কড়িখেলা – ৮

॥ ৮ ॥

দেড় মাসের মধ্যে এই নিয়ে তৃতীয় বার পাড়ায় এল শর্মিলা। একটু কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে? ছ’ বছর এল না, তারপর এত ঘনঘন? গতবারই গায়ত্রী তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছে, “ভানু তোর ওদিকে কি গন্ডগোল হচ্ছে? দেখিস! ভয় করে!”

ভয় কি তারও হচ্ছে না? কিন্তু কত আর ভয় পাবে? সে যে ভিতরে ভিতরে বড্ড একা হয়ে গেছে। আত্মীয় নেই, বন্ধু নেই, সংসারটা ঠিক সংসার নয়। বৈধ স্বামীর কাছে সে যেন ঠিক স্ত্রী নয়, কোথায় যাবে তা হলে সে?

গাড়িটা বিরাট বড়, বিদেশি। আজ এই ব্যাপারেও সে বেশ সাহস দেখিয়ে ফেলল। তাকে অফিস থেকে আজ অন্য ড্রাইভার নিতে এসেছে। সেটাই সুবিধে। হরিন্দর, বিহারি ছেলে। এর সঙ্গে আদিত্যর অত কথা হয় না। এত বড় গাড়ি বাই লেনে ঢুকবে না। ফলে মোহিনীমোহন লেনে ঢোকার মুখে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল শর্মিলা। আর ঠিক তখনই অভীক বেরিয়ে এল ওদের বাড়ির ফটক খুলে। ঘুমিয়ে টুমিয়ে চোখ মুখ ফুলে গেছে অভীকের। মদ খেয়ে খেয়ে একেই তো চোখের তলায় পাউচ। শ্যাম গাত্রবর্ণে লালের প্রলেপ। বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছরের অভীককে দেখাচ্ছে একদম বিশ্বম্ভর ঘোষের মতো! একটা কারুকার্য খচিত পাঞ্জাবি গায়ে, সাদা চটি। গায়ত্রী বলছিল, সেভাবে ব্যাবসাট্যাবসা দেখেই না অভীক আজকাল। এই একটা ব্যাবসা করছে, দু’দিন না যেতেই সেটা তুলে দিচ্ছে। প্রোমোটারিটাই চলছে কোনওমতে।

অভীকের মুখোমুখি পড়ে গিয়ে শর্মিলা ভেবে পেল না কথা বলবে নাকি বলবে না।

অভীক তাকে ভুরু কুঁচকে দেখছে। যেন চিনতে টিনতে পারছে না। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল, “ভানু, তুই?”

“হ্যাঁ অভীকদা।”

“অনেক বদলে গিয়েছিস। আয়েষা বলছিল, তুই পাড়ায় আসিস আজকাল। খবরটবর সব ভাল তো?”

সত্যি কথা বলতে, অনেক বড়লোকের ছেলে হলেও অভীকদা খুব ডাউন টু আর্থ চিরদিনই। একটা সময় খুব রটেছিল তার আর অভীকদার মধ্যে প্রেম চলছে। অভীকদাকে সে পছন্দ করত। প্রেমে কদাচ পড়েনি। তার কারণটা সম্পূর্ণ অন্য। তার খুব ইচ্ছে ছিল, একজন উচ্চশিক্ষিত ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে তার। ব্যবসায়ী-ট্যাবসায়ী সে অত পাত্তা দিত না। ভাগ্যের ফের দেখো!

“খবর, ওই চলছে,” মৃদু হেসে বলল শর্মিলা।

“শোন, তোদের বাড়িতে একদিন যেতাম আমি। আয়েষা ডালিয়ার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। খুব অন্যায়, খুব অন্যায়।”

“খারাপ ব্যবহার? ডালিয়ার সঙ্গে? কেন?”

“পয়লা বৈশাখের দিন মেয়েটা না খেয়ে চলে গেছে। আমি যাব। আয়েষা কেমন যেন হয়ে গেছে। মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না। কাজের লোক, ড্রাইভার, পাড়া-প্রতিবেশী, সকলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। পাড়ায় আমার বেরোতে ভয় হয়। কে এসে বলবে আয়েষার এই দোষ হয়েছে।”

দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাইলেনের মুখে চলে এসেছে। অভীকদা একটু গলা নামিয়ে দিল, “এই রাধাদিরা, সলিলের বউ, আরও কয়েকজন আছে, যারা আয়েষাকে তোল্লাই দেয়। আয়েষা তাদের নিয়ে মাল্টিপ্লেক্সে যায়, রেস্তরাঁয় যায় আর তারা ‘আয়েষা আমাদের নয়নের মণি’ ভাব দেখায়! আয়েষা ভাবে, এরাই বোধহয় পুরো পৃথিবী! তুই জানিস, আমি আয়েষার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখি না?”

সে বলল, “থাক না অভীকদা। ঘরে ঘরে সব একই ব্যাপার। বাইরেটা সকলেই ঠিক রেখে চলে।”

“তোকে দেখে মনে হয় সুখী।”

“তা এক রকম।”

“এটা একটা উত্তর হল?”

“আমরা যে যার পথ বেছে নিয়েছি অভীকদা। তার দায় তো আমাদের উপরই বর্তায়।”

“তুই কি এখনও চাকরি করছিস?”

“হ্যাঁ।”

“কেন রে? মেয়েদের চাকরি করা আমি পছন্দ করি না। স্কুল টিচার, অধ্যাপিকা, এসব ঠিক আছে।”

“ওসব বললে চলবে? সংসারে মেয়েদের টাকার প্রয়োজন আছে।”

‘তাও ভাল যে, তুই বললি না মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতার প্রয়োজন।”

“ওটা বাসি কথা। সকলেরই প্রয়োজন।”

হঠাৎ সে বলল, “অভীকদা, জ্যোতিষ্মানদার ক্যান্সার হয়েছে। কেউ তো নেই মানুষটার, কী করে চিকিৎসা হবে?”

অভীকদা এদিকওদিক তাকাল, “শোন, মকাইদের বাড়িটা আমি কেনার চেষ্টায় আছি। যদি কিনতে পারি, একতলায় একটা বুক স্টোর করব। সঙ্গে কফি শপ, লাইব্রেরিটাও থাকবে।”

“পাড়ার ভিতরে কফি শপ? চলবে? তার উপর এই আদ্যিকালের পাড়ায়?”

“নর্থ ক্যালকাটাকে একটু বদলাতে হবে বুঝলি?”

“তোমার ঠাকুরমার নামে বাসস্ট্যান্ডটা তো খুব সুন্দর হয়েছে!”

“গমের গুদামের ওখানে আমিই তো পাবলিক টয়লেট করালাম।”

“তুমি কি এবার ইলেকশনে দাঁড়াবে অভীকদা?”

গলির মুখে ঝিম ধরা সূর্যালোক, বিকেল শেষ। অভীকদা বলল, “দাঁড়াতেই পারি।”

গায়ত্রীর কাছে চা-টা খেয়ে সে যখন পাড়ায় বেরোল, তখন কত লোকের সঙ্গে যে দেখা হল তার…সকলের সঙ্গে দু’ দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে বলে এগোতেই শর্মিলার এক ঘণ্টা লেগে গেল। শেষ পর্যন্ত লাইব্রেরির দরজার সামনে পৌঁছে সে ডাকল, “জ্যোতিষ্মানদা?”

কাঁচা-পাকা এক রাশ দাড়ি, ঝাঁকড়া চুলের মানুষটা একটা জাবদা কাগজের কাটিং আঠা দিয়ে আটকাচ্ছিল। শর্মিলা দেখল, সেই রংচটা শত পুরনো পাঞ্জাবি। এপাড়ায় কে যে কার জেঠা, কে যে মামা আর কে যে সাত বুড়োটে হয়েও দাদা, তার কোনও সম্পর্ক সূত্র নেই। জ্যোতিষ্মানদা তো বয়সে ছোটমামার চেয়েও বড়। বড়মামার বন্ধু। বড়মামা অবশ্য খুব অল্প বয়সে ম্যালেরিয়া হয়ে মারা গিয়েছিল। শর্মিলার বড়মামাকে মনেই পড়ে না।

এপাড়ায় মুখে মুখে অনেকের ইতিহাসই ঘোরে ফেরে। সবাই বলে জ্যোতিষ্মান নকশাল ছিল। আসলে তা নয়। এই অনাদি ঘোষাল স্ট্রিটটা জ্যোতিষ্মান ঘোষালের খোদ ঠাকুরদার বাবার নামে। ঘোষালরা বনেদি লোক। জ্যোতিষ্মান পড়াশোনা করেছিল দার্জিলিং-এর সেন্ট পলস স্কুলে। ছুটিছাটায় এলেও পাড়ার লোকজনদের সঙ্গে বেশি মিশত না। পারতও না মিশতে। জ্যোতিষ্মানের কাছে এপাড়ার লোকজন ছিল এলিয়েন! এ পাড়ার লোকদের কাছেও জ্যোতিষ্মান ছিল তাই। জ্যোতিষ্মানকে নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প ছিল পাড়ায়। ছেলেটা নাকি নিউ মার্কেট থেকে শুয়োর কিনে এনে খায়! গোরুও খেয়েছে। সন্ধেবেলা একটু ব্র্যান্ডি পান না করলে ছেলের ঘুম আসে না! চাকরবাকরদের সঙ্গেও ইংলিশে কথা বলে! কাঁটা-চামচ দিয়ে ভাত খায়। অনেক অ্যাংলো মেয়েদের সঙ্গে ওঠা বসা আছে। ফলে এপাড়ার ছেলে হয়েও জ্যোতিষ্মানকে কেউ কখনও নিজের বলে ভাবতে পারেনি। এসব রটনার অনেকটাই সত্যিও ছিল। ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও জ্যোতিষ্মান নিজের ঘরের দেয়ালে যিশুর পোর্সেলিনের মূর্তি টাঙিয়েছিল। সকাল-সন্ধে মোমবাতি হাতে ‘প্রে’ও করত! সেই জ্যোতিষ্মান কলকাতায় ফিরে ভর্তি হল প্রেসিডেন্সিতে।

জ্যোতিষ্মানের সঙ্গে কলকাতার সেই সময়ের বাস্তবতার কোনও যোগই ছিল না কোনও৷ সে তখন সন্ধেবেলা থিয়েটার রোডে আড্ডা দিতে যায়, পার্ক স্ট্রিটে মদ খায়। ব্রেকফাস্ট সারে হ্যাম দিয়ে। সিনে ক্লাবের মেম্বার। বাড়িতে গুচ্ছের বিদেশি গান শোনে, স্যাক্সোফোন বাজাতে চেষ্টা করে। তার তখন বছরখানেকের মধ্যেই বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা। সেই অবস্থায় একদিন মাঝরাতে পুলিশ এসে জ্যোতিষ্মান ঘোষালকে তুলে নিয়ে যায় স্রেফ নাম বিভ্রাটের কারণে!

অচিরেই পুলিশের ভুল ভাঙে। কিন্তু প্রোটোকলে আটকে জ্যোতিষ্মান ছাড়া পেতে পেতে চলে যায় বাইশটা মাস! বাইশ মাস পরে ছাড়া পেয়ে সে যখন এপাড়ায় ফেরে, তখন তার খোলনলচে বদলে গেছে। কেউ জানে না, এই বাইশ মাসের হিসেব। কিন্তু ধরেই নেওয়া যায়, ধরা পড়ার পর তাকে যথেষ্ট পুলিশি অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। কারণ, যে জ্যোতিষ্মান ঘোষালকে ধরতে চেয়েছিল পুলিশ সেই জ্যোতিষ্মান ঘোষাল লালবাজারের এক সিনিয়ার অফিসারকে সামনে থেকে গুলি করে মেরেছিল! ওই অফিসার তখন ভোরবেলা কুকুর নিয়ে মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়েছিলেন।

একটা আধপাগল ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে মহা মুশকিলে পড়েন জ্যোতিষ্মানের বাবা অর্ধেন্দু ঘোষাল। ছেলের মা নেই। শরিকি বাড়িতে রমণীর অভাব নেই, যুবতী বউরা, মেয়েরা। গ্যারাজটা খালি ছিল। সেখানে দেওয়াল তুলে দরজা বের করে দেওয়া হল। শিক বসানো একটা জানলা, জানলার লম্বালম্বি একটা খাট। জ্যোতিষ্মানের ঠাঁই হল সেই ঘরে। ভিতরের বাড়িতে আর কোনওদিন ফিরে যাওয়া হল না। একটু সুস্থ-স্বাভাবিক হওয়ার পর দেখা গেল জ্যোতিষ্মান দিনরাত বই পড়ে। ওটাই তার একমাত্র আশ্রয়। যেতে-আসতে সকলেই দেখে, জ্যোতিষ্মান শিক দেওয়া জানলার পাশে বসে বই পড়ে যাচ্ছে! এরও অনেক বছর পরে বাবার কাছে জ্যোতিষ্মান একটাই জিনিস চেয়েছিল, একটা লাইব্রেরি। গ্যারাজের পাশেই একটা বড়, লম্বা অংশ অব্যবহৃত পড়ে ছিল ঘোষাল বাড়িতে। অর্ধেন্দু ঘোষাল মৃত্যুর আগে এই লাইব্রেরিটা তৈরি করে দিয়ে গেলেন ছেলেকে। পরবর্তী সময়ে একটা গ্রান্টও পেয়ে গেল লাইব্রেরিটা, সরকারের কাছ থেকে। ত্রিশ বছর আগে বেশ রমরমাই ছিল ‘কল্লোলিনী পাঠাগার’-এর। তখন মানুষ বই পড়ত। একটু বেলার দিকে আসত পাড়ার মেয়ে-বউরা। বিকেলে ভিড় জমাত পাড়ার অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা। অফিসফেরত বাবুরা আসত খবরের কাগজ পড়তে। মেম্বারশিপ ফি ছিল তিন টাকা মাসে। জ্যোতিষ্মান একটা জীবন পেল। খুব একটা কথাবার্তায় যেত না, কিন্তু মানুষের উত্তাপের মধ্যে তো থাকত। এখন বছর সাত-আট হল সকালে লাইব্রেরি আর খোলা হয় না। বিকেলেও শুধু কিছু কিপটে বুড়োর দল জড়ো হয় খবরের কাগজ পড়তে। এ ছাড়া সারাদিন চারটে বইও ছাড়তে হয় না জ্যোতিষ্মানকে। গত দু’বছরে মাত্র সাতটা নতুন মেম্বারশিপ হয়েছে। চাঁদা বেড়ে বেড়ে হয়েছে মাসে সতেরো টাকা। অনেক সভ্যর চাঁদাই বছরের পর বছর বাকি রয়ে গেছে।

জ্যোতিষ্মানদা তাকাল মুখ তুলে। খুব কষ্ট করে একটা ঢোক গিলে বলতে গেল, “তুই? কত দিন পরে এলি ভানু!” কিন্তু কথাগুলো কেমন ফ্যাঁসফ্যাঁসে শোনাল শর্মিলার কানে।

“হ্যাঁ, জ্যোতিষ্মানদা, তোমার খবর নিতে এলাম।”

“আয় বোস,” সেই এক ফাঁসা গলা। একটা কাঠের চেয়ার দেখিয়ে দিল জ্যোতিষ্মান।

দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকল দু’জনের মুখের দিকে। সে ভাবল আজ এক ফাঁকে সে বলে যাবে, ‘জ্যোতিষ্মানদা, তুমিই কিন্তু আমার প্রথম প্রেম,’ শর্মিলার বোধহয় বাপের বয়সি লোকেদের প্রেমে পড়ার একটা বাতিক ছিল অল্প বয়স থেকে। খুব ছোটবেলায় বাবা মারা গেলেই কি এমনটা হয়? হাতের আঙুল দিয়ে জ্যোতিষ্মান একটা মুদ্রা করল, যার মানে অনেক কিছু হতে পারে। কিন্তু শর্মিলার মনে হল, ‘আর কী!’

সে বলল, “তুমি ভীষণ রোগা হয়ে গেছ জ্যোতিষ্মানদা। তোমাকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে।”

জ্যোতিষ্মানদা বলল, “খেতে পারি না। গলায় ব্যথা।”

এত গরমেও জ্যোতিষ্মানদার গলায় একটা মাফলার জড়ানো। সে বলল, “এটা দিয়ে রেখেছ কেন?”

“আরাম হয়।”

“খুব কষ্ট পাচ্ছ?”

জ্যোতিষ্মান মাথা নাড়ল, “নাঃ, বেড়ে আছি। দিন ফুরিয়ে এল। ভানু, আমার কথা বলতে কষ্ট হয়। আর প্রশ্ন করিস না। বরং তুই বল যা খুশি। আমি শুনি।”

হঠাৎ তার সেই দাদুর প্রশ্ন করার ভঙ্গিটা মনে পড়ে গেল। সে মনে মনে বলল, “তুমি হয়তো ভাবছ, আমি বিয়ে করে চলে গিয়েছিলাম আর আসতাম না। তা হলে হঠাৎ আবার এসেছি কেন? একটা টান রয়েই গেছে গো জ্যোতিষ্মানদা! মামাবাড়িতে মানুষ হয়েছিলাম, তখন বেশ অনটনের সংসার, বাড়িভর্তি ভাড়াটে, নিজস্ব একটু সময়ের বড় অকুলান ছিল। প্রাইভেসি ছিল না। বন্ধুদের আনতে পারতাম না। দাদুর ঘরে বসে পড়তাম, দাদুকে কথায় কথায় কফ ফেলার ডাবর এগিয়ে দিতে হত। মামিও তখন খুব কথা শোনাত। সব মিলিয়ে ভাল লাগত না। মনে হত, কীভাবে মুক্তি পাব। পড়াশোনা করতাম খুব। চাকরি করব বড়, ফ্ল্যাট কিনব, হাত-পা ছড়িয়ে থাকব, যা ইচ্ছে হয় খাব, নিজে নিয়ে খাব, তিন পিস-চার পিস মাছ খাব একসঙ্গে! বাথরুমে আয়না থাকবে। বিছানার পাশে বেডসাইড ল্যাম্প জ্বেলে থ্রিলার পড়ব, একা-একা গান শুনে কাঁদব, এইরকম কাঁচা ইচ্ছে ছিল! ঠিকই এগোচ্ছিল সব, কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল জ্যোতিষ্মানদা। বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়লাম। শুধু প্রেম হলে অসুবিধে ছিল না। বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে প্রেম করলে না অবধারিতভাবে ওই ইগো প্রবলেমটা চলে আসে, আমি না সে? পুরুষ কাকে বেছে নেবে? প্রেম কতটা নিখাদ? কতটা মরিয়া? মুখে বললে তো হবে না, প্রমাণ চাই, প্রমাণ ঘর ভাঙো। তবু বিশ্বাস করো, আমি ওকে ঘর ভাঙতে বলিনি। ওই-ই এগিয়ে গিয়ে করল সেটা। আসলে বড় বিজনেসম্যান তো, ও জানত, দু’দিকই রাখতে গেলে প্রথমে ভাঙতে হবে, তারপর আবার জোড়া লাগাতে হবে। ছ’বছর পর এই ছবিটা খুব পরিষ্কার। এখন আমার বেডরুমে বিছানার পাশে পোর্সেলিনের ল্যাম্পশেড, এখন ক্রমশ চুপ মেরে গেলে আদিত্য আমাকে সঙ্গ দিতে বালি দ্বীপে নিয়ে যায়, মায়ামি নিয়ে যায়। গতবার আমার জন্মদিন পালিত হল টোকিওতে। এখন আমাকে উজ্জীবিত করতে উইক এন্ডে আদিত্য আমার সঙ্গে রান্নাঘরে ঢোকে। চিজ় দেওয়া বেকড ইলিশ মাছ বানায়, আমি খেতে পারি না। তা ছাড়া এক টুকরোর বেশি আমার খাওয়ার অধিকার নেই। আমি যে কী পেয়েছি, আমি নিজেই ঠিক জানি না জ্যোতিষ্মানদা! আমার সুখও নেই, অসুখও নেই। আমার গুরুত্বও নেই, আমি নেগলেক্টেডও নই। আমার প্রয়োজনও নেই, অপ্রয়োজনীয়ও নই। আমার ফ্লাটটা কী সাজানো, কিন্তু সেখানে আমি বড় সন্তর্পণে থাকি! আদিত্যর নিয়মের বাইরে আমার একটা পা-ও পাতার উপায় নেই! কী হল আমার সেই মুক্তির জ্যোতিষ্মানদা? একটু একটু করে আদিত্য ওর পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছে। এখন হয়তো কিছুটা ঢাকা চাপা আছে, এর পর আর তাও থাকবে না। আমাদের আঠাশ তলার আস্তানাটা কী বলো তো? ভুঁইফোড়! সল্টলেকের বাড়িতে কখনও যাইনি৷ সেখানে সকালে আদিত্যর বাবা-মা বারান্দায় বসে চা খায়, সেখানে আদিত্যর পরিবারের সবাই আসছে-যাচ্ছে। চার মামা, চার মামি, ছেলেপুলে, মাসি, মাসতুতো বোনেরা, পিসিরা, পিসতুতো দুই ভাই, তাদের বউরা, পরমা, ওর প্রাক্তন স্ত্রী-র বাপের বাড়ির লোকজন, ছেলের বন্ধুবান্ধব। সব সময় হইহই ব্যাপার! এক ব্যাটেলিয়ন ফোর্স। আর এদিকে আমি একা, কত রকমের বন্ধন, কত রকমের পরিচয়ের বোধ, কত রকমের আশ্রয়, এই সবকিছুর বিরুদ্ধে কতদিন লড়তে পারব? হেরে যাবই। একটা মেয়ের মন আর শরীরে এত রকমের আনন্দ সম্ভার থাকে না! আজকাল আমার বড্ড একা লাগে জ্যোতিষ্মানদা! চরম একা! এই পাড়ায় সেই একাকিত্ব নেই। এখানে বোধহয় কেউই চাইলেও একা হতে পারবে না। এই উত্তাপটা আমার আজ খুব দরকার। হতে পারে, হ্যাঁ হতেই পারে আদিত্যর সঙ্গে, শুধু ওর সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে। যতই সমৃদ্ধির হোক, ওর দেওয়া জীবনটার মধ্যে আমি আর কোনও নতুনত্ব পাই না। এটা তো ঠিক…’ হঠাৎই সংবিৎ ফিরে পেয়ে শর্মিলা দেখল আয়েষাদি দাঁড়িয়ে আছে লাইব্রেরির দরজার সামনে। উফ, ভাগ্যিস কথাগুলো সে সত্যি সত্যি জ্যোতিষ্মানদাকে বলেনি!

তার দিকে একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টি হানল আয়েষাদি, তারপর জ্যোতিষ্মানদাকে বলল, “এই যে জ্যোতিষ্মানদা, তোমার তো গরম কিছু খাওয়া বারণ। তুমি নাকি আজ আবার গঙ্গাধরের ছেলের কাছে চায়ের বায়না করেছ?” |

আধা ইশারায় জ্যোতিষ্মানদা বলল, “চা ছাড়া সম্ভব নয়।”

“যা ডাক্তার বলবে, তাই তো করতে হবে? শনিবার আবার ডাক্তার দেখবে। তখন নিজেই জিজ্ঞেস করে নিয়ো। চা খাবে, সিগারেট খাবে, মামদোবাজি? আমি তা হলে এত চেষ্টা করছি কেন? চা, সিগারেট এ পাড়ায় তোমায় কেউ দেবে না, আয়েষা ঘোষ থাকতে।”

“চলবে না, চলবে না।”

“মরে যাবে তুমি,” চিৎকার করল আয়েষা, “অভীক এই লাইব্রেরিটা বাঁচানোর চেষ্টা করছে, নতুন করে সব সেজে উঠবে, বুক স্টোর হবে, তোমার দেখার ইচ্ছে নেই?”

“হবে না, হবে না! চাউমিনের দোকান হবে। বুক স্টোর হবে না ছাই। আমাকে বোকা পেয়েছে! আমার সইটার জন্য বোকা বোঝাচ্ছে আমাকে!” জ্যোতিষ্মানদা হাঁফাতে লাগল।

আয়েষাদি কোমরে হাত দিয়ে বলল, “আমি তোমাকে কিচ্ছু বোঝাতে আসিনি। বুঝেছ? আমার এখানে কোনও লেনাদেনা নেই। এ পাড়ার কারও সঙ্গে আমার কোনও স্বার্থ নেই। কাউকে আমি পুঁছি না। যেটা ঠিক মনে হয়, করি। যা বুঝি, তখনই বলি। বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে একটা লোক তাই আসি…”

হঠাৎ জ্যোতিষ্মানদা খবরের কাগজ দিয়ে নিজের মুখটা আয়েষার কাছ থেকে আড়াল করে নিল।

আয়েষাদি বলল, “বাঃ, বাঃ, বেশ, বেশ!”

জ্যোতিষ্মানদা বলল, “বিনয় বিনয়! বিনয় বলে কিছু আছে তোর আয়েষা?”

“আমি কারও খাই-পরি না যে, বিনীত হতে হবে!”

“ওইটুকুই তো সার শিখেছ।”

শর্মিলা তো এসব শুনে হতভম্ব! আয়েষাদি একটু চুপ করে থেকে এবার সরাসরি তাকে বলল, “নিজের দুঃখের সাতকাহন না গেয়ে পাগলকে একটু বোঝা, গরম চা কোনওমতে খাওয়া চলবে না।”

আয়েষাদি চলে যাওয়ার পর শর্মিলা বলল, “তোমার ভালর জন্যই বলছে কিন্তু।”

জ্যোতিষ্মানদার চোখ দুটো হঠাৎ কেমন ঘোরালো হয়ে উঠল, “আমি এদের কাউকে বিশ্বাস করি না। কোনও মানুষকে আমি বিশ্বাস করি না।”

শর্মিলা উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে।

জ্যোতিষ্মান বলল, “উঠছিস, আমাকেও একবার বেরোতে হবে।”

“কোথায় যাবে? আমি যাব সঙ্গে?”

“সঞ্জয় নিয়োগীর বাড়ি থেকে দুটো বই আনতে যাব। এক মাস হল নিয়েছে। ফেরত দেয়নি, দশ টাকা ফাইন হয়ে গেছে!” ঘড়ঘড়ি উঠছে জ্যোতিষ্মানদার কথার সঙ্গে।

সে বেরিয়ে এল বাইরে, জ্যোতিষ্মান সমস্ত আলো নেভাল লাইব্রেরির, দরজার হুড়কো টেনে তালা দিল। শর্মিলা দেখল, কী ভীষণ হাত কাঁপছে লোকটার। গায়ত্রীকে একেবারে বলেই বেরিয়েছিল শর্মিলা। তাই আর ফিরল না মামার বাড়িতে। তিন মাথার মোড়ের দিকে হাঁটতে লাগল সে। হঠাৎ তাকে কেউ একটা ডাকল পাশ থেকে, “অ্যাই ভানু, ভানু?”

বাঁ দিকে তাকাতে সে দেখল, অনু-রুণু দুই বোন বসে রয়েছে বাড়ির রকে। অনু-রুণু দুই বোনের মধ্যে অনু বছরখানেকের বড়। দু’জনেই তার বন্ধু এককালের, একই স্কুলে পড়ত তারা। যদিও দুই বোনই মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা করেনি।

সে দাঁড়াল, এগিয়ে গেল ওদের দিকে। অনু-রুণু দু’জনেই খুব হাসল তাকে দেখে, “বাবাঃ, চলে যাচ্ছে। দেখেই না তাকিয়ে, বাবা!”

সে বলল, “না, না, চিনব না কেন? কেমন আছিস তোরা?”

“যেমন দেখছিস!” দুজনেই বলল, “তোর কথা বলছিল অরুণদা। বলছিল ভানুকে একদিন দুপুরবেলা আসতে দেখলাম।”

এই অরুণদা অনু-রুণুর দু’জনেরই প্রেমিক! দু’জনেই অরুণদাকে ভালবাসে। দু’জনেই কেউ বিয়ে করেনি। গায়ত্রী বলছিল, এখনও ওরা তিনজনে সিনেমায় যায় একসঙ্গে। দু’জনের হাতেই রুপোর বালা, গলায় রুপোর হার, দু’জনের কানেই দুটো সোনার রিং। দু’জনেই কালো টিপ পরে। সে দেখল অনু-রুণুর মধ্যে অনুর চুল পেকেছে।

অনু বলল, “তা তোর বরকে একদিন আন। দেখি!”

“তোর বরকে দ্যাখা ভানু। আরে, নিয়ে নেব না। শুধু দেখব!” বলল রুণু।

আশ্চর্য! দুই বোনেরই এতটা সায়া বেরিয়ে আছে শাড়ির নীচ থেকে। ছেঁড়া সায়া। অনু-রুণুদের অবস্থা খুব খারাপ। অরুণদার সঙ্গে প্রেমটাই বোধহয় ওদের জীবনের একমাত্র ভাল জিনিস। দু’জনেই তাই সেটাকে পরস্পরের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে।

রুণু শাড়ি তুলে পায়ের গোছ চুলকাল, “তুই এখন আসবি মাঝে মাঝে?”

“ভাল তো! আসবি মাঝে মাঝে,” অনু বলল, “তুই তো অনেক ফরেন টুর করিস, আমার জন্য একটা ফ্রিল দেওয়া ছাতা আনিস তো পারলে?”

“ধুর, ছাতা দিয়ে কী হবে? একটা ভাল সেন্ট এনে দিবি?” রুণু বলল।

হরিন্দর তাকে দেখতে পেয়েছিল। গাড়ি নিয়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল পাশে, সে অনু-রুণুকে বলল, “চলি রে, একটু দেরি হয়ে গেছে।”

গাড়িতে বসে সে ভাবল অনু-রুণু দুই বোন জীবনে কী পেয়েছে? তারই তো বয়সি। চাওয়াপাওয়ার কোনও সার্থকতা থাকা সত্ত্বেও দু’জনের তা নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই। সারাক্ষণ হাসছে। এই তো অনু-রুণু একটা কাঁসার সানকিতে মুড়ি-চপ খাচ্ছিল। একবার কলেজ থেকে বন্ধুদের সঙ্গে একটা রেস্তরাঁয় খেতে গিয়ে শর্মিলা দেখেছিল, অরুণদা আর অনু-রুণুও সেখানে গেছে। অনেকের ভিড়ে ওরা তাকে লক্ষ করেনি। সে দেখেছিল, অরুণদা এক প্লেট পরোটা আর কষা মাংস খাচ্ছিল। আর এক প্লেট চাউমিন থেকেই অনু-রুণু দুটো চামচে করে খাবার তুলে নিচ্ছিল মুখে। এত বছরে ওরা একই রয়ে গেল, বদলাল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *