পনেরো
ক’সপ্তাহ পর বুক কীপিঙে পাকা হয়ে উঠল নিকেলাস। কাজে এত বেশি আনন্দ পাচ্ছে যে নিজের কপালকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। চিয়ারিবলদের কর্মচারীরা সবাই চমৎকার মানুষ— মালিকদের মতই।
ইতোমধ্যে বাসা বদলে বো-তে চলে এসেছে নিকোলাসরা। চার্লস চিয়ারিবল এলেন একদিন বেড়াতে। জানালেন, রালফ নিকলবি নাকি দেখা করেছেন ওঁদের সঙ্গে। ‘তোমার নামে নালিশ করতে এসেছিলেন,’ বললেন। ‘কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি। নেড তাঁর কথায় তো কান দেয়ইনি, উল্টে দু’কথা শুনিয়ে দিয়েছে।’
‘আমি যে কিভাবে আপনাদের ঋণ শোধ করব।’ বলল নিকোলাস, ওর প্রতি মালিকদের আস্থায় শ্রদ্ধায় অবনত সে।
চুপ করে থেকে বললেন বৃদ্ধ, হাসছেন। ‘তোমার সঙ্গে ডারুরী আলাপ আছে। একটা কাজ করে দিতে হবে।’
‘বলুন কি কাজ,’ পরম সংগ্রহে বলল নিকোলাস।
‘একটা মেসেজ পৌঁছে দিতে হবে- সুন্দরী একটা মেয়েকে,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘তুমিও দেখেছ তাকে। কি মনে আছে?’
‘অফিসে তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওই চেহারা কি ভোলা যায়?’ বলল নিকোলাস। প্রায়ই ওর ভাবনা-চিন্তায় জুড়ে বসে মেয়েটি।
‘ও হচ্ছে আমার প্রাক্তন প্রেমিকার মেয়ে,’ বললেন চার্লস। ‘যে কারণেই হোক ওর মাকে বিয়ে করতে পারিনি। মহিলা মারা গেছে, বিবাহিত জীবনে সুখী হতে পারেনি। ওর স্বামী মেয়েকে নিয়ে থাকে–প্রায়ই মেয়েটা আমার কাছে সাহায্য চাইতে আসে। ওর বাবার নাম মিস্টার ব্রে। আমাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। যদি জানতে পারে, মেয়ে আমার কাছে আসে তবেই সেরেছে, মেয়েটাকে তিষ্ঠোতে দেবে না। ছবি এঁকে, সেলাই করে কোনমতে সংসার চালায় বেচারী।’
তো, দু’ভাই পরিকল্পনা করেছেন, মেয়েটির ছবিগুলো চড়া দামে কিনে নেবেন। নিজেদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় বলে নিকোলাসকে পাঠাচ্ছেন।
ঠিকানা জেনে নিয়েছে নিকোলাস। পরদিন সকালে, হাজির হয়ে গেল মিস্টার ব্রে-র বাড়িতে। ওপরতলার বৈঠকখানায় বসতে দেয়া হয়েছে ওকে। জানালার পাশে ছোট্ট একটা টেবিলে বসে আছে মেয়েটি। ওর সব কথা জানার পর থেকে আরও বেশি দুর্বলতা অনুভব করছে নিকোলাস। মেয়েটির কাছেই ইজি চেয়ারে বসা এক রুগ্ন লোক। শুকনো, ফ্যাকাসে মুখটা দেখে বোঝার উপায় নেই পঞ্চশ বছরের প্রৌঢ় তিনি, মনে হয় খুনখুনে বুড়ো।
‘ম্যাডেলিন, কে এল রে?’ জানতে চাইলেন মিস্টার ব্রে।
নিকোলাস জানিয়ে দিল ছবি কিনতে এসেছে। টেবিলটার কাছে এসে একটা মুখ বন্ধ খাম রাখল।
‘টাকাটা ঠিক আছে কিনা দেখে নে,’ বললেন প্রৌঢ়। ‘খোল ওটা, মা।’
‘খুলতে হবে না, ঠিকই থাকবে,’ বলল মেয়েটি। চিয়ারিবলরা নিকোলাসকে পাঠাতে পারেন আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
‘আমাকে দেখতে দে। তুই অত শিয়োর হচ্ছিস কি করে? দেখি, পাঁচ পাউণ্ড–ঠিক না?’
‘হ্যাঁ!’ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল ম্যাডেলিন।
‘বেলটা বাজা তো, বেলটা বাজা।’ অসুস্থ লোকটি বললেন। ‘চাকরটাকে বল আমার জন্যে আঙুর, খবরের কাগজ আর গত সপ্তাহের সেই ওয়াইনটার আরেক বোতল আনতে। জলদি কর না!’ তারপর নিকোলাসের দিকে ফিরে কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কি, রিসিটের জন্যে অপেক্ষা করছেন?’
‘দরকার নেই,’ বলল নিকোলাস।
‘দরকার নেই মানে! কি বলতে চান আপনি?’ ত্বরিত আক্রমণ এল। ‘আপনার কি ধারণা টাকাটা আমাদের বখসিস দিয়ে গেলেন? জানেন, আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন? শুনে রাখেন, আপনার চেয়ে পঞ্চাশ গুণ বেশি রোজগার করতাম এককালে। দরকার নেই মানেটা কি?’
‘মানে কিছু না। বেচতে রাজি হলে আপনার মেয়ের কাছ থেকে ভবিষ্যতে আরও ছবি কিনব। তাই অযথা রিসিট নিয়ে বিরক্ত করতে চাই না,’ বলল নিকোলাস।
‘কারও দয়ার দরকার নেই আমার মেয়ের,’ রাগান্বিত মিস্টার ব্রে বললেন। ‘ব্যবসা ব্যবসাই। অ্যাই ম্যাডেলিন, রিসিটটা দিয়ে দে তো। কক্ষনো ওটা দিতে ভুল করবি না।’
মেয়েকে রিসিট লেখার ভান করতে দেখে ভদ্রলোক হেলান দিলেন ইজি চেয়ারে, গজগজ করতে লাগলেন।
‘আবার কবে আসব?’ কাগজটা নিয়ে জিজ্ঞেস করল নিকোলাস।
‘তিন-চার সপ্তাহ পরে,’ বলল মেয়েটি।
‘কিসের তিন-চার সপ্তাহ?’ ঘাড় কাত করে প্রশ্ন করলেন প্রৌঢ়। ‘আপনি এক সপ্তাহ পরেই আবার আসবেন।’
নিকোলাস বাউ করে ঘর ছাড়ল। সিড়ি বেয়ে নামছে, ওপর থেকে হালকা পায়ের আওয়াজ কানে এল। পেছন ফিরে চাইলে ম্যাডেলিন জরুরী কণ্ঠে বলল, ‘বাবার মেজাজটা আজ সকাল থেকেই বিগড়ে আছে। ওঁর দুর্ব্যবহারের কথা চিয়ারিবল আঙ্কেলদের বলবেন না, প্লীজ। দোহাই আপনার!’
‘একথা বলার কোন প্রয়োজন ছিল না,’ বলল নিকোলাস
চোখের পানি আড়াল করতে মুখ ফেরাল ম্যাডেলিন, ঘুরে তরতর করে নেমে গেল নিকোলাস। ম্যাডেলিন ব্রে-র সঙ্গে তার পরিচয় পর্ব এভাবেই শেষ হলো।