ছয়
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, থেকে থেকে তুষার ঝরছে। বাতাসে ছুরির ধার। দু’দিন এক রাত ধরে চলল কোচ। গরম কোটের ভেতর গুটিসুটি মেরে, গল্প করে, ঘুমিয়ে, কেঁপে, সকলে পার করে দিল সময়।
পথের ধারে বিভিন্ন সরাইখানায় বার কয়েক থেমেছে কোচ। ঘোড়া বদলে নেয়ার ফাঁকে যাত্রীরা নেমে হাত-পা টান টান করার সুযোগ পেয়েছে। সরাইখানাতেই ডান হাতের কাজ সেরেছে ওরা, শহরের লোকজনের সঙ্গে আড্ডা মেরেছে।
যাত্রাপথে ছোটখাট অ্যাডভেঞ্চারও হয়ে গেছে। ঘন তুষারে দেবে ভেঙে গেল, কোচ। কাছের সরাইখানা থেকে আরেকটা আনিয়ে জোড়া হয়েছে। সন্ত্রস্ত ঘোড়াদের আয়ত্তে রাখতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে নিকোলাস।
পরদিন সন্ধ্যে ছ’টায় গ্রেটা ব্ৰিজে পৌঁছল কোচ।
মিস্টার স্কুয়্যারস, নিকোলাস ও ছাত্রদের লটবহর তোলা হলো সরাইখানায়।
এখানে নিকোলাস ও মিস্টার স্কুয়্যারস একটি কার্টে চাপলেন, ছাত্ররা ও মালপত্র উঠল আরেকটিতে। তীব্র শীতের মধ্যে আরও মাইল তিনেক চলার পর অবশেষে পৌঁছানো গেল স্কুলে।
একতলা স্কুল বাড়িটি লম্বা, আঁধার মত। পেছনে কয়েকটা ফার্ম বিল্ডিং।
‘কই হে, স্মাইক?’ হেঁড়ে গলায় চেঁচালেন স্কুয়্যারস। ‘কোথায় গেলে?’
মিনিট দুয়েকের অপেক্ষার পর কাউকে উঠনের গেট খুলতে শোনা গেল। প্রদীপ হাতে লম্বা, পাতলা একটি ছেলে বেরিয়ে এসেছে। স্কুয়্যারস কার্ট থেকে নেমে ওকে ঘোড়াগুলো সামলানোর নির্দেশ দিলেন। তারপর নিকোলাসকে সামনের দরজায় দাঁড়াতে বলে কোণ ঘুরে ঢুকে পড়লেন নিজে।
তুষারে দাঁড়ানো নিকোলাসের মনে নানা ভয়ঙ্কর ভাবনা ভিড় জমাল। বাড়ি আর প্রিয়জনদের ছেড়ে এতদূর চলে এসেছে ও। অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িটির কালো জানালাগুলো আরও কাবু করে দিচ্ছে ওকে।
‘এসো, নিকোলাস, দরজা থেকে ডাকলেন স্কুয়্যারস। ‘বাতাসের ঝাপটায় দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল!’ দ্রুত পা চালাল নিকোলাস। ওকে ছোট, প্রায় আসবাবহীন একটি ঘরে নিয়ে এলেন স্কুয়্যারস। গোটা কয়েক চেয়ার-টেবিল এলোমেলো অবস্থায় পড়ে রয়েছে, দেয়াল থেকে ঝুলছে হলদে একটি ম্যাপ। টেবিলে ছড়ানো দেখা গেল স্কুলের কিছু বই, আরেকটিতে খাবার।
মুহূর্তখানেক পরই প্রায় ধেয়ে এসে ঢুকলেন এক মহিলা, মিস্টার স্কুয়্যারসের গলা পেঁচিয়ে ধরে চকাস চকাস করে চুমু খেলেন। ভদ্রমহিলা মিস্টার স্কুয়্যারসের চেয়ে লম্বা, মোটাও। রাত্রিবাসের ওপরে কোট পরেছেন, কার্ল পেপারে বাঁধা চুল। মাথায় নোংরা একটা নাইট ক্যাপও আছে।
‘আমার স্কুয়্যারী কেমন আছে?’ কৌতুকপূর্ণ ভঙ্গিতে বললেন মহিলা।
‘ভাল, মাই লাভ,’ জবাব দিলেন স্কুয়্যারস। ‘গরুগুলোর কি খবর?’
‘সব ঠিক আছে,’ জবাব দিলেন মহিলা, ‘শুয়োরগুলোও।’
‘বাঁচা গেল,’ কোট খুলে বললেন স্কুয়্যারস। ‘ছেলেরাও ভাল আছে নিশ্চয়?’
‘ও হ্যাঁ,’ ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে জানালেন মহিলা। ‘পিচার ছোঁড়াটার জ্বর হয়েছিল। কিছু না কিছু সব সময় বাধিয়েই রাখে। আমার মনে হয় ইচ্ছে করেই। আচ্ছাসে একদিন বেতিয়ে দিয়ো তো।’
‘দেখবখন,’ বললেন স্কুয়্যারস।
ওঁদের কথার সময় ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল নিকোলাস, বুঝে পাচ্ছিল না কি করবে। স্কুয়্যারস এবার পরিচয় করিয়ে দিলেন ওকে।
‘এ আমাদের নতুন টীচার, মাই ডিয়ার,’ বললেন।
‘ও,’ জবাবে বললেন মিসেস, নিকোলাসের উদ্দেশে নড করলেন। জরিপ করছেন আপাদমস্তক।
‘ও আমাদের সঙ্গে রাতে খাবে। কাল সকালে ছেলেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব,’ বললেন স্কুয়্যারস। ‘বিছানার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে না?’
‘পারতে হবে,’ বললেন মিসেস স্কুয়্যারস। ‘বিছানা নিয়ে মাথা ঘামাও না তো আবার?’
‘না, না,’ জবাবে বলল নিকোলাস।
‘বাঁচলে,’ বললেন মহিলা। স্বামী-স্ত্রী অট্টহাসি করলেন। মনে হলো, আশা করছেন নিকোলাসও যোগ দেবে।
দু’জনে আরও খানিক কথা হলো। একটু পরে এক কাজের মেয়ে খাবার নিয়ে এল। স্মাইকও এসেছে, খাবার সাজাতে।
ছাত্রদের নামে আসা চিঠিগুলো কোটের পকেট থেকে বার করলেন স্কুয়্যারস। সেদিকে উদ্বিগ্ন চাহনি হানল স্মাইক, আশঙ্কা করছে কোনটা তারও হতে পারে। ছেলেটির বেদনার দৃষ্টি নজর কাড়ল নিকোলাসের।
ভাল করে স্মাইককে লক্ষ করল ও। অদ্ভুত ধরনের পোশাক ওর পরনে। আঠারো বছরের ছেলেটির গায়ে কিশোরদের সুট। জুতোজোড়া বহুব্যবহারে জীর্ণ, ভিখিরিরও অনুপযুক্ত। এক পায়ে আঘাতও আছে। ঈশ্বর জানেন কবে থেকে এই স্কুলে আছে সে। অনেক বছর আগে পরে আসা পোশাকটি এখনও নামাতে পারেনি গা থেকে।
টেবিল সাজানোর অজুহাতে আবারও চিঠিগুলো দেখার চেষ্টা করল স্মাইক। দুঃখী ছেলেটির দিক থেকে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল নিকোলাস। ওর মন কেমন করছে।
‘এখানে কি করছ, স্মাইক?’ গলা চড়িয়ে প্রশ্ন করলেন স্কুয়্যারস। ‘কাজে বাধা দিচ্ছ কেন?’
‘স্যার,’ কাঁচুমাচু হয়ে বলল স্মাইক, ‘কোন চিঠি-টিঠি- আমার ব্যাপারে কিছু শুনেছেন?’
‘কিছুই না,’ বললেন স্কুয়্যারস, ‘শুনবও না। ছ’বছরের পর থেকে কেউ তোমার খোঁজ খবর নেয়নি, টাকা পাঠায়নি— আজব না? তোমার মত একটা ধেড়ে ছেলেকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে হচ্ছে, একটা পয়সাও আসছে না পকেটে।’
ছেলেটি মাথায় হাত দিয়ে কিছু যেন ভাবতে চাইল। তারপর ধীরে ধীরে আহত পা-টা টেনে বেরিয়ে গেল।
এ ঘটনার পরে খাওয়ায় মন বসল না নিকোলাসের। শুনতে পেল মিসেস স্কুয়্যারস নবাগত পাঁচ ছাত্রের পোশাক ‘নিরাপদে তুলে রাখতে’ নিয়ে নিলেন, আর পরিজ খেতে দিলেন ওদের। পরে ছেলেগুলো ছোট্ট একটা বিছানায় গাদাগাদি করে শুয়ে শীত তাড়াল, স্বপ্ন দেখল সুস্বাদু খাবারের।
শেষ পর্যন্ত, মিস্টার স্কুয়্যারস ঘোষণা করলেন শুতে যাওয়ার সময় হয়েছে। মিসেস স্কুয়্যারস চাকরকে দিয়ে নিকোলাসের বিছানাপত্র আনালেন। ‘কাল তোমার নিজের শোবার ঘর পাবে,’ বললেন স্কুয়্যারস। ব্রুকের সঙ্গে কে শুচ্ছে?’
‘ব্রুকের বিছানায়,’ জানালেন মিসেস স্কুয়্যারস, ‘জেনিংস, বোল্ডার, গ্রেমার্শ আর অন্যরা থাকে।’
‘ও,’ বললেন স্কুয়্যারস, ‘জায়গা নেই দেখছি।’
‘কতজন শোয় এক বিছানায়?’ ভাবল নিকোলাস।
‘কাল দেখা হবে,’ বললেন স্কুয়্যারস। ‘গুড নাইট, নিকোলাস। সকাল সাতটায় তৈরি থেকো।’
‘থাকব, স্যার,’ জবাব দিল নিকোলাস। ‘গুড নাইট।’
‘নিজে এসে তোমাকে পাম্প দেখিয়ে দেব,’ বললেন স্কুয়্যারস, ‘রান্নাঘরের জানালায় সাবানও পাবে। তবে কার সঙ্গে তোয়ালে শেয়ার করবে জানি না, মিসেস স্কুয়্যারস সেটা দেখবেন।’ চোখ খুলল নিকোলাসের, মুখ নয়। নিজের জন্যে আলাদা একটা তোয়ালেও কি জুটবে না ওর ভাগ্যে? একাকী ঘরে খানিকক্ষণ পায়চারি করল ও। মন একটু শান্ত হলে চেয়ারে বসল। সব মেনে নেবে ও। তবু মা-বোনকে কথা শোনানোর সুযোগ দেবে না চাচাকে।
শুতে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে, একটা চিঠি খসে পড়ল কোটের পকেট থেকে। কোচের সেই আজব লোকটার কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল। নোংরা কাগজে, জঘন্য হাতের লেখায় একটি চিঠি।
চিঠিটি এরকম:
‘প্ৰিয় নিকোলাস,
আমি দুনিয়াকে চিনি। তোমার বাবা চিনতেন না। তুমিও চেনো না, চিনলে চাকরিটা নিতে না। আমার জন্যে অনেক করেছেন তোমার বাবা, বিনিময়ে কিছু পাননি।
লণ্ডনে আশ্রয়ের প্রয়োজন হলে গোল্ডেন স্কুয়্যারের ক্রাউন ইনে যখন খুশি চলে আসবে। ওরা জানে আমার ঠিকানা। রাতে আসতে পারো।
ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ো। বানান ভুলের কথা নাই বা বললাম।
নিউম্যান নগস।’
চিঠিটা ভাঁজ করে সযত্নে পকেটে রেখে দিল নিকোলাস। নিজের অজান্তেই চোখের কোণ দুটো ভিজে গেছে ওর।