তেরো
মিস লা ক্রিভি নদীর ধারে কেটদের বাসায় বেড়াতে গেল। গিয়ে দেখে মা-মেয়ের চোখে পানি। রালফ আগেই পৌঁছেছেন সেখানে, ফ্যানীর চিঠি নিয়ে। হাত-পা নেড়ে বলছেন, নিকোলাস কিভাবে তার চাকরিদাতাকে মারধর করে, স্কুলের একটি ছেলেকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে— দুটো অপরাধের জন্যেই গ্রেফতার হতে পারে ও।
‘আমি বিশ্বাস করি না,’ ফুঁপিয়ে উঠল কেট। ‘এ সবই মিথ্যে।’
‘সত্যি যে তার প্রমাণ তো আছেই,’ বললেন চাচা। ‘কোথায় ও? সাধুই যদি হবে তো পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন? নিকোলাস খুনের চেষ্টা করেছিল- তাছাড়া, ছেলে চুরির জন্যেও দায়ী।’
‘বাজে কথা!’ দরজার কাছ থেকে গর্জে উঠল একটি কণ্ঠ। ঘরে ঢুকল নিকোলাস। প্রচণ্ড উত্তেজিত।
বিস্ময়ের ধাক্কায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রালফ। নিকোলাসকে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে দেখে দু’জনের মধ্যখানে বাধা হয়ে দাঁড়াল মিস লা ক্রিভি আর কেট।
‘নিকোলাস, থামো!’ চেঁচাল কেট, ভাইকে জড়িয়ে ধরেছে। ‘মাথা ঠাণ্ডা করো!’
‘কিসের মাথা ঠাণ্ডা!’ বলল নিকোলাস। ‘এই লোকের জন্যে কম ভোগান্তি হয়েছে আমার?’
‘এসব কি হচ্ছে!’ গলা বুজে এল মিসেস নিকলবির। চাচার সঙ্গে বেয়াদবি-’
‘মা, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমারই যত দোষ, বাধা দিয়ে বলল নিকোলাস। ‘সত্যি কথাটা জানো না তুমি। এই লোকটা আমাকে নরকে পাঠিয়েছিল। ওখানে মানুষ বাস করতে পারে না। বাচ্চা ছেলেগুলোর কী যে কষ্ট যদি জানতে। এ লোক সবই জানে!’
‘মিস্টার স্কুয়্যারসের ওপর হামলা করেছ কেন?’ প্রশ্ন করলেন রালফ। ‘লোকটা মরেও যেতে পারত!’
‘একটা ছেলেকে গুণ্ডামির হাত থেকে বাঁচাতে যা দরকার তাই করেছি,’ বলল নিকোলাস। ‘বদমাশটাকে এমন শাস্তি দিয়েছি, জীবনে ভুলবে না।’
‘কিন্তু যে ছেলেটা পালিয়েছে তার কি খবর?’ জানতে চাইল কেট
‘ও আমার কাছে থাকবে। ছেলেটা অসুস্থ।’
‘শুনলেন তো?’ বললেন রালফ। ‘নিজের মুখেই স্বীকার করল! ছেলেটাকে ফিরিয়ে দেবে না?’
‘না, দেব না,’ কঠিন গলায় জানাল নিকোলাস। ‘ওই জঘন্য জায়গায় আর যেতে দেব না ওকে!’ নিকোলাসের কথায় যুক্তি আছে বুঝেই মনে হয় চুপ করে গেলেন রালফ, তর্ক করলেন না।
‘তবে শুনে রাখো,’ বললেন তিনি, ‘তোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু আর না। তোমার মুখ আর দেখতে চাই না আমি।’
.
তো, লণ্ডনে কাজ খুঁজতে লাগল নিকোলাস। জানে, নগসের অঢেল নেই যে স্মাইক আর ওকে দিনের পর দিন টেনে যেতে পারবে। লণ্ডন ছেড়ে দক্ষিণে ভাগ্য পরীক্ষা করতে যাবে ঠিক করল।
দক্ষিণ যাত্রার দিন, মালপত্র হাতে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলল ওরা। স্মাইক কিভাবে ওই স্কুলে গিয়েছিল এবং শৈশবের কথা মনে পড়ে কিনা জানতে চাইল নিকোলাস।
‘সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল,’ বলল স্মাইক, ‘এখনও বৃষ্টি হলে সে দিনের কথা মনে পড়ে।
‘একা নিশ্চয় যাওনি?’ প্রশ্ন করল নিকোলাস। ‘সঙ্গে কে ছিল?’
মনে করে কেঁপে উঠল স্মাইক। ‘একটা লোক। কালো, কুঁজোমত। খুব ভয় পেতাম ওকে। তবে পরে দেখলাম, ওর চেয়ে স্কুলটা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর
‘মায়ের কথা মনে পড়ে না?’
‘না,’ বলল স্মাইক। ‘একেবারেই না।’
‘কোন বাড়ি-টাড়ি?’
‘নাহ্,’ বলল ছেলেটি। ‘শুধু একটা ঘর। মনে আছে, একটা অনেক বড় ঘরে একা শুতাম আমি বিছানার ওপরে একটা ট্র্যাপডোর ছিল। প্রায়ই ভাবতাম দরজাটার ওপাশে কি আছে। এখনও ওই ঘরটাকে নিয়ে ভয়ের স্বপ্ন দেখি।’
ক’দিন বাদে গোড়ালমিঙের একটি সরাইখানায় উঠল ওরা। এখানে একদল উচ্ছল মানুষের দেখা পাওয়া গেল। দলটির নেতা মিস্টার ভিনসেট ক্রামলস- থিয়েটারের লোক। বিভিন্ন শহরে অভিনয় করে বেড়ান। নিকোলাসদের কাজ চাই শুনে ভর্তি করে নিলেন তাঁর দলে।
সুখেই কেটে যাচ্ছিল দিন, বাগড়া দিল নগসের চিঠি। কেট নাকি ভাইকে লণ্ডনে ফিরে যেতে বলেছে। জরুরী ব্যাপার। দেরি না করে স্মাইককে নিয়ে লণ্ডনে চলে এল নিকোলাস।
ওরা সিদ্ধান্ত নিল, রালফ নিকলবির বাসা ছেড়ে দিয়ে আগের জায়গায় ফিরে যাবে।