নিকোলাস নিকলবি – ১১

এগারো

দিন গড়ালে ছাত্রদের সঙ্গে মিশে যেতে চেষ্টা করল নিকোলাস। ইতোমধ্যে স্মাইককে বেশ ক’বার উদ্ধার করেছে স্বামী-স্ত্রীর হাত হাত থেকে। স্মাইককে পেটাতে না পেরে নিকোলাসের ওপর মনে মনে মহাখাপ্পা তাঁরা। এরই মাঝে ঘটল একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা।

জানুয়ারির এক ঠাণ্ডা সকালে স্কুল ছেড়ে পালাল স্মাইক।

ওকে স্কুল বিল্ডিঙে খুঁজে না পেয়ে অগত্যা ঘোড়ায় চেপে বেরোলেন স্কুয়্যারস। তাঁর স্থির বিশ্বাস, এই জেলারই কোন রাস্তায় দেখা মিলবে ওর। কিন্তু রাস্তা তো আর একটা নয়, অসংখ্য। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজি করেও ছেলেটির ছায়া দেখা গেল না।

পরদিন সকালে ক্যারিজের ঢাকার শব্দে ঘুম ভাঙল নিকোলাসের। থেমেছে আওয়াজটা। মিসেস স্কুয়্যারসের গলা শোনা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে উঁকি দেয়ার সাহস হচ্ছে না নিকোলাসের, তবু দিল। আরে, স্মাইক না? ওকে ভয়ঙ্কর পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে, শরীরময় কাদা-পানি; চেনা মুশকিল।

‘ওকে ভেতরে নিয়ে এসো,’ চেঁচালেন স্কুয়্যারস। স্কুলে এনে একটা ঘরে বন্দী করা হলো ওকে। মিস্টার স্কুয়্যারস পরে বোঝাপড়া করবেন ওর সঙ্গে।

পলাতক স্মাইকের ধরা পড়া এবং বন্দী হওয়ার খবর মুহূর্তে চাউর হয়ে গেল গোটা স্কুলে। বিকেলে পেট পুরে খেয়ে, সকালে কিনে আনা বেত হাতে স্কুলরূমে এলেন স্কুয়্যারস। পিছু পিছু তাঁর স্ত্রী

‘সবাই আছে এখানে?’ চড়া গলায় জানতে চাইলেন স্কুয়্যারস। আছে, তবে ভয়ে চুঁ শব্দটি করল না কেউ- মেঝের দিকে চোখ সবার।

‘সবাই যে যার জায়গায় বসে পড়ো!’ বললেন স্কুয়্যারস, এবং সপাং করে বেত মারলেন ডেস্কটায়। আঁতকে উঠল ছেলেরা। ‘নিকলবি! তোমার ডেস্কে বসো।’ গোমড়া মুখে আদেশ পালন করল নিকোলাস।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক, খানিক পরেই টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলেন বন্দীকে। ‘তোমার কিছু বলার আছে?’ বেত উঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন। আতঙ্কিত চোখজোড়া সবার ওপর ঘুরাল স্মাইক, এক মুহূর্তের জন্যে ওদুটো স্থির হলো নিকোলাসের চেহারায়। কিন্তু নিকোলাস তখন নিচের দিকে চেয়ে।

‘আমাকে মাফ করে দিন, স্যার! কেঁদে ফেলল স্মাইক। না বুঝে পালিয়েছিলাম।’

‘না বুঝে? অকৃতজ্ঞ কুকুর!’ মিসেস স্কুয়্যারস সজোরে চড় কষালেন অসহায় ছেলেটির গালে। ‘বল, কেন পালিয়েছিলি?’

‘তুমি সরো, মাই ডিয়ার,’ কঠোর গলায় বললেন স্কুয়্যারস। ‘আমি জানি কিভাবে পেটের কথা বার করতে হয়।’ বাঁ হাতে স্মাইকের কব্জি চেপে ধরে নির্দয়ের মত বেতের সদ্ব্যবহার করতে লাগলেন। থেকে থেকে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাকাতর চিৎকার বেরিয়ে আসছে ছেলেটির গলা চিরে। কান দিচ্ছেন না স্কুয়্যারস, মেরেই চলেছেন।

‘থামুন!’ আচমকা গর্জে উঠল একটি চড়া গলা। সীট ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে নিকোলাস, স্কুলরূমটিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার গমগমে কণ্ঠস্বর।

‘কে চেঁচাল?’ চরম ক্রোধে ফিরে চাইলেন স্কুয়্যারস। চোখজোড়া আগুনের মত জ্বলছে।

‘আমি,’ এগিয়ে এসে বলল নিকোলাস। ‘অনেক হয়েছে, আর না।’

‘আর না মানে?’ চিৎকার করে উঠলেন স্কুয়্যারস।

‘আর না মানে, আর না,’ বজ্রকঠিন গলায় বলল নিকোলাস। স্কুয়্যারস এতটাই অবাক হয়েছেন, স্মাইকের হাত ছেড়ে দিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেলেন।

‘ছেলেগুলোর ওপর এতদিন অনেক অত্যাচার করেছেন,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল নিকোলাস। ‘কোনদিন ওদের সুখ-দুঃখের খবর নেননি। কাজেই বাধ্য হয়ে আমাকে নাক গলাতে হলো।

রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে গেলেন স্কুয়্যারস। ‘তুই চুপ থাক, ফকিরের বাচ্চা,’ চেঁচিয়ে উঠলেন। আবার চেপে ধরলেন স্মাইককে।

‘খচ্চর! সাহস থাকলে ওর গায়ে আবার হাত তোল দেখি!’ খেপার মত চিৎকার করল নিকোলাস। ‘আর সহ্য করব না আমি। তোর মত দশটার শক্তি আছে আমার একার গায়ে।’

‘সরে যা, কুত্তা কাঁহাকা!’ বেত উঁচিয়ে চেঁচালেন স্কুয়্যারস।

‘সরব না।’ কড়া গলায় জানাল নিকোলাস। ‘কে একে মারধর করে দেখি। বন্য জন্তুর মত ডাক ছাড়লেন স্কুয়্যারস। তারপর গায়ের সমস্ত শক্তিতে বেতটা বসিয়ে দিলেন নিকোলাসের গালে। তীব্র যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে যুবকটি ঝাঁপিয়ে পড়ল স্কুয়্যারসের ওপর, তারপর বেতটা কেড়ে নিয়ে উন্মাদের মত পেটাতে লাগল ভদ্রলোককে।

‘বাঁচাও, বাঁচাও মেরে ফেলল,’ চিৎকার জুড়লেন স্কুলশিক্ষক। ‘আর কখনও এমন করব না। মাফ চাই।’

একটি ছেলেও নড়ল না একচুল, মিসেস স্কুয়্যারস স্বামীকে টেনে সরিয়ে নিতে ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। ফ্যানী দু’হাতে নিকোলাসকে কিল মেরেও থামাতে পারছে না। বেদম প্রহার করেই চলেছে ও। শেষমেশ হাত ব্যথা হয়ে গেলে প্রচণ্ড দুটো ঘুসি মেরে ক্ষান্ত দিল। দড়াম করে পড়ে গেলেন স্কুয়্যারস, মেঝেতে ঠুকে গেল মাথা। জ্ঞান হারিয়েছেন।

স্কুয়্যারস মরেননি নিশ্চিত হয়ে, গটগট করে স্কুলরূম ছেড়ে বেরিয়ে এল নিকোলাস, চিরদিনের জন্যে। স্মাইককে এদিক ওদিক খুঁজল, কিন্তু ছেলেটি লাপাত্তা।

ওপরে উঠে গিয়ে কাপড়-চোপড় বেঁধে নিল নিকোলাস, তারপর পা বাড়াল স্কুল বিল্ডিঙের বাইরে। কেউ ৰাধা দিতে চেষ্টা করেনি। শীঘ্রিই গ্রেটা ব্রিজের রাস্তায় দেখা গেল ওকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *