চৌদ্দ
পুরানো বান্ধবী মিস লা ক্রিভির সঙ্গে আবার জমে উঠল ওদের। স্মাইক কৃতজ্ঞচিত্তে বাড়ির কাজে মন দিল। আর কেউ খুশি মনে চাকরি ছেড়ে দিয়ে মাকে সঙ্গ দিতে লাগল।
নিকোলাস কিন্তু উদ্বিগ্ন। যে সামান্য সঞ্চয় ছিল তা শেষ হতে চলেছে। ফলে, কাজের খোঁজ করতে লাগল ও।
একদিন সকালে, একটি রেজিস্টার অফিসের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপন দেখছে সে। চাকরির বিজ্ঞাপন। হঠাৎ খেয়াল হলো এক বৃদ্ধও চেয়ে রয়েছেন জানালাটার দিকে। ভদ্রলোকের বন্ধুত্বপূর্ণ চোখে চোখ পড়ল নিকোলাসের;–
‘চাকরি খুঁজছ?’ মৃদু হেসে জানতে চাইলেন বৃদ্ধ। ‘কেন, বাবা নেই?’
নিকোলাস এবার খুলে বলল। জানাল, বাবা মারা যাওয়ার পর মা-বোনের দায়িত্ব ওর ওপরেই বর্তেছে। ও যে শিক্ষিত ছেলে সে কথাও জানাতে ভুল করল না।
‘শিক্ষাই মানুষের সেরা অলঙ্কার, বুঝলে?’ বললেন বৃদ্ধ। ‘আমার ওটা নেই। এখনও মনে আছে, খালি পায়ে লণ্ডনে এসেছিলাম। আপত্তি না থাকলে তোমার সব কথা আমাকে জানাতে পারো। ভদ্রলোকের কণ্ঠে এমন একটা কিছু আছে যার ফলে আপত্তি করতে পারল না নিকোলাস। গভীর মনোযোগে শুনলেন তিনি, তারপর ওর একটা হাত চেপে ধরলেন।
‘এসো আমার সঙ্গে,’ বললেন, ‘সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না!’ নিকোলাসকে নিয়ে তখুনি পা বাড়ালেন প্রেডনিডল স্ট্রীটের উদ্দেশে। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে এলেন।
ভেতরে ঢোকার মুখে দরজায় লাগানো ‘চিয়ারিবল ব্রাদার্স’, লেখাটা নজর কাড়ল নিকোলাসের। অনুমান করলা মস্ত বণিক এঁরা। অনেকগুলো প্যাকিং কেস এবং স্টোরম্যানকেও দেখতে পেল ভেতরে ঢুকে। অফিসরূমে একজন মোটা মত বুড়ো কেরানী বসে আছে, রূপালী ফ্রেমের চশমাটা পিছলে নাকের ওপর নেমে এসেছে।
‘ভাই কি রূমে আছে, টিম?’ প্রশ্ন করলেন মিস্টার চিয়ারিবল।
‘আছেন, স্যার,’ বলল কেরানী। ‘তবে মিস্টার ট্রিমার্স তাঁর ঘরে গেছেন সকালে যে লোকটা জাহাজে মাল তোলার সময় মারা গেছে, ওর পরিবারের জানো সাহায্য চাইতে এসেছেন।’
‘ট্রিমার্সের মনটা বড় ডাল নিকোলাসকে বললেন, মিস্টার চিয়ারিবল আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বহু অভাবী লোকের কথা জানতেও পারতাম না, ও না থাকলে।‘ ঠিক সে মুহূর্তে ট্রিমার্স বেরিয়ে এলে করমর্দন করলেন দু’বন্ধু, ‘লোকটার ছেলেমেয়ে ক’টা ট্রিমার্স? নেড কত দিল?’
‘ছ’টা,’ জানালেন ভদ্রলোক। তোমার ভাই বিশ পাউণ্ড দিয়েছে।
‘আমার নামেও বিশ পাউণ্ড লেখো, ট্রিমার্স। আহা, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেছে বেচারা। ঈশ্বর তোমার ভাল করবেন, ট্রিমার্স। একদিন এসো না, আমাদের সঙ্গে ডিনার করবে।’
‘দুনিয়াতে ভালমানুষও কম নেই,’ ভাবল নিকোলাস। এঁরা দু’জন ওর অন্তর ছুঁয়েছেন। শীঘ্রিই ওকে আরেকটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। মিস্টার নেড চিয়ারিবল উঠে দাঁড়িয়ে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। ভদ্রলোক অবিকল তাঁর ভাইয়ের মত দেখতে। কোন সন্দেহ নেই, যমজ।
‘নেড,’ বললেন চার্লস চিয়ারিবল, ‘এই ছেলেটাকে একটা চাকরি দিতে চাই।’ ভাইয়ের মুখে নিকোলাসের জীবন বৃত্তান্ত শুনে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেন না নেড। পুরানো কেরানী টিম বুড়ো হয়ে গেছে। তাকে পেনশন দিয়ে সে জায়গায় নিকোলাসকে নেয়া হবে।
টিম লিঙ্কিনওয়াটারকে ডেকে পাঠানো হলো। নিকোলাস চাকরি করবে শুনে খুশি হলো সে, কিন্তু পেনশনের কথা কানেই তুলল না। কাজ ছাড়বে না।
‘গত চুয়াল্লিশটা বছর ধরে এই কোম্পানীতে কাজ করছি। আমি এখানেই মরতে চাই।’ কথাগুলো বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেল টিম।
ফলে, নিকোলাসের জন্যে অন্য কাজের ব্যবস্থা করতে হলো দু’ভাইকে। ওঁদেরকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ জানাল নিকোলাস।
সে রাতে বাড়িতে খুশির বন্যা বয়ে গেল। নিকোলাস বছরে একশো বিশ পাউণ্ড কামাই করবে শুনে মা-বোনের মুখে হাসি ধরে না।
এতেই সৌভাগ্যের শেষ নয়। ক’দিন পর চিয়ারিবলরা তাঁদের একটি পুরানো কটেজে নিকোলাসের পরিবারকে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন যৎসামান্য ভাড়ার বিনিময়ে।