ছবি
এক-একটা গোপন কাজ আছে, যখন ঘরের দরজা আটকেও নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। খালি মনে হয়, ছিটকিনিটা ঠিকমতো লাগানো হয়নি, এই বুঝি ঘরে কেউ ঢুকে পড়ল। দরজা যত শক্ত করে বন্ধ করা হয়, টেনশন তত বেশি হয়। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় এই টেনশন মারাত্মক চেহারা নেয়। সেই কারণে বনানী আজ শুধু দরজাই আটকায়নি, একটা চেয়ার এনে দরজার গায়ে হেলান দিয়ে রেখেছে। তারপরেও আড়চোখে বারবার সেদিকে তাকাচ্ছে।
বনানী খাটের উপর বসে কলেজের ব্যাগ খুলল। ফিলজফির খাতা হাতড়ে একটা ছেঁড়া খাম বের করল। খামের উপর নাম-ঠিকানা লেখা। চিঠির খাম। মনে হয় সে কোনও চিঠি বের করে পড়বে। চিঠি নয়, বনানী খাম থেকে বের করল একটা সাদা-কালো ছবি। ছবির সাইজ বড় নয়। এমনকী মাঝারিও নয়। তার চেয়েও ছোট। গ্রুপ ছবি। পরশু বলাকা তাকে ছবিটা দিয়েছে। রাগরাগ মুখে বনানী ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল। এই নিয়ে ঠিক উনিশতমবার সে ছবি দেখছে। সংখ্যার দিক থেকে উনিশ মোটেও বড় কিছু নয়। তবে মাত্র দু’দিনের মধ্যে উনিশবার একটা ছবি দেখা অবশ্যই একটা বড় ঘটনা।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটা টানা সিঁড়ি। মনে হচ্ছে কোনও কলেজের সিঁড়ি। আসলে তা নয়। সিঁড়িটা একটা বাড়ি। বলাকাদের মামাবাড়ির সিঁড়ি। গত শনিবার বরানগরের এই বাড়িতে কলেজের কয়েকজন মিলে হঠাৎ করে যাওয়া হয়েছিল। বলাকার ভাই বাচ্চু। ক্লাস সেভেনে পড়ে। সে তার খেলনা-ধরনের একটা ক্যামেরায় ছবিটা তুলেছে। সিঁড়িতে তিনটে মেয়ে বসে আছে। তাদের ঠিক উপরের ধাপটায় বসে আছে চারটে ছেলে। ছবি ছোট হওয়ায় ছেলেমেয়েগুলোর মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে, তিনটে মেয়েই হাসছে। ছবি তোলার সময় মেয়েরা বেশিরভাগ সময়ই অকারণে হাসে। তারা মনে করে, হাসলে তাদের সবসময় সুন্দর দেখায়। এটা ঠিক নয়। অনেক সময়ই খারাপ লাগে। তাদের আসল সৌন্দর্য হাসির সৌন্দর্যের জন্য হারিয়ে যায়। এখানেও তিনজনের মধ্যে একজনকে খারাপ দেখাচ্ছে। দুঃখের বিষয় হল, সেই একজন হল বনানী। বনানী লক্ষ করেছে, এমনিতে হাসলে তাকে খারাপ দেখায় না, কিন্তু ফোটোতে হাসলে মনে হয় সামনের দুটো দাঁত উঁচু। যদিও তার দাঁত মোটেও উঁচু নয়। চারজন ছেলে কিন্তু হাসছে না। হাবভাব দেখলে মনে হবে তারা খুব বিরক্ত। ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে ছবি তোলাটা যেন খুব বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। একজন তো মুখটা ঘুরিয়েও ফেলেছে।
বনানী এখন খুব মন দিয়ে মুখ ঘোরানো ছেলেটাকে দেখছে। ছেলেটার মাথায় কোঁকড়ানো চুল দেখা যাচ্ছে। জামার বুকপকেটে রাখা পেনটা দেখা যাচ্ছে। এমনকী ভালভাবে দেখলে হাতের ঘড়িটা পর্যন্ত চোখে পড়ছে। কিন্তু মুখটা দেখা যাচ্ছে না। বনানী বোকার মতো একটা কাজ করল। ছবিটা ঘুরিয়ে নিয়ে দেখার চেষ্টা করল। যদি কোনও লাভ হয়। লাভ হল না।
বনানীর রাগ বাড়ছে। সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে কথা বলা শুরু করল, ‘ব্যাপারটা কী? আমাকে দেখলেই মুখ ঘোরাতে হবে? সেদিন ছবি তোলার সময় গোমড়ামুখটা একটু ঘোরালে কী এমন ক্ষতি হত? গা-পিত্তি জ্বলে ওঠে!’
তবে এই মুহূর্তে বনানী সম্ভবত চাইছে তার গা-পিত্তি জ্বলুক। জ্বলতেই থাকুক। নইলে সে মুখ ঘোরানো ছবির দিকে তাকিয়ে থাকবে কেন?
দরজায় ধাক্কা। নিশ্চয়ই মা। বনানী ছবিটা তাড়াতাড়ি ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। চেয়ার সরিয়ে দরজা খুলে দিতে সুরমাদেবী ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাতে দুধের কাপ। তাতে চকোলেট মেশানো। এই ধেড়ে বয়সেও বনানীকে দুধ খেতে হয়। বিষয়টা নিয়ে রোজই বনানী ঝামেলা করে।
সুরমাদেবী ঘরে ঢুকেই চারপাশে তাকালেন এবং ভুরু কুঁচকে ফেললেন। নিশ্চয়ই কোনও খটকা লেগেছে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল গাদাখানেক প্রশ্ন। ‘দরজার সামনে চেয়ার কেন? কলেজ থেকে তো অনেকক্ষণ ফিরেছিস, এখনও চেঞ্জ করিসনি কেন? শুয়েছিলি কেন? মাথা ধরেছে? নিশ্চয়ই মাথা ধরেছে, নইলে গালদুটো অমন লাল কেন?’
এই এক মুশকিল। একটা সন্দেহ হলে মা হাজারটা প্রশ্ন করেন। না, চেয়ারটা রাখা ঠিক হয়নি। বোকামি হয়ে গেছে। ম্যানেজ করতে হবে। বনানী আজ আর কোনও ঝামেলার মধ্যে গেল না। তাড়াতাড়ি উঠে এসে সুরমাদেবীর হাত থেকে কাপ নিয়ে চুমুক দিল। ভাবটা এমন, যেন কোন প্রশ্নই সে শুনতে পায়নি। মা বেরিয়ে যাওয়ার পর বনানী আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। ভাল করে তাকাল। ওমা, সত্যি তো, গালদুটো লাল হয়ে রয়েছে! একেবারে রাঙা! সে আলতো করে দু’গালে হাত দিল। গালের লাল রং সে যেন ছুঁয়ে দেখতে চায়।
বলাকাকে পাওয়া গেল তিনতলায়! ফাঁকা ক্লাসরুমে বসে নোটস টুকছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। বলাকার এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার। গান গাইতে গাইতে সে লেখাপড়া করতে পারে। ওর রেজাল্টও দারুণ। বনানী নিঃশব্দে পাশে এসে বসল। বলাকার কাছে সে একটা জিনিস জানতে এসেছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে কেমন যেন বাধোবাধো ঠেকছে। কেন এরকম হচ্ছে? এমন সময় বলাকা বনানীকে দেখতে পেল। তারপর চোখ বড় বড় করে বলল, ‘এই তে বনানী, তোকেই খুঁজছিলাম। একটা জরুরি কথা আছে। ভার। জরুরি কথা। শনিবার মামাবাড়ির বেড়ানোটা একেবারে জঘন্য হয়েছে। আমি ভেবে দেখলাম এরকম গোমড়ামুখো ছেলেরা সঙ্গে থাকলে যে-কোনও বেড়ানোই জঘন্য হয়। হাঁদাগুলো গাইতে চায় না, নাচতে চায় না। ওদের নেওয়াটাই ভুল হয়েছিল। আমি কমপেনসেট করতে চাই। ঠিক করেছি, কিছুদিনের মধ্যে আমরা আবার ওখানে যাব। তখন নো ছেলে ওনলি মেয়েরা যাবে। সেদিন মামাদের ছাদে অবিরাম নৃত্যগীতের ব্যবস্থা রাখা হবে।
কেন জানি না, বনানীর এ প্রস্তাব মোটে ভাল লাগল না। তবু সে উৎসাহ দেখিয়ে বলল, ‘দারুণ হবে। একেবারে ফাটাফাটি।’
বলাকা হাসিমুখে বলল, ‘দাঁড় দাঁড়া। আরও ফাটাফাটি হবে। আমি ছোটমামাকে বলে সেই অনুষ্ঠানের গোটাটা ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করব। আর শোন বনানী, সেদিন বাচ্চুর ফালতু ক্যামেরাটায় একটা ছবি উঠেছিল না? ওই যে সিঁড়িতে বসা ছবিটা। বাচ্চু বলেছে, আর একটাও ছবি ওঠেনি। শুনে খুবই খুশি হয়েছি। কারণ ওই একটা ছবিও আমরা রাখব না। এরকম গোমড়ামুখো বেড়ানোর কোনও মেমরি যেন না থাকে। তুই আজই বাড়ি গিয়ে ছবিটা খুঁজে বের করবি, তারপর কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলবি। কাল সেগুলো এনে আমায় দেখাবি! মনে থাকবে?’
বনানী মাথা নেড়ে বলল, ‘থাকবে।’ কিন্তু মনে মনে খুব হতাশ হল। তার আশা ছিল, নিশ্চয়ই সেদিন বার ক্যামেরায় আরও ছবি উঠেছিল। ভাল ছবি। সবার মুখ দেখা যাচ্ছে, এমন ছবি। তা হলে কী হবে?
সন্ধেবেলা বনানী অর্কপ্রভকে ফোন করল। ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে পড়লে কী হবে? কম্পিউটারে অর্ক বিরাট ওস্তাদ। ওকে টেলিফোন করলেই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো সবসময় কি বোর্ডের খুটখুট আওয়াজ শোনা যায়। আজও গেল। সেই আওয়াজের মধ্যেই অর্ক বলল, ‘জোরে কথা বল বনানী। অমন ফিসফিস করছিস কেন?’
বনানী আরও ফিসফিস করে বলল, ‘জোরেই তো বলছি। হ্যাঁরে অর্ক, কম্পিউটারে সব হয়?’
অকপ্রভর কি বোর্ডের আওয়াজ থেমে গেল। তার বদলে ভেসে এল অল্প হাসি। বলল, ‘না জেনেই একটা বিরাট প্রশ্ন করে ফেললি বনানী। তোর মতো বোকা ধরনের মেয়ের কাছ থেকে এ ধরনের প্রশ্ন আশা করিনি। গুড, ভেরি গুড। কম্পিউটারে কী করা যায়, সেটা কোনও কথা নয়। কথা হল, কী করা যায় না। তুই যদি এই বিষয়ে জানতে চাস, তা হলে তোকে সফটওয়্যার বিষয়ে একটা প্রবন্ধ পড়াতে পারি। আনসলভড মিস্ট্রি অফ সফটওয়্যার। জাপানি প্রবন্ধ। খুবই ইন্টারেস্টিং।’
বনানী অর্কপ্রভকে থামিয়ে বলল, ‘খেপেছিস নাকি? আমি শুধু জানতে চাই, কম্পিউটারে ছবি, মানে ফোটোগ্রাফের কিছু অদলবদল করা যায় কি?’
অর্কপ্রভ তুচ্ছ ভঙ্গিতে বলল, ‘এই সামান্য জিনিসের জন্য আমাকে ফোন করতে হল বনানী? ফোটোশপ কী জিনিস, জানিস? জানিস না নিশ্চয়ই। এই ফোটোশপ দিয়ে সবকিছু হয়। মুখের হাসিকে ফুঁপিয়ে কান্না, ফুঁপিয়ে কান্নাকে অট্টহাসি, অট্টহাসিকে গড়াগড়ি হাসি, সব। গতবছর ফ্রান্সে…’
কথার মাঝখানেই বনানী ফোন কেটে দিল। তার যা জানার তা জানা হয়ে গেছে।
কলেজ থেকে ফেরার পথে স্টুডিয়োটা দ্যাখে। একেবারে বাজারের পাশেই। নতুন হয়েছে। বাইরে বোর্ড লাগানো। তাতে লেখা, ‘কম্পিউটারে ইচ্ছেমতো ছবি করুন’। তখনই বুদ্ধিটা মাথায় আসে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারেনি। অর্কর সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে কাজটা হবে। এখনই যাবে স্টুডিয়োতে। তৈরি হয়ে নিল বনানী। পাজি ছেলেটাকে শিক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। উফ, আজও একই রকম ব্যবহার করল! হিষ্ট্রি ক্লাসের শেষে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে কমনরুমের দিকে হাঁটতে লাগল, যেন দেখতেই পায়নি! অথচ আজ সে সাদা-লালে মেশানো একটা জমকালো সালোয়ার পরেছিল। কপালে যে লাল টিপটা দিয়েছিল সেটা অন্যদিনের চেয়ে বড়। তরুণ প্রবাল সঙ্ঘমিত্রারা কলেজে ঢুকতেই হইহই করে উঠল।
প্রবাল বলল, ‘আঃ বনানী, তোকে আজ যা লাগছে না। চল, ফুচকা খাওয়াবি চল। জানিস তো, সুন্দর দেখালে ফুচকা খাওয়াতে হয়। নইলে নজর লেগে যাবে। নজরের চোটে তোর টিপ বেঁকে যাবে, অথচ তুই বুঝতেও পারবি না। তখন সারাদিন বাঁকা টিপ কপালে নিয়ে ঘুরতে হবে। চল চল, দেরি করিস না।’
এতজন দেখল, বলল, অথচ ওই ছেলে একবার ঘুরেও তাকাল না! না, প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। এই ছেলের মুখ ঘোরাতে হবে। ঘোরাতেই হবে। বনানী বেরিয়ে পড়ল।
লোকটা কাচের উপর রেখে ঝুঁকে পড়ে ছবিটা দেখছে। চোখমুখে এমন একটা ভাব, যেন ছবি দেখছে না, দুর্বোধ কোনও পুঁথি পড়ছে। মিনিট দশেক পরে মুখ তুলল। বলল, ‘দিদিভাই, আপনি যা বলছেন, তা তো হবে না।’
বনানী অবাক হয়ে গেল। বলল, ‘ওমা, এই তো বললেন হবে। টাকা একটু বেশি লাগবে কিন্তু হয়ে যাবে! বলেননি?’
লোকটা হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু কী বলেছিলাম তা বোধহয় মনে নেই দিদিভাই। আপনি নিশ্চয়ই কোনও বড় চিন্তার মধ্যে আছেন। নইলে পাঁচ মিনিট আগের কথা গুলিয়ে ফেলবেন কেন? যাই হোক, আবার বলছি। আমি বলেছিলাম, গ্রুপ ফোটো থেকে একজনের ছবি বের করা যাবে। এখানেও যাবে। তবে প্রিন্ট বড় হবে না। কারণ ছবির কোয়ালিটি খারাপ। বোঝাই যাচ্ছে, ফেলে দেওয়া কোনও ক্যামেরায় তোলা হয়েছে। ফোকাসে গোলমাল। বেশি টানাহ্যাঁচড়া করলে ছবি ফেটে যাবে।’
বনানী হতাশ ভঙ্গিতে বলল, ‘কিন্তু মুখ? মুখটা একটু বড় করা যাবে না?’
লোকটা বলল, ‘দিদিভাই, আপনি যা বলছেন, তা কি ভেবেচিন্তে বলছেন? আপনি যে মুখটা বড় করতে বলছেন, সেই মুখ তো অন্যদিকে ফেরানো। সেটা কি আপনি দেখেননি? তা হলে আমায় বলতে হবে, এই যে ভাই, আপনি মুখটা এক মিনিটের জন্য এদিকে ঘোরান দেখি। চট করে একটা প্রিন্ট করে নিই। মাপ করবেন, ফোটোগ্রাফিতে এমন কোনও টেকনিকের কথা আমার জানা নেই, যা দিয়ে ছবির ভিতরকার মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়।’
বনানীর এবার রাগ হচ্ছে। আচ্ছা লোক তো! সে বলল, ‘কেন, কম্পিউটারে হয় না? কম্পিউটারে তো সবকিছু করা যায়।’
লোকটা এবার শব্দ করে হেসে উঠল।
আশপাশের লোক বনানীর দিকে ফিরে তাকাল। বনানী লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলল, ‘ঠিক আছে, যা হয় তাই করে দিন। ছবিটা কিন্তু কালই চাই। সেটা পারবেন তা? নাকি তাও বলবেন হবে না।’
লোকটা হাসতে হাসতে বলল, ‘সেটা পারব দিদিভাই। তবে আর্জেন্টের জন্য তো ডবল টাকা। মুখ সোজা যখন করতে পারলাম না… হা হা… ঠিক আছে, আপনি পাঁচটা টাকা কম দেবেন।’
বনানী ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে বলল, ‘না, কম দেব না।’
ভয়ংকর মেজাজ খারাপ নিয়ে স্টুডিয়ো থেকে বেরোল বনানী। তখনই তার মনে হলে, বাড়িতে কী বলবে, এই সন্ধেতে কেন বেরিয়েছিল সে? মা তো জানতেই চাইবেন। একটা কিছু কিনে নিয়ে গেলে কেমন হয়? সেটাই ভাল। বলা যাবে, জিনিস কেনার জন্যই বেরিয়েছিল। কিন্তু কী কিনবে? রাগে দুঃখে তো কিছুই মাথায় আসছে না। আচ্ছা, ওই ফুলের দোকানটা থেকে এক ডজন গোলাপ কিনলে কেমন হয়? কোন কবিতায় যেন পড়েছিল, গোলাপ ফুলের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। যে-কোনও ধরনের খারাপ মেজাজ ভাল করে দিতে পারে। সত্যিই কি পারে? মনে হয় না। কবিতায় কখনও সত্যি কথা থাকে না। ঠিক আছে, একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক। বনানী এক ডজনের জায়গায় দু’ডজন গোলাপ কিনে বসল। তার মেজাজ বেশি খারাপ, তাই বেশি ফুল।
ফোটো-বিজ্ঞানে ছবির সঙ্গে কথা বলার কোনও উপায় আবিষ্কার হয়নি ঠিকই, কিন্তু বনানী গোলাপ হাতে বাড়ি ফেরার পথে ছবির সঙ্গে দিব্যি বকবক করতে করতে চলল, ‘তোমার মুখ আমি ঠিক ঘুরিয়ে ছাড়ব বাছাধন! আমি কী এমন প্যাঁচার মতো দেখতে যে, একবারও তাকানো যায় না? ঠিক আছে, তাকাতে হবে না। আমার ভারী বয়ে গেল। ভেবেছটা কী? না তাকালে আমার চোখ ফেটে জল আসে? কচু আসে। সেদিন বরানগরে আমার চোখে পোকা পড়েছিল। চোখে পোকা পড়লে সবারই জল এসে যায়। তোমারও আসত, বুঝলে হে মুখ-ফেরানো ছেলে?
হাতে গোলাপ ফুল থাকলেও বনানীর মেজাজ একটুও ভাল হল না। উলটে আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল। এত খারাপ হয়ে গেল যে, সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ঠিক করল, এখনই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। সরাসরি টেলিফোন করে জানতে চাইবে, কেন সে এরকম করে? বারবার মুখ ফিরিয়ে নেয় কেন? কাজটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? হোক বাড়াবাড়ি। সে বাড়াবাড়িই করতে চায়। গলির মুখটাতে এস টি ডি বুথ। বনানী দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। বুথের ছেলেটা বনানীকে চেনে। হেসে বলল, ‘দিদির বাড়ির ফোন বুঝি গেছে?’
বনানী গম্ভীর হয়ে মিথ্যে বলল, ‘হ্যাঁ, ওয়ান ওয়ে।’ তারপর টেলিফোনের উপরেই ফুলগুলো ফেলে বনানী দ্রুত ডায়াল করল। এনগেজড সাউন্ড। আবার করল। একই অবস্থা! আচ্ছা ছেলে তো! কার সঙ্গে এত কথা? কোনও বান্ধবী নয় তো? মনে হয় না। ওরকম ছেলের সঙ্গে কে কথা বলবে? বয়ে গেছে কারও! আচ্ছা, বুঝতে পারেনি তো, সে ফোন করছে। সেই জন্যই হয়তো ফোন নামিয়ে রেখেছে। বলা যায় না, এই ছেলে যা খুশি করতে পারে।
ফোনের উপর রাখা ফুলগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, মনে হচ্ছে সেটা একটা ফুলদানি। সেই ফোন-ফুলদানির দিকে তাকিয়ে বনানীর অভিমান হতে লাগল। না, আজ সে ফোন না করে কিছুতেই যাবে না। সেরকম হলে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবে।
পাঁচবারের চেষ্টায় ফোন বাজল। ওপারের তরুণ গলায় উত্তর, ‘হ্যালো… হ্যালো, কে বলছেন?’
এই নম্বরে বনানী আজ প্রথম ফোন করছে না। আগেও বেশ কয়েকবার করেছে। এ-কথা কেউ জানে না। একটুখানি সময় অনিন্দ্যর গলার আওয়াজ শুনে রিসিভার নামিয়ে রেখেছে। আজ কিন্তু অন্যরকম হল। বনানী রাগরাগ গলায় বলল, ‘দুর, আমাকে আপনি-আপনি করছিস কেন রে অনিন্দ্য? আমি কে, বল তো?’
অনিন্দ্য নামের তরুণটি ওপাশে যেন একটু থমকে গেল। বলল, ‘কে আপনি?’
বনানী মজা পেয়ে বলল, “হাঁদা কোথাকার, গলা চিনতে পারছিস না?’
ওপাশের তরুণ আরও গম্ভীর গলায় জবাব দিল, ‘না, চিনতে পারছি না।’
বনানীর মেজাজ খারাপটা যেন কমেছে! গোলাপ ফুলের জন্য নাকি? কবিতার সব কথা তা হলে বানানো নয়! সে বলল, ‘আচ্ছা অনিন্দ্য, গোমড়ামুখো ছেলেগুলো কি সবাই তোর মতো বোকা হয়?’
অনিন্দ্য সহজভাবে বলল, না সবাই হয় না। দু’-একটা ব্যতিক্রম আছে।’
বনানী বলল, ‘বেশি স্মার্ট সাজার চেষ্টা করিস না। হুঁ, টেলিফোনে খুব চালাকি করছিস, না? কলেজে তো একবারও মুখ ফেরাতে পারিস না। কেন রে, আমার দিকে তাকালে কি ভস্ম হয়ে যাবি? অফ পিরিয়ডে একবার ক্যান্টিনে আসলে কী এমন ক্ষতি হত?’
অনিন্দ্য উদাসীন ভাবে বলল, ‘ক্ষতি হত।’
অনিন্দ্যর এই চিনতে না পারার ব্যাপারটায় বনানী খুব মজা পাচ্ছে। বেশ হয়েছে। বোঝো ঠেলা। সে ঠাট্টার ছলে বলল, ‘ব্যাঙের মাথা হত।’
অনিন্দ্য বলল, ‘ব্যাঙের মাথা না, আমার মাথা ধরেছিল। চৈতালীর কাছ থেকে ট্যাবলেট নিলাম।’
বনানী বলল, ‘ট্যাবলেট তো আমার কাছেও থাকে। নিতে পারতিস।’
অনিন্দ্য বলল, ‘আচ্ছা, তাই নেব। এখন তো মাথা ধরেনি। পরেরবার মাথা ধরলে নেব। তবে কিনা, নামটাই যে বুঝতে পারছি না। কার কাছে ওযুধ চাইব, সেটা তো জানা দরকার।’
বনানী বলল, ‘অ্যাই, সত্যি বুঝতে পারছিস না? নাকি গুল দিচ্ছিস? ঠাস করে চড় মারব কিন্তু!’ অনিন্দ্য হাই তোলার আওয়াজ করল। বলল, ‘মারলে ভাল হত মনে হচ্ছে। ব্রেন সেলগুলোতে একটু নাড়া পড়া দরকার। মনে হয় আমার মেমরি সেলে কোথাও গোলমাল হচ্ছে। যে-জায়গাটায় চেনা সাউন্ড জমা থাকে দ্যাট পোর্সন ইজ নট ফাংশনিং প্রপারলি। সেই জন্যই হয়তো গলাটা বুঝতে পারছি না।’
বনানী গাঢ় স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে। যা, বুঝতে হবে না। আজ একটা মজার কাণ্ড হয়েছে, জানিস অনিন্দ্য! ইন ফ্যাক্ট সেই জন্যই তোকে ফোন করছি। আজ আমাদের সেই গ্রুপ ফোটোটা থেকে একজনের ছবি বড় করালাম। কোন ফোটোটা বুঝতে পারছিস? আরে সেই যে, বলাকাদের বরানগরের মামাবাড়িতে তোলা হল না? মনে পড়েছে? হল কী জানিস, এই গ্রুপ ফোটোতে একজনের মুখ উলটোদিকে ঘোরানো ছিল। ওমা, যেই সেই মুখটা স্টুডিয়োতে নিয়ে গিয়ে বড় করালাম, তুই বিশ্বাস করবি না, মুখটা কেমন সামনের দিকে ঘুরে গেছে। বল তো, ছবিটা কার?’
অনিন্দ্য খানিকটা সময় নিল। তারপর সামান্য হেসে বলল, ‘কার আবার? আমার।’
বনানী অবাক। ভীষণ অবাক। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে ঠিক শুনছে?
ফিসফিস করে বলল, ‘কী করে বুঝলি?’
অনিন্দ্য বলল, ‘গোমড়ামুখোরা বোকা হয়ে বলে বুঝতে পারলাম। বনানী, তোকে একটা কথা বলি…’
‘ওমা, এই তো গলা চিনতে পেরেছিস।’ বনানী আরও মুগ্ধ হল।
‘চিনতে পারব না কেন? যখন মাঝেমধ্যে ফোন করে চুপ করে থাকিস, তখনও চিনতে পারি। তখন আরও বেশি করে চিনতে পারি।’
কানে রিসিভার লাগিয়ে বনানী চুপ করে আছে। এত আনন্দ হলে ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েরা সাধারণত কথা বলে না। চুপ করে থাকে। চুপ করে থেকে শরীর আর মন দিয়ে শুধু আনন্দটুকু উপভোগ করতে চায়। কথা বলে সময় নষ্ট করে না। আর ওপাশ থেকে অনিন্দ্য নামের তরুণরা তখন বলে চলে, ‘হ্যালো, হ্যালো বনানী, হ্যালো, চুপ করে গেলি কেন? প্লিজ ফোন ছাড়িস না প্লিজ..’
অনিন্দ্য এখন সে কথাই বলছে। বনানী শুনছে। শুনেই চলেছে।
ফোটো-বিজ্ঞানের ইতিহাসে আগে যা কখনও ঘটেনি, কখনও ঘটতে পারে না, সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটেছে। পরের দিন কলেজ যাওয়ার আগে স্টুডিয়ো থেকে ছবি নিতে গিয়ে বনানী দেখল, সেই মুখ ঘুরে গেছে। শুধু তাই নয়, ছবির ভিতর থেকে অনিন্দ্য বনানীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেও!
অবাক কাণ্ড! ভারী অবাক কাণ্ড!