নিকোলাস নিকলবি – ১

এক

দুনিয়া ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে। তবে তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা বড় শহরে বাস করে, অথচ মাথা কুটে মরলেও কোন বন্ধুর দেখা পায় না।

মিস্টার গডফ্রে নিকলবির কাছে লণ্ডন তেমনই এক শহর। বছরে আশি পাউণ্ডের মত রোজগার তাঁর। বিয়ে করলেন দেরি করে। দুটো ছেলে জন্মানোর পর, সামান্য আয়ে সংসার চালাতে রীতিমত হিমশিম খেতে লাগলেন।

কিন্তু একদিন সকালে একটা চিঠি পেয়ে হাসি ফুটল তাঁর মুখে। গডফ্রের চাচা ভাতিজার জন্যে পাঁচ হাজার পাউণ্ড রেখে গেছেন। খবরটা নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যকর, কারণ জীবিত অবস্থায় বৃদ্ধ কখনোই গরীব ভাতিজার খোঁজখবর নেননি।

ডেভনশায়ারে একটা ছোট ফার্ম কিনলেন গডফ্রে। বাকি টাকাটা যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখলেন, সে সঙ্গে প্রাণপাত করতে লাগলেন ফার্মে।

ফলে, বছর পনেরো পর মারা যাওয়ার সময় দু’ছেলের জন্যে যৎসামান্য সম্পত্তি রেখে যেতে পারলেন। বড় ছেলে রালফ পেল নগদ তিন হাজার পাউণ্ড, আর ছোট ছেলে নিকোলাসের ভাগে পড়ল ফার্ম এবং এক হাজার পাউণ্ড।

এক্সটারের একটি স্কুলে দু ভাই একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে। আবাসিক স্কুল। বাড়িতে বেড়াতে এলে মায়ের মুখে নানা গল্প শুনতে পেত ওরা- কিভাবে ওদের বাবা দারিদ্র্যের মোকাবিলা করেছেন, এবং তাঁর চাচা কী পরিমাণ ধনী এবং গুরুত্বপূর্ণ লোক ছিলেন— এইসব আরকি 1

এসব গল্প শুনলে দু ভাইয়ের দু’রকম অনুভূতি হত। শান্ত স্বভাবের নিকোলাসের মনে হত, জমকালো জীবনের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে বাবার মত সহজ জীবনযাপনে সন্তুষ্ট থাকাই ভাল। রালফ অবশ্য ভিন্ন মতের অনুসারী। তার মতে, সুখ আর ক্ষমতার জন্যে চাই অর্থ, এবং যে কোন উপায়ে সেটা উপার্জন করা উচিত। কিশোর বয়সেই ব্যবসায়ী বুদ্ধি কাজে লাগাতে শুরু করে সে। তার পেন্সিল, খেলনাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র সুদে ধার দিত। স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিন পর থেকে টাকা-পয়সাও ধার দিতে আরম্ভ করল। ওর নিয়ম ছিল, ‘হাফ পেনির জন্যে দু পেন্স।’ রালফ সম্পর্কে এতসব জেনে পাঠকদের হয়তো মনে হতে পারে ও-ই এ গল্পের নায়ক, কিন্তু আসলে তা নয়। বাবার মৃত্যুর পর রালফ লণ্ডনে এক সওদাগরী অফিসে কাজ নিল। টাকার পিছে ছুটতে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, ছোট ভাইটার কথা ভুলেই গেল বেশ ক’বছরের জন্যে।

নিকোলাস ওদিকে ফার্মে একাকী বাস করতে করতে হাঁফিয়ে উঠেছে। শেষটায় এক প্রতিবেশীর মেয়েকে বিয়ে করল। এক হাজার পাউণ্ড যৌতুক পেল বিয়েতে।

ছেলে ও মেয়ের বয়স যথাক্রমে উনিশ আর চোদ্দ হলে নিকোলাস উপলব্ধি করলেন, ওদের লেখাপড়ার খরচ তাঁর রোজগারের বেশিরভাগটাই খেয়ে নিচ্ছে। আয় বাড়ানোর চিন্তা জাঁকিয়ে বসল তাঁর মাথায়।

‘শেয়ারে খাটাও,’ পরামর্শ দিলেন তাঁর স্ত্রী।

‘শেয়ার?’ চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেছেন নিকোলাস।

‘কেন নয়?’

‘যদি সর্বস্বান্ত হই?’ মৃদু কণ্ঠে বলেছেন নিকোলাস। ‘তবে তো পথে বসতে হবে।’

‘ধ্যাত!’ বলেছেন মিসেস নিকলবি। ‘ছেলেটা বড় হয়েছে না? ও কাজ-কর্মে ঢুকবে। বেচারী মেয়েটার কথাও একটু ভাবো। একটা ফুটো পয়সাও দিতে পারব না ওর বিয়েতে। তোমার ভাই রালফ তো শেয়ারের কারবার করেই অত টাকা কামিয়েছে!’

‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করেছেন নিকলবি। ‘ঠিকই বলেছ। আমিও স্পেকুলেট করব।’

স্পেকুলেশান হচ্ছে জুয়ার মত- লাভ হলে লালে লাল, লোকসান হলে ফতুর। ভাগ্য নিকলবির পক্ষ নিল না। চারজন লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হলো। আর কপাল পুড়ল চারশো লোকের- নিকলবিও তাদের একজন।

‘বাড়িটা যাবে,’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন তিনি। ‘ফার্নিচারগুলোও থাকবে না!’

প্রচণ্ড মনঃকষ্টে ভেঙে পড়লেন তিনি, ফলে বিছানা নিতে হলো।

ডাক্তার, নার্স, উকিল, পাদ্রী, প্রতিবেশীদের সান্ত্বনায়ও কোন লাভ হলো না।

বেশ কিছুদিন ভুগে মারা গেলেন তিনি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *