নিকোলাস নিকলবি – ৩

তিন

রালফ নিকলবি স্ট্র্যাণ্ডের বাড়িটা খুঁজে বার করে জোরে জোরে নক করতে লাগলেন দরজায়। অপেক্ষা করার সময় দরজায় ঝোলানো ছবিগুলোর দিকে চোখ পড়ল। ভেতরে এক শিল্পী থাকে- তারই বিজ্ঞাপন। শেষ পর্যন্ত নোংরা চেহারার এক কাজের মেয়ে খুলে দিল দরজা।

‘মিসেস নিকলবি বাড়ি আছেন?’ বিরক্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন রালফ।

‘তাঁর নাম নিকলবি না,’ বলল মেয়েটি। ‘লা ক্রিভি।’

রালফ কথাটার অর্থ জানতে চাইবেন, এমন সময় এক মহিলা জিজ্ঞেস করল তিনি কি চান। ‘মিসেস নিকলবি? বোকা মেয়ে কোথাকার! তিনতলায় চলে যান!’

তো, খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে দম বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হলো রালফের। শেষটায় পৌঁছলেন মিসেস নিকলবির ঘরে।

তাঁকে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছেন মহিলা। বিধবার পোশাক তাঁর পরনে, এক সুন্দরী তরুণীর বাহুতে হেলান দিয়ে রয়েছেন। মেয়েটির চেয়ে বছর কয়েকের বড় এক যুবক রালফকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এল।

‘ও,’ বললেন রালফ, ‘তুমিই বোধহয় নিকোলাস জুনিয়র?

‘জ্বী, স্যার,’ জবাব এল।

‘আমি রালফ নিকলবি। আমার হ্যাটটা নামিয়ে রাখো তো,’ বললেন তিনি। হ্যাট খোলা হলে মিসেস নিকলবির দিকে ফিরলেন। ‘তা কি খবর? অত ভেঙে পড়েছেন কেন? দুঃখ-কষ্ট সহ্য তো করতেই হবে; আমি সবসময় করি।’

‘কিন্তু মন যে মানে না! আমার এতবড় ক্ষতি হয়ে গেল!’ ফুঁপিয়ে উঠলেন মিসেস নিকলবি।

‘কতবড় ক্ষতি?’ প্রশ্ন ছুঁড়লেন রালফ, কোটের বোতাম খুলছেন। ‘কত মহিলার স্বামী রোজই মরছে। চিঠি পড়ে কিন্তু বোঝা গেল না কোন্ রোগে মরেছে।’

‘ডাক্তাররাও বলতে পারেনি। আসলে মন ভেঙে গেলে মানুষ বাঁচে কখনও?’ অশ্রু গড়াচ্ছে বিধবার গাল বেয়ে।

‘ফুহ্!’ বললেন রালফ। ‘অমন রোগের কথা কস্মিনকালেও শুনিনি। মানুষের ঘাড় ভাঙলে মরে। হাত-পা-নাক ভাঙলে কষ্ট পায়; কিন্তু মন ভাঙা! যত্তসব ফালতু! দেনাদার দেনা শোধ করতে না পারলে মন ভেঙে মরে, রেখে যায় একটা কাঁদুনে বিধবা।

‘কারও কারও মনই থাকে না তো ভাঙবে কি?’ শান্ত স্বরে বলল নিকোলাস। ‘এই ছোকরার বয়স কত?’ জানতে চাইলেন রালফ। মাথা থেকে পা পর্যন্ত জরিপ করছেন নিকোলাসকে। দৃষ্টিতে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য।

‘উনিশ হবে শীঘ্রি,’ জবাবে বললেন বিধবা।

‘ওরেব্বাপ, উনিশ?’ রালফের কণ্ঠে বিস্ময়। তো কি করা-টরা হবে জানতে পারি, স্যার?’

‘যাই করি, মায়ের ঘাড়ে বসে খাব না,’ গর্বের সঙ্গে বলল নিকোলাস।

‘মায়ের থাকলে তো খাবে,’ কাটখোট্টা গলায় বললেন রালফ।

‘আপনি এসব কথা বলার কে?’ রাগে লাল হয়ে গেছে নিকোলাসের মুখ।

‘মুখ সামলে কথা বলবে, ছোকরা,’ বললেন ক্রুদ্ধ রালফ। ‘ভাল, খুব ভাল, ভদ্রতা ভালই শিখেছ- মেহমানের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় শেখায়নি বাপ- মা?’

মিসেস নিকলবি ইশারায় ছেলেকে চুপ থাকতে বললেন। চাচা-ভাতিজা পরস্পরকে মেপে নিল ক’সেকেণ্ড। বয়স্ক লোকটির চেহারায় কঠোরতা আর ক্রোধ ফুটে উঠেছে; যুবকের চেহারা সহজ, স্বাভাবিক। ওর অভিব্যক্তিতে এমন একটা কিছু ছিল, যা তাকে সেই মুহূর্ত থেকে রালফের শত্রুতে পরিণত করল।

‘মিসেস নিকলবি,’ মহিলার দিকে ফিরে বললেন রালফ, ‘টাকা-পয়সা কিছুই বোধহয় নেই আপনাদের?’

‘কিছুই না,’ বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন মহিলা। ‘ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের জন্যে আপনি একটা কিছু করবেন জানি।’

রালফ তখন পায়চারি করছেন।

‘নিঃস্ব লোক মরার সময় নিজের দায়িত্ব অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে যায়। মেয়েটার কোন গুণ-টুন আছে?’

‘কেট পড়াশোনা জানে,’ বললেন মিসেস নিকলবি। ‘এই, তোর চাচাকে বল না, ভাষা কেমন শিখে ফেলেছিস।’

‘থাক, থাক,’ বাধা দিলেন রালফ। ‘ওসব শিখে হবেটা কি? স্কুলে চাকরি আর নাহয় দর্জিগিরি বাঁধা। হুঁহ্, ছেলেমেয়ে দুটোকে মানুষ করতেও পারেনি, আগেই পটল তুলল।’

মাথা হেঁট হয়ে গেল ওদের মায়ের।

‘কাজ করবে?’ ভ্রূ কুঁচকে ভাতিজাকে প্রশ্ন করলেন রালফ।

‘অবশ্যই।’

রালফ পকেট থেকে একটা গোটানো খবরের কাগজ বার করে ভাঁজ খুললেন। পড়লেন একটা বিজ্ঞাপন:

‘শিক্ষা- আপনার ছেলেকে মিস্টার ওয়্যাকফোর্ড স্কুয়্যারসের স্কুলে ভর্তি করুন। ইয়র্কশায়ারের গ্রেটা ব্রিজের কাছে স্কুল, ডথবয়েজ গ্রামে। ছেলেদের থাকা-খাওয়া, পোশাক, বই, পকেটমানি সহ সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস দেয়া হয়। শেখানো হয় সব ভাষা, বিষয় এবং পড়ানো হয় সব ধরনের সাহিত্য। বেতন বছরে মাত্র বিশ পাউণ্ড। ছুটি-ছাটা নেই। পরিবেশিত খাবারের জুড়ি মেলা ভার। মিস্টার স্কুয়্যারস স্নো হিলে অবস্থিত সারাসিনের হেড হোটেলে একটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত উপস্থিত থাকেন। বি: দ্র: একজন সুযোগ্য সহকারী শিক্ষক প্রয়োজন। বার্ষিক বেতন পাঁচ পাউণ্ড। কলা বিভাগের শিক্ষক অধিক কাম্য।’

‘নিকোলাসের কপাল খুলে গেল,’ কাগজটা গুটাতে গুটাতে বললেন রালফ। ‘কিন্তু ও তো আর্টসের মাস্টার নয়,’ বললেন মিসেস নিকলবি

‘বেতনও কম, আর সেই কোন্ মুল্লুকে যেতে হবে,’ মন্তব্য করল কেট। ‘আমি বলছি,’ বললেন রালফ, ‘ওকে চাকরিটা নিতে দাও। পছন্দ না হলে নিজে অন্য কিছু খুঁজে নেবে।’

‘নিকোলাস,’ বললেন মা, ‘তোর চাচা আমাদের ভালই চাইছেন। তোর কি মত?’

‘আমি চলে গেলে, স্যার,’ বলল নিকোলাস, ‘আমার মা-বোনের কি হবে?’

‘তাদের ভার আমি নেব,’ বললেন রালফ। ‘যোগ্যতা দেখাতে পারলে স্কুলের পার্টনারও হয়ে যেতে পারো, অল্প সময়েই!’

‘আমি রাজি,’ উঠে দাঁড়িয়ে খোশমেজাজে জানাল নিকোলাস। ‘মিস্টার স্কুয়্যারসের সঙ্গে এখুনি দেখা করতে চাই!’

মা-বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, চাচার সঙ্গে স্নো হিলের দিকে যাত্রা করল নিকোলাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *