বৃষ্টির গান
‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রাবণ মাস নিয়ে ক’টা গান লিখেছেন বল তো?’
নন্দিতার এই একটা স্বভাব। সুযোগ পেলেই বন্ধুদের অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে। আর প্রশ্ন করবার সময় মুখটাকে এমন গম্ভীর করে রাখে যে, মনে হয় কেমিস্ট্রির স্যার ক্যান্টিনে এসে বসেছেন, তারপর চায়ের কাপ হাতে তিনি ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করছেন। নন্দিতা তার এই স্বভাবের জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে ‘শ্রীমতী প্রশ্নময়ী’ খেতাব পেয়েছে। তবে প্রশ্নময়ীর প্রশ্নপর্বের সঙ্গে একটা দারুণ ব্যাপার থাকে। সে প্রতিবারই প্রশ্ন করার পর বন্ধুদের জন্য একটা-না-একটা উপহারের ব্যবস্থা রাখবে। উত্তর পারলেও উপহার, না পারলেও উপহার। আরও মজার কাণ্ড হল, উপহারগুলো সব কোনও-না-কোনও ভাবে প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়। যেমন নন্দিতা যেদিন প্রশ্ন করে— চকোলেটের আবিষ্কর্তার নাম কী? সেদিন বুঝতে হবে ওর ব্যাগে ক্যাডবেরি আছে। একবার নন্দিতার প্রশ্ন ছিল, স্পিলবার্গের ‘জুরাসিক পার্ক’ ছবির সংগীতপরিচালক কে ছিলেন? সকলে তো একেবারে অথই জলে পড়ল। সেদিন নন্দিতা ছুটির পর সবাইকে জোর করে নন্দনে ধরে নিয়ে গেল। সেখানে তখন স্পিলবার্গেরই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ ছবিটা চলছে। টিকিট কেটে সিনেমা দেখাল, চিকেন পকোড়া খাওয়াল, তারপর ছাড়ল। সেবার খুব মজার ব্যাপার হয়েছিল। টিফিনের সময় নন্দিত জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আচ্ছা, বল তো রেড পান্ডা দিনে কত ঘণ্টা ঘুমোয়?’
সকলের দারুণ চিন্তা। প্রশ্নময়ী কি তবে আজ ওর গাড়িতে চাপিয়ে কয়েকটা রেড পান্ডা নিয়ে এসেছে? সেদিন সবাই উপহার পেয়েছিল ওয়ার্ল্ড লাইফ সোসাইটির একটা করে ব্যাচ। সেই ব্যাচগুলোতে রেড পান্ডার চমৎকার ছবি আঁকা। নন্দিতার উপহারের মজা হল, জিনিসের দামের চেয়ে ভাবনাটা অনেক বেশি দামি। সবাই বুঝে গেছে, নন্দিতা আসলে প্রশ্ন করে বন্ধুদের মোটেও অপদস্থ করতে চায় না। উপহার দেওয়াটাই তার আসল উদ্দেশ্য। আজ কী উপহার হবে? শ্রাবণ মাস নিয়ে আবার কোনও উপহার হয় নাকি?
গত বছর থেকে ক্লাস ইলেভেন -টুয়েলভের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা ক্যান্টিনের ব্যবস্থা হয়েছে স্কুলে। প্রিন্সিপ্যাল মনে করেন, স্কুলে পড়লেও এই বয়সের ছেলেমেয়েরা আর ছোট থাকে না। এদের একটু আলাদা জায়গা দরকার। ক্যান্টিনে যাবারটাবার সব একই, শুধু চা আর কফির অতিরিক্ত অনুমতি আছে। ছেলেমেয়েরা টিফিনের সময়, অফ পিরিয়ডে বা ছুটির পর ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বসে এখানে আড্ডা দেয়। গান করে। কবিতা পড়াও চলে। কেউ কেউ আবার চুপচাপ কফির মগ নিয়ে এক কোনায় বসে ক্লাসের নোটস টোকে।
আজ বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে আর ভিতরে জোর আড্ডা চলছে।
প্রদীপ স্যান্ডুইচে কামড় দিয়ে বলল, ‘ইস, এত সহজ প্রশ্ন করলি নন্দিতা। তোর হাতে আজ শক্ত কোনও স্টক নেই? এ তো সবাই পারবে।’
ক’দিন হল যিশু একটা গিটার কিনেছে। সেই গিটার সে স্কুলেও নিয়ে আসছে। ক্যান্টিনে গিটার জমা থাকে। প্রথমদিকে দু’-একদিন যিশু ক্যান্টিনে বসে নিজের তৈরি গান শুনিয়েছিল। সে খুবই ভয়ংকর ব্যাপার। গানের যেমন কথা তেমনই সুর। দীপালি নিয়ম করে দিয়েছে, যিশু গিটার আনতে পারে, তবে তার গান গাওয়া চলবে না। বাকিরা দীপালিকে সমর্থন করেছে। শুধু সমর্থন নয়, কেউ কেউ বলেছে নিয়ম আরও কঠিন হলে ভাল হয়। গ্রুপ থেকে যিশুকে বহিষ্কারের একটা প্রভিশন থাকা উচিত। যিশু অবশ্য এতে অপমানিত হয়েছে বলে মনে হয় না। তারপরও সে নিয়মিত গিটার নিয়ে বসে এবং পিড়িং পিড়িং করে। আজও করছে। এই চর্চা করতে করতেই বলল, ‘প্রদীপের বেশি পাকা কথা। সহজ প্রশ্ন তো উত্তর দে না।
গত মাসে সুচন্দনা জন্ডিস থেকে উঠেছে। ঝাল-মশলা খাওয়া তার একেবারে বারণ। তার উপর তার বাবাবা দু’জনেই ডাক্তার। ফলে ডবল কড়া নজর। গত সোমবার সুচনার মা রেটিনোপ্যাথির উপর পেপার পড়তে ভিয়েনায় গেছেন। যাওয়ার আগে পইপই করে বলে গেছেন, খাওয়ার ব্যাপারে সুচন্দনা যেন সতর্ক থাকে। সুচন্দনা সতর্কই আছে। আজ সে এক প্লেট ঘুগনি নিয়েছে। স্কুল ক্যান্টিনের ঘুগনি যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর। তবে বড়দের ক্যান্টিনে একটা গোপন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সেই ব্যবস্থায় ঘুগনির উপর ঘন করে গুঁড়ো লঙ্কা এবং তেঁতুলজল ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘুগনির নাম হল ঝাল-ঘুগনি। সুচন্দনা নানারকম আদবকায়দা মেনে এবং সতর্কতার সঙ্গে মন দিয়ে সেই ঝাল-ঘুগনি খাচ্ছে। কোলের উপর ফুল-কাটা ন্যাপকিন। বাড়ি থেকে আনা ঝকঝকে চামচ গরম জলে ধুয়ে নিয়েছে। টেবিলে রাখা ফোটানো জলের বোতল। গুঁড়ো লঙ্কার ঝালের চোটে সুচন্দনার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছে। বাটিকের কাজ করা রুমাল দিয়ে সেই জল মুছে বলল, ‘নন্দিতা, আমি ভাই প্রথমেই হার মেনে নিচ্ছি। আমি এসব গানবাজনার কিছু জানি না। উফ, কী ঝাল রে বাবা! ও ভোলাদা, আর একটু লঙ্কাগুঁড়ো পাঠাও।’ আবার সবাই হেসে উঠল।
কিঞ্জল শুধু হাসল না। আজ এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যে, তার পক্ষে হুটহাট হেসে ফেলাটা ঠিক নয়। ঘটনাটা কাউকে বলাও যাচ্ছে না। স্কুলে আসবার পথে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাত থেকে কিঞ্জল একটা বই কিনেছে। বইয়ের নাম ‘ফান উইথ ক্ৰশওয়ার্ড পাজ্ল’। তিনশো টাকার বই মাত্র একশো টাকায় পাওয়া যাচ্ছে দেখে, কিঞ্জল আর লোভ সামলাতে পারেনি। চট করে কিনে নিয়েছে। কিন্তু আসল ঘটনা জানা গেল স্কুলে এসে। বই খোলার পর দেখা যাচ্ছে, ভিতরের অনেকগুলো পাজ্ল পেন দিয়ে করা রয়েছে। এর থেকে মারাত্মক ফান আর কী হতে পারে? এর পর হাসাহাসি করা বেশ কঠিন। কিঞ্জল তাই গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমার মনে হয় প্রদীপেরও পরাজয় স্বীকার করা উচিত। লজ্জার কিছু নেই। আঁখি তো কোনও প্রশ্নের উত্তরই জানে না। ও কি কখনও লজ্জা পায়? মাস্টার জিরো, তুই কী বলিস?’
মাস্টার জিরো হল অর্ণবের নাম। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এই ছেলে পরীক্ষায় মারাত্মক ফল করে। ঝুলি-ভরতি শূন্য না থাকলে ‘মাস্টার জিরো’র মতো খেতাব পাওয়া যায় না। তবে অর্ণবের ক্ষেত্রে ব্যাপার একদম উলটো। লেখাপড়ায় সে দুর্দান্ত। অঙ্কে তার মাথা দেখবার মতো। কোনওদিন নব্বইয়ের কম পায়নি। ক্লাস ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার সময় তো কেলেঙ্কারি কাণ্ড। সেকেন্ড পেপারে পেয়েছে একেবারে একশো। বন্ধুরা বলেছে, নম্বরে যার এতগুলো শূন্য, তাকে ‘মাস্টার জিরো’ নামে ডাকা উচিত। অর্ণবও বিষয়টা উপভোগ করে। গোল গোল চশমার ভিতর দিয়ে বোকাৰোকা করে হাসে। সে বলল, ‘আঁখি, এটা তোর ঠিক হচ্ছে না। আজ বাদে কাল তুই মিস ইন্ডিয়া কনটেস্টে যাবি। আজকাল সুন্দরী প্রতিযোগিতায় খুব কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে। শুধু দাঁত বের করে হাসলেই হয়? দাঁতের সঙ্গে বুদ্ধিও দেখাতে হয়।’
আঁখিকে সত্যিই সুন্দর দেখতে। তার চোখদুটো বড় বড়। চুল কোঁকড়ানো। সহপাঠিনীরা তাকে হিংসে করে। কিন্তু মজার কথা হল, আঁখি তার নিজের সৌন্দর্যকে একদম গুরুত্ব দেয় না। বরং তাকে কেউ সুন্দর বললে খুব বিরক্ত হয়। তার বক্তব্য হল, শুধুমাত্র বাইরের সৌন্দর্য দিয়ে যে সুন্দর হওয়া যায়, সেরকম সুন্দর সে হতে চায় না। সত্যিকারের সুন্দর হওয়ার জন্য ভিতরটাও সুন্দর করতে হয়। এই স্বভাবের জন্য বন্ধুরা ওকে গোপনে শ্রদ্ধার চোখে দেখে, কিন্তু সামনে খেপায়। অর্ণবের কথায় আঁখি রেগে গিয়ে বলল, ‘ঠিকই বলেছিস। শুধু ক্যালকুলাস করলেই হবে না। মানুষ হতে গেলে একটু-আধটু রবীন্দ্রনাথও জানতে হয়।’
বকুল খুব চিন্তায় আছে। চিন্তায় থাকারই কথা। টিউশনির বাড়ি থেকে এখনও মাইনে দেয়নি। টাকার পরিমাণ এমন কিছু নয়। সামান্যই। ক্লাস সেভেনের ছেলে পড়ালে কত টাকাই বা পাওয়া যায়? কিন্তু কলকাতায় কাকার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে হলে এই সামান্য টাকাই মাসের শেষে অসামান্য হয়ে ওঠে। আজ টাকাটা সরাসরি চাইলে কেমন হয়? এমন সময় দীপালি বকুলের পিঠে একটা হালকা চড় মেরে বলল, ‘কী রে বকুল, ধ্যান করছিস নাকি?’
বকুল হেসে বলল, হ্যাঁ, ধ্যানে কবিগুরুকে বলছি, গুরুদেব, প্লিজ আপনি একবার এসে প্রদীপকে উত্তরটা বলে দিয়ে যান।’
প্রদীপ রেগে গিয়ে তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘তোরা আমাকে কী ভাবছিস? গানবাজনার কিছু জানি না? তোরা র্যাভেলের বোলেরো শুনেছিস? ভিভালডির ফোর সিজন সম্পর্কে কোনও আইডিয়া আছে? ভোরাকের নিউ ওয়ার্ল্ড কী জিনিস জানিস? আলডি মেওলা, ইয়ানি, ন্যাটকিং কোলের নাম শুনেছিস জীবনে?’
অল্প বয়সে প্রত্যেক দলেই একজন করে মোটা বন্ধু থাকে। অনেকদিন এই দলে সেরকম কেউ ছিল না। অনেক ভেবেচিন্তে ক্লাস ইলেভেনের মাঝামাঝি আর্টসের মোটা সুতপাকে দলে নেওয়া হল। প্রথমদিকে মেয়েটা খুব নাক কুঁচকেছিল। আজকাল বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হলে হাঁসফাঁস করে। ছুটির দিন টেলিফোনে জ্বালিয়ে মারে। তবে সমস্যা হয়েছে একটাই। গত এক বছর ধরে সুতপা ডায়েট শুরু করেছে এবং চটপট রোগা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই তাকে বেশ ছিপছিপে দেখায়। রোগা হওয়ার অপরাধে যেহেতু কাউকে দল থেকে বহিষ্কার করা যায় না, সেহেতু সুতপা রয়ে গেছে। তবে তাকে এখনও ‘মোটা’ বলেই ডাকা হয়। সুতপা বলল, ‘প্রদীপ, আমরা স্বীকার করছি আমরা কিছুই জানি না এবং তুই সব জানিস। এবার তুই নন্দিতার প্রশ্নের উত্তরটা দে।’
প্রদীপ গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রাবণ মাস নিয়ে আটখানা গান লিখেছেন। ওনলি এইট।’
নন্দিতা বলল, ‘হয়নি।’
প্রদীপ বলল, ‘আলবাত হয়েছে। তুই গীতবিতান আনা।’
নন্দিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, কিছুই আনাতে হবে না। বন্ধুগণ, প্রশ্নোত্তরের পালা শেষ, এবার গিফট-টাইম। উপহারের সময়। তোমরা নিশ্চয়ই অধীর আগ্রহে ভাবছ, শ্রাবণ মাসের প্রশ্নের সঙ্গে মানানসই উপহার কী হতে পারে? আমি এমন একটা উপহার আজ তোমাদের জন্য ভেবেছি যা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। আগামীকাল শ্রাবণ মাসের ২৫ তারিখ, রবিবার। কাল আমরা পিকনিকে যাব। সবাই শীতকালে পিকনিক করে, আমরা পিকনিক করব বর্ষাতে। যাবতীয় ব্যবস্থা আমার।’
যিশু গিটার সরিয়ে রেখে বলল, ‘শ্রাবণ মাসে পিকনিক!’ কিঞ্জল বলল, ‘আইডিয়া ইউনিক, তবে ভয়ংকর। ছাতা নিয়ে পিকনিকে যাচ্ছি শুনলে বাড়িতে হাসবে যে!’ সুচন্দনা বলল, ‘খেপেছিস? এই সময়ে বৃষ্টিতে ভিজলে নিউমোনিয়া মাস্ট। জন্ডিসের উপর নিউমোনিয়া হলে ভয়ংকর। মা ভিয়েনা থেকে ফিরে এসেই ত্যাজ্য কন্যা করে দেবে?’ দীপালি বলল, ‘আমি যাব না। ভিজলো আমার অ্যালার্জি হয়।’ বকুল বলল, নন্দিতা তুই প্রশ্ন বদলে দে। শ্রাবণের বদলে পোষ করলে কোনও ক্ষতি নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌষ মাস নিয়েও গান লিখেছেন। ওই তো, পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে আয়। আমরা পৌষ মাসেই না হয় পিকনিকে যাব।’ অর্ণব চশমা খুলে চিন্তিত মুখে বলল, ‘ওয়েদার ফোরকাস্টটা জেনে নিয়ে যদি রওনা দেওয়া যায়….।’ সুতপা ধমকে উঠে বলল, ‘রাখ তোর ফোরকাস্ট। আমি কোনও পাগলামিতে নেই।’
আঁখি বলল, ‘আমার কিন্তু ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে পিকনিকে মনে হচ্ছে মজাই হবে। সমস্যা শুধু রান্নার। উনুনে ধরানো হবে কী করে? জলে তো ভিজে যাবে।’ প্রদীপ রেগে আছে। সে বিরক্ত গলায় বলল, ‘শ্রীমতী প্রশ্নময়ী, আপনার উপহারের বদভ্যাসটা এবার মনে হচ্ছে ছাড়ার সময় এসেছে। আপনি কি বুঝতে পারছেন যে, আপনি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন?’
নন্দিতা হাত তুলে সবাইকে থামাল। বলল, ‘উফ! তোরা সবটা না শুনেই লাফাচ্ছিস? আমাদের স্পট হল কোলাঘাট। রূপনারায়ণ নদীর ধার। নদীতে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়বে। মেনু হবে খিচুড়ি আর ইলিশমাছ ভাজা। নদীতে বৃষ্টি দেখতে দেখতে খাব।’
সুচন্দনা বলল, ‘নদীর ধারে বসে খাব কী রে? বৃষ্টির জলে ইলিশমাছ ভাজা কি আর ভাজা থাকবে। ঝোল হয়ে যাবে। লোকে খায় সর্ষে-ইলিশ, আমাদের খেতে হবে বৃষ্টি-ইলিশ।’
নন্দিতা বলল, ‘তোরা এত ভিজব ভিজব করছিস কেন বল তো? আমরা কি খোলা আকাশের তলায় বসে থাকব? বাবার বন্ধু ঘোষকাকু কোলাঘাটে একটা ফ্যানটাস্টিক বাংলো কিনেছেন। একেবারে নদীর গায়ে। বাংলার স্পেশালিটি কী জানিস? সব ঘর থেকে নদী দেখা যায়। আর বারান্দায় বসার জায়গাগুলো কেমন, শুনলে তোদের চোখ কপালে উঠে যাবে। অর্ডার দিয়ে বেতের চেয়ারগুলো সব নৌকোর মতো বানানো। বসলে মনে হবে নৌকোয় চেপেছিস। ঘোষকাকুর সঙ্গে আজ সকালেই আমার ফাইনাল কথা হয়ে গেছে। কুক কেয়ারটেকার সব ব্যবস্থা করে রাখবেন। এভরিথিং। এবার বল, কে কে যাবি না? কেউ না গেলে কোনও অসুবিধে নেই। আমি একাই যাব। শীতকালের পিকনিকে অনেক লোক লাগে। বর্ষার পিকনিক একা-একাই করা যায়, কেউ না হলেও চলে। কারণ, সঙ্গে বৃষ্টি থাকে। আঁখি, কাগজ বের করে নামগুলো লিখে ফেল। তুই হলি আমাদের বর্ষা-পিকনিকের ম্যানেজার। সুতরাং যা করবার এখনই করতে হবে।’
যিশু লাফিয়ে উঠে বলল, ‘আমার নাম প্রথমে লিখবি আঁখি।’
দীপালি একটু আগেই অ্যালার্জির কথা বলছিল। এখন দেখা গেল তার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। বলল, ‘আমার প্রস্তাব হল, সবাইকে কিন্তু চাঁদা দিতে হবে। একশো টাকা পার হেড। নন্দিতা বর্ষা-পিকনিকের প্ল্যান দিয়েছে, জায়গা ঠিক করে দিয়েছে, বাংলো দিয়েছে। এটাই ওর দুর্দান্ত উপহার। তা ছাড়া চাঁদা ছাড়া পিকনিক হয় না, নেমন্তন্ন নেমন্তন্ন লাগে। তোদের কারও আপত্তি আছে?’
সুচন্দনা বলল, ‘আমার আপত্তি আছে। আমি চাঁদা দেব না। আমি দেব গাড়ি। আমাদের নতুন বোলেরোতে সবাইকে ধরে যাবে।’
সুতপা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘নন্দিতা, তোর ঘোষকাকুর বাংলোর কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে। কেননা, এই মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম— প্রয়োজনে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে পিকনিকে জয়েন করব।’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
প্রদীপ এবং বকুল ছাড়া সকলেই নাম লিখিয়েছে। প্রদীপ গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমি যাব না। কাল আমার কাজ আছে।’ বকুল কেন যাবে না সে-কথা পরিষ্কার করে বলতে পারল না। খানিকটা আমতা আমতা করে বলল, ‘আমায় এবার ছেড়ে দে।’
সম্প্রতি একটা ব্যাপার হয়েছে। আঁখি বকুলের সঙ্গে কথাবার্তা একদম কমিয়ে দিয়েছে। বিষয়টা এখনও অন্যদের চোখে পড়েনি। শুধু কথা নয়, বকুলের মুখের দিকেও আজকাল আঁখি কম তাকাচ্ছে। মনে হয়, দু’জনের মধ্যে বড় ধরনের কোনও ঝগড়া হয়েছে। তবে ঠিক কী হয়েছে বলা যাচ্ছে না।
বকুলের কথা শুনে আঁখি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ‘ছেড়ে দেওয়ার কী আছে। আমরা কাউকে পা ধরে সাধিনি।’ বকুল খানিকটা থতমত খেয়ে বলল, ‘ঠিকই।’
স্কুল ছুটির পর সুচন্দনা বলল, ‘ম্যানেজার হওয়ার পর থেকে আঁখি কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে, না?’ দীপালি বলল, ‘এই যে গম্ভীর-সুন্দরী, একবার লিস্টটা দেখতে পারি? হাঁটতে হাঁটতে একবার চোখ বুলিয়ে নিতাম।’
আঁখি বলল, ‘না, দেখতে পারো না। এটা তোমার ক্লাস নোটস নয় যে, বারবার চোখ বোলাতে হবে।’
তালিকা না দেখিয়ে আঁখি ভালই করেছে। সেখানে বকুলের নাম দেখে নিশ্চয় দীপালি খুব অবাক হয়ে যেত। যে যাবে না বলল, আঁখি তার নাম লিখল কোন আক্কেলে?
রাতে অনেকগুলো গোলমাল হল। প্রথম গোলমাল হল, আটটা নাগাদ মুষলধারে বৃষ্টি নামল। এক ঘণ্টার মধ্যে বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে জল জমে গেছে। সুতপার বাবা জুতো হাতে করে বাড়িতে এলেন। এসেই ঘোষণা করলেন, সবচেয়ে খারাপ ঋতুর নাম হল বর্ষা ঋতু। কাল আর বাড়ির বাইরে কারও পা দেওয়ার দরকার নেই। দ্বিতীয় গোলমাল সুচন্দনার। সে বাড়ি এসে ই-মেল খুলে দেখল মায়ের চিঠি এসেছে। কয়েক লাইনের চিঠি: চন্দনা, কনফারেন্স থেকে ফিরে এসে তোমাকে লিখছি। খুব পরিশ্রম যাচ্ছে। একটার পর একটা সেশন। তবে সারা পৃথিবীর সেরা চিকিৎসকদের সান্নিধ্যে পরিশ্রমের কথা মনেই থাকে না। এখনও জায়গাটা ঘুরে দেখা সম্ভব হয়নি। শুনেছি, এখানে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে নাকি ইলিশমাছের পাতুরি পাওয়া যায়। ভিয়েনায় ইলিশমাছের পাতুরি। তবু তুমি কিন্তু এই সিজনে ভুলেও ইলিশমাছ খাবে না। আদর নিয়ে। ইতি—মা। তিন নম্বর গোলমাল হয়েছে দীপালির। তার জ্বর এসেছে। হালকা জ্বর, সঙ্গে সর্দি। যিশুর গোলমাল অবশ্য তেমন সিরিয়াস নয়। তার টিউটর আজ যাওয়ার সময় বলে গেছেন, সোমবার তিনি অর্গানিক কেমিস্ট্রির উপর একটা টেস্ট নেবেন। পরীক্ষা যিশুর কাছে তেমন বিষয় নয়। আজ রাত জেগে পড়ে ফেলবে। সমস্যা হল, রাত জাগার পরদিন পিকনিক কেমন হবে? রাত জেগে পরীক্ষা হয়, পিকনিক কি হয়?
এদিকে সুতপার গোলমাল সিরিয়াস গোলমাল। পিকনিকের কথা শুনে তার মা ভয়ংকর চেঁচামেচি শুরু করেছে। যে-বরা বর্ষাকালে পিকনিক করার প্ল্যান করে, তাদের সংস্পর্শে থাকাটা যে কত বড় বিপদে, বারবার সে-কথা বলছেন। সুতপা অবশ্য দেরি করেনি, অনশন শুরু করে দিয়েছে। বিকেলের টিফিন খায়নি, রাতেও কিছু খাবে না। অনশনে কাজ না হলে ভোররাতের দিকে বাড়ি থেকে পালাবে বলে মন শক্ত করছে। কিঞ্জলের গোলমাল হয়েছে ক্রশওয়ার্ডের বই নিয়ে। বই কিনে ঠকে যাওয়ার ঘটনা বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেছে। লাল গম্ভীর হয়ে বলেছেন, যে-ছেলে এরকম ঠকতে পারে, তার পড়াশোনা হবে না। কিছুই হবে না। তাকে গাধারাও দলে নেবে না। এর পর পিকনিকের প্রসঙ্গ তোলা যায় না। রাত দশটা পর্যন্ত তোলাও যায়নি। বকুল পিকনিকের মধ্যে নেই। তবু এমন একটা ব্যাপার, যার মাথামুণ্ডু কিছুই সে বুঝতে পারছে না। স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ খোলার সময় দেখেছে চেনের ফাঁক দিয়ে একটা খাম ঢোকানো। খামের মধ্যে একশো টাকার একটা নোট। উপরে লেখা ‘পিকনিকের চাঁদা’। হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছে, মেয়ের। সম্ভবত প্রদীপের কাণ্ড। ওর হাতের লেখাটা মেয়েদের মতো ছোট ছোট। বকুলের বাড়িতে ফোন নেই। বাইরে গিয়ে প্রদীপকে যে একটা ফোন করবে তার উপায় নেই। বৃষ্টি পড়ছে। খুবই গোলমেলে ব্যাপার। বকুল বেশ চিন্তায় পড়েছে। তবে সবচেয়ে বড় গোলমালের ঘটনাটা ঘটল রাত দশটায়। প্রদীপ আঁখিকে ফোন করে বলল, ‘আঁখি, কাল পিকনিকে গীতবিতানটা নিয়ে যাস। গাধাদের একবার সূচিপত্রটা খুলে দেখতে বলিস। দেখবি, শ্রাবণ দিয়ে শুরু এমন গান আছে ঠিক আটটাই। ওনলি এইট। হুঁ, আমাকে গান শেখাচ্ছে। তুই ম্যানেজার বলেই তোকে ফোন করলাম। গুড নাইট। আর হ্যাঁ, খবরদার আমাকে তোদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য সাধাসাধি করবি না।’
বোম্বে রোড ধরে যখন হালকা হলুদ রঙের বোলেরো জি-এল-এক্স ছুটছে, আকাশ তখন ঝকঝকে। ধোয়া নীল আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ। শ্রাবণ কোথায়? মনে হচ্ছে আশ্বিন মাস। বড় একটা ধাবার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল। টি ব্রেক।
চারপাশটা ভারী চমৎকার। ঠান্ডা ঠান্ডা একটা হাওয়া। রোদেও একটা নরম ভাব। তবু সকলের মুখটা কেমন যেন শুকনো শুকনো।
নন্দিতা একটা অফ হোয়াইট জিনসের উপর নীল টি-শার্ট পরেছে। ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তোরা ঘাবড়ে যাস না। দেখবি ঠিক বৃষ্টি হবে। আরে বাবা, বর্ষাকালে এরকম হয়।’
অর্ণব একটা অদ্ভুত কাণ্ড করেছে। সাদা চুড়িদার পাজামার উপর বাদামি রঙের লম্বা ঝুলের একটা পাঞ্জাবি পরেছে। পাজামা-পাঞ্জাবি পিকনিকের পোশাক নয়, বিয়েবাড়ির পোশাক। তবু অর্ণব এটা পরেছে তার কারণ, পাঞ্জাবির উপর ফেব্রিক করে কবিতার কয়েকটা লাইন লেখা আছে। কবিতাটা বৃষ্টি নিয়ে: ‘এই মেঘ, এই জল/কোথায় যাবি বল?/কোথায় তোর ভালবাসার ছল?’ এর পরে আজ এই পাঞ্জাবি না পরে উপায় আছে। কিন্তু কোথায় বৃষ্টি? কোথায় জল? অর্ণব ক্ষীণস্বরে বলল, ‘কাল রাতে আমি কিন্তু বি বি সি-র ফোরকাস্ট শুনলাম। ওয়েস্টার্ন কোস্টের ওপর হেভি ক্লাউড…।’ দীপালি বলল, ‘রাখ তোর বি বি সি।’ দীপালি পরেছে সবুজ রঙের শাড়ি। মেঘলা দিনে সবুজ শাড়ি নাকি জঙ্গল জঙ্গল এফেক্ট তৈরি করে। দীপালির ক্ষেত্রে কিন্তু সেরকম কোনও এফেক্ট তৈরি করছে না। কারণ তার গলায় একটা ক্যাটক্যাটে বেগুনি রঙের মাফলার। ঠান্ডা লাগার জন্য তাকে বাধ্য হয়ে এই মাফলার নিতে হয়েছে। যিশু আজ তার পেপে-জিনসটা পরেছে। এই রংটা যিশুর পছন্দের রং নয়। কিন্তু প্যান্টে অনেকগুলো পকেট আছে। সেখানে যিশু গিটারের তার, ফিংগার রাখতে পেরেছে। গিটারটাকেও সে এনেছে খুব যত্ন করে। কালো রেক্সিনের কভার গাড়িতে ওঠার সময় সুচন্দনা বলেছিল, ‘গিটারটাকে তুই গাড়ির মাথায় দিয়ে দে।’ যিশু গাড়ি থেকে নেমে বলল, ‘তা হলে তোরা রওনা দে। আমি বাসে যাব।’ সুতরাং তাকে কোলে গিটার নিয়ে বসার অনুমতি দিতে হয়েছে। চা খেতে নামার সময়ও যিশুর কাঁধে গিটার। মনমরা মুখ করে বলল, ‘কী হবে নন্দিতা? আমি যে কাল রাত জেগে দু’খানা বর্ষার গান তৈরি করে ফেললাম। এই রোদে কি সেই ঝড়-বৃষ্টির গান মানাবে?’ সুতপা আজ পোশাক পরেছে বটে! মেরুন রঙের র্যাপ অ্যারাউন্ড স্কার্টে তাকে দুর্দান্ত লাগছে। কে বলবে ক’দিন আগেও তাকে মোটা হিসেবেই এই দলে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল। সুতপা বলল, ‘সেকী রে, তুই নাকি কাল রাত জেগে অর্গানিক পড়েছিস? গান লিখলি কখন?’ যিশু রেগে গিয়ে বলল, ‘চুপ কর মোটা।’ সুতপা হেসে বলল, ‘আহা, রাগ করছিস কেন, কলা খাবি? জানিস তো, কলা খেলে গলা খোলে।’
গতকাল রাতে অনশন করায় আজ গাড়িতে ওঠার পর থেকে সুতপা খাইখাই করছে। এখন যেমন সে চায়ের সঙ্গে কলা খাচ্ছে। সুচন্দনা মুখ বেজার করে ধাবার খাটিয়ার উপর পা গুটিয়ে বসে আছে। সে পরেছে একটা ক্যাপরি আর টি-শার্ট। অ্যানেবেলের টি-শার্টে এমব্রয়ডারির উপর চুমকি বসানো। রং ঘন নীল। সুচন্দনা খুব বাছাই করে এই জামা পরেছে। সে ভেবেছিল, চুমকিগুলোতে মেঘের ছায়া এসে পড়বে। মনে হবে সে গায়ে খানিকটা মেঘ মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন চুমকিতে এমন রোদ ঝলসাচ্ছে যে, বেশিক্ষণ তার দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। বেচারা এতে মুখ বেজার করবে না তো কীসে করবে? আঁখি আজ একদম ধবধবে সাদা সালোয়ার কামিজ পরেছে। শুধু ওড়নাটা লাল। প্রত্যেকদিনের মতো আজও তাকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। শুধু চোখের তলাটা কেমন যেন ফোলাফোলা। অনেক সময় বেশি কান্নাকাটি করলে এরকম হয়। অর্ণব বলল, ‘যথা আজ্ঞা ম্যানেজার সাহেব। ইস, বকুল আর প্রদীপ খুব মিস করল। ওরা এলেই পারত! প্রদীপটার না হয় কাজ আছে, বকুল কেন এল না রে?’ আঁখি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘কে জানে! মনে হয় চাঁদার পয়সা নেই। না এসেছে ভালই হয়েছে। গোমড়ামুখোদের নিয়ে পিকনিক হয় না।’
গাড়ি ছাড়ার ঠিক আগে একটা বাস এসে দাঁড়াল ধাবার সামনে। একটা লম্বা ছেলে হাত নাড়তে নাড়তে দৌড়ে এল। হলদে টি-শার্ট পরা ছেলেটার জামা রোদে ঝকমক করছে। কাঁধে এটা কী? প্রদীপ যে সত্যি সত্যি ছাতা নিয়ে এসেছে। হাঁফাতে হাঁফাতে সে যখন গাড়ির দরজা খুলল, তখন দেখা গেল শুধু ছাতা নয়, তার হাতে একটা গীতবিতান রয়েছে। গাড়িতে উঠে বলল, ‘পথেই তোদের দেখতে পেয়েছি। নে চল। আঁখি, ফান্ড থেকে আমার বাসভাড়া দিয়ে দিবি।’
নদীর কাছে এলে মানুষ শান্ত হয়ে যায়। অস্থির ভাব দূর হয়ে যায়। এদের ক্ষেত্রে উলটো হল। এরা নদী দেখামাত্রই ভয়ানক অস্থির হয়ে পড়েছে এবং লাফালাফি শুরু করছে। এই দলের প্রায় প্রত্যেকে কোনও-না-কোনও সময় নদী দেখেছে। কেউ কেউ বহুবার দেখেছে। তবু মনে হচ্ছে, এরা আজ এই প্রথম নদী দেখছে। ভবিষ্যতেও দেখার চান্স কম। সকলেই নদীর দিকে দৌড়ে গেল। দৌড়োতে গিয়ে দীপালি হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং তার কনুই ছড়ে গেল। প্রদীপ তাকে টেনে তুলেছে ঠিকই, কিন্তু নিজে উলটে পড়েছে। দীপালি বালি ঝেড়ে হাততালি দিতে দিতে আবার ছুট লাগল।
বর্ষার সময় নদীতীরে বালির চর থাকে না। সব চরই জলে ডুবে যায়। আশ্চর্যভাবে এখানে একটা চর জেগে রয়েছে। ভিড় থেকে সরে গিয়ে এই চর নদীপার ধরে চলে গেছে, বেশ অনেকটা। পারে বড় বড় গাছে কেমন একটা জঙ্গলমতো। তারা ঝুঁকে আছে চরের উপর। তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। খানকতক কালো রঙের বোল্ডার ছুঁয়ে জল চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, রূপনারায়ণ জানত আজ এরা আসবে। ওদের জন্যই সে এই চর সাজিয়ে রেখেছে। গাড়ি সেই চরের পাশে দাঁড়ানোমাত্র সবাই একেবারে পড়িমরি করে নেমে ছিটকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময় একবার এরা যদি মাথা তুলে তাকাত তা হলে দেখতে পেত, মেঘ আসছে। শ্রাবণের জল-ভরা কালো মেঘ।
অর্ণবের অঙ্কের নেশা আছে, কিন্তু তার যে ছবি আঁকার শখ আছে সে-কথা কারও জানা ছিল না। ব্যাগ থেকে রংটং বের করে সে একদিকে বসে পড়েছে। স্কেচ হয়ে গেছে। কয়েকটা নৌকো, তার মধ্যে একটা আবার পালতোলা। দূরে কোলাঘাট থার্মাল পাওয়ারের চিমনি দেখা যাচ্ছে। ছবি বেশ খারাপ হয়েছে। কিন্তু অর্ণবের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সেরা নিসর্গ চিত্রগুলির একটি আজ সৃষ্টি হতে চলেছে। জলে মেঘের ছায়া। অর্ণব প্যালেটে বেশি করে কালো রং গুলল। সুচন্দনা আর সুতপা বালির উপর পা ছড়িয়ে বসে লুডো খেলা শুরু করেছিল। বর্ষাকালের পিকনিক বলে ইন্ডোর গেম্স। কিন্তু খেলা শুরু হতে-না-হতেই ভেস্তে গেল। ঝোড়ো হাওয়ায় দুটো হলুদ আর একটা সবুজ গুটি হারিয়ে গেল। সুচন্দনা বলল, ‘দুর, লুডো খেলে সময় নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না।’
সুতপা বলল, ‘আমার খিদে পেয়েছে। ঘোষকাকুর বাংলো কোথায় রে?’ সুচন্দনা নাক কুঁচকে বলল, ‘কাছাকাছিই হবে নিশ্চয়। বাংলো তো আর নদীর মধ্যে হবে না। তবে এখন আমি কিছুতেই বাংলোফাংলোতে যাব না। এই জায়গা ছেড়ে আমি নড়ছি না।’
প্রদীপ লুকিয়ে দল থেকে অনেকটা সরে এসেছে। একটা গাছ বেছে নিয়ে তলায় বসেছে। এই গাছটার নাম কী? না, চেনা যাচ্ছে না। না জানলে ক্ষতি কী? গাছ নিশ্চয় চোখ পাকিয়ে বলবে না ‘এই যে মশাই, আপনি আমাকে চেনেন না, আমার তলায় এসে বসেছেন কেন?’ প্রদীপ নিজের মনেই হাসল। এই জায়গাটা মনে হয় কোলাঘাটের বিখ্যাত পিকনিক স্পটগুলোর মধ্যে একটা। না, বর্ষাকালে পিকনিকের প্ল্যানটা খারাপ নয়। পরিকল্পনার মধ্যে একটা পাগল পাগল ব্যাপার আছে ঠিকই। কিন্তু রাগ করে না এলে চমৎকার একটা মজা মিস হয়ে যেত। তবে শ্রীমতী প্রশ্নময়ীকে আজ জব্দ করতে হবে। আর সেজন্য সে গীতবিতান এনেছে। একেবারে শ্রাবণ মাস নিয়ে লেখা আটখানা গানের প্রথম কলি লিখে সে নন্দিতার সামনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। গুনগুন করতে করতে প্রদীপ গীতবিতানটা খুলল।
দীপালি একটা কালো বোল্ডারের উপর চিত হয়ে শুয়ে আছে। আকাশ-ভরা মেঘ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হচ্ছে, নদী উপরে উঠে এসেছে। মেঘের নদী। একটু আগে সে নদীর কাছে পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছে। জলে পা ভেজায়নি। অ্যালার্জির ভয় আছে। কিন্তু এখন মেঘের নদী দেখতে দেখতে সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ঠিক করেছে, সবাই বাংলোতে চলে গেলে সে আজ গোপনে নদীতে স্নান করবে। একটা তোয়ালে চাই।
গাড়ি থেকে নেমে অল্প সময়ের মধ্যেই যিশু গিটার বের করেছে। অনেক সময় ধরে কান মুচড়ে মুচড়ে গিটারের তার বাঁধছে। সুচন্দনা বলল, ‘কী রে, গাইবি না?’ সুতপা বলল, ‘চট করে গেয়ে ফেল যিশু। কিছু গান শুনলে ঘুম পায়, কিছু গান শুনলে কান্না পায়, তোর গান শুনলে মনে হচ্ছে খিদে। নে শুরু কর, তোর গান শুনে খিদেটা বাড়িয়ে নিই।’ যিশু বলল, আমি গাইলে তো তেড়ে মারতে আসিস। আজ এতবার বলছিস কেন?’ সুতপা বলল, ‘সামনেই নদী তো, সেজন্য বলছি।’ সুচন্দনা অবাক হয়ে বলল, ‘মানে? নদীর সঙ্গে গানের কী সম্পর্ক?’ সুতপা বলল, ‘নদী জঙ্গল সমুদ্র পাহাড়ের গুণ কী জানিস? এরা নিজেরা অনেকটা সুর সাপ্লাই করতে পারে। মহা বেসুরো লোককেও দেখবি বেড়াতে বেরিয়ে গলা খুলে গান করে।’
যে-যিশু গাইবার জন্য সবসময় পাগল হয়ে থাকে সে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘না, গাইব না। বৃষ্টি না নামলে আজ আমি গাইব না।’
অনেকটা গোটানো সত্ত্বেও ঢেউ চলকে উঠে প্যান্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে। কিঞ্জল নদীর জলে পা ডুবিয়ে ক্রশওয়ার্ড পাজ্লের ঠকে যাওয়া বইটা খুলে বসেছে। মজার কথা হল, আজ দেখা যাচ্ছে পেন দিয়ে করে রাখা পাজ্লগুলোর প্রায় সবকটাই ভুল। টুথলেসের মতো সহজ বানানে পর্যন্ত একটা এস! সামান্য একটা পেনসিল দিয়ে এক-একটা ভুল বের করার পর তার আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে। নদীর জলে পা দেওয়া আছে বলে লাফানো যাচ্ছে না। নদীর নিয়ম হল, একবার পা ডুবিয়ে বসলে চট করে সেই পা তুলতে নেই। নদী রাগ করে।
আঁখি একেবারে নদীর ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক এই পর্যন্ত এসে বালির চর শেষ হয়েছে। জল ছলকে উঠে আসছে এখানে। আঁখি সাদামাটা সাজলে কী হবে, তাকে এখন জলপরির মতো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, মেয়েটা এই বুঝি জল থেকে উঠে এল। এই জায়গাটা থেকে রূপনারায়ণের একটা বাঁক দেখা যায়। নদীর বাঁক যে-কোনও মানুষের মন ভাল করে দেয়। মনে হয়, এখান থেকে আর ফিরব না। বাঁক দেখতে পেলেও আঁখির মন একটুও ভাল লাগছে না। তার কলকাতায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। কী মুশকিল, আঁখির হল কী? আসলে খুব সুন্দর দৃশ্যের সামনে দাঁড়ালে অনেক সময় প্রিয়জনের জন্য মন কেমন করে। কে জানে আঁখিরও হয়তো সেরকম কিছু হচ্ছে।
নন্দিত চর ধরে হাঁটছে। তার একপাশে নদী, অন্যপাশে পার বরাবর গাছ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে জঙ্গল। আসলে জঙ্গল নয়, কোনও পুরনো বাড়ির বাগান। এতক্ষণ নদীর জল ছিল সোনালি, এখন কেমন একটা ছাই ছাই রং নিয়েছে। একটু আগে পর্যন্ত নদী থেকে ঝুপ ঝুপ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ঢেউয়ের শব্দ। সেই শব্দ হঠাৎ করে যেন খানিকটা বেড়ে গেছে। ঢেউগুলো খানিকটা উঁচু হয়েছে। জলের এই একটা মজা। বৃষ্টির খবর ওরা অনেক আগে পেয়ে যায়। তারপর লাফালাফি শুরু করে দেয়, নাচতে থাকে। নন্দিতা দাঁড়িয়ে পড়ল। অদ্ভুত লাগছে। গায়ের ভিতরটা কেমন যেন শিরশির করছে। তার ইচ্ছে করছে, লাফাই, চিৎকার করি। মনে হচ্ছে কেউ কোথাও নেই। শুধু নদী আর সে।
না, শুধু নদী আর সে নয়। ওই যে প্রদীপ আসছে। গাছের আড়াল থেকে প্রদীপ বেরিয়ে এসেছে। হন্তদন্ত হয়ে আসছে। কাছে আসতে নন্দিতা বলল, ‘কী হল রে, হাঁফাচ্ছিস কেন?’
প্রদীপ কাঁচুমাচু মুখে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘সরি নন্দিতা, আটটা নয়। আসলে আমি ভুল বুঝেছিলাম। শ্রাবণ মাস দিয়ে শুরু হয়েছে এমন গান আটখানা ঠিকই। কিন্তু শ্রাবণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন অনেক বেশি। এখন পর্যন্ত আটত্রিশটা পেয়েছি। লিস্টটা দেখবি?’ নন্দিতা হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই শুনব। তবে এখানে নয়। চল, একেবারে বাংলোতে গিয়ে সবাই মিলে শুনব। খিদেও পেয়ে গেছে। চল, রাস্তাটা পেরোলেই ঘোষকাকুর বাংলো। তাড়াতাড়ি পা চালা, নইলে, বৃষ্টি এসে গেলে ভিজতে হবে।’
প্ৰদীপ আর নন্দিতা বাকিদের ডাকতে এসে দেখল, সকলে নদীর ধারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে একটা নৌকো। নৌকোটাকে খানিকটা চরের উপর তোলা। একটা লোকের সঙ্গে দীপালি আর কিঞ্জল হাত-পা নেড়ে কী যেন বলছে। লোকটার খালি গা, চিবুকে দাড়ি, কাঁধে গামছা। মনে হয় মাঝি হবে।
নন্দিতাদের দেখে কিঞ্জল হাত তুলে চিৎকার করে বলল, ‘চলে আয়, ভাড়া ঠিক হয়ে গেছে। একপিঠ স্টুডেন্টস কনসেশন পেয়েছি। মাঝিভাই বলেছে, নদীর ভিতর যাওয়াটা ফ্রি। কোনও পয়সা লাগবে না। ফেরার জন্য শুধু পয়সা নেবে। যে ফিরবে না তার পয়সা লাগবে না। আমি তো ফিরব না। দেরি করিস না, উঠে আয়।’ নন্দিতারা দৌড় দিল। এদিকে নৌকোর উপর সুতপা আর অর্ণব তখন তুমুল ঝগড়া করছে। সুতপা বলছে, ‘অ্যাই জিরো, আমি সাঁতার জানি না, আমি মাঝখানে বসব। তুই সরে যা।’ অর্ণব বলছে, ‘আমি মাঝখানে বসব। আমি স্কেচ করতে করতে যাব।’
যিশু নৌকোর একদিকের মাথায় বসে গান শুরু করে দিয়েছে। আশ্চর্যের ঘটনা হল, সে নিজের তৈরি গান না গেয়ে একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইছে।…আমার যে দিন ভেসে গেছে…। বাঃ, ভারী চমৎকার গাইছে তো!
দীপালি ঠিক করেছে সে দাঁড়িয়ে যাবে। প্রদীপ জামাপ্যান্টে কাদা মাখিয়ে ফেলে হাসতে লাগল। বলল, ‘হ্যাঁরে, নৌকোবিহারটা বিকেলে করলে হত না?’ কিঞ্জল ধমক দিল, ‘বিকেলে এই মাঝিভাইকে পাব কোথায়?’ নন্দিতা শক্ত করে ধরে বসেছে। বলল, ‘দীপালি, মাঝনদীতে বৃষ্টি নামে যদি!’ দীপালি উদাসীনভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ‘নামবে না। আমার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।’ দীপালির কথায় সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল।
আঁখি পারে দাঁড়িয়ে আছে। সে নৌকোয় ওঠেনি। মাঝি তার কাছে এসে দাঁত বের করে হাসল। বিড়িতে টান দিয়ে বলল, ‘দিদিভাই, উঠে পড়েন। নৌকো ছেড়ে দিই।’
আঁখি বলল, ‘আমি উঠব না।’
লোকটা হলুদ দাঁত বের করে আবার হাসল। যেন আঁখি খুব মজার কথা বলেছে। বলল, ‘কেন দিদিভাই, ভয় লাগে?’
আঁখি বলল, ‘না, ভয় না। আপনি যান। আমার ভাল লাগছে না।’
মাঝি গলা নামিয়ে বলল, ‘ওঠেন, ওঠেন। নৌকো চড়ার ওইটেই মজা। একবার উঠলে দেখবেন সব ভাল লাগে। ভাল জিনিসও ভাল লাগে, মন্দ জিনিসও ভাল লাগে। হা হা। আসেন দিদিভাই, আমার হাত ধরেন।’
নৌকো ভাসানোর সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি নামল। নদীর জলে বৃষ্টির শব্দ খুব সুন্দর। ঠিক যেন বৃষ্টির গান।