নিকোলাস নিকলবি – ৪

চার

কফিরূমের জানালায় দাঁড়িয়ে ওয়্যাকফোর্ড স্কুয়্যারস বাইরে চেয়ে রয়েছেন। দু’পকেটে হাত। আকর্ষণীয় লোক নন তিনি। এক চোখ কানা। চেহারার কানা অংশে রাজ্যের ভাঁজ, হাসলে কুৎসিত দেখায়। তিপ্পান্ন বছরের কাছাকাছি তাঁর বয়স, মাঝারি গড়ন। পরনের পোশাকটি মোটেও ফিট করেনি, কোথাও লম্বা, কোথাওবা আবার খাটো। তবে কালো পোশাকটি স্কুল শিক্ষকের পক্ষে মানানসই।

তাঁর পেছনে চেয়ারে একটা কাঠের ট্রাঙ্ক রাখা, দড়ি বাঁধা।

ওটার ওপর বসা এক কিশোর, শূন্যে দোলাচ্ছে দু’পা। কানের কাছে কাঁধ নিয়ে গেছে, হাতজোড়া চেপে ধরে রেখেছে হাঁটু। আড়চোখে প্রায়ই স্কুল শিক্ষকের দিকে চাইছে।

‘সাড়ে তিনটে,’ নিজেকে শোনালেন মিস্টার স্কুয়্যারস। জানালা থেকে সরে কফিরূমের দেয়াল ঘড়ির দিকে চাইলেন। ‘আজ কেউ আসবে বলে মনে হচ্ছে না।’

তিরিক্ষে হয়ে গেল তাঁর মেজাজ। ছোট ছেলেটার দিকে তাকালেন। নিশপিশ করছে হাত। আপত্তিকর কিছু করতে দেখলেই গায়ে হাত তুলবেন। ছেলেটা কিছু করছে না বলে মাথায় একটা গাঁট্টা মারলেন, বারণ করলেন পা দোলাতে।

‘গ্রীষ্মে,’ নিজেকেই আবার বললেন মিস্টার স্কুয়্যারস, ‘দশটা ছোঁড়াকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারমানে দুশো পাউণ্ড। কাল সকাল আটটায় ফিরে যাচ্ছি, অথচ এবার যাচ্ছে মাত্র তিনজন- ষাট পাউণ্ড মাত্র। ছোঁড়াগুলোর হলোটা কি? বাপ-মাগুলো আবার কোন্ ষড়যন্ত্র শুরু করল? কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার।’

ট্রাঙ্কে বসা ছেলেটি হঠাৎ কেশে উঠল খুকখুক করে।

‘কি হচ্ছে কি?’ গর্জালেন স্কুল শিক্ষক।

‘কিছু না, স্যার।’

‘কিছু না?’

‘কেশে ফেলেছিলাম, স্যার,’ কাঁপছে কিশোর, কাঁপন উঠেছে ট্রাঙ্কটাতেও।

‘কেশেছ? তবে ‘কিছু না’ বললে কেন?’

ছেলেটা ভয়ে কেঁদে ফেললে এগিয়ে এলেন স্কুয়্যারস। ঠাস করে এক চড় মেরে ফেলে দিলেন ট্রাঙ্ক থেকে।

‘ইয়র্কশায়ারে চলো আগে, মজা বুঝবে,’ বললেন। ‘শাস্তি পাওনা রইল তোমার, বুঝেছ?’

‘জ্বী, স-স্যার,’ বলল ছেলেটি। রুমাল ঘষছে গালে। ঠিক সে সময় এক ওয়েটার উঁকি দিল ঘরে, জানাল, এক ভদ্রলোক মিস্টার স্কুয়্যারসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

‘এখানে পাঠিয়ে দাও,’ বললেন স্কুয়্যারস, ‘অই ছোঁড়া, রুমাল ঢুকা পকেটে, ‘ হিসহিস করে উঠল তাঁর কণ্ঠ, নইলে লোকটা বিদেয় হলেই তুলোধোনা করব তোকে।

তারপর মুহূর্তে পাল্টে ফেললেন ব্যবহার। ভান করছেন, দেখতে পাননি আগন্তুককে। বলতে লাগলেন, ‘বাবু সোনা, জীবনে সবাইকেই কম বেশি কষ্ট করতে হয়। বন্ধুদের ছেড়ে যেতে একটু খারাপ তো লাগবেই, কিন্তু দেখবে আমি তোমাকে বাবার মতই আদর করব; আর মিসেস স্কুয়্যারস তোমাকে দেবেন মায়ের মমতা। ইয়র্কশায়ারের ডথবয়েজ স্কুলে মজার মজার খাবার, সুন্দর সুন্দর কাপড়, বই, পকেটমানি কী না পাবে—’

রালফ নিকলবি নিকোলাসকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললেন, ‘মিস্টার স্কুয়্যারস, আপনার সঙ্গে জরুরী আলাপ ছিল।’

‘আরে, আপনি?’ অবাক হয়ে গেছেন যেন স্কুয়্যারস। ‘বসুন, বসুন।’

‘চিনেছেন আমাকে?’ চেয়ারে বসে স্কুল শিক্ষকের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চাইলেন রালফ।

‘চিনব না আবার?’ পাল্টা বললেন স্কুয়্যারস। ‘আপনি ডর্কার নামে এক ছেলের পড়ার খরচ জোগাতেন- বেচারা-’

‘মারা গেছে ডথবয়েজ হলে,’ বাক্যটা সম্পূর্ণ করে দিলেন রালফ।

‘মনে পড়ছে,’ মিনমিন করে বললেন স্কুয়্যারস। ‘আহা, আমার মিসেস নিজের ছেলের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন ওকে। অসুস্থতার সময় কী সেবাটাই না করেছেন! ছেলেটা খেতে পারত না, তবু প্রত্যেক রাতে রুটি আর গরম চা নিয়ে যেতেন। মারা যাওয়ার রাতে ওর ঘরে আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন- সেরা ডিকশনারীটা পাঠিয়েছিলেন মাথা রাখার জন্যে- আর কী করতে পারে একটা মানুষ?’

রালফ হাসলেন। তেতো হাসি। জানতে চাইলেন, স্কুলের সহকারী শিক্ষক পদে নিকোলাসকে বিবেচনা করা হবে কিনা।

‘এই যে এ,’ বললেন রালফ, ‘স্কুল ছেড়ে সবে বেরিয়েছে। মাথা ভর্তি বিদ্যা, কিন্তু পকেট খালি! আপনি যেমনটা চান আরকি!’

‘একে দিয়ে চলবে না,’ সাফ বলে দিলেন স্কুয়্যারস। সরল গ্রাম্য যুবকটিকে পছন্দ হয়নি তাঁর।

‘আমার বয়স কম বলে চিন্তা করছেন? নাকি ডিগ্রী নেই বলে?’ জানতে চাইল নিকোলাস।

‘কলেজ ডিগ্রী ছাড়া চলবে না,’ জবাব দিলেন স্কুয়্যারস।

‘কিন্তু একটু ভেবে দেখুন,’ বললেন রালফ, ‘উনিশ বছরের একটা বাপ মরা ছেলে। দুনিয়াদারীর কিছুই বোঝে না, কিন্তু কিছু একটা করতে চাইছে। আমি অনুরোধ করছি, ওকে নিয়ে নিন।’ তারপর অর্থপূর্ণ হেসে বললেন, ‘দেখে বুঝতে পারছেন না, ওকে কতভাবে কাজে লাগানো যাবে?’

‘হুঁ,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন স্কুয়্যারস। রালফের সঙ্গে একান্ত আলোচনার পর তিনি পাকা করে দিলেন নিকোলাসের চাকরি।

‘তোমার চাচার কথায় নিলাম,’ বললেন স্কুলশিক্ষক।

নিকোলাস চাচাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল। স্কুয়্যারসের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করছে।

‘মানুষটা দেখতে একটু অদ্ভুত,’ ভাবল সে। কিন্তু তাতে কি? পড়ুয়া লোকেরা অমন হয়ই!’

‘কাল সকাল আটটায় কোচ ছাড়বে, নিকলবি,’ বললেন স্কুয়্যারস। ‘সকাল সকাল এসে পড়বে। তিনটে ছেলেও যাবে আমাদের সঙ্গে।’

‘নিশ্চয়, স্যার,’ বলল নিকোলাস।

‘তোমার কোচের ভাড়া দিয়ে দেব আমি,’ জানালেন রালফ, ‘কাজেই তোমার কোন চিন্তা নেই। সকালে তোমাকে বিদায় জানাতে আসব।’ চাচার মহত্ত্বে গদগদ হয়ে গেল নিকোলাস।

‘আপনার দয়া জীবনেও ভুলতে পারব না,’ বলল ও।

‘ভোলার চেষ্টাও কোরো না,’ বললেন চাচা। ‘এখন বাড়ি ফিরে সব গোছগাছ করে নাও।’

মা-বোনকে সুসংবাদটা জানানোর জন্যে দ্রুত বাড়ির দিকে পা বাড়াল নিকোলাস। আশা আর উত্তেজনার নাচন ওর বুকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *