জল
বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই সাধারণত গভীর রাতে বা একটু বেলার দিকে ঘটে। ভোরগুলো সর্বদাই ভাল হয়। ঘুমের পর মন থাকে নরম। তাজা বাতাসের সঙ্গে নতুন রোদ। জানলা খুলে বুক ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। দূরের কোনও বাড়িতে রেডিয়ো চালানো হয়। ভেসে আসে গান। সে-গানের কথা বা সুর প্রায় কিছুই শোনা যায় না, তবু কেন জানি বেশ লাগে শুনতে। খারাপ ঘটনাগুলো বোধহয় নিজেরাও চায় না এত সুন্দর ভোরটাকে নষ্ট করে দিতে, তাই তারাও এই সময়টাকে এড়িয়ে চলে।
তবু এই বাড়িতে আজ সকালে একটা দুর্ঘটনা ঘটল।
কাদম্বরীদেবীর ঘুম একটু বেলার দিকে ভাঙে। অজন্তা আড়ালে বলে, রান্নাঘরে চায়ের কাপে টুংটাং তার শাশুড়ির কানে নাকি পাখির ডাকের একটা এফেক্ট তৈরি করে। যতক্ষণ না তিনি চা-পাখির ডাক শুনতে পাবেন ততক্ষণ তিনি উঠবেন না। ঘুম ভাঙলেও মটকা মেরে বিছানায় পড়ে থাকবেন। এই অভিযোগ সত্যি না মিথ্যে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অজন্তার স্বামী দীপঙ্কর। সে বার্ড অ্যান্ড ফ্লাই কোম্পানির বড় মাপের অফিসার। কর্মক্ষেত্রে বেশি কথা বলে এবং বাড়িতে কম বলে। যদিও সে তার স্ত্রীর অভিযোগ শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
‘রান্নাঘর একতলায়, মা শোয় তিনতলায়। একতলার শব্দ তিনতলায় যায় কী করে? তা ছাড়া চা বানানো তো আর হাতুড়ি পেটানো নয়। কাচের কাপ স্টিলের চামচ থেকে আর কতটা শব্দ হতে পারে?’
অজন্তা হাল ছাড়েনি। সে বলে, ‘এটা একটা ইনটুইশনের ব্যাপার। ছেলের বউ বাড়িতে এলে শাশুড়িদের এই ইনটুইশনগুলো তৈরি হয়। তোমরা ঠিক বুঝবে না।’
সত্যি দীপঙ্কর বুঝতে পারেনি। ফলে বিষয়টা অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
তবে সাধারণত যা হয় না, আজ তা হল। আজ কাদম্বরীদেবীর ঘুম কিছুটা আগেই ভাঙল। শুধু ভাঙল না, তিনি বিছানায় শুয়ে না থেকে উঠেও পড়লেন। অল্প আলো ফুটেছে। কাচের জানলা দিয়ে সেই আলো তিনতলার ঘরে এসে পড়েছে। অনেকদিন পর দেখার ফলে এই আলো কাদম্বরীদেবীর অচেনা লাগল। অচেনা অথচ সুন্দর।
সূর্যকান্তবাবু ঘুমোচ্ছেন। গভীর ঘুম। ঘুমের শেষ দিকে এরকম একটা গভীরতা আসে। যে ঘুমিয়ে থাকে সে বুঝতে পারে না। পাশে কেউ জেগে থাকলে ভুল করে ভাবে, মানুষটা কম করে আরও পাঁচ বা সাত ঘণ্টা ঘুমোবে। তা হয় না। একটু পরে ঘুমন্ত মানুষ টা জেগে ওঠে। কাদম্বরীদেবীর মনে হল, মানুষটাকে গভীর ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। তুলে বলেন, ‘দেখেছ, কী সুন্দর আলো!’ কিন্তু তা তিনি করলেন না। এ-ধরনের এলোমেলো কাজ তিনি কখনওই করেন না। এলোমেলো কাজে প্রশ্রয় দেওয়াও পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন সংসার ব্যাপার টা সুশৃঙ্খল একটা বিষয়। সেখানে চলতে হয় মাপজোক করে। স্বামীকে ঘুম থেকে তুলে সকালের আলো দেখানো সেই মাপের মধ্যে পড়ে না।
এই ঘরের মধ্যেই চার ফুট বাই তিন ফুট বাথরুম। আসল বাথরুম নয়, শখের বাথরুম। আসল বাথরুম ঘরের বাইরে। গত বছর গরমের আগে অনেক খরচ করে শখের বাথরুম বানানো হয়েছে। তিনি এ-ব্যাপারে বাড়ির কাউকে নাক গলাতে দেননি। কাজ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল কিছু খুঁত থেকে গেছে। খুঁত সবকিছুতেই থাকে। তবে এই খুঁতগুলো অন্যদের চোখে ধরা পড়ে গেল। অজন্তা বলে, ‘এমা, নীল গ্লেজড টাইলসের সঙ্গে সবুজ বেসিন আবার মানায় নাকি? মা, এটা আপনি কী করলেন! একটা নীল বেসিন পেলেন না?’ কথাটা ভুল নয়। নীল আকাশের সঙ্গে সবুজ গাছ মানায়, কিন্তু বেসিনের ক্ষেত্রে তা হয় না। অবশ্য করার কিছু ছিল না। মিস্ত্রি নীল বেসি্ন কিনে আনার পর দেখা যায় তার তলায় একটা হালকা চিড়। যে-কোনও সময়ে চিড় বড় হয়ে ফাটলের চেহারা নিতে পারে। তবে বদলানোর সময় আর রং মেলানো গেল না। এটা অত বড় করে বলার মতো কিছু নয়।
ছোটমেয়ে কণা ঠোঁট-কাটা টাইপের। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলতে ভালবাসে। শুনলে গা জ্বলে যায়। তবু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে কাদম্বরীদেবীর এই মেয়ের প্রতি একটা হালকা প্রশ্রয় আছে। তাঁর তিন পুত্রকন্যার মধ্যে এটি সবথেকে বুদ্ধিমতী। পড়াশুনোতে ভাল। শুধু ভাল নয়, খুবই ভাল। কিন্তু মুডি। মর্জিমতো চলতে ভালবাসে। এটা অসহ্য। ইচ্ছে করলেই মেয়েটা ডাক্তারি পড়তে পারত। পড়েনি, তার বদলে সে অঙ্কে অনার্স নিয়েছে। তার নাকি অঙ্কই পছন্দের। আসলে এর পেছনে তার বাবার গোপন আশকারা আছে। অঙ্ক একটা পড়বার মতো জিনিস হল? তা ছাড়া অঙ্ক ব্যাপারটা মেয়েদের সঙ্গে একেবারেই মানায় না। অঙ্ক জানা মেয়েরা অত্যন্ত কাঠখোট্টা ধরনের হয়। কিন্তু তাঁর সেসব কথা শোনা হয়নি। সেই থেকে কণার ওপর তিনি বিরক্ত।
কলেজ থেকে ফিরে কণা মায়ের বাথরুম দেখতে এল।
‘মা, তোমার এক্সক্লুসিভ বাথরুম নাকি শেষ হয়ে গেছে?’
‘কেন, তোমার আপত্তি আছে?’
‘আপত্তি থাকলেও সেটার এখন কোনও ভ্যালু নেই। কেননা বাথরুমটা হয়ে গেছে।’
‘তোমার আপত্তি শোনার মতো কোনও প্রয়োজন আমি দেখছি না। কলেজ থেকে ফিরে যদি তোমার মুখ ধোওয়া না হয়ে থাকে তা হলে তুমি ওখানে ঢুকতে পারো। বেসিনে মুখ ধুয়ে নাও। তবে শুধু আজই। এটা তোমাদের আমি ব্যবহার করতে দেব না।’
কণা বেরিয়ে এসে বলে, ‘আমাকে যদি তুমি জিজ্ঞেস করো তা হলে বলব, জিনিসটা খুবই খারাপ হয়েছে।’
কাদম্বরীদেবী গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করছি না।’
কণা তাও মা’র সামনে মোড়া টেনে বসে। বলে, ‘বাড়িতে যখন এতগুলো বাথরুম আছে তখন এটা তোমার বানানো ঠিক হয়নি। বানানো উচিত ছিল একটা ছোট বারান্দা। তা ছাড়া তুমি এই বাথরুম টা যেদিকে বানিয়েছ সেটা পূর্ব দিক। সকালবেলা মোড়া টেনে তুমি আর বাবা সেখানে বসতে পারতে। টাটকা হাওয়া এই বয়সে শরীরের পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয়। ফুল অফ অক্সিজেন।’
টিভি থেকে মুখ তুলে কাদম্বরীদেবী বললেন, ‘তুমি ডাক্তারি পড়ে ফেলেছ এটা আমার জানা ছিল না। আমি জানতাম তুমি অঙ্ক নিয়ে পড়ছ। মুখে বলেছ ফার্স্ট হবে, আসলে পড়াশুনো করো না বলে এ-বছর পার্ট ওয়ান পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছ। তুমি ডাক্তারি জেনে গেছ জানলে স্বাস্থ্য সম্পর্কে তোমার কাছে আগেই খোঁজখবর নিতাম।’
কণার কথাটা মিথ্যে নয়। বাথরুমের জন্য পূর্বদিক মোটেই ভাল নয়। কিন্তু দিক তো আর ইচ্ছেমতো পাওয়া যায় না। অনেক কিছু পাওয়ার জন্য দোকান আছে, কিন্তু দিক পাবার কোনও দোকান নেই। যেখানে জায়গা পাওয়া গেছে সেখানেই করতে হয়েছে।
বড় ছেলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। একদিন সেও বাথরুম দেখে গেল। বলল, ‘খুব ভাল হয়েছে। তবে জানলাটা আর একটু বড় হলে মনে হয় ঠিক হত। দিনের বেলা আলোটা আরও ঢুকত। তবে তাতে কোনও ক্ষতি নেই। বাথরুম তো আর শোয়ার ঘর নয়। ভালই হয়েছে। বেশ হয়েছে।’
বড় খুঁত ধরেছে বড় মেয়ে স্মৃতি।
ঘনঘন বাপের বাড়ি যাওয়া তার শশুরমশাই একেবারেই পছন্দ করেন না। কিন্তু মুশকিল হল, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যা পছন্দ করেনা স্মৃতি তা খুবই পছন্দ করে। তাই সে রবিবার রবিবার আসে। এ ছাড়াও প্রায় প্রতি সপ্তাহের মাঝখানে কোনও না-কোনও জরুরি কারণে তাকে একবার আসতে হয়। মা’র কাছ থেকে রান্না শেখা আছে, তা ছাড়া আছে বউদির সঙ্গে বাজার-দোকান। এবার বাথরুম দেখতে বুধবার আসতে হল।
স্মৃতি বাথরুমে ঢুকেই ছিটকে বেরিয়ে এল। আর্তনাদ করে উঠল, ‘ইস মা, তোমার তো ভয়ংকর ভুল হয়ে গেছে। বাথরুমের ঢাল টাইতো উলটো।’
ঢাল মোটেই উলটো নয়। নর্দমার মুখটা একটু ছোট, জল বেরোতে সময় নেয়। একে উলটো ঢাল বলে না।
এইসব খুঁত কাদম্বরীদেবী মোটেই গায়ে মাখেন না। ছেলে মেয়ে এবং ছেলের বউয়ের কথা গায়ে মাখার মতো বদ অভ্যেস তাঁর নেই। বাথরুমটা তাঁর অতি প্রিয়। অন্য কাউকে পারতপক্ষে ঢুকতে দেন না। নিজেই যে খুব একটা ঢোকেন তা নয়। তবে সকালে বেশ কিছুটা সময় কাটান।
আজও সেখানে ঢুকে তিনি বেসিনের কল খুলে দিলেন। দাঁত ব্রাশ করার আগে চোখে মুখে হালকা জল দিলেন। কোথায় যেন পড়েছেন, হালকা জলে মুখের ওপর থেকে বয়সের ছাপ কমে। গত এক বছরে কমেনি। সেটা কোনও কথা নয়, পঞ্চান্ন বছরের ছাপ এক বছরে কমবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তবু প্রত্যেকদিনই মিনিট সাতেক তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের মুখ পরীক্ষা করেন। এই সময় কল খোলা থাকে। দামি এবং আধুনিক সবুজ বেসিন থেকে চাপা ফুসফুস ফুসফুস শব্দে জল পড়তে থাকে। বড় ভাল লাগে। এরপর কাদম্বরীদেবী ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজতে শুরু করলেন।
এই অবস্থায় দুর্ঘটনাটি ঘটল।
কলের জল যেমন নিঃশব্দে পড়ছিল তেমন নিঃশব্দেই থেমে গেল।
কাদম্বরীদেবী ভুরু কোঁচকালেন। এমন হওয়ার কথা নয়। ভোর পাঁচটা থেকে পাঁচটা দশ মিনিটের মধ্যে এ-বাড়িতে প্রথম খেপে পাম্প চালানোর কথা। আবার পাম্প চলবে বেলা আটটার পর। কর্পোরেশনের জলবাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাঙ্ক ভরতি করে দেবার পর। বিকেলেও একবার জল আসে। তবে সবদিন আর বিকেলে পাম্প চালানোর দরকার হয় না।
আজ কি পাম্প চালানো হয়নি? খুবই বিরক্তিকর বিষয়। বাড়ির বউ যদি দায়িত্বজ্ঞানহীন হয় তা হলে সবকিছুই হতে পারে। বাড়িতে কাজের ছেলে আছে। পাম্প নিজের হাতে চালাতে হবেনা। শুধু নজর রাখতে হবে। সেটুকুও যদি না করে তা হলে কিছু বলার নেই। এরা মনে করে শ্বশুর-শাশুড়ি সব করে দেবে।
জল না থাকলে বাথরুম অসহ্য মনে হয়। মুখ-ভরতি পেস্টের ফেনা থাকলে সেই অসহ্য ভাবটা রাগের চেহারা নেয়। অতি যত্নের এবং প্রিয় বাথরুমকেও তখন চরম শত্রু বলে মনে হয়। কাদম্বরীদেবীরও সেরকম হল। তিনি ছিটকে বেরিয়ে এলেন। নিজের ঘরের দরজা খুলে নেমে এলেন সিঁড়িতে। দু’ধাপ নেমে আসার পরেই মনে পড়ল, ভুল হয়ে গেছে। আবার ফিরে গেলেন ঘরে। আলনা থেকে হাউসকোটটা টেনে নিয়ে গায়ে চাপালেন। ইদানীং তিনি সকালের দিকে হাউসকোট পরছেন। হাউসকোটে পারস্যোন্যালিটি বাড়ে। তবে বেশিদিনের অভ্যেস নয় বলে মাঝেমধ্যে ভুল হয়ে যায়। আজও হল।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কাদম্বরীদেবী বুঝতে পারলেন, বাড়ির ঘুম এখনও ভাঙেনি। এটাও অত্যন্ত আশ্চর্যের! এখন ক’টা বাজে? ঘুম থেকে উঠে পড়ার পক্ষে যথেষ্ট নয় কি? নাকি এরা নিয়মকানুন সব বদলে ফেলেছে? শৃঙ্খলা শিথিল হয়ে গেলে সংসারে এই ধরনের গোলমাল হয়। না, কড়া হতে হবে, আরও কড়া।
সিঁড়ির মুখে পাম্প ঘর। কাদম্বরীদেবী সুইচ ঠেলে নামিয়ে দিলেন। পাম্প চলছে। পৃথিবীর সব ধরনের পাম্পই বোধহয় একটু অলস প্রকৃতির হয়। কাজকর্ম তাদের বিশেষ পছন্দের বিষয় নয়। সেই কারণে চলতে শুরু করলেই তারা রাগে ‘গরগর’ ধরনের একটা শব্দ করে। এই শব্দে কাদম্বরীদেবীর রাগ আরও বেড়ে গেল। সেই বেড়ে যাওয়া রাগ আরও বাড়ল যখন তিনি ফিরে যাওয়ার সময় দেখলেন সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে ভীম।
ভীম এ-বাড়ির কাজের ছেলে। বয়স এগারো বাবারো। ভীমের নাম ভীম নয়, ছোটু। সে খুবই রোগা এবং দুর্বল। যখন এ-বাড়িতে কাজে ঢোকে তখন চুক্তি হয় হাতে হাতে সবধরনের কাজই তাকে করতে হবে। কিন্তু খুব অল্পদিনের মধ্যেই দেখা যায় ভারী ধরনের কোনও কাজ সে পারেনা। হাঁপিয়ে ওঠে। কাদম্বরীদেবী এ-খবর শুনে বলেছিলেন, ‘এরা হল পাজি শয়তান।’
ঠাকুমার এই গাল শুনে বুলু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘পাজি শয়তান কী গো ঠাকুমা? সব শয়তানই তো পাজি।’
নাতনির এই প্রশ্নে কাদম্বরীদেবী বিরক্ত হন। বলেন, ‘ছোটদের সব ব্যাপারে নাক গলাতে নেই। তোমার মা কি এ-ব্যাপার টাও তোমাকে শেখাতে পারেনি?’
বুলু সত্যিই ছোট। তার বয়স দশ। সে এ-বাড়ির ক্ষুদ্রতম সদস্য। অজন্তা-দীপঙ্করের মেয়ে। আপাত শান্তশিষ্ট দেখে অনেকে ভুল করে, আসলে খুবই বায়নাক্কাবাজ। সামান্য কোনও একটা বিষয়ে তিন দিন পর্যন্ত কাঁদার রেকর্ড ইতিমধ্যেই সে করে ফেলেছে। যে-কোনও মুহূর্তে সেই রেকর্ড সে ভেঙে ফেলতে পারে।
বুলু ধমক খেয়ে মা’র কাছে যায় এবং বলে, ‘মা, ঠাকুমা আমাকে শয়তানি শিখিয়ে দিতে বলেছে। না শেখালে আমি কিন্তু এক্ষুনি কাঁদতে শুরু করব।’
যাই হোক, ভারী কাজে ফেল করার পরও ভীম দু’বছর হল এ-বাড়িতে রয়ে গেছে। সম্ভবত তাকে তাড়াবার কথা সকলে ভুলে গেছে। এই রোগাপটকা ছেলেটার নাম কীভাবে ভীম হল তা এখন আর বলা মুশকিল। কেউ ঠাট্টা করে ডেকেছিল, সেটাই রয়ে গেছে। অনেক সময় সিরিয়াস জিনিসকে হারিয়ে দিয়ে হাসিঠাট্টার জিনিস বেশি স্থায়ী হয়ে যায়। সামান্য হাতটানের অভ্যেস থাকলে ও ভীম ছেলেটা খারাপ না। তার বেশ কিছু গুণ আছে। এই বয়েসেই সে খুব গম্ভীর প্রকৃতির। চট করে হাসিঠাট্টায় সে যোগ দেয় না। বুলু তাকে অনেক হাসানোর চেষ্টা করে এবং বারবার ব্যর্থ হয়। আবার চেষ্টা চালায়। একমাত্র কেউ বকাঝকা করলে সে হেসে ফেলে। এ-আচরণে প্রথমদিকে সকলেই খুব আশ্চর্য হত।
একবার হল কী, রাতে সকলে একসঙ্গে খেতে বসেছে। দীপঙ্করকে জল দিতে গিয়ে ভীমের হাত থেকে একটা কাচের গ্লাস পড়ে এবং ভেঙে যায়। কাচের গ্লাস ভেঙে যাওয়াটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল, এটা ছিল গ্লাসটার একটা সেটের সঙ্গে মেলানো। তার থেকেও বড় কথা হল, সেটটা অজন্তা বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে তার বোনের কাছ থেকে উপহারস্বরূপ পেয়েছে। স্বভাবতই অজন্তাও গ্লাসের সঙ্গে নিজে খুবই ভেঙে পড়ে। সে ভীমকে ধমকাতে থাকে। সবাইকে আশ্চর্য করে এই ধমকানিতে ভীম হেসে ওঠে এবং হাসতেই থাকে।
অজন্তা বলল, ‘ছেলেটা বোধহয় পাগল। এর আগেও দেখছিলাম বকাবকি করলে হাসে!’
কাদম্বরীদেবী বললেন, ‘পাগল না, পাজি বদমাইশ।’
বুলু বলল, ‘পাজি বদমাইশ কী গো বাবা? বদমাইশরা তো সবাই পাজি।’
কণা বলল, ‘আমার মনে হয় ছেলেটার এক্সপ্রেশনটা ঠিক সকলের মতো নয়।’
কম কথা বললেও দীপঙ্কর এবার কথা না বলে পারল না। বলল, ‘সেটা কী ব্যাপার?’
‘দাদা, ব্যাপারটা এমন কিছু নয়। এরকম হতেই পারে। তুই বেবুনের কথাই ধর না। জানিস তো সব প্রাণীই খাবারের খোঁজ পেলে খুশি হয়, লাফালাফি করতে শুরু করে। কিন্তু বেবুনের ক্ষেত্রে একেবারে রিভার্স হয়। খাবারের খোঁজ পেলে ওরা খুব মনমরা হয়ে যায়।’
বুলু আর্তনাদ করে উঠল, ‘সেকী! আমারও তো এরকম হয়! দুধ দেখলেই আমার খুব মনখারাপ হয়ে যায়। খুব কান্না পায়। আমি কি বেবুন পিসি?’
কণা বলল, ‘বেবুন না হলেও বাঁদর তো বটেই।’
সূর্যকান্তবাবু তাঁর বড় ছেলের মতো। হট্টগোল একেবারে পছন্দ করেন না। নিজের ব্যাবসায় সর্বদাই হট্টগোল। ব্যাবসা যত বাড়ছে হট্টগোল তত বাড়ছে। রোজই ভাবেন বাড়িতে একটু শান্তিতে কাটাবেন। কিন্তু বাড়িতে ইদানীং সবসময়ই হইচই।
তিনি বললেন, ‘থাক। একটা গ্লাস ভেঙে গেছে। ও আবার কিনে নেওয়া যাবে।’
কাদম্বরীদেবী স্বামীর কথায় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘তুমি থামো তো। তোমার জন্যই সংসারে আজ এই অবস্থা। তোমার যদি একটা ‘সে’ থাকত তা হলে এসব হত না। কবে বলেছি এসব আপদ বিদায় করো। ওটা একটা পাজি বাঁদর। কে শোনে কার কথা। এইটুকু বাড়িতে কী এমন কাজ? সকলে হাতে হাতেই সেরে ফেলতে পারে। এর জন্য একটা সবসময়ের লোক পোষার কোনও মানে হয়?’
কণা বলল, ‘সকলে বলতে তুমি কাকে কাকে ধরছ মা? আমাকে কিন্তু বাদ দেবে।’
‘তোমাকে কেউ ধরেনি। কোনদিন তোমাকে কোন কাজে লাগে? বাড়ির কুটোটি পর্যন্ত নাড়ো না।’
‘দ্যাখো মা, তুমি যদি রাগ না করে তা হলে একটা কথা বলি। হিসেবের কথা।’
কাদম্বরীদেবী বললেন, ‘না বলতে হবে না। তোমার অঙ্ক তুমি পরীক্ষার খাতায় করবে। খাওয়ার টেবিলে নয়।’
কণা তাও বলল, ‘দ্যাখো, কাজের ব্যাপারে সকালের দিকে তোমাকে পাওয়া যাবে না। ইদানীং তুমি লেটরাইজার। তারপরে পুজোটুজো আছে। বাবাকে নিশ্চয়ই তুমি কাজকর্মের মধ্যে ফেলছ না। দাদার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কী রে দাদা, তুই কি অফিস কামাই করে চা-ফা বানাতে পারবি ? তারপর ধর দুধটা একটু এনে দিলি। হাত খালি থাকলে বসে না থেকে বসার ঘরের সোফাটা একটু ঝেড়ে দিলি। কী রে পারবি? মনে হয় না। তা হলে রইল পড়ে শুধু বউদি। মা, আমার মনে হয় ওইসব হাতে হাতের মধ্যে না গিয়ে তুমি শুধু বউদির হাতে সব দায়িত্ব ছেড়ে দাও। কোনও ভাগশেষ থাকবে না, হিসেব একেবারে মিলেযাবে। কী যাবে না?’
কাদম্বরীদেবী গম্ভীর। সূর্যকান্তবাবু খাওয়ায় ভীষণরকম মন দিলেন। যেন রুটি হল চারা মাছ, একটু অমনোযোগী হলেই কাঁটা ফুটবে। দীপঙ্কর পরপর দু’গেলাস জল খেয়ে ফেলল। অজন্তা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল, ইস, কণাটা এমন সব কাণ্ড করে না।
গোটা ঘটনাটা অন্যদিকে মোড় নেওয়ায় ভীমের ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল না। সে ঠিক কোন ধরনের ‘পাজি’ তা নিয়ে অবশ্য কাদম্বরীদেবী এখনও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই সকালে বাড়ির কর্ত্রীকে পাম্পঘরের সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখে ভীম যথেষ্ট অবাক।
ভীমকে দেখে কাদম্বরীদেবীর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। লাই দিয়ে দিয়ে ছোকরাকে এরা মাথায় তুলেছে। নইলে কাজের ছেলে এত বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে? প্রচণ্ড একটা ধমক দিতে ইচ্ছে করল। মুখে টুথব্রাশ থাকলে অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু ধমক দেওয়া যায় না। তবে একটা কিছু করা দরকার। তিনি এগিয়ে গিয়ে ভীমের গালে সজোরে একটা চড় কষালেন।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখে অজন্তার সঙ্গে দেখা। গুনগুন করতে করতে সে নীচে নামছে। এত ভোরে শাশুড়িকে দেখে সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। নেহাত সকালে ভূত দেখার নিয়ম নেই, নইলে সে হয়তো ‘ভূত’ বলে চেঁচিয়ে একটা কেলেঙ্কারি করে ফেলত। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে বলল, ‘মা, আপনি এত সকালে! শরীরটরির খারাপ নয় তো? প্রেশার বেড়েছে?’
ভীমকে চড় মেরে রাগ যেটুকু কমেছিল বউমাকে দেখে সেটুকু আবার চড়ে গেল। একেও একটা চড় মারা উচিত। পুত্রবধূদের মারার ব্যাপারে আইনে বাধা আছে। তবে যে-পুত্রবধূরা দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে, শাশুড়ির মুখে টুথব্রাশ দেখেও ভাবে প্রেশার বেড়েছে, এবং সর্বোপরি বাড়িতে জল না-থাকা সত্ত্বেও গুনগুন করে গান করে, তাদের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আইনের ফাঁক আছে। আপাতত সেই ফাঁক খুঁজে না-পাওয়ায় কাদম্বরীদেবী কী একটা বলতে গেলেন। মুখে টুথব্রাশ থাকায় সেকথা বেরোল না। একটা ‘হপচপ’ ধরনের শব্দ হল। সেই শব্দ শুনে ঘর থেকে ঘুম চোখে বেরিয়ে আসা বুলু হি হি করে হেসে উঠল। আজ তার একটা বিশেষ দিন, এই বিশেষ দিনে নাতনিকে চড় মারা যায় না। নইলে কী হত বলা যাচ্ছে না।
তিনতলায় নিজের ঘরে ঢোকার আগে কাদম্বরী শুনতে পেলেন শোঁ শোঁ শব্দ করে পাম্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জল টানতে না-পারলে পাম্পরা সাধারণত এরকম একটা দীর্ঘশ্বাস জাতীয় শব্দ করে চুপ করে যায়।
নীচের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাঙ্কেও জল ফুরিয়ে গেছে।
বাড়ি এখন সত্যিকারের জলশূন্য। ভোরবেলা এ-বাড়িতে ছোটভাবে যে দুর্ঘটনা শুরু হয়েছিল এখন তা বড় চেহারা নিল।
২
আটটা নাগাদ বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল।
ট্যাক্সি থেকে খুব সুন্দরী এক মহিলা নামল। তার হাতে একটা ঢাউস সুটকেস। সুটকেসের পেছন পেছন নেমে এল দুটো ছোট ছেলে। একটা ছেলের কাঁধে কিটব্যাগ ধরনের একটা জিনিস। সেটিও ফুলে ঢোল। ছোট কাঁধে সেটি থাকতে চাইছে না, বারবার পড়ে যাচ্ছে। আর একটি ছেলের কাঁধে কিছু নেই, হাতে একটা ফুটবল। তবে এই গরমেও তার মাথায় একটি লাল রঙের মাফলার জড়ানো। সম্ভবত সে অসুস্থ। এই ছেলেদুটোকেও খুব ফুটফুটে দেখতে।
সুন্দরী এই মহিলার নাম স্মৃতি। ফুটফুটে ছেলেটি তারই। একজনের ডাকনাম নোটন, আর একজনের ঝোটন। নোটন তার ভাইয়ের থেকে দু’বছরের বড়। এদের নাম নিয়ে ছোট একটা সমস্যা আছে। নিজের ডাকনামটা ঝোটনের একেবারেই পাছন্দ নয়। তার পছন্দের নাম হল নোটন। সে দাদার কাছ থেকে নামটা চেয়েছেও। কিন্তু নাম তো এমন জিনিস নয় যে ইচ্ছেমতো দিয়ে দেওয়া যাবে। নোটন তাই বিষয়টি চিন্তাভাবনার মধ্যে রেখেছে। তবে ভাইয়ের অসুখবিসুখ হলে তার মন ভাল করতে সে নিজের নামটা কয়েকদিনের জন্য তাকে ব্যবহার করতে দেয়। আজ সকালে যেমন দিয়েছে। ফলে ঝোটনের নামও এখন নোটন। গলা ব্যথা এবং জ্বরজ্বর ভাব থাকলেও দাদার নাম পেয়ে তার মন এখন বেশ খুশিখুশি।
তিনতলার বারান্দা থেকে সূর্যকান্তবাবু তাঁর বড় মেয়ে এবং নাতিদের নামতে দেখলেন। এতে তাঁর খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু তিনি চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকলেন।
কাদম্বরীদেবীর মেজাজ এখনও ঠিক হয়নি। তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। খাবার জলের বোতল থেকে জল নিয়ে তাঁকে দাঁত মাজতে হয়েছে, মুখ ধুতে হয়েছে। দু’কাপের জায়গায় চা এসেছে এক কাপ। সবথেকে বিচ্ছিরি ব্যাপার হল, সূর্যকান্তবাবুকে দেখে মনে হচ্ছে না জলসমস্যা নিয়ে তিনি আদৌ চিন্তিত। সত্যিই এরপরে মেজাজ ভাল রাখা অত্যন্ত শক্ত ব্যাপার। তিনি গুম হয়ে বসে টিভিতে ভজনের অনুষ্ঠান দেখছেন।
‘স্মৃতিদের কি আজ এখানে আসার কথা ছিল?’ স্বামীর প্রশ্ন শুনতে পেয়েও তিনি কোনও উত্তর দিলেন না! সূর্যকান্তবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী গো? স্মৃতিদের কি আজ এখানে আসার কথা ছিল নাকি?”
‘কেন বাপের বাড়ি কি কথা থাকলে আসতে হয়? এমনি আসা যায় না?’
‘তা বলছি না। সে তো ও আসেই।ֹ’
‘আলবাত আসবে। বেশ করবে আসবে। বাপের বাড়ি আসার ব্যাপারে ওর শ্বশুর-শাশুড়ি বারণ করার কে? ওই তো বাড়ি, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। স্মৃতির এর থেকে ঢের ঢের ভাল বিয়ে হত। ছিঃ, অমন ডানাকাটা মেয়ের স্কুলমাস্টার বর! ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সব লাইন লাগাত। লোককে বলতে পারি না। সেই বাড়ির আবার এত বাধানিষেধ কীসের?’
‘এগুলো সব আমি জানি। তুমি আবার বলছ কেন বুঝতে পারছি না।’ সূর্যকান্তবাবু শান্ত গলায় বললেন।
‘ছাই জানো। জানো অমর গত দু’মাস স্কুল থেকে মাইনে পায়নি? ওদের স্কুলে কী একটা ঝামেলা চলছে। জানো সেকথা?’
সূর্যকান্তবাবু একটু অবাক হলেন। এই খবরটা তিনি জানেন না। জানা উচিত ছিল। কেউ তাঁকে বলেনি। অথচ পরিচিত মানুষজনের ভাল খবরগুলো যেমন জানা যায় তেমনি খারাপ খবরগুলো জানা উচিত। এরা এটা বোঝে না, খারাপ খবরগুল লুকিয়ে রাখে।
কাদম্বরীদেবী একটু চুপ থেকে আবার শুরু করলেন।
‘ওদের বিকেলে এখানে খাওয়ার নেমন্তন্ন। আজকের তারিখটা কি তুমি ভুলে গেলে? কী করে যে কী হবে! বাড়িতে একফোঁটা জল নেই। অত রান্নাবান্না। বউমাটাও হয়েছে তেমনি অকাজের। সকাল থেকে যে একটু নড়াচড়া করবে তা নয়, দুপুর পর্যন্ত ঘুমোবে।’
‘স্মৃতি চলে এসেছে। ছেলেদের নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামল। আমার মনে হয় কোনও গোলমাল হয়েছে।’
কাদম্বরীদেবী স্বামীর দিকে তাকালেন।
‘কেন গোলমাল কেন? ট্যাক্সিওলার সঙ্গে ঝগড়া করছে নাকি?’
‘না, সেসব কিছু নয়। তবে রাতের নেমন্তন্ন খেতে কেউ সাতসকালে সুটকেস নিয়ে চলে আসে না।’
কথাটা শুনে কাদম্বরীদেবী চমকালেন না। চমকানোর কোনও কারণ নেই। কেননা তিনি জানতেন, দু’-একদিনের মধ্যেই মেয়ে নাতিদের নিয়ে চলে আসবে। সত্যি কথা বলতে কী এ-ব্যাপারে গত তিনসপ্তাহ ধরে মেয়েকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সবটা গোপন রাখা হয়েছিল। মুখে অবশ্য বললেন, ‘যদি চলে আসে তা হলে বলব ঠিক করেছে। বেশ করেছে। অমন অপদার্থ বর আর শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ওর অনেক আগেই চলে আসা উচিত ছিল। ওদের মনে রাখা উচিত মেয়ের বাবা-মা মরে যায়নি।’
সত্যিই স্মৃতি চলে এসেছে। কাল রাতেই আসত। ঝোটনের টনসিল ফুলে জ্বর এল বলে আসতে পারেনি। তবে এদের হাবভাব দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। একতলার গেস্টরুম খুলে দেওয়া হয়েছে। স্মৃতি সেই ঘরের আলনায় খুব যত্ন করে তার শাড়ি এবং ছেলেদের জামাটামা গোছগাছ করছে। নোটন এবং ঝোটন দোতলায় বুলুর কাছে চলে গেছে। ঘরের মধ্যেই তারা ফুটবল খেলতে শুরু করেছে। অজন্তার ড্রেসিং টেবলটাকে গোলপোস্ট বানানো হয়েছে। বুলু হয়েছে গোলকিপার। খুবই উত্তেজনার ফুটবল। একটা গোল খাওয়ার মূল্য ভয়াবহ। আয়না, সেন্টের শিশি, লোশনের বোতল যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। এই উত্তেজনায় ঝোটনের জ্বরজ্বর ভাবটা এখন অনেকটা কম। অজন্তার উচিত ছিল ঘরের মধ্যে এই খেলা বন্ধ করা। তার খুবই ইচ্ছে করছে ভাল করে কান মূলে তিনজনকেই বাইরে বের করে দিতে। কিন্তু তা সে পারবে না। কেননা, গতকাল রাতেই মেয়ের সঙ্গে তার শর্ত হয়েছে, আজ বিশেষ দিনে তাকে কোনও কাজেই বাধা দেওয়া চলবে না। কিন্তু এই দৃশ্য বেশিক্ষণ বসে থেকে দেখা অসম্ভব। হার্টের ক্ষতি হতে পারে। সে নীচে চলে গেল।
একতলার অবস্থা আরও সংকটজনক। এক ফোঁটা জল নেই। রান্নাঘর, বাথরুম সব একেবারে খটখট করছে। রান্নার মাসি ঘুরে গেছে। বলে গেছে, জল এলে আসবে। আজ আবার রান্নার ঝক্কি অনেক বেশি। সকালে পার্শে মাছ ভাজা আর দই-কই। শাশুড়ি নিজে পায়েসটা করবেন বলেছেন। ছোটখাটো শখেরগুলো উনি করেন, বড় ঝামেলাগুলো সব অন্যের ঘাড়ে। অথচ বিকেলের পোলাও, চিকেনটা উনি করতে পারতেন। কিন্তু করবেন না। সবকিছু কেনাকাটা আছে। বুলুর বাবা বাজারে মাছ আনতে গেছে। মাছ আর কলের মিস্ত্রি একসঙ্গে নিয়ে ফিরবে।
জল না থাকাও ভীমেরও কোনও কাজ নেই। বড়দির মালপত্র ঘরে তুলে দেবার পর সে ঘুরঘুর করছে। ওপরের খেলায় সে যাবে না। সেখানে খুবই হাসাহাসি হচ্ছে। এটা তার পছন্দ নয়। তা ছাড়া ফাঁকায় ফাঁকায় থাকলে ছোটখাটো জিনিসটিনিস একটু-আধটু এদিক-ওদিক করা যায়। তার টিনের সুটকেসে এরকম এদিক-ওদিক করা জিনিস বেশ কয়েকটা জমেছে। তেমন দামি কিছু নয়, ক্রিমের কৌটো, বাজনা-বাজা লাইটার, একটা ক্যাসেট এইসব। দামি বলতে বুলুর একটা দুল। তাও জোড়ার একটা মাত্র।
ভীমের গালে এখনও চড়ের দাগ মোছনি। তবে তা নিয়ে সে একেবারেই চিন্তিত নয়। সে সিঁড়িতে বসে গুনগুন করে গাইছে— বসিয়া বিজনে কেন একা মনে। এরপরে সে গাইবে, ফুলের জলসায় নীরব কেন। এইটি তার একটি অদ্ভুত গুণ। কাজের লোকদের ক্ষেত্রে সচরাচর এরকম দেখা যায় না। বুলুর গান শেখা শুনে শুনে সে বেশ কিছু গুরুগম্ভীর গান জেনে গেছে। ভুল সুরে সেইসব গান দু’-তিন লাইন করে সে মাঝেমধ্যেই গায়।
অজন্তা গেস্টরুমে ঢোকার আগে একটু থমকে দাঁড়াল। এই ননদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কিঞ্চিৎ ঠোকাঠুকির। বোকাসোকা মানুষটা যে খারাপ তা নয়, কিন্তু শাশুড়ির সাইড নিয়ে চলে। অজন্তার কাছে খবর আছে সে শাশুড়িকে নাকি বলেছে, ‘আমি সুন্দরী বলে বউদি আমাকে হিংসে করে’। এ—ব্যাপারে দীপঙ্করকে সে একবার কমপ্লেনও করেছিল। দীপঙ্কর বলেছিল, ‘হিংসেটিংসের কথা জানি না। তবে স্মৃতি যে সুন্দরী এতে কি তোমার সন্দেহ আছে?’
‘তা বলে আমি হিংসে করব? তুমি এটা কী বলছ?’
‘আমি তো তা বলিনি।’
‘স্মৃতিটা মায়ের মতোই মিন মাইনন্ডেড হয়েছে। কই কণা তো এরকম নয়!’
‘আহা, কথাটা বলেছে কিনা সেটা একবার ভাল করে খোঁজ নেবে তো। শোনা কথায় বিশ্বাস করছ কেন?’
‘এরকম একটা নোংরা কথা নিয়ে ঘাঁটতে আমার রুচিতে বাধবে। তা ছাড়া তোমার ওই বোন কত সুন্দরী? কাজল না মাধুরী দীক্ষিত? আমাদের কলেজে অমন ঢের ঢের সুন্দরী ছিল। তা ছাড়া সারাসপ্তাহ বাপের বাড়িতে বসে থাকলে এমনিতেই ফিগারে গ্লেজ দেয়। আমার মতো যদি সংসারের হাঁড়ি ঠেলতে হত তা হলে দেখতে দু’দিনেই চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে।’
‘নোংরা কথা নিয়ে তুমি বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করছ অজন্তা। তাই না?’
স্মৃতি বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে সকালেই হাজির কেন? নিশ্চয় ও-বাড়িতে বাড়াবাড়ি কিছু হয়েছে। অজন্তার সন্দেহ হল।
অজন্তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে স্মৃতি হাসল। একরকমের হাসি আছে যা খুবই মারাত্মক। মানুষকে ভুল জিনিস শেখাতে চেষ্টা করে। মনে হয়, পৃথিবীতে দুঃখটুঃখ যা আছে তা আসলে সবটাই বানানো, এই হাসিটাই সত্যি। স্মৃতির হাসিটা হল সেই ধরনের মারাত্মক হাসি। এই হাসি যতবার দ্যাখে ততবারই অজন্তার হিংসে হয়। মনে হয়, ইস, আমি যদি ওরকম হাসতে পারতাম। আজও হল।
‘এসো বউদি! আমিই ওপরে যেতাম, ঘরটা একটু গুছিয়ে নিচ্ছি।’
‘ওইটুকু আলনায় অত জিনিস রাখবে কী করে? শাড়িগুলো তো কুঁচকে যাবে৷’
অজন্তা মনে মনে ভাবল, ঝামেলা তা হলে বড় রকমের।
‘কী বউদি, ঘাবড়ে গেলে তো? ভাবছ ঘাড়ে পড়লাম? ভয় নেই, বাবা যতদিন বেঁচে থাকবে দাদার ঘাড়ে পড়ব না।’
‘ছিঃ স্মৃতি, একথা কেন বলছ? আমি কি তোমাকে সেরকম কিছু বলেছি? এটা তো তোমারও বাড়ি! আর তা ছাড়া ভালই তো হল, সবাই মিলে বেশ কয়েকদিন থাকা যাবে। আমি, তুমি, কণা চুটিয়ে আড্ডা দেব।’
‘কয়েকদিন কেন? পারমানেন্ট হলে আপত্তি আছে?’
‘দ্যাখো স্মৃতি, তুমি সবকিছু অত সিরিয়াসলি নিয়ো না তো! দেখবে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। অমর কখন আসবে?’
‘অমর আসবে না। আমি তাকে এ-বাড়িতে পা রাখতে বারণ করে দিয়েছি।’
‘না না এটা তুমি ঠিক করোনি। তা ছাড়া আজকের দিনটা— আজ তো ওরও নেমন্তন্ন। তোমার দাদা শুনলে খুব রাগ করবে। না না, তুমি বরং ওকে একটা টেলিফোন করে দাও। আচ্ছা আমিই না হয় করে দিচ্ছি। তোমাদের পাশের বাড়ির নম্বরটা কত যেন?’
‘থাক বউদি। যা হবার তাই হয়েছে। অমরের সঙ্গে বিয়ের সময়ই তোমাদের আটকানো উচিত ছিল। ছিল না? তোমরা আটকাওনি।’
পরিবেশ গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। অজন্তা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ভালবাসার বিয়ে আমরা আটকানোর কে? তাও তো মা’র আপত্তি ছিল। তুমি শোনোনি। আর আমরা তো তোমার শ্বশুরবাড়ির খোঁজ নিইনি। নেওয়ার কোনও প্রশ্নও ছিল না।’
‘বাদ দাও ওসব। বুলু কোথায়? এখনও ওর সঙ্গেই দেখা করতে পারলাম না। ওর জিনিসটা—।’
‘নোটন-ঝোটনের সঙ্গে খেলছে। ঝোটনের শুনলাম জ্বর এসেছিল? এখন অবশ্য ঠিক আছে। খুব লাফালাফি করছে।’
‘বউদি, ভীমকে একটু বলবে এক বালতি জল একটু কুসুমকুসুম গরম করে দিতে? ছেলেদুটোকে স্নান করিয়ে দিই। টনসিল-জ্বরে অল্প স্নান করালে তো ক্ষতি নেই, কী বলো?’
অজন্তা উঠতে উঠতে বলল, ‘না, তা নেই। তবে জল তুমি পাবে না। পাম্পে জল তোলা যায়নি, আজ সকালে জলই আসেনি। মা তো সকাল থেকে রেগে আগুন। মনে হচ্ছে প্রেশার বেড়েছে। মুখে টুথব্রাশ নিয়ে ঘুরছেন।’
স্মৃতি খুবই ভেঙে পড়ল। ইস, স্নানটানগুলো একেবারে সেরে আসলে তো হত। কত বেলায় জল আসবে তার ঠিক কী।
সত্যিই তার কোনও ঠিক নেই।
দীপঙ্কর কলের মিস্ত্রি নিয়ে ফিরেছে। সেই মিস্ত্রি ‘ব্যাপারটা কিছুই নয়’ এরকম একটা মুখ করে কাজ শুরু করেও দিয়েছে। আলো, কল এবং কাঠের মিস্ত্রিরা যে-কোনও বাড়িতেই সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোতে জানে। একটা ভাঙা প্লাস্টিকের কল বদলাতে এসে তারা বাথরুমে দামি টেলিফোন শাওয়ার লাগিয়ে দিয়ে যায়। ফিউজ সারাতে ডাকলে তারা বসার ঘরে ডবল শেডের টিউবলাইট, শোওয়ার ঘরে বেড-ল্যাম্পের নতুন শেড এবং রান্নাঘরে এক্সস্ট ফ্যানের ব্যবস্থা করে। দুটো পেরেক লাগানোর জন্য যে-কাঠের মিস্ত্রি একবার বাড়িতে ঢোকে সে বিদেশি বই দেখিয়ে হোয়াটনট না বানিয়ে বেরোবেই না। একশো টাকার জন্য ডাকা মিস্ত্রি শেষপর্যন্ত এক হাজার, পাঁচ হাজার এমনকী দশহাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে যায়। আর এই কারণে, মূল যে-কাজে তাদের ডাকা হয় সেই কাজটা খুবই তুচ্ছ ভঙ্গিতে তারা করে ফ্যালে।
দীপঙ্করের আনা মিস্ত্রিও সেরকম একটা ভঙ্গি করেছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত পারল না। ঘরে বাইরে ঘণ্টাখানেক দৌড়ঝাঁপ করার পর যথেষ্ট ভেঙে পড়ল এবং ঘোষণা করল, গোলমাল বাড়ির বাইরে। কর্পোরেশনের মেন পাইপ বাড়ির লাইনে জল ঢোকানোর আগে কোথাও গোলযোগ পাকিয়েছে। এ-জিনিস সারাই করা তার কর্ম নয়। যেতে হবে কর্পোরেশনের বরো অফিসে। সেখানকার লোক এসে বাড়ির সামনে মাটি খুঁড়ে যদি করতে পারে।
মিস্ত্রি খুব নিরাসক্তভাবে বলল, ‘কাজে কিন্তু হ্যাপা আছে মেসোমশাই। এসব আমাদের মতো প্রাইভেট ব্যাপার তো নয়। বরো অফিসে যাও রে, ট্যাক্সের রসিদ জমা দাও রে, প্লাম্বার ডাকো রে, মাটি কোপানোর মজুর খোঁজো রে, গোডাউন থেকে জয়েন্ট আনাও রে— সেসব মিলিয়ে দিন তিনেকের ধাক্কা তো মিনিমাম। হপ্তাখানেক হলেও হতে পারে।’
সূর্যকান্তবাবু ব্যবসায়ী মানুষ, সহজে বিচলিত হওয়া তাঁর স্বভাব নয়। এখন হলেন। এ-সমস্যা সহজে সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। দশটার কাছাকাছি সময়। এই সময়ে বাড়ি থাকবে জলের দখলে। অথচ এখনও রান্নাটুক পর্যন্ত চাপানো যায়নি। সঞ্চিত খাবার জল দিয়ে কোনওরকমে সিস্টেম চালু রাখা গেছে। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেটাও ভেঙে পড়বে। তার ওপর স্মৃতিরা এসে মেম্বার বাড়িয়ে দিয়েছে।
কাদম্বরীদেবী উত্তেজনায় বারবার ওপর-নীচ ওঠানামা করছেন। পায়েসের কোনও স্তরেই এখনও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। যাকে দেখছেন, যা কথা শুনছেন তাতেই মাথায় একেবারে রাগের আলপিন ফুটছে। অজন্তা বলল, ‘মা, আপনি এতবার ওঠানামা করবেন না। শান্ত হয়ে একটা কোথাও বসুন। এতবার ওপর-নীচ করলে হার্টে লেগে যেতে পারে।’
‘লেগে গেলে তুমি খুব দুঃখ পাবে কি? মনে হয় না। সকালবেলা পাম্প চালানোর ব্যাপারটায় একটু নজর দিলেই আর শাশুড়ির শরীর নিয়ে এত বিচলিত হতে হত না। তোমাকে তো আর পাম্প চালাতে বলছি না। কাজের লোক আছেই, একটু শুধু দেখবে।’
অজন্তা নিজেকে সামলাতে পারল না। বলল, ‘পাম্প চালানো সূক্ষ্ম কোনও কাজ নয় যে নজরদারি রাখতে হবে মা। আর পাম্প চালালেও কোনও কাজ হত না। আপনি তো চালিয়েছেন। শুনলেই তো বাড়িতে জলই ঢুকছে না।’
স্মৃতির আর গোছগাছ করতে ভাল লাগছে না। তার সঙ্গে এ-বাড়ির লোকেরা কেমন যেন একটা ব্যবহার করছে। ঠিক অন্যদিনের মতো নয়। সবাই যেন জোর করে স্বাভাবিক হতে চাইছে। ভাবটা এমন করছে যেন কিছুই হয়নি, সে একবেলার জন্য ছেলেদের নিয়ে বেড়াতে এসেছে। তার ওপর আবার যত্নও খুব বেড়ে গেছে। বউদি জলহীন অবস্থাতেই ইতিমধ্যে ভীমকে দিয়ে দু’কাপ চা পাঠিয়ে দিয়েছে। নোটন ঝোটন কেক এবং সন্দেশ খেয়েছে। তেষ্টা মেটাতে অলটারনেটিভ হিসেবে বাবা ছোটদের বড় এক বোতল কোকাকোলা এনে দিয়েছে। টনসিলে বিষ হওয়া সত্বেও ঝোটন সেই ঠান্ডা জিনিস এক গেলাস খেয়ে নিয়েছে। দাদা একটু আগে এসে একটা টেবল ফ্যান ঘরে রেখে বলে গেল, ‘পাখাটা রাতে চালিয়ে নিস। একটা পাখায় গরম লাগতে পারে।’ এত আদর কীভাবে নেওয়া উচিত স্মৃতি বুঝতে পারছে না। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে সে এখন শুয়ে শুয়ে এফ-এমে পুরনো দিনের গান শুনছে। এরা আজকাল সন্ধ্যার গান বেশি দেয় না।
কাদম্বরীদেবী ঘরে ঢুকলেন।
‘শুয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ?’
‘না।’
‘তা হলে মন খারাপ? ওরকম একটা ছোটলোকের বাড়ি থেকে চলে এসে মন খারাপের কী হল?’
‘বাজে কথা বোলো না তো মা। চুপ করো, গান শুনতে দাও!ֺ’
‘আমার তো সবই বাজে কথা। তখনও তুই একই কথা বলেছিলি। বলিসনি? যাক ভাল হয়েছে। এবার থেকে তুই এই সংসারের কয়েকটা ভার নিয়ে নে। কণাটা এখনও ছেলেমানুষ, বউমারও এদিকটায় একেবারে মতি নেই।’
‘আবার বাজে কথা শুরু করলে?’
‘কী বাজে কথা বললাম? কাজ তো কিছু করতে বলছি না। রান্নার লোক, ঘর মোছার লোক সবই তো আছে। তুই শুধু একটু নজর রাখবি। কড়া নজর। সংসারে কড়া নজরটাই আসল।’
স্মৃতি এখন তার মা’র কোনও কথাই শুনছে না। সে মন দিয়ে গান শুনছে। এলোমেলো ধরনের অচেনা-অজানা একটা গান। কথাগুলো বোকাবোকা, সুরটাও কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে। তবে গানটার একটা আশ্চর্যরকমের বদগুণ আছে। একটু শোনার পরই খুব কান্না পাচ্ছে। মা’র সামনে কাদাটা কি ঠিক হবে? মা আবার অন্যরকম কিছু ভেবে বসবে না তো? আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়? মাকে যদি বলে নেওয়া যায়, ‘মা, আমি কিন্তু অন্য কোনও কারণে কাঁদছি না। গান শুনেই কাঁদছি। এমনি শুধু শুধু।’
কান্না খুবই স্বার্থপর ধরনের জিনিস, এত ভাবনাচিন্তার সময় দেয় না। কাদম্বরীদেবী খুব অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর মেয়ে কাঁদছে।
৩
গোয়েন্দা-গল্প সকালে পড়তে নেই। রাতে পড়লে গোয়েন্দা-গল্পের স্বাদ বেশি পাওয়া যায়। অঙ্কও হল সেরকম। যত রাত বাড়ে রহস্য তত বাড়তে থাকে। এর ওপরে আছে রহস্য সমাধানের মজা। তখন তো নিজেকেই গোয়েন্দার মতো মনে হয়। কণা তাই পড়াশুনো করে রাতেই। স্বভাবতই ঘুম থেকে উঠতে তার যথেষ্ট বেলা হয়ে যায়। তখন থাকে কলেজে যাওয়ার তাড়া।
আজ দিনটা অন্যরকম। পিসির ঘুম ভাঙিয়েছে আজ বুলু।
‘পিসি ওঠো ওঠো, আজ দারুণ মজার দিন।’
কণা চোখ না খুলেই বলল, ‘আমি জানি আজ মজার দিন।’
‘কাঁচকলা জানো৷ তুমি কি জানো আজ আমাদের বাড়িতে জল আসবে না? যেটুকু ছিল তাও নোটন আর ঝোটন মিলে ফুরিয়ে ফেলেছে।’
কণা পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ‘ওরা এসে গেছে?’
‘শুধু এসে গেছে না, বড়পিসি বলল ওরা আর কোনওদিনও যাবে না। এখানেই সবসময় থাকবে।’
‘ভালই হল, বাড়িটা কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগত। তোরা তিনজন মিলে এতক্ষণে নিশ্চয় কিছু ভাঙতে পেরেছিস’
‘হ্যাঁ, পেরেছি।’
‘কী ভেঙেছিস?’
‘মা’র ড্রেসিং-টেবিলের কাচ। ঝোটন ফুটবল মেরে ভেঙে দিয়েছে।’
‘ভেরি গুড। ঝোটন খুবই ভাল কাজ করেছে। বাড়িতে মাঝে মাঝে কিছু না ভাঙলে নতুন জিনিস আসে না। এই ভাল কাজটার জন্য ঝোটনের কী ধরনের শাস্তি হয়েছে?ֹ’
‘এমা, ঝোটনের শাস্তি হবে কেন? ঝোটন নামে তো আজ কেউ নেই। জ্বর বলে আজ সে তো তার দাদার নাম ধার করেছে। তুমি দেখছি কিছুই জানো না।আমাদের বাড়িতে এখন দু’জন নোটন। ঝোটনাকে তুমি ঝোটন বলে ডাকলে সে সাড়াই দেবে না।’
‘আজ বাড়িটা দেখছি সত্যি সত্যি খুব মজার হয়ে উঠেছে রে বুলু। যাকে বলে ফুল অফ ফান।’
বুলু ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, ‘তুমি উঠলে আরও মজা পাবে। মুখও ধুতে পারবে না, খেতে পারবে না, স্নানও করতে পারবে না। হি হি।’
বুলু বেরিয়ে যাওয়ার পরই ফোন এল। রাতবিরেতে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে হয় বলে তার ঘরে একটা লাইনের এক্সটেনশন নেওয়া আছে। ধরেই মনে হল, ইস না ধরলেই হত। ফোন করেছে ইন্দ্র। ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী, শিবপুর কলেজ থেকে পাশ করা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। এখন বার্ড অ্যান্ড ফ্লাই কোম্পানিতে চাকুরিরত। প্রোবেশনে থাকলে কী হবে, ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। যে-কোনও ধরনের কাজ নিয়ে আমেরিকা চলে যেতে বদ্ধপরিকর। খুব চেষ্টা চালাচ্ছে। ছোটখাটো শহর হলেও আপত্তি নেই, আমেরিকা হলেই চলবে।
ইন্দ্র সপ্তাহে চারদিন কণাকে ফোন করে। কণা দু‘দিন ধরে না। তবু সে ফোনের সংখ্যা কমায়নি। প্রায় প্রত্যেকদিনই চা-কফির নেমন্তন্ন করে। কণা খুব বেশি হলে একদিন যায়। নেমন্তন্ন চা-কফির হলেও সে তা খায় না। খায় আইসক্রিম। ইন্দ্র কণার মুখের সামনে গদগদ বসে থাকে এবং একটানা বলে যেতে থাকে আমেরিকা যাওয়ার জন্য সে কীভাবে নিজেকে তৈরি করছে। মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে কতরকমের কাগজপত্র নিয়ে এসেছে, ইতিমধ্যে কয়েকটা ঠিকানায় ই-মেল পর্যন্ত পাঠিয়ে ফেলেছে। কণা অন্য দিকে তাকিয়ে সম্পূর্ণ অন্য কথা ভাবে। ইন্দ্র তা বুঝতে পেরে দুঃখিত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কণা, কোনও সমস্যা হয়েছে? এনি ট্রাবল? তোমাকে অন্যমনস্ক লাগছে।’
‘হ্যাঁ সমস্যা হয়েছে। তবে কী জানেন, সমস্যাটা কী ঠিক ধরতে পারছি না। প্রবলেমটা না বুঝলে অঙ্ক সলভ্ করা যায় না।’
ইন্দ্র বোকার মতো হাসে। বলে, ‘তুমি বুঝি সব অঙ্ক দিয়ে সলভ্ করো?’
‘করা উচিত কিন্তু করি না। করতে পারি না। তার ফলে সব গোলমাল পাকিয়ে যায়। ব্যাপারটা কি বুঝতে পারলেন ইন্দ্রজিৎবাবু?’
‘না পারলাম না। তোমার অনেক কিছুই এখনও ধোঁয়াধোঁয়া। যেমন তোমার আমাকে এই আপনি সম্বোধনটা। তোমার-আমার সম্পর্ক প্রায় সকলেই জানে। দু’জনের বাড়িতেও মোটামুটি জেনে গেছে। এই সম্পর্কের পরিণতি কী তাও সকলের জানা। তবু তুমি যে কেন আমাকে…’
কণা উঠতে উঠতে বলল, ‘সম্বোধনটা কোনও সিরিয়াস বিষয় নয়। এই যে আপনি আমেরিকায় যাচ্ছেন সেখানে আপনাকেও সবাই ইউ বলবে আবার একজন পকেটমারকেও ইউ বলবে। বলবে না? তাতে কী হল? আপনারা কি এক হয়ে যাবেন? হবে না। বাংলাতেও এরকম অনেক উদাহরণ দিতে পারি। আমরা এমন অনেককে সামনে তুমি বলি যাদের আমরা মনে মনে খুবই ঘৃণা করি। করি কিনা?’
ইন্দ্র ছাত্র ভাল হলে কী হবে, গোটা ব্যাপারটা তার কাছে আরও জটিল হয়ে গেল। সে মুখ কাঁচুমাচু করে উঠে পড়ে।
আজ কণা ফোন ধরেই বলল, ‘ও ইন্দ্রজিৎবাবু, ফোন করে খুব ভাল করেছেন। আপনার কথাই ভাবছিলাম।’
ওপাশে ইন্দ্র কণার কথায় খুবই উৎসাহ বোধ করে। কাব্য করে বলে, ‘কী ভাগ্য আমার।’
‘আপনার কাছে ন্যাচারাল ডিস্যাসটারের ওপর কোনও বই আছে?’
‘কী বললে?’
‘ন্যাচারাল ডিস্যাসটার। বুঝতে পারছেন না? প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বই না হলেও চলবে। কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তালিকা লাগবে আমার। আমাদের বাড়িতে মনে হচ্ছে একটা বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে। আধঘণ্টা সময় দিলাম।’
‘সেকী! আমি তোমাদের বাড়ি চলে যাব?’
‘না না। আপনি এসে কী করবেন? প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষের তো করার কিছু থাকে না। আপনি তো মানুষ না কী? সময় নষ্ট না করে লিস্টটা জোগাড় করে ফোনেই জানিয়ে দিন, তা হলেই হবে।’
কথা না বাড়িয়ে কণা ফোন নামিয়ে রাখল। উফ খুব বাঁচান বাঁচা গেছে। ঠিক সময়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথাটা মনে এল। নইলে কতক্ষণ যে বোর হতে হত কে জানে।
আজ আর মুখটুখ ধোওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। বাসি মুখে থাকতে অবশ্য খুব একটা খারাপ লাগছে না। চা কি পাওয়া যাবে? পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। বউদি কখনওই তার কথা ভোলে না। নিশ্চয় ফ্লাস্কে তার জন্য আলাদা করে সরানো আছে।
বউদি নয়, দিদি চা নিয়ে ঘরে ঢুকল।
‘নে ধর। বউদি পাঠিয়ে দিল। বাড়ির নয় কিন্তু। দোকান থেকে ভীমকে দিয়ে আনিয়েছে। খেতে পারবি কিনা দ্যাখ। হ্যাঁরে, কণা, কে ফোন করেছিল রে? ইন্দ্র, না?’
‘জানিসই যখন তখন আর জিজ্ঞেস করছিস কেন?’
‘কতগুলো জিনিস আছে জানলেও বারবার জিজ্ঞেস করতে ভাল লাগে। তোর লাগে না?’
‘না, লাগে না। এই যে ধর আমি জানি যে তুই আজ রাগ করে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছিস, আমি কি তোকে জিজ্ঞেস করছি? করছি না।’
‘কেন করছিস না? জিজ্ঞেস করা উচিত। তোরা যদি প্রথম থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করতিস তা হলে আজ আমার এই অবস্থা হত না?’ স্মৃতির গলা ধরাধরা।
‘সেইজন্যে আমাকে জিজ্ঞেস করছিস?’
‘যদি বলি, হ্যাঁ?’
‘তা হলে বলব তুই বরং বাসি মুখে দোকানের এক কাপ চা খা, দেখবি কেমন একটা ট্রেন-ট্রেন এফেক্ট পাবি। মনে হবে অচেনা কোনও স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছিস।’
‘ইন্দ্রকে বিয়ে করার আগে সবদিক দেখেশুনে নিস কণা। আমার মতো অবস্থা যেন না হয়। ভালবাসার বিয়ে খুব ভয়ংকর।’
কণা দিদির কথা যেন শুনতেই পেল না। বলল, ‘জলের কোনও ব্যবস্থা হয়েছে? চ গিয়ে দেখি। একা বউদি নিশ্চয় খুব নাজেহাল হয়ে পড়েছে।’
জলের একটা ব্যবস্থা হয়েছে। তবে সেটা পুরো ব্যবস্থা নয়, হাফ ব্যবস্থা। ভীম খোঁজ নিয়ে এসে জানিয়েছে, পাশের বাড়ির বাগানে ঝোপঝাড়ের আড়ালে একটা টিউবওয়েল পাওয়া গেছে। শুধু পাওয়া গেছে নয়, সেটি সচল। প্রতি দু’বার টেপায় সেখান থেকে একবার করে জল পড়ছে। সেটা সমস্যা নয়, সমস্যা হল, ওই বাড়িতে কেউ নেই। বোধহয় কোথাও বেড়াতে টেড়াতে গেছে। লোহার গেটে তালা দেওয়া। পাঁচিল টপকে টিউবওয়েলের কাছে পৌঁছোতে হবে। এখন এ-বাড়িতে পাঁচিল টপকানোর মতো কেউ নেই। সূর্যকান্তবাবুকে জরুরি কাজে ঘণ্টাখানেকের জন্য অফিসে বেরোতে হয়েছে। তিনি স্নান-খাওয়া না করেই বেরিয়েছেন। দীপঙ্কর গেছে কর্পোরেশনের বরো অফিসে।
কণা বলল, ‘দাদারা থাকলে কী লাভ হত? পাঁচিল টপকে জল আনত? ও আমরাও পারব। আমি আছি, ভীম আছে। আজ আবার নোটন-ঝোটন দুই বীর আছে। ওদের এক এক শটে আয়না ভাঙে।’
ঝোটন গম্ভীরভাবে বলল, ‘সরি মাসি, এখানে ঝোটন নামে কেউ নেই।’
কণা জিভ কেটে বলল, ‘ঠিক কথা। আমি একবারে ভুলে গেছি।’ এরপর সে হাত নেড়ে সকলকে গোটা ছকটা বোঝাতে লাগল। জল তোলা নয়, তারা যেন কোনও অভিযানে বেরোচ্ছে। যেখানে পাহাড় এবং জঙ্গল দুইই আছে।
কণা বলতে লাগল, ‘আমাদের সঙ্গে দিদি-বউদি থাকবে। ওরা পাঁচিলের এ-পাশে দাঁড়াবে। আমরা ক’জন পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকব। নোটনরা থাকবে ওদিকে। আমি টিউবওয়েল টিপব। ভীম ঝোপ পার করে সেই বালতি তুলে দেবে নোটন এক নম্বর আর নোটন দু’নম্বরকে। সেখান থেকে বউদিদের হাতে। কী মা, তুমি থাকবে নাকি?’
কাদম্বরীদেবীর কাছে ব্যাপারটা অতি অসভ্য একটা জিনিস বলে মনে হচ্ছে। বাড়ির মেয়েরা এরকম ধরনের একটা কাজে নামবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারছেন না। নিজে নামা তো দুরের কথা।
কণা কিন্তু মাকে কোনও কথা বলার সুযোগ দিল না। বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার যখন আমাদের জল-ভেঞ্চারে থাকার এত ইচ্ছে তুমিও থাকো। তুমি দাঁড়াবে ঘরের ভেতর, একতলার বাথরুমের সামনে। আমরা তো আর বেশি জল তুলব না, মোটামুটি স্নানটানের মতো হলেই ব্যস। এমারজেন্সি যাকে বলে।’
বুলু কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘পিসি, তুমি সবাইকে নিলে, আমায় কেন নিলে না? আমি কিন্তু এক্ষুনি কাঁদতে শুরু করব।’
কণা আঁতকে উঠে বলল, ‘ওরে বাবা, তুই কাঁদতে শুরু করলে বিপদ হবে। তুই বরং সুপারভাইজার হ। ঘুরে ঘুরে দেখবি আমরা সবাই ঠিকঠাক কাজ করছি কিনা। সবসময় আমরা তোর কাজ দেখি, আজ তুই আমাদের ওপর খবরদারি করবি। ঠিক আছে? খুশি তো?’
শুধু বুলু খুশি নয়, কণার জল-ভেঞ্চার শুরু হওয়ার পর দেখা গেল সকলেই দারুণ উৎসাহ পেয়ে গেছে। যেহেতু ছোটরা আছে সেহেতু ছোট ছোট দুটো বালতি নেওয়া হয়েছে। বড়গুলো জড়ো করা হয়েছে একতলার বাথরুমে। কণা ম্যাক্সি ছেড়ে প্যান্ট এবং শার্ট পরে নিয়েছে। তাকে পাঁচিল টপকাতে হবে। সে অজন্তাকে বলল, ‘তুমিও আমার মতো চেঞ্জ করে এসো বউদি। নইলে শাড়িটাড়ি জড়িয়ে একাকার কাণ্ড হবে।’
অজন্তারও প্যান্ট-শার্ট আছে। শ্বশুরবাড়িতে প্যান্ট-শার্ট পরা যায় না। গোয়া বা সিমলা গিয়ে পরতে হয়। এটাই প্যান্ট-শার্টের নিয়ম। অজন্তা বড় নিয়ম না ভেঙে একটা ছোট নিয়ম ভাঙল। সে সালোয়ার-কামিজ পরে নিল। এই পোশাকে তাকে অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। এতদিনের চেনা মানুষটাকে এইভাবে দেখে স্মৃতিও অবাক হয়ে দেখছে। সত্যিকারের রূপ বোধহয় একেই বলে। কখন কোথায় যে সে ঝলসে উঠবে আগে থেকে বলা যায় না। তবে মুখে কিছু বলল না। বোন এবং বউদির কাণ্ডকারখানা দেখে হাসতে লাগল। বলল, ‘তোরা পারিসও বটে বাবা। আমার কিছু লাগবে না। তোমরা ভুলে যেয়ো না, স্কুলে আমি স্পোর্টসে প্রাইজ পেতাম।’ সে শুধু শাড়ির আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নিয়েছে। ছোটদের লাফালাফি চরম জায়গায় পৌঁছেছে। নোটন এবং ঝোটন কিটব্যাগ থেকে বের করে কেডস পায়ে দিয়ে নিয়েছে। স্কুলের জন্য তাদের মা সাদা রং মাখিয়ে কষ্ট করে এগুলো বয়ে এনেছিল। ছোটাছুটি করে ইতিমধ্যেই সেই সাদার ওপর কয়েকটা কালো ছোপ পড়ে গেছে। বুলুর কেডস নেই। সে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘পিসি, আমার কেডস নেই। আমি কী পরব? এক্ষুনি কিন্তু আমি কঁদতে শুরু করব।’
কণা বলল, ‘ওরে বাবা, কান্নাকাটির মধ্যে যাস না। কেডস নেই তো কী হয়েছে, তোর একটা লাল রঙের জিপসি টুপি আছে না? তুই সেটা পরে আয়। সুপারভাইজাররা সবসময় টুপি পরে।’
বুলুর টুপিটা চমৎকার। একটু বড়। ফলে বারবার চোখ ঢেকে যায়। নোটন বলল, ‘চোখ ঢেকে গেলে কোনও ক্ষতি নেই।’ বুলু বলল, ‘এমা! তা হলে তোমরা আমাকে চিনবে কী করে?’
‘এক কাজ কর, তুই বরং মুখটাকে হাসিহাসি করে রাখ। হাসি তো আর ঢাকা পড়বে না। আমরা তোর হাসি দেখে ঠিক চিনতে পারব।’
ভীম হাসিঠাট্টার মধ্যে নেই। সে পাঁচিলের ওপর অনেক আগে থেকেই উঠে বসে আছে এবং ভুল সুরে গুনগুন করছে— তুমি খুশি থাকো, আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো। খুশির গান হলেও ভীম গানটা গম্ভীরভাবে গাইছে। এটা হল দাদরা, ছয় মাত্রার গান। বুলু যখন শেখে তখন সে এরকমই শুনেছে। অবশ্য দাদরা বা ছয় মাত্রা ব্যাপারটা কী তা সে জানে না। তবু পাঁচিলে টোকা মেরে তাল ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই গানের সঙ্গে সে-টোকা মিলছে না।
খুবই মজার সঙ্গে জল-ভেঞ্চার শুরু হল। অনেকটা পথ যাবার ফলে জল কিছুটা নষ্ট হচ্ছে। তবে তাতে কেউ দুঃখিত হচ্ছে বলে মনে হয় না। নইলে কষ্ট করে তোলা জল পড়ে গেলে সবাই এত হাসাহাসি করবে কেন?
৪
বাড়ির সামনে একটা রিকশা এসে দাঁড়াল।
রিকশা থেকে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এক সুদর্শন যুবক নামল। কিছু সুদর্শন মানুষ আছে যাদের দেখলে মনে হয় এই হতভাগা দেশ তাদের জন্য নয়। ভাগ্যের গ্রহে তারা এখানে আছে বটে, কিন্তু বেশিদিন থাকবে না। সুটকেস গুছিয়ে রেখেছে। পোড়ার ছাই দেশকে দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়ে যে-কোনও সময় প্লেনে চড়ে বসবে।
একে দেখেও সেরকম মনে হবে। এর নাম ইন্দ্র। রিকশা থেকে নামলেও ইন্দ্র রিকশা করে আসতে চায়নি। এ-বাড়িতে রিকশা করে আসা তার পক্ষে খুবই বেমানান। সে চেয়েছিল ট্যাক্সি করে আসতে। কলকাতায় অফিস-টাইমে ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। অফিস যাচ্ছে এমন একটা মিথ্যে ভান করেই ট্যাক্সি খুঁজছিল, তবু পায়নি৷ ওয়াশিংটন বা লস এঞ্জেলসে এরকম কোনও সমস্যা নেই।
গ্রিলের গেট খুলে বাড়িতে ঢুকতেই ইন্দ্র প্রথম শকটা পেল। দু’জন সুন্দরী মহিলা জলের বালতি হাতে নিয়ে প্রায় ছোটাছুটি করছে। একবার তারা পাশের পাঁচিলের আড়ালে চলে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ বাদে আবার এসে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ছে। যাওয়া-আসা প্রতি খেপেই তারা ভয়ানক হাসাহাসি করছে। এদের পেছন পেছন মাঝে মাঝে ছুটে আসছে একটা ছোট মেয়ে। লাল টুপিতে তার মুখ ঢাকা। তবে তার গলা শোনা যাচ্ছে— ‘এই বড়পিসি তুম ঠিকসে কাম কর্। মা, তুমহারা ইতনা পানি কিঁউ গির যাতা হ্যায়?’
এ-বাড়িতে ইন্দ্র এর আগেও দু’বার এসেছে। সে সকলকেই কমবেশি চেনে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কাউকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। তার ওপর কণা ফোনে বলছিল কী একটা বিপর্যয় ঘটেছে। হাসাহাসি দেখে সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না তো?
কৃতী, সফল এবং বিদেশমুখী ছেলেটি দ্বিতীয়বার শক পেল পাঁচিলের ওপর থেকে উঁকি দিয়ে কণাকে দেখার পর। ভাবী স্ত্রীকে লাফিয়ে লাফিয়ে টিউবওয়েল টিপতে দেখে শক পাওয়ারই কথা। বিশেষ করে যে মেয়ে আগামী বছর নিশ্চিত অঙ্ক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হবে।
কণা জল ভরতে ভরতেই চিৎকার করে বলল, ‘এই যে ইন্দ্রবাবু, আপনি শেষপর্যন্ত না এসে পারলেন না তো?’
ইন্দ্র নার্ভাস হয়ে আমতা আমতা করে কী একটা বলতে গেল। জোরে না বলার জন্য সে-কথা শোনা গেল না।
কণা আবার বলল, ‘পাঁচিল টপকাতে পারবেন? পারবেন না। পারলে ভাল হত। দু’বালতি জল তুলে দিতেন।’
অজন্তা ফিসফিস করে বলল, ‘ছিঃ কণা, এসব কী বলছ?’
স্মৃতি বলল, ‘আসুন, আপনি ভেতরে এসে বসুন।’
ইন্দ্রর চোখ মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
‘ঠিক আছে ভেতরে গিয়ে বসুন। আমার লিস্টটা এনেছেন তো? গিয়ে দেখছি।’
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তালিকা যে সত্যি সত্যি করা হবে কণা তা ভাবতে পারেনি। ইন্দ্রও ভাবেনি এত তাড়াতাড়ি কাজটা হয়ে যাবে। মাত্র তিনটে ফোন করে মোটামুটি সে একটা খাড়া করে ফেলেছে।
গর্বিত ভঙ্গিতে কাগজটা সে কণার হাতে তুলে দিল।
হাতের লেখা বড় সুন্দর। যত্ন করে লেখার ফলে এই লেখা আরও সুন্দর হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, ছেলেদের সুন্দর হাতের লেখা দেখলে কণার কেমন গা ঘিনঘিন করে। তালিকাটা ছেলেমানুষি গোছের, সামান্য সাহিত্যের চেষ্টাও হয়েছে। কণা মুখে কিছু না বলে চোখ বোলাতে লাগল।
তালিকা এরকম:
১. ভয়াবহ ভূমিকম্প: আফ্রিকা (২১৭ খ্রি.পূ.), ১০০ শহর ধূলিসাৎ, মৃত প্রায় ৭৫ হাজার মানুষ; আলজিরিয়ার আসনাম শহর (১০ অক্টোবর, ১৯৮০), ৬ হাজার মানুষের মৃত্যু, চিলি (২৪ জানুয়ারি, ১৯৩৯),.৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু।
২. বিপর্যয়কারী বন্যা: চিন (১৮৮৭), আশঙ্কা মৃত্যু হয়েছিল ৭০ লক্ষ মানুষের; ব্রাজিলের তুবারাও (২৪ মার্চ, ১৯৭৪); ইংল্যান্ডের লিনমাউথ শহর (১৫ অগাস্ট, ১৯৫২)।
৩. হঠকারী হ্যারিকেন বারবাদোস (১৬৯৪), টেক্সাস (১৯০০), (১৯৬৪)।
৪. টানটান টর্নেডো: জর্জিয়া (১ জুন, ১৯০৩)।
৫. টলমল টাইফুন: কোরিয়া (১৯৩৬); জাপানের কিয়োসু (১৯২৭); হোনসু প্রদেশ (২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯), মৃত্যু কম করে ৫ হাজার মানুষের।
আরও আছে, তবে আর পড়তে কণার ভাল লাগছে না। এত মৃত্যুর কথায় তার মন খারাপ লাগছে। এরকম জানলে সে ইন্দ্রকে কিছুই বলত না। আসলে সে খুব ভেবেচিন্তে যে বলেছিল তা নয়। মজা করতে চেয়েছিল। মজা জিনিসটার এই এক মুশকিল, কখন যে মন ভারী করে দেবে বোঝা যায় না। আর এই লোকটাই বা কেমন? এতগুলো মরার খবর এনে এমন একটা ভান করছে যেন বিরাট কাজ করেছে। সত্যিকারের মড়া আনতে পারলে বোধহয় আরও খুশি হত। অতি অসহ্য।
কণা কাগজ মুড়ে বলল, ‘থাক, বাকিটা পরে দেখব।’
ইন্দ্রর আরও খানিকটা বসার ইচ্ছে ছিল। কণা উঠে দাঁড়ানোয় তাকেও উঠতে হল।
‘কণা, তুমি আজ কলেজে যাবে না?’
‘না। দেখলেন না আজ আমাদের বাড়ি জলের সমস্যা হয়েছে? স্নান, খাওয়া কিছুই হয়নি। খুব ব্যস্ত।’
স্নান নেই, খাওয়া নেই, কলেজেও বেরোতে হবে না, তাও যে কণা কেন ব্যস্ত তা ইন্দ্র ঠিক বুঝতে পারল না। এই অবস্থায় নিজের ব্যস্ততা না থাকাটা খুবই লজ্জার হবে ভেবে সে বলল, ‘আমিও ব্যস্ত। এখান থেকে সোজা একবার ইউসিস যাব। আমেরিকান সেন্টার। বোস্টন থেকে কতগুলো ফর্ম আনাব ভাবছি।’
‘তা হলে আর দেরি করবেন না। ফর্মের ব্যাপার তো, ফুরিয়েটুরিয়ে গেলে খুব আপশোস লাগে।’
দরজার দিকে পা বাড়িয়ে ইন্দ্র আবার ফিরে এল। চারপাশটা একবার দেখে নিল, তারপর গলা নামিয়ে গাঢ় স্বরে বলল, ‘কণা, ওই কাগজের শেষে একটা জরুরি কথা লিখেছি। প্লিজ পড়ে আমাকে উত্তর দিয়ো। রাতে তোমাকে ফোন করব।’
ইন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে কণা মনে মনে হাসল। জলহাতে ধরায় কাগজটা কেমন ন্যাতান্যাতা হয়ে গেছে। শেষের দিকের লেখাগুলো তো একেবারে মুছেই গেছে। সেখানটা কি আর পড়া যাবে?
দীপঙ্কর যখন তিনজন মিস্ত্রি এবং দু’জন মাটি কাটার মজুর নিয়ে ফিরল তখন বাড়ির সকলেরই স্নান হয়ে গেছে। টিউবওয়েলের জলের মতো একটা নোংরা জিনিসে স্নান করার কোনও ইচ্ছে কাদম্বরীদেবীর ছিল না। একদিন স্নান না করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। বহুদিনই তিনি স্নান না করে কাটিয়েছেন। তবু আজ কেন জানি সকলের স্নান হয়ে যাওয়ার পর মনে হতে লাগল গায়ে দু’মগ জল না ঢাললে বেঁচে থাকারই কোনও মানে হয় না।
দীপঙ্করও তার ভাগের জল পেয়েছে। বাড়ি ফিরে স্নান করতে পারবে সে ভাবতেও পারেনি। সে বোধহয় সব থেকে বেশি অবাক হয়েছে।
জলের পাইপ সারানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। যারা কাজ করছে তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই কাজ শেষ হতে কত সময় লাগবে। অজন্তা একবার ভীমকে পাঠিয়েছিল এ-ব্যাপারে কোনও খবর যদি সে সংগ্রহ করে আনতে পারে। ভীম সে-খবর তো আনতে পারেইনি, উলটে বলল, ‘বউদি, ওরা চায়ের জন্য পয়সা চাইছে।’
পয়সার ব্যাপারটা অনেকক্ষণ থেকেই শুরু হয়ে গেছে। বরো অফিসের যে-ভদ্রলোক দীপঙ্করকে সব ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি সম্ভবত এলাকার জল-বিভাগের সেকেন্ড অফিসার। বেশি এবং স্পষ্ট কথার মানুষ। সব শুনে বললেন, ‘কথায় আছে জলের জন্য জলের মতো পয়সা খরচ করতে হয়। আপনি কি রাজি আছেন? রাজি থাকলে চটপট বলে ফেলুন। না থাকলেও কোনও ক্ষতি নেই। আপনি ভাববেন না যাদের পয়সা দেবার সামর্থ্য নেই তাদের কথা আমরা ভাবি না। তাদের কথাই আমরা বেশি ভাবি। তবে অনেক ভাবতে হয় বলে শুরু করতে একটু দেরি হয়ে যায়।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করল, ‘কীরকম দেরি?’
‘এই ধরুন, আপনারটা ভাবতে শুরু করব ধরুন, আজ শনিবার, তা হলে রবি, সোম, মঙ্গলের পরে হল গিয়ে বুধ। তাই তো?’ একটা গোটা পরিবারের জলের ভাগ্য যার হাতে তার নাকে একটা ঘুঁষি মারতে ইচ্ছে করলেও মারা যায় না। হাসিমুখে তার কথায় তাল দিতে হয়। তবে দীপঙ্কর হাসল না। গম্ভীর মুখে বলল, ‘হ্যাঁ তাই। মঙ্গলের পর বুধবার।’
লোকটা এবার চোখ বন্ধ করে কী একটা হিসেব করতে লাগল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, শুক্রবারই আপনার কথা ভাবব। তা হলে হিসেবমতো পরের মঙ্গল নাগাদ আপনি মিস্ত্রি-মজুর পেয়ে যাবেন।’
‘পরের মঙ্গলবার! বলেন কী? অতদিন চলবে কী করে? একদম জল ছাড়া—।’
লোকটা যেন মুখের কথা কেড়ে নিল, ‘এর জন্যই তো বলছিলাম। আপনি আমি তো আর উট নই যে জল ছাড়া দিনের পর দিন চালিয়ে যাব। কী, চালাতে পারব? পারব না। তাই একটা অলটারনেটিভ ব্যবস্থা বাধ্য হয়ে রাখতে হয়েছে।
‘সেই ব্যবস্থার খরচ কত?’
‘দেখুন জলের আর এক নাম হল জীবন। এই জীবনের মায়া কাটিয়ে লাস্ট টোয়েন্টি সিক্স ইয়ার কোথাও যেতে পারিনি। যতবার অন্য দপ্তরে বদলির অর্ডার হয়েছে ততবারই হাতে পায়ে ধরে আটকেছি। এই জীবনের খরচ আর কী বলব? তবে আমি অল্প কথার মানুষ। বেশি ভ্যানতারা পছন্দ করি না। আপনি আটশো দিন, গোটা কাজটাকে আট দিন এগিয়ে নিয়ে যান। আর যদি এক্ষুনি চান তার ব্যবস্থাও আমাদের আছে। এটা কিন্তু ড্রেন বা লাইটের কাজে এলে পাবেন না। ওরা নানারকম পাঁয়তাড়া কষবে। কিন্তু জল নিয়ে তো ছেলেখেলা করা যায় না। আপনি ডবল দিন। মানে আট আট যোলো। ষোলোই হল তো?’
দীপঙ্কর আরও গম্ভীর। রাগে মুখটা তার সত্যি সত্যি উটের মতো ঝুলে গেছে। সেই অবস্থাতেই সে বলল, ‘হ্যাঁ, ষোলো৷’
‘ঠিক আছে, আপনি পনেরোশো দিন। গ্যারান্টি, আজ সন্ধের মধ্যে আপনার বাড়িতে জল ঢুকে যাবে। ডিফেক্ট সে জি আই পাইপেই হোক, জয়েন্টেই হোক, ফেরুলেই হোক। আপনি একেবারে লোক সঙ্গে নিয়ে চলে যান।’
অতগুলো টাকা বেরিয়ে গেলেও দীপঙ্কর খুশি। আজকের মধ্যে জল পাওয়া যাবে। এটাই আসল কথা। মাটির ভেতরকার ঠান্ডা জল মাথায় দেবার পর সেই খুশি ভাবটা আরও বেড়ে গেল। অজন্তাকে বলল, ‘কী ব্যাপার, এ-বাড়ির মেয়েরা কি ম্যাজিক জানে?’
অজন্তা হাসতে হাসতে বলল, ‘সে এক কাণ্ড। তোমার ছোটবোনকে জিজ্ঞেস করো। তবে তোমার মা-ও কম যান না দেখছি। সকালবেলা একজগ সরিয়ে রেখেছিলেন। সেটা দিয়ে পায়েস বানিয়ে ফেলেছেন। আমরা কিছু জানতেও পারিনি। এইমাত্র নোটন এসে খবর দিল। সে গন্ধ পেয়ে রান্নাঘরে দেখতে গিয়েছিল।’
‘এটা নিশ্চয় তোমার বিরুদ্ধে কোনও চক্রান্ত।’
‘বাজে কথা বোলো না। অ্যাই, আজ না ওই ছেলেটা এসেছিল।’
‘কোন ছেলেটা?’
‘আরে তোমার ছোটবোনের ইয়ে। ইন্দ্র, এই যে বিলেত না আমেরিকায় চলে যাবে যে ছেলেটা। ভালই হবে বলো, কণা আমাদের বেশ বিদেশি লিপস্টিক টিপস্টিক পাঠাবে। তাই না?’
দীপঙ্কর কোনও কথা বলল না। কণার বিয়ের কথা ভাবতেই তার স্মৃতির মুখটা ভেসে এল। সেটাকে কাটানোর জন্য বলল, ‘আচ্ছা খাওয়াদাওয়ার কী হবে? রান্নাবান্না তো কিছুই হয়নি।’
অজন্তা আবার হাসল। বলল, ‘ওই ম্যাজিকটা তোমার বাবার জন্যে রেখে দিয়েছি। উনি একটু আগে ফোন করেছিলেন। বুলুর কাছে সব শুনে বলেছেন, ঠিক আছে, আমিও একটা ভেলকি দেখাব। আজ দুপুরে খাওয়ানোর দায়িত্ব আমার। শাশুড়ি অবশ্য শুনে বলেছেন, আজ তা হলে সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে। তোমার কী মনে হয়?’
‘কী জানি বাবা। বাবাও কি ঘাড়ে করে জল আনবে নাকি?’
সূর্যকান্তবাবু আনলেন ঠিকই তবে ঘাড়ে করে নয়। গাড়ির পেছনে চেপে খাবারের প্যাকেট এল। নোটন, ঝোটন এবং বুলু কণার ঘরে বসে হিন্দি গানের অন্তাক্ষরী খেলছিল। এ-বাড়িতে ছোটদের হিন্দি গান গাওয়া নিষিদ্ধ। সেই দেখে স্মৃতিও তার ছেলেদের ওপর হুইপ জারি করে দিয়েছে, ‘হিন্দি সিনেমার গান শুনলে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব।’ হিন্দি গান শোনার রেওয়াজও এ-বাড়িতে রাখা হয়নি। ‘বুলু রাতে ঘুমিয়ে পড়লে অজন্তা মাঝেমধ্যে লুকিয়ে টিভিতে হিন্দি সিনেমা দ্যাখে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বাজার চলতি সব হিন্দি গান এ-বাড়ির ছোটদের কণ্ঠস্থ। এমনকী তারা গানগুলোর সঙ্গে নাচতেও পারে। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তারা প্রকাশ্যেই এসব করে। এখনও করছিল। খাবারের খবর পেয়ে হইহই করে নেমে এল।
৫
আজ বুলুর জন্মদিন। চিলি চিকেনের পরে সকলকে পায়েস খেতে হল।
বুলু একটা নীল রঙের নতুন জামা পরেছে। কাঁধের কাছে সাদা ফ্রিলের কাজ করা। মনে হচ্ছে আকাশে কোনও পরি ডানা মেলে উড়ছে। এই পরি-জামা তার ঠাকুমা তাকে দিয়েছে। বাবা-মা তাকে দিয়েছে স্টিলের ব্যাডমিন্টন র্যাকেট। পিসি ভারী মজার একটা জিনিস দিয়েছে। এমন জিনিস কেউ আগে কখনও দ্যাখেনি। এটা একটা ম্যাজিক। পিসি বলছে, এটার নাম বুনো ঝোপে ফুল। একটা প্লাস্টিকের টব। টবের ওপরে সবুজ কাগজ কেটে বুনো ঝোপের মতো করা। ইংরি বিংরি তিংরি’ বলে সেই ঝোপ ধরে টান দিলেই সেটা একপাশে সরে যাচ্ছে আর সবাইকে চমকে দিয়ে বেরিয়ে আসছে একরাশ রংবেরঙের কাগজের ফুল। সবাই কিছু-না-কিছু দেওয়ায় ভীম বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। তার তো বুলুকে কিছু দেওয়া হল না? একটু পরে সে ঘরে এসে জানায় পরশু বুলুর যে দুলের একটা হারিয়ে গিয়েছিল আজ নাকি সেটা পাওয়া গেছে বারান্দার কোণে। এই যে সেই দুল।
আসল লজ্জায় পড়েছে স্মৃতি ও তার দুই ছেলে। তাড়াহুড়োতে বুলুর উপহার শ্বশুরবাড়ি থেকে আনতে ভুলে গেছে। হাতে টাকাপয়সাও তেমন নেই যে দোকান থেকে কিছু এনে দেবে। নোটল-ঝোটনও বারবার মা’র মুখের দিকে তাকাচ্ছে। এইরকম একটা পরিস্থিতি আসবে তারা ভাবতে পারেনি। লজ্জায় তারা ভাল করে খেতে পর্যন্ত পারছে না।
এরকম একটা সময় কণা সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, ‘বুলু, তোকে বুনো ঝোপে ফুল ম্যাজিকটা কে দিল?’
‘কেন তুমি, আমার ছোটপিসি।’
‘সকলে কী জানে?’
‘সকলে সেটাই জানে। কী মা, তাই না? দাদু, পিসি এটা দিল না?’
কণা বলল, ‘ঠিক আছে, এবার আর একটা ম্যাজিক দ্যাখ। ঝোপ সরিয়ে কী পেলি? ফুল। এবার ওই ফুল সরিয়ে দ্যাখ তো কিছু পাস কিনা?’
সত্যি পাওয়া গেল। একটা ছোট্ট চিরকুট। তাতে লেখা, ‘আমাদের আদরের বোনকে জন্মদিনে দিলাম— নোটন আর ঝোটন।’
সবাই টেবিল চাপড়ে উঠল। কণা পাকা ম্যাজিশিয়ানের মতো মাথা বো করে বলল, ‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।’ নোটনরা খুব অবাক হয়েছে, মাসি তাদের দু’জনের হাতের লেখা কীভাবে নকল করল?
চিলি চিকেনে এমন কিছু ঝাল থাকে না যে চোখে জল এসে যাবে। ছোটদের ক্ষেত্রে তাও একটা কথা ছিল, কিন্তু বড় অফিসারদের বেলায় এটা অসম্ভব। সেই অসম্ভবটাই হয়েছে। কণার দ্বিতীয় ম্যাজিক দেখার পর দীপঙ্করের চোখ ভিজে গেছে। সে রুমাল খুঁজছে। খাওয়া শেষ করে সূর্যকান্তবাবু বাইরে গিয়ে একবার খোঁজ নিয়ে এসেছেন। মাটি খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। জং-ধরা পুরনো পাইপের অনেকটা কেটে বাদ দিতে হবে। সেখানে বসবে গ্যালভানাইসড্ পাইপ। দু’পাশে লাগানো হবে দুটো সকেট। কাজ পুরোদমে এগোচ্ছে। আশা করা যেতে পারে বিকেলের দিকে অবস্থার উন্নতি হবে। সেই সময়ের জলটা ঢুকবে বলে মনে হয়। তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরলেন। সকলেই যে যার ঘরে। সম্ভবত বিশ্রাম নিচ্ছে। বাচ্চাগুলোরও সাড়াশব্দ নেই। সকাল থেকে কম ধকল যায়নি। সকালে অফিস ঘুরে এসেছেন, এখন একবার কারখানায় যেতে পারলে ভাল হত। চারটে অর্ডার আটকে আছে। ওয়ানফোর্থ মালও রেডি হয়নি। টেলিফোনে চ্যাঁচামেচি করেছেন, কিন্তু ওদেরও দোষ নেই। এত কাজ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। পার্টি বুঝতে চাইছে কই? ঠিক সময় জিনিস না পেলে বিরক্ত হচ্ছে। অথচ সরকারি কাজ ঠিক সময় না দিতে পারলে ব্ল্যাক লিস্টেড হতে হবে। একা এতদিক সামলানো যাচ্ছে না। দীপঙ্কর ব্যবসায় যেতে রাজি নয়। কিন্তু তা বললে হবে কেন? বাপ-ঠাকুরদার জিনিস কি তুলে দিতে হবে? তা ছাড়া ওসব ফুটো পরের গোলামিতে ক’টা পয়সা? মেয়ে বড় হচ্ছে, তার পড়াশুনো আছে, বিয়ে থা আছে। দীপঙ্করের সঙ্গে এ-প্রসঙ্গে কথা বলা হয়েছে। আরও বলতে হবে। তার ওপর আবার স্মৃতির ঝামেলাটা এসে পড়েছে। এবার ব্যাপারটা বোধহয় জটিল হয়ে গেছে। কাদম্বরী আজকাল কোনও কিছু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারে না। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক এমন কী খারাপ হতে পারে যে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হবে? অমরের স্কুলের সমস্যাটাও আগে তাঁকে জানানো উচিত ছিল। কণা বা দীপঙ্করও তো এসে জানাতে পারত। বলতে পারত, ‘বাবা, অমরদা একটা সমস্যার মধ্যে আছে।’ তা হলে হয়তো ঘটনাটা এতটা পর্যন্ত গড়াত না। সবাই কেমন ছাড়াছাড়া হয়ে যাচ্ছে। যেন একসঙ্গে থেকেও অনেক দূরে দূরে। এটা ঠিক নয়। অমরকে একবার ডেকে কথা বললে কেমন হয়?
ডাকতে হল না। অমর নিজেই এল।
দরজা খুলল কণা। যদিও খোলার কথা ভীমের। টিউবওয়েলের জলে বোধহয় ঘুম বেশি হয়, চট করে ভাঙতে চায় না। অমরকে দেখে চমকে যাওয়ার কথা ছিল, কণা চট করে কিছুতে চমকায় না। তা ছাড়া মানুষটাকে কেন জানি তার একটু অদ্ভুত লাগে। অসহায় ধরনের একটা মানুষ। খুব সুন্দরী এবং মোটামুটি বড়লোক একটা মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করে বেচারি যেন জট পাকিয়ে ফেলেছে। যাদের সাহায্যে সে এই জট খুলতে পারত সেই বাবা-মা, শ্বশুরবাড়ি জটটাকে আরও জড়িয়ে ফেলেছে। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো এর সঙ্গে এসে পড়েছে কর্মক্ষেত্রের ঝামেলা। একধরনের বোকা আছে যারা নিজেদের সমস্যা লোককে বলতে লজ্জা পায়। আর যদি বা লজ্জা কাটিয়ে বলতে যায় তা হলে সব গুলিয়ে ফেলে। ফলে এদের সমস্যা কোনওদিন কাটে না। খুব ভাল অবস্থার মধ্যেও এরা সমস্যা নিয়ে থাকে। কণা মনে করে অমর হল সেই ধরনের একজন বোকা। আর সেই কারণে সে তাকে পছন্দ করে। সম্ভবত এই বাড়িতে কণাকে অমর খানিকটা ভরসা করে। মনে করে বুদ্ধিমতী এই মেয়েটা তাকে সাহায্য করলেও করতে পারে। তার সমস্যার কথা সে দু’-একবার তার শালিকে বলতে চেষ্টা করেছে। পারেনি। গতমাসে কণা একদিন কলেজ থেকে বেরিয়ে দেখল, অমর দাঁড়িয়ে আছে।
‘অমরদা, আপনি? কোনও বিপদ হয়েছে? দিদি, নোটন-ঝোটন ভাল আছে?’
‘হ্যাঁ, সবাই ভাল আছে।’
‘আপনি ভাল আছেন?’
ফ্যাকাশে হেসে মানুষটা বলল, ‘কণা, তোমার হাতে একটু সময় আছে?’
‘নিশ্চয় আছে। একটা ক্লাস ছিল, করব না। আপনি আমাকে কিছু বলবেন? চলুন না , বাড়িতে যাই।’
‘না, এখানে কোথাও বসলে ভাল হত। বেশিক্ষণ নয়, অল্প একটু সময় নেব।’
কণা খুব একচোট হাসতে লাগল, ‘শালির সঙ্গে প্রেম আবার অল্পক্ষণে হয় নাকি?’
অনেকক্ষণ বসেও অমরের কিছু বলা হল না। শেষপর্যন্ত চায়ের কাপ নাড়াচাড়া করে বলল, ‘থাক কণা, আর একদিন বলব। কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। ইস তোমার অনেকক্ষণ সময় নষ্ট করলাম। ক্লাসটাও করা হল না।’
আর একদিন সে ফোন করেছিল। সম্ভবত বাইরের কোনও বুথ থেকে। কণা বাসের শব্দ শুনেছে।
‘কিছু বলবেন অমরদা?’
‘হ্যাঁ, একটু কথা ছিল।’
কণা বলল, ‘ঠিক আছে, আজ আপনি বরং শেষ থেকে শুরু করুন। পরে প্রথমটা মনে পড়লে একসময় বলবেন। আমরা অঙ্কেও অনেক সময় শেষ থেকে ভাবি। একসময় মাথাটা আপনা-আপনিই এসে যায়। দেখবেন, আপনারও তাই হবে।’
কণা জানে মানুষটার কোনওদিনই বলা হয়ে উঠবে না। থাক, না বলাই ভাল।
আজ কণা না চমকালেও, অমর কিন্তু থতমত খেয়ে গেল। তার হাতে একটা প্যাকেট। ঘরের ভেতর না ঢুকে সে বলল, ‘ঘুমোচ্ছিলে? ইস, তোমাদের বিরক্ত করলাম।’
কণা, ‘হ্যাঁ, করলেন। আপনি যদি বাইরে একটু অপেক্ষা করেন তা হলে খুব ভাল হয়। আমি বাকি ঘুমটা দিয়ে আসতে পারি। দিদি অবশ্য জেগে আছে। রেডিয়োর আওয়াজ শুনছিলাম। তবে ও আপনার সঙ্গে কথা বলবে বলে মনে হয় না। আপনার কী মনে হয়?’
অমর হাসল। বোকার মতো হাসি। বলল, ‘আমি সত্যিই চলে যাচ্ছি। এই প্যাকেটটা রাখো। বুলুর জন্মদিনের জন্য স্মৃতি বোধহয় কিছু কিনেছিল, আনতে ভুলে গেছে। দিয়ে গেলাম। বাচ্চারা জন্মদিনের জিনিস পরে পেলে খুব দুঃখ পায়।’
কণা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আপনি বোধহয় আমাদের বাড়ির নিয়ম ভুলে গেছেন। আমরা দাঁড়িয়ে থাকা কারও কাছ থেকে কিছু নিই না। পোস্টম্যান এলেও তাকে মোড়া এনে বসতে দিই। বিশ্বাস না হলে ভেতর থেকে দিদিকে ডেকে আনতে পারি, আপনি জিজ্ঞেস করে নেবেন। ডাকব?’
অমর ভেতরে এসে জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসল। যেন এখন সে এ-বাড়ির কেউ না। কণা বসল মুখোমুখি। বলল, ‘ভেরি গুড। এবার একটু অপেক্ষা করুন। যার উপহার সে আসুক তার হাতে দেবেন।’
‘না না, তোমার দিদির হাতে দিয়ে দিলেই হবে।’
বোঝা যাচ্ছে বেচারি খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। মাথা নামিয়ে বসে আছে অপরাধীর মতো। পালাতে পারলে বাঁচে। কণার হাসি পেল। হাসি চেপে সে বলল, ‘অমরদা, আপনার খাওয়া হয়েছে?’
‘হ্যাঁ হয়েছে।’
‘না হলেও কিছু করার থাকত না। আমাদের বাড়িতে আজ জল নেই, কোনও খাবারও নেই। চিলি চিকেন কম পড়েছে। ঠান্ডা ফ্রায়েডরাইস কি ভাল লাগবে? থাক, দরকার নেই, অম্বলটম্বল হয়ে যাবে।’
‘আমি এবার উঠি কণা। আর একদিন আসব। প্লিজ আজ আর আমাকে আটকিও না।’
কণা সিরিয়াস মুখ করে, ‘ঠিক আছে আটকাব না। দেখুন অমরদা, সত্যি কথা বলতে কী, আর আপনি এই বাড়িতে আসবেন কি না সে ব্যাপারে একটা ডাউট দেখা দিয়েছে। আপনি চাইলেও পারবেন বলে মনে হয় না। অন্তত দিদি সকালে সেরকমই বলছিল। হয়তো সে বাড়ির সামনে দারোয়ান বসাবে। এই যে আপনি এসেছিলেন এটা শুনলেও সে বাড়ি মাথায় তুলবে। সে যাক, এইটুকু ঝক্কি তো আমাকে নিতে হবেই। আমি আপনার জন্য এত বড় ঝুঁকি নিলাম তার বদলে আপনি আমার একটা কাজ করে দিয়ে যান।’
অমর হাসল, ‘আবার তুমি আমাকে আটকানোর চেষ্টা করছ কণা। তোমার দিদি আমাকে দেখলে রেগে যাবে।’
‘রেগে যাওয়াই উচিত। আমিও রেগে যাচ্ছি। আপনি আমার কাজটা করবেন কি না বলুন?’
‘কী করতে হবে বলো।?’
কণা রান্নাঘর থেকে একটা কেটলি এনে বলল, ‘ভীম ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। আপনি আমার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়েছেন, মাথাটা ধরে গেল। এবার চায়ের ব্যবস্থা করুন। সামনের দোকান থেকে চুপি চুপি দু’কাপ চা এনে দিন। তারপর কেটে পড়ুন।’
অমর কেটলি হাতে বেরিয়ে গেলে কণা গেস্টরুমে ঢুকল। বুলু জানিয়ে দিয়েছিল, আজ সারাদুপুর সে নোটন-ঝোটনের সঙ্গে খেলবে, কিছুতেই ঘুমোবে না। জন্মদিনের দুপুর কেউ ঘুমিয়ে নষ্ট করে না। যদিও তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কণার ঘরে ঢোকার শব্দ পেয়ে স্মৃতি বলল, ‘কেউ এসেছে? কার সঙ্গে শুনলাম কথা বলছিলি। কেউ এসেছে?’
‘হ্যাঁ, তোকে সে-কথাই বলতে এলাম। অমরদা এসেছে। আমি ওকে বললাম, আপনি এ-বাড়ির দরজা মাড়ালেন কেন? আপনার তো সাহস কম নয়। এই প্যাকেটটা দিল। আমি প্রথমে নিতে চাইছিলাম না। যদি বোমটোম থাকে। আজকাল কত কী বেরিয়েছে। পরে তুই যদি বকিস এই ভয়ে নিলাম। এবার গিয়ে তাড়িয়ে দেব। ঠিক করেছি না?’
‘ঠিক করেছিস। বাড়িতে ঢুকতে দিসনি তো?’
‘পাগল হয়েছিস? ঢুকেছিল, আমি বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। তুই গিয়ে দেখে আয়। থাক, যাস না। আমরদার মুখ দেখে মনে হল আজ বোধহয় দুপুরে ভাতটাত জোটেনি। দেখে তোর মন যদি বিগড়ে যায় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তুই হয়তো খাওয়ায় ব্যবস্থা করবি। আশকারা পেয়ে যাবে।’
স্মৃতি মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আমার বয়ে গেছে।’
সূর্যকান্তবাবু নীচে নেমে এসে দেখলেন, একটা লোক চায়ের কেটলি হাতে বসার ঘরে থতমতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যকান্তবাবু লোকটাকে চিনতে পারলেন না। না পারারই কথা। মিষ্টির বাক্স হাতে জামাইকে চেনা যায়, চায়ের কেটলি হাতে চেনা যায় না। তিনি লোকটার পাশ দিয়ে গম্ভীরভাবে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হয়।
‘আরে! তুমি? অমর! হাতে ওটা কী?’
‘চা।’ অমর বুঝতে পারে সমস্ত ব্যাপারটায় একটা বড় ধরনের গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে।
সূর্যকান্তবাবু অবাক হয়ে গেলেন। খুবই অবাক। সকালে স্ত্রী ছেড়ে চলে এসেছে। স্বামী চায়ের কেটলি হাতে তাকে ডাকতে এসেছে? নাকি অন্য কিছু? এখনকার ছেলেমেয়েদের বোঝা খুবই শক্ত।
অমর বলল, ‘কণা কেটলি দিয়ে বলল, সামনের দোকান থেকে— ভাঁড়ও এনেছি।’
‘ভাঁড়? কেন ভাঁড় কেন?’ সূর্যকান্তবাবু অবাকের ওপর অবাক হলেন, ‘কণা তোমাকে ভাঁড় আনতে বলল!’
অমর বুঝল, এখানেও গোলমাল করে ফেলেছে। ভাঁড় আনার সত্যি কোনও দরকার ছিল না। বাড়িতে বসে বাইরের চা খাওয়া যায় কিন্তু ভাঁড়ে করে খাওয়া যায় না। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় চলে যেতে হবে। আজ এ-বাড়িতে সে যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণই কোনও না কোনও ভুল সে করবে।
সূর্যকান্তবাবু বললেন, ‘যাক, এনে ফেলেছ যখন দাও খেয়ে ফেলি। চা গরম থাকলে অমৃত, ঠান্ডায় বিষ। ঢালো, ভাঁড়েই ঢেলে ফেলো। তুমিও নাও।’
শশুর এবং জামাই দু’জনে সোফায় বসে ভাঁড়ে চা খাচ্ছে। চা গরম, তবু কেন জানি অমরের বিষের মতো মনে হচ্ছে। যদিও শ্বশুরমশাইয়ের কথা অনুযায়ী উলটো হওয়ার কথা ছিল। হচ্ছে না। চা গলা দিয়ে নামতে চাইছে না।
সূর্যকান্তবাবু বললেন, ‘ভালই হল, তোমার সঙ্গে চট করে দুটো কথা সেরে নিই।’
অমর আমতা আমতা করে বলল, ‘এখনই?’
‘হ্যাঁ এখনই। সবাই চলে আসবে তখন আর বলতে পারব না। শোনো অমর, তোমার সঙ্গে স্মৃতির কী ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে আমার জানার দরকার নেই। দরকার হত যদি তুমি বা স্মৃতি আমাকে বিষয়টার মধ্যে ঢুকতে বলতে। তোমরা কেউই বলোনি, সুতরাং এ-প্রসঙ্গে আমার কোনও কথা নেই। তবে যেটা আমার নিজের থেকে বলা উচিত সেটা আমাকে বলতে হবে। দ্যাট ইজ মাই ডিউটি। তোমার কর্মক্ষেত্রে কিছু গোলমাল হচ্ছে শুনলাম। সেটা কি ঠিক?’
অমর মাথা নামিয়ে বসে আছে। মানুষটা মাথা নামিয়ে বসে থাকতে ভালবাসে।
‘হ্যাঁ, হচ্ছে। প্রাইভেট স্কুল। মানেজমেন্ট মনে হচ্ছে বন্ধ করে দেবে।’
‘চিন্তার ব্যাপার। এই বয়েসে আয়ের দরজা বন্ধ হলে, নতুন দরজা পাওয়া যায় না। তোমার জন্য বা আমার মেয়ের জন্য আমি চিন্তা করছি না। আমার ভাবনা নাতিদুটোর জন্য।’
‘আপনি বেশি ভাববেন না। একটা কিছু হয়ে যাবে।’
‘ভাগ্যের দিকে তাকিয়ে তুমি বসে থাকতে পারো অমর। আমি পারি না। একটা কিছু হয়ে যাবে কথাটা অপদার্থের কথা। তুমি স্কুল মাস্টার তোমাকে জ্ঞান দেব না, তোমার জানা উচিত কিছু হয়ে যায় না। সব করে নিতে হয়। যাক, শোনো, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি আমার ব্যবসায় জয়েন করবে। আমি একা সবদিক সামলাতে পারছি না। আজ হোক কাল হোক দীপঙ্করকেও আমি নিয়ে আসব। ওকে অফিসের দিকটা দেব, তুমি কারখানা দেখাবে। ম্যানেজার দিয়ে ব্যাবসা হয় না। নিজের লোক লাগে।’
অমর হতভম্ব হয়ে গেছে। এরকম একটা প্রস্তাব আসবে সে ভাবতেও পারেনি। সে ভেবেছিল শ্বশুরমশাই স্মৃতির বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবেন এবং সেসব প্রশ্নের একটি উত্তরও সে দিতে পারবে না।
সূর্যকান্তবাবু উঠতে উঠতে বললেন, ‘যাই দেখি, জলের কাজটা কতটা এগোল। হয়ে এসেছে বোধহয়। শোনো অমর, আর একটা কথা, শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে তও শোনো। ট্রুথ ইজ ট্রুথ। খারাপ লাগলেও তা সত্যি। টাকাপয়সার একটা সচ্ছলতা থাকলে সংসারে শান্তি থাকে। আমার মেয়েও যেমন তোমার কাছে চলে যাবে, তোমার বাবা-মা’রও স্মৃতিকে আর তত খারাপ লাগবে না। কী, ঠিক কিনা মাস্টার? ততদিন ইচ্ছে করলে স্মৃতি এখানে থাকুক। ক্ষতি কী?’
আড়াল থেকে কথা শোনা উচিত নয়। কণা আবার যে-কাজ গুলো উচিত নয়, সেগুলো করতে বেশি ভালবাসে। সে বাবার সব কথা দরজার আড়ালে থেকে শুনেছে। এই কারণেই বাবা ইজ বাবা। সে প্রায় ছুটে যাচ্ছিল দিদির কাছে। খবরটা আগে দিতে হবে। আনন্দের খবর দেবার মতো মজা আর কিছুতে নেই।
রান্নাঘরে শব্দ শুনে থমকে দাঁড়াল কণা। ওমা! দিদি কার জন্য ঠাণ্ডা ফ্রায়েডরাইস গরম করছে?
৬
তিনটে ছোট গণ্ডগোল হয়েছে।
এক নম্বর, গরম করতে গিয়ে স্মৃতি ফ্রায়েডরাইস পুড়িয়ে ফেলেছে। সেই পোড়া ফ্রায়েডরাইস খুব খারাপ খেতে হলে আমাকে মুখ বুজে খেতে হয়েছে।
দু’নম্বর গণ্ডগোলটা অমরের। বুলুর উপহারের প্যাকেট খোলার পর দেখা গেছে, পুতুলের একটা হাত ভাঙা। পুতুলের কোনও দোষ নেই। সস্তার জিনিস, বাসে আসার সময় ভেঙে গেছে। স্মৃতি এই ঘটনায় ভীষণ রেগে গেছে। চেঁচামেচিও করছে। যদিও যার পুতুল সেই বুলু বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। সে নোটন-ঝোটনকে কাজে নামিয়ে দিয়েছে। তারা প্রবল উৎসাহে সেই ভাঙা হাত আঠা দিয়ে জোড়া দেবার চেষ্টা করছে। ভীম একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সে জানে, এরা পারবে না, তখন তার ডাক আসবে।
তিন নম্বর গণ্ডগোল হল, কাদম্বরীদেবী বিশ্রাম সেরে নীচে নেমেছেন। অমরকে বাইরের ঘরে বসে থাকতে দেখে খুবই বিরক্ত হলেন। লোকটার লজ্জাশরম নেই। দু’কথা শুনিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু পারছেন না। বউমা হেসে হেসে কথা বলছে। কেন বলছে? ইচ্ছে করেই বলছে, পুত্রবধুরা শত্রুশিবিরের সঙ্গে কথা বলতে ভালবাসে। কই শ্বশুরমশাই বলছে? বলছে না। কণা বলছে? বলছে না। যেখানে শ্বশুর, শালী, এমনকী নিজের স্ত্রী কোনও কথা বলছে না, সেখানে বাড়ির বউয়ের কথা বলার দরকার কী? কোনও দরকার নেই। অথচ বলতে যাও খ্যাঁক করে উঠবে, বরের কাছে মায়ের নামে লাগাবে।
তবে এই তিন গণ্ডগোল ছাপিয়ে সবথেকে ভাল ব্যাপার হল, জলের কাজ শেষ হয়েছে। মিস্ত্রি মজুররা জানিয়ে গেল আর একটুক্ষণের মধ্যেই জল আসবে। সবাই খুব উৎসাহে এখন বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। যেন অনেকদিন পরে বড় কোনও অতিথি আসছে। জল এলে গেটের মুখের কালেই তা পড়বে। ভীম অকারণে একটা বালতি নিয়ে সেখানে গেছে। দিনের প্রথম জল সে ধরবে। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছটফট করছে বুলু, নোটন এবং ঝোটন। তারা ঠিক করেছে প্রথম জল তারা ধরবে না। কিন্তু ছোঁবে। এখন বিকেল। ঝোটনের টনসিলের ব্যথা বাড়তে পারে তাই তার মা গলায় মাফলার বেঁধে দিয়েছে। স্মৃতির মতে ঠিক সময়ে মাফলার বাঁধা থাকলে অনেক অসুখের হাত থেকেই বাঁচা যায়। বুলুর ভাঙা পুতুল সারানো যায়নি, তবু মেয়েটা সেই পুতুল হাতে ধরে রেখেছে। সম্ভবত সে এই পঙ্গু পুতুলটিকে কিঞ্চিৎ ভালবেসে ফেলেছে।
ছোটদের তাও মানায়, কিন্তু এ-বাড়ির বড়রাও বেমানানভাবে গেটের মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সূর্যকান্তবাবু মিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলছেন। গোলমালটা ঠিক কী হয়েছিল বোঝার চেষ্টা করছেন। দীপঙ্কর আর অমর রয়েছে পাশাপাশি। অমর বসার সময় যেমন মাথা নামিয়ে থাকে দাঁড়িয়েও সেরকম মাথা নামিয়ে আছে। দীপঙ্কর ইতিমধ্যেই অজন্তার কাছ থেকে বাবার প্রস্তাব জানতে পেরেছে। সে খুবই খুশি। প্রথম, স্মৃতির ভাল হল। দ্বিতীয়ত, এই মুহূর্তে বাবা তাকে চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় ঢুকতে বলবেন না। তিনি একজন লোক পেয়ে গেলেন। কিছুদিন অন্তত সময় পাওয়া গেল। কণা আর অজন্তা কথা বলতে বলতে রাস্তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর সব বউদি ও ননদ যে-কোনও বিষয়ে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারে। সেই সব কথার মধ্যে হাসির কোনও বিষয় না থাকলেও তারা হাসে। আজও হাসছে। যদিও এখন কণার হাসা উচিত নয়। একটু আগে ইন্দ্রজিৎ নামে এক সুদর্শন যুবক তাকে ফোন করেছিল। যুবকের ফোন করার কথা ছিল রাতে। কিন্তু ধৈর্য ধরতে পারেনি। সেই যুবক কণাকে বলে, ‘কণা, তুমি কি আমার চিঠি পড়েছ?’
‘না, পড়িনি।’
‘তুমি কি পরে পড়বে? আমি তোমাকে পরে ফোন করব।’
‘না, আমি পড়ব না। লেখাটা টিউবওয়েলের জলে ভিজে গেছে।’
‘আমি কি তোমাকে বলব?’
‘না। বলবেন না।’
‘কণা, আমি আর সময় পাব না। খুব সম্ভবত সামনের মাসেই আমাকে বাইরে চলে যেতে হবে। আজই একটা চিঠি পেয়েছি। আমি ঠিক করেছি ওটা আমি অ্যাকসেপ্ট করব। সেইজন্য তোমাকে তাড়াহুড়ো করে ফোন করলাম। আশা করি তুমি বুঝতে পারছ এটা আমাদের দু’জনের পক্ষে খুবই জরুরি। আমি একা বাইরে যেতে চাইছি না।’
‘ইন্দ্রজিৎবাবু, আমার একটু তাড়া আছে। আজ সারাদিন আমাদের বাড়িতে জল ছিল না। আপনি তো দেখে গেলেন। এখন পাইপটাইপ সব সারানো হয়ে গেছে, একটু পরেই জল আসবে, বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। জল না থাকার কষ্ট যেমন আমরা সবাই ফেস করেছি, তেমনি জল আসাটাও আমরা সবাই মিলে মজা করে দেখব। এটা আমার বাবার প্ল্যান। খুবই ছোটখাটো বোকা মজা ছেড়ে আমি বিলেত আমেরিকা কোথাও যেতে পারব না। যাবও না। বেস্ট অফ লাক। আর শুনুন, বাইরে থেকে কিন্তু খামে নয়, ভাল দেখে পিকচার পোস্টকার্ডে চিঠি দেবেন। টা টা। ছাড়ি তা হলে?’
এমন এক যুবককে প্রত্যাখ্যান করার পর কোনও তরুণীর হাসিঠাট্টা করা উচিত নয়। তবু কণা করছে। যা উচিত নয় সেই কাজ কণা কেন যে বেশিবেশি করে কে জানে। সে কী-একটা বলে হাসতে হাসতে তার বউদির গায়ে একেবারে ঢলে পড়ছে।
অমর মাথা নামিয়েই শ্বশুরের পাশে এসে দাঁড়াল।
‘একটা কথা ছিল।’
সূর্যকান্তবাবু জামাইয়ের দিকে তাকালেন।
‘পরে বললে হবে না? জলটা এসে যাক। টেনশনে আছি। বিকেলের জলটা এলেই বুঝতে পারব কাজটা ঠিকমতো হল কিনা। তারপর না হয় ভেতরে গিয়ে শুনব।’
‘এক মিনিটের কথা। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তা হলে বলে ফেলি।’
‘বলো।’
‘আপনার মেয়ে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না।’
কীসে রাজি হচ্ছে না? বাড়ি যেতে? থাক না। বললাম না কয়েকদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একটা মাস যেতে দাও। আমি ম্যানেজারকে ফোন করে দিয়েছি, তুমি কালই আমার সঙ্গে অফিসে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে ইয়ংম্যান, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড।’
সূর্যকান্তবাবু অমরের পিঠে হাত রাখলেন।
অমর এখনও মাথা নামিয়ে আছে। বলল, ‘স্মৃতি বলছে দরকার নেই। আমিও তাই ভেবে দেখলাম। কয়েকটা টিউশনি পেয়ে যাব। তাতেই চলে যাবে আপাতত। কণাও দিদিকে বলেছে কয়েকটা জোগাড় করে দেবে।’
বাইরে আসতে স্মৃতির কিছুটা দেরি হয়ে গেল। হবারই কথা। সুটকেস এবং কিটব্যাগ গুছিয়ে আসতে সময় তো লাগবেই। নোটন-ঝোটন ইতিমধ্যেই জিনিসপত্র এদিক-ওদিক করে ফেলেছে। একটা গেঞ্জি আর একপাটি কেডস পাওয়া যাচ্ছে না। থাক, কাল এসে একসময় নিয়ে গেলেই হবে। মা ঠিক খুঁজে রাখবে।
জল এল। সারাদিন শুকনো থাকার পর জল পেলে কল একটা শোঁ শোঁ ধরনের শব্দ করে। এই কলও সেই শব্দ করল। কিন্তু জল কলে এল না। এল নতুন পাইপ ফাটিয়ে, সদ্য খোঁড়া মাটি ফুঁড়ে, ফোয়ারার মতো অনেক উঁচুতে লাফ দিয়ে, অজস্র ধারায় সেই জল পড়তে লাগল।
মিস্ত্রি মজুররা দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে, কাজ ঠিক হয়নি, রেগে যাওয়ার কথা। খুবই রেগে যাওয়ার কথা। তবু এই অদ্ভুত বাড়ির লোকগুলো রাগ করছে না। মনে হচ্ছে যেন আনন্দ করছে! হইচই করে জলধারার তলায় বারবার এসে দাঁড়াচ্ছে। জলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইচ্ছে করে ভিজছে।