বিভ্রম
ডাক্তার রায় চিন্তিত হলেন।
চিন্তিত হবারই কথা। যে-কোনও ধরনের মানসিক রোগে প্রথম লক্ষণ ফুটে ওঠে চোখে। মণির ঘোরাফেরার মধ্যে থাকবে অস্থিরতা। দৃষ্টি হবে অর্থহীন। সহজভাবে যাকে বলা হয় ‘ভেকেন্ট লুক’। ডাক্তারের দরকার নেই, সেই তাকানো দেখলে যে-কেউ বুঝবে, মানুষটার সমস্যা হয়েছে। কথায় বা আচরণে রোগ লুকোনোর চেষ্টা করলেও, চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে যাবে।
এই পেশেন্টের চোখে কোনওরকম লক্ষণ নেই। ‘আই মুভমেন্ট’ স্বাভাবিক। দৃষ্টিতে অর্থহীন ভাব তো দূরের কথা, উলটে একটা বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাপার রয়েছে। অথচ অসুখটা সহজেই ধরা গেছে। হ্যালুসিনেশন ডিসঅর্ডার। অর্থাৎ যা নয়, যা হতে পারে না, রোগী তাই দেখছে, তাই শুনছে। দেখে ভাবছে, সত্যি। হ্যালুসিনেশন হল মিথেকে সত্যি ভাবার অসুখ। কিন্তু মুশকিল হল, এক্ষেত্রে সিমটম আর ভায়াগনিসেসের মধ্যে একটা বড় ধরনের ফাঁক চলে আসছে। রোগ-নির্ণয় যা বলছে, উপসর্গ তা বলছে না। অঙ্কের এই ফাঁক ভরাট না-হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা শুরু করা উচিত হবে কি? ডাক্তার রায় ভাবলেন, আর একটু বাজিয়ে দেখা যাক।
ডাক্তার রায় চেয়ারে হেলান দিলেন। গলায় একটা হালকা ভাব এনে বললেন, ‘সমরবাবু, আপনার কি মনে হয় ওয়েস্টবেঙ্গলে থ্রি ফিফটি সিক্স জারি হবে? শেষপর্যন্ত সেন্টার কি সেই রিস্ক নিতে পারবে?’
সমরের বিরক্তি লাগছে। মনে হচ্ছে, ডাক্তার অসুখটা ঠিকমতো ধরতে পারছে না। আর ধরতে পারছে না বলে এইসব আবোল তাবোল কথা বলে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে। অথচ সে চায়, বিষয়টা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা ফয়সালা হয়ে যাক।
সে ডাক্তারের প্রশ্ন উপেক্ষা করে সরাসরি বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আপনার কি মনে হচ্ছে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’
ডাক্তার রায় হাসলেন। বুদ্ধিমান পেশেন্ট। অন্য কোনও পথে একে ধরা যাবে না। সরাসরি কথা বলাই ভাল।
‘আপনার নিজের কী মনে হচ্ছে সমরবাবু?’
সমর বলল, ‘আমি কি একটা সিগারেট খেতে পারি ডাক্তারবাবু?’
‘না, পারেন না। একমাস হতে চলল, আমি সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা করছি। সামনে বসে কেউ খেলে আমারও খেতে ইচ্ছে করবে। আপনি বরং একটা চুইংগাম খান। ’
ডাক্তার রায় টেবিলের ড্রয়ার টেনে চুইংগাম বের করলেন। সমরকে দিলেন। সমর মোড়ক ছিঁড়ে মুখে দিল। এটা একটা পুরনো পদ্ধতি। অভ্যেসের বাইরে থেকেও রোগী কতটা মনোসংযোগ করতে পারছে সেটা খানিকটা বোঝা যায়। শুধু চুইংগাম নয়, লেখার দরকার হলে পেনের বদলে পেনসিল, শীত থাকলে হালকা করে পাখা চালিয়ে দিয়ে রোগীকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলার চেষ্টা হয়। আজকাল বেশিরভাগ মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ এই পদ্ধতি মানে না। ডাক্তার রায় মানেন। তিনি পুরনো দিনের মানুষ। তিনি দেখেছেন, পুরনো পদ্ধতিতে অনেক সময় কাজ হয়। পেশেন্টের ‘কনসেনট্রেশন এবিলিটি’ কতটা নষ্ট হয়েছে তা অনেকটাই মাপা যায়।
আজ মাপা গেল না।
সমর চুইংগাম চিবোতে চিবোতে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘সেটাই তো ঠিক বুঝতে পারছি না ডাক্তারবাবু। অসুবিধেটা সেখানেই। বরং মনে হচ্ছে, আমি পুরোপুরি সুস্থই আছি। প্রথমদিকে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই ঘটনার পর রাতে ঘুম হবে না। সারাদিন চোখ লাল হয়ে থাকবে। কাজে ভুল হবে। আবোল তাবোল বকব। আস্তে আস্তে বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হব। দেখলাম, কিছুই হল না। সবকিছু ঠিকঠাক রয়েছে। লাস্ট উইকে অফিসে একটা প্রোমোশন হয়েছে। বড় কিছু নয়। রুটিন প্রোমোশন! তবু হয়েছে। পাগল কখনও রুটিন প্রোমোশনও পায় না। ডাক্তারবাবু, শুধু অফিসে নয়, বাড়িতেও কোনও ঝামেলা নেই!’
‘কী করে বুঝলেন ঝামেলা নেই?’ ডাক্তার রায় মাঝপথে প্রশ্ন করলেন।
‘রবিবার মাসকাবারি বাজার করার জন্য দোকানে গেছি। গিয়ে দেখি ফর্দ আনিনি। নতুন কিছু নয়, প্রত্যেকবারই ফর্দ আনতে ভুলে যাই। এবারও গেছি। ভাবলাম, এবার অসুবিধে হবে। কিন্তু হল না। বাড়ি ফিরে দেখি, জিরে ছাড়া সব মনে করে নিয়ে এসেছি। মাথা খারাপ হলে কি এতটা মনে থাকত? ডাক্তারবাবু, আপনার কি এর পরেও মনে হচ্ছে আমার কোনও সমস্যা হয়েছে?’
ডাক্তার রায় ভেবেছিলেন, রোগীর কথা শুনতে শুনতে তাঁর বিভ্রান্তি কাটবে। উপসর্গ ঢেকে রাখা পরদা সরে যাবে। তিনি নিশ্চিন্ত হবেন। তা হল না। উলটে বিভ্রান্তি বাড়ল। খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ সমরবাবু, একটা সমস্যা আপনার হয়েছে। সমস্যা ছাড়া কেউ তিন বছর পর তার মৃত বাবার দেখা পায় না। শুধু দেখা নয়, নিয়মিত দেখা পাওয়া এবং কথাবার্তা বলা। ডবল সমস্যা। এই সমস্যার ঘটনা আপনার জীবনে ঘটছে। সাইকোলজির ভাষায় এই সমস্যাকে বলা হয়, হ্যালুসিনেশন।
‘এই সমস্যার সমাধান কী? সমাধান কি আছে, নাকি আমি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাব?’
‘অজস্র সমাধান আছে। ’
‘কী ধরনের সমাধান? পাগলা গারদে ভরতি হতে হবে, না শক্ নিতে হবে?’
‘দুর সমরবাবু, আপনি অযথা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। মানসিক অসুখের চিকিৎসায় পৃথিবী কতদূর এগিয়ে গেছে আমরা ভাবতেও পারি না। আমাশা সারাতে পারব না, মাথার অসুখ সারাতে কয়েকটা ট্যাবলেটই যথেষ্ট। তা ছাড়া, আপনি একজন ইনটেলিজেন্ট পার্সন। অসুখ আপনাকে মোটেই সেভাবে চেপে ধরতে পারেনি। আপনি ইচ্ছে করলে এবার একটা সিগারেট ধরাতে পারেন। ’
সমর সিগারেট ধরাল না। বলল, ‘তা হলে দয়া করে তাই করুন, কয়েকটা ট্যাবলেটই দিন। আমার মনে হচ্ছে আর কয়েকটা দিন এরকম চলতে থাকলে, হয় পুরোপুরি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাব, নয় হঠাৎ একদিন বাবাকে নিয়ে বাড়ি চলে যাব। ’
ডাক্তার রায় গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, দেব। কিন্তু তার আগে আমাকে আর একটু কনফার্ম হতে হবে। ফ্লু আর ম্যালেরিয়া দুটোই জ্বর, কিন্তু দুটো জ্বর এক নয়। তা ছাড়া সমরবাবু, আপনি কি মনে করেন যে আপনি চাইলে আপনার মৃত বাবাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন? এটা কি সম্ভব?’
‘সম্ভব নয়। কিন্তু আমি কী করব বলুন তো? ঠিকমতো পাগলও হচ্ছি না, অথচ বাবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। আমাকে তো একটা কিছু করতে হবে। ’
সমর এবার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল।
ডাক্তারবাবু হাসলেন। ডাক্তারদের বানানো হাসি। রোগীকে সাহস জোগানোর জন্য এই হাসি তাঁরা ব্যবহার করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই রোগী সাহস পায় না, ঘাবড়ে যায়। সমরও কি ঘাবড়ে গেল?
‘সমরবাবু, আপনি মনে হয় সবটাই বলেছেন, তবু আবার আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করছি। প্রথমবার বলার সময় অনেক খুঁটিনাটি জিনিস বাদ যায়। আশা করি এবার সবটাই বলতে পারবেন। প্রশ্নের উত্তর গুলো পেলে আমি আপনার ওষুধ দিতে পারব। প্রথম ঠিক কী ভাবে আপনার সঙ্গে আপনার বাবার দেখা হল সেটা আর একবার বলুন। গোড়া থেকে বলবেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ভেবে ভেবে বলুন। কোন পয়েন্ট বাদ না গেলেই ভাল। ’
সমর সিগারেট ধরাতে গিয়ে থমকে গেল। সিগারেট প্যাকেটে ভরে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, একটা চুইংগাম দেবেন?’
ডাক্তার রায় চুইংগাম বের করে দিলেন। সমর মুখে দিল। তারপর শুরু করল—
‘তারিখটা মনে নেই। বারটা মনে আছে। শনিবার, হাফ ছুটি। লেকের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করছি। রোজ করি না। ইচ্ছে থাকলেও করা যায় না। সন্ধেবেলা লেকে বড্ড ভিড় থাকে। তা ছাড়া আপনি তো জানেন, আজকাল অন্ধকারে লেক আর সেফ নয়। যেদিন দিনের আলো পাই সেদিন ঢুকি। সেদিন যেতে যেতে একটা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে মনে হল, রোজ চলে যাই, আজ জলের ধারে একটু বসে গেলে ক্ষতি কী? ক্ষতি কিছু নেই। বসলাম। বেশ লাগছিল। ভিড় নেই। হাওয়া দিচ্ছে। ফ্রেশ হাওয়া। কলকাতায় ফ্রেশ হাওয়া আর কোথায়? ভাবলাম, মাঝেমধ্যে ঝর্নাকে নিয়ে আসব। ঝর্নার কথা তো আপনাকে আগেই বলেছি। আমার স্ত্রী। ’
ডাক্তার রায় বললেন, ‘হ্যাঁ, বলেছেন। আপনাদের বিয়ে কতদিন হয়েছে? আপনার বাবা মারা যাওয়ার পর?’
‘না, আগে। বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। বাবা মারা গেছেন পরে। এই ডিসেম্বরে তিন বছর হবে। ’
‘ঠিক আছে। বলুন তারপর কী হল। কখন আপনার সঙ্গে আপনার বাবার দেখা হল?’
‘বেশ ভাল লাগছিল। উঠতে ইচ্ছে করছেনা। এটা-সেটা ভাবতে ভাবতে আলো মরে এল। খেয়াল করিনি পাশে কখন বৃদ্ধ মানুষটা এসে বসেছে। খেয়াল করলাম চেনা গলা শুনে। চমকে তাকিয়ে দেখি বাবা। ’
ডাক্তার রায় আবার কথা বললেন, ‘চমকে তাকালেন? মানে দেখার আগেই চমকে গেলেন? নাকি দেখার পর চমকালেন। ভাল করে মনে করার চেষ্টা করুন। ’
‘দেখে চমকালাম। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। গায়ে নস্যি রঙের একটা চাদর। এখনও গায়ে চাদর দেওয়ার সময় হয়নি, তাও বাবা গায়ে চাদর দিয়েছে। হাসিমুখেই বাবা অল্প কাশল। বলল, আর দেরি করিসনি খোকা। এবার ওঠ। জলের হাওয়া বেশিক্ষণ ভাল না। তোর অভ্যেস নেই, ফট করে ঠান্ডা লেগে যাবে। ভাবলাম মনের ভুল। খুব ভয় পেলাম। ভয়ংকর ভয়। একেবারে সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম। মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। একটুও দেরি করিনি। আসার সময় বাবাকে বলেও এলাম না। পেছনেও তাকালাম না। সেদিন রাতটা প্রায় না ঘুমিয়ে কাটল। সোমবার অফিসের কাজেও মন দিতে পারলাম না। ছটফট করছি। হাফ-ছুটি নিয়ে বেরিয়ে এলাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, লেকের ভেতরে ঢুকব না। বড় রাস্তা ধরে চলে আসব। পারলাম না, ঢুকলাম। লেকের ধারে গিয়ে আবার বেঞ্চে বসলাম। ’
‘একই বেঞ্চে তো? মানে সেই আগের দিনের জায়গায় বসলেন? সেম প্লেস?’
‘না, আলাদা বেঞ্চে। ’
‘ও। ঠিক আছে, বলুন। আপনি একটু জল খাবেন সমরবাবু?’
‘হ্যাঁ খাব। ’
জল এল। সমর দু’চুমুক জল খেল। খেয়ে গেলাস সরিয়ে রাখল। ডাক্তার রায় মন দিয়ে সমরের জল খাওয়া দেখলেন। তিনি আশা করেছিলেন, সমর গেলাসের পুরো জলটাই খাবে, এবং সম্ভবত এক চুমুকেই খাবে। মানুষের জল খাওয়ার প্যাটার্ন দেখলে তার বিপন্ন অবস্থা অনেকটা বোঝা যায়। সেই জন্যই তিনি জলের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কাজ হল না। বরং বলা ভাল উলটো কাজ হল। এর জল খাওয়া দেখে মনে হল, লোকটার মধ্যে একেবারেই বিপন্ন বোধ নেই।
সমর আবার বলতে শুরু করল।
‘তখন দুপুরের আলো ফটফট করছে। বেঞ্চের ওপর জারুল গাছের ছায়া পড়েছে। গতদিনের ঘটনা মনে পড়তে নিজের ওপর কেমন লজ্জা লজ্জা করল। ছিঃ, সামান্য মনের ভুলের জন্য কত কী ভেবেছিলাম। একটা বাদামওলার কাছ থেকে এক ঠোঙা বাদাম কিনলাম। দশ টাকার নোটের ভাঙতি দিতে গিয়ে লোকটা একটা ছেঁড়া পাঁচ টাকা দিল। বেশি ছেড়া নয়। অল্প ছেড়া। তবু ঝগড়া করলাম। ইচ্ছে করেই করলাম। বসে বসে বাদাম খেলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। ’
‘আপনার বাবা এলেন?’
‘না, এলেন না। পরের দিনও এলেন না। তার পরের দিনও নয়। এলেন এক সপ্তাহ পর। ’
‘এই ক’দিন আপনি রোজ লেকে গিয়ে বসতেন?
‘হ্যাঁ, বসতাম। ’
‘কেন বসতেন? আপনি চাইছিলেন আপনার মৃত বাবা আসক?’
‘না, চাইতাম তিনি না আসুন। প্রথম দিনের ঘটনা যে ভুল ছিল সেটা নিজের কাছে ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু তা হল না। তিনি এলেন। সেই আবছা সন্ধেবেলা বাবা পাশে এসে বসলেন। গায়ে সেই নস্যি রঙের চাদর। ’
‘সেদিন কী বললেন? আপনাকে উঠে যেতে বললেন? বাড়ি ফিরে যেতে বললেন?’
‘না, বললেন না। অন্য সব ছোটখাটো কথাবার্তা হল। বাড়ির ট্যাক্স জমা দিয়েছি কিনা, রান্নাঘরের পেছন দিকে একটা জলের পাইপ লিক করছিল, সেটা সারালাম কিনা। এইসব ছোটখাটো ব্যাপার। ’
ডাক্তার রায় সামান্য হেসে বললেন, ‘সেকী! আপনি এত কথা বললেন? আপনার ভয় করল না?’
‘না ভয় করল না। বরং বাবার সঙ্গে কথা বলতে এখন আমার ভালই লাগে। বেশ দু’জনে বসে থাকি। বেশিরভাগ সময়েই কোনও কথা হয় না। চুপচাপই থাকি। বাবার পাশে এভাবে কতদিন যে বসিনি। ছোটবেলায় আসানসোলে বড় হয়েছি। আবছা মনে পড়ে, ছুটির দিন বিকেলে বাবা পার্কে নিয়ে যেত। বল নিয়ে খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে যেতাম। বেঞ্চে বাবার পাশে গিয়ে বসতাম। সন্ধে হত। বাবা একসময়ে বলত, চল, মা চিন্তা করবে। তারপর কত বছর কেটে গেছে। পাশাপাশি বসা হয়নি। ’
‘ও। আচ্ছা সমরবাবু, আপনার বাবার গলার স্বরটা কেমন মনে হল?’
‘নরমাল। বাবার যেমন গলা। বুকে একটা কফ জমা-জমা গলা। ’
‘ও। সেই জন্যই উনি বোধহয় গায়ে চাদর দিয়ে আসেন। ’
‘না। ওই জন্য নয়। আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাবা, এই গরমে তুমি গায়ে চাদর দিয়ে আছ কেন? তোমার কি জ্বর হয়েছে? বাবা বলল, না, আসলে গায়ের পাঞ্জাবিটা ছেঁড়া। কাঁধের কাছে বিচ্ছিরি হাঁ। চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছি। ছেঁড়া পাঞ্জাবি দেখে তুই যদি আবার রাগ করিস। দ্যাখ মানুষ মরাকে ভয় করে, আর আমি এখনও কেমন বাঁচা মানুষদের ভয় পাই। বলে বাবা হাসল। ’
‘হাসল?’ ডাক্তার রায় সোজা হয়ে বসলেন।
‘হ্যাঁ, হাসল। ’
‘জোরে না আস্তে?’
‘বাবা কখনও জোরে হাসতনা। ’
‘ঠিক আছে। শেষ প্রশ্ন, আপনি এই এক মাসে মোট কতবার বাবাকে দেখেছেন তার কোনও হিসেব আছে?’
‘না। তবে খুব বেশিবার নয়। পাঁচ-সাত বার হবে। ’
‘এটা কোনও প্রশ্ন নয়, কৌতূহল বলতে পারেন। আপনি কি আপনার স্ত্রীকে বিষয়টা জানিয়েছেন?’
‘এখনও জানাইনি। তবে মনে হচ্ছে এবার জানাতে হবে। জানানোর ছোট একটা প্রয়োজন হয়েছে। ডাক্তারবাবু, আপনি কি আমাকে এবার ওষুধ দেবেন?’
‘দেব, তবে আজ নয়। আরও কিছু দিন যাক। এই ক’দিন আপনি লেকে ঢুকবেন। হ্যালুসিনেশন অনেক সময় নির্ভর করে জায়গার ওপর। এখন আমার মনে হচ্ছে, আপনার সে রকম কিছু হচ্ছে। গাছপালা, জল, নির্জনতা এবং একাকিত্ব আপনাকে আপনার বাবার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেই জন্যই আপনার মধ্যে এই বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। সমস্যা হল, এই মুহূর্তে আপনি এই বিভ্রান্তি পছন্দ করছেন। আপনি মৃত বাবার সঙ্গ চাইছেন। আপনি ভাবছেন, আপনার কাছে তিনি আসছেন। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। আপনি তাঁর কাছে যাচ্ছেন। এখন দেখার ব্যাপার, আপনার এই অবস্থাটা কতদিন চলে। কতদিন আপনি এই সঙ্গ পছন্দ করেন, কতদিন আপনি তাঁর কাছে যেতে চান। আমি চাই, আপনি নিজেই সে-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন। যখন মনে হবে, এনাফ, আর নয়, দেন ইউ কাম টু মি। আমি আপনাকে ওষুধ দেব। এখন জোর করে দিয়ে কোনও লাভ হবে না। ’
সমর বেরিয়ে দেখল বিকেল হতে আর বেশি দেরি নেই। সে একটা সিগারেট ধরাল। ডাক্তার কিছু পারল না। পারলে ভাল হত। মনে হচ্ছে ডাক্তার বদলাতে হবে। সে হাঁটতে শুরু করল। এখান থেকে লেক বেশি দূরে নয়। সে ঠিক করল লেকে যাবে। বিষয়টা নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়?
সন্ধের পরপর সমর বাড়ি ফিরে দেখল, ঝর্না বসার ঘরে সোফায় বসে। তার হাতে ছুঁচ, অনেক রঙের সুতো, এবং একটুকরো কাপড়। ঝর্নার দিদির বাচ্চা হবে। সে কাঁথা সেলাই করতে বসেছে। অনেক ভেবেচিন্তে কাঁথার ওপর সে পেনসিল দিয়ে একটা কম্পিউটার এঁকেছে। মনিটরের সামনে কি-বোর্ড। দু’হাজার সালের বাচ্চার কাঁথায় কম্পিউটার আঁকার কথা ভাবতে পেরে তার মনটা খুশিখুশি। দিদি-জামাইবাবুকে তাক লাগানো যাবে। ঝামেলা হচ্ছিল সুতোর রং নিয়ে। কোন সুতোয় কম্পিউটার সেলাই হবে?
সমর ঢুকে টিভি চালাল। ফাল্গুনী পাঠকের গান হচ্ছে। সে সোফায় বসে গান শুনতে লাগল। গুনগুন করে গানের সঙ্গে গলা মেলাল। গান শেষ হওয়ার পর মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘ঝর্না, তুমি সেলাই করছ?’
‘হ্যাঁ, দিদির ছেলের জন্য কাঁথা করছি। ’
‘তুমি শিয়োর যে দিদির ছেলে হবে?
‘হ্যাঁ, শিয়োর। কাল রাতে, দিদি মেয়ের স্বপ্ন দেখেছে। বাচ্চা হওয়ার সময় মেয়ের স্বপ্ন দেখলে ছেলে হয়। ’
‘কে বলেছে?’
‘সুতপা বলেছে। ’
‘বাঃ! ঝর্না, তুমি চট করে একটা জিনিস একটু সেলাই করে দেবে?’
‘কি?’
‘বাবার বাদামি রঙের পাঞ্জাবিটা। কাঁধের কাছে না কোথায় যেন একটু ছেঁড়া আছে দেখে নিয়ো। বাবার আলমারিতে আছে। মানে হয় নীচের দিকে। প্লিজ একটু খুঁজে নাও। ’
ঝর্না অবাক হয়ে মুখ তুলল। বলল, ‘কেন? তোমার কি পাঞ্জাবি কম পড়েছে? বাবার পচাধচাটা বের করে পরতে হবে? তোমার হঠাৎ হল কী? ওগুলো যা অবস্থা, রতনের মা-ও নেবে না। অনেকদিন হয়ে গেল, এবার ভাবছি সবকটা ফেলে দেব। কে পরবে ওসব?’
‘বাবা। ’ ঠান্ডা গলায় টিভির দিকে তাকিয়ে সমর বলল।
‘কী বললে? বাবা পরবেন? তুমি কি এবার মৃত মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা শুরু করলে? ছি ছি!’
সমর জানত ঝর্না এই প্রশ্ন করবে। করাটা স্বাভাবিক। খুবস্বাভাবিক। সেই জন্য এতদিন সে ব্যাপারটা গোপন রেখেছে। পাঞ্জাবির প্রসঙ্গ না এলে গোপনই রাখত। তিন বছর আগে মরে যাওয়া বাবার সঙ্গে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার ঘটনা বলে বেড়াবার জিনিস নয়। স্ত্রীকেও নয়। প্রয়োজন হল বলেই বলতে হল।
সমর হাসল। আশ্বস্ত করার হাসি। বলল, ‘তুমি যদি সবটা শুনতে চাও, বলতে পারি। শুনবে?’
‘না, শুনব না। সব বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করাটা ঠিক নয়। ’ ঝর্না মাথা নামিয়ে সেলাইতে মন দিতে গেল। কম্পিউটারের রং কি হলুদ সুতোয় মানাবে? না, মানাবে না। লাইট ব্রাউনে কেমন হবে?
‘বাবা পাঞ্জাবিটার কথা জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, কোন পাঞ্জাবি? আমার তো মনে নেই। তবে তুমি যদি পরবে বলো খুঁজে এনে দিতে পারি। বাবা বলল, খুঁজতে হবে না। আমার কাঠের আলমারির নীচের তাকে ভাঁজ করাই আছে। আমি বললাম, ঠিক আছে এনে দেব খন। বাবা বলল—’
ঝর্নার হাত থেকে সেলাইয়ের জিনিস পড়ে গেছে। সে গভীর ভয়ে তাকিয়ে আছে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকার কারণও আছে। গত সপ্তাহে রতনের মাকে নিয়ে পরিষ্কার করতে সে শ্বশুরমশাইয়ের আলমারি খুলেছিল। অত বড় জিনিসটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। জামাকাপড়গুলো বিলিয়ে টিলিয়ে দিয়ে অনায়াসে আলমারিটা এবার ব্যবহার করা যায়। তখনই সে দেখে নীচের তাকে বাদামি রঙের পাঞ্জাবি রয়েছে। রতনের মাকে দেবার জন্য সেটা টেনে বের করা হয়। খুলে দেখা যায় কাঁধের কাছে এত বড় হাঁ। রতনের মা মুখ বেঁকিয়ে বলে, না বউদি, রতনের বাবায়ে ছেঁড়া কাপড় গায়ে দেয় না। তুমি ধুতিমুতি আছে কিনা দ্যাখো। সোয়টার নেই? ফুলহাতা সোয়েটার? পাঞ্জাবির কথা সমরের জানার নয়। তবু জেনেছে। কীভাবে জানল? কে বলল? রতনের মা তো বলবে না।
সমর বলে চলল, ‘বাবা বলল, না থাক। আনতে হবে না। ছেঁড়া জামা গায়ে দিলে বউমা রাগ করত। তবে কী জানিস খোকা, কতগুলো জামাকাপড়ের ওপরে কেমন যেন মায়া পড়ে যায়। বউমাকে কয়েকবার সেলাইয়ের কথা বলেছিলাম। বেচারি সংসারের পাঁচ ঝামেলায় বোধ হয় সময় পায়নি। ’
‘বাবার সঙ্গে তোমার দ্যাখা হল কোথায়? শ্মশানে?’
সমর উত্তর দিল না। আবার হাসল। বলল, ‘দ্যাখা হল না, দ্যাখা হয়। মাঝেমধ্যেই দ্যাখা হয়। ’
‘দ্যাখা হলে কি তোমাদের শুধু পাঞ্জাবি নিয়ে কথা হয়?’ ঝর্না ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল। তার চোখে এখন ভয়ের বদলে সন্দেহ।
‘না, আরও কথা হয়। তবে সিরিয়াস কিছু নয়। বাড়ির ট্যাক্স জমা দিয়েছি কিনা। বাথরুমের পাইপটা সারানো হয়েছে কিনা। রাতে শোওয়ার সময় যেন অ্যাসিডের ওষুধটা খেতে না ভুলি। পরশু নাকি খাইনি। ’
‘পরশু ওষুধ ছিল না। কাল সকালে কিনেছি। ’
‘হবে হয়তো। আমার মনে নেই। আমার তো মনে হয়, রোজই খাই। ’
ঝর্না বলল, ‘বাবা আমার কথা কিছু বলে না?’
‘হ্যাঁ, বলে। ’
‘কী কথা?’
‘থাক, তোমার শুনে দরকার নেই। তুমি পারলে পাঞ্জাবিটা সেলাই করে রেখো। বুড়ো মানুষের শখ। বড় কোনও শখ নয়, ছোট শখ। ’
ঝর্নার ভুরু আরও কুঁচকে গেছে। ওষুধের কথাটা সমর জানল কী করে? টানা এক বছর ধরে সে এই ওষুধ খাচ্ছে। একদিন না খেলে মনে রাখা অসম্ভব। বরং বহুদিন ওষুধ না খেয়েই সমর বলেছে, ‘এই তো খেলাম ঝর্না, আবার দিচ্ছ কেন?’ সেই সমর আজ ওষুধের কথা বলল কেন?
পরের দিন সমর অফিসে বেরোতেই সুতপাকে ফোনে ধরল ঝর্না। সুতপা কলেজে একসঙ্গে পড়ত। কলেজ পেরোতে পারেনি, কিন্তু পৃথিবীর প্রায় সবরকম উদ্ভট ব্যাপার সে জানে। ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করার পর হাসতে হাসতে বলল, ‘কুছ পরোয়া নেই, এবার সংস্কার কুসংস্কারের ওপর অনার্স দেব। দেখব কোন ব্যাটা ফেল করায়। ’ ইউনিভার্সিটিতে এ ধরনের কোনও বিষয় না থাকায় বেচারির আর পাশ করা হল না, কিন্তু এত বছর পরেও সুতপার সঙ্গে পুরনো বন্ধুরা অনেকে যোগাযোগ রাখে। না রেখে উপায় নেই। হাতের তালু চুলকানো, কড়ে আঙুল কাঁপা, চোখের পাতা নাচা, ঘরে চামচিকে ঢুকে পড়ার মতো সহজ বিষয় থেকে শুরু করে বেরোতে গিয়ে কাশি, টিকটিকির আরশোলা ধরা, মেঘের ফাঁকে সূর্যোদয়ের মতো জটিল ঘটনার ভালমন্দ প্রতিক্রিয়া তার একেবারে জলের মতো কণ্ঠস্থ।
‘সুতপা, আমি ঝর্না বলছি। ভাল আছিস?’
‘আদিখ্যেতা রাখ। কী দরকারে ফোন করেছিস সেটা বল, ব্যস্ত আছি। ’
‘সুতপা, মরা মানুষ দেখলে কী হয় রে?’
‘কতদিনের মরা? টাটকা না বাসি?’
‘মরা কতদিনে বাসি হয় তা তো বলতে পারব না। তবে এটা বছর তিনেকের ব্যাপার। ’
‘ঠিক আছে বুঝেছি। কেস তোর এক থেকে দশের মধ্যেই পড়েছে। এক থেকে দশ তোর একটা স্ল্যাব, আবার এগারো থেকে উনত্রিশ আর একটা স্ল্যাব। তিরিশের পর কেস অন্য। যাক মরা কতবার দেখা গেছে?’
‘ঠিক বলতে পারব না। মনে হয় বেশ কয়েকবার। ’
‘ঠিক আছে, বুঝেছি। চট করে শুনে নে। এক বার বলব। নো রিপিট। একবার দেখলে ঘরে টাকা আসে। দু’বার দেখলে ঘরে জিনিস আসে। তিনবার বা তার বেশি দেখলে ঘরে মানুষ আসে। ব্যস হল? এবার যেন ছেড়ে দাও বাছাধন। ’
‘সুতপা দাঁড়া, ফোন ছাড়িস না। তুই কি ব্যাপারটা পুরো শুনতে চাস?’
‘না শুনতে চাই না। ’
সুতপা ফোন রেখে দিলে ঝর্না ভাবতে বসল। সমর কি পাগল হয়ে গেছে? মনে হয় না। কারণ এ ব্যাপারে সে আজ একটা পরীক্ষা করেছে। নুন ঝাল পরীক্ষা। ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে মাঝে মধ্যে মায়ের এক দূর সম্পর্কের ভাই আসত। বেশি আসত না, বছরে একবার-দু’বার আসত। মানুষটা একেবারে বদ্ধ উন্মাদ ছিল। টোটাল ম্যাড যাকে বলে। চুল এলোমেলো। এক মুখ দাড়ি। চোখ দুটো ছিল বড় বড় আর লাল। পাগলটা বাড়িতে এসেই বলত, ‘দিদি, ভাত দে। এক্ষুনি দে, একমিনিট দেরি করবি তো তুলকালাম করব। তোর ছেলে মেয়েকে জ্যান্ত চিবিয়ে খাব। ’ তাড়াহুড়ো করে মা ভাত চাপাত, ডাল রাঁধত, ডিমের তরকারি করে দিত। খাবার তৈরি করতে গিয়ে মা খালি কাঁদত আর চোখ মুছত। অত কাদলে যা হবার তাই হত। একটা-না-একটা ভুল হবেই। মায়ের ও হত। বেশির ভাগ দিনই রান্নায় নুন দিতে ভুলে যেত, ঝাল পড়ত না। পাগলের কিছু এসে যেত না। সে নুন ঝাল ছাড়াই সাপেট সুপটে সব খেয়ে নিত। খেয়ে হেসে বলত, ‘বাঃ বড় ভাল রেঁধেছিস দিদি। তখন থেকেই ঝর্না জানে পাগলের নুন ঝালের স্বাদ নেই। আজ রান্নার সময় সে ডালে ইচ্ছে করে নুন দেয়নি। সমর সেই ডাল মুখে দিয়েই সরিয়ে রাখল। পাগল হলে এটা হত না। সুতরাং মনে হচ্ছে, সমর হয় বদমাইশি করছে, নয়, ভড়কে দিতে চাইছে। ভড়কে দিতে চাইলে ঠিক আছে। স্বামী মাঝেমাঝে ভড়কে দিলে খারাপ নয়, শরীরে একটা শিরশিরানি আসে। কিন্তু বদমাইশি করলে খারাপ লাগে। তিন বছর আগে সামান্য একটা পাঞ্জাবি সেলাই করা হয়নি বলে ভূতের ভয় দেখানো ভাল কাজ নয়। শ্বশুরমশাইয়ের কোন দায়িত্বটা সে পালন করেনি? জামাকাপড় গুছিয়ে দেওয়া, সময় করে খাবার দেওয়া, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওষুধ—সবই করেছে। সংসারে কাজ বাড়লে তো সব নিজের হাতে করা যায় না। তখন রতনের মা করেছে। কাজের লোক করলে একটু-আধটু গোলমাল তো থাকবে। কাজের লোকতো আর নিজের লোক নয়, সে হল কাজের লোক। সে খাটের তলা ঝাট দেবে না, দুপুরে বৃষ্টি এলে ছাদে কাপড় ভিজবে, খেতে দিতে একটু দেরি হবে। আজকালকার দিনে সেগুলো বড় করে বলার কী আছে? কিছু নেই। তাও আবার এতদিন পরে! ছেলের বউ মানেতো আর দাসী নয় যে সব সময় জো হুজুর হয়ে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকতে হবে। সব থেকে বড় কথা, শ্বশুরমশাই মুখ ফুটে কখনও এসব বলেননি। তখন যখন বলেননি তা হলে এখন কেন সমর পাঞ্জাবির প্রশ্ন তুলল?
ভাবতে ভাবতে সমরের ওপর ঝর্নার রাগ হতে শুরু করল। দিদিকে একবার ফোন করে ব্যাপারটা জানানো উচিত। পুরুষমানুষকে বেশি দূর এগোতে দেওয়া ঠিক না। একবার ঘাড়ে চড়লে, পরক্ষণেই মাথায় চড়তে চাইবে। এখন পাগল সেজে ভুতের ভয় দেখাচ্ছে, এরপর পাগল সেজে কামড়াতে আসবে। সমরকে অফিসে ফোন করে ঝগড়া করলে কেমন হয়? ভাল হয়। ঝর্না ফোন তুলল। সমরকে টেবিলে পাওয়া গেল না। সে বড়বাবুর ঘরে মিটিং করছে। জরুরি মিটিং, ডেকে দেওয়া যাবে না। এতে ঝর্না আরও রেগে গেল।
রেগে গেলে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়। ঝর্নারও পেল। সে দিদির ছেলের কাঁথা ফেলে একতলায় গেল। আলমারি খুলে শ্বশুরমশাইয়ের পাঞ্জাবি বের করল। বহু ব্যবহৃত পাঞ্জাবির বাদামি রং ঝলসে গেছে। রং মিলল না, মেলার কথাও নয়। রং-ঝলসানো সুতো পাওয়া যায় না। তবু বাদামি সুতো দিয়ে সে কাঁধের কাছটা সেলাই করল। আজ ফিরুক সমর। মুখের ওপর এই পাঞ্জাবি ছুড়ে দিয়ে তবে সে রাগ কমাবে। ততক্ষণে সে রেগেই থাকবে।
বাবা আজ একটু দেরি করে এল। সমর ভেবেছিল, এত যখন দেরি হচ্ছে তখন আর আসবে না। কিন্তু এল।
অন্ধকার হতে আর বেশি দেরি নেই। বিকেলের হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। একটু পরেই সন্ধের বাতাস বইতে শুরু করবে। গাছে গাছে পাখিদের ফেরাও প্রায় শেষ। জায়গা নিয়ে গভীর ঝগড়া হচ্ছে ঠিকই, তবে অন্ধকার হওয়ার আগে সে সব মিটে যাবে। যে যার মতো বাসা পেয়ে যাবে। যে পাবে না, সে হয় তো আজকের রাতটার জন্য অন্যকারও বাসায় থেকে যাবে। ঝগড়ার মতোই এদের ভালবাসা গভীর।
সমরের মনটা ভাল নেই। বসের সঙ্গে মিটিংয়ে সামান্য কথা কাটাকাটি হল। সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, অফিস থেকে বেরোনোর আগে ঝর্না ফোন করল। বলল, ‘রবিবার দিদির ওখানে চলে যাব। ’
‘কেন?’
‘কেন বুঝতে পারছ না?’
‘না ঝর্না। হঠাৎ কী হল তোমার?’
‘ভেবে দেখলাম, হয় তুমি পাগল, নয় তুমি বদমাইশ। স্বামী হিসেবে দুটোই খুব খারাপ। তাই চলে যাব ঠিক করেছি। ’
‘কী বলছ টা কী? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা। ’
‘তোমাকে বুঝতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি। আমার থেকে তুমি তোমার মরা বাবাকে নিয়েই অনেক ভাল থাকবে। ভাল কথা, রতনের মাকে দিয়ে আজ তোমার বাবার ঘর পরিষ্কার করে রেখেছি। ইচ্ছে করলে ওনাকে নিয়ে আসতে পারো। জগে করে খাবার জল রাখব কি?’
‘ছিঃ ঝর্না, একজন মৃত মানুষকে নিয়ে তুমি ঠাট্টা করছ?’
‘আমি করছি না তুমি করছ? বউকে দিয়ে মরা মানুষের জামা সেলাই করানোটা কী ধরনের সিরিয়াস কাজ বলে তুমি মনে করছ? যাক গোড়াতেই ধরতে পেরেছি, এটাই রক্ষে। দিদি বলল, এক মিনিট দেরি করবি না। কালই চলে আয়। আমি কাল যাব না। জিনিসপত্র গোছাতে হবে। লকার থেকে গয়নাতোলার ব্যাপার আছে। আমি ঠিক করেছি, রোববার যাব। বাবার সঙ্গে দ্যাখা ট্যাখা করে যদি তোমার সময় হয় তা হলে দয়া করে ফেরার পথে ধোপা বাড়ি থেকে আমার শাড়িগুলো নিয়ে আসবে। ’
বাবা আজ নিঃশব্দে এল না। পায়ে শব্দ হল। সমর সরে বসল।
‘কীরে, আজ এতক্ষণ বসে আছিস?’
‘তোমার জন্য বসে আছি বাবা। ’
‘ঠিক করিসনি। দুম করে ঠান্ডা লেগে গেলে জ্বরজ্বারিতে পড়ে যাবি বলেছি না। কোনও কথা যদি তোরা শুনিস। শীতের আর কতদিন দেরি?’
‘বেশি নয় বাবা। এটা হল গিয়ে তোমার অক্টোবর। ’
‘ঝর্নার হাঁটুর ব্যথাটা কমেছে? শীতে বেচারি কষ্ট পায়। ’
‘কমেছে। তবে শীতে জ্বালাবে। ’
‘কত করে বললাম, তিষির তেল কুসুম কুসুম গরম করে লাগাতে। তোরা তো শুনবিনা। কাঁড়ি কাঁড়ি ওষুধ গিলবি। একবার বুঝলি, আমার ডান হাতে খুব ব্যথা হত। তখন তুই ছোট। তোর মা মাঝরাতে উঠে গরম তেল লাগিয়ে দিত। তিষির তেলে ফোড়ন দিলে একটা গন্ধ হয়। ’
‘বাবা, তুমি ভাল আছ?’ সমর অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করল। ’
‘কী জানি। মনে হয় না ভাল আছি। তোদের জন্য চিন্তা হয়। অদ্ভুত অদ্ভুত লোকদের জন্য মন কেমন করে আজকাল। থাক সে কথা। ’
‘বলো না। তুমি তো কিছুই বলো না। খালি আমাদের কথাই জানতে চাও। ’
‘মধ্যমগ্রামের পিসির কথা মনে আছে তোর? থাকার কথা নয়। আমারই ছিল না। হঠাৎ সেদিন মনে পড়ল। খুব কষ্টে ছিল রে সমর। পাড়ার লোকের কাছে চেয়েচিন্তে খেত। তারা প্রথমদিকে দু’বেলা ভাত দিত। শেষবার শুনেছিলাম, একবেলা বন্ধ করে দিয়েছে। ভেবেছিলাম কিছু করব। করা হয়নি। অনেক কিছুই করা হয়নি। ’
বাবা চুপ করল। অন্ধকার হয়ে গেছে। আবছা অন্ধকার নয়, ঘন অন্ধকার। পাখিদের ঝগড়া আর শোনা যাচ্ছে না। বেঞ্চের মাথার দিকে দীর্ঘ ল্যাম্পপোস্টে একটা হলুদ আলো জ্বলছে। পোকার ঝাঁক সেই আলো ঢেকে দিতে দল বেঁধে এসেছে।
বাবা বলে চলেছে, ‘তারপর ধর, আসানসোল হাইস্কুলের মুরারি। মুরারি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। তিরিশ বছর দেখা হয়নি। তবু কী জানি আজকাল তার কথা খুব মনে পড়ে। কোনও কারণ নেই, তবু পড়ে। মনে পড়ে গণিত শিক্ষক সুশীল স্যারের কথা। কে জানে মানুষটা কতদিন আগে মারা গেছে। খুব মারত। গাঁট্টায় মাথায় ঢেলা হয়ে যেত। অথচ দ্যাখো মানুষটার কোনও খবরই রাখিনি। আমাদের পুরনো বাড়িওলা অক্ষয়বাবু কোথায় আছে জানিস সমর? তোর মায়ের কথাও খুব মনে পড়ে। বাপরে! কী ঝগড়াইনা করত। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে চিৎকার। হা হা। আমার তাসের পার্টনার তপন কেমন আছে একবার খোঁজ নিস তো। সময় পেলে নিস, না পেলে নিস না। বেশি কষ্ট হয় যাদের ফেলে চলে এসেছি, যারা রয়ে গেল তাদের জন্য। মনে হয় যাই। বেশি নয়, আর একবার যাই। দেখি আসি সবাই কেমন আছে। ’
‘যাও না কেন? এই তো আমার কাছে এলে?’
‘সবার কাছে বারবার যাওয়া যায় না। সবার কাছে যেতে নেই। ফিরে আসা সবাই পছন্দ করে না। ’
বাবা মাথা নামিয়ে বসে আছে। সমরের মনে হল, বাবা কাঁদছে। জীবিত মানুষের মনে যখন মৃতরা ভিড় করে আসে তখন অনেক সময় চোখে জল আসে। মৃত মানুষ কখনও জীবিত মানুষদের কথা ভেবে কাঁদে। কে জানে হয়তো কাঁদে। নইলে বাবা কাঁদছে কেন? থাক কাঁদুক। জীবনে কতবার যে সে বাবার কাছে বসে কেঁদেছে তার কোনও হিসেব নেই। আজ বাবা ছেলের কাছে বসে কাঁদছে কাঁদুক। সে কি বাবার মাথায় হাত রাখবে?
‘তুই কি আমায় কিছু বলবি সমর?’
‘হ্যাঁ বাবা, বলব। বাবা, কতগুলো বিচ্ছিরি সমস্যায়-পড়েছি। তুমি কি একটু শুনবে?’
‘আজ থাক। মনটা ভাল নেই। তার ওপর রাত হয়ে গেছে। আজ বরং বাড়ি যা। ঝর্না একা আছে, বেচারি ভাববে। পরে যদি আবার দ্যাখা হয় তখন শুনব, কেমন?’
‘ঠিক আছে। ’
বাবা উঠে পড়ল। কোনও কথা না বলে হাঁটতে লাগল। দীর্ঘ ল্যাম্পপোস্ট থেকে হলুদ আলো এসে তার গায়ে পড়েছে। তাকে মনে হচ্ছে হলুদ মানুষ। খুব অবাক হয়ে সমর দেখল, আজ বাবার গায়ে চাদর নেই। বাবা পরে আছে একটা পাঞ্জাবি। অন্ধকারে সেই পাঞ্জাবির রং বোঝা যাচ্ছে না, তবে মনে হল কাঁধের কাছটা যেন সেলাই করা!
সমরের মনটা হঠাৎ করে ভাল হয়ে গেল। ভীষণ ভাল।
ফেরার পথে ডাক্তার রায়ের চেম্বার হয়ে ফিরল সমর। ডাক্তারবাবু কথা রেখেছেন। তিনি ওষুধ দিয়েছেন। মেপরোমেট গ্রুপের হালকা ঘুমের ওষুধ। রাতে খাওয়ার আগে একটা করে দশদিন। তারপর কুড়িদিন একদিন অন্তর একটা। এই ট্যাবলেট স্নায়ুতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। কোনও সাইড এফেক্ট নেই। ‘হ্যালুসিনেশন ডিসঅর্ডার’ সারিয়ে দিতে এই ওষুধের খ্যাতি নাকি বিশ্বজোড়া।
বাড়ি ফিরে চা এবং পরোটা খেয়েছে সমর। তারপর টিভি খুলে বসেছে। ঝর্নাও খুশি। সে শুধু ওষুধ দ্যাখেনি, সমর তাকে টেলিফোনে ডাক্তাররায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আপনার স্বামীর কিছুই হয়নি। বাতের ব্যথার অসুখ এর থেকে অনেক মারাত্মক। সাময়িক একটা হ্যালুসিনেশনের মধ্যে উনি পড়েছিলেন। তাও প্লেস হ্যালুসিনেশনে। জায়গা বিশেষে এগুলো হয়। লেকে গিয়ে বসলে ওঁর মনে হচ্ছে তিন বছর আগে মরে যাওয়া বাবা এসে পাশে বসছে। অন্য কোথাও কিন্তু নয়। দ্যাট পাট্রিকুলার জায়গা কয়েকটাদিন অ্যাভয়েড করলে ভাল। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। ইয়োর হাজবেন্ড ইজ টোটালি ওকে আন্ড ভেরি রাশনাল। তিনি নিজেই এর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ’ টেলিফোন ছেড়ে র্ঝনা শ্বশুরমশাইয়ের পাঞ্জাবি যত্ন করে একতলার আলমারিতে তুলে দিয়ে এসেছে। সমরই তুলে রাখতে বলেছে। এরপর খুশি না হয়ে থাকা যায়?
ঝর্না কাঁথা সেলাই থামিয়ে মুখ তুলে বলল, ‘শুনছ, পুরী যাবে?’
‘খেপেছ? এখন অফিস ছাড়া যাবে না। জোর পলিটিক্স চলছে। ’
‘আহা, চলো না। ক’টাদিন ঘুরে আসি। দিদি বলছিল, জামাইবাবুর ব্যাঙ্কের হলিডে হোমটা নাকি দারুণ। দোতলার সবকটা ঘর সি ফেসিং। প্লিজ চলো না। ’
‘উফ, ঝর্না, সিনেমাটা দেখতে দেবে? আচ্ছা যাবখন। এখন চুপ করো তো। ’
‘তা হলে দিদিকে ফোন করি?’
সমর টিভি থেকে মুখ না সরিয়ে বলল, ‘করো। ’
কলিং বেল বাজল। বিরক্ত মুখে ঝর্না উঠল। সে লক্ষ করে দেখেছে, যখনই সে বাপের বাড়ির কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে যাবে তখনই একটা-না-একটা বাধা। হয় কেউ আসবে, নয় রান্নাঘরে দুধ পুড়বে, নয় সমর চা চাইবে।
ঝর্না দরজা খুলল। সমর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে, সিনেমা দ্যাখার সময় কে আবার বিরক্ত করতে এল। দরজা খুলে ঝর্না চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
সমর বলল, ‘কে এল ঝর্না?’
ঝর্না আস্তে আস্তে মাথায় ঘোমটা দিল, তারপর সমরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘বাবা এসেছেন। ’