কে মোরে ফিরাবে অনাদরে
আমি কি পালাব? হ্যাঁ, আমি পালাব।
তপন আমাকে বলেছিল, ‘আমার সঙ্গে একটা জায়গায় চল তাপস। যাব আর চলে আসব।’ আমি বললাম, ‘এখন? অসম্ভব। আজ আমার বিরাট কাজ। দেখছিস না জামা গুঁজে জুতো পরে বেরিয়েছি। একটু পরে সেলুনে ঢুকে চুলটা ছোট করব। তারপর জুতো পালিশের ব্যাপার আছে। টাকা কুড়ি ধার দে তো।’
‘ধার নয়, কুড়ি টাকা এমনিই তোকে দিয়ে দেব। আগে তুই আমার সঙ্গে যাবি বল?’
‘সরি তপন। কুড়ি কেন, দুশো টাকা দিলেও আমি তোর সঙ্গে আজ যেতে পারছি না। আজ রাত ন’টার সময় ভবানীপুরে পৌঁছোতেই হবে। একজনের সঙ্গে অ্যাপয়েনমেন্ট আছে। ভদ্রলোক আবার কাল ভোরের ফ্লাইটে বাইরে চলে যাচ্ছেন। ফেঁসে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’
তপন রাগরাগ মুখ করে বলল, ‘কী কেলেঙ্কারি হবে?’
আমি হাসলাম। বললাম, ‘চাকরির কেস। এবার স্ট্রং ক্যাচ আছে, মনে হচ্ছে, কাজটা হয়ে যাবে। আজ ফাইনাল ইন্টারভিউ বলতে পারিস। তোর কী মনে হচ্ছে বল তো, কাজটা হবে?’
তপন আমার হাতটা চেপে ধরল। বলল, ‘মনে হচ্ছে না হবে। কারণ এর আগেও কমপক্ষে পনেরোটা ইন্টারভিউয়ের সময় তোর স্ট্রং ক্যাচ ছিল। কোনওবারই চাকরি হয়নি। তবে আজ তোর ইন্টারভিউয়ের অনেক আগেই ফিরে আসব। প্লিজ চল। কথা দিচ্ছি, তোকে ট্যাক্সি করে ভবানীপুরে ছেড়ে দেব। খামোকা বাসে চেপে পালিশ করা জুতো নষ্ট করবি কেন? তা ছাড়া ইন্টারভিউয়ের সময় ট্যাক্সি করে গেলে একস্ট্রা নম্বর থাকে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান সেই নম্বর দেয়। আমরা জানতে পারি না।’ আমি থমকে গেলাম। তপনের পরিকল্পনা খারাপ নয়। ঘণ্টাকয়েক ওর সঙ্গে থাকলে কুড়ি টাকা, ট্যাক্সি, চা, সিগারেট অনেক সুবিধে পাব।
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘হ্যাঁরে, আটকে দিবি না তো?’
‘খেপেছিস? তোর চাকরির ব্যাপার আমি দেরি করব? তা ছাড়া এসব বাড়িতে কেউ দেরি করে ? যাব আর চলে আসব। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মামলাও নয়। যেতে আসতে যতটা সময় লাগে। ওখানে ম্যাক্সিমাম পনেরো মিনিট। আমি তো যেতে রাজিই হচ্ছিলাম না। মা বলল, একেবারে কেউ না গেলে…।’
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘কী ব্যাপার বল তো, বিয়েবাড়িটাড়ি নাকি?’
তপন সামান্য হাসল। বলল, ‘না বিয়েবাড়ি নয়।’
‘একা যাচ্ছিস না কেন? মারধর খাওয়ার ব্যাপার আছে মনে হচ্ছে।’ তপন এবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই তো তিন নম্বর আসছে। চল বাসটায় উঠে সব বলছি।’
বাস রাস্তা পেরিয়ে যে-গলিটায় ঢুকলাম সেটা ভাঙাচোরা। শীতের আগে আগে এই সময়টা তাড়াহুড়ো করে সন্ধ্যা নামে। আজও নেমেছে। রাস্তা ভাঙা হলেও ল্যাম্পপোস্ট আছে। তবে আলো নেই। বাড়িঘর অল্প। প্রতিটা বাড়ির সঙ্গে গাছপালা। তেমন কিছু না হোক দুটো ডাব গাছ আছে। জায়গাটা অন্যরকম, ফাঁকাফাঁকা। একটা শিরশিরে হাওয়া। কলকাতার কাছে এখনও এরকম ফাঁকা জায়গা আছে? পথের পাশে একটা পুকুরের মতো। দুটো চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলে ঘাটে বসে আছে। এই বয়েসের ছেলেদের সন্ধেবেলা চুপ করে বসে থাকতে দেখলে কেমন যেন লাগে। কী করছে ওরা ? আমি তাকালাম। একজন জলে ঢিল ছুড়ছে। খানিক বাদে বাদে শব্দ হচ্ছে ঝুপ ঝুপ। পুকুরের জলে এখনও কিছুটা দিনের আলো আটকে রয়েছে, ঢিল পড়লে সেই আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে।
তপন বলল, ‘জায়গাটা একইরকম আছে। কতবছর পরে এলাম। কোনও ডেভলপমেন্ট নেই।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কতবছর মানে! এই তো বললি, তোর মামার বাড়ি যাচ্ছি। মামার বাড়িতে আসিস না তুই?’
‘মামা ঠিকই, কিন্তু নিজের মামা নয়। খুড়তুতো মামা। তুই কোনওদিন তোর খুড়তুতো মামার বাড়ি গেছিস? ধর হঠাৎ সেই মামার মেয়ের সঙ্গে তোর শ্যামবাজারের মোড়ে দেখা হয়ে গেল। তুই চিনতে পারবি?’
আমি বিরক্ত হলাম। বললাম, ‘আমার কোনও খুড়তুতো-মামাতো বোন নেই। থাকলেও চিনতে পারব না। চিনতে চাইও না। এখন বল তপন, আটকে যাব না তো?’
তপন সিগারেটের টুকরোটা ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু ছন্দাকে চিনতে পেরেছিলাম। এমনিতে তো ওদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। কালেভদ্রে দেখা হয়। সপ্তাহখানেক আগে, না দশ দিনই হবে, দেখলাম ছন্দা ট্রাম ডিপোর সামনে দাঁড়িয়ে। শাড়িটাড়ি পরে একাক্কার কাণ্ড। কত বড় হয়ে গেছে! কাঁধে ব্যাগ, হাতে গাদাখানেক বই। নিশ্চয় কলেজ থেকে ফিরছিল। চেঁচিয়ে ডাকলাম। মেয়েটা শুনতে পেলে না, বাসে উঠে পড়ল। যাক, আয় পৌঁছে গেছি। এই যে, এই বাড়িটা।’
বাড়ির সামনে পৌঁছে বোঝা গেল, বাড়িটা পুরোপুরি একতলা নয়, আবার দোতলাও নয়। ন্যাড়া ছাদের ওপর একটা ঘর রয়েছে। আসবেসটসের ছাদওলা সেই ঘর অন্ধকার। পুরো বাড়িটাতেই আলো কম। বাইরে কোমর সমান উঁচু পাঁচিল। পাঁচিল থেকে একটা ভেজা শ্যাওলা ধরনের গন্ধ আসছে। সম্ভবত পাঁচিলের ওদিকে বাগানটাগান ধরনের কিছু আছে। সেখান থেকে কয়েকটা ডাল পাতা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে পাঁচিলের এদিকে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, এরা যেন রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ আসবে, তাই অপেক্ষা করছে।
নড়বড়ে টিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার আগে তপন এক মুহূর্ত দাঁড়াল। আধো অন্ধকার বাড়ির ভেতর থেকে একটানা একটা শব্দ ভেসে আসছে উ-উ-উ। কেউ কি গান করছে? আমি গলা নামিয়ে বললাম, ‘এ কেমন অনুষ্ঠানের বাড়ি রে তপন! আলো নেই, কিছু নেই!’
তপন আমার দিকে ফিরে চাপা গলায় বলল, ‘আমার সেই বোন ছন্দা আত্মহত্যা করেছে। সুইসাইড। আমরা খবর পেলাম অনেক পরে। রাঙামাসি মাকে ফোন করে জানাল। তাপস, রাগ করিস না প্লিজ। এরকম একটা বাড়িতে একা একা আসা যায়? তুই ভাবিস না, আমি তোকে কথা দিয়েছি, দেরি করব না।’
আমার কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। আমার ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে। ছুটে পালিয়ে যেতে। ইস, কেন যে তপনের কথায় রাজি হয়ে চলে এলাম? এটা তপন কী করল? আমি ওকে বিশ্বাস করলাম, আর ও আমাকে একটা অচেনা অজানা আত্মহত্যার বাড়িতে এনে ফেলল!
বাড়ির ভেতরে পা দিতেই বুঝতে পারলাম, ভেসে আসা একটানা শব্দটা গান নয়, কান্না। কেউ চাপা গলায় কাঁদছে।
ছোট একটুকরো বাগান। ছড়ানো ছিটানো কয়েকটা ঝোপঝাড়। হয়তো ফুলগাছই হবে। অন্ধকারে গাছগুলোকে চেনা যাচ্ছে না। বাগান পেরোলে লম্বা বারান্দা। বারান্দায় এখনও আলো জ্বালানো হয়নি। আবছা অন্ধকারে দেখলাম, বেঞ্চমতো একটা কিছুতে কেউ বসে আছে। মাথা নামানো। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম, একজন বুড়ো মানুষ। গেটের আওয়াজে মানুষটা মুখ তুলল। বলল, ‘কে, খোকন?’
‘না মামা, আমি তপন।’
মানুষটা বলল, ‘ও।’ বলে আবার মুখ নামিয়ে নিল। তপন এগিয়ে গেল। গলা নামিয়ে বলল, ‘আমরা অনেক পরে খবর পেলাম মামা। মা আসতে পারল না। খবরটা শুনে এত ভেঙে পড়েছে।’ মানুষটা এবারও মুখ না তুলে বলল, ‘ও।’ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তপনের কথায় মানুষটার কোনও উৎসাহ নেই। তপন আমার দিকে একবার তাকাল। মামার দিকে ফিরে বলল, ‘মামিমা কি ভেতরে? ঠিক আছে আমি দেখা করে আসছি।’ মানুষটা বিজবিজ করে কী যেন বলল, বোঝা গেল না। শুধু ‘খোকন’ শব্দটা শোনা গেল। খোকন কে?
বারান্দার অন্যদিকে কয়েকটা চেয়ার পাতা। জায়গাটায় কোথা থেকে জানি খানিকটা আলো এসে পড়েছে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে, মাঝবয়সি এক পুরুষ চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। কাছে গিয়ে বুঝলাম, শুধু পা দোলাচ্ছে না, লোকটা ছটফটও করছে। মনে হচ্ছে কোনও কারণে বিরক্ত। ছটফটে লোকটার সামনে আরও একজন বসে। তার হাতে একটা মোবাইল ফোন। সেই ফোন থেকে চাপা হলুদ আলো বেরোচ্ছে। লোকটা মন দিয়ে তাকিয়ে আছে সেই আলোর দিকে। এদের কাছে এসে তপন বলল, ‘মন্টুদা, তুমি কখন এলে? বিনুকাকা, তুমিও এসেছ? তপতী কাকিমা আসেনি?’ বিনুকাকা মোবাইল থেকে চোখ সরাল না। মন্টুদা মুখ তুলে বলল, ‘ও তুই। আমি আর তপতী এসেছি। এখন তো মনে হচ্ছে বডি আসতে রাত কাবার হয়ে যাবে। সুইসাইড কেস অত সহজ নয়। পোস্টমর্টেম, পুলিশ । হাজার একটা ফ্যাচাং। যে মরে তার তো হ্যাপা পোয়াতে হয় না। যারা রইল তারা ফাঁসল। কাল ভোরের আগে ছাড়া পাব বলে তো মনে হচ্ছে না।’
বিনুকাকা নামের লোকটার এখনও মোবাইল ফোনে চোখ। বলল, ‘ইমপসিবল। কাল দুপুরের আগে কিস্যু হবে না। এই যাঃ গেম ওভার। বুঝলি মন্টু, মোবাইলের গেমস্গুলোকে আমরা হালকাভাবে নিই বটে বাট নট সো ইজি।’
বিনুকাকার কথায় পাত্তা না দিয়ে মন্টুদা বলল, ‘বোস তপন।’
‘না বসব না। আমি বরং ভেতর থেকে একবার ঘুরে আসি। মন্টুদা, এ হচ্ছে আমার বন্ধু তাপস। ওকে ধরে এনেছি। বলা যায় না যদি কোনও দরকার টরকার লাগে। তোমাদের সঙ্গে একটু বসুক।’
রাগের বদলে এখন আমার যা হচ্ছে, তা হল অস্বস্তি। এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে কখনও পড়তে হয়নি। আমার ইন্টারভিউয়ের কী হবে? ঠিক সময় পৌঁছোতে পারব তো? ঘরের ভেতর মেয়েলি গলার ছেঁড়া ছেঁড়া কথা শোনা যাচ্ছে। চুপ করে বসে আছি। খানিক পরে বিনুকাকা লোকটা আবার বোতাম টিপে মোবাইল ফোনের গেমস্ খুলল। বিপ বিপ বিপ…। একঘেয়ে আওয়াজ।
মন্টুদা আমার দিকে চেয়ার ঘুরিয়ে বলল, ‘উফ কী বিরক্তিকর ঘটনা বলুন তো। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ব্যাপার, না এলেও নয়। একদম আটকে গেলাম। ভাই, কী যেন নাম আপনার ? একটা সিগারেট হবে?’
‘না, প্যাকেটটা তপনের কাছে। নিয়ে আসব?’
বিনুকাকা এবার কথা বলল, ‘আটকে গেলি মানে? ছন্দার সুইসাইডে তোরা আসবি না তো কে আসবে? আমাদের এভাবে ছুটে আসাটাই বরং বাড়াবাড়ি হয়েছে। কাল পরশু একবার দেখা করে গেলেই হত। বছরে একবারও আসা হয় কিনা সন্দেহ। তপতীকে বললাম, এসব হল কেলেঙ্কারির কেস। যত পারো অ্যাভয়েড করো। শুনল না, ছুটে চলে এল। এখন ঠ্যালা সামলাও। তাও ভাগ্যিস হাসপাতালে ছুটতে হয়নি। শুনলাম, ওখানে পাড়ার ছেলেপিলেরা আছে। এই ধরনের সসি কেসে পাড়ার ছেলেরা আগে ছুটে আসে। রাবিশ।’
মন্টুদা আমার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘তপনের কাছে আপনি কেসটা কিছু শুনলেন?’ আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, ‘কোন কেসটা? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’ মন্টুদা বলল, ‘কোন কেস মানে? ছন্দার কেস। মেয়েটা হঠাৎ কেন সুইসাইড করল শুনেছেন কিছু?’ বিনুকাকা মোবাইল বন্ধ করে বলল, ‘আঃ আস্তে বল মন্টু। জেঠামশাই শুনতে পাবেন।’ লোকটা এরপর পা ছড়িয়ে বসল। পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বের করল। মন্টুদাকে একটা দিল, আমাকে বলল, ‘খাবেন?’ আমি বললাম, ‘না।’ বিনুকাকা মন্টুদার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘তোকে বললাম তো গোলমাল ছিল। সামথিং রং।’ মন্টুদা বলল, ‘কী রং?’ বিনুকাকা বলল, ‘এক কাপ চা অ্যারেঞ্জ করা গেলে ভাল হত। গলাটা শুকিয়ে গেছে। রং মানে রং। ডোন্ট ফরগেট মেয়েটা বড় হয়েছিল। তপতীই আজ আসার সময় গাড়িতে বলল, লাস্ট মান্থে নাকি গড়িয়া না গড়িয়াহাট কোথায় দেখা হয়েছিল ওদের। উইথ আ বেগার লুকিং ইয়াং ম্যান। আজকালকার মেয়েরা স্বাধীনতা শিখেছে। স্বাধীনতা সামলাতে শেখেনি। বিশেষ করে এই ধরনের লোয়ার মিডলক্লাস ফ্যামিলির মেয়েরা একবার ফেঁসে গেলে ব্যালান্স হারিয়ে ফেলে। লাতিন আমেরিকায় একটা এনজিও এ বিষয়টার ওপর বেশ ভাল কাজ করেছিল। ওদের ফাইন্ডিংস হল, কুমারী মেয়ে কনসিভ করলেই তাদের মধ্যে নাকি একটা সুইসাইডাল আটিটিউট তৈরি হয়। আত্মহত্যার ইচ্ছে। জেঠিমার উচিত ছিল ছন্দার বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলা। সেই বেগারটাকে ধরে বিয়ে দিলেই হত। আমাদের জানালেও পারত। তখন ঘরের কেচ্ছা চাপতে গিয়ে এখন বড় ধরনের লস করে ফেলল।’ কথা শেষ করে বিনুকাকা লম্বা করে সিগারেটে টান দিল।
‘বিনুকাকা, তুমি একটু বেশি হার্ড হয়ে যাচ্ছ। এত শিয়োর হচ্ছ কী করে? ওসব তো না-ও হতে পারে। ধরো বয় ফ্রেন্ড বিট্রে করেছে বা অন্য কিছু।’
‘না হলে ভাল। ফ্যামিলিটা একটা বড় ধরনের কেলেঙ্কারি থেকে বেঁচে যাবে। যাক সে তো পোস্টমর্টেম করলেই বোঝা যাবে। তবে হার্ড ঘটনা হার্ড ভাবেই দেখা উচিত। কারণ নেই, অকারণ নেই, একটা মেয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে জ্বলে মরল সেটা নিশ্চয় আতুপুতু করে দেখার বিষয় নয়। কঠিন ঘটনা কঠিন ভাবেই দেখা উচিত। এই জন্যই বাঙালি জাতটার কিছু হয় না।’
মন্টুদা বলল, ‘ছন্দার কোনও পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোয়নি তো? কাকিমা কিছু বলতে পারছে না? আজকাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলেই ছেলেমেয়েরা টকাটক সুইসাইড করে। হয়তো প্রেম ফ্রেম কিছুই ছিল না। তাই না?’
এদের কথা শুনতে শুনতে আমার কেমন যেন লাগছে! তপন এত দেরি করছে কেন? ভেতরে কী হচ্ছে?
মন্টুদা বলল, ‘কী, চুপ করে আছেন যে, আপনি কী বলেন?’
আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘আমি? আমি তো কিছু জানি না। ইনফ্যাক্ট আমি মেয়েটিকে চিনিই না।’
বিনুকাকা ফোঁস করে একটা শব্দ করল। বলল, ‘রাবিশ! এখানে চেনা-না-চেনার কথা হচ্ছে না। একটা উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে ফট করে কেন সুইসাইড করবে তা নিয়ে একটা জেনারেল কথা হচ্ছে। তা ছাড়া আপনি চেনেন না তো কী হয়েছে? আমরা তো চিনতাম। তার বাবা-মা তো তাকে চিনত। আমরা কি কিছু বলতে পারছি? নাথিং, কিছুই বলতে পারছি না। চল মন্টু, বেরিয়ে একটা চায়ের দোকান টোকানের খোঁজ করি। আর তো পারা যাচ্ছে না। রাতের খাবারেরও একটা ধান্দা করে রাখতে হবে। আপনি যাবেন নাকি?’ আমি মাথা নাড়লাম।
মন্টুদা চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল, ‘আরে ব্রাদার, শোক আমাদের সকলেরই হয়েছে। একটা অল্প বয়েসের মেয়ের এরকম প্যাথিটিক ডেথ কার সহ্য হয় ? কারওই হয় না। কিন্তু আমাদের তো বাঁচতে হবে। হবে না? আপনি অত ভেঙে পড়ছেন কেন? গেট আপ। চলুন কিছু মুখে দিয়ে আসবেন। সারারাতের ব্যাপার।’ আমি আবার মাথা নাড়লাম। ওরা চলে গেল। আশ্চর্য তো! লোকটা বলল, আমার শোক! আমার কীসের শোক? চিনি না জানি না একটা মেয়ের জন্য আমার কেন শোক হবে?
ভেতর থেকে কান্নার শব্দটা আর আসছে না। যে কাঁদছিল সে নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বাগান থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসায় চমকে উঠলাম। রাত হয়ে গেল? চমকে ঘড়ি দেখলাম। মোটে সাড়ে ছ’টা! এখানে সাড়ে ছ’টাতেই ঝিঁঝিঁ ডাকছে! ঝিঁঝিঁর ডাক শুনলে মন খারাপ লাগে। আমারও কি লাগছে? সত্যিই তো ছন্দা নামের মেয়েটা মরতে গেল কেন? শুনেছি মনোবিজ্ঞানীদের তত্ত্ব হল, ওসব দুঃখ টুঃখ বাজে কথা। আত্মহত্যার আসল কারণ নাকি টেম্পোরারি ইনস্যানিটি। সাময়িক পাগলামি। ছন্দাও নিশ্চয় সাময়িকভাবে পাগল হয়ে গিয়েছিল। হয়তো গভীর কোনও দুঃখ থেকেই মেয়েটার মাথার গোলমাল হয়েছিল। আচ্ছা, মানুষ কি দুঃখতেই শুধু পাগল হয়? আনন্দে হয় না? তা হলে আমরা কেন বলি আনন্দে পাগল? মেয়েটার সেরকম কিছু হয়নি তো? হয়তো বড় কোনও আনন্দে মেয়েটা পাগল হয়ে গিয়েছিল। সেটাও তো টেম্পোরারি ইনস্যানিটি। দুর, এসব আমি কী ভাবছি? কেন ভাবছি? ছন্দা কেন সুইসাইড করল তাতে আমার কী? ওই লোকদুটো আমার মাথায় এসব ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। হোক, যা খুশি হোক। ছন্দা আনন্দে আত্মহত্যা করুক, দুঃখে আত্মহত্যা করুক, আমার কিছু এসে যায় না। আমি এখান থেকে পালাতে চাই।
আকাশের দিকে চোখ পড়তে দেখলাম, চাঁদ নেই, শুধু তারা। শীতের আগের আকাশে অজস্র ঝকঝকে তারা।
দরজার মুখে এসে তপন দাঁড়াল। বলল, ‘তাপস, একবার ঘরে আয়।’
আমাকে ভেতরে ডাকছে কেন? উফ, তপনটার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। আমি হলফ করে বলতে পারি, এই অজ পাড়াগাঁ থেকে ভবানীপুর যাওয়ার ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না। আর না। অনেক হয়েছে। তপন থাকুক, আমি একাই চলে যাব।
ঘরে ঢুকলাম। এসব বাড়িতে বসার জন্য আলাদা ঘর থাকে না। শোবার ঘরের একপাশে সস্তা ধরনের সোফা। একটা বেমানান বেতের টেবিল। ধুতি পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক সোফার এককোণে বসে আছেন। পাশে দু’জন মহিলা। একটা বাচ্চা লাল সিমেন্টের মেঝেতে বসে পুতুল ধরনের কিছু নিয়ে খেলছে। বাচ্চাটা মাঝেমধ্যে শব্দ করে হাসছে।
তপন বলল, ‘ন’কাকা, তুমি তাপসকে বলে। তাপস, তুই ওখানে পাশে বোস।’
ন’কাকা নামের ভদ্রলোক ভূমিকা ছাড়াই শুরু করলেন—‘তপনের কাছ থেকে আপনি তো সবই শুনেছেন। একটা সমস্যা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছেলের ফোন করেছিল। ফর্মালিটি সবই হয়ে গেছে তবু ওরা বডি ছাড়তে চাইছে না। বলছে, সুইসাইড কেসে এনকোয়ারি ছাড়া বডি ছাড়া অসম্ভব। লোকাল থানার ক্লিয়ারেন্স চাই।’
সামনে বসে থাকা ফরসা মহিলাটি বলল, -‘এনকোয়ারি তো হবেই। সেটা কি ঠেকানো যাবে?’
‘আঃ তপতী, আমরা কি বলেছি এনকোয়ারি হবে না? না, আমরা এনাকে বলেছি, আপনি এনকোয়ারিটা ঠেকান? তপন বলল, আপনার কোন এক রিলেটিভ নাকি পুলিশে কাজ করে। যদি তাকে একটা ফোনটোন করে ব্যাপারটাকে দ্রুত করিয়ে দিতে পারেন। ব্যস এই পর্যন্তই। আপনি তো বুঝতে পারছেন, এসব ক্ষেত্রে শ্মশানের কাজ যত তাড়াতাড়ি মিটে যায় তত ভাল। মাসিমা মেসোমশাই আর কতটাই বা সহ্য করবেন? বডি থাকা মানেই তো একটা মানসিক চাপ।’
তপতী নামের মহিলার পাশে যে-মেয়েটি বসে তার বয়স খানিকটা কম। সে চোখ কুঁচকে বলল, ‘তা ছাড়া ছন্দার শরীরটা কি আর শরীর আছে? ও টেলিফোনে বলছিল, শরীরটা এইটুকু আর কালো হয়ে গেছে, চোখগুলোতে শুধু…। ওফ, বীভৎসও দেখাচ্ছে। ও বার্ন ওয়ার্ডের বাইরে গিয়েই বমি করে ফেলেছে?’
তপতী নামের মহিলা নাকে কাপড় দিয়ে বলল, ‘মালা, তুই থামবি? চুপ করবি?’
তপন কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘ইস, মেয়েটা যে কেন এমন করল?’
ন’কাকা মাথা নামিয়ে খানিকটা আপন মনেই চুকচুক শব্দ করলেন। বললেন, ‘করল করল। হোয়াই সি চুজ দিস প্রসেস? পুড়ে মরার মতো একটা ভয়ংকর জিনিস সে কেন বাছল ? অন্য কত পদ্ধতি তো ছিল। উফ, আমার তো এখনও গোটা ব্যাপারটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। কী ধরনের পাগলামি মানুষকে এই দুর্বুদ্ধি দেয় বলুন দেখি।’
এসব শুনতে আমার ভাল লাগছে না, মনে হচ্ছে, এখনই ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। তপনের দিকে কাতর চোখে তাকালাম। তপন সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বলল, ‘তাপস, তুই প্লিজ একটু চেষ্টা কর। তোর ভোম্বলদা না কে যেন হেস্টিংস থানায় আছে বলেছিলি। তাঁকে একটা ফোন কর। তিনি যদি এখনকার থানায় একটু বলে দেন। মালা, ফোনটা পাশের ঘরে তো?’
‘আসুন।’
আমি যন্ত্রের মতো মালার সঙ্গে উঠলাম। আমি কেন যাচ্ছি? কেন শুনছি এদের কথা?
পাশের ঘরে যেতে যেতে টিনের দরজায় আওয়াজ পেলাম। মন্টুদারা বোধহয় চা খেয়ে ফিরল। বুড়ো মানুষটার গলা—‘কে, খোকন?’
ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াতে হল। খাটের ওপর যে-মহিলা বসে আছেন তিনি যে ছন্দার মা তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। আমি দেখেছি, নবজাতকের মায়ের শরীর থেকে এক ধরনের চাপা আলো বের হয়। চরম সুখ থেকে সেই আলোর জন্ম। এই আলো দেখলেই মাকে চেনা যায়। সন্তানের মৃত্যুতেও কি মা এরকম আলো পায়? নিশ্চয় পায়। নইলে এই মহিলার চারপাশে আলোর বলয় কেন? ঈশ্বর কি চরম শোকেও মানুষকে আলো দেন? দুঃখের আলো!
বাসি বিছানা এখনও তোলা হয়নি। ছড়ানো ছিটোনো বালিশ, মশারি। খাটের এককোণে হেলান দিয়ে মহিলা বসে আছেন। ঘরের কম পাওয়ারের বালবেও দেখা যাচ্ছে, তাঁর চোখ মুখ শক্ত। মেঝেতে একজন গুড়িসুড়ি মেরে বসে। বুড়ি ধরনের কেউ। অনেকটা ঘোমটা নামানো, মুখ দেখা যাচ্ছে না। মনে হয়, এ-বাড়ির কাজের লোক।
মালা গলা নামিয়ে বলল, মাসিমা, ইনি তপনদার বন্ধু। একটা ফোন করবেন।’
ছন্দার মা আমার দিকে সরাসরি তাকালেন। পৃথিবীর অনেক খারাপ জিনিস তাকিয়ে দেখা যায়, কিন্তু মৃতের মায়ের চোখের দিকে তাকানো যায় না। আমি তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিলাম। মহিলা কিন্তু স্বাভাবিক গলাতেই বললেন, ‘করুন, ওই যে টেলিফোন। গঙ্গার মা, ওনাকে মোড়াটা এগিয়ে দাও।’
মালা ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। মাথা নামিয়ে ডায়াল করছি আমি। হেস্টিংস থানার ফোন নম্বর আপ্রাণ মনে করার চেষ্টা করছি। মনে পড়ছে না। কোনও নম্বরই মনে পড়ছে না। মনে হচ্ছে ছন্দার মা একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখ তুলে তাকালাম। না, কেউ আমার দিকে তাকিয়ে নেই। তবু মনে হচ্ছে কেউ তাকিয়ে আছে। কেন আমার এমন হচ্ছে? আমি এদের কে ? কেউ নই। তবে আমার কেন এমন হবে?
মেঝেতে বসা মহিলা উ উ ধরনের শব্দ শুরু করল। সম্ভবত এই কান্নাই বাড়িতে ঢোকার সময় শুনেছি।
‘আঃ গঙ্গার মা, চুপ করো। চুপ করো বলছি।’
গঙ্গার মা চুপ করল।
মহিলা বললেন, ‘আপনি কি জানেন ওরা কখন আসবে?’
‘আমাকে বলছেন?’ আমি মুখ তুলে বললাম।
‘হ্যাঁ আপনাকে বলছি। ছন্দা কখন আসবে আপনি কি জানেন?’
আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। খুব শিগগিরই চলে আসবে।’
মহিলা যেন আমার কথায় অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন, ‘গঙ্গার মা, চন্দন বাটা হয়েছে? একই কথা কতবার বলতে হবে? যাও ও-ঘর থেকে কাউকে ডেকে দাও। আর আসার সময় কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করে আসবে খোকন মালা কিনে এনেছে কিনা। একটা কাজও এরা সময়মতো করতে পারলে হয়।’
আমার শরীরে শিরশির করছে। মনে হচ্ছে, পা দুটো পাথরের। আমি কোনওদিন এই পা নড়াতে পারব না। সারাজীবন আমাকে এখানে, এই মোড়ায় বসে থাকতে হবে। আমি ডায়াল না করেই ফিসফিস করে বলতে লাগলাম, ‘হ্যালো হেস্টিং থানা? হেস্টিং পুলিশ স্টেশন? হ্যালো, হ্যালো…’
থানার বড়বাবু সন্দেশের একপাশটা ভেঙে মুখে ফেললেন। বললেন, ‘সুগার নিয়ে মিষ্টি খাওয়া মানেই বিপদ। আবার লোভও সামলাতে পারি না। যাই হোক, আপনার মেয়ে কোনও চিঠিটিঠি লিখে গেছে? সুইসাইডাল নোট? এইসব কেস চিঠি না থাকলে খুবই ঝামেলা। কী, কোনও চিঠি পেয়েছেন?’ তপনের মামা অবাক হয়ে তাকালেন। যেন চিঠি শব্দটা উনি এই প্রথম শুনছেন।
মন্টুদা তাড়াতাড়ি বলল, ‘না বড়বাবু, ছন্দা কোনও চিঠি লেখেনি।’
চায়ে চুমুক দিয়ে বড়বাবু মন্টুদার দিকে চোখ কুঁচকে তাকালেন। বললেন, ‘লেখেনি? তা হলে তো সমস্যা হল।’ তারপর সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী করে বুঝলেন লেখেনি? ঘরটা ভাল করে দেখেছেন? শুধু তোষকের তলায় বা ড্রয়ারে দেখলে তো হবে না। এই বয়েসের মেয়েরা সুইসাইডাল নোট সাধারণত অড জায়গায় রাখে। সেসব অদ্ভুত জায়গা। অনেকবার এরকম হয়েছে। একবার তো মার্ডার বলে কেস চালু করে দিচ্ছিলাম বলে, তিনদিন পরে পোস্টে সেই চিঠি এল। এমনি চিঠি নয়, রেজিষ্ট্রি চিঠি। পিয়োন সই করিয়ে চিঠি দিয়ে গেল—আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। অ্যাঁ, ভাবুন কাণ্ডটা। ভাবুন একবার। তাই বলছিলাম, সব দেখে শুনে বলছেন তো।’
আমি অসহায় চোখে তপনের দিকে তাকালাম। আমি কী বলব? আমাকে কিছু জিজ্ঞেসা করবেন না। আমি এ-বাড়ির কেউ নই। আমি ছন্দাকে চিনি না।
আমাকে কিছু বলতে হল না। তার আগেই ন’কাকা বললেন, ‘আমরা ভাল করেই দেখেছি। তবু আপনারা যদি একবার দ্যাখেন। পুলিশের চোখ তো।’
‘দেখব বলছেন? তা অবশ্য দেখতে পারি। মেয়েটির ঘর ছাদে বললেন না? এইটাই তো ঝামেলা করেন। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের আইসোলেটেড থাকতে দেওয়াটাই বাপ-মা’র ভুল, মস্ত ভুল।’ এরপরই বড়বাবু ঝপ করে গলা নামিয়ে বললেন, ‘এবার চটপট গোলমালটা কী বলুন দেখি ? ঝেড়ে কাশুন। বাড়িতে ঝগড়াটগড়া হয়নি বলছেন, আবার কোনও বয় ফ্রেন্ডও ছিল না। তা হলে ঘটনা কী? কিছু ঘটনা নেই তা তো হয় না। ঘটনা একটা কিছু তো থাকবে। থাকবে না? দেখুন, পুলিশকে কিছু লুকোবেন না। আমরা গ্রিন সিগন্যাল না দিলে হাসপাতাল থেকে বডি ছাড়বে না। সারারাত আটকে থাকবে। আপনাদেরও কষ্ট, আমাদেরও ঝামেলা। তাই না? গলায় দড়ি বা পয়েজন কেস হলে এত কথা বলতাম না। কিন্তু পোড়া কে যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই ভাল। বড়ি খুব তাড়াতাড়ি পচতে শুরু হয় কিনা। জানেন তো।’ কথা শেষ করে বড়বাবু এমনভাবে নাক কুঁচকোলেন যেন পচা গন্ধ পাচ্ছেন।
এবার বিনুকাকা এগিয়ে এল। বলল, ‘জানি স্যার। আসুন আমি আপনাকে সবটা বলছি। আপনি যদি কষ্ট করে একটু বারান্দায় আসেন। বুঝতেই পারছেন, এ ধরনের ফ্যামিলি ম্যাটার সবার সামনে…!’ বড়বাবুর চোখদুটো জ্বলে উঠল। তিনি অল্প হেসে উঠে দাঁড়ালেন। বিনুকাকা বলল, ‘তপন, একটু এদিকে আয় তো। আমার মানিব্যাগটা আনিস, দ্যাখ, ওই টেবিলের ওপর রেখেছি বোধহয়।’
ঘরে কেউ নেই। আমি হাত-পা ছড়িয়ে সোফায় বসে আছি। ক্লান্ত লাগছে। মনের ক্লান্তিতে কি ঘুম পায় ? আমার পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোথাও শুয়ে পড়তে পারলে বেশ হত। ঘুমিয়ে নেওয়া যেত। এই খাটটা একটু শুলে কি এরা আপত্তি করবে? খুব ইচ্ছে করছে শুই। এখন আর নিজেকে তেমন বাইরের লোক বলে মনে হচ্ছে না! এখন এ-বাড়ি অনেকেই আমাকে তুমি তুমি করে বলছে।
পাশের ঘর থেকে নাকি স্বরে আওয়াজ আসছে উ উ উ। নিশ্চয় গঙ্গার মা। ওর কি চন্দন বাটা হয়েছে?
পিঠে হাত পড়তে চমকে উঠলাম। তপন। তপন ফিসফিস করে বলল, ‘তাপস, চল, আটটা বাজে। চল এবার চলে যাই। তোর সময় হয়ে গেছে। থানার প্রবলেম মিটে গেছে। বডি এলে আটকে যাব। অসীমদার গাড়ি কলকাতায় যাচ্ছে।’
‘অসীমদা কে?’
‘আমার পিসতুতো দাদা হয়। বউদিও এসেছে। অসীমদার অফিসের কার যেন বিয়ে, অ্যাটেন করতে হবে। আমি তোর ইন্টারভিউয়ের কথা বললাম, এসপ্লানেডে আমাদের ড্রপ করে দেবে। ভাল হবে না?’
খানিকটা অন্যমনস্কভাবেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘হ্যাঁ, খুব ভাল হবে।’
বাইরে এসে দেখি বাড়াবাড়ি রকমের চাঁদ উঠেছে। এই ভাঙাচোরা, আধো অন্ধকার বাড়ি, এক চিলতে জঙ্গল। বাগান চাঁদের আলোয় ভাসছে। প্রকৃতির এ এক অদ্ভুত আচরণ! সে যেমন আনন্দে তার সৌন্দর্য ঢেলে দেয়, তেমনি শোকের জায়গাতেও নিজেকে উজাড় করে।
ছন্দার মৃতদেহ আসতে বোধহয় আর দেরি নেই। বাড়িতে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। গেটের কাছে তার টেনে কে যেন একটা বালব ঝুলিয়ে দিল। মৃতদেহ বরণের আয়োজন। এদের আরও কয়েকজন আত্মীয় এসে পৌঁছেছে দেখছি। কোট পরা একজন খুব ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘এই যে তুমি এসে গেছ? বি টি রোডে এমন আটকে গেলাম। লরি ট্রাক। বিচ্ছিরি ব্যাপার। এ-দেশে একটা সরকার আছে বলে মনেই হয় না। নো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন।’
নিঃশব্দ বাড়িতে একটু-আধটু কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। জোরে কান্না নয়, ফোঁপানি ধরানের কান্না। কে জানে, হয়তো আত্মহত্যার বাড়িতে প্রাণ খুলে কাঁদতে নেই। বারান্দাতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকজন দাঁড়িয়ে। কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে পাড়া প্রতিবেশী। ডেডবডি আসছে শুনে এসেছে। ফ্ৰকপরা একটা ছোট মেয়ে ফিসফিস করে উঠল, ‘মা, বাড়ি যাব, আমার ভয় করছে।’ কে একজন গম্ভীর গলায় বলল, ‘ছন্দার ঘরের আলোটা কেউ জ্বালিয়ে দাও।’ গলা শুনে মনে হল ন’কাকা।
গেটের পাশের বেঞ্চেতে বুড়ো মানুষটা এখনও মাথা নামিয়ে বসে আছে। তপন পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মামা, আমি যাচ্ছি। দেখি কাল পরশু পারলে মাকে নিয়ে আসব।’ বুড়ো মানুষটা চোখ তুলে তপনের দিকে তাকাল। বলল, ‘ও।’
আমি একটু এগিয়ে গেলাম। মাথা নামিয়ে বললাম, ‘মামা, খোকন কি মালা নিয়ে এসেছে?’
মানুষটা বিহ্বল চোখে তাকাল। বলল, ‘কই না তো? খোকন তো এখনও আসেনি, এদিকে মেয়েটার আসার সময় হয়ে গেল। দ্যাখো দেখি কাণ্ড।’
আমি বললাম, ‘চিন্তা করবেন না, ও নিশ্চয় ঠিকসময় এসে যাবে। মালাও আনবে।’
তপন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বললাম, ‘চল, গাড়ি কোনদিকে?’
ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে তপনের অসীমদা সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ির ভেতর এসি চলছে, কিন্তু তাতে গাড়ির লাফালাফি কমছে না। তপন আর অসীমদার স্ত্রী পেছনে বসেছে। আমি সামনে। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর তপন বলল, ‘বউদি, ছন্দার ব্যাপারটা কিছু জানতে পারলে?’
মহিলা জিভ দিয়ে একটা আপশোসের শব্দ করল। বলল, ‘না রে! ইস মেয়েটা যে কী করল। সকালবেলাও নাকি হারমোনিয়ম বের করে গান করেছে। দুপুরে কাকিমাকে বলল, মা, আজ কলেজ যাব না। গা ম্যাজম্যাজ করছে। কাকিমা বলল, থাক তা হলে যাসনি। আজ ভাত খেয়ে কাজ নেই, গঙ্গার মাকে বল ক’টা রুটি করে দিক। ছন্দা বলল, না ভাতই খাব। ভাত খেয়ে ওপরে গেল। এর মধ্যে কখন যে কেরোসিনের টিনটা নিয়েছে। যখন দরজা ভাঙা হয়, তখনও নাকি ঘরে রেডিয়ো খোলা, এফ এম চলছে! ভাবতে পারো? প্রেমের কথাটাও আমরা একদম ভুল ভাবছিলাম। ক’দিন আগেই কাকিমা নাকি ছন্দার কাছে বিয়ের কথাও তুলেছিল। কই ছন্দা তো আপত্তি করেনি ? বরং খানিটা নিমরাজিই হয়েছিল। তা হলে? প্রেম করলে তো তখনই বলত। কেউ কিছু জানতেই পারল না। কাকিমার জন্য খারাপ লাগছে।’
অসীমা বড় রাস্তার ওপর গাড়িটা তুলে বলল, ‘আমি জানি’।
‘কী জানো?’
‘সবই জানি। জানি মেয়েটা কেন সুইসাইড করল। আমি তো ও-বাড়িতে পা দিয়েই বুঝে গেছি।’
কথা থামিয়ে অসীমদা রাস্তার একপাশে সাবধানে গাড়িটাকে দাঁড় করাল। তার স্ত্রী পেছনের আসন থেকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘কী বুঝলে তুমি?’ অসীমদা হেসে বলল, ‘দাঁড়াও, অনেকক্ষণ সিগারেট খাইনি। প্যাকেটটাও দেখছি শেষ। সিগারেট কিনে এনে বলছি।’
আমি বললাম, ‘দাঁড়ান, আপনাকে নামতে হবে না। আমি নিয়ে আসছি।’
অসীমদা বলল, ‘তুমি নিয়ে আসবে? আচ্ছা যাও। তপন বলছিল, আজ তোমার নাকি একটা গুড ডে। ভাল দিন। চাকরি ফাইনাল হবে। ভেরি গুড। আজকালকার দিনে চাকরি পাওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। কোথায় যেন তোমার অ্যাপয়নমেন্ট, টালিগঞ্জে?’
‘না, ভবানীপুর।’
‘ঠিক আছে তোমাকে ভবানীপুরেই ছেড়ে দেব।’
তপন হেসে বলল, ‘খুব ভাল হয় অসীমদা। তাপসটা যা টেনশন করছিল। খালি বলছিল, দেরি হয়ে যাবে, দেরি হয়ে যাবে। কী রে তাপস, এবার তুই নিশ্চিন্ত তো?’
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, ‘হ্যাঁ, নিশ্চিন্ত। ধন্যবাদ অসীমদা।’
অসীমদা হাত তুলে বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। যাও চট করে সিগারেটটা নিয়ে এসো দেখি। তুমি এলে ছন্দার কেসটা বুঝিয়ে বলছি। উই শ্যাল ওয়েট ফর ইউ।’
তপন বলল, ‘আমি নামব তাপস?’
‘কোনও দরকার নেই। এই তো দোকান। তারা বোস, একছুটে আসছি।’
ধীরে সুস্থে আমি নামলাম। এই সুযোগটাই খুঁজছিলাম। অসীমা লোকটা মিথ্যে কথা বলছে। ডাহা মিথ্যে কথা। ছন্দার আত্মহত্যার কারণ ও কিছুই জানে না। কেউই কিছু জানে না। সব সুখ দুঃখ অভিমানের কথা জানা যায় না। তবু জানবার জন্য মানুষ সারাজীবন হাতড়ে বেড়ায়। বারবার ব্যর্থ হয়।
গাড়ি থেকে সামান্য দূরে গিয়ে রাস্তা পেরোলাম। আরও একটু সরতে হবে আমাকে। এই যে ভিড়টা, ওখানে মিশে যেতে হবে। তপনরা যেন দেখতে না পায়। গাড়ি, রিকশা আড়াল করে একবার ভাঙা রাস্তাটায় ঢুকে পড়তে পারলেই নিশ্চিন্ত। তারপর পুকুরের ধার দিয়ে চলে যাব। রাস্তা চিনে রেখেছি।
একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, এখানে ফুলের মালা কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারেন?’