ভূত
কারও গলার আওয়াজ যদি নাকি হয় সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তার নাম হয় ‘নেকো’। ছোটবেলায় বন্ধুরা সামনেই ‘নেকো’ নামে ডাকে। বড় হয়ে গেলেও ডাকে। তখন সামনে ডাকে না, আড়ালে ডাকে। সামনে ডাকলেও অবশ্য মুকুন্দর কিছু এসে যেত না। শিশুকাল থেকে যে এই তামাশায় অভ্যস্ত, সাঁইত্রিশ বছর বয়সে তার আর কিছু মনে হয় না।
রবিবার দুপুরে এই ‘নেকো’ মুকুন্দ পাইকের টালির ছাদ এবং কঞ্চির বেড়া দেওয়া জরাজীর্ণ বাড়ির সামনে যখন হালকা সবুজ রঙের একটা মারুতি জেন গাড়ি এসে দাঁড়াল তখন পাড়ার লোকেরা কিছুটা অবাকই হল।
মুকুন্দ গাড়ি দেখেনি। সে রান্না করছিল। খুবই ছোট আয়োজন। ডালসেদ্ধ, ভাত এবং শিম-বেগুনের একটা তরকারি। কিন্তু এইটুকু সারতেই তার বেলা গড়িয়ে যায়। যাওয়ারই কথা। মুকুন্দ বাজারে যায় বাজার ভেঙে যাওয়ার পর। এই সময়টা হল সাশ্রয়ের সময়। এই সময় একটু ঘোরাঘুরি করলে শুকনো শিম, কানা বেগুন, পোকা-লাগা কুমড়ো একেবারে জলের দর মেলে। সেসব এনে রান্না বসাতে বসাতে একা মানুষের তো একটু সময় লাগবেই। তা লাগুক। ক্ষতি তো কিছু নেই। তাড়া কীসের? মুকুন্দকে তো আর কাজকর্মে বেরোতে হচ্ছে না। বরং বেলার দিকে ভাত খেলে লাভ আছে। সেই ভাত রাত পর্যন্ত পেটে গজগজ করে। আজ স্টোভে হাঁড়ি বসানোর পর দেখা গেল, কৌটোতে চালের পরিমাণ খুব কম। আধপেটাও হবে কিনা সন্দেহ। হাঁড়ি নামিয়ে, স্টোভ নিভিয়ে মুকুন্দ তাই ভাবতে বসেছে। ভাতের বদলে কিছু আছে কি?
এমন সময় দরজায় শব্দ। দরজা খুলতে হল না। ছিটকিনি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে গত তিন মাস এই দরজা আটকানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। সারাদিন খোলাই থাকে। রাতে মুকুন্দ টেবিলটা দরজার গায়ে ঠেলে দেয়।
ঘরে ঢুকল নিতাই। নিতাই এ-পাড়ার ছেলে। মুকুন্দর সঙ্গে পথেঘাটে দেখা হয়। সঙ্গের মানুষটা অচেনা। লোকটার নীল শার্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোন উঁকি দিচ্ছে। ফুরফুরে একটা গন্ধ। বোধহয় পারফিউমের।
এ-ঘরে বসবার আলাদা কোনও জায়গা নেই। বিছানা গুটিয়ে শোওয়ার তক্তাপোশই বসার চেয়ার। নিতাই নিজেই সেসব সরিয়ে নিল। নীল শার্টকে বলল, ‘বসুন বিমলদা। এই যে এঁর কথাই বলছিলাম। ইনিই মুকুন্দদা। আর মুকুন্দদা, এই হল বিমলদা। খুব বড় ডেভলাপার কাম প্রোমোটার। এখনই হাতে ছাব্বিশটা বিল্ডিং।’
মুকুন্দ কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘আপনাদের যে কোথায় বসতে দিই।’
নীল শার্ট একটু হাসল তারপর তক্তাপোশের ওপর বসল। ভাবটা এমন যেন সে তক্তাপোশে বসেই অভ্যস্ত। মুকুন্দ দেখেছে, বড়লোকদের এই একটা ব্যাপার, তারা চট করে গরিব সেজে যেতে পারে।
নিতাই বলল, ‘কাজের কথাটা সেরে ফেলো বিমলদা। তোমাকে তো সাইটে যেতে হবে।’
নীল শার্ট খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল, নিতাই উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। নীল শার্ট তারপর মুকুন্দের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, ‘আপনি বসুন মুকুন্দবাবু। আমার বলতে একটু সময় লাগবে।’
মুকুন্দ নড়বড়ে টুলটা টেনে নিয়ে বসল। নীল শার্ট বলতে শুরু করল, ‘দেখুন ভাই, কাজটা একটু অদ্ভুত, আর ভয়ংকর গোপনীয়। তা ছাড়া সবাইকে দিয়ে হবে না। একটা স্পেশালাইজেশনের দরকার। আমরা লোক খুঁজছিলাম, নিতাই আপনার কথা বলল।’
নিতাই বসেনি। সে দাঁড়িয়ে আছে। হাসিহাসি মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি বলেছি। এখন বলুন দাদা, আমি কি ভুল বলেছি?’
নীল শার্ট বলল, ‘না, তুমি ভুল বলোনি। ঠিক লোকের কাছেই এনেছ দেখছি। হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম মুকুন্দবাবু, এক বছর হল জগৎপুরে আমি একটা বড় প্রোজেক্টে হাত নিতে চলেছি। হাউজিং কমপ্লেক্স। রেল স্টেশন থেকে একটু দূরে। এই ধরুন টেন মিনিটস ড্রাইভ। একসঙ্গে দেড়শো ফ্ল্যাট। আমার কমপ্লেক্সটা যেখানে হচ্ছে মূলত সেটা ফাঁকা জমি, একটু জলা মতো। তবে কয়েকটা বাড়িও আছে। বেশি নয়, ছড়ানো ছিটানো দশ-পনেরোটা বাড়ি। সামান্য এদিক ওদিক হতে পারে। কিন্তু বাড়িগুলোর এমন পজিশন যে ক্লিয়ার না করলে প্রজেক্টটা হবে না। সবই ক্লিয়ার করে ফেলেছি।’
নীল শার্ট থামল। পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বের করে হাতে একটা নিল, কিন্তু সিগারেট ধরাল না। আবার বলতে শুরু করল, ‘ট্রাবল দিচ্ছে একটা ফ্যামিলি। ফ্যামিলি মানে বুড়ো-বুড়ি, তাদের মেয়ে আর একটা বাচ্চা ছেলে। মেয়েটাই এখন বাড়ির সব। মালিক বলতে যা বোঝায়। দু’বছর হল ওর স্বামী বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। শুনেছি, লোকটা লং ডিসট্যান্সে বাস চালাত। মদফদ খেয়েছিল নাকি কে জানে, একদিন খাদে পড়ে যায়। স্পট ডেড। শ্বশুরবাড়িটাড়ি কিছু নেই বোধহয়। আগেও নাকি মেয়েটা বাপের বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় কাটাত। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলের হাত ধরে পাকাপাকিভাবে বাপ-মায়ের ঘাড়ে এসে উঠেছে। টাকাফাকা কিচ্ছু খাচ্ছে না। সব টেকনিক অ্যাপ্লাই করেছি। এল আই জি লেভেলের একটা ফ্ল্যাট পর্যন্ত অফার করেছি। এমনকী যা কাউকে আমি বলি না তাই পর্যন্ত বলেছিলাম। বলেছিলাম, একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেব। কিছুই শুনছে না। বাড়ি আঁকড়ে বসে আছে। বলছে এ-বাড়িতে নাকি ওর মরা স্বামীর স্মৃতি আছে। এ-বাড়ি ছেড়ে ও যাবে না। মেয়েছেলের ব্যাপার, গুন্ডা বদমাইশ দিয়ে হবে না। কমপ্লেক্সের গুড উইল নষ্ট করা চলবে না। কিন্তু বাড়িটা না ভাঙলেই নয়। এটা হবে আমার কমপ্লেক্সের এন্ট্রান্স। ঢোকার মুখ।’
মুকুন্দ অবাক হল। বলল, ‘আমি এ ব্যাপারে আপনাদের কীভাবে সাহায্য করব! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
নীল শার্ট সিগারেট ধরাল। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘বুঝতে পারবেন। আমি বললেই বুঝতে পারবেন। ফ্যামিলিটাকে ভূতের ভয় দেখাতে হবে মুকুন্দবাবু। আপনিই একমাত্র যিনি কাজটা পারবেন। আপনাকে কাজটা করতে হবে।’
‘আমাকে!’
‘হ্যাঁ, আপনাকে। ওই মাগির কত সাহস আমি দেখতে চাই। ও আমার পায়ে এসে পড়বে। তখন আমি জলের থেকে সস্তায় ও-বাড়ি নিয়ে নেব।’
নীল শার্ট উত্তেজনায় কি একটু কাঁপছে? লোকটা বলে কী? তাকে কি ভূতের মতো দেখতে? নাকি রং টং মেখে ওই বাড়ির সামনে গিয়ে নাচতে হবে? যাত্রা কোম্পানি থেকে লোক ভাড়া করে আনলেই হয়। তারা রাজার পার্ট করে। ভূতের পার্টও নিশ্চয় পারবে। সে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, আমি এসব পারব না। আমি কখনও অভিনয় করিনি। ভূত সাজা তো দূরের কথা, আমাকে ভাল করে একটা মানুষ সাজতে বললেও পারব না। নিতাই আমাকে ছেড়ে দাও।’
নিতাই হেসে উঠল। বলল, ‘আরে দুর মুকুন্দদা, কে তোমাকে ভূত সাজতে বলেছে? বিমলদা কি সেকথা বলল? আগে কথাটা পুরো শুনবে তো। এনারা তোমার গলাটা একটু ইউজ করতে চাইছেন। কিছু মনে কোরো না মুকুন্দদা, এতদিন তুমি তোমার খোনা গলাটা একটা কাজে লাগানোর চান্স পেয়ে গেলে।’
নীল শার্ট ঠান্ডা গলায় বলল, ‘চুপ কর নিতাই। হ্যাঁ, আপনার গলাটা আমার কয়েকদিনের জন্য চাই। আমি একটা গলা খুঁজছিলাম যেটা একটু ন্যাজাল হবে। নাকি গলায় একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়। হঠাৎই প্ল্যানটা আমার মাথায় এসেছে। কিন্তু কাউকে দিয়ে বানিয়ে করালে চলবে না। একদিন দু’দিনের মাথায় জিনিসটা যদি ফেল করে সবটা ভেস্তে যাবে। অত কোটি টাকার প্রোজেক্ট একটা কোয়েশ্চেন মার্কের সামনে এসে দাঁড়াৰে। ব্যাপারটা আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন? প্লিজ আপনি না বলবেন না। আমি ভাল অ্যামাউন্ট দেব। খুবই ভাল। আপনি ভাবতেও পারছেন না। আর আমার তো মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে আপনার সত্যিই কিছু টাকার দরকার।’
টাকার কথা শুনে মুকুন্দ একটু থমকে গেল। কথাটা ঠিকই। এই মুহূর্তে কিছু টাকা হলে খারাপ হয় না। ভালই হয়। ভাঁড়ার ফুরিয়ে আসছে। খুব তাড়াহুড়ো থাকলে ঘোষরা ওদের কারখানায় খাতা লেখার জন্য ডাকে। তখন কিছু পাওয়া যায়। সেও আজ তিন মাস হয় ডাক আসেনি। হাত একেবারেই ফাঁকা। দরজার ছিটকিনিটা সারাতে হবে। সব থেকে বড় কথা হল, কাজটা ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। ছোটবেলা থেকে যে-গালাটার জন্য অন্যদের হাসির পাত্র হতে হয়েছে সেটা কাজে লাগলে খারাপ কী? হাসানোর গলা দিয়ে ভয় পাওয়ানো! অপমানের একটা প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
‘আমাকে কী করতে হবে? দেখুন আমার কিন্তু ভয় করছে। ঝামেলায় পড়ব না তো?’
নীল শার্ট উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। মুকুন্দর কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ভেরি গুড। আপনার কোনও ঝামেলা নেই। আমার সব প্ল্যানই় ছকা হয়ে গেছে। ওই বুড়োর বাড়ির গায়ে আমার একটা ফ্ল্যাট হাফ ডান হয়ে পড়ে আছে। আদ্দেক হয়েছে। আপনি রোজ রাতে সেখানে যাবেন। এই ধরুন এগারোটা নাগাদ ঢুকে গেলেন। তারপর দেড়টা-দুটো নাগাদ চারতলার জানলা বা বারান্দা থেকে মুখ বের করে আপনার নাকি সুরে একটা হাঁক দেবেন। ব্যস, একবারই, দু’বার নয়। হাঁক শুনে যদি ওরা সাহস করে বেরিয়েও আসে ক্ষতি নেই। আপনাকে দেখতে পাচ্ছে না। ভোর চারটে নাগাদ আমার লরি ওখানে মাল ফেলে বেরিয়ে আসে। আলো ফোটার আগেই আপনি সেটায় উঠে জগৎপুর ছেড়ে চলে আসছেন। রোজ রাতে আমার গাড়ি আপনাকে কমপ্লেক্সের একটু দূরে ছেড়ে দিয়ে আসবে। নো রিস্ক। ঝামেলার কোনও ব্যাপারই নেই।’
‘ওই যে হাঁক পাড়তে হবে বললেন, সেটা কী হবে কিছু ঠিক করেছেন?’
‘ঠিক করেছি। ডায়লগ একটাই। আপনাকে এখনই দিয়ে যাচ্ছি। আপনি ক’দিন প্র্যাকটিস করুন। একেবারে মোক্ষম ডায়ালগ। অনেক খোঁজখবর নিয়ে তৈরি করেছি। মেয়েটার মধ্যে একটা সেন্টিমেন্টাল ফিয়ারসাইকোসিস ঢোকাতে চাইছি।’
‘সেটা কী ব্যাপার?’
‘শুনতে শক্ত লাগছে তো? ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই শক্ত কিছু নয়। আমাদের ডায়ালগটা এমন হবে যাতে মেয়েটা যখন যুক্তি দিয়ে ভয়টাকে এড়াতে যাবে তখন সেন্টিমেন্টালি আঘাত পাবে।’
মুকুল বলল, ‘বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কোনও হুমকি টুমকি?’
নীল শার্ট আবার সিগারেট ধরাল। বলল, ‘খেপেছেন? তা হলে একদিনেই কট হয়ে যাবে। ও লাইনেই নয়। মেয়েটার নাম কুসুম। আপনাকে ওর মরা স্বামীর রোল প্লে করতে হবে। ঠিক রোল নয়, একটা ছোট্ট কথা। যেন ঠিক মরার সময় লোকটা বলছে। বলছে, উফ, কুসুম, কী কষ্ট! আবার বলছি ভাল করে শুনে নিন, সেরকম বুঝলে লিখে নিতে পারেন।’
নিতাই পকেট থেকে কলম বের করল, ‘লিখেই নাও না বাবা।’
মুকুন্দ বলল, ‘থাক লাগবে না। আপনি আর একবার বলুন।’
‘উফ, কুসুম, কী কষ্ট! বলার ধরনটা হবে একটু কাতরানি গোছের। অ্যাক্সিডেন্টে মরেছে তো। মনে থাকবে? ভেরি গুড। আপনি বেশি ন্যাজাল করতে যাবেন না। দেখবেন যেন বানানো মনে না হয়। আপনার যতটা নরমাল ততটাই চলবে। কখনওই দু’বার করবেন না। যদি কোনওদিন মনে হয়, হাঁকটা ঠিক হল না, হারামজাদাদের বন্ধ জানলা দিয়ে কথাটা ঢুকল না, চিন্তা করবেন না। তা হলে সেদিনের মতো চেপে যাবেন। আমি তাড়া চাইছি না। আমি চাইছি ভয়টা ওদের ভেতর চেপে বসুক। মনে থাকবে?’
‘মনে থাকবে। একটা কথা বলব?’
‘বলুন।’
‘মেয়েটা ওর স্বামীর গলা চিনতে পারবে না এটা ভাবছেন কেন? আমার গলা তো সেই লোকটার মতো নয়।’
‘না, আমি সেরকম কিছু ভাবছি না। এটা একটা হ্যালুসিনেশনের মতো কাজ করবে। হ্যালুসিনেশন কী বোঝেন? থাক, আপনার বুঝে কাজ নেই। প্রথমদিকে মেয়েটা বুঝবে এ কণ্ঠস্বর ওর স্বামীর নয়। তারপর ভাল করে শোনার চেষ্টা করবে। রাতে জেগে অপেক্ষা করবে। বহুবার শোনার পর ওর মধ্যে একটা বিশ্বাস জন্মাবে। ওর স্বামীর আসল গলাটা আস্তে আস্তে গুলিয়ে ফেলবে। আপনারটাই সত্যি বলে মনে হতে শুরু করবে। আর তখনই ভীষণ ভয় পেয়ে যাবে। গোটা ফ্যামিলিটা আতঙ্কে ছটফট করবে। আতঙ্ক, আর একই সঙ্গে সেন্টিমেন্ট। মরা মানুষের জন্য দুঃখ। থাক আপনার বেশি বুঝে দরকার নেই, আপনি শুধু আপনার কাজটা করুন।’ এবার নীল শার্ট একটা খাম বের করল। বলল, ‘এই নিন মুকুন্দবাবু, এখন দু’হাজার রইল। ঝামেলার না হলেও কাজটা শক্ত। রাত জাগাফাগার একটা কষ্ট তো আছে। আরও দেব। আপাতত এটা নিয়েই শুরু করুন। আচ্ছা আরও পাঁচশো রাখুন। তবে হ্যাঁ, আমি ধরে নিচ্ছি না, কাজটা সাকসেসফুল হবেই, না-ও হতে পারে। আমি একটা চান্স নিচ্ছি। না হলে আবার অন্য কিছু ভাবতে হবে। আপনি সাবধানে থাকবেন। কমপ্লেক্সে ঢুকে অন্যদের সঙ্গে যত কম পারবেন কথা বলবেন। পারলে একেবারেই বলবেন না। আপনার গলাটা জানাজানি হলে কাজটা ভেস্তে যাবে।’
ওরা চলে যেতে তক্তাপোশটার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল মুকুন্দ। আজ আর রান্নাবান্নার দরকার নেই। খিদেটা নষ্ট হয়ে গেছে। নিতাই কলমটা তক্তাপোশের ওপরই ফেলে গেছে। মুকুন্দ উঠে বসে টাকার খামটার ওপর বড় বড় করে লিখল, উফ, কুসুম, কী কষ্ট!
২
জগৎপুরের নিজের কোনও থানা নেই। তার আছে ফাঁড়ি। ফাঁড়ি হল পুলিশ বিভাগের সৎ ছেলে। একেবারে যত্নআত্তি নেই। তাকে বেঁচে থাকতে হয় খুবই হেলাফেলার মধ্যে। এখানে পুলিশ কম থাকে, লকআপের ভেতর জানলার গ্রিল এমন নিচুর দিকে হয় যে খুব সহজেই আসামি গলায় লুঙ্গি বেঁধে ঝুলে পড়তে পারে। ফাঁড়িতে কখনওই বন্দুক জাতীয় কিছু পাঠানো হয় না। যদি না ভুল করে দু’-একটা চলে আসে তা হলে তার গুলি আসে না।
জগৎপুর ফাঁড়ি আবার এক কাঠি ওপরে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এখানকার লাঠিগুলো পর্যন্ত কোনও এক রহস্যময় কারণে ফাঁপা। মারলে ঠং ঠং শব্দ হয়।
ফাঁড়ির বড়বাবু রমাকান্তবাবু শান্তিপ্রিয় ধরনের মানুষ। আর সেই কারণেই বোধহয় তাঁর ঘাড়ে যত অশান্তি চাপে। যেমন আজ সকাল থেকে তিনি খুবই চিন্তিত। চিন্তিত হবারই কথা। হাবিলদাররা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, ফাঁপা লাঠি নিয়ে তারা ডিউটিতে যেতে পারবে না। তাতে যে-শাস্তি হয় হোক। দু’ঘা মারার পর যদি লাঠি ভেঙে যায় তা হলে যা অপমান তার থেকে শাস্তি ঢের ভাল। শাস্তি মাথা পেতে নেওয়া যায়, কিন্তু অপমান নেওয়া যায় না। হেড কোয়ার্টারে রমাকান্তবাবু এ ব্যাপারে বিশদ একটা মেসেজ পাঠিয়েছেন। মেসেজ পেলেই যে হেডকোয়ার্টার জামাই আদর করে লাঠি পাঠাবে সেরকম ভাববার কোনও কারণ নেই। আগেও একবার এরকম হয়েছিল। লাঠি কম পড়েছিল। সেবার বলা হল, দুঃখিত, বাজেটে লাঠি খাতে এবার কোনও অ্যালোকেশন নেই, কম্পিউটারের পেছনে অনেক টাকা চলে গেছে। সুতরাং যা আছে তাই যেন ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। অদ্ভুত কথা, লাঠির অভাবে কাজ বন্ধ করে দিতে হবে!
এরকম দুশ্চিন্তার সময় হাবিলদার ঘরে ঢুকল। সঙ্গে এক মহিলা। হাবিলদার বলল, ‘স্যার, ইনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’
রমাকান্তবাবু মুখ না তুলে বললেন, ‘আজ কোনও কথা হবে না। নো টক।’
‘না, আজই হবে। আমি বেশি সময় নেব না।’
রমাকান্তবাবু মুখ তুলে দেখলেন মেয়েটি চেয়ার টেনে বসে পড়েছে। হালকা সবুজ শাড়ি পরেছে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের বেশি হবে না। কালোর ওপর বেশ দেখতে। মুখে একটা দুঃখ দুঃখ ভাব। নরমসরমই মনে হচ্ছে। রমাকান্তবাবু সতর্ক হলেন। যে-মেয়ের মুখ দেখে শান্তশিষ্ট মনে হয়, সেই-ই বেশি গোলমাল পাকায়। আচ্ছা ফ্যাকড়া তো। মেয়েরা ইদানীং থানায় এসে খুব ঝামেলা পাকায়। এও নিশ্চয় পাকাবে। কে জানে হয়তো আঁচলের তলায় লুকিয়ে ঝাঁটাও এনেছে। শালার চাকরি! মাঝেমধ্যে মনে হয় লাথি মেরে চলে যাই। অনেক হয়েছে পুলিশগিরি, আর নয়।
‘আমার নাম কুসুম। কুসুম পাল। স্বামীর নাম স্বর্গীয় দীনেশ পাল। বাড়ি জগৎপুরেই। এই যে নতুন হাউজিং কমপ্লেক্সটা হচ্ছে না? ওখানে। আমি কি আমার সমস্যাটা বলব?
রমাকান্তবাবু হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, ‘বলুন। তবে সংক্ষেপে বলুন।’
কুসুম খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার সমস্যা বলে ফেলল। বলা শেষ হলে রমাকান্তবাবু সোজা হয়ে বসলেন। ঘণ্টা বাজিয়ে হাবিলদারকে ডাকলেন। ঘণ্টা বাজল না। ঘণ্টা এক সপ্তাহ হল খারাপ।
‘কুসুমদেবী, আপনি ঘটনাটা আবার বলুন। প্রথমবার যেগুলো বাদ গেছে সেগুলো মনে করার চেষ্টা করুন। আমি ডিটেলসে শুনতে চাই।’
কুসুম আবার শুরু করল, ‘সতেরোদিন আগে প্রথম শুনতে পেলাম। আমার ছেলে বাপ্পা পেচ্ছাপ করতে উঠেছিল। আমাকে ডাকল। তখন ক’টা বাজে, এই দুটো-আড়াইটে হবে! বাপ্পা এসে শুয়ে পড়ল। আমি জল খেতে উঠোনে গেলাম।’
রামাকান্তবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘জল খেতে উঠোনে কেন?’
কুসুম বলল, ‘আমাদের জলের জালাটা উঠোনের এক কোনায় থাকে। বাবামা-ও রাতে তেষ্টা পেলে খায়।’
রমাকান্তবাবু বললেন, ‘সেখানে আলো আছে?’
কুসুম বলল, ‘না, আলো নেই। তবে ঘরের দরজা খুললে আলো এসে পড়ে। আমি সবে জল খেয়ে ঘরের দরজা আটকাতে যাব এমন সময় শুনলাম। উত্তরের মাঠের দিক থেকে যেন গলাটা ভেসে এল। কে যেন বলে উঠল, উফ, কুসুম, কী কষ্ট! একটু যেন নাকি সুরে। সর্দিটর্দি হলে যেমন হয় সেরকম। আমি দরজাটা খুলে আবার উঠোনে এসে দাঁড়ালাম।’
রমাকান্তবাবু সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘আবার শুনলেন?’
এবার কুসুম চেয়ারে হেলান দিল। বলল, ‘না। আর শুনলাম না।’
‘ভাল করে ভেবে বলুন। চা খাবেন?’
‘না, আর শুনলাম না। আমি ভাবলাম, মনের ভুল বোধহয়। দরজা আটকে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কিছু শুনেছে কিনা। বাবা বলল, না, ওরা শোনেনি। সেদিন রাতে ফের ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, ঘুমের মধ্যেই যেন শুনলাম।’
রমাকান্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী শুনলেন?’
কুসুম বলল, ‘একই কথা। উফ, কুসুম, কী কষ্ট! আমি আলো জ্বেলে তাকের ওপর ঘড়িটা দেখলাম। দেড়টা বাজে। মানে একটা চল্লিশ। এই ঘড়িটা দশ মিনিট স্লো। পরের দিন সকালে মা বলল, খুকু, রাতে একটা অদ্ভুত জিনিস শুনলাম। মনে হল তোর নাম ধরে কেউ ডাকছে। ঠিক ডাকল না, কী যেন বলল। তোর বাবাকে ডাকলাম। উঠল না। সেদিন রাতে আমি জেগে থাকলাম। বাপ্পা বলল, মা আলো নিভিয়ে দাও, ঘুমোতে পারছি না।’
রমাকান্তবাবু বললেন, ‘সেদিনও শুনলেন?’
কুসুম বলল, ‘একটু জল খাওয়াবেন?’
টেবিলের ওপর রাখা নিজের গেলাসটা এগিয়ে দিলেন রমাকান্তবাবু।
কুসুম এক ঢোঁক খেয়ে বলল, ‘না, সেদিন আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। তবে বাবা শুনলো।’
‘গলাটা কি একদিক থেকেই ভেসে এল? মানে এই উত্তরে মাঠ থেকে?’
‘না, বাবা শুনেছে বাড়ির পেছন থেকে গলাটা ভেসে আসছে। বাবা আর একটা কথা বলল।’
‘এক মিনিট। একটু চা দিতে বলি।’
এবার রমাকান্তবাবু আর ঘন্টা বাজালেন না। তিনি চেঁচিয়ে হাবিলদারকে ডাকলেন। চা দিতে বললেন। মেয়েটার সমস্যাটা ইন্টারেস্টিং। খুবই ইন্টারেস্টিং। অনেকটা গল্প-উপন্যাসের মতো। ফাঁড়িতে আসার পর থেকে এরকম কেস এই প্রথম। লাঠি নয়, এখানে মনে হচ্ছে মাথা কাজে লাগাতে হবে। ভেরি গুড। বললেন, ‘হ্যাঁ কুসুমদেবী, আপনার বাবা আর কী বললেন?’
‘বললেন গলাটা যেন চেনাচেনা।’
রমাকান্তবাবু সামান্য হাসলেন। বললেন, ‘চেনা! সেটা আগে বলবেন তো। নিশ্চয় কোনও বদ ছোকরার কাণ্ড! কার গলা?’
‘দীনেশের। দীনেশ পাল, আমার স্বামী। চার বছর আগে উনি মারা গেছেন।’
‘অ্যাঁ! মৃত স্বামী আপনাকে ডাকছে!’
‘ডাকছে না। কষ্ট হচ্ছে বলে জানাচ্ছে। অ্যাক্সিডেন্ট কেস, মরবার সময় মানুষটা খুব কষ্ট পেয়েছিল।’
হাবিলদার চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে রমাকান্তবাবু বললেন, ‘আর ইউ জোকিং? আপনি নিশ্চয় ফাঁড়ি পর্যন্ত এসে আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন না? দেখুন ম্যাডাম, পুলিশকে নিয়ে নানারকম রসিকতা চলে কিন্তু পুলিশের সঙ্গে রসিকতা কেউ করে না। নিন চা খান।’
কুসুম চা খেল না। বলল, ‘দয়া করে আপনি আর একটু শুনুন। তারপর থেকে টানা পনেরো দিন আমি রাত জেগে ওই গলা শুনেছি। একদিন আমার ছেলেকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে শুনিয়েছি। সে খুব ভয় পেয়েছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, বাবা না? বাড়ির সবাই ভয় পেয়েছে।’
‘সন্ধেবেলা কোনওদিন শুনেছেন?’
‘না, রাতে। শুধু রাতে। তাও একবার করে। আমি একদিন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির বাইরে বাগানে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রায় রাত তিনটে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত। কিছু শুনতে পাইনি। ঘরে ঢুকে দরজা দেওয়ার পর শুনলাম।’
‘আপনাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেছেন?’
‘আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী খুব একটা নেই। প্রায় সকলেই বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছে। একজন-দু’জন আছে। তাও তারা অনেক দূরে দূরে। ওরাও চলে যাবে। আমাদের বাড়ির একদিকে বড় বড় ফ্ল্যাট উঠতে শুরু করেছে। সারাদিন কাজ হয়।’
রমাকান্তবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আপনি কি বলছেন গলাটা আপনার মৃত স্বামীর?’
‘প্রথম কয়েকদিন মনে হয়নি। আমার স্বামীর গলা অমন সর্দি-ধরা ছিল না। তবে এখন যেন মনে হচ্ছে হলেও হতে পারে। কেউ নকল করছে। তবে বাড়ির সকলে এখন বিশ্বাস করছে। মা পুজোটুজো দেওয়ার কথা বলছে।’
রমাকান্তবাবু সামান্য ঝুঁকে বলল, ‘আপনি কি বিশ্বাস করেন যে আপনার মৃত স্বামী রোজ রাতে এসে আপনাকে তার কষ্টের কথা বলছে? ভাল করে ভেবে বলুন। আপনার বিশ্বাসের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।’
কুসুম কিছুক্ষণ মুখ নামিয়ে বসে রইল। তারপর সেই অবস্থাতেই বলল, ‘না। আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করলে আমি পুলিশের কাছে আসতাম না।’
বড়বাবু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, ‘তা হলে আপনার কী মনে হয়? কাউকে সন্দেহ?’
‘আমার কিছু মনে হয় না।’ কুসুম মুখ তুলল। তার চোখে জল।
রমাকান্তবাবু অস্বস্তির মধ্যে পড়লেন। ডাক্তারদের যেমন রক্ত দেখলে ঘাবড়াতে নেই, পুলিশের তেমনই চোখের জলে কিছু যায় আসে না। তবু আজ যে কেন অস্বস্তি হচ্ছে? শালা চাকরিটাই গোলমালের। দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি বললেন, ‘দেখুন কুসুমদেবী, ভূত ধরা আমাদের কাজ নয়। পুলিশ ওঝা নয়। আপনি যদি বলতেন আপনার মরা স্বামী ফিরে এসেছে, আমি নিশ্চিন্ত হতাম। কেসটা আর আমার এক্তিয়ারে পড়ত না। কিন্তু যেহেতু আপনি তা মনে করছেন না সেহেতু আমাকে কেসটা একবার দেখতে হবে। তবে এখন আমাদের ফাঁড়িতে একটা ঝামেলা চলছে। লাঠি নিয়ে ঝামেলা। সেই ঝামেলা না মিটলে কিছু করা যাবে না। আপনি বাড়ি যান।’
কুসুম থানা থেকে চলে যাওয়ার পরই রমাকান্তবাবুর লাঠির ঝামেলা কেটে গেল। হেড কোয়ার্টার থেকে মেসেজ এল, কাল সকালেই লাঠি পাঠানো হচ্ছে।
৩
এখন জগৎপুর প্রাথমিক বিদ্যানিকেতনে টিফিনের সময়। সকলেই হয় টিফিন খাচ্ছে নয়তো ছুটোছুটি করে খেলছে। একটি মাত্র ছেলে মাঠের এক কোণে চুপচাপ বসে। সে টিফিনও খাচ্ছে না, বন্ধুদের সঙ্গে খেলছেও না। কোনও বড় মানুষ একা বসে থাকলে চোখ পড়ে না, কিন্তু কোনও ছোট ছেলে একা একা বসে থাকলে পড়ে।
আজ অবশ্য এই ছেলেটার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। বন্ধুরা নিজেদের মতো খেলছে। ছেলেটার কি শরীর খারাপ?
না, শরীর খারাপ নয়, বাপ্পার আজ মন খুব খারাপ। মন খারাপের যথেষ্ট কারণ আছে। আজকাল তাদের বাড়িতে খুব গোলমাল হচ্ছে। মা সবসময় খুব রেগে থাকে। ছোটখাটো ঘটনা নিয়ে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলছে। কাল খুব বিশ্রী ঘটনা ঘটেছে।
কাল ছিল বৃষ্টির দিন। সকাল থেকে অল্প অল্প করে পড়ছিল, সন্ধের পর বাড়ল। রান্নাঘর আর উঠোনের ছাদ থেকে জল পড়ছে। দিদা বলল, ‘এই হতচ্ছাড়া বাড়িতে থাকলে একদিন ঠিক মরতে হবে। মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়বে। কবে থেকে বলছি ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। আমার কথা কে শোনে?’ মা বলল, ‘বৃষ্টি পড়লে বাড়ি ছেড়ে দিতে হয় নাকি?’ দিদা বলল, ‘চুপ কর। তোর জন্যই তো এখানে পড়ে থাকতে হয়েছে। নইলে কবে এখান থেকে চলে যেতাম। অত সুন্দর একটা দাম দিল, লোকটাকে দুর দুর করে তাড়ালি’। এবার মা-ও রেগে গেল। চিৎকার করে বলল, ‘আমার জন্য? আমার জন্য কেন? বাড়ি কি আমার? আর তোমাদের তো বলেই দিয়েছি এ-বাড়ি যদি বিক্রি করে দাও আমি আলাদা চলে যাব। তোমাদের সঙ্গে থাকব না।’ দিদা বলল, ‘কেন চলে যাবি কেন? এ-বাড়িতে কী আছে? দীনেশের কোন স্মৃতিটা আঁকড়ে বসে আছিস তুই? বাগানের ক’টা গাছ? গরিবের এইসব ঢঙ মানায় না কুসুম, আমি বলে দিলাম, গরিবের এসব ঢঙ মানায় না।’ মা ওই বৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে বাগানে নেমে পড়ল। হেঁচকা হেঁচকা টানে কতগুলো গাছ উপড়ে ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দিল।
গাছগুলো কি বাবা লাগিয়েছিল? কে জানে! বাবাকে বাপ্পার খুব বেশি মনে নেই। শুধু মনে আছে, বাবা আসত তিন-চার দিন পরপর। দূর থেকে বাস ফিরলে। শেষ রাতে যখন বাবা আসত, তখন সে ঘুমোত।
কিছুদিন হল আবার বাবা ফিরে আসছে। ঠিক আসছে না, বাড়ির বাইরে থেকে মাকে একবার ডেকে চলে যাচ্ছে। অনেক রাতে, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সেই ডাক শোনা যায়। ক’দিন আগে পর্যন্ত মা বলত, ‘তোর বাবা না ছাই। কোনও দুষ্ট লোক আমাদের ভয় দেখানোর জন্য এরকম করছে রে বাপ্পা। তোর দাদু-দিদাকে বলে দিস, ওরা মিছিমিছি ভয় পাচ্ছে। ভয় পেলে খারাপ লোকগুলোকেই আশকারা দেওয়া হবে।’
আশ্চর্যের কথা, সেই মা কাল রাতে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, ‘ভাল করে শোন তো বাপ্পা, তোর বাবার গলা না? অবিকল সেই একইভাবে কুসুম বলে ডাকল!’
বাপ্পা অবাক হয়ে গেল। ভয়ও পেল। ঘুমচোখে সে দেখল, ঘরে আলো জ্বলছে। বিছানার ওপর বসে মা কাঁদছে। অনেক রাত পর্যন্ত মায়ের ফোঁপানির শব্দ শুনেছে সে।
সকালে যতবার এই ঘটনাটার কথা মনে হচ্ছে ততবারই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বাপ্পার।
৪
বড় ডাক্তাররা সাধারণত গম্ভীর প্রকৃতির হয়। ডাক্তার নাগও খুব বড় ডাক্তার। কিন্তু গম্ভীর নন। হাসিমুখে বললেন, ‘আপনি মুকুন্দ পাইক? বিমলবাবু ফোন করেছিলেন। ঠিক আছে, আপনার গলাটা আগে দেখে নিই, তারপর কথা শুনছি।’
ঘর অন্ধকার করে গলার মধ্যে আলো ফেলে অনেকক্ষণ পরীক্ষা চলল। একটা ফরসেপ আলজিভের কাছে চেপে ধরে ডাক্তার বললেন, ‘আ আ করুন, আ আ আ। হ্যাঁ, ঠিক আছে।’
ঘরের আলো জ্বেলে ডাক্তার বসলেন। আবার একমুখ হেসে বললেন, ‘কই, আপনার গলায় কোনও সমস্যা দেখছি না তো! অথচ বিমলবাবু ফোন করে বললেন, খুব আর্জেন্ট ব্যাপার। আপনার প্রবলেমটা কী?’
মুকুন্দ বলল, ‘আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘সেকী! আপনার কী সমস্যা আপনি বুঝতে পারছেন না? আপনি আমার কাছে এলেন কেন?’
‘আমার একটা জিনিস মনে হচ্ছে। বলব?’
‘হ্যাঁ, বলুন। বলবেন না কেন! খুলে বলুন। ডাক্তারকে কোনও সংকোচ করবেন না।’
‘আমার গলাটা আপনি কি কিছুটা নাকি নাকি শুনছেন ডাক্তারবাবু?’
‘নাকি নাকি মানে? ন্যাজাল বলছেন? কই সেরকম তো মনে হচ্ছে না। আবছা একটা ট্রেন্ড আছে মনে হয়েছিল প্রথমে। তবে সেটা লক্ষ করার মতো কিছু না।’
‘ডাক্তারবাবু, এটাই আমার সমস্যা। জন্ম থেকেই আমার গলায় নাকি ভাবটা প্রকট। সবাই আমাকে নেকো বলে ডাকত। হঠাৎ কয়েকদিন হল, এই ধরুন দু’-তিন দিন, মনে হচ্ছে নেকো ভাবটা কেটে যাচ্ছে! স্বরটা যেন অন্য আর পাঁচজনের মতো হয়ে যাচ্ছে! আমি ঘাবড়ে গেলাম। প্রথমটা বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি নিজের ঘরে একা একা কথা বলে দেখলাম। না, এটা যেন আমার নিজের গলা নয়, মনে হচ্ছে, অন্য কারও গলা আমার ভেতর ঢুকে পড়ছে! ডাক্তারবাবু, আমার ভয় করছে।’
ডাক্তার চেয়ারে হেলান দিলেন। বললেন, ‘আপনার আগের গলা যেহেতু আমি শুনিনি সেহেতু আমার পক্ষে এই পরিবর্তনটা ধরা সম্ভব নয়। তবে আপনি যে ভয়ের কথা বলছেন সেটার সঙ্গে গলার কোনও সম্পর্ক নেই। ওটা মানসিক।’
‘ভয়টা না হয় মানসিক, কিন্তু গলাটা? গলাটা যে বদলে যাচ্ছে? সেটা কী করে সম্ভব?’
ডা. নাগের কোনও কারণে মুকুন্দকে পছন্দ হয়েছে, অথবা মজা পাচ্ছেন। তিনি ছাত্র পড়ানোর মতো করে বললেন, ‘আমি ধরে নিচ্ছি, আপনার গলার একটা পরিবর্তন এসেছে। আর সেটা হঠাৎ করে আসায় আপনি ঘাবড়ে গেছেন। স্বরের পরিবর্তন হতে পারে বয়ঃসন্ধির সময়। এত বড়বয়েসে হঠাৎ স্বরের পরিবর্তনে ঘাবড়ে যাওয়াটা আশ্চর্যের কিছু না। তবে এটা একেবারে অসম্ভব এমনও নয়। আপনার প্রবলেমটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে। কেন লাগছে জানেন? ভয়েস ন্যাজাল থেকে নরমাল হয়ে গেলে খুশি হওয়ার কথা। অথচ উলটোটা হচ্ছে, আপনি ভয় পাচ্ছেন। এটাই ইন্টারেস্টিং।’
‘আপনি দয়া করে একটু বলবেন কেন এমন হল?’
ডাক্তারবাবু মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘বলব? আচ্ছা শুনুন। আসলে ব্যাপারটা হল, ছেলেদের ভোকাল কর্ড হয় ন্যাতানো ধরনের। তাই তাদের গলার স্বরটাও হয় ভারী। আর মেয়েদের ভোকাল কর্ড হল স্টিফ, একটু শক্তমতো। সেইজন্য গলার স্বরটা সরু। আমার মনে হচ্ছে, আপনার ভোকাল কর্ডটা ছিল কিছুটা শক্ত। সেটা কোনও কারণে নরম হয়ে গেছে।’
‘কীভাবে সেটা হল?’
‘হওয়াটা রেয়ার। তবে আবার একেবারে হয় না, তাও নয়। এই তো আপনার হয়েছে। আপনি কি চিন্তা করছেন?’
মুকুন্দ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর সেই অবস্থাতেই বলল, ‘না করছি না। তবে আমার মনে হয় কারণটা আমি বুঝতে পারছি। আমার আর চিন্তা নেই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। অনেক সময় নষ্ট করলেন।’
ডা. নাগ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘মুকুন্দবাবু, আপনার গলার স্বরটা সত্যি যদি বদলে গিয়ে থাকে তা হলে সেটা খারাপের দিকে বদলেছে বলব না। বরং ভালই হয়েছে। সুন্দর লাগছে।’
বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে মুকুন্দ, এমন সময় নিতাই এল। সে হাঁপাচ্ছে।
‘তুমি বেরিয়ে আসার পরই ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়েছিলাম। কই কিছুই তো হয়নি তোমার! উফ, যা চিন্তায় আমাদের ফেলেছিলে। বিমলদা তো বারবার মোবাইলে ফোন করছে, বলছে তোমার গলায় নাকি কীসব হচ্ছে। গুরু, গলাটাকে সাবধানে রেখো মাইরি। আর মাত্র ক’টা দিন। তীরে এসে তরী ডুবিও না। খবর আছে, মাগি ভয় পেতে শুরু করেছে। রাতে ঘরে আলো জ্বেলে রাখছে। তুমি আজ জগৎপুর যাচ্ছ তো?’
মুকুন্দ অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘না, আজ আমি যাব না।’
রাতে মুকুন্দ রান্নার আয়োজন করতে বসে দেখল তেল নেই। এটা কোনও ব্যাপার নয়। চাল ডাল হাঁড়িতে বসিয়ে দিলেই খিচুড়ি। খিচুড়ি বেশি করেই খেল মুকুন্দ। মনটা আজ নিশ্চিন্ত। গলা নিয়ে দুর্ভাবনা কেটেছে। মানুষের শরীরে কলকবজাগুলো বড় আশ্চর্যের। তার এতদিনের খোনা গলা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ভাল, খুবই ভাল। বিমলবাবুর কাজটা চলে যাবে। তা যাক। কোন কাজটাই বা থাকে? আড়াই হাজার- টাকা পাওয়ার পর ভেবেছিল, অনেক কাজ করবে। আগে ছিটকিনিটা সারাবে। কিছুই করা হয়নি, দরজাটা সেই খোলাই থাকে। টাকার খামটা পড়ে আছে। আচ্ছা, টাকাটা নিতাইদের ফিরিয়ে দিলে কেমন হয়? দেওয়াই তো উচিত। ওরা তো ভূতকে টাকা দিয়েছিল। সে কি আর ভূত আছে?
মুকুন্দ ভেবেছিল, ঘুমোবে। কিন্তু তা হল না, ঘুম এল না। এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়ল। রাত বেশি হয়নি। এখনও বড় রাস্তায় গেলে জগৎপুরের দিকে যাওয়ার লরি পাওয়া যাবে।
৫
কাল রাতে ঘুমোতে অনেক দেরি হয়েছিল। তবু আজ ভোরে উঠে পড়ল কুসুম। এখনও কেউ ওঠেনি।
কুসুম উঠোনে এসে দাঁড়াল। দুটো ধাপ নামলেই বাগান। বাগান নামেই, আসলে ঝোপঝাড়ই বেশি। মাঝেমধ্যে দু’-চারটে গাছ। তারা অভ্যেসমতো মাঝেমধ্যে ফুল ফোটায়। দীনেশ যখনই বাস নিয়ে দূরে কোথাও যেত— শিলিগুড়ি, মালদা, রায়গঞ্জ, সঙ্গে করে একটা-না-একটা চারা নিয়ে ফিরত। কখনও টবে, কখনও প্লাস্টিকে মাটি দিয়ে। সেসব বেশিরভাগই বাঁচত না। তবু তার উৎসাহে ভাঁটা পড়ত না, আবার নিয়ে আসত। একবার একটা হাসনুহানার চারা আনল। মা খুব রাগ করলেন। বললেন, ‘ওই গাছ কিন্তু বাড়িতে পুঁতবে না। ওর গন্ধে বাড়িতে সাপ আসে।’ দীনেশ শুনল না। লাগিয়ে দিল।
সেই হাসনুহানা কোনও যত্ন ছাড়াই বেঁচে গেছে। শুধু বেঁচে গেছে না, বলা নেই কওয়া নেই সে দুমদাম কোনও কোনও দিন ফুল ফুটিয়ে বসে। তীব্র গন্ধে বাড়ি ম-ম করে। কুসুমের যেন মাথা ধরে যায়, নেশার মতো লাগে।
কুসুম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই বাড়ি, এই ঝোপঝাড়ের বাগান আর বোধহয় ধরে রাখা যাবে না। মা বেঁকে বসেছেন। ভুতুড়ে বাড়িতে তিনি আর একটা দিনও থাকতে চান না। তার কিন্তু আজকাল আর ভয় করে না। কোনও কোনও দিন ভূতের গলা শোনার জন্য পা টিপে সে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। চারিদিকে গভীর অন্ধকার। আকাশে ফোঁটা ফোঁটা তারার আলো। কোনওদিন কোনওদিন কুসুমের মনে হয়, বাপ্পাকে ঘুম থেকে তুলে আনি। দু’জনে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। লজ্জায় বাপ্পাকে ডাকা হয় না। কালও অনেক রাত পর্যন্ত সে বাগানে অপেক্ষা করেছিল। কেন করেছিল? কুসুম জানে না।
বাপ্পাকে নিয়ে স্কুলে বেরোনোর সময় একটা ছেলে এল। সাইকেল রেখে উঠে এল উঠোনে। বলল, ‘আপনার নাম কুসুম দেবী? আপনাকে বড়বাবু এখনই একবার থানায় ডেকেছেন।’
মা ভয় পেয়ে গেল। বলল, ‘সেকী রে! সাতসকালে পুলিশ ডাকছে কেন? শুনছ, তুমি একবার মেয়েটার সঙ্গে যাও না। আজ আর বাপ্পাকে স্কুলে যেতে হবে না।”
কুসুম বলল, ‘না, আমি একাই যাব।’
ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে সেই রিকশাতেই ফাঁড়িতে এল কুসুম।
রমাকান্তবাবুর টেবিলে একরাশ বেঁটে বেঁটে লাঠি। তিনি মন দিয়ে একটা করে লাঠি টেবিলে ঠুকছেন আর পাশে সরিয়ে রাখছেন। কুসুমকে দেখে একটু যেন লজ্জা পেলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘আসুন কুসুম দেবী। বসুন, চেয়ারটা টেনে নিন। আমি চট করে লাঠিগুলো একটু টেস্ট করে নিই। এইমাত্র এসেছে। আগেরবারেরগুলো খুব ঝামেলায় ফেলেছিল। সবকটা ফাঁপা ছিল। এবার বলেছি ঠং আওয়াজ পেলেই ফেরত। নো কমপ্রোমাইজ।’
কুসুম হাসল। মানুষটা খারাপ নয়।
রমাকান্তবাবু কাজ শেষ করার আগেই চা এল। বিস্কুট এল। ভাঙা কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে রমাকান্তবাবু বললেন, ‘নিন চা খান। নিন বিস্কুট নিন। আপনার জন্য একটা ভাল খবর আছে কুসুম দেবী। আপনার ভূতবাবাজি ধরা পড়েছেন।’
‘ধরা পড়েছে!’
‘হ্যাঁ। ধরা পড়েছে শুধু নয়, মারধরের আগেই হড়হড় করে সব বলে দিয়েছে। তাও ব্যাটাকে ঘা-কতক দিয়েছি। কাল রাতে আমার চারটে লোক ছিল আপনার বাড়ির চারদিকে। আমি নিজে ছিলাম আপনার বাগানে।’ রমাকান্তবাবু আবার লাজুক একটা হাসি দিলেন।
গোটা ঘটনায় কুসুম এতটাই অবাক যে সে কোনও কথা বলতে পারছে না। অনেক কষ্ট করে এবার বলল, ‘আপনি নিজে ছিলেন! আমাদের একবার ডাকলেন না?’
‘ডাকার জন্য তো যাইনি। লোকটা আপনার বাড়ির সামনে এলোমেলো ঘুরছিল। তখন ক’টা বাজে! এই আপনার ধরুন দেড়টা-পৌনে দুটো।’ রমাকান্তবাবু চোখ নাচিয়ে বললেন, ‘একবার ভূতটাকে দেখবেন নাকি? দেখা উচিত। পারলে আপনার মা-বাবাকেও একবার দেখানো উচিত। ভয়ফয় সব কেটে যাবে। তবে লোকটার পিছন বিগ শট আছে। বিগ শট বোঝেন তো? বড় মাছ আর কী! বেশিক্ষণ ধরে রাখা যাবে না। থানাটানা হলে তাও কথা ছিল। ফাঁড়ি এদের কাছে নস্যি। আমি একটা চেষ্টা করব। কিছুদিন যদি রাখা যায়।’
লকআপের এক কোনায় লোকটা বসে আছে। খাকি রঙের একটা ফুল প্যান্টের ওপর গাঢ় বেগুনি একটা জামা। খুবই বেমানান। জামাটার একদিকের কনুইতে তাপ্পি। জামার সঙ্গে সেই তাপ্পির রং মেলেনি। প্যান্টের হাঁটুর কাছটা টানাটানিতে ছিঁড়ে গেছে। লকআপের এক কোণে ক্যাম্বিসের একপাটি জুতো পড়ে আছে। অন্য পার্টিটা কোথায়?
পায়ের শব্দে লোকটা মুখ ফেরাল। একটা চোখ ফুলে আছে। মারের চোটে ঠোঁটের পাশটাও ফেটেছে। কালচে রক্ত। লোকটা ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছে। মুখ তুলে কুসুমের দিকে অপ্রকৃতিস্থের মতো তাকাল।
রমাকান্তবাবু বলল, ‘কী রে, চা খাবি?’ লোকটা যন্ত্রের মতো মাথা নাড়ল। রমাকান্তবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে দিতে বলছি। তার আগে তুই একটা কাজ কর তো। দিদিমণিকে শুনিয়ে দে তো ভূত সেজে তুই কী বলতিস?’
লোকটা চুপ করে রইল।
কুসুম বিড়বিড় করে বলল, ‘থাক।’
রমাকান্তবাবু রেগে গেলেন, ‘কেন? থাকবে কেন? হারামজাদা কাল সারারাত জাগিয়ে রেখেছে। আপনিও গলাটা শুনে বলুন ঠিক লোককে ধরেছি কিনা। আজকাল অনেক সময় ভুল লোককে ধরে আসামি বলে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। বুঝলেন কুসুম দেবী, তারাই সব পুলিশে বড় বড় পোস্টিং পেয়ে যায়, আর আমাদের কপালে জোটে লবডঙ্কা। ঘেন্না ধরে গেল চাকরিতে। কী রে বলবি? না লকআপে ঢোকাব? নতুন লাঠি এসেছে কিন্তু।’
ধমকানিতে কুঁকড়ে থাকা লোকটা আরও ভয় পেয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল, ‘উফ! কুসুম, কী কষ্ট!’
নিজের ঘরে ফিরে আর এক কাপ চা দিতে বললেন রমাকান্তবাবু। চা এল। কুসুম সেই কাপ মুখে তুলল না।
রমাকান্তবাবু বললেন, ‘সেকী! চা খাবেন না? ঠিক আছে আপনি ভাল করে একটা কমপ্লেন লিখে ফেলুন। এই নিন কাগজ। আচ্ছা, আমি বলছি, আপনি লিখুন। অভিযোগটা জবরদস্ত করতে পারলে এদের কিছুদিন আটকে রাখা যায়। নইলে ফাঁকফোকর দিয়ে গলে যাবে।’
কুসুম মুখ তুলল। বড়বাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি ভুল করেছেন। এ সে লোক নয়। আমি গলা শুনেই বুঝতে পেরেছি আপনারা ভুল করেছেন।’
৬
সন্ধে হয়নি। তবে বেশি দেরিও নেই।
কুসুম উঠোনের সিঁড়িতে বসে আছে। সে অনেকদিন পরে আজ একটা শাড়ি বের করেছে। হালকা নীল। ম্যাচ করা টিপ খুঁজেছিল, পায়নি। অগত্যা একটা লাল টিপ লাগিয়েছে সে। নীল শাড়ির সঙ্গে লাল টিপ খুবই বেমানান। তবুও কোনও এক আশ্চর্য কারণে আজ বড় সুন্দর দেখাচ্ছে কুসুমকে। একটু পরেই অন্ধকার নামবে। হয়তো না বলে কয়ে আজও হাসনুহানা ফুটবে এবং তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে বাড়ি জুড়ে। তীব্র সেই গন্ধে আজও মাথা টিপটিপ করবে কিনা কে বলতে পারে। হয়তো করবে, হয়তো করবে না।
এইরকম একটা দোনামোনা সময় কুসুম দেখতে পেল একটা মানুষ তাদের দরমার গেট খুলে বাড়িতে ঢুকছে। আবছা আলোতেই বোঝা যাচ্ছে তার চোখের ফোলাটা এখনও কমেনি।
কুসুম নেমে এল। মানুষটার কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল, ‘বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি তো?’
মুকুন্দ হাসল। ম্লান হাসি। বলল, ‘না। অসুবিধে হয়নি।’