ছোট মামা
শুরুতে হালকা ছিল, কিছুক্ষণ হল ঘটনা গুরুতর দিকে মোড় নিয়েছে।
লোকটা ধরা পড়েছে ছ’নম্বর ব্যাচে। এরপর লাস্ট ব্যাচ। ধরা পড়েছে ছ’নম্বর ব্যাচে। এরপর লাস্ট ব্যাচ। লাস্ট ব্যাচে বর-কনেকে নিয়ে বাড়ির লোকরা বসবে। খাওয়া সবে শুরু হয়েছে। রাধাবল্লভির রিপিট চলছে। পরের আইটেম ফিশ ফিঙ্গার। কেটারার কোম্পানির ম্যানেজার মিস্টার দত্ত বেশ চিন্তিত। চিন্তায় ভুল করে রুমালের বদলে তিনি দু’বার টাই দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেলেছেন। মিস্টার দত্তের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। অনেক মালেই শর্ট পড়ছে। ফিশ ফিঙ্গার যা পড়ে আছে তাতে টেনেটুনে এই ব্যাচ পর্যন্ত চলতে পারে। লাস্ট ব্যাচে হওয়া অসম্ভব। চিকেনের পজিশনও ভাল নয়। এক্ষুনি জানা গেল, ইলিশ মাছের পাতুরি তিরিশটাও পড়ে নেই। গোড়া থেকেই কুড়িটা প্লেটের হিসেবে জল মারা রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, পরিবেশনের সময় ছেলেরা মাল সরাতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এখন সিচ্যুয়েশন ম্যানেজ করা দরকার। ম্যানেজারের কাজই হল ম্যানেজ করা।
এমন সময় লোকটার দিকে চোখ পড়ল।
ছোটখাটো মানুষ। বছর পঞ্চাশেক বয়স। চুল ব্যাকব্রাশ করা। সম্ভবত তেল দেওয়ার কারণে চকচক করছে। দাড়ি গোঁফ নিখুঁত করে কামানো। গায়ের পাঞ্জাবিটা ইস্ত্রি করা হলেও বহু ব্যবহারে সাদা রং খানিকটা ফ্যাকাশে মেরে গেছে। এসব চোখে পড়ার মতো জিনিস নয়। ম্যানেজারের চোখে পড়ল অন্য জিনিস। লোকটা সাতখানা শেষ করার পরও আট নম্বর রাধাবল্লভি নিয়েছে এবং প্লেটের অবশিষ্ট ডালটুকু তাতে এমন যত্ন করে মাখাচ্ছে যে মনে হচ্ছে, একটু আগে টিভিতে ঘোষণা করা হয়েছে, আজ রাতেই ডাল বস্তুটি দেশে নিষিদ্ধ হল। আজই দেশবাসীর শেষ ডাল খাওয়া।
দশ বছরের কেটারিং অভিজ্ঞতার চোখ ম্যানেজার দত্তকে বলে দিল, লোকটা ফালতু। কাজের বাড়িতে এ ধরনের ‘ফালতু’-দের হামেশাই দেখা যায়। এরা বিনা নেমন্তন্নে গম্ভীর মুখে ঢোকে এবং ভয়ংকর বিরক্ত মুখে খেতে বসে। খেতে বসে বারবার হাতঘড়ি দেখে। ভাবটা এমন যেন, ইচ্ছে ছিল না তবু তাকে জোর করে খেতে বসানো হয়েছে। খাওয়ার মতো একটা সামান্য কাজ করতে গিয়ে লাস্ট ট্রেন মিস হয়ে যাবে।
তবে এই লোকটার হাতে ঘড়ি নেই। আর মুখও বিরও নয়। বরং এক ধরনের হাসিহাসি ভাব রয়েছে। মানুষটা চেটেপুটে ডাল খাচ্ছে।
‘ফালতু’দের নিয়ে কেটারিং ম্যানেজার কখনও মাথা ঘামায় না। খাওয়াদাওয়ার বাড়িতে ওরকম দু’-চারটে প্লেট কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু আজ মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে। লোকটাকে ধরিয়ে দিতে হবে। লোকটাকে নিয়ে একটা হইচই শুরু হবে। খাওয়া ছেড়ে লোকটার দিকে বাড়ির লোকের মন চলে যাবে। খাবার কম পড়ে যাওয়ার ঘটনাটা আর সামনে আসবে না। ম্যানেজার পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন এবং একতলায় নেমে এলেন।
একতলায় গেটের মুখে অনেকে দাঁড়িয়ে। এইমাত্র মেয়ের বাড়ির লোকেরা পান চিবোতে চিবোতে বাসে উঠল। বাস ছেড়ে দিয়েছে। স্বপনও এখানে রয়েছে। আজ স্বপনেরই বউভাত। বউভাতের দিন বরের মেজাজে একটা ফুরফুরে ব্যাপার থাকে। স্বপনের মেজাজ বিগড়ে আছে। বিগড়ানোর কারণ দুটো। একনম্বর কারণ হল, তার পাঞ্জাবিতে কোথা থেকে যেন মাংসের ঝোল লেগেছে! জল দেওয়ার পরও সে দাগ ওঠেনি। উলটে জলেরও একটা বিচ্ছিরি ধরনের দাগ হয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে, এই জলের দাগের তুলনায় ঝোলের দাগ অনেক ভাল ছিল।
দু’নম্বর কারণ হল, গোলাপ ফুল। বিয়েবাড়িতে প্রবেশপথেই অভিথিদের হাতে একটা করে গোলাপ ফুল ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই ফুল বিয়েবাড়িতেই ফেলে তারা চলে যায়। স্বপন এই নিয়ম বদলানোর জন্য অন্য পরিকল্পনা করেছিল। ঠিক হয়েছিল, ফুল দেওয়া হবে, তবে ঢোকবার সময় নয়, অতিথিরা যখন খাওয়া সেরে বেরিয়ে যাবে তখন। এতে গোলাপ অতিথিদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছোবে। বেশ একটা নতুন জিনিস হবে। কিন্তু নতুন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যখন বেরোচ্ছে তখন দেখা গেল, গোলাপ কম পড়ছে। যারা পেল না তাদের ভুরু কুঁচকে গেল। সামান্য গোলাপ ফুলের জন্য এমন ভাবে চোখ সুরু করে তারা তাকাতে লাগল যেন এই বাড়িতে মেয়েকে রেখে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের মনে গভীর সংশয় দেখা দিয়েছে।
এর পরেও স্বপনের মেজাজ ফুরফুরে থাকার কোনও কারণ নেই। এরকম সময় ম্যানেজার দত্ত গম্ভীর মুখে স্বপনের কাছে আসে এবং কানের কাছে মুখ নামিয়ে কিছু বলে। স্বপন প্রথমটায় অবাক হয়ে তাকায়। সে তার ভাই তপনকে কাছে ডেকে ঘটনা বলে। তপন শিবপুরে সিভিল পড়ছে। ফাইনাল ইয়ার। সে আজ খয়েরি রঙের ধুতি পরেছে। তপনের গায়ের রং ময়লা। খয়েরি ধুতিতে তাকে মোটেই মানাচ্ছে না। কিন্তু এই ধুতি তাকে পছন্দ করে দিয়েছে নন্দিতা। নন্দিতার পছন্দ করা ধুতি পরে তপনের হাবভাব বদলে গেছে। তার ধারণা, আজ তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রুপবান পুরুষের মতো দেখাচ্ছে। সেই তপন দাদার কাছে ঘটনা শুনে দুটো করে সিঁড়ি টপকাতে থাকে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনতলায় পৌঁছে যায়।
তিন নম্বর রোয়ের বাঁদিকের চেয়ার থেকে ফ্যাকাশে পাঞ্জাবি পরা লোকটাকে কার্যত ঘাড় ধরে তুলে ফেলা হল।
লোকটা বাধা দেওয়ার কোনও চেষ্টা করেনি। তবু তপনের টানাহেঁচড়ায় একটা গেলাস উলটেছে এবং টেবিলের ওপর জল পড়ে প্লেট ভাসিয়েছে।
লোকটাকে এনে বসানো হল ছাদের ঘরে। পেছনে ভিড়। এমনকী খাওয়া ফেলেও কেউ কেউ উঠে এসেছে। সেটাই স্বাভাবিক। নেমন্তন্ন বাড়ির কোনও মজাই ছাড়তে নেই। তপন বলল, ‘মেজকা, তুমি দরজায় বাইরে দাঁড়াও। দেখবে কেউ যেন ভেতরে না ঢোকে। লোকটাকে জেরা করতে হবে। আর বাবলুকে খবর দাও।’
বাবলু তপনের বন্ধু। একই সঙ্গে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়েছিল। চান্স হয়নি। তাতে অবশ্য অসুবিধে নেই। সে এখন তার বাবার স্টেশনারি দোকানে বসে। দোকান ছোট কিন্তু চালু। বাবলুর একটা সেলুলার ফোন আছে এবং শনিবার করে জিমে যায়। বাবলু একতলায় প্যান্ডেলের কোণের দিকে বসে নবনীতাকে হাতে ধরে সেলুলারে ভিডিও গেম খেলা শেখাচ্ছিল। ‘ডাকাত’ ধরা পড়েছে শুনে জামার হাতা গোটাতে গোটাতে সে ছুটল।
কমলাদেবী খবর পেলেন রতনের মায়ের কাছ থেকে। একটু আগে পর্যন্ত রতনের মায়ের মেজাজ খুবই খারাপ ছিল। বিয়েবাড়িতে খাটনি বেশি। কিন্তু এখন তার মনটা খুশিতে ভরে আছে। অনেকক্ষণ টার্গেট করার পর কিছুক্ষণ হল সে একটা গিফটের প্যাকেট সরাতে পেরেছে। বড় প্যাকেটে লোভ ছিল, কিন্তু লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া শক্ত হবে বলে ছোটই নিয়েছে। প্যাকেট খুলে দেখে ঘড়ি। লেডিস ঘড়ি। রতনের মা এতটা ভাবতে পারেনি। সে কাগজ এবং বাক্স ফেলে দিয়েছে। ঘড়ি এখন তার কোমরে। তার খুবই ইচ্ছে করছে কোমর থেকে বের করে বারবার জিনিসটা দেখে, সত্যি ঘড়িই তো? সাহস পাচ্ছে না। সে হাসিমুখে দোতলায় কমলাদেবীর কাছে এল। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘বউদি, শুনসেন? খাবার জায়গায় একটা ডাকাইত ধরা পড়সে? ছোড়দায় ছাদের ঘরে এখন পিটান দিতাসে।’
রতনের মায়ের কথা শুনে কমলাদেবী খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। স্বপনের বাবাকে দোতলায় খুঁজে বের করলেন। গলা নামিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁগো, বউয়ের গয়নাগুলো গা থেকে খুলে আলমারিতে ঢুকিয়ে দেব নাকি?’
রাধানাথবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘খেপেছ নাকি? তোমার সবটাতে বাড়াবাড়ি। কে একটা বাজে লোক ঢুকে পড়ে খেয়ে নিয়েছে তাই নিয়ে হইচই করছ ?’
কমলাদেবী রিস্ক নিলেন না। নতুন বউয়ের কাছে গিয়ে বললেন, ‘গলার হারটা খুলে দাও তো মা, তুলে রাখি। রাত অনেক হয়েছে। হারটা হল গিয়ে খোকার ঠাকুমার। ভাল মন্দ কিছু হলে এসব জিনিস আর করানো যাবে না। যাবে, বলো?’
নতুন বউ মন্দিরা শাশুড়িকে হার খুলে দিয়ে দেয়।
বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামলী। এদিকটা একটু আলো অন্ধকার। হঠাৎ করে চোখে পড়ে না। শ্যামলী এখন চাইছে না সে কারও চোখে পড়ুক। রাগে তার মাথা ঝিমঝিম করছে। করাটা স্বাভাবিক। আজ সারাসন্ধে তার স্বামী অপূর্ব যে কাণ্ড করে বেড়িয়েছে তাতে স্ত্রী হিসেবে তার মাথা ঝিমঝিম করা দোষের কিছু নয়। একটু আগের ঘটনা তো মারাত্মক। তাতে শুধু মাথা কেন শ্যামলীর সারাশরীর ঝিমঝিম করার কথা। সে স্পষ্ট দেখেছে, অপূর্ব মধুমিতার কাঁধে হাত রেখে কথা বলছে। ছি ছি। বাড়ি-ভরতি লোকের সামনে এ কী কাণ্ড। সারাসন্ধে মধুমিতার গায়ে লেপটে লেপটে ঘুরলি। এখন একেবারে কাঁধে হাত! উফ। ব্যাটাছেলেগুলো যে কতদূর নামতে পারে। শ্যামলী বুম্বাকে পাঠিয়েছে তার বাবাকে ডেকে আনতে। এখনই বাড়ি চলে যাবে সে। একটু পরেই বুম্বা ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ‘মা, ছাদে খুব মজা হচ্ছে। ছাদে ডাকাতটার গায়ে বাবা লেডিকেনির এক হাঁড়ি রস ঢেলে দিয়েছে। এরপর বলছে পিঁপড়ে ছেড়ে দেবে। বাবলুমামা বাগানে পিঁপড়ে খুঁজছে। দারুণ হবে! বাবা এখন আসতে পারবে না। আমিও ওপরে চললাম।’
মুকুল একটা ঝামেলার মধ্যে পড়েছে। বড় ঝামেলা নয়, ছোট ঝামেলা। কিন্তু বেরোনোর পথ পাচ্ছে না। ঘটনা এরকম— মুকুল আজ তার হ্যান্ডক্যামটা নিয়ে এসেছে। কেউ আনতে বলেনি। সে নিজে থেকেই এনেছে। ক্যামেরা খুবই দামি। হাতের তালুর মধ্যে ধরে যায়। বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে সিঙ্গাপুর থেকে চোরাই পথে আনাতে হয়েছে। ক্যামেরা আনার উদ্দেশ্য ছিল দুটো। এক নম্বর হল, বউভাতের ছবি তোলা। তবে দু’নম্বরটাই হল আসল। তার যে এরকম একটা দামি বস্তু আছে তা সবাইকে দেখানো। দুটো উদ্দেশ্যই সফলভাবে এগোচ্ছিল। কায়দা মেরে বর কনে খাওয়াদাওয়ার কয়েকটা ছবি নিয়েছে সে। অল্পবয়সি মেয়েরা ক্যামেরা দেখলে পুরুষদের কোনও দোষ দ্যাখে না। আর এই জিনিস দেখে তো তারা ‘মুকুলদা, মুকুলদা’ করে একদম পাগল। সঙ্গ ছাড়তেই চাইছে না। ফরসা, টানাটানা চোখের একজন ইতিমধ্যে মুকুলকে তার বাড়ির টেলিফোন নম্বর পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। ক্যামেরা ছাড়া এ জিনিস অসম্ভব হত। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, কিছুক্ষণ হল মেয়ের দল দাবি তুলেছে, এই ক্যামেরা নিয়ে আজ রাতে মুকুলকে নাকি ফুলশয্যার খাটের তলায় লুকিয়ে থাকতে হবে। থাকতেই হবে। কাল ব্রেকফাস্টের সময় ভিসিআর ভাড়া করে সেই ছবি দেখা হবে। মেয়েরা প্রায় ঝুলোঝুলির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দামি ক্যামেরা দেখিয়ে সুন্দরীদের কাছে যাওয়া যত সহজ, সারারাত খাটের তলায় শুয়ে থাকা মোটেও তত সহজ নয়। কিন্তু এই ঝামেলা থেকে বেরোনোর পথ কী ?
পথ নিয়ে এল অর্ঘ্যদা। ঘরে ঢুকেই বলল, ‘এই যে মুকুল, তুমি এতক্ষণ ছিলে কোথায় ? এখানে বসে আছ। ইস, ওপরে ডাকাত ধরা পড়েছে তুমি খবর পাওনি? দুর্দান্ত মজা হচ্ছে। মাথায় রসে ঢালা হয়েছে। এবার লঙ্কাগুঁড়ো দিয়ে ফিশচপ খাওয়ানো হবে। রান্নাঘরে স্পেশাল চপ বানানো হচ্ছে। হা হা। বাপ রে, তপনটার মাথায় সব আসেও বটে। যাও যাও ক্যামেরা নিয়ে ছোটো। ডাকাতের চপ খাওয়া— এমন ইন্টারেস্টিং ছবি পাবে না।’ মুকুল ডাকাতকে ধন্যবাদ দিতে দিতে ক্যামেরা নিয়ে ছুটল। অর্ঘ্যদা মেয়েদের দিকে ফিরে হাসিহাসি মুখে বলল, ‘কী হে সুন্দরীরা, তোমরা হাত দেখাবে নাকি? আমি কিন্তু ভীষণ ভাল হাত দেখতে পারি। যে দেখাবে চটপট হাত বাড়াও। সময় কম।’
টানা চোখের মেয়েটা উঠে দাড়াল এবং বলল, ‘না, আমরা কেউ হাত দেখাব না। আমরাও ডাকাত দেখব। অ্যাই চল তো সবাই।’
চিলেকোঠার ঘরের সামনে ভিড়। সামলানোর দায়িত্বে রয়েছেন মেজকাকা নিজে। একটু আগে পর্যন্ত দলবেঁধে ঘরে ঢোকা যাচ্ছিল। ভিড় বাড়ার ফলে মেজকাকা ব্যবস্থা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। এখন একসঙ্গে দু’জনের বেশি অ্যালাউ নেই। ঘরের ভেতরে ঢোকাও বন্ধ। দরজা থেকে উঁকি মেরে চলে যেতে হবে।
এই ব্যবস্থায় অনেকেই বিরক্ত। বিশেষ করে দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা ব্যাপারটাকে মোটেই ভাল চোখে দেখছে না। দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা যে-কোনও বিষয়কে অপমানের চোখে দেখতে পছন্দ করে। একেও তাই করছে। তারা নাকি রস ঢালার দৃশ্য থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে নিশ্চয় কোনও পক্ষপাতিত্ব চলছে। তবে সকলেই অপেক্ষা করছে, কঠিন জেরার মুখে আসামি কখন তার দোষ কবুল করে।
এমন সময় ঘর থেকে স্বপন বেরিয়ে এল। চিন্তিত মুখে বলল, ‘বাবা কোথায়?’
রাধানাথবাবু একতলায়। বাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। তিনি বসে আছেন কনেযাত্রীর জন্য আনা লাল সোফায়। এগুলো ভাড়া বেশি। নরম গদিতে বসতে আরাম লাগে। কিন্তু রাধানাথবাবুর নরম লাগছে না। জ্বালাজ্বালা লাগছে। কারণ আছে। স্বপনের শুরমশাই মারাত্মক ধরনের একটা কথার খেলাপ করেছে। ছেলের বাবা হয়ে সেকথা কাউকে বলা যাচ্ছে না। সবাই ভাববে পণের ব্যাপার ফলে জ্বালা বেশি। বিয়ের আগেরদিন পর্যন্ত মেয়ের বাবা টেলিফোনে তাঁকে জানিয়েছিল, বালিগঞ্জের জমিটা মাসখানেকের মধ্যেই মেয়ে-জামাইয়ের নামে করে দেবে। তারপর স্বপন তাতে যা ইচ্ছে করবে। বাড়ি বানাবে না ফেলে রাখবে তা জামাইয়ের ব্যাপার। হারামজাদা আজ বলে গেল, দলিল খুলে দেখা গেছে, জমিতে নাকি ডিসপিউট আছে। এখন নাম ট্রান্সফার অসম্ভব। এতদিন বিষয়টা জানা যায়নি? ঠিক আজই চোখে পড়ল।
এমন একটা বিরক্তির সময় স্বপন এসে দাঁড়াল। বলল, ‘বাবা, একটা প্রবলেম হয়েছে।’
রাধানাথবাবু মুখ না তুলে বললেন, ‘জানি প্রবলেম হবে। কী, পিটিয়ে লোকটাকে মেরে ফেলেছ তো? বেশ করে। এবার পাঁজাকোলা করে লাশটাকে নামিয়ে আনে।’
‘বাবা, তুমি খামোখা রেগে যাচ্ছ। আজকাল আর শুধু খাওয়ার জন্য কেউ নেমন্তন্ন বাড়িতে ঢোকে না। সেসব তোমাদের আমলে হত। এদের পেছনে বড় কোনও মোটিভ থাকে। সেটাই দেখছিলাম। যাক, লোকটা এখন চড় থাপ্পড় খেয়ে বলছে সে নাকি সম্পর্কে মন্দিরার মামা হয়।’
‘মন্দিরা কে?’
স্বপন মাথা নামিয়ে বলল, ‘উফ বাবা! যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। লোকটা নাকি ওদের ডিসটান্ট রিলেশন। দূর সম্পর্কের আত্মীয়। মামা ধরনের কিছু। ছোট মামা না কী যেন বলছে, ঠিক নেমন্তন্নের ব্যাপার নয়। হঠাৎ বিয়ের খবর পেয়ে, ঠিকানা খুঁজে ভাগনির বউভাতে চলে এসেছে। ভেবেছিল, না বলে এসে সবাইকে চমকে দেবে। কিন্তু এসে দেখে মেয়ের বাড়ির লোক চলে গেছে। বলছে বউ-মেয়েরাও নাকি আসতে চেয়েছিল। রাত হয়ে যাবে বলে আনেনি।’
‘বলিস কী রে! এতক্ষণ শ্বশুরবাড়ির লোককে ধরে পেটাচ্ছিলি!’
‘আস্তে বাবা। উত্তেজিত হয়ো না। গোটাটা গল্প। ঘটনা সত্যি হলে অনেক আগেই বলে ফেলত। মাথায় রস ঢালার পরেও তো চুপচাপ ছিল। আরও মারের ভয়ে এখন বানিয়ে বানিয়ে বলছে। আমি শুনলাম, এরকম লোক নাকি আছে। অনুষ্ঠানের বাড়িতে ঢোকে। বাড়িঘর, গয়নাগাঁটি সব দেখে নেয়। তারপর ডাকাতির জন্য টিপ অফ করে। খবর দেয়। বাইরে আসল গ্যাং অপেক্ষা করে। বাবলু বলছিল, লাস্ট মান্থে নাকি সন্তোষপুরে সেম কেস হয়েছে। যাই হোক, আমি বাবলুকে গাড়ি দিয়ে থানায় পাঠাচ্ছি। পুলিশ এসে লোকটাকে নিয়ে যাক। আর আজ রাতে সবাইকে একটু অ্যালার্ট থাকতে বলো।’
রাধানাথবাবু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘লোকটা মন্দিরার নাম বলতে পারল?’
স্বপন ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হাসল। বলল, ‘না। আর তাতেই তো ধরে ফেললাম। বলছে, সে নাকি মন্দিরাকে ডাক নামে চেনে। ফিসফিস করে রুনু না কী একটা বলল যেন। অনেক বছর আগে ফ্রক পরা অবস্থায় দেখেছে বলে একটা গল্প ফাঁদতে গিয়েছিল। আমি আর বাড়াতে দিইনি।’
‘মন্দিরার ডাক নাম কী?’
‘উফ বাবা। ইটস টু মাচ! আমি কি খবর না নিয়ে বলছি? মন্দিরার ডাক নাম রুনু নয়। ইনফ্যাক্ট এর কোনও ডাক নামই নেই। অনেকের হয় না, ছোটবেলায় এক-এক জন এক-এক নামে ডাকে? সেরকম আর কী।’
রাধানাথবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ও, তা হলে পুলিশকে ডাকাই ভাল।’
ডাকাত পালিয়ে গেছে শুনলে পুলিশের আসতে দেরি হয়। কিন্তু ডাকাত ধরা পড়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে শুনলে পুলিশ দেরি করে না। আজও করল না। জিপে খাবারের চারটে প্যাকেট তুলে দেওয়া হয়েছে। ওরা আরও দুটো প্যাকেট দিতে বলল। থানায় নাইট ডিউটিতে আজকাল ফোর্স বেশি থাকে। তাই অতিরিক্ত প্যাকেট।
কোমরে দড়ি পরিয়ে লোকটাকে নামানো হচ্ছে। লোকটা কি খানিকটা ঘাবড়ে গেছে? বোঝা মুশকিল। চোর-ডাকাতদের এটাই স্বভাব। ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত স্মার্ট দেখায়। ধরা পড়লে মনে হয়, ঘাবড়ে গেছে।
সিঁড়ির মুখটাতে ভিড়। নতুন বউও এসেছে। এরকম ক্যাবলা ধরনের পামশু পরা একটা লোক যে ডাকাত হতে পারে তা ভাবতেও পারছে না মন্দিরা। রস লেগে লোকটার পাঞ্জাবি গায়ের সঙ্গে লেপটে গেছে। ঘাড়ের কাছে অনেকটা মাটি লেগে। ওরা বলছিল, পিঁপড়ের বাসা না কী যেন দিয়েছে। পিঁপড়ের বদলে মাটি? বেশ করেছে। বদমাইশ কোথাকার। একদিকের চোখটা ফুলে আছে না? ভাগ্যিস ধরা পড়ল! সত্যি সত্যি যদি ডাকাতি হত? বাড়ি-ভরতি এত গয়নাগাঁটি, জিনিসপত্র। শাশুড়ি তো তাল বুঝে হারটা নিজের আলমারিতে ঢুকিয়ে নিল। শাশুড়ি মহিলা পাজি কম নয় তো! নতুন বউয়ের গলা থেকে হার কাড়তে হাত কাঁপল না? শুধু ওই হারেরই দাম আছে? আর সে যে বাপের বাড়ি থেকে বিশ ভরি এনেছে সেটা কি মাগনায়?
স্বপন বউয়ের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘ছোট মামাকে চিনতে পারছ নাকি?’
মন্দিরা লজ্জা পেয়ে সরে যায়। ওমা কী অসভ্য! এত লোকের মাঝখানে একেবারে ঘাড়ের ওপর উঠে এসেছে যে!
কোমরে দড়ি বাঁধা থাকলেও পুলিশরা খারাপ কোনও ব্যবহার করছে না। সম্ভবত ডাকাতদের সঙ্গে পুলিশের খারাপ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে। বরং জিপে ওঠবার সময় ভেতর থেকে একজন হাত বাড়িয়ে দিল।
‘ডাকাত’ পেছন ফিরে তাকায়।
ফ্যালফ্যালে, নার্ভাস সেই চোখ কি ভিড়ের মধ্যে রুনু নামে কোনও মেয়েকে খুঁজছে? সেই মেয়ে কি ছোটমামা বলে ডেকে উঠবে এখনই?