছু একটা হয়ে যাবে।’

‘দুর, সবটাতে তোমার বাড়াবাড়ি। এখন ইসিজির কী হবে? এমনি হলে একটা কথা ছিল। গাড়িতে বসিয়ে কোনও ক্লিনিকে নিয়ে চলে যেতাম। বাড়িতে আনার কথা বলেই তো ঝামেলা হয়ে গেল।’

‘ওই লোকটাকে একবার বল না?’

‘কোন লোকটাকে? বাবার অফিসের ভদ্রলোককে?’

‘হ্যাঁ, মাধব না কী নাম। ওই তো দেখলি ঠিক ডাক্তার ধরে আনল।’

‘তা হলে তুমি একবার বলো। উনি কি এখনও আছেন?’

‘তুই নীচে গিয়ে বল। আমি বরং দাদাকে একটা ফোন করে দিই। আসতে বলি।’

‘বড়মামাকে বিরক্ত করবে কেন?’

‘এতে বিরক্তির কী আছে? ভগ্নিপতির এইসময় খবর দেবনা; কী যে বলিস। পরে শুনলে রাগ করবে। বাড়িতে একটা পুরুষমানুষ না থাকলে হয়?’

বিমলাদেবী নয়, মাধবের সঙ্গে কথা বলল বৈশাখী। মাধব একতলার ঘরের সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। হতচকিত ভাব সে কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে। বৈশাখীকে দেখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল। বিপদে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। এই বাড়িরও নেই। বাড়ির লোকেরা ডাক্তারবাবুকে ফি দিতে ভুলে গেছে। গাড়িতে ওঠার সময় তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘আমার টাকাটা?’

মাধব নিজের পকেট ঘেঁটে একশো দশ টাকা বের করে। খুচরোতে আরও সাড়ে তিন টাকার মতো ছিল। খুচরো দেওয়া যায় না। নোট হল সম্মানদক্ষিণা, কিন্তু খুচরো দিলে ডাক্তারের অপমান করা হয়।

সে একশো দশ টাকা হাতে দিয়ে বললে, “বিপদের বাড়ি ডাক্তারবাবু। বিপদের সময় মানুষের ভুল হয়ে যায়। কিছু মনে করবেন না। বাকিটা গিয়ে দিয়ে আসছি।’

ডাক্তারবাবু গাড়ির দরজা আটকে বললেন, ‘এরকম ভুল হওয়া ঠিক নয়। এই নিন দশ টাকা। আমি একশোই নিই। পেশেন্টকে সাবধানে থাকতে বলবেন।’

মরে গেলেও এই টাকা মাধৰ এদের কাছ থেকে চাইবে না। তাতে একটু অসুবিধে হবে। একটু নয়, বেশ অসুবিধেই হবে। মাসের শেষের টাকা। তা হোক। পরিবারকে বললে, সে একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেবে।

বৈশাখী অবাক হয়ে বলল, ‘একী! আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। ইস পাখাটা কেউ চালিয়ে দেয়নি। রতনের মা কোথায় গেল?’

মাধব বসল না। বলল, আমার পাখার দরকার নেই। স্যার কেমন আছেন?’

বৈশাখী পাখা চালিয়ে দিল। বলল, ‘ভাল আছেন। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। একটু পরেই মনে হয় ঘুমিয়ে পড়বেন। আমরা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আপনি ভাগ্যিস ছিলেন। নইলে ডাক্তার কে ডাকত? শুধু ডাক্তার কেন, ধরে ওপরে তুলতেই পারতাম না। তা ছাড়া আপনি বাবা পড়ে যাবার সময় ধরে ফেলেছিলেন। অনেক বড় বিপদের হাত থেকে উনি রক্ষা পেয়েছেন, ডাক্তারবাবু বলছিলেন, পড়ে গিয়ে মাথায় লাগলে ভয়ানক হত। ধন্যবাদ, আপনি অনেক করলেন।’

‘ছি ছি এরকমভাবে বলবেন না ম্যাডাম।’

‘আর একটা কাজ করে দেবেন? পোর্টেবল ইসিজি মেশিনের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ডাক্তারবাবু বললেন, যত তাড়াতাড়ি হয় তত ভাল। পারলে এবেলাই। রবিবার তো, কোথায় কী পাব বুঝতে পারছি না। গড়িয়াহাটের মোড়ের দিকে গেলে হয়তো পাওয়া যাবে। আসলে ইসিজি মেশিন তো কখনও আনিনি।’

মাধব উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনাকে চিন্তা করতে হবে না ম্যাডাম, আমি বের হচ্ছি। একটা কিছু ব্যবস্থা হবে ঠিক।’

বৈশাখীর নজর পড়ল টেবিলের ওপর। একটা মিষ্টির বাক্স।

‘এটা কে এনেছে?’

মাধব মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি ম্যাডাম। স্যারের জন্য ক’টা শোনপাপড়ি এনেছিলাম।’

‘এখানে পড়ে কেন? রতনের মা যে কী করে?’

বাক্সটা বৈশাখী তুলে নিল।

‘ম্যাডাম, ওটা ফেরত নিয়ে যাব।’

মিষ্টি এনে ফেরত নিয়ে যাবার ঘটনা বৈশাখী জীবনে এই প্রথম শুনল। মানুষটা কী বলছে!

‘ফেরত নিয়ে যাবেন? সেকী! কেন?’

মাধব উত্তর দিল না। পায়ের নখ দিয়ে মেঝেতে ঘষতে লাগল।

‘আপনি কিছু খেয়েছেন?’

‘সেকী! কত বেলা হয়ে গেল। আপনার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে?’

‘হ্যাঁ, পেয়েছে।’

বৈশাখীর মায়া হল।

রজতবাবু ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন। পরদা টানায় ঘর অন্ধকার। বিমলাদেবী মুখ শুকিয়ে মাথার কাছে বসে। বৈশাখী পা টিপে ঘরে ঢুকল। বাবার মাথায় হাত রাখল। ফিসফিস করে বলল, ‘আমি সুনন্দকে ডাকতে যাচ্ছি। আমার মনে হয়, ও এলে সব থেকে ভাল হবে। গাড়ি নিয়েই যাচ্ছি। তুমি চিন্তা কোরো না, সঙ্গে বাবার অফিসের ভদ্রলোককে নেব।’

‘সাবধানে যাস।’

‘তুমি কি মামাকে খবর দিতে পেরেছ?’

‘না। মনে হচ্ছে ওদের টেলিফোনটা খারাপ।’

বৈশাখীর কেমন জানি লাগছে। ভাল লাগছে না। একটা বড় চাকরির কাজ করা মানুষ। এত টাকা মাইনে। বাড়িতে গাড়ি, কম্পিউটার। অফিসে কত লোক ঘিরে থাকে। বাড়িতেও ফোনের পর ফোন আসছে। দিল্লি বাঙ্গালোর থেকে। বাবা সেদিনই বলছিল, ‘তোর বিয়ের সময় যে কত লোক আসবে বৈশাখী, তুই ভাবতে পারছিস না। আমরাই সেদিন দেখবি হারিয়ে যাব। সানাই থামিয়ে মাইকে ঘোষণা করতে হবে, রজতবাবু, আপনি যদি দোতলায় থাকেন তা হলে এক্ষুনি একতলায় চলে আসুন। আপনার মেয়ে আপনাকে খুঁজছে।’ অথচ আজ হঠাৎ বিপদের সময় গোটা পরিবারটা কতু একা!

অসুস্থ মানুষকে ঘুমন্ত দেখতে ভাল লাগে না। মন খারাপ হয়ে যায়। বাবাকে দেখেও বৈশাখীর মন খারাপ হয়ে গেল। সে অনেক কষ্টে চোখের জল সামলে ঘর থেকে বের হল। রান্নাঘরে গেল, ‘রতনের মা, নীচে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। ফ্রিজে দ্যাখো কী আছে। মনে হয়, পেস্ট্রি আর সন্দেশ আছে। এক গ্লাস শরবত আর ওগুলো দিয়ে এসো। দেরি কোরো না আমরা এখুনি বেরোব। থাক, তুমি প্লেট সাজাও আমি নিজে দিয়ে আসব।’ কেন জানি বৈশাখীর মনে হল, এই মানুষটাকে নিজের হাতে খেতে দিলে ভাল লাগবে।

প্যান্ট এবং টি শার্ট পরা কোনও মেয়ে গাড়ি চালালে আজকাল কেউ ফিরেও তাকায় না। শাড়ি পরা মেয়ে স্টিয়ারিং ধরলে অনেকেই অবাক হয়।

বৈশাখী বাড়িতে অনেক সময় প্যান্ট এবং টি শার্ট পরে। কখনও কখনও সালোয়ার। অথচ গাড়ি চালানোর সময় কেন জানি সে শাড়ি ছাড়া কিছু পরবে না।

সাদা মারুতি গাড়ির চালকের আসনে কোনও সবুজ শাড়ি পরা রূপসি তরুণী বসলে বড় সুন্দর লাগে। সেই মেয়ের চুল যদি ঠিকমতো আঁচড়ানো না থাকে, বেরোনোর সময় সে যদি তাড়াহুড়োতে টিপ পরতে ভুলে যায় এবং তার চোখ যদি হয় বিষণ্ণ, তা হলে সেই সৌন্দর্য আরও বাড়ে। বারবার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।

মাধব কিন্তু তাকিয়ে নেই। সে পিছনের সিটে বসে আছে। দরজার দিকে ঘেঁষে। যারা অন্যের গাড়িতে উঠে চুড়ান্ত ধরনের সংকোচের মধ্যে পড়ে তারা দরজার গায়ে নিজেকে ঠেসে রাখে। যেন দরজার পাশে কুঁকড়ে থাকার অর্থ হল গাড়িতে কম চড়া হল। অল্প হলেও লজ্জার হাত থেকে বুঝি একটু বাঁচা যায়।

বৈশাখী ব্লেকে আলতো করে পা রেখে বলল, ‘মাধববাবু, আপনি ঠিক করে বসুন। বি ইজি।’ মাধব অন্যমনস্ক। অন্যমনস্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। তার বিস্ময় ক্রমাগত বাড়ছে। এ কী সমস্যায় সে পড়েছে? এইজন্যই বলা হয়, মেয়েলোকের কথায় চলতে নেই। সবটা যে চলেছে তাও নয়। তবে কিছুটা তো চলে। তাতে এই। শুধু এটুকুই নয়, গোলমাল লাগছে আরও। কেমন জানি মনে হচ্ছে, ‘স্যারে’র অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য সে দায়ী নয় তো? শোনপাপড়ি দেখে উত্তেজনায় এমন হল না তো? ছি ছি। স্যারের মেয়ে কি ব্যাপারটা জানেন? মনে হয় না। জানবেনই বা কী করে? সেটা আরও অন্যায় হচ্ছে। হয়তো শুনলে ম্যাডাম গাড়ি থামিয়ে বলবেন, ‘আপনি নেমে যান।’ সেও ভাল। এতবড় একটা অন্যায় লুকিয়ে রাখা ঠিক হচ্ছে না। গাড়িতে ওঠার আগে একবার ভেবেছিল পালিয়ে যাবে। পালিয়ে ঠিক না, কাউকে না বলে চলে যাবে। সেটাও মোটে ভাল কিছু হত না। খারাপ হত। পরিবার বড় রাগ করত। বলত, ‘অতবড় মানুষটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল, আর তুমি দুটো মেয়েমানুষের হাতে ছেড়ে পালিয়ে এলে?’ সে এক জ্বালাতনের বিষয় হবে। তারও মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হত না।

হ্যারিসন রোডের মুখে একটা কিছু হয়েছে। সারি দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। একটা ট্যাক্সির গা চেপে গাড়ি দাড় করাল বৈশাখী। ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়লে সকলেরই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বৈশাখীর ভাল লাগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়ালে আশেপাশে কতরকম যে ছোট ছোট ঘটনা। নাটকের মতো। গাড়ির মানুষ, বাসের মানুষ, রিকশ, ঠেলা, এমনকী রাস্তার পাশের দোকান, বাড়ির ছাদে কিশোরী মেয়ে— সবাই কিছু-না-কিছু ঘটিয়ে চলেছে। একটু মন দিয়ে দেখলেই দেখা যায়।

বেশ মনে আছে, একবার কলেজ যাবার সময় পথ-অবরোধে বাস আটকে গেল। অতক্ষণ কে আর বসে থাকবে, অনেকেই নেমে গেছে। ফাঁকা ফাঁকা সিটে হাত-পা ছড়িয়ে বসে বৈশাখী তো রাস্তা দেখছে। হঠাৎ চোখে পড়ল ইউনিভার্সিটির সামনে ফুটপাতে একটা কুকুর বসে আছে অলস ভঙ্গিতে। একেবারে রাস্তার এলেবেলে কুকুর। নজরে পড়ার মতো নয়। চোখ সরাতে গিয়ে বৈশাখী দেখল কুকুরটা হাসছে! স্পষ্ট হাসছে! হো হো হাসি নয়৷ মুচকি হাসি। সেনসব্‌ল কুকুর। জানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে শব্দ করে হাসতে নেই, তাতে পড়াশুনোর ব্যাঘাত হয়। বৈশাখী মজা পেল। খুব মজা। এমন ধরনের মজা সে জীবনে খুব বেশি পায়নি। জানলা দিয়ে মুখ বের করে দেখল। ওমা! এমন সময় আর একটা কুকুর এল! অবিশ্বাস্যভাবে সে প্রথমটার দিকে তাকাল। একটু হাসল। তারপর হাঁটা দিল কফি হাউসের দিকে! বৈশাখী মুগ্ধ হয়ে গেল। যদি মজায় মুগ্ধ ভাব মেশে তা হলে সেই মজা ভুলতে সময় লাগে। বৈশাখীরও লাগল।

দু’দিন পরে দেখা হতে সে সুনন্দকে ঘটনা বলল। ভেবেছিল, সুনন্দ উড়িয়ে দেবে। কারণ যে দেখেনি তার কাছে এটা উড়িয়ে দেওয়ার মতোই কথা। সুনন্দ উড়িয়ে দিল না। সবটা খুব মন দিয়ে শুনল।

‘তোমার কী মনে হচ্ছে, আমার চোখের ভুল?’

‘না আমার তা মনে হচ্ছে না। চোখের ভুল হবে কেন? সিঙ্গাপুরের ডলফিন পার্কে যদি ডলফিন গান গাইতে পারে তা হলে ইউনিভার্সিটির সামনে কুকুর হাসবে না কেন?’

‘তুমি কখনও ডলফিনের গান শুনেছ?’

সুনন্দকে পছন্দ করার সামান্য যে বহু কারণ আছে বলে বৈশাখীর মনে হয়, এটা তার মধ্যে একটা। সে বৈশাখীকে কোনও ব্যাপারেই অনুৎসাহিত করে না।

তবে আসল কথা হল, এ সবই ঘটল ট্রাফিক জ্যামের জন্য। কুকুরের হাসির মতো কোনও দুর্লভ সময় তার জীবনে আর কি আসবে?

এখন কিন্তু ট্রাফিক জ্যাম ভাল লাগছে না। বাবার জন্য চিন্তা হচ্ছে। হাসপাতালে সুনন্দকে পাওয়া যাবে তো? না পাওয়া গেলে ঝামেলা বাড়বে। পোর্টেবল ইসিজি মেশিন নিজেদেরই জোগাড় করতে হবে। অবশ্য ভদ্রলোক সঙ্গে আছে। ভদ্রলোক? মানুষটা যেন ঠিক ভদ্রলোকের মতো নয়। কেমন জানি।

‘ম্যাডাম, আমি কি নেমে দেখব?’

‘না, নেমে কী দেখবেন? মনে হচ্ছে অ্যাক্সিডেন্ট। রোড ব্লকেড়ও হতে পারে।’

‘ম্যাডাম, আপনি বরং বলে দিন আমি হেঁটে চলে যাই। হাসপাতালে গেলে ডাক্তারবাবুর খোজ নিশ্চয় পাব।’

লোকটা বলে কী? হেঁটে যাবে! পাগল নয় তো? কৌতূহল বাড়াচ্ছে। বৈশাখীর ট্রাফিক জ্যাম-জনিত কৌতূহল।

বৈশাখী স্টার্ট বন্ধ করে দিল। বলল, ‘মাধববাবু, আপনি কোন ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন?

মাধব কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। বলল, ‘পারচেজ ডিপার্টমেন্টে করতাম। নিচুর দিকে কাজ। মাল এলে হিসেব মেলানো।’

‘করতেন মানে?’ বৈশাখী ঘাড় ঘোরাল, ‘এখন কি অন্য ডিপার্টমেন্টে গেছেন।’

মাধব এবার আর দেরি করল না। প্রথমবার বলতেই যা দ্বিধা লাগে, একবার বলে ফেললে আর অসুবিধে হয় না।

‘না, ম্যাডাম। গতকাল আমার চাকরি গেছে’— এমন খবর যদি কেউ ঠান্ডা গলায় বলে তা হলে চমকানোরই কথা।

‘কী হয়েছে বললেন?’

‘বরখাস্ত। চুরির দায়ে বরখাস্ত করেছেন। স্যারের কোনও দোষ নেই। চুরি ম্যাডাম সত্যি হয়েছে।’

বৈশাখী কী করবে বুঝতে পারছে না। এই অবস্থায় কী করা উচিত? তার মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

‘ম্যাডাম, আমি কি নেমে যাব?’

রাস্তা পরিষ্কার হয়েছে। স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছাড়ল বৈশাখী। ছাড়ার সময় সামান্য ঝাঁকুনি নিয়েছে। অন্যমনস্কতার ফল।

‘আপনি বাবার কাছে এসেছিলেন কেন? চাকরি ফেরত নিতে?’ এ প্রশ্ন অন্য কাউকে করা যায় না। একে করা যায়। তা ছাড়া বৈশাখীর মাথায় এখন চেপেছে কৌতূহলের ভূত।

‘ছি ছি ম্যাডাম। তা কেন আসব? পরিবার বলল, যাও, এতদিন যাঁর কাছে করে খেয়েছ তাঁকে একটা প্রণাম জানিয়ে এসো। ম্যাডাম, পরিবার আমার সবসময়ই ভুল কথা বলে। তার কথা শুনে আমি যা করি সবই ভুল হয়। তবু করি। এবারও করলাম। ভাবলাম, সত্যিই তো, সরাসরি না হলে কী হবে, এই অফিসে আমরা তো সবাই স্যারের তলায়। স্যারকে ভুলি কী করে?’

একটা ঠেলাকে কাটিয়ে বৈশাখী সামান্য স্পিড় বাড়াল।

মাধব বলতে পেরে যেন দারুণ আনন্দ পেয়েছে। সে বলেই চলল।

‘ম্যাডাম, বড় খারাপ লাগছে।’

‘মাধববাবু, আপনি কি ভেবেছিলেন কাজ চলে গেলেও আপনার ভাল লাগবে? খারাপ তো লাগবেই।’

‘না না। তার জন্য নয়। আসলে আমার মনে হয়, আমার জন্যই স্যার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খুব খারাপ লাগছে। পরিবার শুনলে বড় রাগ করবে।’

‘কেন? বাবা কি আপনার সঙ্গে চেঁচামেচি করছিলেন?’

‘ছি ছি একথা বলছেন কেন? উনি কত বড় মানুষ। আমার সঙ্গে চেঁচাবেন কেন? আসলে—।’

‘আসলে কী?’

‘আসলে শোনপাপড়িটার জন্য উনি বোধহয় মনে মনে বিরক্ত হয়েছেন। হবার কথাই। জিনিসটা ভাল নয়। পচাও হতে পারে। নইলে প্যাকেটে অত মাছি বসবে কেন? কথাটা আমার আগে ভাবা উচিত ছিল। কেনার আগেই। পরিবার সঙ্গে থাকলে এই ভুলটা হত না। মাছি বসা জিনিস নিয়ে স্যারের বাসায় আসতে দিত না। তবে ম্যাডাম ট্রেনের হকার কাজটা ভাল করেনি। আপনি বলুন, করেছে? বেশি দামের জিনিসে ঠকাতে হয়। যারা বেশি দামে জিনিস কেনে তারা আবার কিনতে পারে। কম দামের খরিদ্দাররা পারে না। পারে?’

হাসপাতালের গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে বৈশাখী বলল, ‘বাবা কি ওটা খেয়েছে?’

‘না না, ওতে হাতই লাগাননি।’

‘তা হলে ওটার জন্য শরীর খারাপের কথা আপনি ভাবছেন কেন? এরকম ভাববেন না।’

কথাটা শুনে মাধবের বড় স্বস্তি হল। অনেক বড় একটা ভার নেমে গেল। বৈশাখী লুকিং গ্লাসে দেখল লোকটার মুখে হাসি।

‘ম্যাডাম, কথাটা শুনে বড় ভাল লাগল। বুকে যেন একটা পাথর বসে ছিল। এখন নামল। আপনার যুক্তি বড় সুন্দর। আমি দেখেছি, সুন্দর মানুষের যুক্তি সুন্দরই হয়। আমার পরিবারও হল বিশ্রী। সেইজন্য তার যুক্তিও বিশ্রী। একটা কথা বলব ম্যাডাম?’

‘বলুন।’

‘এক্ষুনি আমায় তাড়াবেন না। আমি আর একটু থেকে যাই। নইলে স্যারের শরীরটা নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় থাকব। বাড়ি গিয়ে শান্তি পাব না। পরিবার বলবে, একটা অসুস্থ মানুষকে দুটো মেয়েলোকের হাতে রেখে তুমি একটা দামড়া লোক কেমন করে বাড়ি চলে এলে; তোমার মনে একটু বাধল না? তোমার ছেলেমেয়ে কী শিখবে বলো? ম্যাডাম, পরিবার আমার যা ভুল কথা বলে। কিন্তু এই কথাটা আমার মনে হয় ঠিকই বলবে। ম্যাডাম আমি একটু থেকে যেতে চাই।’

আউটডোরের পাশে বৈশাখী গাড়ি রাখল। সে যেন ঘোরের মধ্যে আছে। এই ঘোর তৈরি হয় বিস্ময় থেকে সমুদ্র বা পাহাড়ের মুখোমুখি হলে মানুষের মনে হয়, ছুঁয়ে দেখি সত্যি কিনা। খুবই ছেলেমানুষি মনে হওয়া। তবু তো মনে হয়। বৈশাখীর মনে হল, মানুষটাকে একবার ছুঁয়ে দেখি।

সে মাধবের দিকে না তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আপনি থাকবেন। আপনি যাবেন না।’

দুপুরের দিকে আকাশ কালো করে এল। গরমের সময়ে এরকমই হয়। হঠাৎ মেঘ জমে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই মে ঝড় হয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে।

বড়মামা এসেছেন। সঙ্গে মামি আর ছেলেমেয়েরা।

বাড়ির বিপদ অবশ্য বড়মামা আসার বেশ কিছু আগেই কেটেছে।

সুনন্দ তার পরিচিত একটি নার্সিংহোম থেকে হার্ট পরীক্ষার জন্য ইসিজি মেশিন নিয়ে এসেছে। তবে কথা দিতে হল এক ঘণ্টার মধ্যে মেশিন ফেরত দিতে হবে।

মাধব দোতলা পর্যন্ত সেই মেশিন তুলে দেয়। বৈশাখীরা ঘরে ঢুকে দেখে, রজতবাবু ঘুম থেকে উঠে তারিয়ে তারিয়ে চা খাছেন এবং টিভিতে সিরিয়াল দেখছেন। সিরিয়াল সম্ভবত ভয়ের। কারণ বৈশাখী এক ঝলক তাকিয়ে দেখল, ড্রাকুলা ধরনের একটা লোক একটা মেয়ের গলার কাছে তার বড় বড় দাঁত নিয়ে গেছে। ভয়ের হলেও বাবা-মা দু’জনেই হাসছে। আজকাল টিভি সিরিয়ালে অনেক সময় এরকম হয়। ভয়ের কিছু দেখলে হাসি পায়, আবার হাসির কিছু হলে দেখতে ভয় লাগে।

যে-মানুষ এইভাবে হাসে তার হৃৎপিণ্ড পরীক্ষা হয় কিনা সন্দেহ। কিন্তু রজতবাবুর হল। সুনন্দ নিজে করল। তারপর কাগজের ওপর আঁকাবাঁকা গ্রাফ দেখে বলল, ‘আপনার হার্ট আমার থেকেও ভাল। প্রেশার নরম্যাল। বয়সের তুলনায় বেশি নরম্যাল। তবে এত নরম্যালও ঠিক নয়। আপনি আজকের দিনটা আর ওঠাউঠি করবেন না। কাল থেকে আবার যা খুশি করবেন। আমি এই রিপোর্টটা একবার কার্ডিওলজির হেডকে দেখাব। তবে আমি শিয়োর।’

খুবই আনন্দের কথা। সকালে মাধবের ধরে আনা ডাক্তার যে ভরসা দিয়েছিল, সুনন্দ তা যেন দ্বিগুণ করে দিল। এইসময় হইহই করে বড়মামা এসে পড়ায় বিমলাদেবীর আনন্দ হল তিনগুণ। তিনি ফ্রিজে তুলে রাখা মাংস ফের বের করলেন। রতনের মাকে ডেকে বললেন, ‘কাঁচালঙ্কা দিয়ে আজ একটু লাইট করে ঝোল করো। দাদাবাবুর আজ বেশি রিচ খেয়ে কাজ নেই। থাক, তোমায় করতে হবে না। মাংসটা আমি আজ নিজেই করছি।’

এত বেলায় মাংস রাঁধতে হবে শুনলে কাজের লোকেরা বিরক্ত হয়। মুখ হাঁড়ির মতো করে। রতনের মা খুশি হল। কয়েক টুকরো মাংস চুরি করা যাবে। সে সবসময়ই সঙ্গে একটা ছোট টিফিন কৌটো রাখে। সমস্যা কিছু নেই। শুধু কৌটোর ঢাকনা একটু লগবগ করে এই যা। সাবধানে রাখতে হয়, ঝোল পড়ে না যায়। মাংস দরকার নেই, খানিকটা ঝোল সরাতে পারলেই হবে। হঠাৎ মাংস পেলে ছেলেমেয়েগুলো ভারী খুশি হবে।

বৈশাখীও খুশি। সে জানত সুনন্দ এসে পড়লে সমস্যা কেটে যাবে। সমস্যা কেটে গেছে

চায়ের কাপ নিয়ে বৈশাখী বাবার ঘরে ঢুকল। হাসিমুখে বলল, ‘নাও, এবার খুশি তো।’

রজতবাবু মুখ গম্ভীর করে বললেন, ‘না খুশি নয়। তুই বস।’

বৈশাখী খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসল।

‘কী হল? খুশি নও কেন? আবার অজ্ঞান হতে ইচ্ছে করছে?’

‘ঠাট্টা করিস না বৈশাখী।’

রাগের ভান করে বৈশাখী বলল, ‘ঠাট্টা আমি করছি, না তুমি করছ বাবা? অফিস অফিস করে তুমি যা শুরু করেছ সেটা কী?’

চায়ে চুমুক দিয়ে রজতবাবু বললন, ‘তুই মাধব নামের লোকটাকে নিয়ে বেরিয়েছিলি?’

‘হ্যাঁ, কী হয়েছে?’

‘কাজটা ঠিক করিসনি। তুই কি জানিস ওকে চুরির অভিযোগে সাসপেন্ড করা হয়েছে?’

‘জানি। ভদ্রলোক নিজেই বলেছেন।’

রজতবাবু এবার অবাক হয়ে উঠে বসলেন। ‘জানিস! তারপরেও তুই তাকে এন্টারটেইন করলি! শুনলাম, চা সন্দেশ খেতে দিয়েছিস?’

বৈশাখী খুব ঠান্ডা গলায় বলল, ‘দুপুরেও খেতে বলব। কতদূর থেকে এসেছেন।’

‘একটা চোরকে দুপুরে খেতে বলবি?’

‘বৈশাখী অল্প হেসে বলল, ‘কেন বাবা, চোরেরা দুপুরে খায় না? তুমি ফরনাথিং টেনশন করছ। মাধববাবুর জন্য আমরা কিছুই করিনি। বরং উনিই আমাদের জন্য অনেক করেছেন। জানোই তো রোববার ডাক্তার পাওয়া কত শক্ত। উনিই কোনও একটা ওষুধের দোকান থেকে বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে খুঁজে আনলেন। তারপর, সুনন্দকে ধরে আনলাম তো ওনাকেই নিয়ে গিয়ে। আর শেষটা হল, তোমার হৃদয় পরীক্ষার যন্ত্রটা ওই চোর ভদ্রলোকই কাঁধে করে ওপরে তুলে দিল। এর পরেও যদি ওঁকে না খাইয়ে ছাড়ি, সেটা চুরির থেকে অনেক বড় অপরাধ হয়ে যাবে না বাবা?’

রজতবাবু বিরক্ত হলেন, ‘তুই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না। হয়তো লোকটা প্রতিশোধ নিতে এসেছে। আমি তো ভাবছিলাম পুলিশ ডাকব।’

‘বাবা, তুমি শান্ত হও তো। এসব কিছু না। আমি চোর ডাকাত বুঝি না, সেসব তোমার অফিসের ব্যাপার। বাড়ির নয়। তা ছাড়া চোর ডাকাত যাই হোক মানুষটা কিন্তু চমৎকার বাবা। কেমন যেন অন্যরকম। তোমাদের ভুলও তো হতে পারে। পারে না?’ কথাটা বলে বৈশাখী যেন সামান্য লজ্জা পেল। মুখ ঘুরিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

রজতবাবু চিন্তিত মুখে টেবিলের ওপর থেকে টেলিফোনটা নিলেন। তাঁর এই মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই বড় ঝামেলায় ফেলে।

বৈশাখী ভালভাবেই বুঝতে পারছে, এ-বাড়িতে মাধবকে কেউ খেয়ে যেতে বলবে না। মানুষটার কথাই সবাই ভুলে গেছে। সে নিজেই খাওয়ার কথা বলতে নীচে নামল। একতলায় বসার ঘরে তখন বড় অদ্ভুত এক আসর বসছে। এতই অদ্ভুত যে বৈশাখী সিঁড়ি মুখে থমকে দাঁড়াল।

মাধববাবু মোড়ায় বসে। পাশে সোফায় মুগ্ধ নয়নে বসে আছে মামাতো ভাইবোন, টুম্পা আর বুবাই। মাধববাবু একটা হাত নাকের কাছে রেখে কাঁপাচ্ছে। গিটারের মতো একটা শব্দ হচ্ছে। সে নাক-গিটারে এখন বাজাচ্ছে, খর বায়ু বায় বেগে। শেষ হতেই টুম্পা বুবাই লাফিয়ে উঠল, ‘মাধবকাকু আর একটা, আর একটা। প্লিজ আর একটা।’ মাধবকাকু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ‘আর না। এবার আমাকে যেতে হবে।’

টুম্পা বলল, ‘আর একটা না শোনালে তোমাকে কিছুতেই ছাড়ব না।’

‘আচ্ছা, আর একটা। তবে এটাই কিন্তু শেষ।’

শ্রোতাদের তুমুল আবদারে মাধব এবার নাক গিটার বাজাতে লাগল, ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে।’

এমন সময় সে সিঁড়ির মুখে বৈশাখীকে দেখতে পায়। খুবই ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বৈশাখ এগিয়ে আসে। হেসে বলে, ‘থামালেন কেন? বেশ তো হচ্ছিল।’

‘ছি ছি ম্যাডাম এ কী বলছেন? এর আবার ভাল মন্দ। তবে গতবার অফিস সোশালে একটা চান্স পেয়েছিলাম। প্রথমে সাহস হচ্ছিল না। পরিবার বলল, করো না। খারাপ কী? ছেলেমেয়ে দুটোও খুব ধরল। কী মুশকিল বলন তো। ওরা ওদের বাবাকে স্টেজের ওপর দেখতে চায়। কী লজ্জার কথা। এই হচ্ছে আমাদের মুশকিল ম্যাডাম। আপনাদের মতো বড় ঘরের বাবা-মা ছেলেমেয়েকে স্টেজে দেখার জন্য ছটফট করে আর ছোটলোকের ঘরে হয় উলটো। ছেলেমেয়েরা বাবাকে স্টেজে দেখার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারে। শেষপর্যন্ত ওদের ঠেলাঠেলিতেই রাজি হলাম। বলতে লজ্জা করছে, সেদিন খুব হাততালি পেয়েছিলাম। কী এমন ব্যাপার বলুন? হাততালি শুনে দেখি ছোট ছেলেটা আমার ভেউ ভেউ করে কান্না জুড়েছে। বোকা, রাম বোকা।’

বৈশাখী মুগ্ধ হয়ে লক্ষ করল কথা বলতে বলতে মানুষটার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে।

‘ভাল করেছিলেন। খুব ভাল করেছিলেন। টুম্পা বুবুন তোরা ওপরে যা। রতনের মা তোদের জন্য লিচু ধুয়ে রেখেছে খেতে তো বেলা হবে। মাধববাবু, আপনিও কটা খাবেন নাকি? একটা টেস্ট করে দেখলাম দারুণ মিষ্টি।’

‘আপনি বুঝি লিচু খেতে ভালবাসেন?’

‘ফ্যানটাস্টিক। এই তো দেখুন না খেয়ে উঠেই একগাদা নিয়ে বসব। আর হ্যাঁ, আপনি আজ এখানে খেয়ে যাবেন।’

‘ম্যাডাম, তার কোনও দরকার নেই। এই তো একটু আগেই মিষ্টি খেলাম। পেট এখনও ঢাঁই মেরে আছে। আমি বরং রওনা দিই। অনেকটা পথ তো। স্যার সুস্থ হয়েছেন এই সংবাদটাই বড় ভাল।’

‘খেয়ে আপনাকে যেতেই হবে মাধববাবু। যদি কিছু মনে না করেন তা হলে আরও একটা কাজ আপনাকে করে দিতে হবে। ইসিজি মেশিনটা আপনাকে ফেরত দিয়ে আসতে হবে। আমিই গাড়ি নিয়ে বেরোতাম। কিন্তু মামারা সবাই চলে এসেছে।’

‘এ কী বলছেন? আমি থাকতে আপনারা কেন যাবেন? আমি ঠিক দিয়ে আসব। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। দিন, যন্ত্রটা কোথায়। চট করে দিয়ে আসছি।’

‘জায়গাটা মনে আছে আপনার? দেরি করবেন না। এই নিন, ট্যাক্সিভাড়া রাখুন।’

‘না না ট্যাক্সি ভাড়া কীসের? এইটুকু তো পথ মোটে। বাসেই চলে যাব। রোবারের বাস তো ফাঁকাই। মেশিনটাও ছোট। একটা ব্যাগ যদি দেন।’

বৈশাখী নিশ্চিন্ত হল। ওপরে সুনন্দ অনেকক্ষণ থেকে টেনশন করছিল। মেশিনটা এক্ষুনি নার্সিংহোমে না পাঠিয়ে দিলে বিচ্ছিরি হবে। বৈশাখী বলেছে, ‘তোমায় ভাবতে হবে না। আমি ঠিক ব্যবস্থা করব।’

‘কী ব্যবস্থা করবে?’

‘সেটা আমি বুঝব। তোমার তো জিনিসটা পোঁছোলেই হল। দরকার হলে আমি নিজে যাব।’

‘তা হলে দাও আমিই যাই। আমি না হয় হাসপাতালে চলে যাব।’

‘সেকি, তুমি না খেয়ে গেলে মা আমাকে আর আস্ত রাখবে না। তুমি বাদ দাও আমি দেখছি।’

মাধব ইসিজি মেশিন নিয়ে রওনা দেবার একটু পরে ঝড় উঠল। বৃষ্টি ছাড়া ঝড়। শুধু ধুলা আর গাছের পাতার ঝড়। রতনের মা একতলায় ঘরে জানলা আটকাতে গিয়ে একশো টাকার একটা নোট পেল। টেবিলের ওপর চিনামাটির অ্যাশট্রে দিয়ে যত্ন করে চাপা ছিল। সে পাউরুটি, অল্প সর্ষের তেল এবং মাংসের ঝোলের মতো দামি জিনিস চুরি করে। টাকার মতো সামান্য জিনিসে তার কোনও লোভ নেই। খুবই তুচ্ছ, ভঙ্গিতে সে সেই নোটটা বৈশাখীর হাতে এনে দিল। সব টাকাই একরকম। আলাদা করে চেনা যায় না। এই টাকা বৈশাখী কিন্তু সহজেই চিনতে পারল।

মাধবকে ইসিজি মেশিন নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সিভাড়া বাবদ এই টাকা দেওয়া হয়েছিল। সে-ই দিয়েছিল।

বড়মামা পান মুখে নিয়ে বললেন, ‘বুঝলি বৈশাখী, তোর মামি সকালে উঠে বলল, রাতে একটা বাজে স্বপ্ন দেখলাম। চলো আজ একবার বিমলার এখান থেকে ঘুরে আসি। আমি বললাম, নিশ্চয় কাল রাতে তোমার একাধিক ডিম্ব ভক্ষণ হয়ে গেছে, সেখান থেকে পেট গরম। তার থেকেই স্বপ্ন। ‘স্বপ্ন দেখে দুর্বল হজমের মানুষেরা। ঠিক কিনা ইয়ং ডাক্তার?’

একটু আগেই দুপুরের খাওয়া শেষ হয়েছে। বৈশাখীর ঘরে খাটে আধশোয়া বড়মামা। বৈশাখী বসো পায়ের কাছে। সুনন্দ চেয়ারে। বড়মামা বোঝাচ্ছেন, কোনও খবর না পেয়েও, কীভাবে স্রেফ স্বপ্ন-আজ্ঞা পেয়ে তিনি সস্ত্রীক পুত্রকন্যা সমেত এই বিপদের বাড়িতে চলে এসেছেন। বোঝা যাচ্ছে তাঁর কথার সবটাই বানানো। শুধু চলে আসাটা ছাড়া।

ঝড় থেমেছে। একটা ঠান্ডা ভাব! সবই ঠিকভাবে হয়েছে। সকলেরই খাওয়া হয়ে গেছে। বাকি শুধু মাধব। তার ভাত এবং মাংস আলাদা করে তুলে রাখা হয়েছে ফ্রিজে। এলে গরম করে দেওয়া হবে। সে এখনও ফেরেনি। বৈশাখী উদ্‌বেগের মধ্যে আছে। তার চিন্তা বাড়ছে।অন্য কারওই ওই বিষয়টা মনে নেই। মাধব বলে যে একজন সকাল থেকে এ-বাড়িতে আছে এবং সে যে বিপদের সময় অনেক ছোটাছুটি করেছে, এটাই যেন সকলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভুলে গেছে। বৈশাখী ভেবেছিল, সে খাবে না। অপেক্ষা করবে। সুনন্দর জন্য তা সম্ভব হয়নি। তার খিদে পেয়ে গিয়েছিল।

চিন্তার সঙ্গে বৈশাখীর রাগ হচ্ছে। অদ্ভুত মানুষ তো। এই আসব বলল। এখন ক’টা বাজে সেটা একবারে খেয়াল নেই?

সে স্বপ্নের আলোচনায় বসে আছে, কিন্তু শুনছে না। শোনার মতো মনের অবস্থা তার নেই।’

বড়মামা ভুরু কোচকালেন, ‘এই হল তোমার ইয়ং ডক্টরদের নিয়ে ঝামেলা। দুটো বই পড়েই তারা পুরনো সবকিছু ফেলে দিতে চায়। আরে বাবা আমাদের মা দিদিমারা হয়তো তোমাদের মতো বই পড়েনি, কিন্তু স্বাস্থ্য নিয়ে তারাও তো কম জানতেন না। কী বল বৈশাখী? অ্যাঁ, তারা জানতেন না?’

বৈশাখী কিছু বলল না। কথা বলল সুনন্দ, ‘হ্যাঁ, জানতেন। তবে বেশিটাই ভুল জানতেন। আর তার ফলে খুব অসুবিধে হত।’

বড়মামা ছোকরা ডাক্তারের বেয়াদপিতে খুবই বিরক্ত। অন্যদিন হলে বৈশাখী এই ঘটনায় মজা পেত। আজ পাচ্ছে না। আজ তার চিন্তা বাড়ছে। মনে হচ্ছে ইস্‌, গাড়িটা নিয়ে গেলেই হত।

‘স্বপ্নের ব্যাপারটা আপনি কি শুনবেন?’ ঠান্ডা গলায় সুনন্দ বলল।

বড়মামার ছেলেটিকে পছন্দ হচ্ছে না। বিয়ের আগেই এত পাকামো? বিয়ের পর না জানি কী হবে। তবু বললেন, ‘কী আর শুনব? তবু বলো।’

‘মামা, আপনি কী স্বপ্ন দেখবেন তা নির্ভর করছে আপনার চোখের মণি ঘোরাফেরার ওপর। আমাদের ঘুমের মধ্যে রয়েছে দুটো পর্যায়।’

‘আমি বিশ্বাস করি না।’

‘আমিও করি না। কিন্তু গবেষণা করে। গ্যাসটেন্ট নামে এক মনোস্তত্ত্ববিদ স্বপ্নাতাঙ্ক নিয়ে বড় গবেষণা করেছেন। এই যে পরীক্ষার সময় আমরা ভয়ংকর ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখি তারও ব্যাখ্যা আছে। ওয়ার্নার কার্লে নামে এক সাহেব এ ব্যাপারে বিশাল সমীক্ষা করে ফেলেছেন।

মামা বিষয় বদলাতে চেষ্টা করলেন। চট করে রাগিয়ে ছোকরাকে যদি অন্যদিকে টেনে আনা যায়। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, আজকাল শুনি ডাক্তাররা প্যাথলজিকাল লেবরেটরিগুলো থেকে মোটা কমিশন নেয়। ইচ্ছে করে ভুল চিকিৎসা করে। কথাটা ঠিক নাকি? ছি ছি, আমরা তো ভাবতেই পারি না।’

‘ঠিকই শুনেছেন। কম শুনেছেন। তবে সবাই নয়। কেউ কেউ। যেমন ধরুন কথায় বলে, মামা মানেই বোকা। কথাটা কি ঠিক? ঠিক নয়। এ কথা ছেড়ে দিন। স্বপ্নের আর একটা ব্যাপার বলে দিই। খুবই ইন্টারেস্টিং! সেনয় কনসেপ্ট বলে একটা চিকিৎসা আছে যা দিয়ে দুঃস্বপ্ন দূর করা যায়। সম্ভবত ১৯৫০ সালে কিলটন স্টুয়ার্ট নামের এক মনোবিজ্ঞানী এর প্রবক্তা। তিনি মালয়েশিয়ার সেনয় উপজাতির ছেলেদের নিয়ে এই পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। জানেন তো মালয়েশিয়ার বাঘ হল ভয়ংকর। সেখানকার ছেলেরা খালি স্বপ্ন দেখত, সেই ভয়ংকর বাঘ তাড়া করে আসছে। স্টুয়ার্ট তাদের ক্রমাগত বলতে লাগল, ভয় পাবে না। ঘুরে দাঁড়াবে। চিৎকার করবে। তাতে যদি বাঘ না পালায় তখন তাড়া করবে। লাঠি নিয়ে তাড়া। আশ্চর্য কথা কী মামা, ক্রমাগত বলতে বলতে ছেলেরা সত্যিই সত্যিই একদিন ঘুমের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াল। বাঘকে তাড়া করতে পারল। তাদের আতঙ্ক কাটল। এই ঘটনা গোটা বিশ্বে দারুণ সাড়া ফেলেছিল। আজ ওই সেনয় কনসেপ্ট ব্যবহার করে কত মানুষের যে স্বপ্নাতঙ্ক কাটানো হয় তার ঠিক নেই। আপনার সমস্যা হলে বলবেন মামা।’

বড়মামা উঠে পড়লেন। অনেকটা রণে ভঙ্গ দেওয়ার ভঙ্গি। বললেন, ‘যাই রজতের কাছে গিয়ে একটু বসি৷’ ঘর থেকে বেরোনোর আগে একটু খোঁচা দিলেন— রজতকে বলি একটা ভাল হার্টের ডাক্তার দেখাতে। নেগলেক্ট করা ঠিক হবে না। বাবা, তোমার ভাবি শ্বশুরমশাইয়ের অসুখ তো স্বপ্নে হয়নি। মনে হয় না তোমার বিদ্যায় কোনও কাজ হবে।’

মামা ঘর ছাড়লে সুনন্দ প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল। হাসতে হাসতে বৈশাখীকে বলল, “কেমন দিলাম বলো?’।

‘খুব খারাপ। গুরুজনকে এমনভাবে বলাটা ঠিক হয়নি।’

‘যা সত্যি তাই বলেছি। এর মধ্যে গুরুজন লঘুজনের কী আছে?’

‘স্বপ্ন নিয়ে এতসব ব্যাখ্যা খুব বাজে জিনিস। স্বপ্ন হল স্বপ্ন। তার আবার ব্যাখ্যা কী? স্বপ্ন হল একটা রহস্যময় সুন্দর জিনিস। রোমান্টিক ব্যাপার ডাক্তাররা কী বুঝবে?’

সুনন্দ গম্ভীর হয়ে সিগারেটে লম্বা টান দিল। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কি মনে হয় আমি রোমান্টিক নই। আমি রবিঠাকুর পড়িনি? গান শুনি না? কবিতা মাথায় ঢোকে না? শুধুই ছুরি কাঁচি নিয়ে ঘুরি?’

‘আমার কিছুই মনে হয় না। সুনন্দ, একটা সমস্যা হয়ে গেছে। আমার ভীষণ ভয় করছে। তুমি কি সমস্যাটা শুনবে?’

‘শুনব।’

‘চলো বারান্দায় গিয়ে বলছি।’

সন্ধে হব হব করছে। তবে এখনও পুরো অন্ধকার নামেনি। বোধহয় মাঝপথে কোথাও সেই অন্ধকার দিনের আলোর সঙ্গে তার শেষ কথা বলে নিচ্ছে।

মাধব অধ্যায় শুনতে গিয়ে সুনন্দ আরও তিনটে সিগারেট শেষ করে ফেলল। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কাজটা ঠিক করোনি বৈশাখী।’

‘কোন কাজটা।’

‘একটা চোরের হাত দিয়ে মেশিনটা পাঠানোটা ঠিক হয়নি। এদেশেরগুলো আঠারো-বিশ হাজার টাকা হয়, তা হলে বিদেশি একটা পোর্টেবল ইসিজির দাম এখন তিরিশ হাজার হবে। ইস নিজের রিস্কে নিয়ে এলাম। কী হবে ভাবতেও পারছি না।’

‘তুমি মেশিনের দাম ভাবছ; লোকটার কথা একবার ভাবছ না? এখনি আসছি বলে মানুষটা গেল। তারও তো কোনও বিকল হতে পারে। পারে না?’

‘এতসব ভাবার কিছু নেই। লোকটা নিশ্চয় এতক্ষণে জিনিসটা বিক্রি করে দিয়েছে। আমার গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এই মুহুর্তে অত টাকা আমি কোথা থেকে পাব?’

চেয়ারের ওপর বসে পড়ল সুনন্দা। স্মার্ট ছেলেটা এক মুহূর্তে একেবারে বদলে গেছে। মুখ পাংশু।

বৈশাখীর খুব খারাপ লাগছে।

‘তুমি এরকম ভাব কেন? লোকটা চুরি করবে কেন? সকাল থেকে ও যা করেছে। বাবার জন্য ওই তো প্রথমে ডাক্তার ডাকল।’

‘ওফ, ডোন্ট বি সিলি বৈশাখী। চার জানার পর লোকটাকে তোমার ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া উচিত ছিল।’

‘আমি জানিনি।’

‘লোকটা নিজে বলছে চুরির দায়ে বরখাস্ত হয়েছে, তুমি বলছ চোর কিনা জানো না? ওয়াট হ্যাপেন্ড? ইউ আর টকিং রাবিশ।’

‘চিৎকার করছ কেন? বাবা শুনলে টেনশন করবে।’

‘সেটা আমি জানি। আমাকে যদি বলতে তা হলে আমি ওকে দিয়ে পাঠাতাম না, নিজে যেতাম।’

‘সুনন্দ তুমি মাথা ঠান্ডা করো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমরা যেরকম ভাবছ লোকটা সেরকম নয়। তুমি ওর সঙ্গে কথা বললে বুঝতে। একটা অদ্ভুত মানুষ৷’ বৈশাখী একটু থামল। তারপর বলল, ‘দারুণ মানুষ।’

সুনন্দ লাফিয়ে উঠল।

‘কী বললে, দারুণ? একটা চোরকে তুমি বলছ দারুণ! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

‘মনে হচ্ছে খারাপ হয়ে গেছে।’

‘বৈশাখী, তুমি বসে না থেকে একটা কাজ করবে? তোমার মামার তো শুনেছি পুলিশে কানেকশন আছে। ওনাকে রিকোয়েস্ট করলে কিছু করবেন না? লোকটাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধোলাই দিলেই বলে দেবে মাল কোথায় বেচেছে। ইচ্ছে করলে পুলিশ সব পারে।’

বৈশাখীর অবাক লাগছে। সুনন্দ এরকম করছে কেন? কেন সে তার কথা বিশ্বাস করছে না? তার কথার কি কোনও দাম নেই? সুনন্দ বারবার তার মেশিনটার কথা বলছে। অথচ লোকটার কথা একবারও ভাবছে না।

বড়মামা স্বপ্নের তত্ত্বে হেরে গেলেও বাস্তব অভিজ্ঞতায় সুনন্দকে হারিয়ে দিলেন। ঘটনা শুনে বললেন, ‘আগে থেকে লাফাচ্ছ কেন? আমাদের মা ঠাকুমা বলত, বিপদে পড়লে মাথা ঠান্ডা করতে হয়। তোমাদের ডাক্তারি বই কি মাথা গরম করে লাফাতে বলে? তুমি যেখান থেকে মেশিনটা এনেছিলে সেখানে একটা টেলিফোন করো। তারপর পুলিশটুলিশ হবে।’

পুলিশটুলিশ হল না। টেলিফোনেই জানা গেল, মেশিন ফেরত চলে গেছে। দু’ঘন্টা আগেই চলে গেছে।

একটু আগেই অন্ধকার নেমেছে। মামারা চলে গেছে। ঘরের আলো নিবিয়ে শুয়ে আছে বৈশাখী। ঘরে ঢুকল সুনন্দ। সে চলে যাবে। তাকে হাসপাতালে যেতে হবে।

খাটের পাশে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘বৈশাখী, মাথা ধরেছে?’

বৈশাখী উত্তর দিল না।

‘সরি। কতগুলো খারাপ কথা বলেছি। আসলে মানুষকে তো আজকাল বিশ্বাস করা যায় না। তা ছাড়া একটা বড় ঘটনায় যে জড়িয়ে পড়েছে। তোমার বাবাও তো বললেন, লোকটা ভাল না। ওর বিরুদ্ধে নাকি ডেফিনিট প্রমাণ আছে।’

‘সুনন্দ, প্লিজ চুপ করবে?’

‘আমি জানি তুমি এখনও রেগে আছ। আচ্ছা, একটা গোপন জিনিস ফাঁস করে তোমার মন ঠিক করে দিচ্ছি। শুনবে?’

‘না। শুনব না। কারণ আমার মন ঠিক আছে।’

‘তাও বলব। রোজ সকালে ই-মেলে তুমি যে চিঠিগুলো পাও সেগুলো সব আমার পাঠানো।’

‘জানি।’

সুনন্দ অবাক হয়ে বলল, ‘কী করে জানলে?’

বৈশাখী বলল, ‘কারণ তুমি চমৎকার মানুষ। আর সেজন্যেই ভেবেছিলাম, তুমি আর একটা চমৎকার মানুষকে বুঝতে পারবে। পারলে না। কিন্তু এখন আর তোমার হাতে ওই চিঠি মানায় না। তুমি আর পাঠিয়ো না। প্লিজ সুনন্দ।’

চলে আসার সময় সুন্দর মনে হল, কোথাও গোলমাল হয়ে গেছে। তবে গোলমালটা বড় না ছোট সেটা পরিষ্কার নয়।

সত্যিই গোলমাল হয়ে গেছে। নইলে রাতে খাবার টেবিলে ভাত নাড়তে নাড়তে বৈশাখী তার বাবাকে একথা বলতে পারত না।

‘বাবা, একটা কথা বলব। তুমি টেনশন করবে না বলো?’

বল না। টেনশন করব কেন?’

কাল তুমি অফিসে গিয়ে মাধববাবুর ঠিকানাটা জানবে। জেনে আমাকে ফোন করবে।

‘কেন’

‘বৈশাখী মন দিয়ে খেতে খেতে বলল, ‘আমি একেবার ওনার বাড়ি যাব।’

রজতবাবু ঠান্ডা গলায় বললেন, “সে তোর ইচ্ছে। বড় হয়েছিস, তুই বুঝবি। তবে তোকে একটা কথা বলতে চাই। শুধু অন্যের মুখে শুনে নয়, আমি নিজে আলাদাভাবে খোঁজ নিয়েছি। পার্সোনাল ম্যাসেনজার নিজে আজ রবিবার সত্তেও অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়েছে। খাতা ঘেঁটেছে। একটু আগে সে আমাকে ফোন করেছিল। কী বলল জানিস?

‘হা জানি। মাধববাবুই টাকা চুরি করেছেন তো? তা হলে আমি যাব।’

বিমলাদেবী বললেন, ‘এর পরেও এই চরটার বাড়ি তুই যাবি বলছিস! তোর বাবার প্রেস্টিজ জানিস?

বৈশাখী বলল, ‘ইস তরকারিটা কী মিষ্টি হয়েছে।’

বিমলাদেবী আবার বললেন, ‘কী, বলছিস না যে?

বৈশাখী চোখ তুলে সরাসরি মায়ের দিকে তাকাল। কঠিনভাবে বলল, কী বলব মা? তুমি কী শুনতে চাইছ? বাবার প্রেস্টিজ রাখতেই তো যাব।

তুই কি খেপছিস?

হ্যাঁ মা, আমি খেপেছি।

রজতবাবুকে আর ঠিকানা খুঁজতে হল না।

গভীর রাতে ফোন এল। হাসপাতাল থেকে সুনন্দ ফোন করেছে। বারান্দা থেকে উঠে এসে বৈশাখী ফোন ধরল।

বৈশাখী, তোমার মাধববাবুর শার্টের রংটা কি নীল ছিল?

মনে হচ্ছে নীল নয়। আবার নীল হতেও পারে।’

একটা খারাপ খবর আছে বৈশাখী। আমি কি বল?

ঠান্ডা গলায় বৈশাখী বলল, হ্যাঁ, বলো।’

‘একটা অ্যাক্সিড়ে কেস। পুরোটা জানি না! যতদূর শুনেছি বাস-অক্সিডেন্ট। তুমি যদি চাও রেজিস্টার দেখে বলতে পারি। পেশেন্ট দুপুরেই অ্যাডমিট হয়েছে। সন্ধে পর্যন্ত এমার্জেন্সিতে ছিল। আমি জানতাম না। তোমাদের ওখান থেকে আসার পরও জানতাম না। আমার কাছে খবর এল অপারেশনের পর।’

‘খবরটা বলে।’

‘লোকটার পকেটে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। চিঠিটা একটু অদ্ভুত। অফিস থেকে সাসপেনশনের চিঠি। এখানে খুব আলোচনা হচ্ছিল। নইলে অ্যাক্সিডেন্ট তো আকছার আসছে। হাসপাতাল মানেই তো অ্যাক্সিডেন্ট। জলভাতের মতো। কে আর খবর রাখে বলো? নামটা শুনে তোমায় ফোন করছি। লোকটাকে যারা হাসপাতালে দিয়ে গিয়েছিল তার একটা ব্যাগও দিয়ে গেছে। সেটাও অদ্ভুত। তাতে নাকি সামান্য কয়েকটা লিচু রয়েছে। আমি অবশ্য নিজে দেখিনি। অত বড় ব্যাগে সামান্য কয়েকটা লিচু! স্ট্রেঞ্জ না’

‘এত কথা বলছ কেন সুনন্দ? খবরটা বলো। মাধববাবু কি মারা গেছেন?’

‘হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন। তুমি কি একবার আসবে? কেউ নেই। আসলে কোনও ক্লেম নেই তো। ডেডবডি একটু পরেই মর্গে পাঠিয়ে দেবে।’

বৈশাখী কিছুক্ষণ ফোন ধরে থাকল। তারপর বলল, না। আসব না।

বৈশাখী আবার বারান্দায় গিয়ে বসল। রজতবাবু এসে দাড়ালেন। টেলিফোনের শব্দে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

‘হ্যাঁরে, রে ফোন করেছিল? সুনন্দ?’

বৈশাখ মুখ না ঘুরিয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি এত রাতে উঠলে কেন? শরীরটা খারাপ লাগছে?

না শরীর ভাল আছে। দুপুরে তো অনেক ঘুমোলাম। তুই শুৰি না?’

রজতবাবু মুখ না দেখেও বুঝলেন বৈশাখী কাঁদছে। তিনি এগিয়ে এলেন। পেছন হকে মেরে মাথায় হাত রাখলেন।

মৃত্যুর খবরে মানুষ শব্দ করে কাঁদতে পারে। এই কান্নায় কোনও বাধানিষেধ থাকে না। তাও কেন জানি কিছু মৃত্যুতে কাঁদতে হয় নিঃশব্দে, খুব গোপনে। সেই চোখের জল প্রিয়জনকে দেখানো যায় না। শুকোতে গিয়ে এই কান্না আসে প্রাণের গভীর থেকে। বহু ভাঙনের পথ ধরে।

বৈশাখী শক্ত গলায় বলল, বাবা, মাধববাবু একটু আগে মারা গেছেন। সম্ভবত বাস অক্সিডেন্টে। সুনন্দ ফোন করেছিল বডি ওদের হাসপাতালেই আছে। আমি কি একবার যাব?’।

‘তুই কি এত রাতে গাড়ি চালাতে পারবি?’

‘তুমি যদি পাশে থাকো পারব।’

‘চল। আমি পাশে থাকব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *