ভাইরাস
রত্না গাড়ির চাবিটা আঙুলের ডগায় নিয়ে বনবন করে ঘোরাচ্ছে।
এর মানে রত্না ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। ভেতরে ভেতরে ছটফট করলেই রত্না আঙুলে গাড়ির চাবি ঘোরায়। সে অবশ্য গাড়ি চালায় না। চালাতে জানেও না। গাড়ি চালায় ড্রাইভার। কিন্তু চাবি নিজের কাছে রাখে।
চন্দ্রনাথ অনেকক্ষণ ধরে ঘুরন্ত চাবির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে মনে রত্নার ব্যালান্স প্রতিভার তারিফ করছে সে। আহা! যেমন রূপে তেমন গুণে! একটু এদিক-ওদিক হলে চাবি মিলেনিয়াম পার্কের রেলিং টপকে গঙ্গায় গিয়ে পড়বে। রত্নার প্রতিভার জন্যই পড়ছে না।
‘কী হাঁদার মতো তাকিয়ে আছ? কী করবে কিছু ভাবলে? আমি আজ ফাইনাল কথা শুনতে চাই।’
‘আজ ফাইনাল কথাই বলব রত্না।’
‘বলব বলব তা অনেকদিন ধরে শুনছি। দু’মাসে তিনটে পার্টি বাবার সঙ্গে কথা বলে গেছে। একটা ছেলে আবার এয়াললাইন্সের অফিসার। বছরে একবার করে সিঙ্গাপুর যাওয়া আসার টিকিট ফ্রি! বাবা তো খুব ইন্টারেস্টেড। সত্যি কথা বলতে কী ছেলেটি দেখতে ভাল। বিশেষ করে হাইট। তোমার মতো বাঁটকুলচন্দ্র নয়।’
বাঁটুল বলায় চন্দ্রনাথ অন্যদিন হলে দুঃখ পেত। আজ হাসিহাসি মুখে বলল. ’তুমি তোমার বাবাকে বলো রত্না।’
রত্না চাবি ঘোরানো বন্ধ করে চন্দ্রনাথের দিকে ঘুরে বসল। বলল, ‘কী বলব? বাবা, আমি একজন রাজপুত্রকে বিয়ে করতে চলেছি। তাদের ছেঁচকি না চাটনির বড় ব্যাবসা আছে। ময়ূরপঙ্খী নৌকোতে সেই ছেঁচকি আর চাটনি নিয়ে তারা মাঝে মাঝে বাণিজ্যে বের হয়। এই কথাটা বাবাকে বলতে বলছ তুমি? তার থেকে একটা কাজ করো না চন্দ্রনাথ। আমি ওই রেলিঙের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি আমাকে ধাক্কা মেরে গঙ্গায় ফেলে দাও। তারপর এই চাবিটা আমার ড্রাইভারকে দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলো। ইচ্ছে করলে তুমি শিয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত লিফটও নিতে পারো।’
উত্তেজনায় চন্দ্রনাথ উঠে দাড়াল। বলল, ‘ছেঁচকি নয় রত্না। আমি অন্য ব্যাবসা করব।’
রত্না চোখ সরু করে বলল, ‘কীসের বিজনেস?’ চন্দ্রনাথ রত্নার হাত ধরে বলল, ‘উহু, এখন তো বলব না সোনা। একেবারে উদ্বোধনের দিন গিয়ে জানতে পারবে। সেদিন তোমার বাবাকে নিয়ে যেতে হবে। আশাকরি এতক্ষণে তোমার চিন্তা কমল।’
রত্না উলটোদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল ‘না, চিন্তা বাড়ল।’
২
কর্মচারীরা সকলেই কাজ করছে, কিন্তু একটা চাপা টেনশন রয়েছে।
বিশ্বনাথ সামন্তের মাথার পেছনে কালো বোর্ড। এই বোর্ডে রোজকার ‘স্পেশাল আইটেম’ লেখা হয়। বোর্ডে লেখা অনুযায়ী আজকের ‘স্পেশাল আইটেম’ হল— কুমড়ো ফুলের বড়া! এই জিনিস তৈরি করা কোনও কঠিন ব্যাপার নয়। আগেও বহুবার হয়েছে। কিন্তু আজ আটটা বাজতে চলেছে, রান্নাঘরে বড়ার কাজ কিছুই এগোয়নি। তার কারণ বিশ্বনাথবাবু কুমড়ো ফুল আনেননি। মালিককে সবকিছু বলা যায় কিন্তু বাজারে যেতে বলা যায় না।
বিশ্বনাথ সামন্তের ঠাকুরদা জগন্নাথ সামন্ত এই ছোট্ট মফস্সল শহরে খাবার হোটেল শুরু করেছিলেন। তখন ছিল মোটে দুটো টেবিল। হোটেলের নাম ছিল, ‘ভাতের হোটেল’। রমরমা চলতে লাগল। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর বাবা তারকনাথ সামন্ত এসে বসলেন। তখন টেবিল বেড়ে হল ছয়। নামে সামান্য বদল আনলেন তারকনাথ। একটা ঘরোয়া টাচ। শুধু ভাতের বদলে ‘ভাত-ডালের হোটেল’। ভিড় আরও বাড়ল। লাভের টাকায় স্টেশন রোডের পাশে জমি কিনলেন তারকনাথ। একতলা বাড়ি হল। বাড়ির সামনে বাগান হল। বাগানে গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা। তারকনাথ মাসকাবারি সাইকেল রিকশর ব্যবস্থা করলেন। পরে সেই সাইকেল রিকশ কিনেও নিলেন। আজও সেই রিকশর একটা চাকা আর এয়ার হর্ন বাড়ির গুদামে রাখা আছে।
ছেলে বিশ্বনাথের হাতে বারো টেবিল সাজানো ভাত-ডালের হোটেল তুলে দিয়ে তারকনাথ গত হয়েছেন আজ বিশ বছর। তারপর শহর বড় হয়েছে। হোটেলের গায়ে বাসস্ট্যান্ড হয়েছে। সেখান থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় কলকাতা যাওয়ার এক্সপ্রেস বাস ছাড়ে। এসবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হোটেল বড় হয়েছে। বিশ্বনাথ সামন্তের বাড়িও একতলা থেকে বেড়ে হল দোতলা। ছাদে ঠাকুরঘর। ঠাকুরঘরের মেঝেতে মার্বেল। বসার ঘরে সোফা, রঙিন টিভি। টিভিতে কেবল লাইন লেগেছে।
বিশ্বনাথ সামন্ত আজ যে কুমড়ো ফুল কিনতে ভুলে গেছেন তা এমনি এমনি নয়।
কাল রাতে বিশ্বনাথবাবু বাড়ি ফিরেছিলেন তাড়াতাড়ি। স্বামীকে দেখে সুরমা বিরক্ত হলেন। আজকাল সন্ধেগুলো তিনি একধরনের ঘোরের মধ্যে কাটান। টিভিতে এখন পরপর তিনটে মারকাটারি সিরিয়াল চলছে। একটা হাসির, একটা দুঃখের, আর তিন নম্বরটা ভয়ের। মনের ওপর তিনরকম চাপ সামলে থাকতে হচ্ছে। এই অবস্থায় টিভির মানুষদের পছন্দ হয়, জ্যান্ত মানুষদের অসহ্য লাগে। সে মানুষ স্বামী হলেও লাগে! তবু কিছু বলা যায় না।
বিশ্বনাথ জামাকাপড় বদলে ফতুয়া আর লুঙ্গি পরে সোফায় এসে বসলেন। বললেন, ‘সুরমা, একটা জরুরি আলোচনা ছিল। সুরমা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, চন্দ্রনাথকে এবার হোটেলের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেব। আমি ওর থেকেও কম বয়েসে ব্যাবসায় বসেছিলাম। আজ আমার ফিফটি সিক্স। কাল থেকে তুমি ছেলেকে আমার সঙ্গে হোটেলে যেতে বলবে’।
সুরমা হাই তুললেন। টিভি সিরিয়ালগুলোর সঙ্গে মনে হয় হাইয়ের ওষুধ মেশানো থাকে। নইলে শেষ হলেই ঘনঘন হাই পায় কেন? সুরমা আবার হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘খোকা হোটেলে বসবে না’।
বিশ্বনাথ অবাক হয়ে বললেন, ‘মানে?বসবে না মানে’?
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘সবাই যে চচ্চড়ি আর মাছের ঝোল নিয়ে কারবার করবে ভাবছ কেন? পাঁচজনকে বলতে লজ্জা হয় এমন কাজ’। সে করবে কেন? একদমই করবে না’।
বিশ্বনাথ রাতে দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমোতে গেলেন। ঘুম হল ছেঁড়াছেঁড়া। সেই ছেঁড়া ঘুমের মধ্যেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ছেলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে।
৩
বিশ্বনাথবাবু ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলের দিকে ঠিক নয়, ছেলের চোখের মণির দিকে। তিনি শুনেছেন, পাগলদের চোখের মণি নাকি অন্যরকম হয়। চন্দ্রনাথের মণি কি অন্যরকম হয়ে গেছে?
তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘হোটেলটা তুলে দেব বলছিস চন্দ্রনাথ?এত বড় একটা লাভের জিনিস—।’
‘হ্যাঁ, তুলে দেবে। আজকাল কেউ ভাতের হোটেল নিয়ে পড়ে থাকে নাকি? এই ব্যাবসার কথা কাউকে বলা যায়।’
‘কেন? বলা যাবে না কেন ? ভাত খাওয়া যায় আর ভাতের কথা বলা যায় না! বাপ ঠাকুরদার এমন চালু ব্যবসা বন্ধ করে তুই অন্য ব্যাবসা করবি! তুই বরং আর একটা জায়গা খোঁজ খোকা। আমি বলি কী, দুটোই থাকুক।’
চন্দ্রনাথ বলল, ‘তুমি কি পাগল হলে? এই পজিশনের দামই তো কোটি টাকা। জায়গা দেখিয়েই তো টাকা আসছে।’ সে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে বাবার পাশে এসে বসল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, বাবা, তোমার কি আমার নতুন বিজনেস প্রজেক্টটা শুনতে ইচ্ছে করছে? না ইচ্ছে করলেও শোনো। বাবা, আমি একটা সাইবার কাফে করছি। সাইবার কাফে কী জিনিস জানো? জানো না। সহজ কথায় জিনিসটা হল একটা কম্পিউটার সেন্টার। অনেকগুলো কম্পিউটার থাকবে, তাতে নানারকম কাজ করা যাবে। আমার এক বন্ধু রতনের মেজমামা বালিগঞ্জে খুলেছে। রতনকে ধরে একদিন সেই মেজমামার কাছে গেলাম। বাপ রে! কী কাণ্ড! বিজনেস চলছে ঝমঝম করে। আমার কথা শুনে মেজমামা বললেন, ভেরি গুড। এখন ইন থিঙ্ক হল কম্পিউটার। ইন থিঙ্ক কী জানো? জানো না। ইন থিঙ্ক হল চালু জিনিস। সেই চালু জিনিসের কথা বলতে বলতে মেজমামা পেস্ট্রি খাওয়াল। বলল, বাঙালি আজ কম্পিউটারেই এগিয়ে চলার পথ খুঁজে পাবে। তারপর মেজমামা নিজেই খসখস করে প্রজেক্ট লিখে ফেললেন। সোজা চলে গেলাম মিস্টার গাঙ্গুরিয়ার কাছে।’
‘গাঙ্গুরিয়া! গাঙ্গুরিয়া কে?’
চন্দ্রনাথ হেসে বলল, ‘গাঙ্গুরিয়া একজন ভেরি নাইস ম্যান। ভেরি বললে কম বলা হবে। বলা উচিত ভেরি ভেরি নাইস ম্যান। তিন বছর হল রাজস্থান থেকে এসেছেন। বাংলা বলতে পাগল। সব শুনে তিনি লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, চান্দো, যত টাকা লাগে লাগুক। গো অ্যাহেড। কদম কদম বাড়ায়ে যা। মফসস্ল শহরে এ জিনিস কলকাতার থেকেও ভাল চলবে। একদিকে কম্পিউটার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। অন্যদিকে করবে ইন্টারনেট, ই-মেল, ওয়েবসাইট সার্কিং। এক কোণে কম্পিউটার গেমস রাখলে স্কুল স্টুডেন্টস পাবে। ছাত্রদের আজকাল এই খেলাতেই বেশি মন। বাবা, তুমি শুনলে খুশি হবে, ইতিমধ্যে বাঙ্গালোরে কম্পিউটারের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। জাপানি সফটওয়ার নিচ্ছি।মেজমামা বললেন, আমেরিকান সফটওয়ারের থেকে জাপানি সফটওয়ারই এখন ভাল।’
‘মেজমামাটা কে?’
‘উফ বাবা, ঘ্যাঁট আর আলুভাজা নিয়ে ভেবে ভেবে তোমার মাথাটা একদম গেছে। মা ঠিকই বলে। তোমায় বললাম না রতনের মেজমামা? বলিনি?’
‘হ্যাঁ বলেছিস। কিন্তু তাকে তুইও যে মেজমামা ডাকছিস এটা বলিসনি’।
৪
চন্দ্রনাথের খুব ইচ্ছে ছিল নাম হোক রত্না সাইবার কাফে। লজ্জায় সেই নাম দেওয়া গেল না। এ পোড়ার দেশে প্রেমিকার নামে ব্যাবসার নাম হয় না। তা ছাড়া মিস্টার গাঙ্গুরিয়াকে নাম থেকে বাদ দেওয়াটা ঠিক হবে না। অনেক ভাবনাচিন্তার পর নাম হল ‘চন্দ্ররিয়া কম্পিউটার’। চন্দ্রনাথের ‘চন্দ্র’ আর গাঙ্গুরিয়ার ‘রিয়া’।
কয়েকদিনের মধ্যে ভাত-ডালের সাইনবোর্ড খুলে ফেলা হল। বসল নীল গ্লোসাইন। কাঠের চেয়ার বদলে এল গদির হালকা চেয়ার। বসে বসেই যেদিকে খুশি ঘোরা যায়। নতুন টেবিলগুলোও সুন্দর। হালকা নীল কার্পেট। মেজমামার চেনা ইন্টিরিয়র ডেকরেটর শাহনীলা ভট্ট একদিন কলকাতা থেকে এসে সাজসজ্জায় ফাইনাল টাচ দিয়ে গেলেন। মহিলার কাজ দারুণ, তবে বড় সিগারেট খান। দেয়ালে ছবি। একটা বিরাট বড় মাউস। কম্পিউটারের মাউস। সেই মাউসের মধ্যে শিশুর মাথা, মাথার মধ্যে আবার মাউস, মাউসের মধ্যে আবার মাথা…! ঢোকার কাঠের দরজা ফেলে লাগল কাচের স্লাইডিং ডোর। সাতদিনে ভাত-ডালের হোটেলের ভোল একেবারে পালটে গেল। এরমধ্যে একদিন বাঙ্গালোর থেকে ভায়া কলকাতা হয়ে চলে এল কম্পিউটার মেশিন।
ইঞ্জিনিয়ারা এলেন তিনদিন পরে, মাঝরাতে। রাতে ছাড়া তাদের হাতে সময় নেই। এখানে কাজ সেরেই ছুটতে হবে। অনেক সাধাসাধিতেও সলিড কিছু মুখে তুলল না ওরা। ভাগ্যিস চন্দ্রনাথ বুদ্ধি করে কয়েকটা ক্যান বিয়ার এনে লুকিয়ে রেখেছিল। তবে লোকগুলো কাজ জানে বটে। উদ্বোধনের জন্য একটা দারুণ ব্যবস্থা করে দিল। সেই ব্যবস্থায় বোতাম টিপলেই সারি সারি বন্ধ কম্পিউটার চালু হয়ে যাচ্ছে। পরদায় ফুটে উঠছে কয়েকশো হাউই আর তুবড়ি ফাটার দৃশ্য। আলো আর রঙে ভরে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে হাজার হাজার করতালির আওয়াজ। এই জিনিস দেখে চন্দ্রনাথ মুগ্ধ। এরকমও হয়! তার ওপর ইঞ্জিনিয়াররা জানাল, এই ‘উদ্বোধন সফটওয়ার’-এর চাহিদা এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি নাকি ব্রাজিল আর মেক্সিকোতে। ভাবা যায়? কোথাকার জিনিস কোথায়!
গাঙ্গুরিয়া চান সাইবার কাফের উদ্বোধন তোক পয়লা বৈশাখ। তিনি বললেন, ‘দ্যাখো চান্দো, ডোন্ট ফরগেট বাংলা, ডোন্ট ফরগেট বেঙ্গলি। কবিগুরু বলেছেন কী মোদের গরোব, মোদের আশা…’
সেইমতো পয়লা বৈশাখ আয়োজন হয়েছে।
চন্দ্ররিয়া কাফের সামনে রজনীগন্ধার ঝালর। মাঝে মাঝে লাল গোলাপ। হালকা করে সানাই বাজছে। দরজার মুখেই সারি সারি চেয়ার পাতা। সামনে লাল সোফা সেখানে বসে আছেন মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান হরিশ মুখার্জি। তিনি এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। হরিশবাবু অল্প অল্প ঘামছেন। নার্ভাস বোধ করছেন। কম্পিউটার জিনিসটা সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই নেই। প্রথমটায় ভেবেছিলেন আসবেন না, কাটান দেবেন। সবাই বলল, ‘খেপেছেন মশাই? এখন আর কম্পিউটার ছাড়া ভোট পাবেন?’ ভোটের ভয়ে হরিশবাবু রাজি হয়েছেন। কিন্তু ভয় কমছে না। সেক্রেটারির লিখে দেওয়া ভাষণ মুখস্থ করে এসেছেন ঠিকই, তবু খালি মনে হচ্ছে ভুলে যাচ্ছি, ভুলে যাচ্ছি। উফ, হতচ্ছাড়া জিনিসটা যে কখন শেষ হবে। পাশেই মিস্টার গাঙ্গুরিয়া। তিনি আজ ধুতি পরে বাঙালি সেজেছেন। পাঞ্জাবিতে চন্দন কাঠের বোতাম। ঠোঁটের ফাঁকে হাসি। গাঙ্গুরিয়া ঠিক করেছেন আজ সারাক্ষণ এই হাসিটা ধরে রাখবেন। না, চন্দ্রনাথ ছোকরার ব্যবস্থা ভাল। টাকাগুলো জলে যায়নি। গাঙ্গুরিয়ার পাশে রত্না বসেছে বাবাকে নিয়ে। সে ডান হাতের আঙুলে গাড়ির চাবি ঘোরাচ্ছে এবং চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখছে। আয়োজনে সে খুশি কিন্তু তার ধারণা শেষপর্যন্ত কিছুই ঠিকমতো হবে না। না হলে চন্দ্রনাথের কপালে দুঃখ আছে। খুব বড় দুঃখ। কলকাতা থেকে এত দূরে বাবাকে নিয়ে আসতে অনেক ঝামেলা করতে হয়েছে তাকে। তখনই সে ঠিক করেছে বাঁটুলচন্দ্রের ব্যাপারটা আজই ফাইনাল করে ফিরবে। হয় এসপার, নয় ওসপার। হয় তরী ডোবাবে, নয় তরী ভাসাবে।
চন্দ্রনাথকে রত্ন যতটা বেঁটে ভাবে আজ তার থেকেও তাকে বেশি বেঁটে দেখাচ্ছে। সম্ভবত সুট পরার কারণেই এমন হচ্ছে। সে হাসিহাসি মুখে ঘুরছে ঠিকই, কিন্তু টেনশনে সেই হাসিকে দেখাচ্ছে কান্নার মতো। যদিও কান্নার কোনও কারণ নেই। প্রথম দিনেই একুশ জন ছাত্রছাত্রী নগদ টাকা দিয়ে ভরতি হয়ে গেছে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পরেই তারা এক একটা কম্পিউটার নিয়ে বসে যাবে। চন্দ্রনাথ নিশ্চিত, কাচের দরজার বাইরে থেকে সেই দৃশ্য দেখলে আজ বিকেলেই আরও একুশজন পাওয়া যাবে। তবু তার টেনশন হচ্ছে। বাবা এলে ভাল হত। টেনশনটা কমত।
চন্দ্রনাথ খবর পায়নি, বিশ্বনাথ সামন্ত এসেছেন। সুরমাদেবী তাকে নিয়ে সামনে বসতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজি হননি। পেছনে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। যতটা সম্ভব নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন।
উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সমবেত শঙ্খ বাদনের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হল ঠিক দশটায়। অতিথিরা উঠে দাঁড়ালেন। ব্যবস্থামতো চেয়ারম্যান সাহেব এগিয়ে গিয়ে কম্পিউটারের বোতাম টিপলেন। সবাই হাততালির জন্য তৈরি। দু’জন ক্যামেরা বাগিয়ে আছে। এদের মধ্যে একজন চন্দ্রনাথের ভাড়া করা। অন্যজন স্থানীয় পত্রিকা ‘গাঁ-গঞ্জ’ থেকে এসেছে। এদের ঠিক মুহুর্তটা ধরতে হবে। দুনিয়া কাঁপানো বাজি ফাটানোর মুহূর্ত।
কিন্তু ঠিক মুহূর্ত আসছে না। বোতাম টেপার পরও কম্পিউটার চালু হল না। চেয়ারম্যান আবার বোতাম টিপলেন। এবার জোর দিয়ে টিপলেন। কিছুই হল না। এবার চারপাশে চেয়ে চেয়ারম্যান হাসলেন। নার্ভাস হাসি। আবার বোতাম টিপলেন। তারপর কঠিন গলায় বললেন,’চন্দ্রনাথ কোথায়? কোথায় চন্দ্রনাথ হারামজাদা?’
রতনের মেজমামা ততক্ষণে সবাইকে ঠেলে এগিয়ে এসেছেন। বললেন, ‘দেখি দেখি, মনে হচ্ছে হার্ডওয়ারের প্রবলেম। দেখি একটু সরুন তো ভাই।’
কম্পিউটার কোম্পানির যে-লোকটা চন্দ্রনাথের টেলিফোন ধরল সে সম্ভবত টিফিন করছিল। প্রতি কথায় একটা করে টোস্ট কামড়ানোর মতো কুড়মুড়ে আওয়াজ। তবে লোকটা খারাপ নয়। সবটাই বলে দিল।
‘কী বললেন স্যার, এখন যাব ? অসম্ভব, ইমপসিবল। আজ তো দূরের কথা, গোটা সপ্তাহ আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা সব ফরেনে। নেক্সট উইকে চেষ্টা করব। তাও মনে হচ্ছে না হবে। আপনার প্রবলেম শুনে মনে হচ্ছে, ভাইরাস ঢুকেছে। ক্লিন করতে হবে। প্রথমে কোন ভাইরাস ঢুকেছে দেখতে হবে। কাজটা গোলমেলে স্যার। সাউথ আমেরিকা থেকে জাপান হয়ে এক ধরনের ভাইরাস ইন্ডিয়াতে ঢুকে পড়েছে। সেটা যদি হয় তো আপনি গেছেন। আর তা যদি না হয়ে ইউরোপিয়ান কোনও ভাইরাস হয় তা হলে কাজ কিছুটা সহজ হবে। সেরকম হলে জাপান কনসুলেটের সঙ্গে কথা বলে সরাসরি টোকিওতে ফ্যাক্স পাঠাতে হবে। মাস দুই-তিন লেগে যাবে মনে হচ্ছে। কম্পিউটার নিয়ে কাজ করছেন স্যার, ভাইরাসে ঘাবড়ে গেলে চলবে? মাথা ঠান্ডা রাখুন। চিন্তার কিছু নেই।’
রাত অনেক হল। একা একা বাড়ি ফিরছে চন্দ্রনাথ। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। রত্না একটা কথাও না বলে চলে গেছে। মিস্টার গাঙ্গুরিয়ার সন্দেহ মেশিন কেনা-বেচায় বড় কোনও গোলমাল হয়েছে। নইলে প্রথমদিনেই কেন বিগড়োবে? তিনি চন্দ্রনাথের কাছে হিসেব বুঝে নিতে চান।
এত রাতেও বিশ্বনাথবাবু বারান্দায় বসে। তিনি ছেলের জন্যে অপেক্ষা করছেন। চন্দ্রনাথ ফিরলে তাকে একটা জরুরি কথা বলতে হবে।বলতে হবে—‘ভাবিস না খোকা। হোটেলের সাইনবোর্ড ছাদে তোলা আছে। কাল ভোরে অন্ধকার থাকতে থাকতে দু’জনে মিলে গিয়ে লাগিয়ে দেব। তুই ববং কালকের জন্যে ঠান্ডা মাথায় একটা স্পেশাল আইটেম ভেবে ফেল দেখি। আচ্ছা বড়ি দিয়ে সুক্তো করলে কেমন হবে? ভালই হবে মনে হচ্ছে। তুই অবশ্য অন্য কিছুও ভাবতে পারিস। ঠিক আছে, তোকে আধঘণ্টা সময় দিলাম।ওনলি হাফ অ্যান আওয়ার।’
বিশ্বনাথ সামন্ত অপেক্ষা করছেন।