কাক

কাক

হাসপাতালে ঢুকতে হয় মনে সুখ অথবা দুঃখ নিয়ে। মনের এই অবস্থাটা মুখে ফুটে ওঠে। হাসপাতালে রোগীর আত্মীয়দের মুখ দেখে বলে দেওয়া যায় রোগী এখন কেমন আছে। তার বিপদ কি কেটেছে? নাকি যমে-মানুষে টানাটানি চলছে এখনও?

গদাইয়ের মুখ দেখে আজ কিন্তু কিছু বোঝা মুশকিল। সে হাসপাতালে ঢুকেছে মনের দু’রকম অবস্থা নিয়ে। সুখ কিংবা একই সঙ্গে দুঃখ। কাজটা জটিল। একটা মুখকে একই সময়ে সুখী এবং দুঃখী করা কোনও সহজ ব্যাপার নয়। তবু গদাই ম্যানেজ করবার চেষ্টা চালাচ্ছে। সে আজ হাসপাতালে একই সঙ্গে দু’জনকে দেখতে এসেছে। প্রথমজন তাদের বাড়িওয়ালা সমাদ্দারের বড় মেয়ে। নাম তপতী। তপতী আছে মেটারনিটি ওয়ার্ডে। পরশু রাতে তার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। মা এবং নবজাতকের জন্য মুখ থাকবে হাসিহাসি। দ্বিতীয়জনও মহিলা। এই কেসটা গোলমেলে কেস। পয়জনিং কেস। সাপের কামড়। গদাইয়ের যত দূর মনে পড়ছে, এই মেয়ের নাম চন্দ্রা অথবা ছন্দা। মুকুন্দ হালদারের মেয়ে। কসবার বাড়িতে ভর সন্ধেবেলা তাকে নাকি সাপে কামড়েছে। এই মুহূর্তে মুকুন্দ হালদার গদাইয়ের জীবনের পক্ষে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই মেয়ের জন্য মুখ রাখতে হবে কাঁদোকাঁদো। অবস্থা সে রকম হলে হয়তো কাঁদতেও হবে।

একটু এগোতেই গদাই দেখল, বাড়িওয়ালা আসছে। নাতি হওয়া সত্ত্বেও মানুষটার মুখ গম্ভীর। গদাইকে দেখে বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘তুমি এখানে কেন?’ গদাই হাসিমুখে বলল, ‘দিদি আর বাচ্চাকে দেখতে এলাম। এত ভাল খবর।’ সমাদ্দার চোখের সঙ্গে নাকও কুঁচকে ফেললেন। বললেন, ‘তিন নম্বর নাতি হওয়াটা ভাল খবর তোমায় কে বলল গদাই? আমরা সকলেই খুব আপসেট, আর তুমি বলছ ভাল খবর! এই বোকামির জন্যই তোমার কিছু হল না। এখনও একটা চাকরিবাকরি জোটাতে পারলে না। ছেলে মানুষ করা যে কত কঠিন নিজেকে দেখে বুঝতে পারো না? মেয়ে হলে মানুষ করতে হয় না, বিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। যাক, এসেছ যখন চট করে একবার দেখে এসো।’

গদাই বুঝতে পারল, হিসেবে বড় ভুল হয়ে গেছে। বড় ভুল। মানেজারির এটাই বড় সমস্যা। ভুল হলে, বড় ভুল হয়ে যায়। তবে হাল ছাড়া যাবে না। সে কাঁচুমাচু মুখে ভেতরে ঢুকল। তপতী বেডে বসে আছে। একজন আয়া ধরনের মহিলার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। মুখে শোকের চিহ্নমাত্র নেই। গদাইয়ের দিকে তাকিয়েও একমুখ হাসল। তিন মাস ভাড়া বাকি থাকা ভাড়াটের দিকে তাকিয়ে বাড়িওয়ালার মেয়ে হাসা মানে বিরাট ব্যাপার। প্রায় জড়িয়ে ধরার সমান। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। গদাই কাছে এসে হেসে বলল, ‘তপতীদি, মা বলছিল ছেলে হলে ভাগ্যবতী হয়। আপনি হলেন ভাগ্যবতী।’ তপতী আবার হাসল। বলল, ‘শোনো গদাই, তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে। আমার এই ছেলের জন্য একটা ভাল নাম জোগাড় করে দিতে হবে যে ভাই। বেশ একটা কাব্যিক নাম। আমার বাকি দুটো হাবলা পটলা গোছের নাম পেয়েছে। নামেই বেচারিরা আদ্দেক মার খেয়ে গেছে।’ গদাই ঠোঁট উলটে বলল, ‘এটা কোনও কাজ হল? ক’টা নাম চান আপনি?’ একেই বলে ম্যানেজ। ঠিক সময় ঠিক কথা। সে গলা নামিয়ে বলল, ‘দিদি, একটা কথা বলতে লজ্জা করছে। কিন্তু আপনাকে ছাড়া আর কাকে বলি? তিন মাসের ভাড়া বাকি পড়ে গেছে। মেসোমশাইকে আপনি যদি একটু বলে দেন।’ তপতী বলল, ‘তিন মাস। ঠিক আছে, তুমি যাও। আমি বাবাকে বলব।’

হাসিমুখে বেরোলেও, মুখটা খুব দ্রুত গম্ভীর করল গদাই। এবারের পেশেন্ট হল শোকের পেশেন্ট। সেখানে হাসিমুখ চলবে না।

ফিমেল ওয়ার্ডের সিঁড়ির মুখেই মুকুন্দ হালদারের সঙ্গে দ্যাখা। ভদ্রলোক গদাইকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। একী কাণ্ড! মেয়ে বিষের জ্বালায় মরছে আর বাবা হাসছে! আজ এসব হচ্ছেটা কী? ঘটনা বুঝে ওঠার আগেই মুকুন্দ হালদার কাছে এসে বললেন, ‘এই যে গদাই, ডাক্তাররা এইমাত্র জানালেন, ছন্দার বিপদ কেটে গেছে। আউট অব ডেনজার।’ দুঃখ-মুখ মুছে গদাই ম্যানেজ দিতে গেল। বলল, ‘আমি জানতাম স্যার। আমি জানতাম। শহরের সাপে আর কত বিষ থাকবে?’ মুকুন্দবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘বলছ কী! আমাদের কসবার ওদিকে লাস্ট মান্থে দু’দুটো কেউটে মেরেছে পাড়ার ছেলেরা। একেবারে জেনুইন কেউটে। জু থেকে এসে ভেরিফাই করে দিয়ে গেল। আর তুমি বলছ শহরের সাপ। আরে বাবা, শহর বাড়ছে। এবার বলো তো মাঠঘাটের সাপখোপগুলো সব যাবে কোথায়? অ্যাঁ, যাবে কোথায়? তোমার আমার বাড়িতেই তো সেঁধুচ্ছে।’

বিপদ কেটে গেলে মানুষ খুশি হয়। তখন কেটে যাওয়া বিপদটাকে বড় করে দেখাতে ভালবাসে। গদাইয়ের মনে হল নিজের গালেই ঠাস করে একটা চড় কষাই। ছিঃ, এই সামান্য জিনিসটা সে বুঝতে পারল না? তার বলা উচিত ছিল, ‘ইস! অল্পের জন্য রক্ষা হয়েছে।’ সে নিজেকে সামলে নিয়ে চিন্তিত মুখে বলল, ‘স্যার, সাপটাকে কি মারা গেছে? কেউটের মতো ভয়ংকর জিনিস তো আর বেশিদিন বাড়িতে রেখে দেওয়া যায় না। তার ওপর কেউটে মারার আবার আলাদা কায়দা। বর্ধমানে থাকতে আমাকে কয়েকটা মারতে হয়েছিল কিনা। আমি স্যার নিজে আপনার বাড়িতে গিয়ে সাপ মেরে আসব।’ মুকুন্দবাবু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এসো একদিন।’

ভাল হয়ে উঠলেও এই মেয়েটার চোখ বন্ধ। চোখ-বন্ধ মেয়েদের বয়স বোঝা মুশকিল। তার ওপর আলোটাও কম। তবু ছন্দার বয়স আঁচ হচ্ছে। মনে হয়, কুড়ি-বাইশ হবে। তবে ছন্দার বয়সে গদাইয়ের কোনও উৎসাহ নেই। তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল তার বাবা অর্থাৎ মুকুন্দ হালদারের বয়স। সে-হিসেব এখন গদাইয়ের ঠোঁটে। উনষাট বছর নমাস চোদ্দো দিন। অর্থাৎ ষাট হতে বাকি মাত্র দু’মাস ষোলো দিন। তার পরই তিনি ঘোষ অ্যাসোসিয়েটস অ্যান্ড কোং থেকে অবসর নেবেন। এই কোম্পানির নিয়ম হল, ক্যাশিয়ার পদ থেকে যিনি ‘সততা’র সঙ্গে অবসর নেন তাঁকে একটা বড় পুরস্কার দেওয়া হয়। সৎ কাজের পুরস্কার। তিনি ইচ্ছে করলে কর্তৃপক্ষের কাছে পরবর্তী ক্যাশিয়ারের পদের জন্য নাম প্রস্তাব করতে পারেন। শোনা যায়, একসময় নাকি চিনে এরকম নিয়ম ছিল, সৎ কর্মীর কাছ থেকে আর একজন সৎ কর্মী নেওয়া। গদাই সেই ‘সৎকর্মী’ হতে চায়। সে চায় মুকুন্দ হালদার তার নাম প্রস্তাব করুক। গত ছ’মাস ধরে সে এই বুড়োকে ম্যানেজ করবার চেষ্টা করছে। এখন পর্যন্ত বুড়ো ‘হ্যাঁ’ বলেনি। বলেছে, ‘এসব কি ফট করে হয়?’

‘ফট করে করতে হবে না স্যার। আপনি ধীরে সুস্থেই করুন। আমার অবস্থা স্যার খুবই ক্রিটিকাল। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্যার অসৎ হওয়া যায়, কিন্তু সৎ হতে গেলে আজকাল স্ট্রং রেকমেন্ডেশন লাগে। আপনি তো স্যার সবই জানেন।’ হালদার বলেছেন, ‘আরে বাবা, তুমি বুঝছ না, এটা একটা সম্মানের প্রশ্ন। কোয়েশ্চেন অব লয়ালটি।’ গদাই বলেছে, ‘স্যার, আমার সততা নিয়ে কি আপনার কোনও প্রশ্ন আছে?’

‘না, প্রশ্ন নেই। তেমনি আবার কোনও উত্তরও নেই। তোমাকে আর দেখলাম কতটুকু?’

সেই দেখা চলছে। গদাই নিজেও নেড়েচেড়ে উলটেপালটে দেখাচ্ছে।

শব্দ পেয়ে ছন্দা চোখ খুলল। গদাইয়ের দিকে তাকাল। গদাই হাসল। মেয়েটা হাসল না। গদাই বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি সাপটা কি দেখেছেন?’

ছন্দা গম্ভীর গলায় বলল, ‘না।’ মুকুন্দবাবু বললেন, ‘দেখবে কী করে? উঠোন দিয়ে আসছিল। বাল্‌বটাও গেছে কেটে। হঠাৎ হাঁটুর কাছে কামড়।’

‘হাঁটু নয়। গোড়ালিতে।’ ছন্দা শুধরে দেয়।

‘ও! গোড়ালিতে কামড় বলেই ভয়ংকর কিছু হতে পারেনি।’ কথাটা বলেই গদাই বুঝল কথাটা কাঁচা হয়ে গেল।

ছন্দা কড়া গলায় বলল, ‘বাজে কথা বলবেন না। বিষাক্ত সাপ হাঁটুতে কামড়ালেও যা, গোড়ালিতে কামড়ালেও একই।’ তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘বাবা, তোমাকে কাল একবার বললাম না, যাকে-তাকে হাসপাতালে আসতে বলবে না? কাল তুমি একই কাণ্ড করেছিলে। বনির মাকে নিয়ে এসেছিলে। আজ এই গদাইলশকরবাবুকে এনেছ।’

বাইরে বেরিয়ে মুকুন্দবাবু বললেন, ‘তুমি কিছু মনে কোরো না গদাই। মেয়েটা ওইরকম।’ গদাই হাসিমুখে বলল, ‘আমি কিছু মনে করি না স্যার। স্যার, আমার চাকরির ব্যাপারটা কিছু ভাবলেন?’

‘হ্যাঁ, আর দেরি করা যাবে না। ম্যানেজমেন্ট তাড়া দিচ্ছে।’

হাসপাতালে ঢোকার সময়টা ছিল ঝামেলার। না হাসি, না কান্না। সব মিলিয়ে একটা টেনশন। এখন অনেক হালকা। বাচ্চার জুতসই দু’-চারটে নাম জোগাড় করতে পারলে হয়তো নেক্সট মান্থের বাড়িভাড়াটাও ম্যানেজ হবে। তারপর আছে সাপ মারা। তা হলে চাকরিটাও শিয়োর। গদাইয়ের মন ভাল হয়ে গেল।

পঞ্চবিংশ দণ্ডে কাক দক্ষিণ দিকে ‘ওয়া ওয়া’ ডাকলে গৃহবাসীকে অকস্মাৎ চক্রান্তের অপরাধে পড়তে হয়।

গিরিধারীবাবু আজ দুপুরে সেই ডাক শুনে বুঝেছিলেন একটা কিছু হবে। তাই হল। কাক হল দৈবজ্ঞ। তার ডাক সকল কল্যাণ-অকল্যাণের দিক নির্দেশক। তিনি জানেন, এ জিনিস ভুল হওয়ার নয়। আজ বিকেলে পুলিশ এসে ছোট ছেলে মাধবকে ডাকাতির দায়ে ধরে নিয়ে গেল। কাক ঠিকই বলেছিল। এটা চক্রান্ত ছাড়া কিছুই নয়। মাধব তো আর সত্যি সত্যি কাল রাতে জটুর টিভির দোকান ভাঙেনি। সে তো দরজা দিয়ে পড়ছিল। পড়বেই তো৷ সামনে যার মাধ্যমিক পরীক্ষা সে তো পড়বেই। সে কি ডাকাতি করতে বেরোবে? গিরিধারীবাবু একবার ভেবেছিলেন কথাটা পুলিশকে বলেন। তারপর ভাবলেন, না থাক। বলে লাভ কী? পুলিশের জিপ চলে যাওয়ার পর তিনি গদাইয়ের মাকে জানালেন। গদাইয়ের মা প্রতিবারের মতো আজও রেগে গেল। বলল, ‘যত্ত সব বুজরুকি। ঘরে একটা পয়সা নেই আর উনি বসে বসে কাকের ডাক শুনছেন।’ জটিল বাতের ঝামেলায় হাফ পঙ্গু গিরিধারীবাবু গভীর নিশ্বাস ফেললেন। গদাইয়ের মায়ের জন্য তাঁর করুণা হয়। এই জন্য বলে, অবিশ্বাসীদের কষ্ট বেশি।

হাসপাতাল থেকে ফিরতে ফিরতে গদাইয়ের রাত হল। বাড়িতে ঢুকেই জানা গেল, কলে জল নেই। সমাদ্দার জল বন্ধ করে দিয়েছে। শুয়োরের বাচ্চা। তিন মাস বকেয়া ভাড়াটাদের কি হাগু-মুতু নেই? মেজাজ খারাপের থেকে গদাইয়ের কাছে বিষয়টা চিন্তার। তপতী কি তা হলে এখনও বাবাকে বলেনি? যাক, ধৈর্য ধরতে হবে। ম্যানেজারির মূল মন্ত্রই হল ধৈর্য।

এমন সময় মা এসে বলল, ‘বড় খোকা, একবার থানায় যা। মাধবকে বিকেলে পুলিশে নিয়ে গেছে।’

মানুষের ক’টা ভাল নাম থাকে? একটা, খুব বেশি হলে দুটো। চারটে ভাল নাম কিছুতেই হয় না। হলে পাগলামি হয়। তপতী সেই পাগলামিই করছে। সে চাইছে তার ছেলের চারটে নামই থাকুক। গদাইয়ের আনা চারটে নামের কোনওটাই সে ফেলতে রাজি না। নাম লেখা কাগজটা নিয়ে বাড়াবাড়ির চরম করছে। আয়া নার্সদের তো দেখিয়েছেই, এমনকী দু’জন মরোমরো রোগীকে দেখিয়ে এল। গদাই খুশি। তার উদ্দেশ্য সফল।

ওয়ার্ডের বাইরে এসে সমাদ্দারের সঙ্গে দেখা। গদাইকে দেখে বাড়িওয়ালার গম্ভীর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। ‘গদাই, তোমার সঙ্গে কথা আছে। তপু কয়েকটা মাস আমার কাছে থেকে যাবে। ওর পছন্দ একতলাটা। কালই আমায় বলছিল, এ-সপ্তাহেই তুমি গদাইদের ছেড়ে দিতে বলে। আমি ভেবে দেখলাম, এক সপ্তাহটা বড় কম, তুমি না হয় দশটা দিন সময় নাও।’

ছন্দা আজ বসে আছো। চুল বিনুনি করে বাঁধা। মনে হয়, হাসপাতালে ভাল হয়ে যাওয়া মেয়েদের চুল বিনুনি করে বেঁধে দেওয়ার নিয়ম। গদাই উঁকি দিল। চোখ পড়তে ছন্দাই হাত নেড়ে ডাকল, ‘কী ব্যাপার গদাইলশকরবাবু, উঁকি দিচ্ছেন কেন? ভেতরে আসুন।’ গদাই ভেতরে ঢুকে বলল, ‘আসতে ভয় করছিল। যদি রেগে যান।’ ছন্দা বলল, ‘রেগে গেলেই বা আপনার কী? আপনাকে তো আসতেই হবে। তা ছাড়া আমার কাছে তো আসেননি। বাবার কাছে এসেছেন। আমার সব শোনা হয়ে গেছে।’ মেয়েটা কি নার্ভাস করে দিতে চাইছে? চাইলে চাক। একে দিয়ে কাজ হবে কি না সেটাই আসল কথা। ছন্দা বলল, ‘দাঁড়িয়ে থাকবেন, না টুলটা নিয়ে বসবেন? বসতে পারেন, তবে বললেই উঠে যেতে হবে। বুঝতে পারছি না আপনাকে কতক্ষণ সহ্য করা যাবে। আপনি এখন এমন প্যাঁচে আছেন যে এখন আপনাকে আমি যা বলব তাই করতে হবে। গল্প করতে ইচ্ছে না করলেও করতে হবে। তাই না? হি হি।’

গদাই টুল টেনে বসল। বলল, ‘আজ স্যার আসেননি?’ ছন্দা বলল, ‘না, এবেলা কেউ আসবে না। বিকেলে আমার ছুটি। শুনেছি, আপনি নাকি সাপ মারতে একদিন আমাদের বাড়িতে যাচ্ছেন? সেটা চাকরি পাওয়ার আগে না পরে? আমার মনে হয় পরে হলেই ভাল। নইলে হয়তো দেখবেন সাপও মরল, অথচ লাঠিও ভাঙল না। হি হি।’ গদাই ঘাবড়াতে ভালবাসে না। তবু কেন আজ সে বারবার ঘাবড়ে যাচ্ছে? এ মেয়ের থেকে দ্রুত পালাতে হবে। ছন্দার মুখ আজ দিনের আলোয় পুরো দেখতে পাচ্ছে গদাই। গায়ের রং কালো হলেও চোখগুলো বড়। কে জানে হয়তো সব মেয়েদেরই চোখ বড় হয়। মেয়েদের চোখ দেখার সময় গদাইয়ের হয় না। আজ কি সময় হল?

ছন্দা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনি এবার উঠুন গদাইলশকরবাবু। আর ভাল লাগছে না। ও হ্যাঁ, আপনি আজই একবার বাবার অফিসে যাবেন। বাবা বলে গেছেন।’

গদাইয়ের বুকটা ধক করে উঠল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তা হলে চাকরিটা হয়ে গেল? বাঃ! ধন্যবাদ জানানোর জন্য মুখ তুলে দেখল ছন্দা শুয়ে পড়েছে। তার চোখ বন্ধ।

অফিসে পৌঁছোতেই মুকুন্দবাবু গদাইকে ঘরে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘বসো গদাই। চা খাবে? দাঁড়াও কফি দিতে বলি। এরা কফিটা ভাল করে। গদাই, কথাটা তোমায় বলতে খারাপ লাগছে। সরি, এই চাকরিটা তোমার হবে না। ছন্দাকে কাল সব বলছিলাম। তুমি ভাল ছেলে, খুবই ভাল ছেলে। কিন্তু শুনলাম তোমার ভাই নাকি চুরি করে ধরা পড়েছে?’

এর জন্য প্রস্তুত ছিল না গদাই। চায়ের কাপে লম্বা করে চুমুক দিয়ে প্রস্তুত হল। তারপর নরম করে বলল, ‘না স্যার, চুরি নয়, ডাকাতি। টিভির দোকান ভেঙেছে, এরপর মনে হয় গয়নার দোকান ভাঙতে হবে। দোষই বা দিই কী করে? একটা কিছু করে তো ম্যানেজ করতে হবে। স্যার, আমরা হলাম অনেকটা কাকের মতো। ম্যানেজ করতে করতে বেঁচে থাকি। তাড়িয়ে দিলে উড়ে যাই। আবার আসি। তবে, থানার বড়বাবু ভারী চমৎকার একজন মানুষ। খবর পেলাম ভদ্রলোক আগে নাকি গ্রামের স্কুলে হেডমাস্টারি করতেন। তাকে ম্যানেজ করলাম। মাধবের মাধ্যমিক পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড দেখালাম। ক্লাস সেভেন থেকে এইটে ওঠার মার্কশিট দেখালাম। সেবার অঙ্কে নাইনটি নাইন ছিল। মনে হয় ভদ্রলোক মাধবকে ছেড়ে দেবেন। চমৎকার মানুষ।’

মুকুন্দবাবু মাথা নামিয়ে বললেন, ‘সত্যি, চমৎকার মানুষ। কিন্তু গদাই, তুমি তো এটা বুঝতে পারছ এই চাকরিটায় টাকাপয়সা নিয়ে কাজ— তুমি বরং বাড়িতে একদিন এসো। এই ধরো রোববার দেখে চলে এলে, একেবারে খাওয়াদাওয়া করে ফিরলে।’ গদাই অল্প হেসে বলল, ‘তাই ভাল স্যার। রোববার দেখেই যাব।’

অফিস থেকে বেরোনোর সময় রজনীবাবুর সঙ্গে দেখা হল। গদাই শুনেছে, এই লোকটা তার ভাইপোর চাকরির জন্য মুকুন্দ হালদারকে ধরেছিল। সুবিধে হয়নি। লোকটা দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘এই যে ব্রাদার, লেটেস্ট খবরটা শুনেছ তো? তোমার এই হালদারের মেয়ে নাকি বড় কেলেঙ্কারিতে ফেঁসেছিল, ফেঁসে বিষ খেয়েছিল। আমার শালা আবার ওদিকেই থাকে কিনা। সেই-ই বলছিল। তাই বলি, কসবায় কেউটে সাপ এল কোথা থেকে, অ্যাঁ! এরপর শুনব বালিগঞ্জে রয়েল বেঙ্গল টাইগার! হা হা! কেলেঙ্কারি ঢাকতে এইবাৰ সাপ বাঘ সব আসবে। হা হা।’ গদাই চমকে উঠল। ঘটনা তা হলে এই?

কোনও দরকার ছিল না তবু বিকেলে গদাই হাসপাতালে পৌঁছোল। ছন্দা তার বাবার সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠছে। নীল রঙের শাড়ি পড়েছে। নীল শাড়িতে বুঝি মেয়েদের এত সুন্দর দেখায়? ছন্দা তাকে দেখে এগিয়ে এল। হেসে বলল, ‘আসুন গদাইলশকরবাবু। আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’

গদাই ম্যানেজ করতে গিয়ে বলল, ‘এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম ঘুরে যাই। মনে করে উঠোনের বাল্‌বটা বদলাবেন এবার।’

ছন্দা গাঢ় স্বরে বলল, ‘চলুন, বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন। ভয় নেই সাপ মারতে হবে না, শুধু চা খেলেই চলবে।’

গদাই ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে ভাবল, গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বড় গোলমাল। কোথায় যেন কাক ডেকে উঠল। সন্ধের একা কাক। কাক কী বলছে? সে কি গোলমালের কথা বলছে? কে জানে, বাবা থাকলে হয়তো বলতে পারত। বাবা কাকের ডাক বোঝে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *