বিশ
এ ঘটনার কিছুদিন পর স্মাইক অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাঁটতে চলতে পারেই না বলতে গেলে, শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, হাওয়া বদলের জন্যে ওকে গ্রামের দিকে নিয়ে যেতে হবে। নিকোলাস চিয়ারিবলদের একথা জানালে চার্লস বললেন, ‘তবে আর সময় নষ্ট কোরো না। যেভাবে হোক ছেলেটাকে বাঁচাতেই হবে।’
নিকোলাস স্মাইককে ডেভনশায়ারে নিয়ে যাবে ভাবল। ওখানকার আবহাওয়া উষ্ণ, বাতাসও স্বাস্থ্যকর। সকালের কোচে রওনা দিল ওরা। নিকোলাসদের সেই ফার্মের কাছেই থাকার জায়গা পাওয়া গেল। ক’দিন পর খানিকটা উন্নতি দেখা গেল স্মাইকের। নিকোলাস আর কেটের ছেলেবেলার প্রিয় জায়গাগুলো দেখতে পেলে আর কিছু চায় না ও।
একদিন চার্চইয়ার্ডের গাছটার কাছে স্মাইককে নিয়ে গেল নিকোলাস। ‘কেট ছোটবেলায় একবার হারিয়ে গিয়েছিল,’ বলল ও। ‘অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেল এই গাছের নিচে ঘুমিয়ে কাদা। বাবার কবরও এখানে, তাঁর সেরকমই ইচ্ছে ছিল।‘
সে রাতে স্মাইকের শিয়রে বসে আছে নিকোলাস, ছেলেটি ওর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি চাইল। ‘কথা দিন, আমি মারা গেলে ওই গাছটার কাছে আমাকে কবর দেবেন।’
‘ওসব অলক্ষুণে কথা মুখে এনো না,’ বলল নিকোলাস। ‘দেখো, তুমি ক’দিন পরই ভাল হয়ে যাবে।‘ মনে মনে অবশ্য কথা দিল।
ক’সপ্তাহ পরে বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা হারাল স্মাইক। মাঝেমধ্যে ওকে কোলে করে দুপুরের রোদে, বাগানে বেরিয়ে আসে নিকোলাস। স্মাইক গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ে, ও বসে থাকে পাশে।
সূর্যাস্ত দেখতে স্মাইককে একদিন বাগানে নিয়ে এল নিকোলাস। বসে থেকে কখন যে চোখ লেগে এনেছে নিজেও জানে না। হঠাৎ আতঙ্কিত চিৎকার শুনে চমকে জেগে গেল।
‘কি হয়েছে, স্মাইক?’ ঝুঁকে প্রশ্ন করল নিকোলাস। ‘স্বপ্ন দেখেছ?’
‘না, না! মামাকে শক্ত করে ধরে থাকুন। ওদিকে তাকান- ওই যে লোকটা, গাছটার পেছনে!’ নিকোলাসকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল স্মাইক।
‘কই, কেউ তো নেই। ভুল দেখেছ,’ স্মাইককে শান্ত করতে চাইল নিকোলাস।
‘না,’ জবাব এল। ‘আমি নিজের চোখে দেখেছি।‘
‘তুমি শুয়ে পড়ো। ভয় নেই, আমি তো আছি।’
‘মনে আছে?’ নিচু স্বরে বলল স্মাইক। ‘যে লোকটা আমাকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল তার কথা আপনাকে বলেছিলাম? ওই গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে ছিল ও, একটু আগেই।‘
‘একটু ভেবে দেখো,’ বলল নিকোলাস। ‘লোকটা যদি থেকেও থাকে, এত বছর পর তুমি ওকে চিনলে কিভাবে?’
‘ওকে ভোলা যায় না,’ বলল স্মাইক। ‘প্রায়ই তো কল্পনায় দেখি। নিকোলাস বহু চেষ্টা করেও ওর ভুল ভাঙাতে পারল না! বুঝে গেল, আর আশা নেই- প্ৰসাপ বকছে স্মাইক, পৃথিবীর মায়া কাটাতে চলেছে।
শরতের এক শান্ত, পবিত্র দিনে দাফন করা হলো ওকে।
.
লণ্ডনে একাকী বসে আছেন রালফ নিকলবি। তাঁকে একটি অবিশ্বাস্য সত্য শোনানো হয়েছে। স্মাইক তাঁর ছেলে- তাঁরই ঔরসে ওর জন্য।
ব্রুকার ফাঁস করে দিয়েছে গোপন কথা। রালফ নিকলবির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর শিশু স্মাইককে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন মহিলা। পরে তাঁর অনুরোধে, স্কুয়্যারসের স্কুলে স্মাইককে ভর্তি করে দেয় ব্রুকার। আর রালফকে বেশ পরে জানানো হয়, ছেলে মারা গেছে। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা সেই ব্রুকার। স্মাইক ওকেই দেখেছিল।
বড় নির্মম সত্য- ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! স্নলিকে দিয়ে যে মিথ্যাটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন রালফ, সেটি আসলে তাঁর নিজের ক্ষেত্রেই চরম বাস্তব।
ঠাণ্ডা আর হতাশায় কেঁপে উঠে ওপরতলায় চলে এলেন রালফ। বড্ড একা বোধ করছেন। তাঁর ছেলে, একমাত্র সন্তান মারা গেছে বহুদূরে- তাঁরই দু’চোখের বিষ ভাতিজার কোলে মাথা রেখে। ছেলেকে হারিয়েছেন জেনেই কি নিকোলাসকে সহ্য করতে পারতেন না? ছেলে বেঁচে আছে জানলে কি অন্যরকম হত তাঁর জীবন? সন্তানকে ভালবাসলে এবং তার ভালবাসা পেলে কি এতখানি কঠিন হতে পারতেন সবার প্রতি? তাঁকে যে কেউই সহ্য করতে পারে না !
শান্তি কোথায়? কোথায় শাস্তি? পাগলের মত ঘরের চারদিকে চাইলেন তিনি, ট্র্যাপ-ডোরটা চোখে পড়ল।
রাতে, বৃষ্টির ছাঁট যখন জানালার শার্সিতে এসে লাগছে, রালফ নিকলবি তখন ফাঁস পরলেন গলায়।