নিকোলাস নিকলবি – ১৮

আঠারো

এক সন্ধ্যেয় লণ্ডনের পথে হাঁটছেন রালফ। হঠাৎ করে জমাট মেঘ মুষলধারে বর্ষণ শুরু করল। একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিলেন ভদ্রলোক। লক্ষ করেননি, তাঁকে অনুসরণ করা হয়েছে। 

গাছের গায়ে হেলান দিয়ে আছেন, কে যেন নাম ধরে ডাকল। মুখ তুলে চেয়েই বিস্ময়ে দু’পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। কালো, কুঁজো, ক্ষুধার্ত চেহারার এক লোক সামনে দাঁড়ানো। 

‘চিনতে পেরেছেন?’ জানতে চাইল লোকটি। ‘বহুদিন পর দেখা যদিও, না চেনার তো কথা নয়।’ 

‘তা তো বটেই,’ ফ্যাসফেসে শোনাল রালফের কণ্ঠ। ‘কি চান আপনি?’

‘সাহায্য,’ বলল লোকটি। ‘আপনার হয়ে কম কাজ তো করিনি। এখন আমার বড় দুরবস্থা। বড্ড খিদের কষ্ট, কিছু টাকা দিন–রুটি কিনব!’ শেষ দিকে কেঁপে গেল লোকটির কণ্ঠ। 

‘কাজ করে খান, মিস্টার ব্রুকার’ বললেন রালফ। হাত পাতবেন-না | 

‘কাজ পাব কই?’ বলল ব্রুকাব। আট বছর জেল খেটেছি। কাজ দেবেন আপনি? 

‘অসৎ হলেও, কেরানী হিসেবে খারাপ ছিলেন না আপনি। কিন্তু আমার অফিসে এখন জায়গা খালি নেই।’ 

‘ধরুন, আপনাকে যদি এমন একটা খবর দিই, যেটা আপনার কল্পনাতেও নেই, আর আমি ছাড়া অন্য কেউ জানেও না, তাহলেও সাহায্য করবেন না?’ 

‘শোনেন,’ ব্রুকার রাগতস্বরে বললেন রালফ। ‘আপনাকে ভালই চেনা আছে আমার। আপনি থাকুন আপনার গোপন খবর নিয়ে! আমাকে অত সহজে ঠকাতে পারবেন না!’ 

‘রক্তের সম্পর্কের মানুষরা আপনার প্রিয় নয়?’ জানতে চাইল লোকটি। 

‘না’ নিকোলাসের কথা ভেবে সাফ জানিয়ে দিলেন রালফ। ‘ভিক্ষা মাঙতে এসে থাকলে, পুরানো কর্মচারী হিসেবে ছ’ পেন্স পর্যন্ত দিতে পারি। কিন্তু বোকা বানিয়ে পয়সা আদায় করতে পারবেন না।’ ভ্রূ কুঁচকে সাবেক কেবানীর দিকে একবার চেয়ে হাঁটা ধরলেন রালফ। 

ব্রুকার তাঁর গমনপথের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটায় হুঁশ ফিরল ওর। হিড়হিড় করে কাঁপতে কাঁপতে পথচারীদের কাছে হাত পাতল ও।

এ ঘটনার অল্প ক’দিন পরে এক সুদখোর দেখা করতে এল রালফের অফিসে। সত্তরের কাছাকাছি বয়স তার, খাড়া নাক আর চিবুকে রীতিমত খলনায়কের মত দেখায়। 

‘কেমন আছেন, মিস্টার গ্রাইড’ বললেন রালফ। ‘অনেকদিন পর দেখা। তা কি জন্যে এসেছেন বলে ফেলুন। সময় কম।‘ 

‘বলছি বলছি’ বলল লোকটি। ‘যদি বলি, আমি বিয়ে করব ভেবেছি, চমকে যাবেন?’

‘না। পয়সাঅলা বুড়ি বিধবা বাগিয়েছেন?’ 

‘না, না,’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল গ্রাইড। মনের আনন্দ চাপতে দু’হাত ঘষছে। ‘উনিশ বছরের এক সুন্দরী।‘ 

‘তা কে সেই বেচারী?’ 

‘জানতাম আপনার কৌতূহল হবে,’ বলল বৃদ্ধ। ‘কেউ শুনছে না তো? মিস্টার নগসের আবার যা ছোঁক ছোঁক করার স্বভাব—’ দরজাটা বন্ধ করে এল। 

‘বলুন কি বলবেন!’ 

 ‘মেয়েটার নাম ম্যাডেলিন ব্রে’ বলছে বুড়ো। ‘ব্রের কথা ভুলে যাননি নিশ্চয়ই? দু’জনেই ব্যবসা করেছি ওর সঙ্গে। আপনি তো টাকাও পান ওর কাছে।’ 

রালফের আগ্রহ এবার বহু গুণ বেড়ে গেল। ‘ওর মেয়ের কথা বলছেন? হ্যাঁ, এর কাছে ন’শো পাউন্ডের বেশি পাব।’ 

‘আমি পাব সতেরোশো পাউণ্ড!’ বলল সুদখোর। ‘এখন আমার প্ল্যানটা বলছি, শুনুন। মেয়েটা বাপের কথায় ওঠবস করে। ব্রেকে যদি বলি, আমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে সব ধার মাফ করে দেব, রাজি হবে না?’ 

‘ঝেড়ে কাসুন!’ 

‘কাশছি!’ মৃদু হাসল বুড়ো। ‘বাপটার কাছে কথা পাড়ার জন্যে একজন ঘটক চাই আমার। সেজন্যে আপনি হচ্ছেন সেরা লোক। আপনারও যদি কিছু নগদপ্রাপ্তি ঘটে তো এ কাজে নিশ্চয়ই আপত্তি থাকবে না?’ 

‘এতসবের পেছনে নিশ্চয়ই আরও কোন কারণ আছে,’ বললেন রালফ। 

‘আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি বলে বলিনি,’ বলল গ্রাইড। কিন্তু জিজ্ঞেস যখন করলেনই, তখন বলে ফেলি। মেয়েটার কপালে সামান্য কিছু সম্পত্তি জুটবে- কেউ জানে না ব্যাপারটা–ওর স্বামীই তো পাবে সব, তাই না? এবার নিশ্চয়ই-’ 

‘পরিষ্কার বুঝেছি,’ সংক্ষেপে জানালেন রালফ। ‘আমাকে একটু ভাবতে দিন। আপনাকে সাহায্য করলেই তো হবে না, নিজের পকেটের কথাও ভাবতে হবে।‘ 

‘একটু কম করে ভাববেন’ অনুনয় জুড়ল বৃদ্ধ। ‘ব্রের প্রতি পাউণ্ডের জন্যে দশ শিলিং করে দেব। এর বেশি হলে একদম মারা পড়ব!’ 

রালফ বুড়োর কথা কানেই তুললেন না। দীর্ঘ কয়েকটি মিনিট গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। ‘ওই মেয়েকে বিয়ে করলে মিস্টার ব্রের সমস্ত ঋণ শুধতে হবে আপনাকে। আর আমার ঘটকালির ফি বাবদ আরও পাঁচশো পাউণ্ড। বিয়ের দিন দুটোর টাকাই মিটিয়ে দেবেন- লিখিত থাকবে শর্তটা। এখন ভেবে দেখুন, কি করবেন। ব্রের কাছ থেকে পাওনা ঠিকই য়াদায় করতে পারব আমি, কোনভাবে না কোনভাবে।‘ 

গ্রাইড কাতরকণ্ঠে বেশ খানিকক্ষণ দর কষাকার্য করল, কিন্তু রালফ কানে তুলো গুঁজে রইলেন। শীঘ্রি চুক্তিপত্রে সই-সাবুদ হয়ে গেল। দু’জন যাত্রা করল ব্রের বাড়ির দিকে। 

নিউম্যান নগস এবার বেরিয়ে এল কাবার্ড ছেড়ে, ঘাপটি মেরে ছিল ভেতরে। মাথা নাড়ল সে। ‘মেয়েটা কে জানি না। কিন্তু বেচারীকে সাহায্য করতে হবে যেভাবে হোক। গ্রাইড আর রালফ নিকলবি! এদের চেয়ে বদ জুটি আর হতে পারে না!’ মনে মনে বলল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *